আক্বিদা

ইবনে উমর রা: এর শানে ইবনে তাইমিয়ার বেয়াদবি ও শিরকের অপবাদ (১ম পর্ব)

ইজহারুল ইসলাম শনি, 23 নভে., 2024

ইবনে উমর রা: এর উপর ইবনে তাইমিয়ার শিরকের অপবাদ

 

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা: ছিলেন শীর্ষস্থানীয় ফকীহ সাহাবী। সাহাবীগণের মধ্যে ফিকহ, ফতোয়া ইত্যাদির ক্ষেত্রে চারজন সাহাবী ছিলেন আব্দুল্লাহ নামে প্রসিদ্ধ। তাদের অন্যতম ছিলেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা:। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা: বিভিন্ন ক্ষেত্রে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিস থেকে বরকত হাসিলের চেষ্টা করতেন। বিশেষ করে, নবীজী যেসব জায়গায় নামাজ আদায় করেছেন, সেসব জায়গা খুঁজে খুঁজে তিনি নামাজ আদায় করতেন। 

এ বিষয়ে মুয়াত্তায়ে মালিকে ইমাম মালিক রহ: বর্ণনা এনেছেন,

عن عبد الله بن عبد الله بن جابر بن عتيك، أنه قال: جاءنا عبد الله بن عمر في بني معاوية -وهي قرية من قرى الأنصار- فقال: هل تدرون أين صلى رسول الله صلى الله عليه [وآله] وسلم من مسجدكم هذا؟، فقلت له: نعم؛ وأشرت إلى ناحية منه، فقال لي: هل تدري ما الثلاث التي دعا بهن فيه؟، فقلت له: نعم، قال: فأخبرني بهن، قال: فقلت: دعا بأن لا يظهر عليهم عدوا من غيرهم، ولا يهلكهم بالسنين فأعطيهما، ودعا بأن لا يجعل بأسهم بينهم فمنعها، قال: صدقت. قال ابن عمر: فلن يزال الهرج إلى يوم القيامة

অর্থাৎ হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল্লাহ বিন জাবের বিন আতিক থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, বনু মুয়ায়িয়া গোত্রে হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমর রা: আমাদের কাছে একবার আসলেন। এই গোত্রটি মূলত: আনসার সাহাবীদের একটি গ্রাম ছিলো। ইবনে উমর রা: এসে বললেন, তোমরা কি জানো, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের এই মসজিদের কোথায় নামাজ আদায় করেছেন? আমি তাকে বললাম, হ্যাঁ। এরপর মসজিদের একটি কোনার দিকে ইঙ্গিত করলাম। 

[মুওয়াত্তায়ে মালিক, হা: ৫৭৫]


সহীহ বোখারীতেও এ সংক্রান্ত বর্ণনা রয়েছে। 

 

এ হাদীসের ব্যাখ্যায় ইবনে আব্দিল বার (মৃত: ৪৬৩ হি:)  রহ: বলেন,

فيه ما كان عليه ابن عمر من التبرك بحركات رسول الله صلى الله عليه [وآله] وسلم اقتداء به وتأسيا بحركاته؛ ألا ترى أنه إنما سألهم عن الموضع الذي صلى فيه رسول الله صلى الله عليه [وآله] وسلم من مسجدهم ليصلي فيه تبركا بذلك ورجاء الخير فيه

অর্থাৎ উপর্যুক্ত হাদীস থেকে এটিও প্রমাণিত হয় যে, হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমর রা: নবীজীর বিভিন্ন কাজ ও আমল থেকে বরকত হাসিল করতে চাইতেন। বিশেষ করে অধিক অনুসরণ - অনুকরণ, স্মরণ ইত্যাদির মাধ্যমে। তুমি কি দেখো না যে, তিনি উপরের হাদীসে নবীজী তাদের মসজিদের কোথায় নামাজ পড়েছেন, সেখানে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে বরকত ও কল্যাণের আশা করে  এটি জিজ্ঞেস করেছেন?

 

[আত-তামহীদ, খ: ১৯, পৃ: ১৯৭ ]
 

 

মালেকী মাজহাবের আরেক ইমাম ইবনুল আরাবী আল-মালেকী (মৃত: ৫৪৩ হি:)  রহ: বলেন,

 

في هذا الحديث أن رسول الله صلى الله عليه [وآله] وسلم كان يأتي قرى الأنصار ويصلي في مساجدها ودورها، ليتبرك بالصلاة فيها بعده

 

অর্থাৎ এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসার সাহাবীদের মসজিদ ও ঘরে এসে নামাজ আদায় করতেন যেন পরবর্তীতে তারা এটিকে বরকত হাসিলের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করতে পারে।[আল-মাসালিক ফি শরহি মুয়াত্তায়ে মালিক, খ:৩, পৃ:৪৭৯ ]

 


 

ইমাম জুরকানী (মৃত: ১১২২ হি:) উপরের হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন,

 

هل تدرون أين صلى رسول الله، صلى الله عليه [وآله] وسلم من مسجدكم هذا؟”: لأصلي فيه وأتبرك به لأنه كان حريصا على اقتفاء آثاره

অর্থাৎ ইবনে উমর রা: তাদেরকে জিজ্ঞেস করেছেন যে, তোমরা কি জানো নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের এই মজসিদের কোথায় নামাজ আদায় করেছেন? (এর দ্বারা তিনি মূলত: বলতে চেয়েছেন)  কারণ, আমি সেখানে নামাজ আদায় করতে চাই এবং এর মাধ্যমে বরকত হাসিল করতে চাই। কেননা, ইবনে উমর রা: নবীজীর রেখে যাওয়া বস্তু ও আমল থেকে বরকত হাসিলের ব্যাপারে উন্মুখ ছিলেন। 

 


 

ইবনে উমর রাজি: এর উপরের আমলকে ইবনে তাইমিয়া তার কিতাবে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন। সেই সাথে মারাত্মক কিছু অপবাদ ও অভিযোগ জুড়ে দিয়েছেন এর উপর। ইবনে তাইমিয়া তার ইকতিজাউস সিরাতিল মুস্তাকিম কিতাবের ২ খন্ডে এ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন,

 

“নবীজী সাল্লাল্লাহু ঘটনাক্রমে যেসব জায়গায় নামাজ আদায় করেছেন, সেখানে নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্য করাটা ইবনে উমর ছাড়া অন্য কোন সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়নি। বরং হযরত আবু বকর, উমর, উসমান ও আলী, সমস্ত আনসার ও মুহাজির সাহাবায়ে কেরাম মক্কা থেকে হজ্ব, উমরা বা সফরের জন্য মদিনায় যেতেন, তাদের কারও থেকে এটি বর্ণিত হয়নি যে, তারা নবীজীর নামাজের জায়গাগুলো খুঁজে খুঁজে নামজ আদায় করেছেন। আর এটা জানা কথা যে, এটি তাদের কাছে যদি মুস্তাহাব হতো, তাহলে তারা এবিষয়ে অগ্রগামী থাকতেন। কারণ, তারা নবীজীর সুন্নত সম্পর্কে বেশি জানতেন এবং অন্যদের চেয়ে তা অনুসরণে অগ্রগামী ছিলেন। আর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের উপর আমার সুন্নত ও আমার পরবর্তী খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত অনুসরণ করা কর্তব্য। তোমরা এগুলো শক্তভাবে আঁকড়ে ধরো। মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে রাখো। সাবধান, নবসৃষ্ট বিষয় থেকে বেঁচে থাকবে। কারণ, প্রত্যেক নব-সৃষ্ট বিষয়ই বিদয়াত। আর প্রত্যেক বিদয়াতই ভ্রষ্টতা। 

 

সুতরাং এভাবে নবীজীর নামাজের জায়গা খুঁজে খুঁজে সেখানে নামাজ আদায় করা খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত নয়।  বরং এটি নতুন সৃষ্ট বিদয়াত। আর সাহাবীর বক্তব্য যখন অন্যদের বিপরীত হয়, তখন সেটি দলিল থাকে না। তাহলে সমস্ত সাহাবী থেকে বিচ্ছিন্ন এই আমল কীভাবে দলিল হতে পারে? 

 

তাছাড়া এভাবে নবীজীর নামাজের জায়গা খুঁজে খুঁজে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে এটিকে মজসিদ হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং ইয়াহুদী-খ্রিষ্টানদের সাথে সাদৃশ্য হয়ে যায়। অথচ শরীয়াতে এজাতীয় বিষয়ে ইয়াহুদী-খ্রিষ্টানদের সাথে সাদৃশ্য থেকে নিষেধ করা হয়েছে। আর এটি আল্লাহর সাথে শিরকের মাধ্যমও।……” 

 

 

ইবনে তাইমিয়ার উপরের বক্তব্য থেকে যেসব বিষয় সামনে আসছে,

 

১। ইবনে উমর রা: সেসব জায়গা খুঁজে খুঁজে নামাজ আদায় করতেন যেখানে নবীজী নামাজ আদায় করেছেন। 

২। ইবনে উমর রা: ছাড়া অন্য কারও থেকে এসব জায়গায় নামাজ আদায়ের কথা বর্ণিত হয়নি। 

৩। ইবনে উমর রা: এর এই আমলটি ভ্রষ্টতাপূর্ণ বিদয়াত। আহলে কিতাবদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, বরং এটি শিরকের মাধ্যম। 

 

ইবনে তাইমিয়ার উপরের বক্তব্যের পাশাপাশি আরেকটি বিষয় খুব স্পষ্ট। সেটি হলো, ইবনে তাইমিয়া যে মতটি গ্রহণ করেছে সেটিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মত এমনকি খোলাফায়ে - রাশেদীন, প্রথম সারির আনসার - মুহাজিরীন সকলের মত হিসেবে উপস্থাপন করা। এর বিপরীত মত অর্থাৎ হযরত ইবনে উমর রা: এর মতকে বিচ্ছিন্ন মত, অন্য সাহাবীদের বিপরীতে একক মত, বিদয়াত, শিরকের মাধ্যম ইত্যাদি আখ্যা দেয়া। এটি আসলে ইবনে তাইমিযার খুবই পুরাতন সমস্যা। এই সমস্যা বহু উলামায়ে কেরাম হাতে-নাতে দেখিয়েছেন। নিজের মতের পক্ষে তিনি সর্ব-সম্মত মত, ঐকমত্য, ইজমা ইত্যাদির মিথ্যা দাবী করে সাধারণ মানুষের সাথে ধোঁকাবাজী ও প্রতারণা করে থাকেন। যদিও বিষয়গুলো খুব স্পষ্ট বিষয় হোক। কিন্তু খুব সাধারণ ও স্পষ্ট বিষয়েও নিজের মতের পক্ষে ইবনে তাইমিয়া ইজমা বা সর্ব-সম্মত মতের দাবী করে মিথ্যাচার ও প্রতারণা করে থাকেন। এটি বলা যায়, তার একটি অভ্যাসগত বিষয়। তিনি যতো বিষয়ে এভাবে ইজমার দাবী করেছেন ভালোভাবে অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে এর অধিকাংশই মিথ্যা। আল-ইয়াজু বিল্লাহ। 

 

নিজের মতের পক্ষে ইজমা বা ঐকমত্যের দাবী করে ইবনে তাইমিয়ার  এধরণের মিথ্যাচার ও প্রতারণা বহু উলামায়ে কেরামের কাছে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট বিষয়। উদাহরণ হিসেবে আমি এখানে ইমাম ত্বকিউদ্দীন হুসোনী (752-829 হি:) রহ: এর কিছু আলোচনা উল্লেখ করছি। ত্বকিউদ্দীন হুসোনী রহ: তার দাফউ শুবাহি মান শাব্বাহা ও তামাররাদা কিতাবে ইবনে তাইমিয়ার এধরণের অনেকগুলো মিথ্যাচার ও প্রতারণার উদাহরণ এনে উম্মতকে তার ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। এ কিতাবের ৯৪ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন,

 

“ইবনে তাইমিয়ার একটি পাপকাজ হলো, সে যা বলে এবং যার পক্ষে ফতোয়া দেয়, এর উপর ইজমার দাবী করে থাকে। যেমন মক্কা উত্তম নাকি মদীনা এই বিষয়ে সে তার নিজের মতের পক্ষে ইজমার দাবী করেছে। অথচ বিষয়টি নিয়ে ওলামাদের মতবিরোধ খুবই প্রসিদ্ধ। এমনকি মানুষের কাছে সহজলভ্য কিতাব কাজী ইয়াদের শিফাতেও এই মতবিরোধ নিয়ে আলোচনা রয়েছে। সেখানে তিনি বলেছেন, ইমাম মালিক রহ: ও অধিকাংশ মদিনাবাসীর মত হলো, মদিনা মক্কা থেকে উত্তম। মক্কাবাসী ও কুফাবাসীর মত হলো, মক্কা উত্তম।”

 

[দাফউ শুবাহি মান শাব্বাহা ও তামাররাদা, পৃ: ৯৪]







 



 

একই কিতাবের ১৪৭ পৃষ্ঠায় ত্বকিউদ্দীন হুসোনী রহ: লিখেছেন, 

 

“উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে, ইবনে তাইমিয়া ইজমার দাবী করার ক্ষেত্রে মিথ্যাচার করে থাকে। যে তার এজাতীয় দাবীর অনুসন্ধান করবে সে তার এই মিথ্যাচার দেখতে পাবে। অনেক ক্ষেত্রে এমন কিছু সে অন্যের থেকে বর্ণনা করে যা নিরেট মিথ্যা। অন্যের কথা নকল করলেও সঠিকভাবে করে না। আর সঠিকভাবে বর্ণনা করলেও এমন কথা ঢুকিয়ে দেয় যা ঐ ব্যক্তির বক্তব্য নয়। বিষয়টি ভালোভাবে জেনে রেখো এবং তার তাকলীদ করার বিষয়ে সতর্ক থেকো। কারণ, এরকম তাকলীদ করলে সে যেমন ধ্বংস হয়েছে, তুমিও হবে।”

 

[দাফউ শুবাহি মান শাব্বাহা ও তামাররাদা, পৃ: ১৪৭ ]







 


 

একই কিতাবের ১৫১ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন,

“ ঐকমত্য ও ইজমার দাবীর ক্ষেত্রে ইবনে তাইমিয়ার চেয়ে বড় মিথ্যুক ও এধরণের পাপকাজে অধিক দু:সাহসী আর কাউকে দেখিনি” 

[দাফউ শুবাহি মান শাব্বাহা ও তামাররাদা, পৃ: ১৫১ ]


 


 

একই ধরণের কথা তিনি ১৫৫ ও ১৫৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন। 

এখানে ইবনে তাইমিয়ার ব্যাপারে ত্বকিউদ্দীন হুসোনী রহ: এর বক্তব্য বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা আসলে এর চেয়ে ভয়াবহ। আসলে ইবনে তাইমিয়ার এজাতীয় মিথ্যার বেসাতির কোন কুল-কিনারা নেই। এ বিষয়ে আব্দুল্লাহ বিন সিদ্দিক আল-গুমারীর ‘আর-রদ্দুল মুহকামুল মাতীন’ দেখা যেতে পারে। যেখানে তিনি জায়গায় জায়গা ইবনে তাইমিয়ার এজাতীয় মিথ্যাচার ও প্রতারণা স্পষ্ট করেছেন। ইজ্জুদ্দিন বিন আব্দুস সালামের একটি বক্তব্যকে ইবনে তাইমিয়া বিকৃতভাবে উপস্থাপন করলে এ কিতাবের ৫৩ পৃষ্ঠায় তিনি এর প্রতিবাদ করে লিখেছেন, 

“আমার মত হলো, ইবনে তাইমিয়ার এই ভুলটি অনিচ্ছাকৃত নয়। বরং এটি তার ইচ্ছাকৃত বিকৃতি”

[আর-রদ্দুল মুহকামুল মাতিন, পৃ: ৫৩]

 

এখানে ইবনে তাইমিয়ার ব্যাপারে ত্বকিউদ্দীন হুসোনী রহ: এর বক্তব্য বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা আসলে এর চেয়ে ভয়াবহ। আসলে ইবনে তাইমিয়ার এজাতীয় মিথ্যার বেসাতির কোন কুল-কিনারা নেই। এ বিষয়ে আব্দুল্লাহ বিন সিদ্দিক আল-গুমারীর ‘আর-রদ্দুল মুহকামুল মাতীন’ দেখা যেতে পারে। যেখানে তিনি জায়গায় জায়গা ইবনে তাইমিয়ার এজাতীয় মিথ্যাচার ও প্রতারণা স্পষ্ট করেছেন। ইজ্জুদ্দিন বিন আব্দুস সালামের একটি বক্তব্যকে ইবনে তাইমিয়া বিকৃতভাবে উপস্থাপন করলে এ কিতাবের ৫৩ পৃষ্ঠায় তিনি এর প্রতিবাদ করে লিখেছেন, 

“আমার মত হলো, ইবনে তাইমিয়ার এই ভুলটি অনিচ্ছাকৃত নয়। বরং এটি তার ইচ্ছাকৃত বিকৃতি”

[আর-রদ্দুল মুহকামুল মাতিন, পৃ: ৫৩]










 



 

একই কিতাবের ২১৯ পৃষ্ঠায় আব্দুল্লাহ বিন সিদ্দিক আল-গুমারী রহ: বলেন,

 

“পূর্বের আলোচনায় ইজ্জুদ্দিন ইবনে আব্দিস সালামের বক্তব্যকে ইবনে তাইমিয়া যে ভুল করেছেন সেটি উল্লেখ করেছি। এটি সম্ভবত: তার ইচ্ছাকৃত ভুল। আমার কাছে এটি স্পষ্ট হয়েছে যে, উলামাদের বক্তব্য বর্ণনা করার ক্ষেত্রে ইবনে তাইমিয়া বিশ্বস্ত বা নিরাপদ নন”। 

 

[আর-রদ্দুল মুহকামুল মাতিন, পৃ: ২১৯ ]













 


 

ইবনে তাইমিয়ার ব্যাপারে একই কথা বলেছেন, বিখ্যাত ইমাম ত্বকিউদ্দীন সুবকী রহ:। তিনি তার ফতোয়ায় লিখেছেন,

 

وَهَذَا الرَّجُلُ [=ابن تيميّة] كُنْت رَدَدْتُ عَلَيْهِ فِي حَيَاتِهِ فِي إنْكَارِهِ السَّفَرَ لِزِيَارَةِ الْمُصْطَفَى صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ [وَآلِهِ] وَسَلَّمَ، وَفِي إنْكَارِهِ وُقُوعَ الطَّلَاقِ إذَا حُلِفَ بِهِ، ثُمَّ ظَهَرَ لِي مِنْ حَالِهِ مَا يَقْتَضِي أَنَّهُ لَيْسَ مِمَّنْ يُعْتَمَدُ عَلَيْهِ فِي نَقْلٍ يَنْفَرِدُ بِهِ لِمُسَارَعَتِهِ إلَى النَّقْلِ لِفَهْمِهِ...وَلَا فِي بَحْثٍ يُنْشِئُهُ لِخَلْطِهِ الْمَقْصُودَ بِغَيْرِهِ وَخُرُوجِهِ عَنْ الْحَدِّ جِدًّا

অর্থাৎ এই ব্যক্তিকে (ইবনে তাইমিয়া) তার জীবদ্দশায় নবীজীর কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা হারাম বিষয়ক বক্তব্য ও তালাকের ব্যাপারে কসম খেলে সেটি সংগঠিত হওয়ার বিষয়ে তার খন্ডন করেছি। এরপর তার বিষয়ে আমার কাছে এটি স্পষ্ট হয়েছে যে, সে কোন বিষয় এককভাবে বর্ণনা করলে এর উপর নির্ভর করা যায় না। কারণ, অনেক কিছু সে নিজের বুঝ অনুযায়ী বর্ণনা করে। এছাড়া তার নিজের শুরু করা কোন মাসআলার উপরও নির্ভর করা যায় না। কারণ সে আলোচনার বিষয়বস্তু পাল্টে ফেলে এবং মূল বিষয়ের সীমা থেকে বহু দূরে চলে যায়। 

[ফতোয়াস সুবকী, খ: ২, পৃ: ২১০]



 

 





 

শায়খ সালামাহ কুদায়ী ইজামী রহ: বিখ্যাত আলিম ছিলেন। আল্লামা জাহেদ কাউসারী রহ: তার বিভিন্ন কিতাবের উপর প্রশংসাবাণী দিয়েছেন। তিনিও তার কিতাবে ইবনে তাইমিয়ার এজাতীয় নানা মিথ্যাচারের স্বরুপ স্পষ্ট করেছেন। তিনি তার ‘বারাহিনুল কিতাবি ওয়াস সুন্নাহ’ কিতাবে লিখেছেন, 

“এই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নানা রকম চিন্তাগত বিচ্যূতি আছে যেগুলোতে তারা সমস্ত উম্মতের বিরোধিতা করে এবং সবাইকে পরিত্যাগ করে থাকে। মানুষকে তাদের দ্বীন থেকে বিচ্যূত করতে এরা ধোঁকাবাজী ও প্রতারণায় উস্তায। সত্য ও সঠিক বিষয় জানার আগে কেউ যদি তাদের কিতাব পড়ার বিপদে নিপতিত হয়, সে তাদের কাছ থেকে চূড়ান্ত মূর্খতা ( জাহেলে মুরাক্কাব) শিখবে। কোন কোন আলিম তো বলেছেন, সাজান - গোছান মূর্খতা শিখবে। (অর্থাৎ মূর্খতাকে তারা সাজিয়ে-গুছিয়ে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করে থাকে)। কারণ তাদের কারণে সে বাতিল জিনিসকে হক্ব মনে করা শুরু করবে। আর তাদের বিপরীত যারা আছে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ উলামা হলেও তাদেরকে বাতিল মনে করা শুরু করবে। সে বিশ্বাস করা শুরু করবে, প্রকৃত সুন্নতের উপর এবং কুরআন-সুন্নাহের একমাত্র সঠিক বুঝের উপর কেবল তাদের মতো বিচ্ছিন্নতাবাদীরাই রয়েছে। অথচ বিষয়টি এমন হওয়া আল্লাহর চিরাচরিত নিয়মের বিপরীত। কারণ, আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ওয়াদা করেছেন যে, তার উম্মত সকলে ভ্রষ্টতার উপর একমত হবে না। আর আল্লাহ তায়ালা তার প্রতিশ্রুতিতে সদা সত্য। তিনি এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন, প্রত্যেক যুগে নবীজী ও তার প্রকৃত অনুসারী উলামাদেরকে সাহায্য করেছেন। নবীজী ও তার অনুসারী উলামাদের উপর শতকোটি দুরুদ ও সালাম। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, “দ্বীনের এই ইলমকে প্রত্যেক পরবর্তী যুগের ন্যায়-পরায়ণ ব্যক্তিরা বহন করবে। সীমালঙ্ঘনকারীদের বিকৃতি, বাতিল মতাদর্শীদের চিন্তা-চেতনা, অজ্ঞ-মূর্খদের অপব্যাখ্যা থেকে তারা দ্বীনকে সংরক্ষণ করবে।”

 

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “আমি আপনার কাছে এই উপদেশমালা (দ্বীন ও কুরআন) অবতীর্ণ করেছি, আমিই এর সংরক্ষণ করব।” আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ এই দ্বীনের সংরক্ষণ হবে এর নীতিমালা ও বিধি-বিধান এতো অধিক সংখ্যক উলামাদের মাধ্যমে সংরক্ষিত হবে যে, যখনই কোন বিচ্ছিন্নতাবাদী বের হবে বা উলামাদের জামায়াত থেকে কেউ বের হয়ে যাবে, কুরআন-সুন্নাহের ইলমে অভিজ্ঞ উলামা ও ফকীহদের কাছে তার এই বিচ্ছিন্নতা ও দলছুট হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। এই বিচ্ছিন্নতাবাদী যতই নিজের এই বিচ্ছিন্ন চিন্তা-চেতনাকে সুন্নতের অনুসরণ ও কুরআন - হাদীস সংরক্ষণ ইত্যকার বড় বড় দাবীর মাধ্যমে ঢেকে রাখার চেষ্টা করুক। সে নিজেকে কিংবা তার ব্যাপারে অজ্ঞ কেউ তাকে যতই বড় বড় উপাধি দিক যেমন, নিজেকে সালাফী দাবী করা কিংবা সালাফের অনুসারী ইত্যাদি দাবী করা। এজন্য মুজতাহিদ উলামাদের ইজমা শরীয়াতের খুবই শক্তিশালী একটি দলিল। তাদের ইজমা থেকে বের হয়ে যাওয়া ভ্রষ্টতা ও বিদয়াতের নিদর্শন। এজন্য তুমি দেখবে, এই নতুন নতুন বিদয়াত তৈরিতে দক্ষ এই বিদয়াতী (ইবনে তাইমিয়া), তার নিজের তৈরি বিদয়াতের বিরুদ্ধে উম্মতের ইজমাকে খুব জোর গলায় অস্বীকার করতে চায়। বরং মিথ্যা ও জালিয়াতির মাধ্যমে  তার নিজের মতের পক্ষে ইজমা বা ঐকমত্যের দাবী করে। যেমনটি তুমি তিন তালাক ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের উপরের আলোচনা থেকে ইবনুল কাইয়্যিম ও তার উস্তাযের কাজ থেকে দেখেছো।”








 












 


 





 

শায়খ নিদাল বিন ইব্রাহীম আলু রাশশী ইবনে তাইমিয়ার এই মিথ্যাচার ও প্রতারণার উপর লম্বা আলোচনা করেছেন তার রফউল গাশিয়াহ কিতাবে। আলোচনার শুরুতে তিনি বলেন,

 

“ আমি আগে যেমনটি বলেছি, ইবনে তাইমিয়া ইজমা ইত্যাদি বর্ণনার ক্ষেত্রে মিথ্যাচার করে থাকে। যেই কথার কোন শরয়ী ভিত্তি নেই এমন কথাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ আহলে সুন্নত, অধিকাংশ সালাফ, অধিকাংশ মুহাদ্দিসীনদের নামে চালিয়ে দেয়। এটা শুধু আকিদার ক্ষেত্রে করে এমন নয়, বরং শাখাগত মাসআলা-মাসাইল ও ইমামদের বক্তব্যের ক্ষেত্রেও একই কাজ করে থাকে। একটি শাখাগত বিষয়ের উদাহরণ দেয়াই এখানে যথেষ্ট যার দ্বারা স্পষ্ট হবে যে, ইবনে তাইমিয়া কী পরিমাণ ভ্রষ্টতা, প্রবৃত্তিপূজা, নিজের মতকে বড় করে দেখান, নিজের আকিদার সমর্থনে মিথ্যা বলে হলেও সেটিকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে কোন পর্যায়ের ছিলো।”

 

 

 


 

নিজের মতের পক্ষে ইজমার দাবী, সর্ব-সম্মত মত ইত্যাদি বলার ক্ষেত্রে ইবনে তাইমিয়ার চিরাচরিত মিথ্যাচার নিয়ে অন্য কোথাও বিস্তারিত লিখব ইনশা আল্লাহ। উপরের আলোচনা থেকে এতটুকু স্পষ্ট করা উদ্দেশ্য যে, ইবনে উমর রা: এর উপর ইবনে তাইমিয়া সেই একই রকমের মিথ্যাচার করে তার অবস্থানকে অন্যান্য সাহাবীদের বিরোধী একক মত, বিদয়াত ও শিরকের মাধ্যম বানাতে চেয়েছে। এটি মূলত: ইবনে তাইমিয়ার পুরাতন টেকনিক। অধিকাংশ বিষয়ে তিনি এই ধরণের মিথ্যাচার করে থাকেন। এবার চলুন, ইবনে তাইমিয়ার এই ধোঁকাবাজীর স্বরুপ বিশ্লেষণ করা যাক আরেকটু বিস্তারিতভাবে। 

 

নবীজীর সাথে সম্পর্কিত বস্তু বা আমলের মাধ্যমে বরকত হাসিলের প্রচেষ্টা যেমন যেখানে যেখানে নবীজী নামাজ আদায় করেছেন সেখানে নামাজ আদায়ের চেষ্টাকে ইবনে তাইমিয়া উপরে বিদয়াত, আহলে কিতাবদের সাথে সাদৃশ্য, শিরকের মাধ্যম ইত্যাদি আখ্যা দিয়েছেন। অথচ পবিত্র কুরআনে সু্স্পষ্টভাবে মাকামে ইব্রাহীমে নামাজ আদায়ের আদেশ করা হয়েছে। যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, মাকামে ইব্রাহীম কী জিনিস? এর সহজ উত্তর হলো, যেই পাথরে দাঁড়িয়ে হযরত ইব্রাহীম আ: পবিত্র কা’বা নির্মাণ করেছিলেন সেটিই মাকামে ইব্রাহীম। ইব্রাহীম আ: এর এই স্মৃতির পাশে যদি নামাজ পড়ার বিধান সুস্পষ্টভাবে কুরআনে আসে এবং সেটি যদি শিরকের মাধ্যম না হয়, তাহলে নবীজীর নামাজের জায়গায় ইবনে উমর রা: এর আমল শিরকের মাধ্যম হবে কেন? যদি নবীগণের স্মৃতিবিজড়িত জায়গা থেকে বরকত হাসিল করা কিংবা সেটিকে উপলক্ষ্য বানিয়ে শরীয়াতের বৈধ আমলকে শিরকের মাধ্যম বলা হয়, তাহলে মাকামে ইব্রাহীমে নামাজ আদায় করা শিরকের মাধ্যম নয় কেন? ইবনে তাইমিয়ার কাছে কোন কিছুকে শিরক বা শিরকের মাধ্যম বলার মূলনীতিটা আসলে কী? নাকি ইয়াহুদী মুসা ইবনে মাইমুনের কাছ থেকে শিরক-তাওহীদের সবক নিয়ে সাহাবীদের আমলেও শিরক দেখা শুরু করেছিলেন? 

 

মজার ব্যাপার হলো, উপরে ইবনে উমর রা: এর আমলকে অন্য সাহাবীদের আমলের বিরোধী ও বিচ্ছিন্ন আমল সাব্যস্ত করার জন্য এমনভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে যেন খোলাফায়ে রাশেদীন থেকে শুরু করে সবাই এই আমলেের বিরোধী ছিলেন। অথচ বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আসুন বোখারী থেকে বিষয়টি বোঝা যাক। 

 

ইমাম বোখারী রহ: হযরত উমর রা: থেকে হাদীস উল্লেখ করেছেন যে, আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের কয়েকটি বিষয় হযরত উমর রা: এর ইচ্ছার অনুরুপ অবতীর্ণ করেছেন। এ বিষয়ে নিচের হাদীসটি লক্ষণীয়,

 

حَدَّثَنَا عَمْرُو بْنُ عَوْنٍ، قَالَ حَدَّثَنَا هُشَيْمٌ، عَنْ حُمَيْدٍ، عَنْ أَنَسٍ، قَالَ قَالَ عُمَرُ وَافَقْتُ رَبِّي فِي ثَلاَثٍ، فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ لَوِ اتَّخَذْنَا مِنْ مَقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى فَنَزَلَتْ ‏(‏وَاتَّخِذُوا مِنْ مَقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى‏)‏ وَآيَةُ الْحِجَابِ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ، لَوْ أَمَرْتَ نِسَاءَكَ أَنْ يَحْتَجِبْنَ، فَإِنَّهُ يُكَلِّمُهُنَّ الْبَرُّ وَالْفَاجِرُ‏.‏ فَنَزَلَتْ آيَةُ الْحِجَابِ، وَاجْتَمَعَ نِسَاءُ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم صلى الله عليه وسلم فِي الْغَيْرَةِ عَلَيْهِ فَقُلْتُ لَهُنَّ عَسَى رَبُّهُ إِنْ طَلَّقَكُنَّ أَنْ يُبَدِّلَهُ أَزْوَاجًا خَيْرًا مِنْكُنَّ‏.‏ فَنَزَلَتْ هَذِهِ الآيَةُ‏.‏

 

আনাস ইবনু মালিক (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘উমার (রাযি.) বলেছেনঃ তিনটি বিষয়ে আমার অভিমত আল্লাহর ওয়াহীর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়েছে। আমি বলেছিলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা যদি মাকামে ইব্রাহীমকে সালাতের স্থান বানাতে পারতাম! তখন এ আয়াত নাযিল হয়ঃ ‘‘তোমরা মাকামে ইব্রাহীমকে সালাতের স্থান বানাও’’- (সূরাহ্ আল-বাক্বারাহ ২/১২৫)। (দ্বিতীয়) পর্দার আয়াত, আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! আপনি যদি আপনার সহধর্মিণীগণকে পর্দার আদেশ করতেন! কেননা, সৎ ও অসৎ সবাই তাঁদের সাথে কথা বলে। তখন পর্দার আয়াত নাযিল হয়। আর একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সহধর্মিণীগণ অভিমান সহকারে একত্রে তাঁর নিকট উপস্থিত হন। তখন আমি তাঁদেরকে বললামঃ ‘‘আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি তোমাদের ত্বলাক (তালাক) দেন, তাহলে তাঁর রব তাঁকে তোমাদের পরিবর্তে তোমাদের চেয়ে উত্তম অনুগত স্ত্রী দান করবেন’’- (সূরাহ্ তাহরীম ৬৬/৫)। তখন এ আয়াত অবতীর্ণ হয়।

 

বোখারী, হা: ৩০২

 

 

 

 

উপরের হাদীসে হযরত উমর রা: খুব স্পষ্টভাবে নবীজীর কাছে মাকামে ইব্রাহীমকে নামাজের জায়গা বানাবার জন্য আবেদন করেছেন। পরবর্তীতে এ বিষয়ে কুরআনের আয়াত নাজিল হয়। নবীগণের স্মৃতিবিজড়িত জিনিসকে কেন্দ্র করে নামাজ ইত্যাদির আমল যদি শিরকের মাধ্যম হতো, তাহলে উমর রা: এই ইচ্ছা ব্যক্ত করতেন না আর এ বিষয়ে কুরআনের আয়াতও নাজিল হতো না। 

 

দ্বিতীয়ত: আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়াতে ইবনে তাইমিয়ার ছাত্র ইবনে কাসীর বাইতুল মুকাদ্দাসের বিজয়ের ঘটনা বিস্তারিত লিখেছেন। সেখানে তিনি হযরত উমর রা: এর আমল তুলে ধরেছেন, 

 

قال الإمام أحمد: حدثنا أسود بن عامر، ثنا حماد بن سلمة عن أبي سنان، عن عبيد بن آدم، وأبي مريم، وأبي شعيب: أن عمر بن الخطاب كان بالجابية فذكر فتح بيت المقدس، قال: قال ابن سلمة: فحدثني أبو سنان، عن عبيد بن آدم سمعت عمر يقول لكعب: أين ترى أن أصلي؟

قال: إن أخذت عني صليت خلف الصخرة، وكانت القدس كلها بين يديك.

فقال عمر: ضاهيت اليهودية، لا ولكن أصلي حيث صلى رسول الله ﷺ، فتقدم إلى القبلة فصلى، ثم جاء فبسط ردائه وكنس الكناسة في ردائه، وكنس الناس.

وهذا إسناد جيد، اختاره الحافظ ضياء الدين المقدسي في كتابه (المستخرج)، وقد تكلمنا على رجاله في كتابنا الذي أفردناه في مسند عمر، ما رواه من الأحاديث المرفوعة، وما روى عنه من الآثار الموقوفة مبوبا على أبواب الفقه، ولله الحمد والمنة.

 

অর্থাৎ ইমাম আহমাদ রহ: বলেন, আমাদের কাছে আসওয়াদ বিন আমের বর্ণনা করেছেন, আমাদের কাছে হাম্মাদ বিন সালামা আবু সিনান থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি উবাইদ বিন আদম, আবু মারইয়াম ও আবু শুয়াইব থেকে বর্ণনা করেছেন যে, হযরত উমর রা: জাবিয়া নামক স্থানে ছিলেন। তখন তিনি বাইতুল মুকাদ্দাস বিজয়ের ঘটনা আলোচনা করলেন। তিনি বলেন, ইবনে সালামা আমার কাছে বর্ণনা করেছেন, আবু সিনান উবাইদ বিন আদম থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমি উমর রা: কে কা’য়াব আল-আহবারকে বলতে শুনেছি যে, হে কা’য়াব, বাইতুল মুকাদ্দাসের কোথায় আমার নামাজ পড়াকে তুমি উত্তম মনে করো? তিনি বললেন, আপনি যদি আমার মত নিতে চান, তাহলে আমি হলে পাথরের পিছে নামাজ আদায় করতাম। সম্পূর্ণ বাতুল মুকাদ্দাসই তখন আপনার সামনে থাকবে। 

এই কথা শুনে হযরত উমর রা: বললেন, তুমি ইয়াহুদীবাদকে প্রাধান্য দিয়েছো। না। আমি বরং সেখানে নামাজ আদায় করব যেখানে নবীজী নামাজ আদায় করেছেন। তখন তিনি কেবলার দিকে অগ্রসর হয়ে নামাজ আদায় করলেন। 

 

উক্ত হাদীস বর্ণনা উল্লেখ করে, ইবনে কাসীর বলেন, هذا إسناد جيد অর্থাৎ এটি একটি জাইয়্যেদ (ভালো) স্তরের সনদ। হাফেজ জিয়া আল-মাকেদসী তার আল-মুস্তাখরাজ কিতাবে এই মতটি গ্রহণ করেছেন। আমি এই হাদীসের রাবীদের ব্যাপারে আমার মুসনাদে উমর নামক স্বতন্ত্র কিতাবে আলোচনা করেছি। 

[আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, খ:৭, পৃ: ৫৮ ]

 

বর্তমানে শায়খ আলবানী বা শায়খ শুয়াইব আরনাউত উক্ত বর্ণনাকে দুর্বল বললেও শায়খ আহমাদ শাকের মুসনাদে আহমাদের উক্ত বর্ণনাকে হাসান বলেছেন। সুতরাং ইবনে কাসীর রহ: এর বক্তব্য ও শায়খ আহমাদ শাকেরের বক্তব্য অনুযায়ী হাদীসটি হাসান বা জাইয়্যেদ স্তরের।



 



 





 

এছাড়া ইতবান বিন মালেক রা: এর বিখ্যাত হাদীস যা বোখারী - মুসলিমে রয়েছে এবং এ বিষয়ে খুবই স্পষ্ট হাদীস, সেটিও ইবনে তাইমিয়া খুব সহজেই এড়িয়ে গিয়ে পুরো বিষয়টাকে বিদয়াত বানাবার অপচেষ্টা করেছেন। হাদীসটি দেখে নেয়া যাক,

 

হযরত মাহমুদ ইবনে রবী আল-আনসারী বর্ণনা করেন,

أن عتبان بن مالك كان يؤم قومه وهو أعمى، وأنه قال لرسول الله صلى الله عليه وسلم: يا رسول الله إنها تكون الظلمة والسيل وأنا رجل ضرير، فصل يا رسول الله في بيتي مكانا أتخذه مصلى، فجاءه رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال: “أين تحب أن أصلي؟” فأشار إلى مكان من البيت، فصلى فيه رسول الله صلى الله عليه وسلم

অর্থ: হযরত ইতবান বিন মালিক রা. একজন অন্ধ সাহাবী ছিলেন। তিনি তার সম্প্রদায়ের ইমাম ছিলেন। তিনি রাসূল স. কে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, অনেক সময় পথ অন্ধকার থাকে, বৃষ্টি হলে পানির প্রবাহ থাকে। আর আমি একজন অন্ধ। হে আল্লাহর রাসূল, আপনি আমার ঘরের একটি জায়গায় নামায পড়ুন। এটাকে আমার নামাযের জায়গা বানাব। রাসূল স. তার বাড়ী আগমন করলেন এবং বললেন, আমি কোথায় নামায পড়লে তুমি খুশি হবে? তিনি ঘরের একটি জায়গা দেখালেন। রাসূল স. সেখানে নামায আদায় করলেন।[বোখারী শরীফ, হাদীস নং ৬৩৬]

 

উক্ত হাদীসের মূল শব্দেই নবীজীর নামাজের জায়গাকে পরবর্তীতে নামাজের স্থান হিসেবে নির্ধারণের জন্য আবেদন করা হয়েছে। নবীজী নিজেই সেই আবেদনে সাড়া দিয়েছেন। এমনকি সেই সাহাবীর ঘরে গিয়ে বলেছেন, আমি কোথায় নামায পড়লে তুমি খুশি হবে। সাহাবী যেখানে স্পষ্ট শব্দে বলেছেন যে, হে আল্লাহর রাসূল, আমার ঘরের কোথাও আপনি নামাজ আদায় করুন, যেখানে আমি পরবর্তীতে নামাজ আদায় করব, এক্ষেত্রে নবীজী তাকে বলেননি, তুমি শিরকের দরজা খুলে দিচ্ছো। তোমার এই আবেদন বিদয়াত ও শিরক। তাহলে ইবনে তাইমিয়া এই শিরকের বুঝ কোথায় পেলেন? বিদয়াতের এমন ধারণা কোথায় পেলেন যেখানে খোদ ইবনে উমর রা: এর আমলকে বিদয়াত বানিয়ে দিচ্ছেন?

 

ইবনে তাইমিয়ার পূর্বে উক্ত হাদীসের উপর কাজী ইয়াদ, ইমাম নববী রহ: সহ অসংখ্য আলিম এধরণের বরকত হাসিলের বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। কেউ বিষয়টিকে শিরক কিংবা বিদয়াত বলেননি। 

 

কাজী ইয়াদ রহ. বলেন,

فيه التبرك بالفضلاء، ومشاهد الأنبياء وأهل الخير ومواطئهم، ومواضع صلاتهم، وإجابة أهل الفضل لما رغب إليهم فيه من ذلك” এই হাদীস থেকে বুজুর্গদের থেকে বরকত হাসিলের বিষয়টি প্রমাণিত হয়। এছাড়া নবী ও ওলীগণের  স্মরণীয় স্থান, তাদের হাটা-চলার জায়গা, তাদের নামাজের জায়গা থেকে বরকত হাসিল প্রমাণিত হয়। সেই সাথে এটাও প্রমাণিত হয় যে, বুজুর্গদের থেকে এভাবে কেউ বরকত লাভ করতে চাইলে তার আবেদনে সাড়া দেয়া উচিৎ। “[ইকমালুল মু’লিম, কাজী ইয়াদ রহ. খ.২, পৃ.৩৫৩]

ইমাম নববী রহ. বলেন,

وفيه التبرك بالصالحين وآثارهم، والصلاة في المواضع التي صلوا بها، وطلب التبريك منه

অর্থ: এই হাদীস থেকে একটি শিক্ষণীয় বিষয় হল, নেককার বুজুর্গদের মাধ্যমে বরকত লাভ। এবং বুজুর্গরা যেখানে নামায আদায় করেছেন সেখানে নামায আদায় করে বরকত অর্জন করা। [শরহু সহীহি মুসলিম, খ.৫, পৃ.১৬১]

 

হাদীস থেকে শুধু নবীজীর নামাজের জায়গার মাধ্যমে বরকত হাসিলের বিষয়টি প্রমাণিত এমন নয়, বরং খোদ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববীর পবিত্র কুরআন রাখার জায়গাকে বরকতপূর্ণ মনে করে সেখানে বিভিন্ন আমল করতেন। সহীহ মুসলিমে হযরত সালামা ইবনুল আকওয়া রা: থেকে বর্ণিত একটি হাদীস রয়েছে যেখানে বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। 

حَدَّثَنَا إِسْحَاقُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ، وَمُحَمَّدُ بْنُ الْمُثَنَّى، - وَاللَّفْظُ لاِبْنِ الْمُثَنَّى - قَالَ إِسْحَاقُ أَخْبَرَنَا وَقَالَ ابْنُ الْمُثَنَّى، حَدَّثَنَا حَمَّادُ بْنُ مَسْعَدَةَ، - عَنْ يَزِيدَ، - يَعْنِي ابْنَ أَبِي عُبَيْدٍ - عَنْ سَلَمَةَ، - وَهُوَ ابْنُ الأَكْوَعِ أَنَّهُ كَانَ يَتَحَرَّى مَوْضِعَ مَكَانِ الْمُصْحَفِ يُسَبِّحُ فِيهِ ‏.‏ وَذَكَرَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَتَحَرَّى ذَلِكَ الْمَكَانَ وَكَانَ بَيْنَ الْمِنْبَرِ وَالْقِبْلَةِ قَدْرُ مَمَرِّ الشَّاةِ ‏.‏

 

১০১৮। ইসহাক ইবনু ইবরাহীম ও মুহাম্মদ ইবনুল মূসান্না (রহঃ) ... সালামা ইবনুল আকওয়া (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, তিনি তাসবীহ ও নফল সালাত (নামায/নামাজ)-এর জন্য মুসহাফ (কুরআন) রাখার স্থান লক্ষ্য করে এগিয়ে যেতেন । এবং বলতেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ স্থানটিত লক্ষ্য করে এগিয়ে যেতেন। আর মিম্বার ও কিবলার মধ্যকার স্থান একটি ছাগল যেতে পারে এই পরিমাণ ছিল।

 

এই হাদীসে স্পষ্টভাবে কুরআন রাখার জায়গাকে গুরুত্ব দিয়ে সেখানে তাসবীহ ইত্যাদি আদায়ের কথা উল্লেখ রয়েছে। আর এটি নবীজীও করতেন। নবীজীর অনুসরণে হযরত সালামাহ ইবনুল আকওয়া একই কাজ করেছেন। 

উপরে ইবনে তাইমিয়া তার মতের পক্ষে একটি ঐকমত্যের দাবী করেছেন, অন্য দিকে একই বিষয়ে ইমাম নববী রহ: ঠিক উল্টো দাবী করেছেন। উল্লেখিত হাদীসগুলো থেকে ইবনে তাইমিয়ার দাবীর অসারতা এমনিতেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। চলুন এ বিষয়ে ইমাম নববী রহ: এর বক্তব্যটি দেখে নেয়া যাক। 

 

মুসলিম শরীফে হযরত সাহাল বিন সা’য়াদ রা: এর একটি লম্বা হাদীস রয়েছে। উক্ত হাদীসের শেষ অংশে রয়েছে, 

 

‏.‏ قَالَ سَهْلٌ فَأَقْبَلَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَوْمَئِذٍ حَتَّى جَلَسَ فِي سَقِيفَةِ بَنِي سَاعِدَةَ هُوَ وَأَصْحَابُهُ ثُمَّ قَالَ ‏"‏ اسْقِنَا ‏"‏ ‏.‏ لِسَهْلٍ قَالَ فَأَخْرَجْتُ لَهُمْ هَذَا الْقَدَحَ فَأَسْقَيْتُهُمْ فِيهِ ‏.‏ قَالَ أَبُو حَازِمٍ فَأَخْرَجَ لَنَا سَهْلٌ ذَلِكَ الْقَدَحَ فَشَرِبْنَا فِيهِ قَالَ ثُمَّ اسْتَوْهَبَهُ بَعْدَ ذَلِكَ عُمَرُ بْنُ عَبْدِ الْعَزِيزِ فَوَهَبَهُ لَهُ

সাহল (রাঃ) বলেন, এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেদিন ফিরে এসে তার সাহাবীদের সাথে বনু সাঈদার সাকীফায় (বৈধ জায়গায়) উপবেশন করেন। এরপর তিনি সাহলকে বললেন, আমাদেরকে কিছু পান করাও। সাহল বলেনঃ পরে আমি একটি পেয়ালাটি বের করে তাদের সকলকেই তা থেকে পান করিয়েছিলাম। আবূ হাযিম (রহঃ) বলেন, সাহল (রাঃ) আমাদের সামনে পেয়ালাটি বের করলে আমরা তাতে পান করলাম। তারপর উমার ইবনু আবদুল আযীয (রহঃ) তা চাইলে, তিনি তাঁকে সেটি দান করেন। 

মুসলীম: হা: ৫০৬৬

উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম নববীর বক্তব্যটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইমাম নববী রহ: বলেন,

 

‏ ‏قَوْله : ( فَأَخْرَجَ لَنَا سَهْل ذَلِكَ الْقَدَح فَشَرِبْنَا مِنْهُ , قَالَ : ثُمَّ اِسْتَوْهَبَهُ بَعْد ذَلِكَ عُمَر بْن عَبْد الْعَزِيز فَوَهَبَهُ لَهُ ) ‏ ‏يَعْنِي : الْقَدَح الَّذِي شَرِبَ مِنْهُ رَسُول اللَّه صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ.

هَذَا فِيهِ التَّبَرُّك بِآثَارِ النَّبِيّ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَمَا مَسَّهُ أَوْ لَبِسَهُ , أَوْ كَانَ مِنْهُ فِيهِ سَبَب , وَهَذَا نَحْو مَا أَجْمَعُوا عَلَيْهِ وَأَطْبَقَ السَّلَف وَالْخَلَف عَلَيْهِ مِنْ التَّبَرُّك بِالصَّلَاةِ فِي مُصَلَّى رَسُول اللَّه صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي الرَّوْضَة الْكَرِيمَة , وَدُخُول الْغَار الَّذِي دَخَلَهُ النَّبِيّ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَغَيْر ذَلِكَ , وَمِنْ هَذَا إِعْطَاؤُهُ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَبَا طَلْحَة شَعْره لِيَقْسِمهُ بَيْن النَّاس , وَإِعْطَاؤُهُ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حِقْوَة لِتُكَفَّن فِيهِ بِنْته رَضِيَ اللَّه عَنْهَا , وَجَعَلَهُ الْجَرِيدَتَيْنِ عَلَى الْقَبْرَيْنِ , وَجَمَعَتْ بِنْت مِلْحَانِ عَرَقَهُ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ , وَتَمَسَّحُوا بِوُضُوئِهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَدَلَّكُوا وُجُوههمْ بِنُخَامَتِهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ , وَأَشْبَاه هَذِهِ كَثِيرَة مَشْهُورَة فِي الصَّحِيح , وَكُلّ ذَلِكَ وَاضِح لَا شَكّ فِيهِ

 

অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু এর ব্যবহৃত জিনিস, নবীজী যা স্পর্শ করেছেন, যা পরিধান করেছেন বা নবীজীর সাথে সম্পর্কি জিনিসের মাধ্যমে বরকত অর্জন করার বিষয়টি এই হাদীস দ্বারা প্রতীয়মান হয়। এই বিষয়ে সকলেই ইজমা বা ঐকমত্য পোষণ করেছেন। সালাফ ও খালাফ সকলেই একমত হয়েছেন যে, পবিত্র রওজায় তারা নবীজীর নামাজের জায়গাকে নিজেদের নামাজের জায়গা বানিয়ে বরকত হাসিল করেছেন, নবীজী যে গোহায় প্রবেশ করেছেন সেখানে প্রবেশ করে তারা বরকত হাসিল করেছেন। ইত্যকর অসংখ্য বিষয় রয়েছে। এজাতীয় একটি বিষয় হলো, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু তালহা রা: কে নিজের চুল মোবারক দিয়েছিলেন সাহাবীদের মাঝে বন্টনের জন্য। এবং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কন্যার কাফনের জন্য নিজের পরিধানের কাপড় দিয়েছিলেন। একইভাবে দু’টি কবরের উপর নবীজী দু’টি ডাল দিয়েছিলেন (যাতে কবরের আজাব কমে যায়), হযরত বিনতে মিলহান নবীজীর ঘাম জমা করেছিলেন, নবীজীর ওজুর অবিশষ্ট পানি সাহাবায়ে কেরাম বরকতের জন্য নিজেদের মুখে মেখে নিতেন, একইভাবে নবীজীর নাকের সরদিও সাহাবীরা মুখে মেখে নিতেন। এজাতীয় অসংখ্য বিষয় সহীহ সহীহ হাদীসে রয়েছে যা খুবই প্রসিদ্ধ। এগুলো এতো স্পষ্ট যে, এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। 

[শরহে মুসলিম লিন-নববী, ৩৬৫৫ নং হাদীসের ব্যাখ্যা ]

 

উপরে আমরা ইবনে তাইমিয়ার একটি দাবী দেখে এসেছি, যেখানে তিনি বলেছেন, ইবনে উমর রা: ছাড়া কেউ নবীজীর নামাজের জায়গায় নামাজ আদায়ের মাধ্যমে বরকত হাসিলের চেষ্টা করেননি। অন্য দিকে ইমাম নববী রহ: পূর্ববর্তী ও পরবর্তী (সালাফ ও খালাফ) সকলের ইজমা ও ঐকমত্যের দাবী করেছেন যে, সকলেই নবীজীর নামাজের জায়গাকে বরকত হাসিলের জায়গা বানিয়েছেন। উপরের দলিলের আলোকে প্রিয় পাঠক সিদ্ধান্ত নিবেন, কে তার দাবীতে সঠিক? উপরে যে ত্বকিউদ্দীন হুসোনী রহ: বলেছেন, ইবনে তাইমিয়া তার মতের পক্ষে মিথ্যা ইজমার দাবী করে, বিষয়টি এখানেও আমরা দেখতে পাচ্ছি। এধরণের মিথ্যাচার ও প্রতারণা তার জন্য খুব সাধারণ বিষয়। আল-ইয়াজু বিল্লাহ। 

 

ইবনে তাইমিয়া যে ইবনে উমর রা: এর উপর মিথ্যা অভিযোগ করেছেন যে, তিনি ছাড়া কোন সাহাবী নবীজীর নামাজের জায়গা খুঁজে নামাজ আদা করেননি, এ বিষয়ে আরেকটি হাদীস এখানে উল্লেখ করছি। সুনানে নাসায়ীতে রয়েছে, 

 

أَخْبَرَنَا سَعِيدُ بْنُ يَحْيَى بْنِ سَعِيدٍ الْأُمَوِيُّ، ‏‏‏‏‏‏قال:‏‏‏‏ حَدَّثَنَا أَبِي، ‏‏‏‏‏‏قال:‏‏‏‏ حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ سَعِيدٍ، ‏‏‏‏‏‏عَنْ إِسْحَاقَ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ أَبِي طَلْحَةَ، ‏‏‏‏‏‏عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، ‏‏‏‏‏‏أَنَّ أُمَّ سُلَيْمٍ سَأَلَتْ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ يَأْتِيَهَا فَيُصَلِّيَ فِي بَيْتِهَا فَتَتَّخِذَهُ مُصَلًّى، ‏‏‏‏‏‏ فَأَتَاهَا فَعَمِدَتْ إِلَى حَصِيرٍ فَنَضَحَتْهُ بِمَاءٍ، ‏‏‏‏‏‏فَصَلَّى عَلَيْهِ وَصَلَّوْا مَعَهُ

সা’ঈদ ইবনু ইয়াহইয়া ইবনু সাঈদ আল উমাবী (রহ.) ..... আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত, উম্মু সুলায়ম (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে আবেদন করলেন, তিনি যেন তার কাছে এসে তার ঘরে সালাত আদায় করেন। তাহলে তিনি ঐ স্থানকে সালাতের স্থান ঠিক করে নিবেন। তিনি তার ঘরে আসলেন, তখন তিনি একটি চাটাইয়ের ব্যবস্থা করলেন এবং পানি দ্বারা তা মুছে ফেললেন। তারপর রাসূলুল্লাহ (সা.) তার ওপর সালাত আদায় করলেন এবং অন্য লোকেরাও তাঁর সঙ্গে সালাত আদায় করলেন।

সুনানে নাসায়ী: হা: ৭৩৮

হযরত উম্মে সুলাইম রা:ও নবীজীকে আবেদন করেছেন তার ঘরে এসে নামাজ আদায় করার জন্য। যেন তিনি নবীজীর আদায় করা জায়গায় নামাজ আদা করতে পারেন। ইতবান বিন মালিক রা: এর মতো নবীজী এখানেও উপস্থিত হয়ে তার ঘরে নামাজ আদায় করেছেন। সাহাবায়ে কেরাও নবীজীর সাথে উপস্থিত ছিলেন। এভাবে সাহাবীদের জামায়াত নিয়ে বিভিন্ন সাহাবীর ঘরে নবীজী নামাজ আদায় করেছেন যেন সেটিকে পরবর্তীতে নামাজের জায়গা বানান হয়, অথচ ইবনে তাইমিয়া দাবী করছেন, এটি ইবনে উমর রা: ছাড়া কেউ-ই আমল করেননি। অথচ সাহাবীদের জামায়াত নিয়ে এভাবে নামাজ আদায় করার মাধ্যমে বিষয়টি শুরু থেকে সাহাবায়ে কেরামের মাঝে প্রসিদ্ধ হওয়ার কথা। এই প্রসিদ্ধ বিষয়কে উল্টিয়ে দিয়ে ইবনে উমর রা: এর উপর শিরক-বিদয়াতের অপবাদ দেয়া ইবনে তাইমিয়ার কতো বড় ধৃষ্ঠতা একটু ভেবে দেখুন। 

 

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাথে সম্পর্কি জিনিসের মাধ্যমে বরকত হাসিলের এতো বেশি দলিল বর্ণিত আছে যে, কোন অন্ধ বা প্রবৃত্তিপূজারী ছাড়া এটি অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। যা ইমাম নববী রহ: স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করেছেন যে, বিষয়গুলো এতো বেশি প্রসিদ্ধ ও বিশুদ্ধভাবে বর্ণিত যে, এগুলো নিয়ে সংশয় - সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। অথচ নজদী-তাইমীরা এসব দলিলকে উপেক্ষা করে সম্পূর্ণ বিষয়কে ইয়াহুদী মুসা  ইবনে মাইমুনের শেখান শিরকের দর্শনের কারণে সব কিছুকে শিরকের মাধ্যম বানাবার চেষ্টা করে থাকে। 

 

এই পাহাড় সমান দলিলের বিপরীতে হযরত উমর রা: এর দু’টি বিষয়কে তারা সামনে আনার চেষ্টা করে। যা তাদের পক্ষে কোনভাবেই দলিল নয়। কেউ কেউ বিষয়গুলোকে এমনভাবে উপস্থাপন করে যেন, হযরত উমর রা: তাদের মতো নাউজুবিল্লাহ খারেজী চিন্তায় প্রভাবিত হয়ে নবীজীর সাথে সম্পর্কিত বিষয় থেকে বরকত হাসিলের বিরোধী ছিলেন। অথচ উমর রা: এর বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণ এর বিপরীত। শুরুতে চলুন, তাদের দেয়া দলিলগুলোর বাস্তবতা দেখে নেওয়া যাক। 

বাইয়াতে রিদওয়ানের গাছ কাটার ঘটনা

নজদী - সালাফীরা বিষয়টি খুব গুরুত্বের সাথে প্রচার করে যে, হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় যেই গাছের নিচে সাহাবায়ে কেরাম রা: নবীজীর হাতে বাইয়াত নিয়েছিলেন, সেই গাছকে কেটে ফেলার হুকুম দিয়েছিলেন। এর অর্থ হলো, হযরত উমর রা: নবীজীর সাথে সম্পর্কিত জিনিস থেকে বরকত হাসিলের বিপক্ষে ছিলেন। এভাবে তারা সাধারণ মানুষকে হযরত উমর রা: এর বিষয়ে একটি ভুল ধারণা দেয়ার চেষ্টা করে। নাউজুবিল্লাহ। অথচ বিষয়টি তারা তাদের আলিমদের গবেষণা থেকেও যাচাই করে না। সেই সাথে এর বিপরীতে যে হযরত উমর রা: থেকে নবীজীর বিভিন্ন বিষয় থেকে বরকত হাসিলের বিষয়টি প্রমাণিত হলেও সেগুলো গোপন করে থাকে।

বাইয়াতে রিদওয়ানের গাছকাটার বিষয়ে নাফে রহ: থেকে মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবাতে একটি বর্ণনা রয়েছে। 

নাফে রহ: বলেন,

كَانَ النَّاسُ يَأْتُونَ الشَّجَرَةَ الَّتِي يُقَالُ لَهَا شَجَرَةُ الرِّضْوَانِ فَيُصَلُّونَ عِنْدَهَا قَالَ فَبَلَغَ ذَلِكَ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ فَأَوْعَدَهُمْ فِيهَا وَأَمَرَ بِهَا فَقُطِعَتْ

অর্থাৎ শাজারাতুর রিদওয়ান নামে পরিচিত বাইয়াতে রিদওয়ানের গাছের কাছে এসে মানুষ নামাজ আদায় করত। বিষয়টি হযরত উমর রা: এর কাছে পৌঁছলে তিনি তাদেরকে সতর্ক করেন এবং গাছটি কেটে ফেলার নির্দেশ দিলে সেটি কেটে ফেলা হয়। 

[মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, খ: ৫, পৃ: ১৭৫]

 

 বাইয়াতে রিদওয়ানের গাছ কাটার বিষয়ে উপরের বর্ণনা সম্পর্কে শায়খ আলবানী লিখেছেন, 

 

قُلْتُ رَوَاهُ ابْنُ أَبِيْ شَيْبَةَ أَيْضًا وَرِجَالُهُ ثِقَاتٌ كُلُّهُمْ وَلَكِنَّهُ مُنْقَطِعٌ بَيْنَ نَافِعٍ وَعُمَرَ فَلَعَلَّ الْوَاسِطَةَ بَيْنَهُمَا عَبْدُ اللهِ بْنُ عُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا ثُمَّ اسْتَدْرَكْتُ فَقُلْتُ يُبْعِدُ ذَلِكَ كُلَّهُ مَا أَخْرَجَهُ الْبُخِارِيُّ فِيْ “صَحِيْحِهِ – الْجِهَاد” مِنْ طَرِيْقِ أُخْرُى عَنْ نَافِعٍ قَالَ قَالَ ابْنُ عُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا “رَجَعْنَا مِنَ الْعَامِ الْمُقْبِلْ فَمَا اجْتَمَعَ اثْنَانِ عَلَى الشَّجَرَةِ الَّتِيْ بَايَعْنَا تَحْتَهُ كَانَتْ رَحْمَةً مِّنَ اللهِ” قُلْتُ يَعْنِيْ إِخْفَاءَهَا عَلَيْهِمْ فَهُوَ نَصٌّ عَلَى أَنَّ الشَّجَرَةَ لَمْ تَبْقِ مَعْرُوْفَةَ الْمَكَانِ حَتَّى يُمْكِنَ قَطْعُهَا مِنْ عُمَرَ فَدَلَّ ذَلِكَ عَلَى ضُعْفِ رِوَايَةِ الْقَطْعِ الدَّالِ عَلَيْهِ الْإِنْقِطَاعُ الظَّاهِرُ فِيْهَا نَفْسُهَا وَمِمَّا يَزِيْدُهَا ضَعْفًا مَّا رَوَى الْبُخَارِيُّ فِي “الْمَغَازِيْ” مِنْ “صَحِيْحِهِ” عَنْ سَعِيْدِ بْنِ الْمُسَيَّبِ عَنْ أَبِيْهِ قَالَ “لَقَدْ رَأَيْتُ الشَّجَرَةَ ثُمَّ أَتَيْتُهَا بَعْدُ فَلَمْ أَعْرِفْهَ

অর্থাৎ বর্ণনাটি ইবনে আবি শাইবাও এনেছেন। বর্ণনার সকল রাবী সিকা বা নির্ভরযোগ্য। তবে বর্ণনাটি হযরত উমর রা: ও নাফে রহ: এর মাঝে বিচ্ছিন্ন (মুনকাতি)। সম্ভবত: নাফে রহ: ইবনে উমর রা: এর কাছ থেকে শুনে এটি বর্ণনা করেছেন। তবে এবিষয়ে আরও যাচাই করে আমি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, উক্ত বর্ণনা অন্যান্য বিশুদ্ধ বর্ণনার বিপরীত। বিশেষ করে ইমাম বোখারী রহ: বোখারী শরীফের কিতাবুল জিহাদে খোদ নাফে রহ: এর সূত্রে ইবনে উমর রা: থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমরা বাইয়াতে রিদওয়ানের ঘটনার পরবর্তী বছর সেখানে গেলে আমাদের কেউ-ই উক্ত গাছটি সুনির্দিষ্ট করতে পারেনি। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত ছিলো। 

(শায়খ আলবানী বলেন), গাছটি অপরিচিত হয়ে যাওয়াটা আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত ছিলো। (তবে শায়খ আলবানীর এই ব্যাখ্যা ছাড়াও মূল গাছটিই আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত ছিলো এই অর্থ হতে পারে। কারণ, স্ত্রী লিংগ বাচক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যা স্পষ্টভাবে গাছকে নির্দেশ করছে, ইবনে হাজার আসকালানী রহ:ও গাছটি আল্লাহর রহমত ছিল এই ব্যাখ্যা উল্লেখ করেছেন।)। বোখারীর এই বর্ণনা থেকে স্পষ্ট যে, গাছটি সাহাবায়ে কেরামের কাছে অপরিচিত হয়ে গিয়েছিল। যেহেতু গাছ সুনির্দিষ্ট ছিলো না, এজন্য এটি হযরত উমরের কেটে ফেলা সম্ভাবনা থাকে না। সুতরাং এই বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, গাছ কেটে ফেলার বর্ণনাটি সূত্র বিচ্ছিন্ন ও দুর্বল। এই বর্ণনাটি দুর্বল হওয়ার আরেকটি প্রমাণ হলো, বোখারী শরীফের কিতাবুল মাগাজীতে রয়েছে, হযরত সাইদ ইবনুল মুসায়্যাব তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি বাইয়াতের রিদওয়ানের গাছটি দেখেছিলাম। পরে যখন আসি এরপর আর গাছটি চিনতে পারিনি।

[তাতহীরুজ সাজিদ মিন ইত্তিখাজিল কুবুর মাসাজিদ, পৃ: ১২৫-১২৭]

 

তাফসীরে ত্ববারীতে ইবনে জারীর ত্ববারী রহ: বুকাইর ইবনুল আশজা থেকে বর্ণনা করেছেন, 

​​وَزَعَمُوْا أَنَّ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ مَرَّ بِذَلِكَ الْمَكَانِ بَعْدَ أَنْ ذَهَبَتِ الشَّجَرَةُ فَقَالَ أَيْنَ كَانَتْ فَجَعَلَ بَعْضُهُمْ يَقُوْلُ هُنَا وَبَعْضُهُمْ يَقُوْلُ هَهُنَا فَلَمَّا كَثُرَ اخْتِلَافُهُمْ قَالَ سِيْرُوْا هَذَا التَّكَلُّفَ فَذَهَبَتِ الشَّجَرَةُ وَكَانَتْ سَمْرَاءَ إِمَّا ذَهَبَ بِهَا سَيْلٌ وَإِمَّا شَيْءٌ سِوَى ذَلِكَ

অর্থাৎ তারা বলেন, বাইয়াতে রিদওয়ানের ওই জায়গা দিয়ে হযরত উমর রা: গেলে গাছটি সেখানে ছিলো না। সাহাবায়ে কেরামের কেউ বলেন, এখানে ছিলো, কেউ বলেন ওখানে ছিলো। এভাবে তাদের মাঝে মতবিরোধ যখন বাড়তে থাকল হযরত উমর রা: বললেন, তোমরা এই অপ্রয়োজনীয় মতবিরোধ রাখো। গাছটি একটি কাঁটা জাতীয় বাবলা গাছ ছিলো। হয়ত এটি কোন বন্যা বা অন্য কোন কারণে সেখান থেকে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। 

[তাফসীরে ত্ববারী, খ: ১৩, পৃ: ৮৭]

 

ইমাম হাকেম রহ: বলেন,

 

والحديبية بئر وكانت الشجرة بالقرب من البئر، ثم إن الشجرة فُقدت بعد ذلك فلم يجدوها وقالوا إن السيول ذهبت بها، فقال سعيد بن المسيب: (سمعت أبي وكان من أصحاب الشجرة يقول: قد طلبناها غير مرة فلم نجدها) 

 

অর্থাৎ হুদায়বিয়া মূলত: একটি কুপ। বাইয়াতে রিদওয়ানের গাছটি কুপের কাছেই ছিলো। তবে গাছটি পরবর্তীতে হারিয়ে যায়। সাহাবায়ে কেরাম পরে এই গাছটি আর খুঁজে পাননি। তারা বলেছেন, গাছটি বন্যার কারণে বিলীন হয়ে গিয়েছে। হযরত সাইদ ইবনুল মুসায়্যাব রহ: বলেন, আমি আমার পিতাকে বলতে শুনেছি, যিনি বাইয়াতে রিদওয়ানের সময় উপস্থিত ছিলেন, আমরা পরবর্তীতে কয়েকবার গাছটি খোঁজার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সেটি পাইনি। 

[মা’রিফাতু উলুমিল হাদীস,  পৃ: ১৬২]

 

 

 

মোটকথা বোখারী শরীফের বেশ কয়েকটি বর্ণনা দ্বারা এটি স্পষ্ট যে, বাইয়াতে রিদওয়ানের গাছ পরবর্তীতে সাহাবায়ে কেরাম শনাক্ত করতে পারেননি। কেউ কেউ বলেছেন, গাছের জায়গাটি ভুলে গিয়েছি অথবা জায়গার কথা স্মরণ থাকলেও সেখানে গাছটি পরবর্তীতে ছিলো না। বন্যা বা অন্য কোন কারণে গাছটি বিলীন হতে পারে। বোখারীর একটি বর্ণনায় হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা: বলেছেন, তিনি গাছের জায়গাটি নিশ্চিৎভাবে জানেন। বোখারীতে এসেছে,

عن جابر بنِ عبدِ الله رضي الله عنه قال: قال لنا رسولُ اللهِ صلّى الله عليه وسلّم يَوْمَ الْحُدَيْبِيَةِ: (( أَنْتُمْ خَيْرُ أَهْلِ الْأَرْضِ ))، وَكُنَّا أَلْفًا وَأَرْبَعَ مِائَةٍ، وَلَوْ كُنْتُ أُبْصِرُ الْيَوْمَ لَأَرَيْتُكُمْ مَكَانَ الشَّجَرَةِ.

 

অর্থাৎ হযরত জাবির বিন আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুদাইবিয়ার বাইয়াতের দিন আমাদেরকে বলেন, তোমরা জমীনের মধ্যে সবার শ্রেষ্ঠ। তখন আমরা এক হাজার চারশত সাহাবী ছিলাম সেখানে। আমি যদি আজ দেখতে পেতাম, তাহলে তোমাদেরকে ওই গাছের জায়গাটি দেখিয়ে দিতাম। 

 

এই বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ ওই জায়গাটি সুনিশ্চিৎভাবে চিনতেন। বক্তব্য থেকে এটাও বোঝা যায় যে, সেসময় সেখানে গাছটি ছিলো না। বন্যা বা অন্য কোন কারণে সেটি সেখানে না থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য তিনি গাছ দেখিয়ে দেয়ার পরিবর্তে গাছের জায়গা দেখিয়ে দেয়ার কথা বলেছেন। 

 

উপরের আলোচনা থেকে আমরা নিচের উপসংহারে উপনীত হতে পারি,

১। বাইয়াতের রিদওয়ানের গাছটি অধিকাংশ সাহাবায়ে কেরাম পরবর্তীতে শনাক্ত করতে পারেননি। হয়ত তারা ভুলে গিয়েছিলেন অথবা মূল গাছটি সেখানে ছিলো না। বন্যা বা অন্য কোন কারণে গাছটি বিলীন হওয়াতে তাদের জন্য বিষয়টি শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা: এর মতো কিছু কিছু সাহাবী সেই গাছের জায়গাটি নিশ্চিৎভাবে চিনতেন। 

 

২। হযরত নাফে রহ: যেখানে বলেছেন, হযরত উমর রা: গাছটি কেটে ফেলেছেন, এই বর্ণনাতে দু’টি ত্রুটি রয়েছে। ১। বর্ণনাটি মুনকাতি বা সূত্র বিচ্ছিন্ন। হযরত নাফে হযরত উমর রা: কে পাননি। ২। বোখারীর বর্ণনাতে রয়েছে, খোদ হযরত নাফে রহ: ইবনে উমর রা: থেকে বর্ণনা করেছেন যে, সাহাবায়ে কেরাম বাইয়াতের রিদওয়ানের পরের বছর গিয়ে গাছটি শনাক্ত করতে পারেননি। 

এই দু’টি ত্রুটির কারণে গাছ কেটে ফেলার বিষয়টি এখানে ব্যাখ্যা-সাপেক্ষ। হয়ত নাফে রহ: এর বর্ণনাটি সূত্র বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে দুর্বল বলতে হবে। অথবা যদি শক্তিশালী ধরা হয়, তাহলে এখানে ভিন্ন ব্যাখ্যা করতে হবে। এক্ষেত্রে অনেকে বলেছেন, বাইয়াতে রিদওয়ানের গাছটি অপরিচিত বা বিলীন হয়ে গেলে লোকেরা অন্য কোন গাছকে হয়ত বরকত হাসিলের মাধ্যম বানিয়েছিল। পরে হযরত উমর রা: এই ভুল গাছকে বরকত হাসিলের মাধ্যম বানাবার কারণে সেটি কেটে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন। 

 

সুতরাং উপরের আলোচনা থেকে কোনভাবেই এটা প্রমাণ করা সম্ভব নয় যে, হযরত উমর রা: নবীজীর সাথে সম্পর্কিত বিষয় থেকে বরকত হাসিলের বিরোধিতা করেছেন। উল্টো বাইয়াতে রিদওয়ানের গাছটির ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের উৎসাহ, সেটাকে পরবর্তীতে অনুসন্ধান করা থেকে বোঝা যায়, তারা এই গাছকে বরকতময় মনে করেছিলেন। এবং এর থেকে বরকত হাসিলের চেষ্টা করেছিলেন।  যেমন, হযরত ইবনে উমর রা: এর বক্তব্য থেকেও স্পষ্ট। তিনি গাছকে রহমত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যদিও গাছটি অপরিচিত হয়ে যাওয়া কিংবা বিলীন হওয়ার কারণে এই গাছ নিয়ে তাদের মাঝে মতবিরোধ হয়। আর হযরত উমর রা: যদি কোন গাছ কেটে থাকেন, সেটা অবশ্যই বাইয়াতে রিদওয়ানের গাছ ছিলো না। অন্য কোন ভুল গাছকে বরকত হাসিলের মাধ্যম বানাবার কারণে কেটে থাকতে পারেন। এরপরও বিষয়টি শক্তিশালী নয়। সুতরাং এই কথা বলার সুযোগ নেই যে, হযরত উমর রা: নবীজীর সাথে সম্পর্কিত বিষয় থেকে বরকত হাসিলের বিরোধী ছিলেন। 

 

হযরত উমর রা: থেকে আরও অসংখ্য জায়গায় নবীজীর বিভিন্ন বিষয় থেকে বরকত হাসিলের বিষয়টি প্রমাণিত। যেমন, 

 

১। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয়ভাজন ও বংশের হওয়ার কারণে হযরত আব্বাস রা: কে ওসিলা করে নিজে আল্লাহর কাছে বৃষ্টির জন্য দু’য়া করেছেন। একইভাবে হযরত আব্বাস রা: কে দিয়ে দু’য়া করিয়েছেন। যা বোখারীতে বর্ণিত হয়েছে।

 

বোখারী শরীফে রয়েছে, হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, 

عن أنس بن مالك - رضي الله عنه - قال: كنا إذا قحطنا استسقى عمر بن الخطاب - رضي الله عنه - بالعباس بن عبد المطلب - رضي الله عنه - فقال: اللهم إنا كنا نتوسل إليك بنبينا فتسقينا , وإنا نتوسل إليك بعم نبينا فاسقنا , قال: فيسقون.

অথর্: আমরা যখন অনাবৃষ্টির স্বীকার হতাম, তখন হযরত উমর রা. হযরত আব্বাস রা. এর মাধ‍্যমে বৃষ্টির দুয়া করতেন। হযরত উমর রা. বলেন, অথর্: আমরা যখন অনাবৃষ্টির স্বীকার হতাম, তখন হযরত উমর রা. হযরত আব্বাস রা. এর মাধ‍্যমে বৃষ্টির দুয়া করতেন। হযরত উমর রা. বলেন, হে আল্লাহ, নিশ্চয় আমরা আমাদের নবী রাসূল স. এর মাধ‍্যমে আপনার কাছে ওসিলা করতাম, আপনি আমাদেরকে বৃষ্টি দান করতেন, এখন আমরা আপনার কাছে আমাদের নবীজীর চাচাকে ওসিলা করছি, আপনি আমাদেরকে বৃষ্টি দান করুন। হযরত আনাস বলেন, এরপর বৃষ্টি হতো। 

বোখারী শরিফ, হাদীস নং ৫১১

এই হাদীস জীবিত ব‍্যক্তির ওসিলার সুস্পষ্ট প্রমাণ। এই হাদীসে হযরত উমর রা. এর দুয়াটি ব‍্যক্তির মাধ‍্যমে ওসিলা প্রমাণ করছে। আর হযরত উমর রা. যখন হযরত আব্বাস রা. কে ওসিলার দুয়া করতে বলছেন, তখন এটি নেককার লোকের কাছে দুয়ার প্রমাণ। মূল কথা হলো, হযরত উমর রা. এই দুয়াটিতে স্পষ্ট ওসীলা রয়েছে। আমাদের কাছে হযরত উমর রা. এর নিজের এই দুয়া যেমন ওসিলার প্রমাণ, একইভাবে হযরত আব্বাস রা. কে দুয়া করার জন‍্য যখন তিনি অনুরোধ করেছেন, সেটাও আরেক প্রকার ওসিলার প্রমাণ। হযরত উমর রা. এর নিজের দুয়াটি লক্ষ‍্য করুন,

اللهم إنا كنا نتوسل إليك بنبينا فتسقينا , وإنا نتوسل إليك بعم نبينا فاسقنا

হে আল্লাহ, নিশ্চয় আমরা আমাদের নবী রাসূল স. এর মাধ‍্যমে আপনার কাছে ওসিলা করতাম, আপনি আমাদেরকে বৃষ্টি দান করতেন, এখন আমরা আপনার কাছে আমাদের নবীজীর চাচাকে ওসিলা করছি, আপনি আমাদেরকে বৃষ্টি দান করুন। 

উমর রা. এখানে আল্লাহর কাছে বৃষ্টির জন‍্য দুয়া করেছেন। এই দুয়ার মধ্যে হযরত আব্বাস রা. কে ওসীলা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। হযরত উমর রা. দুয়াটি ব‍্যক্তির মাধ‍্যমে ওসীলার প্রমাণ। এবং হযরত আব্বাস রা.কে দুয়া করতে বলাটা কোন নেককার ব‍্যক্তির মাধ‍্যমে ওসীলার প্রমাণ। এখানে দু’প্রকার ওসিলা এক সাথে হয়েছে। একে এক প্রকার বানাবার চেষ্টার কোন সুযোগ নেই। 

এই হাদীসের অন‍্য বর্ণনা থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় স্পষ্ট হয়। বণর্নাটি শায়খ নাসীরুদ্দীন আল-বানী তার আত-তাওয়াসসুল কিতাবের ৬২ পৃষ্টায় এনেছেন এবং একে সহীহ বলেছেন। হযরত আব্বাস রা দুয়া করেছেন,

اللهم إنه لم ينزل بلاء إلا بذنب ، ولم يكشف إلا بتوبة ، وقد توجه القوم بي إليك لمكاني من نبيك ، وهذه أيدينا إليك بالذنوب ونواصينا إليك بالتوبة فاسقنا الغيث .

অথর্: হে আল্লাহ, প্রত্যেক বালা- মুসীবতই গোনাহের কারণে আসে, আর তাওবা ছাড়া এটি দূর হয় না, হে আল্লাহ, আমার জাতি আমার মাধ‍্যমে আপনার স্মরণাপন্ন হয়েছে, কারণ আপনার প্রিয় নবীর সাথে আমার সম্পর্ক রয়েছে (নবীজীর চাচা)। আপনার সামনে আমাদের গোনাহগার হাতগুলো উপস্থিত, আর উপস্থিত আমাদের তাওবার কপাল, আমাদেরকে বৃষ্টি দান করুন। 

আত-তাওয়াসসুল, পৃ.৬২

হযরত আব্বাস রা. এখানে গুরুত্বপূণর্ কয়েকটি কথা বলেছেন। 

১. তিনি আল্লাহর কাছে দুয়ার সময় বলেছেন, আমার জাতি আমার মাধ‍্যমে হে আল্লাহ আপনার কাছে আবেদন করেছে। এখানে স্পষ্টভাবে হযরত আব্বাস রা. এর ওসিলা প্রমাণিত। হযরত আব্বাস রা. এর এই বক্তব্যের দ্বিতীয় কোন ব‍্যাখ‍্যার সুযোগ নেই।

২.সাহাবায়ে কেরাম রা. হযরত আব্বাস রা. এর ওসিলা গ্রহণের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, হযরত আব্বাস রা. এর সাথে রাসূল স. এর আত্মীয়তার সম্পর্কের কারণে। কারণ তিনি রাসূল স. এর চাচা ছিলেন। রাসূল স. এর সাথে এই সম্পর্কের কারণে তার ওসিলা গ্রহণ পরোক্ষভাবে রাসুল স. এর ওসিলা গ্রহণ। হযরত উমর রা. তার দুয়ার মধ্যেও এই সম্পর্কের কথা বলেছেন। তিনি বলেন, হে আল্লাহ, আমাদের নবীজীর চাচার মাধ‍্যমে আপনার কাছে আবেদন করছি। উমর রা. এর কথা থেকেও সম্পর্কের গুরুত্ব স্পষ্ট। সুতরাং এখানে হযরত আব্বাস রা. ও হযরত উমর রা. এর বক্তব‍্য থেকে স্পষ্ট যে, মূলত: এখানে রাসূল স. এর ওসিলা দিয়ে দুয়া করা হয়েছে। 

সম্পূর্ণ ঘটনা থেকে যেসকল বিষয় প্রমাণিত হয়,

১. হযরত উমর রা. তার দুয়ার মধ্যে হযরত আব্বাস রা. এর ওসিলা করেছেন। এবং পরোক্ষভাবে হযরত আব্বাস রা. এর ওসিলার কারণ হলো, তিনি রাসূল স. এর চাচা। 

২.হযরত আববাস রা. এর নিজের বক্তব‍্য থেকে দিবালোকের ন‍্যায় স্পষ্ট যে, সাহাবায়ে কেরাম তার মাধ‍্যমে আল্লাহর কাছে আবেদন করেছে। হযরত আব্বাস রা. এর স্বীকারোক্তিতে বিষয়টি প্রমাণিত।

৩. হযরত উমর রা. হযরত আব্বাসকে দুয়া করার কথা বলেছেন। এর মাধ‍্যমে কোন নেককার লোকের কাছে দুয়া চাওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত।

৪. হযরত উমর রা. ও অন‍্যান‍্য সাহাবী হযরত আব্বাস রা. এর ওসিলা গ্রহণের মূল কারণ হলো, হযরত আব্বাস হলেন রাসূল স. এর আপন চাচা। রাসূল স. এর সাথে তার সম্পর্কের কারণে এই ওসিলা করা হয়েছে। সুতরাং মূল ওসিলা করা হয়েছে রাসূল স. এর মাধ‍্যমে। হযরত আব্বাস রা. এর স্পষ্ট বক্তব‍্য থেকে বিষয়টি প্রমাণিত। হযরত আব্বাস বলেছেন, “হে আল্লাহ, আমার জাতি আপনার কাছে আমার মাধ‍্যমে আবেদন করেছে, কারণ আপনার নবীর সাথে আমার বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে”। হযরত আব্বাস রা. এর এই স্পষ্ট বক্তব‍্য থেকে রাসূল স. এর ইন্তেকালের পরে রাসূল স. এর মাধ‍্যমে ওসিলা দেয়ার সুস্পষ্ট প্রমাণ। 

হযরত উমর রা. এর ঘটনায় মোট তিন প্রকারের ওসিলা প্রমাণিত হয়েছে। 

১. কোন ব‍্যক্তির ওসিলায় দুয়া করা। (বোখারীতে বর্নিত, হযরত উমর রা. এর নিজের দুয়া)।

২.কোন নেককার লোকের কাছে দুয়ার আবেদন করা। (হযরত আব্বাস রা. কে উমর রা. দুয়ার অনুরোধ করেছেন)।

৩. মৃত ব‍্যক্তির ওসিলা দেয়া। (হযরত আব্বাস রা. দুয়ার সময় রাসূল স. এর সাথে তার সম্পর্কের কথা বলে দুয়া করেছেন)

এই তিন প্রকারের ওসিলা উক্ত সহীহ বর্ণনা থেকে প্রমাণিত হয়েছে। বক্তব‍্যগুলো সালাফীদের নিজেদের বানানো আকিদার বিরোধী হওয়ার কারণে তারা বিভিন্নভাবে এগুলোর অপব‍্যাখ‍্যা করার চেষ্টা করেছে। সালেহ আল-মুনাজ্জিদ, শায়খ আলবানীসহ অন‍্যান‍্যরা ঘটনাকে বিকৃত করার চেষ্টা করলেও বাস্তবতা সকলের কাছে স্পষ্ট। তারা এক্ষেত্রে একটা ভিত্তিহীন দাবী করেছে যে, হযরত উমর রা. হযরত আব্বাস রা.কে বলেছেন, হে আব্বাস, আপনি উঠুন। আল্লাহর কাছে দুয়া করুন। এই বক্তবে‍্যর মাধ‍্যমে দাবী করেছে যে, এখানে শুধু হযরত আব্বাস রা এর কাছে দুয়া চাওয়া হয়েছে। এছাড়া আর কিছুই নয়। এটা সালেহ আল-মুনাজ্জিদ ও শায়খ আলবানীর স্পষ্ট বিকৃতি। নীচের লিংকে শায়খ মুনাজ্জিদের বিকৃতির নমুনা দেখতে পাবেন, https://islamqa.info/ar/118099

আমরা সহীহ দু’টি হাদীসের আলোকে তাদের এই বিকৃতির জওয়াব উল্লেখ করেছি আল-হামদুলিল্লাহ। হযরত উমর রা. হযরত আব্বাসকে দুয়া করতে বলেছেন। এটা অন‍্য প্রকারের ওসিলার তো বিরোধী নয়। সুতরাং এটা দিয়ে বাকী দুই প্রকারের ওসিলা অস্বীকারের অপচেষ্টা নিতান্ত হাস‍্যকর। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করুন। আমীন। 

 

 

২। হযরত আলী রা: এর কন্যা উম্মে কুলসুমকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছেন শুধু এজন্য তিনি নবীজীর বংশের। নবীজীর বংশের বরকত হাসিলের উদ্দেশ্যেই তিনি এটা করেছেন, যা এ বিষয়ক বর্ণনাগুলোতে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে।

এ বিষয়ক গ্রহণযোগ্য বর্ণনাগুলো বিখ্যাত মুহাদ্দিস আব্দুল্লাহ বিন সিদ্দিক আল-গুমারী তার আর-রদ্দুল মুহকামুল মাতীনে হাদীসের কিতাবসমূহ থেকে তাখরিজ করেছেন। নিচের দু’পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।

 

 

৩। নবীজীর পাশে কবরের জন্য হযরত আয়েশা রা: এর কাছে বার বার অনুরোধ করেছেন। 

 

৪। একদা হযরত উমর রা: মসজিদে নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে রওনা হলে হযরত আব্বাস রা: এর ঘরের পরনালার পানি উমর রা: এর গায়ে পড়ে। তিনি কাপড় পরিবর্তন করে নামাজ আদায় করেন এবং উনার পরনালাটি সরিয়ে ফেলতে বলেন। তখন হযরত আব্বাস রা: বলেন, হে উমর, আপনি এই পরনালা সরিয়েছেন অথচ এটি নবীজী নিজ হাতে লাগিয়েছিলেন। একথা শুনে হযরত উমর রা: বলেন, আপনি নিজ হাতে পরনালাটি আগের জায়গায় লাগাবেন। তবে এটা লাগানোর জন্য কোন সিঁড়ি ব্যবহার করতে হবে না। বরং উমরের কাঁধ হবে আপনার সিঁড়ি। (সুবহানাল্লাহ)। তখন হযরত আব্বাস রা: হযরত উমরের কাঁধে চড়ে পরনালাটি আবার আগের জায়গায় রেখে দেন। 

حدثنا أسباط بن محمد حدثنا هشام بن سعد عن عبيد الله بن عباس بن عبد المطلب أخي عبد الله قال كان للعباس ميزاب على طريق عمر بن الخطاب فلبس عمر ثيابه يوم الجمعة وقد كان ذبح للعباس فرخان فلما وافى الميزاب صب ماء بدم الفرخين فأصاب عمر وفيه دم الفرخين فأمر عمر بقلعه ثم رجع عمر فطرح ثيابه ولبس ثيابا غير ثيابه ثم جاء فصلى بالناس فأتاه العباس فقال والله إنه للموضع الذي وضعه النبي صلى الله عليه وسلم فقال عمر للعباس وأنا أعزم عليك لما صعدت على ظهري حتى تضعه في الموضع الذي وضعه رسول الله صلى الله عليه وسلم ففعل ذلك العباس رضي الله تعالى عنه

[মুসনাদে আহমাদ, বর্ণনা: 1793]

 

সুবহানাল্লাহ। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরনালাটি লাগিয়েছিলেন, এই জন্য হযরত উমর রাজিয়াল্লাহু আনহু পরনালি সেখানেই রেখে দিলেন। আর এই পরনালাটি সেখানে রাখার জন্য তিনি নিজের কাঁধ ব্যবহার করেছেন। কোন সিঁড়ি ব্যবহার করতে চাননি। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি কী আজমত ও মহব্বত ছিলো হযরত উমর রাজিয়াল্লাহু আনহু। আল-ফাতহুর রব্বানিতে আব্দুর রহমান সায়াতি রহ: বলেন, 

وفيه انقياد الصحابة لما فعله النبي صلى الله عليه وسلم والتبرك بآثاره رضي الله عنهم

অর্থাৎ এই হাদীসে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা করেছেন তার প্রতি সাহাবায়ে কেরামের নিরঙ্কুশ আনুগত্য এবং এর মাধ্যমে বরকত হাসিলের বিষয়টিও স্পষ্ট।

[আল-ফাতহুর রাব্বানি, খ: ১৫, পৃ: ১১১ ]

৫। বাইতুল মুকাদ্দাসে নবীজী যেখানে নামাজ আদায় করেছেন সেখানে গিয়ে নামাজ আদায় করেছেন। যদিও কা’য়াব আল-আহবার র: বাইতুল মুকাদ্দাসের পাথরের কাছে নামাজ আদায়ের পরামর্শ দিয়েছিলেন। 

আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়াতে ইবনে কাসীর রহ: বাইতুল মুকাদ্দাসের বিজয়ের ঘটনা বিস্তারিত লিখেছেন। সেখানে তিনি হযরত উমর রা: এর আমল তুলে ধরেছেন, 

 

قال الإمام أحمد: حدثنا أسود بن عامر، ثنا حماد بن سلمة عن أبي سنان، عن عبيد بن آدم، وأبي مريم، وأبي شعيب: أن عمر بن الخطاب كان بالجابية فذكر فتح بيت المقدس، قال: قال ابن سلمة: فحدثني أبو سنان، عن عبيد بن آدم سمعت عمر يقول لكعب: أين ترى أن أصلي؟

قال: إن أخذت عني صليت خلف الصخرة، وكانت القدس كلها بين يديك.

فقال عمر: ضاهيت اليهودية، لا ولكن أصلي حيث صلى رسول الله ﷺ، فتقدم إلى القبلة فصلى، ثم جاء فبسط ردائه وكنس الكناسة في ردائه، وكنس الناس.

وهذا إسناد جيد، اختاره الحافظ ضياء الدين المقدسي في كتابه (المستخرج)، وقد تكلمنا على رجاله في كتابنا الذي أفردناه في مسند عمر، ما رواه من الأحاديث المرفوعة، وما روى عنه من الآثار الموقوفة مبوبا على أبواب الفقه، ولله الحمد والمنة.

 

অর্থাৎ ইমাম আহমাদ রহ: বলেন, আমাদের কাছে আসওয়াদ বিন আমের বর্ণনা করেছেন, আমাদের কাছে হাম্মাদ বিন সালামা আবু সিনান থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি উবাইদ বিন আদম, আবু মারইয়াম ও আবু শুয়াইব থেকে বর্ণনা করেছেন যে, হযরত উমর রা: জাবিয়া নামক স্থানে ছিলেন। তখন তিনি বাইতুল মুকাদ্দাস বিজয়ের ঘটনা আলোচনা করলেন। তিনি বলেন, ইবনে সালামা আমার কাছে বর্ণনা করেছেন, আবু সিনান উবাইদ বিন আদম থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমি উমর রা: কে কা’য়াব আল-আহবারকে বলতে শুনেছি যে, হে কা’য়াব, বাইতুল মুকাদ্দাসের কোথায় আমার নামাজ পড়াকে তুমি উত্তম মনে করো? তিনি বললেন, আপনি যদি আমার মত নিতে চান, তাহলে আমি হলে পাথরের পিছে নামাজ আদায় করতাম। সম্পূর্ণ বাতুল মুকাদ্দাসই তখন আপনার সামনে থাকবে। 

এই কথা শুনে হযরত উমর রা: বললেন, তুমি ইয়াহুদীবাদকে প্রাধান্য দিয়েছো। না। আমি বরং সেখানে নামাজ আদায় করব যেখানে নবীজী নামাজ আদায় করেছেন। তখন তিনি কেবলার দিকে অগ্রসর হয়ে নামাজ আদায় করলেন। 

 

উক্ত হাদীস বর্ণনা উল্লেখ করে, ইবনে কাসীর বলেন, هذا إسناد جيد অর্থাৎ এটি একটি জাইয়্যেদ (ভালো) স্তরের সনদ। হাফেজ জিয়া আল-মাকেদসী তার আল-মুস্তাখরাজ কিতাবে এই মতটি গ্রহণ করেছেন। আমি এই হাদীসের রাবীদের ব্যাপারে আমার মুসনাদে উমর নামক স্বতন্ত্র কিতাবে আলোচনা করেছি। 

[আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, খ:৭, পৃ: ৫৮ ]

 

বর্তমানে শায়খ আলবানী বা শায়খ শুয়াইব আরনাউত উক্ত বর্ণনাকে দুর্বল বললেও শায়খ আহমাদ শাকের মুসনাদে আহমাদের উক্ত বর্ণনাকে হাসান বলেছেন। সুতরাং ইবনে কাসীর রহ: এর বক্তব্য ও শায়খ আহমাদ শাকেরের বক্তব্য অনুযায়ী হাদীসটি হাসান বা জাইয়্যেদ স্তরের।



 

 

 

 

৬। নবীজীর আংটি ও বর্ষা পর্যায়ক্রমে চারও খলিফা সংরক্ষণ করেছেন এবং একজন থেকে আরেকজন সেটি গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে হযরত উমর রা:ও ছিলেন। 

৭। হযরত উমর রা: এর বিখ্যাত দু’য়াটি প্রায় সবারই জানা। তিনি দু’য়া করতেন, হে আল্লাহ, আপনি আমাকে আপনার রাস্তায় শাহাদাত নসীব করুন এবং আপনার রাসূলের শহরে আমার মৃত্যু দান করুন। নবীজীর শহরে ইন্তিকাল করতে চাওয়ার দু’য়াটি নবীজীর প্রতি হযরত উমরের সীমাহীন মহব্বত ও এখানের বরকত হাসিলের প্রমাণ। 

সহীহ বোখারীতে রয়েছে,

عن عمر رضي الله عنه، قال: «اللهم ارزقني شهادة في سبيلك، واجعل موتي في بلد رسولك صلى الله عليه وسلم»

হযরত উমর রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হে আল্লাহ, আপনি আমাকে আপনার রাস্তায় শাহাদাত নসীব করুন এবং আমার মৃত্যু আপনার রাসূলের শহরে দান করুন। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। 

বোখারী, হা: ১৮৯০

 

৮। আল-ইসাবাতে ইবনে হাজার আসকালানী রহ: হযরত ফিরাস রা: এর জীবন আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন,

“হযরত সফিয়্যাহ বিনতে বাহরাহ রাজিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার চাচা ফিরাস নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একটি পাত্রে পানি পান করতে দেখে সেটি তিনি নবীজীর কাছ থেকে হাদিয়া চান। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ফিরাসকে পাত্রটি দেন। পরবর্তীতে যখনই হযরত উমর রাজিয়াল্লাহু আনহু আমাদের এখানে আসতেন, তিনি বলতেন, তোমরা নবীজী সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পান-পাত্রটি বের করো। আমরা সেটি বের করতাম। তিনি এতে জমজমের পানি নিয়ে পান করতেন এবং তার মুখে ছিটিয়ে দিতেন”।

[আল-ইসাবা, বর্ণনা নং ৬৯৮৭]

এই বর্ণনা থেকে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পানপাত্রের প্রতি হজরত উমর রাজিয়াল্লাহু আনহুর আজমত ও মহব্বতের বহি:প্রকাশ ঘটেছে। সেই সাথে এই পান-পাত্র থেকে বরকত হাসিলের চেষ্টাও করেছেন। এতে তিনি জমজমের পানি পান করতেন এবং সেটি তার মুখে ছিটিয়ে দিতেন। যা পানপাত্র থেকে তাবাররুক হাসিলের স্পষ্ট প্রমাণ। 

 

৯। হযরত উমর রাজিয়াল্লাহু আনহু এর সময় দুর্ভিক্ষ হলে এক ব্যক্তি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবরে গিয়ে বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনার উম্মতের জন্য বৃষ্টির দু’য়া করুন। পরে ঐ ব্যক্তি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্ন দেখেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেন, তুমি উমরের কাছে যাও। আমার পক্ষ থেকে তাকে সালাম জানাও এবং বলো যে, তাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করা হবে। তাকে বলবে, সে যেন বুদ্ধিমত্তা বজায় রাখে। ঐ ব্যক্তি হযরত উমর রাজিয়াল্লাহু আনহুকে এই ঘটনা বর্ণনা করলে হযরত উমর রাজিয়াল্লাহু এটি শুনে কেঁদে ফেলেন। এবং বললেন, হে আল্লাহ, আমি তো আমার সাধ্যের মধ্যে চেষ্টা করে যাচ্ছি। 

উক্ত বর্ণনা থেকেও স্পষ্ট যে, হযরত উমর রাজিয়াল্লাহু এই ব্যক্তি যে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে বৃষ্টির দু’য়ার কথা বলেছেন এবং এর ওসিলায় যে বৃষ্টি হচ্ছে, এটিকে হযরত উমর রাজিয়াল্লাহু এখানে সমর্থন করেছেন। বিষয়টি যদি হযরত রাজিয়াল্লাহু আনহুর কাছে নিন্দনীয় হতো তাহলে তিনি অবশ্যই ঐ ব্যক্তিকে সতর্করতে

মজার বিষয় হলো, ইবনে তাইমিয়া হযরত ইবনে উমর রাজিয়াল্লাহু এর আমলকে শিরকের মাধ্যম বলে উল্লেখ করলেও খোদ ইবনে তাইমিয়ার হাতে চুমু খেয়ে যখন তার ভক্ত-মুরীদান বরকত হাসিলের চেষ্টা করত, তখন কিন্তু সেখানে শিরকের অভিযোগ পাওয়া যায় না। সাহাবায়ে কেরামের আমলের উপর শিরকের অভিযোগের মত ধৃষ্ঠতা অন্যদিকে তার মাধ্যমে বরকত হাসিলের জন্য যখন লোকজন তার হাত চুম্বন করতো তখন সেটাকে অনুমোদন দেয়া কতো বড় দ্বিচারিতা বলার অপেক্ষা রাখে না। 

ইবনে তাইমিয়ার খুব কাছের ছাত্র আবু হাফস উমর বিন আলী আল-বাজ্জার ইবনে তাইমিয়ার জীবনীর উপর কিতাব লিখেছেন। এর নাম দিয়েছেন, আল-আ'লামুল আলিয়্যাহ ফি মানাকিবি শাইখিল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ। এ কিতাবের ৩৯ পৃষ্ঠায় নিজের উস্তায সম্পর্কে  লিখেছেন,

" অন্তর দৃষ্টিসম্পন্ন যে কেউ তাকে দেখত সাথে সাথে তার হাত ধরে চুমু খেত। এমনকি দুনিয়াদার ব্যবসায়ীরা  শায়খকে সালাম দিতে ও তার থেকে বরকত হাসিলের জন্য তাদের দোকান থেকে বেরিয়ে আসত"।

[আল-আ'লামুল আলিয়্যাহ, পৃ: ৩৯ ]

 

 

 

 

 

 

 

ইবনে তাইমিয়ার আরেকটি বড় ধরণের বিকৃত অপচেষ্টা হলো, হযরত ইবনে উমর রাজিয়াল্লাহু এর আমলকে বিচ্ছিন্ন একক আমল হিসেবে উল্লেখ করা। অথচ এটি ইবনে তাইমিয়ার সুস্পষ্ট মিথ্যাচার। খোলাফায়ে রাশেদীন থেকে শুরু করে অসংখ্য সাহাবী থেকে তাবাররুকের বিষয়টি প্রমাণিত। বিশেষ করে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেখানে নামাজ আদায় করেছেন সেখানে বরকত হাসিলের জন্য নামাজের বিষয়টিও প্রমাণিত। এটি কখনই ইবনে উমর রাজিয়াল্লাহু এর একক আমল নয়। অথচ ইবনে তাইমিয়া তার বক্তব্য বোঝানোর চেষ্টা করেছে, যদি খোলাফায়ে রাশেদীন বা বড় বড় সাহাবী এই আমল করতেন তাহলে বোধ হয় তিনি এই আমল মেনে নিতেন। শুধু ইবনে উমর রাজিয়াল্লাহু এর আমল হওয়ার কারণে মেনে নিতে পারছেন না। এটি আসলে ইবনে তাইমিয়ার অভ্যাসগত চতুরতা ছাড়া কিছুই নয়। ইবনে তাইমিয়ার এধরণের প্রবৃত্তিপূজা ও চতুরতা নিয়ে শায়খ আব্দুল্লাহ বিন সিদ্দিক আল-গুমারী সুন্দর লিখেছেন। তার ভাষায় বিষয়টি দেখি,

“আশ্চর্য্যের বিষয় হলো, আমরা দেখি এজাতীয় বিষয়ে ইবনে তাইমিয়া প্রায়ই সাহাবায়ে কেরামের না করাকে দলিল হিসেবে ব্যবহার করেন। অথচ এটি কোন গ্রহণযোগ্য দলিল নয়। উল্টো দিকে আমরা দেখি, তার কোন মতের বিপরীতে কোন সাহাবী আমল করে থাকলে কিংবা কোন বক্তব্য দিয়ে থাকলে সে তাদের বিরোধিতা করে। এবং কোন ধরণের লজ্জা-শরম ছাড়াই বড় বড় ও শীর্ষস্থানীয় সাহাবায়ে কেরামের অবস্থানকে ভুল সাব্যস্ত করে। যেমন হযরত উমর রা: ও হযরত আলী রা: কে সে ভুল সাব্যস্ত করে। তার কাছে তো সাহাবায়ে কেরামের পরবর্তী কোন তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন বা ইমামের বক্তব্যের সামান্য কোন মূল্যও নেই, যদি সেগুলো তার মতের বিপরীত হয়। সে তার মতের বিপক্ষে এগুলোর কোন মূল্যায়নই করে না। কেউ যদি তার কিতাব ভালো করে অধ্যয়ন করে এবং গ্রহণ করা মতগুলো পর্যালোচনা করে, তাহলে এধরণের আশ্চর্যজনক বিষয়গুলো দেখতে পাবে। এগুলো (প্রবৃত্তিপূজা ও স্বেচ্ছাচারিতা) দেখে বিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম বিস্মিত হোন।”

[আর-রদ্দুল মুহকামুল মাতীন, পৃ: ৪৯ ]

 

পরের পৃষ্ঠায় শায়খ আব্দুল্লাহ বিন সিদ্দিক আল-গুমারী লিখেছেন, 

“দুর্ভিক্ষের সময় হযরত উমর রা: হযরত আব্বাস রা: কে দিয়ে বৃস্টির দোয়া করিয়েছেন। এই ঘটনাকে ইবনে তাইমিয়া বহু জায়গায় দলিল হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে। যত্র-তত্র এটা দিয়ে দলিলও দিয়েছে, কেমন যেন এটি একটি অকাট্য দলিল, যেখানে কোন ব্যাখ্যা বা আলোচনার অবকাশ নেই। সে হযত সাহাবায়ে কেরামের আমলকে দলিল মনে করে এজন্য তার এই কাজে হয়ত আশ্চর্য্য হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এই বিষয়ে উমর রা: এর আমল তার কাছে দলিল কিন্তু তিন তালাকের মাসআলায় হযরত উমর ও অন্যান্য সাহাবায়ে কেরামের সম্মিলিত মত তার কাছে দলিল নয়। ইবনে তাইমিয়ার কিতাব পড়লে এসব বিষয় পাঠককে বিস্মিত করে। তাকে আসলে কী বলা উচিৎ? সে কি শরীয়াত নিয়ে তামাশাকারী, খেয়াল-খুশিমত ছাড় প্রদানকারী নাকি স্ববিরোধী? তবে স্ববিরোধী বলাটাই তার জন্য সবচেয়ে উপযোগী ও বাস্তব-সম্মত। কারণ সে তার কিতাবে প্রচুর স্ববিরোধিতা করে থাকে। 

 

[আর-রদ্দুল মুহকামুল মাতীন, পৃ: ৫০ ]

 

 

 

 

মোটকথা, এধরণের বাগাড়ম্বর, মিথ্যাচার, দ্বীনকে নিজের খেয়াল-খুশিমত ব্যবহার করা ইবনে তাইমিয়ার স্বভাবগত বিষয়। তালাউব বিদদীন বা দ্বীনকে নিয়ে এধরণের খেলতামাশা করা খুবই ন্যাক্কারজনক বিষয়। বিষয়টি যদি দলিল ভিত্তিক বিপরীত মত পোষণ হতো, তাও একটা ব্যাখ্যার সুযোগ ছিলো। এখানে সরাসরি ইবনে উমর রা: এর কাজকে শিরকের মাধ্যমে বলে দেয়া হচ্ছে নাউজুবিল্লাহ। অথচ একই বিষয় সাহাবায়ে কেরাম নবীজীর মাধ্যমে করিয়েছেন, সেখানে সাহাবায়ে কেরামের বড় একটি জামায়াত উপস্থিত ছিলো। এর মধ্যে হযরত আবু বকর রা:ও ছিলেন। যা নাসায়ীর বর্ণনা থেকে স্পষ্ট। যেটি নবীজীর আমল, সাহাবায়ে কেরামের আমল এবং পরবর্তীতে হযরত উমর রা: এর আমলের মাধ্যমে প্রমাণিত, সেটি কীভাবে হযরত ইবনে উমর রা: এর বিচ্ছিন্ন আমল হিসেবে শিরকের মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হতে পারে?

 

নোট: পরবর্তী পর্বে আমরা ইনশা আল্লাহ এ সংক্রান্ত ইবনে তাইমিয়ার দলিলের পর্যালোচনা উল্লেখ করব। 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

------ ------

লেখকের আরো ব্লগ

আক্বিদা

ইলমের সফর অব্যাহত থাকুক

ইজহারুল ইসলাম শনি, 23 নভে., 2024

খতীব বাগদাদী রহ. তার ‘আল-জামে লি-আখলাকির রাবি ও আদাবিস সামে’ কিতাবে ইমাম আবু ইউসুফ রহ. থেকে একটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন।
الْعِلْمُ شَيْءٌ لا يُعْطِيكَ بَعْضَهُ حَتَّى تُعْطِيَهُ كُلَّكَ
অর্থ: ইলম এমন একটি জিনিস, সে তোমাকে তার কিছু অংশও দিবে না যতক্ষণ না তুমি নিজেকে পূর্ণভাবে তার কাছে সমর্পণ না করবে।

অন্যান্য সৃষ্টি থেকে মানুষের শ্রেষ্ঠত্যের একটি বিশেষ দিক হলো ইলম অর্জনের ক্ষমতা। এটি মানুষের জন্য আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।

ইলমের জন্য যে…

বাকি অংশ পড়তে সাবস্ক্রাইব করুন
আক্বিদা

ইবনে তাইমিয়া রহ. এর কারামত

ইজহারুল ইসলাম শনি, 23 নভে., 2024

ইবনে তাইমিয়া রহ. এর জীবনী আলোচনা করেছেন তার বিশিষ্ট ছাত্র ইবনুল কাইয়্যিম রহ। তার পৃথক জীবনী লিখেছেন ইবনে তাইমিয়া রহ. এর বিশিষ্ট দুই ছাত্র। একজন হলেন, হাফেজ আবু হাফস উমর ইবনে আলি আল-বাযযার (মৃত:৭৪৯ হি:) তিনি আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া লিখেছেন। ইবনে তাইমিয়া রহ. আরেক ছাত্র ইবনে আব্দুল হাদী রহ. (মৃত: ৭৪৪ হি:) আরেকটি জীবনী লিখেছেন। তার লিখিত জীবনীর নাম আল-উকুদুল দুররিয়া মিন মানাকিবি শাইখিল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া।

আমি এখানে ইবনে তাইমিয়া রহ. এর বিশিষ্ট ছাত্রদের বর্ণনায় তার কিছু উল্লেখযোগ্য কারামত উল্লেখ করছি।

কারামত-১:

লওহে মাহফুজ দেখে বিজয়ের সংবাদ:

গায়েবসম্পর্কেইবনেতাইমিয়ারহএরকারামত:

আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) “মাদারিজুস সালিকিন শরহু মানাযিলিস সাঈরিন” নামক কিতাবে আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) এর কারামতের কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) লিখেছেন-

أخبر الناس والأمراء سنة اثنتين وسبعمائة لما تحرك التتار وقصدوا الشام : أن الدائرة والهزيمة عليهم وأن الظفر والنصر للمسلمين وأقسم على ذلك أكثر من سبعين يمينا فيقال له : قل إن شاء الله فيقول : إن شاء الله تحقيقا لا تعليقا  وسمعته يقول ذلك قال : فلما أكثروا علي قلت : لا تكثروا كتب الله تعالى في اللوح المحفوظ : أنهم مهزومون في هذه الكرة وأن النصر لجيوش الإسلام

“তাতারীরা যখন মুসলিম উম্মাহের বিভিন্ন অঞ্চলে সেনা অভিযান পরিচালনা করে এবং শামে আক্রমণের উদ্যোাগ গ্রহণ করে তখন ৭০২ হিঃ সনে শায়েখ (রহঃ) সাধারণ মানুষ এবং আমীর-উমারাদেরকে সংবাদ দিলেন যে, “তাতারীরা পরাজিত হবে এবং মুসলমানরা বিজয় ও সাহায্য লাভ করবে।”। তিনি তাঁর কথার উপর সত্তরটিরও বেশি কসম খেয়েছেন। তাঁকে বলা হল, আপনি ইনশাআল্লাহ বলুন! অতঃপর তিনি বলেন, নিশ্চিতভাবে ইনশাআল্লাহ বলছি, সম্ভাবনা হিসেবে নয়। আমি তাঁকে বলতে শুনেছি, যখন তারা আমার উপর পীড়াপীড়ি করল, আমি তাদেরকে বললাম, তোমরা পীড়াপীড়ি কর না, আল্লাহ তায়ালা লউহে মাহফুজে লিখে রেখেছেন যে, তারা পরাজিত হবে এবং মুসলমানরা বিজয়ী হবে।

[মাদারিজুস সালিকিন, খ–২, পৃষ্ঠা-৪৮৯]

আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) আরও অনেক কারামতের কথা উল্লেখ করেছেন, ইবনে আব্দুল হাদী মুকাদ্দেসী (রহঃ) এবং আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ)। বিস্তারিত জানার জন্য আগ্রহী পাঠক, মাদারিজুস সালিকীন ও আ’লামুল আলিয়্যা গ্রন্থদ্বয় দেখতে পারেন।

¬

কারামত-২: ইবনে তাইমিয়া রহ. এর ভবিষ্যৎবাণী:

আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) এর বিশেষ ছাত্র আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) লিখেছেন-

وأخبرني غير مرة بأمور باطنة تختص بي مما عزمت عليه ولم ينطق به لساني وأخبرني ببعض حوادث كبار تجري في المستقبل ولم يعين أوقاتها وقد رأيت بعضها وأنا أنتظر بقيتها وما شاهده كبار أصحابه من ذلك أضعاف أضعاف ما شاهدته والله أعلم

“তিনি আমাকে অনেকবার অনেক বাতেনি বিষয়ের সংবাদ দিয়েছেন। তিনি শুধু আমাকে এগুলো বলেছেন এবং এ বিষয় সম্পর্কে আমি কাউকে কিছু বলি নি। তিনি আমাকে ভবিষ্যতের অনেক ঘটনার সংবাদ দিয়েছেন কিন্তু তিনি সময় নির্দিষ্ট করে দেননি। তাঁর ভবিষ্যৎ বাণীর কিছু কিছু আমি ঘটতে দেখেছি এবং অবশিষ্টগুলো সংঘটিত হওয়ার অপেক্ষায় আছি। তাঁর বড় বড় সাগরেদগণ আমি যা দেখেছি, তার চেয়ে বহু বহু গুণ বেশি দেখেছেন”

[মাদারিজুস সালিকিন, খ–২, পৃষ্ঠা-৪৯০]

কারামত-৩: অন্তরের বিষয় সম্পর্কে অবগত হওয়া:

ইবনে তাইমিয়া রহ. এর ছাত্র আবু হাফস উমর আল-বাযযার বলেন,

أنه جرى بيني وبين بعض الفضلاء منازعة في عدة مسائل وطال كلامنا فيها وجعلنا نقطع الكلام في كل مسألة بأن نرجع إلى الشيخ وما يرجحه من القول فيها

ثم أن الشيخ رضي الله عنه حضر فلما هممنا بسؤاله عن ذلك سبقنا هو وشرع يذكر لنا مسألة مسألة كما كنا فيه وجعل يذكر غالب ما أوردناه في كل مسأله ويذكر أقوال العلماء ثم يرجح منها ما يرجحه الدليل حتى أتى على آخر ما أردنا أن نسأله عنه وبين لنا ما قصدنا أن نستعلمه منه فبقيت أنا وصاحبي ومن حضرنا أولا مبهوتين متعجبين مما كاشفنا به وأظهره الله عليه مما كان في خواطرنا.”

অর্থাৎ আমার সাথে একজন সম্মানিত আলেমের কয়েকটি মাসআলা নিয়ে বিতর্ক হলো। এ বিষয়ে আমাদের আলোচনা অনেক দীঘর্ হলো। প্রত্যেক মাসআলায় আমরা এভাবে কথা শেষ করলাম যে, মাসআলার সমাধান ইবনে তাইমিয়া রহ. এর কাছ থেকে জেনে নিবো।

এরপর শায়খ রহ. আমাদের নিকট উপস্থিত হলেন। আমরা যখন মাসআলাগুলো সম্পর্কে শায়খকে জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছা করলাম তিনি আমাদের জিজ্ঞাসার পূর্বেই আলোচনা শুরু করলেন। তিনি আমাদের আলোচনা অনুযায়ী একের পর এক মাসআলার সমাধান বলতেছিলেন। প্রত্যেক মাসআলায় আমাদের কাঙ্খিত উত্তর প্রদান করছিলেন। এভাবে তিনি প্রত্যেকটি মাসআলায় উলামায়ে কেরামের বক্তব্য এবং দলিল অনুযায়ী প্রাধান্য পাওয়া মাসআলাটি উল্লেখ করছিলেন। অবশেষে তিনি আমাদের আলোচিত সর্বশেষ মাসআলাটির সমাধান প্রদান করলেন। আমাদের অন্তরের বিষয়গুলো আল্লাহ তায়ালা এভাবে সুস্পষ্ট করে প্রকাশ করায় উপস্থিত লোকজন, আমার সঙ্গী ও আমি আশ্চর্যন্বিত ও বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৩, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

নিচের স্ক্রিনশট দেখুন,

এছাড়া আবু হাফস আল-বাযযার অন্তরের বিষয়ে ইবনে তাইমিয়া রহ. এর অবগত হওয়া সম্পর্কে আরও বলেন,

و كنت في خلال الأيام التي صحبته فيها إذا بحث مسألة يحضر لي إيراد فما يستتم خاطري به حتي يشرع فيرده و يذكر الجواب من عدة وجوه

অর্থাৎ আমি যখন যেসময়ে তার সংস্পর্শে ছিলাম, তখন আমার মনে কোন বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ার সঙ্গে তিনি এর জওয়াব দিতে শুরু করতেন এবং কয়েকভাবে এর উত্তর প্রদান করতেন।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৩, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কারামত-৪: অন্যের সাহায্য

“وحدثني الشيخ الصالح المقريء أحمد بن الحريمي أنه سافر إلى دمشق قال فاتفق أنى لما قدمتها لم يكن معي شئ من النفقة البتة وأنا لا اعرف أحدا من أهلها فجعلت أمشي في زقاق منها كالحائر فإذا بشيخ قد أقبل نحوي مسرعا فسلم وهش في وجهي ووضع في يدي صرة فيها دراهم صالحة وقال لي انفق هذه الآن وخلي خاطرك مما أنت فيه فإن الله لا يضيعك ثم رد على أثره كأنه ما جاء إلا من أجلي فدعوت له وفرحت بذلك، وقلت لبعض من رأيته من الناس من هذا الشيخ؟ فقال وكأنك لا تعرفه هذا ابن تيمية

আমার নিকট শায়খ সালেহ আল –মুকরী বর্ণনা করেন, তিনি  দামেশকের উদ্দেশে সফর করেন। তিনি বলেন, ঘটনাক্রমে ঐ সফরে আমার সঙ্গে কোন চলার মতো কোন খাবার বা অর্থ ছিলো না। আমি ওখানকার কাউকে চিনতাম না। এ অবস্থায় আমি উদভ্রান্তের মতো  দামেশকের অলি-গলিতে ঘুরছিলাম। হঠাৎ একজন শায়খ আমার দিকে দ্রুত গতিতে হেঁটে এলেন। তিনি হাস্যোজ্জল মুখে সালাম দিলেন। তিনি আমার হাতে একটা থলি দিলেন যাতে কিছু খাটি দিরহাম ছিলো। এরপর বললেন, “ এগুলো ব্যবহার করো। তোমার অন্তরে যেই পেরেশানী আছে এগুলো ঝেড়ে ফেলো।  আল্লাহ তায়ালা তোমাকে ধ্বংস করবেন না।” একথা বলে তিনি একই পথে ফিরে গেলেন। তিনি যেন শুধু আমার কাছেই এসেছিলেন। আমি তার জন্য দুয়া করলাম এবং এতে আনন্দি হলাম। আমি অন্যান্য মানুষকে জিজ্ঞেস করলাম, এই শায়খ কে? তারা বললো, তুমি মনে হয় শায়খকে চেনো না, তিনি হলেন ইবনে তাইমিয়া।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৪, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কারামত-৫:

وحدثني الشيخ العالم المقريء تقي الدين عبد الله ابن الشيخ الصالح المقريء احمد بن سعيد قال سافرت إلى مصر حين كان الشيخ مقيما بها فاتفق أني قدمتها ليلا وأنا مثقل مريض فأنزلت في بعض الأمكنة فلم ألبث أن سمعت من ينادي باسمي وكنيتي فأجبته وأنا ضعيف فدخل إلي جماعة من أصحاب الشيخ ممن كنت قد اجتمعت ببعضهم في دمشق فقلت كيف عرفتم بقدومي وأنا قدمت هذه الساعة فذكروا أن الشيخ أخبرنا بأنك قدمت وأنت مريض وأمرنا أن نسرع بنقلك وما رأينا أحدا جاء ولا أخبرنا بشيء، فعلمت أن ذلك من كرامات الشيخ رضي الله عنه.”

শায়খ সালেহ আল-মুকরী এর ছেলে শায়খ তাকিউদ্দীন আব্দুল্লাহ আল-মুকরী আমাকে বলেছেন, শায়খ ইবনে তাইমিয়া রহ. যখন মিশরে ছিলেন তখন আমি মিশরে সফর করি। আমি রাতে মিশরে গিয়ে উপস্থিত হলাম। তখন আমার কাছে ভারী বোঝা ছিল আর আমি অসুস্থ ছিলাম। আমি এক জায়গায় গিয়ে বাহন থেকে নামলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে শুনতে পেলাম এক ব্যক্তি আমার নাম ও উপনাম ধরে ডাকছে। আমি দুর্বল শরীরে তার ডাকে সাড়া দিলাম। তখন শায়খ ইবনে তাইমিয়ার একদল ছাত্র আমার নিকট এলো। তাদের সাথে আমি পূর্বে দামেশকে সাক্ষাৎ করেছিলাম। আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা আমার আগমন সম্পর্কে কীভাবে জানলে; অথচ আমি মাত্র এলাম? তারা বলল, শায়খ ইবনে তাইমিয়া তাদেরকে বলেছে যে, আপনি এসেছেন এবং আপনার শরীর অসুস্থ। আমাদেরকে দ্রুত আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন। আমরা কাউকে আসতেও দেখিনি এবং আপনার সম্পর্কে কেউ পূর্বে সংবাদও দেয়নি। আমি তখন বুঝলাম এটি শায়খের কারামত।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৪, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কারামত-৬:                                  

“وحدثني أيضا قال مرضت بدمشق إذ كنت فيها مرضة شديدة منعتني حتى من الجلوس فلم اشعر إلا والشيخ عند رأسي وأنا مثقل مشتد بالحمى والمرض فدعا لي وقال جاءت العافية، فما هو إلا أن فارقني وجاءت العافية وشفيت من وقتي”

শায়খ সালেহ আল-মুকরী এর ছেলে শায়খ তাকিউদ্দীন আব্দুল্লাহ আল-মুকরী আরও বলেন, আমি দামেশকে কঠিন রোগে আক্রান্ত হলাম। এমনকি আমি বসতেও পারতাম না। হঠাৎ আমার মাথার নিকট শায়খকে দেখতে পেলাম।তখন আমি মারাত্মক জ্বর ও রোগে আক্রান্ত ছিলাম।তিনি আমার জন্য দুয়া করলেন এবং বললেন, সুস্থতা চলে এসেছে।তিনি আমার কাছ থেকে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি সুস্থ হয়ে গেলাম।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৫, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কারামত-৭:

“وحدثني أيضا قال أخبرني الشيخ ابن عماد الدين المقرئ المطرز قال قدمت على الشيخ ومعي حينئذ نفقة فسلمت عليه فرد علي ورحب بي وأدناني ولم يسألني هل معك نفقة أم لا، فلما كان بعد أيام ونفدت نفقتي أردت أن اخرج من مجلسه بعد أن صليت مع الناس وراءه فمنعني وأجلسني دونهم فلما خلا المجلس دفع إلي جملة دراهم وقال أنت الآن بغير نفقة فارتفق بهذه فعجبت من ذلك وعلمت أن الله كشفه على حالي أولا لما كان معي نفقة وآخرا لما نفدت واحتجت إلى نفقة.”

আমার নিকট তিনি আরও বর্ণনা করেছেন, আমার নিকট শায়খ ইবনে ইমাদুদ্দিন আল-মুকরী আল-মুতাররায বর্ণনা করেন, তিনি বলেন আমি একবার শায়খের নিকট আগমন করলাম। তখন আমার কাছে খরচের টাকা-পয়সা ছিলো। আমি তাকে সালাম দিলাম, তিনি উত্তর দিলেন এবং আমাকে স্বাগত জানালেন। আমাকে তিনি তার নিকটে বসালেন। এবার তিনি আমার জীবিকা নির্বাহের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন না। কিছুদিন পর আমার খরচের উপকরণ শেষ হয়ে গেল। তখন আমি তার পিছে নামায আদায় করে তার মজলিশ থেকে বের হতে উদ্যত হলাম। তিনি আমাকে বাধা দিয়ে বসতে বললেন। এরপর যখন মজলিশ শেষ হলো, তখন তিনি আমাকে কিছু দিরহাম দিয়ে বললেন, এখন তোমার কোন খরচের টাকা-পয়সা নেই। এগুলো ব্যবহার করতে থাকে। এ ঘটনায় আমি বিস্মিত হলাম। বুঝলাম যে আল্লাহ তায়ালা আমার পূর্বের ও বর্তমান অবস্থা শায়খের নিকট প্রকাশ করে দিয়েছেন।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৬, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কারামত-৮: মৃত সম্পর্কে সংবাদ:

“وحدثني من لا أتهمه أن الشيخ رضي الله عنه حين نزل المغل بالشام لأخذ دمشق وغيرها رجف أهلها وخافوا خوفا شديدا، وجاء إليه جماعة منهم وسألوه الدعاء للمسلمين فتوجه إلى الله ثم قال أبشروا فإن الله يأتيكم بالنصر في اليوم الفلاني بعد ثالثة حتى ترون الرؤوس معبأة بعضها فوق بعض.قال الذي حدثني فوالذي نفسي بيده أو كما حلف ما مضى إلا ثلاث مثل قوله حتى رأينا رؤوسهم كما قال الشيخ على ظاهر دمشق معبأة بعضها فوق بعض.”

আমার নিকট বিশ্বস্ত এক ব্যক্তি বর্ণনা করেছেন, যখন মোগলরা দামেশক ও অন্যান্য অন্চল দখলের জন্য শামে আক্রমণ করলো, দামেশকের অধিবাসীরা খুবই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। এসময় একদল মুসলমান শায়খ ইবনে তাইমিয়া রহ. এর নিকট আগমন করলেন এবং তাকে মুসলমানদের জন্য দুয়া করার অনুরোধ করলেন। তিনি আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করলেন। এরপর বললেন, তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ করো, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা  তিন দিন পর তোমাদেরকে সাহায্য করবেন, এমনকি তোমরা দেখবে যে একটার উপর আরেকটা মাথা স্তুপ হয়ে থাকবে। ঘটনার বর্ণনাকারী বলেন, আল্লাহর শপথ, তৃতীয় দিন দামেশকের প্রবেশ মুখে শত্রুদের মাথাগুলো একটার উপর আরেকটা স্তুপ হয়েছিলো যেমন শায়খ বলেছিলেন।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৬, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কারামত-৯:

“وحدثني الشيخ الصالح الورع عثمان بن احمد بن عيسى النساج أن الشيخ رضي الله عنه كان يعود المرضى بالبيمارستان بدمشق في كل أسبوع فجاء على عادته فعادهم فوصل إلى شاب منهم فدعا له فشفي سريعا وجاء إلى الشيخ يقصد السلام عليه فلما رآه هش له وأدناه ثم دفع إليه نفقة وقال قد شفاك الله فعاهد الله أن تعجل الرجوع إلى بلدك أيجوز أن تترك زوجتك وبناتك أربعا ضيعة وتقيم هاهنا؟ فقبل يده وقال يا سيدي أنا تائب إلى الله على يدك وقال الفتى وعجبت مما كاشفني به وكنت قد تركتهم بلا نفقة ولم يكن قد عرف بحالي أحد من أهل دمشق.”

শায়খ উসমান ইবনে আহমাদ ইবনে ইসা আন-নাসসাজ আমার নিকট বর্ণনা করেছেন, শায়খ ইবনে তাইমিয়া রহ. দামেশকের বিমারিস্তান নামক জায়গায় প্রত্যেক সপ্তাহে রোগীদের দেখতে আসতেন। অভ্যাস অনুযায়ী তিনি রোগী দেখতে এলেন। তাদের মধ্যে এক যুবককে তিনি দেখলেন এবং তার জন্য দুয়া করলেন। সে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠল। যুবকটি শায়খকে সালাম দেয়ার জন্য এলো। তাকে দেখে শায়খ হাসিমুখে নিকটে বসালেন। তার কাছে কিছু খরচের টাকা-পয়সা দিলেন এবং বলেন, আল্লাহ তায়ালা তোমাকে সুস্থ করেছেন। সুতরাং তুমি আল্লাহর কাছে ওয়াদা করো যে তুমি দ্রুত পরিবারের কাছে ফিরে যাবে। তোমার জন্য কখনও বৈধ হবে যে তোমার স্ত্রী ও চার কন্যাকে ধ্বংসের মুখে রেখে এখানে অবস্থান করবে? যুবকটি বলল, আমি তার হাতে চুমু দিলাম এবং বললাম, শায়খ, আমি আল্লাহর নিকট আপনার হাতে তওবা করছি।

আমি তার কাশফ দেখে বিস্মিত হলাম। বাস্তবেই আমি আমার পরিবারকে সহায়-সম্বলহীন রেখে এসেছিলাম।দামেশকের কেউ আামার পরিবার সম্পর্কে অবগত ছিলো না।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৬, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

এই কারামতগুলো লিখে আবু হাফস আল-বাযযার রহ. লিখেছেন,

و كرامات الشيخ رضي الله عنه  كثيرة جدا لا يليق بهذا المختصر أكثر من ذكر هذا القدر منها . ومن أظهر كراماته أنه ما سمع بأحد عاداه أو غض عنه إلا و أبتلي بعدة بلايا غالبها في دينه وهذا ظاهر مشهور لا يحتاج فيه إلي شرح صفته

শায়খ রহ. অনেক কারামত রয়েছে। এই সংক্ষিপ্ত বইয়ে সেগুলো উল্লেখ করা সঙ্গত নয়। তার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ করামত হলো যে কেউ শায়খের বিরোধীতা করেছে বা তার সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক রয়েছে, সে বিভিন্ন ধরনের বালা-মুসীবতে নিপতিত হয়েছে। বেশিরভাগ মুসীবত দীন সম্পর্কীয়। বিষয়গুলো স্পষ্ট ও প্রকাশিত। এগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা অনাবশ্যক।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৮, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কাশফ ও ইলহাম সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া রহ. এর অনেক কারামত রয়েছে। এ বিষয়ে তার অনেক বক্তব্যও আছে। এগুলোর কিছু কিছু ইবনে তাইমিয়া রহ. এর দৃষ্টিতে তাসাউফ বইয়ে উল্লেখ করেছি। দু:খজনক বিষয় হলো, আমাদের আজকের আলোচনার মূল বিষয় এখনও শুরু করা হয়নি। আজ এখানেই ইতি টানছি। পরবর্তী আলোচনায় গায়েব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করা হবে। 

------ ------

আক্বিদা

আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাকার ইবনে আবিল ইয রহ: হানাফী না কি হাশাবী?

ইজহারুল ইসলাম শনি, 23 নভে., 2024

[বর্তমানে  ইবনে আবিল ইযের  আকিদাতুত ত্বহাবীর  ব্যাখ্যাগ্রন্থটি ব্যাপকভাবে প্রচারের চেষ্টা করা হচ্ছে। যেমন, সালাফী আলেম আব্দুল্লাহ শাহেদ মাদানী এর বাংলা অনুবাদ করে অনলাইনে প্রচার করছেন। সুতরাং এই কিতাবের বাস্তবতা ও এর লেখক সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাগুলো সুস্পষ্ট করা আবশ্যক। আকিদাতুত ত্বহাবীর উপর দরসের নিয়ত ব্যক্ত করেছিলাম কিছু দিন আগে। উক্ত দরসের প্রয়োজনে আজকের আলোচনাটি লেখা। যারা উক্ত দরস দেখবেন, আশা করি বিষয়টি তাদের উপকারে আসবে।  ]

সৌদি আরবের কল্যাণে কাররামিয়াদের ভ্রান্ত দেহবাদী আকিদাগুলো সালাফী মতবাদের মোড়কে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। পেট্র-ডলারের সহায়তায় তারা এক্ষেত্রে অনেকটা অগ্রসর। সালাফীদের ভ্রান্ত আকিদা সম্পর্কে বেশ কিছু প্রবন্ধ লেখার সুযোগ হয়েছে আল-হামদুলিল্লাহ। আমাদের আইডিয়ার ওয়েবসাইটে লেখাগুলো পাবেন। সালাফী মতবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে থাকে। এর মধ্যে একটি বিশেষ কৌশল হল, বিভিন্ন ইমামের আকিদার কিতাব ব্যাখ্যার নামে নিজেদের ভ্রান্ত আকিদা ছড়িয়ে দেয়া। উদাহরণ হিসেবে ইমাম ত্বহাবীর আকিদাতুত ত্বহাবীর কথা বলা যায়। একটু খোজ নিলে দেখবেন, প্রায় প্রত্যেক সালাফী শায়খই আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখেছেন, কেউ অডিও বা ভিডিও লেকচার দিয়েছেন। অন্তত বিশ-পজিশজন বা এর চেয়ে বেশি সালাফী শায়খের ব্যাখ্যা পাবেন। একটি মৌলিক প্রশ্ন হল,  এসব সালাফী আলেমরা কি ইমাম ত্বহাবীর আকিদা পোষণ করেন? ধ্রুব সত্য হল, ইমাম ত্বহাবীর আকিদার সাথে এদের আকিদার দূরতম কোন সম্পর্ক নেই। ইমাম ত্বহাবী রহ. এর আকিদার ও এদের আকিদার মাঝে আসমান-জমিনের ফারাক। আরেকটি প্রশ্ন মনে উকি দেয়, এরা যেহেতু ইমাম ত্বাহাবীর আকিদা পোষণ করে না, তাহলে এর ব্যাখ্যা করে কেন? সহজ উত্তর হল, ইমাম ত্বহাবীর আকিদা প্রচারের ছদ্মাবরণে নিজেদের ভ্রান্ত আকিদা প্রচার। এদের যে কোন একটা ব্যাখ্য পড়লেই এই বাস্তবতা উপলব্ধি করবেন। 

সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে ইমাম ত্বহাবী রহ. এর আকিদাকে বিকৃত করার লক্ষ্যে লিখিত একটি বেনামী ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৩৪৯ হিজরীতে।  বে-নামী ব্যাখ্যা এজন্য বললাম, উক্ত ব্যাখ্যার উপর লেখকের নাম ছিল না। আর প্রশাকগণ নিশ্চিত ছিলেন না যে, ব্যাখ্যাগ্রন্থটি মূলত: কার। পরবর্তীতে তারা তত্ব-তালাশ করে উদ্ধার করেন, এটি ইবনে আবিল ইয আল-হানাফীর লেখা। বর্তমানে এটি ইবনে আবিল ইযের ব্যাখ্যা হিসেবে প্রচার করা হয়। আমাদের আলোচ্য বিষয় শিরোনাম থেকে কিছুটা স্পষ্ট। তবে দু’টি বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করার চেষ্টা করব। ১. ইবনে আবিল ইযের নামে প্রচারিত আকিদা কি আসলেই ইবনে আবিল ইযের লেখা?২. ইবনে আবিল ইযকে হানাফী হিসেবে প্রচার করা হয়। তিনি কি হানাফী ছিলেন না কি দেহবাদী আকিদায় বিশ্বাসী হাশাবী ছিলেন?

প্রচলিত আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যা কি ইবনে আবিল ইযের?

বিষয়টি বোঝার জন্য ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রকাশের ইতিহাসের দিকে ফিরে যেতে হবে। আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যাগ্রন্থটি ১৩৪৯ হিজরীতে মক্কায় সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়।

এই প্রকাশনায় কিতাবের উপর লেখকের কোন নাম ছিল না। বরং প্রকাশকরা লেখেন,

 راجعنا ما في أيدينا من كتب التراجم والفنون، فلم نجد ما يمكننا معه الجزم بنسبته لشخص بعينه، وإنا نثبت هنا أسماء شارحي هذه العقيدة الذين عدهم صاحب كشف الظنون وهم سبعة ……. ومنهم صدر الدين علي بن محمد بن أبي العز الأذرعي الدمشقي الحنفي المتوفى سنة 746هـ وهو الذي يترجح الظن أنه الشارح” আমাদের কাছে বিদ্যমান বিভিন্ন জীবনীগ্রন্থ ও রিজালের কিতাবে আমরা অনুসন্ধান চালিয়েছি। আমরা এমন কোন তথ্য পাইনি, যার আলোকে সুনিশ্চিতভাবে ব্যাখ্যাগ্রন্থটিকে সুনির্দিষ্ট কোন লেখকের দিকে সম্পৃক্ত করা সম্ভব। কাশফুজ জুনুন এর লেখকের বক্তব্য অনুযায়ী আমরা এখানে আকিদাত্ব ত্বহাবীর সমস্ত ব্যাখ্যাকারের নাম উল্লেখ করছি। তারা হলেন সাতজন…….। এদের মাঝে একজন ব্যাখ্যাকার হলেন, সদরুদ্দিন আলী ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবিল ইয হানাফী (মৃত:৭৪৬ হি:)। আমাদের বিশেষ ধারণা হল, সাতজন ব্যাখ্যাকারের মাঝে তিনি হলেন আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাকার। “

এখানে প্রবল ধারণা হিসেবে সদরুদ্দিন আলী ইবনে মুহাম্মাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যার মৃত্যু তারিখ হল, ৭৪৬ হিজরী। আর বর্তমানে প্রচারিত ব্যাখ্যাকার হলেন, আলী ইবনে আলী ইবনে আবিল ইয। যার মৃত্যু তারিখ হল, ৭৯২ হিজরী। এখানে প্রবল ধারণা হিসেবে যার কথা বলা হয়েছে, তিনি হলেন বর্তমানে প্রচারিত লেখকের পিতা। ছেলে আর পিতা কখনও এক হতে পারে না। উভয়ের মৃত্যু তারিখ থেকেও বিষয়টি স্পষ্ট। মোটকথা, ব্যাখ্যাগ্রন্থটি কার সেটা সুনিশ্চিতভাবে বলার মত কোন তথ্য তখনকার উলামায়ে কেরাম পাননি। পরবর্তীতে সৌদি আরবের শায়খগণ বিখ্যাত আলেম আহমাদ শাকেরকে এটি তাহকীক করার অনুরোধ করেন। শায়খ আহমাদ শাকের পরবর্তীতে এটি তাহকীক করে প্রকাশ করেন।

তিনি এর ভূমিকায় লেখেন, ” এ কিতাবের যে মাখতুতা বা হস্তলিপি আমি পেয়েছি, সেখানে মূল লেখকের নেই। সুতরাং কিতাবের লেখক আসলে কে সেটা জানা সম্ভব হয়নি। ” 

শায়খ আহমাদ শাকের তার ভূমিকায় কয়েকবার বলেছেন যে, তিনি এই কিতাবের নির্ভরযোগ্য কোন মাখতুতা বা হস্তলিপি পাননি।

তিনি তার সাধ্য অনুযায়ী এটি তাহকীক করার চেষ্টা করেছেন। শায়খ আহমাদ শাকের আশা ব্যক্ত করেছেন, তিনি যদি নির্ভরযোগ্য কোন হস্তলিপি পান, তাহলে পরবর্তীতে এটি সংশোধনের চেষ্টা করবেন।

শায়খ আহমাদ শাকের বলেন,

 ولكني لا أزال أرى هذه الطبعة مؤقتة أيضا، حتى يوفقنا الله إلى أصل محفوظ للشرح صحيح، يكون عمدة في التصحيح فنعيد طبعه

“আমি এখনও মনে করি, এই সংস্করণ অস্থায়ী। আল্লাহ তায়ালা যদি নির্ভরযোগ্য বিশুদ্ধ কোন হস্তলিপি মিলিয়ে দেন, তাহলে এটি সংশোধন করে নতুনভাবে প্রকাশ করার করব। শায়খ আহমাদ শাকের আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. [মৃত: ১২০৫ হি:] এর একটি বক্তব্য পান ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিনে। সেখানে মোর্তজা যাবিদি রহ. ব্যাখ্যাকারের নাম লিখেছেন, আলী ইবনে আলী ইবনে মুহাম্মাদ আল-গাজ্জী আল-হানাফী। মোর্তজা যাবিদি রহ. এর উদ্ধৃতিতে লেখকের সঠিক পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি।

শায়খ আহমাদ শাকের বলেন, মোর্তজা যাবিদি রহ. লেখকের নামের নিসবতে ভুল করেছেন। তিনি লিখেছেন, আলী ইবনে আলী আল-গাজ্জী, বাস্তবে হওয়ার কথা ছিল, আলী ইবনে আলী ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী। মোটকথা, শায়খ আহমাদ শাকেরের সামনে মোর্তজা যাবিদি রহ. এর উদ্ধৃতি ছিল, বেশ কয়েকটি মাখতুতা ছিল এরপরেও ব্যাখ্যাকার সম্পর্কে সুনিশ্চিতভাবে বলেননিন যে, অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে, উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের লেখক ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী। শায়খ আহমাদ শাকের মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্যের আলোকে তার ধারণা অনুযায়ী কিতাবে লেখকের নাম লিখেছেন, আলী ইবনে আলী ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী। পরবর্তীতে মাকতাবাতুল ইসলামী থেকে শায়খ আলবানীর তাহকীকে ব্যাখ্যাগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। সেখানে কিছু মাখতুতা বা হস্তলিপি এর চিত্র দেয়া হয়েছে। এসকল হস্তলিপিতে স্পষ্টভাবে লেখকের নাম লেখা হয়েছে, আলী ইবনে মুহাম্মাদ। যার মৃত্যু তারিখ, ৭৪৬ হি:। সুতরাং মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্য অনুযায়ী, লেখকের নাম হওয়ার কথা ছিল, আলী ইবনে আলী আল-গাজ্জী। মাকতাবাতুল ইসলামী এর মাখতুতা অনুযায়ী, লেখকের নাম আলী ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবিল ইয। সুতরাং একথা সুনিশ্চিতভাবে বলার অবকাশ নেই যে, উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের প্রকৃত লেখক কে। এরপরেও শায়খ আলবানী ও যুহাইর আশ-শাবীশ দাবী করেন, সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হল, উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের লেখক ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী।

শায়খ যুহাইর আশ-শাবীস নবম সংস্করণের ভূমিকায় ( পৃ.৯) লিখেছেন, 

وأما نسختنا فقد كان اسم مؤلفها مثبتا على الورقة الأولى منها، إلا أن بعض الأيدي قد لعبت فيه بالمحو والكتابة أكثر من مرة، وأخيرا أثبت عليه ما أثبته الشيخ أحمد شاكرঅর্থ: আমাদের মূল হস্তলিপিতে লেখকের নাম প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা ছিল। তবে অজ্ঞাত কেউ উক্ত নাম কয়েকবার ঘষা-মাজা করে নতুনভাবে লিখেছে। অবশেষে আমি শায়খ আহমাদ শাকেরের তথ্য অনুযায়ী লেখকের নাম উল্লেখ করেছি।মোটকথা, এই ব্যাখ্যাগ্রন্থের মূল হস্তলিপিতে লেখকের নাম উল্লেখ নেই। পরবর্তীতে বিভিন্ন ঘষা-মাজার মাধ্যমে অজ্ঞাত কেউ হস্তলিপিতে লেখকের নাম সংযুক্ত করেছে। ঘষা-মাজা করে নাম সংযুক্ত করার পরও বর্তমানে প্রচলিত লেখকের নাম উক্ত হস্তলিপিতে নেই। বরং প্রচলিত লেখকের পিতার নাম ও তার মৃত্যু তারিখ দেয়া রয়েছে।

 চূড়ান্ত কথা:

ইবনে আবিল ইয এধরণের ব্যাখ্যাগ্রন্থ লেখাটা অসম্ভব নয়। প্রবল ধারণা মতে হয়ত তিনি এটি লিখেছেন। কিন্তু ইবনে ইয এর লেখক হওয়ার ব্যাপারে অকাট্য কোন প্রমাণ কারও কাছে নেই, যার আলোকে নি:সন্দেহে বলা যাবে, এটি ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী লিখেছেন। ইবনে আবিল ইয আল-হানাফীর জীবনী থেকে একটা ধারণা সৃষ্টি হয়, হয়ত তিনি এটি লিখেছেন। আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. এর উদ্ধৃতি থেকে হয়ত ধারণাটি আরেকটু মজবুত হয়। কিন্তু এটা সুনিশ্চিত বা অকাট্য কোন প্রমাণ বলার সুযোগ নেই। উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের লেখক ইবনে আবিল ইয হলেও আমাদের কোন আপত্তি নেই। না হলেও এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই। কিতাবটি ছেলে লিখেছে না কি তার পিতা লিখেছে সেটাও মৌলিক কোন বিষয় নয়।

 আমাদের নিকট মূল বিবেচ্য বিষয় হল, ইবনে আবিল ইযকে হানাফী হিসেবে প্রচার করা হয়। সেই সাথে এটাও বোঝানো হয় যে, তিনি হানাফীদের আকিদার প্রতিনিধত্ব করেন। অন্যান্য হানাফীগণ তার বিরোধীতা করে মূলত: হানাফীদের মৌলিক আকিদার বিরোধিতা করে থাকে।

আমাদের সামনে মৌলিক কয়েকটি প্রশ্ন দেখা দিয়েছে,

১. ইবনে আবিল ইয বাস্তবেই কি হানাফী ছিলেন?

২. তিনি আদৌ কি হানাফী মাজহাবের সুপ্রতিষ্ঠিত আকিদার অনুসারী ছিলেন?৩. তার লেখা ব্যাখ্যাগ্রন্থ ইমাম ত্বহাবী বা হানাফী মাজহাবের মৌলিক আকিদার প্রতিনিধিত্ব করে কি?৪. ইবনে আবিল ইযের আকিদা হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমদের নিকট নির্ভরযোগ্য কি?

৫. ইবনে আবিল ইযকে হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণ নির্ভরযোগ্য আলেম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন কি?

৬. হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণ ইবনে আবিল ইযের আকিদার সাথে সহমত পোষণ করেন না কি তার প্রবল বিরোধীতা করেন?

৭. হানাফী মাজহাবের উলামায়ে কেরামের জীবনীর উপর বিভিন্ন গ্রন্থ লেখা হয়েছে। এসকল কিতাবে হানাফী আলেম হিসেবে তার জীবনী বা নির্ভরযোগ্য আলেম হিসেবে কোথাও  তস্বীকৃতি দেয়া হয়েছে কি?আমরা ইনশাআল্লাহ প্রত্যেকটি বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করব। 

ইবনে আবিল ইযের মাজহাব:

শরহে আকিদাতু ত্বহাবীর তাহকীক করেছেন, শায়খ শুয়াইব আরনাউত ও শায়খ আব্দুল্লাহ তুরকী। তারা উক্ত তাহকীকে ইবনে আবিল ইযের জীবনী আলোচনা করেছেন। তার জীবনী আলোচনা করতে গিয়ে তারা লিখেছেন, ইবনে আবিল ইযকে হানাফী মাজহাবের দিকে সম্পৃক্ত করা হয়। তবে বাস্তবে তিনি নিজের গর্দানকে তাকলীদের (মাজহাব অনুসরণ) বন্ধন থেকে মুক্ত করেন।  শায়খ শুয়াইব আরনাউত ও শায়খ আব্দুল্লাহ তুরকীর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ইবনে আবিল ইয একজন গাইরে মুকাল্লিদ, লা-মাজহাবী বা যাহেরী ছিল। 

ইবনে আবিল ইয পারিবারিকভাবে হানাফী ছিল। যেমন শায়খ আলবানী পারিবারিকভাবে হানাফী ছিল। কিন্তু কেউ হানাফী পরিবারে জন্মগ্রহণ করলে, কিংবা হানাফী মাদ্রাসায় পড়লে বা পড়ালে সে হানাফী হয়ে যায় না। আমাদের দেশের অধিকাংশ লা-মাজহাবী হানাফী পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও তারা গাইরে মুকাল্লিদ। একইভাবে বর্তমানে আহলে হাদীসদের অধিকাংশ শায়খ হানাফী মাজহাবের মাদ্রাসায় পড়া-লেখা করেছে, কিন্তু তারা হানাফী নয়। সুতরাং কারও হানাফী হওয়াটা তার পরিবার, পিতা-মাতা বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করে না। ইবনে আবিল ইয জন্মগতভাবে হানাফী হলেও বাস্তবে সে হানাফী নয়। বরং  ইবনে আবিল ইয একজন গাইরে মুকাল্লিদ বা লা-মাজহাবী।সুতরাং তাকে হানাফী হিসেবে প্রচার করে তাকে হানাফী মাজহাব বা আকিদার প্রতিনিধি হিসেবে প্রকাশ করা একটি মারাত্মক ভুল। 

যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেই যে, ইবনে আবিল ইয হানাফী ফিকহের অনুসারী ছিল, কারণ সে হানাফী মাজহাবের মাদ্রাসায় শিক্ষতা করেছে, তাহলে এটি কখনও বলা সম্ভব নয় যে, সে আকিদার দিক থেকেও হানাফী ছিলা। মু’তাজিলা সম্প্রদায়ের অনেকেই হানাফী মাজহাবের অনুসারী ছিল, কিন্তু তাদের কাউকে হানাফী বলা হয় না। একইভাবে কাররামিয়াদের অনেকেই হানাফী মাজহাব অনুসরণ করত। কিন্তু তাদেরকেও হানাফী বলা হয় না। ফিকহের দিক থেকে কেউ হানাফী ফিকহ অনুসরণ করলেই তাকে হানাফী হিসেবে পরিচয় দেয়া হয় না। কারণ হানাফী হিসেবে কারও পরিচিতি এটা প্রমাণ করে যে, সে আকিদা ও ফিকহ উভয় ক্ষেত্রে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অন্তর্ভূক্ত। কেউ যদি ফিকহের ক্ষেত্রে হানাফী মাজহাব অনুসরণ করে, কিন্তু আকিদার ক্ষেত্রে আহলে সু্ন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত আকিদা পোষণ করে তাকে হানাফী বলা হয় না। বরং আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত আকিদার দিকে তাকে সম্পৃক্ত করা হয়। কাররামিয়া মতবাদের অনুসারী কারও নামের শেষে হানাফী লাগিয়ে দিয়ে আকিদা ও ফিকহে তাকে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অন্তর্ভূক্ত করার অপচেষ্টা কেউ করলে সেটি অবশ্যই বাস্তবতা বিরোধী। সুতরাং ফিকহ ও আকিদা উভয় ক্ষেত্রে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত ইবনে আবিল ইযকে কীভাবে হানাফী হিসেবে পরিচয় দেয়া হয়? তার বাহ্যিক অবস্থা বিবেচনা করে হানাফী লিখলেও তাকে যদি কেউ হানাফী ফিকহ বা আকিদার প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন করে, তাহলে অবশ্যই আমরা বলব, প্রকৃতপক্ষে ইবনে আবিল ইয ফিকহ ও আকিদা কোন ক্ষেত্রেই হানাফী ছিল না। বরং সে কাররামিয়াদের অনুসারী হাশাবী বা দেহবাদী আকিদায় বিশ্বাসী ছিল। ইবনে আবিল ইযের যেসকল কিতাব তার দিকে সম্পৃক্ত করা হয়, তার প্রত্যেকটি সে হানাফী মাজহাবের বিরুদ্ধে লিখেছে। হানাফী মাজহাবের পক্ষে তার বিশেষ কোন খেদমত নেই।

ইবনে আবিল ইযের গাইরে মুকাল্লিদ হওয়ার আরেকটি প্রমাণ হল, তার একটি কিতাব বর্তমানের আহলে লা-মাজহাবীরা প্রচার করে থাকে। আহলে হাদীস আলেম আতাউল্লাহ হানীফ ইবনে আবিল ইযের “আল-ইত্তেবা” কিতাবটি তাহকীক করে প্রকাশ করেছে। পরবর্তীতে আবু সুহাইব আসিম ইবনে আব্দুল্লাহ  আল-কারইউতী এটি তাহকীক করেছে। আবু সুহাইব এই কিতাবের ভূমিকায় হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেম আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. ও আল্লামা যফর আহমাদ উসমানী রহ. এর বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছে এবং এসমস্ত বিখ্যাত আলেমদের বিরুদ্ধে ইবনে আবিল ইযের বক্তব্য উপস্থাপন করেছে। যেখানে ইবনে আবিল ইয সুনিদিষ্ট একটি মাজহাবের অনুসারীকে শিয়াদের সাথে তুলনা করেছে। নাউযুবিল্লাহ। ইবনে আবিল ইযের অবস্থা থেকে বাংলা ভাষার প্রসিদ্ধ একটি প্রবাদবাক্য মনে পড়ে গেল।  “মার চেয়ে মাসির দরদ বেশি” ।ইবনে আবিল ইযের প্রতি সালাফী ও আহলে হাদীসদের অতিশয় আগ্রহ এটিই প্রমাণ করে।  বর্তমানের সালাফীরা হানাফী মাজহাবের উলামায়ে কেরামকে তাদের আকিদার বিরোধী হওয়ার কারণে কাফের, বিদযাতী, জাহমী, মুয়াত্তিলা ইত্যাদি আখ্যায়িত করে। এ বিষয়ে অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে।  হানাফী মাজহাবের অধিকাংশ আলেম যাদের কাছে কাফের ও বিদয়াতী, তারাই ইবনে আবিল ইযের আকিদা প্রচার করছে। আবার উপমহাদেশের লা-মাজহাবীরা মাজহাবের অনুসারীদেরকে মুশরিক বলে বিশ্বাস করে, অথচ তারাই আবার ইবনে আবিল ইযের কিতাব প্রকাশ ও প্রচার করছে। ইবনে আবিল ইয আসলেই যদি হানাফী হত, তাহলে হানাফীদেরকে যারা কাফের-মুশরিক আখ্যা দিচ্ছে, তারা কেন তার কিতাব নিয়ে এত মাতামাতি করে?

ইবনে আবিল ইয সম্পর্কে হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণের বক্তব্য:

মোল্লা আলী কারী রহ. এর বক্তব্য:

মোল্লা আলী কারী রহ. শরহে ফিকহুল আকবারে আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যাকার সম্পর্কে লিখেছেন, 

 والحاصل ان الشارح يقول بعلو المكان مع نفي التشبيه وتبع فيه طائفة من أهل البدعة

মোটকথা, আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যাকার  তাশবীহমুক্ত অবস্থায় আল্লাহ তায়ালা স্থানগতভাবে উপরের দিকে রয়েছেন বলে বিশ্বাস করে। এক্ষেত্রে সে একদল বিদয়াতীর অনুসরণ করেছে। তিনি আরও বলেন,

 و من الغريب أنه إستدل على مذهبه الباطل برفع الأيدي في الدعاء إلى السماء

 অর্থ: আশ্চর্যের বিষয় হল, সে তার ভ্রান্ত মতবাদ প্রমাণ করতে গিয়ে দুয়ার সময় হাত উপরের দিকে উঠানোর দলিল দিয়েছে। (শরহুল ফিকহিল আকবার, পৃ.১৭২. আল-ইলিময়া)মোল্লা আলী কারী রহ. এর বক্তব্য থেকে দু’টি বিষয় স্পষ্ট। তিনি ইবনে আবিল ইযকে বিদয়াতীদের অনুসারী বলেছেন। এবং তার মতবাদকে বাতিল বা ভ্রান্ত মতবাদ আখ্যায়িত করেছেন। 

আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্য:

আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিনে ইবনে আবিল ইয সম্পর্কে লিখেছেন,

“ولما تأملته حق التأمل؛ وجدته كلامًا مخالفًا لأصول مذهب إمامه!! وهو في الحقيقة كالرد على أئمة السنة، كأنه تكلم بلسان المخالفين، وجازف وتجاوز عن الحدود، حتى شبه قول أهل السنة بقول النصارى! فليتنبه لذلك”.

অর্থ: আমি  তার (ইবনে আবিল ইযের) বক্তব্য সম্পর্কে পরিপূর্ণ চিন্তা-ভাবনা করে দেখেছি, তার বক্তব্য তার ইমামের মাজহাবের মৌলিক নীতিমালার সম্পূর্ণ বিরোধী। বরং প্রকৃতপক্ষে তার বক্তব্য যেন আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের ইমামগণের বক্তব্য খন্ডনে লিখিত।  তার বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয়, সে যেন আহলে সুন্নতের ইমামগণের সাথে প্রতিপক্ষ হিসেবে কথা বলেছে। সে মারাত্মক বিকৃতির শিকার হয়েছে এবং সীমা অতিক্রম করেছে। এমনকি সে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের ইমামগণের বক্তব্যকে খ্রিষ্টানদের বক্তব্যের সাথে তুলনা করেছে। সুতরাং এ বিষয় সতর্ক থেক। [ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিন, খ.২, পৃ.১৪৬]

আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্য থেকে যেসকল বিষয় স্পষ্ট:

১. ইবনে আবিল ইয হানাফী মাজহাবের মৌলিক নীতিমালা অনুসরণ করত না।

২. তার লেখনী মূলত: হানাফী মাজহাব ও আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের বক্তব্য খন্ডনের উদ্দেশ্যে লিখিত।৩. হানাফী মাজহাব ও আহলে সুন্নতের উলামায়ে কেরামের সাথে যেন সে প্রতিপক্ষ হিসেবে কথা বলেছে।

৪.সে মারাত্মক প্রগলভতার  শিকার হয়ে সীমা অতিক্রম করেছে। 

৫. আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের উলামায়ে কেরামের বক্তব্যকে খ্রিষ্টানদের বক্তব্যের সাথে তুলনা করেছে।

 ৬. আল্লামা যাবিদি রহ. তার এসব বক্তব্যের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেছেন। 

আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. এর বক্তব্য:

হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত ইমাম আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাকার সম্পর্কে বলেন,

وطبع شرح لمجهول ينسب إلى المذهب الحنفي زورا ينادي صنع يده بأنه جاهل بهذا الفن وأنه حشوي مختل العيار

“আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যা হিসেবে একজন অজ্ঞাত ব্যক্তির একটি ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। যাকে বানোয়াটী করে হানাফী মাজহাবের দিকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এ লোকের লেখনী দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করে যে  সে আকিদা সম্পর্কে অজ্ঞ। সে একজন হাশাবী বা দেহবাদী এবং মারাত্মক বিচ্যুতির শিকার। “[আল-হাবী ফি সিরাতিল ইমামিত ত্বহাবী, পৃ. ৩৮]আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. এর বক্তব্য থেকে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট। প্রথমত: ইবনে আবিল ইযকে হানাফী মাজহাবের দিকে সম্পৃক্ত করা একটি বানোয়াট বা মিথ্যা। বাস্তবে সে হানাফী ছিল না। দ্বিতীয়ত: ইবনে আবিল ইয আকিদা বিষয়ে জাহেল বা অজ্ঞ ছিল এবং সে একজন মুজাসসিমা বা দেহবাদী আকিদার অনুসারী হাশাবী ছিল। আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. এর বক্তব্য অনুযায়ী আমরা ইবনে আবিল ইযকে হানাফী না বলে দেহবাদী আকিদার অনুসারী হাশাবী বলতে পারি। 

ইবনে আবিল ইযের সম-সাময়িক আলেমগণের বিরোধীতা:ইবনে আবিল ইযের ভ্রান্ত কিছু বক্তব্য প্রকাশিত হওয়ার তখনকার বিখ্যাত আলেমগণ তার প্রতিবাদ করেন। বিশেষভাবে অন্যান্য তিন মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণের সাথে হানাফী মাজহাবের আলেমগণও তার প্রতিবাদ করেন।

আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহ. তার ‘ইম্বাউল গুমর বি আবনায়িল উমর’ কিতাবে লিখেছেন,

وأن العلماء بالديار المصرية خصوصا أهل مذهبة من الحنفية أنكرواذلك عليه

অর্থ: মিশরের আলেমগণ বিশেষভাবে তার মাজহাব তথা হানাফী মাজহাবের উলামায়ে কেরাম তার বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন। [ইমবাউল গুমর, খ.২, পৃ.৯৬]

যেসব উলামায়ে কেরাম ইবনে আবিল ইযের বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন, এদের মাঝে বিখ্যাত কিছু আলেমের নাম উল্লেখ করেছেন ইবনে হাজার আসকালানী রহ.। যেমন, যাইনুদ্দীন ইবনে রজব রহ, তকীউদ্দীন ইবনে মুফলিহ রহ. শরফুদ্দীন ইবনে গাজ্জী রহ. ।

বর্তমানে সালাফীরা ইবনে আবিল ইযের আরেকটি কিতাব প্রকাশ করেছে। কিতাবের নাম হল, আত-তাম্বীহ আলা মুশকিলাতিল হিদায়াহ। সালাফী আলেমরা ইবনে আবিল ইযের রচনা হিসেবে এটি প্রকাশ করেছে। যদিও কিতাবটি ইবনে আবিল ইযের নাকি তার দাদার এটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সালাফীদের বক্তব্য অনুযায়ী কিতাবটি যদি ইবনে আবিল ইযের হয়, তাহলে তার সম্পর্কে হানাফী মাজহাবের আরও কিছু উলামায়ে কেরামের বক্তব্য শুনুন। 

ইমাম সাখাবী রহ. তার আজ-জাওউল লামে কিতাবে লিখেছেন, হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত ইমাম কাসেম ইবনে কুতলুবুগা ইবনে হেদায়া কিতাবের উপর ইবনুল ইযের অভিযোগ খন্ডন করে কিতাব লিখেছেন। “صنّف “أجوبةً عن اعتراضات ابن العزّ على الهداية”[আজ-জাওউল লামে, খ.৬, পৃ.১৮৭]

সালাফীরা ইবনে আবিল ইযের উক্ত কিতাবকে হেদায়ার ব্যাখ্যা হিসেবে প্রচারের চেষ্টা করলেও এটি মূলত: হেদায়া কিতাবের উপর তার অভিযোগ সংকলন। একারণে আল্লামা কাসেম ইবনে কুতলুবুগা তার অভিযোগ খন্ডন করেছেন। একইভাবে আল-বাহরুর রায়েকে রয়েছে ফাতহুল কাদীরে আল্লামা ইবনুল হুমাম ইবনুল ইযের বক্তব্য খন্ডন করেছেন।

 وَقَدْ أَطَالَ فِي فَتْحِ الْقَدِيرِ فِي بَيَانِهِ إطَالَةً حَسَنَةً وَتَعَرَّضَ لِلرَّدِّ عَلَى ابْنِ الْعِزِّ، وَلَسْنَا بِصَدَدِ ذَلِكَ

[আল-বাহরুর রায়েক, বাবুল ইয়ামীন ফিল আকলি ওয়াশ শুরব]

সালাফীদের বক্তব্য অনুযায়ী আত-তাম্বীহ আলা শরহিল হেদায়া কিতাবটি যদি আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাকার ইবনে আবিল ইযের হয়, তাহলে তার বক্তব্য আল্লামা হাসকাফী ও আল্লামা ইবনে আবিদীন খন্ডন করেছেন। তার বক্তব্যকে গরীব (আশ্চর্যজনক) আখ্যা দিয়েছেন। বিস্তারিত,

 “قال (ابن العز!): فحينئذ ينقض الوضوء، وهو فرع غريب وتخريج ظاهر.قال المصنف: ولظهوره عوّلنا عليه.قلت: قال شيخنا الرملي حفظه الله تعالى: كيف يعول عليه وهو مع غرابته لا يشهد له رواية ولا دراية، أما الاولى فظاهر إذا لم يرو عن أحد ممن يعتمد عليه، وأما الثانية فلعدم تسليم المقدمة الاولى ويشهد لبطلانها مسألة الجدي إذا غذي بلبن الخنزير فقد عللوا حل أكله بصيرورته مستهلكا لا يبقى له أثر، فكذلك نقول في عرق مدمن الخمر، ويكفينا في ضعفه غرابته”.[রদ্দুল মুহতার, খ.৬, পৃ.১৪৬-১৪৭]

আকিদার ক্ষেত্রে ইবনে আবিল ইযের বিচ্যুতি সুস্পষ্ট। অধিকাংশ বিষয়ে সে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত আকিদা পোষণ করে। এবং কাররামিয়া ও মুজাসসিমাদের ভ্রান্ত বক্তব্য প্রচার করেছে। আকিদাতুত ত্বহাবীর সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা ভিডিও আকারে প্রকাশের নিয়ত রয়েছে। আমাদের আলোচনায় ইবনে আবিল ইযের ভ্রান্ত মতবাদগুলি বিস্তারিত উল্লেখ করা হবে ইনশাআল্লাহ। এখানে সংক্ষেপে দু’একটি বিষয় উল্লেখ করা মুনাসিব মনে করছি। এসকল বিষয়ের কয়েকটি কুফুরী পর্যায়ের। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করেন। 

১. কিছু সৃষ্টি কাদীম বা অবিনশ্বর। অনাদী থেকেই বিদ্যমান। এটি তাসালসুলুল হাওয়াদিস নামে পরিচিত। [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.১২৯, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]

২. আল্লাহ তায়ালার হদ বা সীমা রয়েছে।  [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.২১৯, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]

৩. আল্লাহর সত্তার মাঝে নশ্বর বিষয় সৃষ্টি হয়।  [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.১৭৭, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]

৪. আল্লাহর বক্তব্যের অক্ষর ও শব্দ রয়েছে।  [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.১৬৯, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]

৫. আল্লাহ তায়ালা স্থানগতভাবে উপরের দিকে রয়েছেন। অর্থাৎ আল্লাহর দিক রয়েছে। 

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে দেহবাদী আকিদার ভ্রান্তি থেকে হেফাজত করুন। আমীন।

------ ------

আক্বিদা

আল্লাহ তায়ালার এককত্বের প্রমাণ

ইজহারুল ইসলাম শনি, 23 নভে., 2024

ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের মাঝে সর্বপ্রধান বিষয় হল, আল্লাহর তাওহীদ তথা একত্বের উপর ঈমান আনয়ন করা। এই বিশ্বাস করা যে, সৃষ্টা হিসেবে তিনি একক, গুণাবলীর বিবেচনায় তিনি একক এবং উপাসনার যোগ্য একমাত্র তিনিই। পবিত্র কুরআন ও রাসূল (সঃ) এর সমস্ত হাদীস তাওহীদ তথা আল্লাহর এককত্বের উপর ভিত্তি করেই আবর্তিত। কোন বিষয়ে আল্লাহর সমকক্ষ বা অংশীদার নেই, এটিই এ বিশ্বাসের মূলমন্ত্র। পবিত্র কুরআনের ১১২ নং সূরায় এ বিষয়টি সুষ্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষিত হয়েছে। সে প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর অস্তিত্ব অনুভব করে এবং আল্লাহর এককত্বের স্বাক্ষর প্রদান করে।

আমরা এখানে আল্লাহর এককত্বের উপর পাঁচটি যুক্তি উপস্থাপন করব।

অকহ্যাম রেজর এর তত্ত্ব

কুরআন স্পষ্টভাষায় জিজ্ঞাসা করেছে, এই মহাবিশ্ব কি এমনিতেই সৃষ্টি হয়েছে? এর উত্তর খুবই সহজ ও স্পষ্ট। কেননা ভৌত পদার্থবিদ্যা এবং সকল দর্শন এবিষয়ে একমত যে, যে বস্তু অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এসেছে, তার অস্তিত্বের পিছে একটি কজ বা কারণ রয়েছে। আর মহাবিশ্ব যেহেতু অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এসেছে এজন্য এর পিছে একটি কারণ বা কজ রয়েছে। মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পিছে একটি সামগ্রিক কজ বা কারণ থাকাটাই যুক্তিযুক্ত। অসীম সংখ্যক কারণ থাকাটা অসম্ভব। কেননা বাস্তবে কখনও অসীম কোন কিছু থেকে আমরা কোন ফলাফল লাভ করি না।

উদাহরণ হিসেবে নীচের দু’টি বিষয় লক্ষ্য করুণ-

১. কোন কক্ষে যদি অসীম সংখ্যক মানুষ থাকে এবং সেখান থেকে যদি আমি দু’জনকে বাদ দেই, তাহলে কতজন থাকবে? আপনি উত্তর দিবেন, অসীম বিয়োগ দুই। অর্থাৎ অসীম থেকে দু’জনকে বাদ দিলে যা থাকে। এর দ্বারা বাস্তবে কোন অর্থ বোঝায় কি? অসীম থেকে যদি দুজনকে বাদ দেয়া হলেও কক্ষে অসীম সংখ্যক মানুষই থেকে যাবে। বাস্তবে এটি বিশেষ কোন অর্থ প্রদান করে না। আপনাকে যদি কক্ষের অসীম সংখ্যক লোক গণনা করতে বলা হয়, আপনার পক্ষে তা গণনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু লোকসংখ্যা যদি অসীম থেকে সামান্য কমিয়ে গণনা করতে বলা হয়, তবুও আপনার পক্ষে তা গণনা করা সম্ভব নয়। এর অর্থ হল, বাস্তব জীবনে অসীম সংখ্যা থেকে বিশেষ অর্থ বোঝা সম্ভব নয়। 

২. মনে করুন, আমি একজন সৈনিক। আমি একটা শত্রুকে গুলি করতে চাই। আমার গুলি করার জন্য আমার পেছনের সৈনিকের অনুমতি নেয়া প্রয়োজন। আমার পিছের সৈনিকের জন্য আবার তার পেছনের সৈনিকের অনুমতি প্রয়োজন। এভাবে এ ধারা যদি চলতে থাকে এবং আমার গুলি করার জন্য অসীম সংখ্যক সৈনিকের অনুমতির প্রয়োজন হয়, তবে আমি কি আদৌ শত্রুকে গুলি করতে পারব? উত্তর খুবই সহজ ও স্বাভাবিক। একইভাবে আমি মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পিছে যদি অসীম সংখ্যক কারণ ধরে নেই, তবে আদৌ মহাবিশ্বের অস্তিত্ব সম্ভব হত না। এবং কখনও এটি অস্তিত্বে আসত না। সুতরাং মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পিছে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বাধীন ও একক কারণ থাকাটাই যুক্তিসঙ্গত।

আপনি এ যুক্তি দেখাতে পারেন যে, উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্য তথা স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বাধীন একাধিক কারণ একই সাথে ক্রিয়াশীল হলে সমস্যা কোথায়? 

আমি বলব, আপনার এ যুক্তিটা খুবই দুর্বল প্রকৃতির। চতুর্দশ শতাব্দীর দার্শনিক অকহ্যাম রেজর এর তত্ত্বের মাধ্যমে আপনার এ যুক্তির অসারতা প্রমাণিত হয়। অকহ্যাম রেজরের নীতি হল, প্রয়োজন ছাড়া বহু সংখ্যার ব্যবহার অনুচিৎ। আরেকটু সহজ করে বললে এভাবে বলা যায়,  সবচেয়ে সরল ও সর্বাধিক অর্থবহ ব্যাখ্যা হল, সর্বোত্তম ব্যাখ্যা।

অতএব, কোন প্রমাণ ছাড়া কিংবা প্রয়োজন ছাড়া আমরা এটা বলতে পারি না যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির পিছে অনেকগুলো কারণ ক্রিয়াশীল। সুতরাং এক্ষেত্রে আমাদেরকে সবচেয়ে অর্থবহ ও সরল কারণ তথা মহাবিশ্ব সৃষ্টির একক কারণকেই গ্রহণ করতে হবে। কেননা এক্ষেত্রে আমাদেরকে কাছে কোন প্রমাণ নেই যে আমরা বলতে পারি, মহাবিশ্বের সৃষ্টি মূলতঃ দুটি, তিনটি, কিংবা কয়েক হাজার কারণের কম্বিনেশন বা সমন্বয়। একাধিক কারণ গ্রহণের দ্বারা একটি স্বাধীন, স্বয়ংসম্পূর্ণ কারণে অতিরিক্ত কোন মাত্রা যোগ হয় না।

যেমন, যখন বলা হল, মহাবিশ্ব একটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কারণের দ্বারা সৃষ্ট, এ কথা দ্বারা যে অর্থ স্পষ্ট হয়েছে, যদি বলা হয়, মহাবিশ্ব দু’টি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কারণের দ্বারা সৃষ্ট, এ কথার দ্বারা অতিরিক্ত কোন অর্থ প্রকাশ পায় না। কেননা আমি যখন বলছি, কারণটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী তখন অন্য কোন সর্বময় ক্ষমতার প্রয়োজন নেই। কারণটি যদি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী না হত, তবে সাহায্যকারী হিসেবে অন্য কোন কারণের প্রয়োজন পড়ত। এক্ষেত্রে কোন কারণই তখন স্বাধীন বা স্বয়ংসম্পূর্ণ কারণ থাকবে না।

সুতরাং মহাবিশ্ব সৃষ্টির পিছে আমাদের মূলতঃ একটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কারণের প্রয়োজন ছিল এবং এটুকুই যথেষ্ট কেননা কারণটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।

২. যৌক্তিক প্রমাণ

যুক্তির দাবি হল, মহাবিশ্ব সৃষ্টি যদি অনেক প্রভূ থাকত, তবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে মহাবিশ্ব ধ্বংস হয়েছে। এবং আমরা মহাবিশ্বে যে সুষম শৃঙ্খলা ও নিয়মতান্ত্রিকতার সর্বোচ্চ সমাবেশ লক্ষ্য করে থাকি, অনেক প্রভূ থাকলে তা পরিলক্ষিত হত না।

আপনি যুক্তি দেখাতে পারেন, আপনার গাড়িটি তৈরি করে অনেক মানুষ। যেমন, কেউ গাড়ীর বডি তৈরি করে, কেউ ইঞ্জিন আবার কেউ চাকা। কিন্তু পূর্ণ গাড়িটি তৈরি হলে সেটি একটি সুন্দর ও সুষম গাড়ি হয়ে থাকে। অতএব, একটি সৃষ্ট বস্তুর অনেক স্রষ্টা থাকলেও সেটি ভারসাম্যপূর্ণ হতে পারে। 

আপনার এ প্রশ্নের উত্তর হল, মহাবিশ্ব সৃষ্টির পিছে আমরা যে কারণটি উল্লেখ করেছি সেটি হল, এমন একজন প্রভূ যিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং ইচ্ছার ক্ষেত্রে এককভাবে স্বাধীন। কেননা প্রভূ তো তিনিই হবেন, যার অসীম প্রয়োগিক ইচ্ছা রয়েছে। যদি অনেক প্রভূ থাকত, তবে প্রত্যেকের ইচ্ছা প্রয়োগের প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হত, আর এটিই মহাবিশ্বে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণ হতো।

আপনি যুক্তি দেখাতে পারেন, এ সম্ভাবনা রয়েছে যে, অনেকগুলো প্রভূ একটি বিষয়ে একমত পোষণ করতে পারে। অথবা এক একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে তাদের পৃথক পৃথক ক্ষমতা থাকবে। এক্ষেত্রে আমরা বলব, এ ধরণের প্রভূর ইচ্ছা অসীম ও স্বাধীন নয়। ফলে এরা প্রভূ হওয়ার যোগ্য নয়। সার কথা হল, যদি দু’জন স্রষ্টা থাকে, এবং তারা কোন বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে, যেমন একজন ক নামক ব্যক্তিকে স্থির রাখতে চাচ্ছে, আরেকজন তাকে গতিশীল করতে চাচ্ছে। অথবা একজন প্রভূ খ কে জীবন্ত প্রাণি বানাতে চাচ্ছে, আরেকজন চাচ্ছে যে, এটি জড়পদার্থ হিসেবে অবস্থান করবে।

যুক্তির আলোকে যদি বিশ্লেষণ করা হয়, তবে এখানে তিনটি অবস্থার কোন একটি ঘটতে বাধ্য-

১. উভয় প্রভূর ইচ্ছা বহাল রাখা হবে এবং তা বাস্তবায়ন করা হবে।

২. শুধু তাদের একজনের ইচ্ছা বহাল রাখা হবে।

৩. তাদের কারও ইচ্ছায় বাস্তবায়ন করা হবে না।প্রথমটি সম্ভব নয়।

কেননা এক্ষেত্রে দু’টি বিপরীত বিষয় একই সাথে অস্তিত্ব লাভ করা আবশ্যক হবে। যা অসম্ভব। অর্থাৎ একই সাথে একটি বস্তু জীবিত ও মৃত হতে পারে না। তৃতীয় বক্তব্যও বাতিল হয়ে যাবে। কেননা এর দ্বারা এটা আবশ্যক হয় যে, একটি বস্তু গতিশীলও না, আবার স্থিরও না। একইভাবে একটি বস্তু জীবিতও না, আবার মৃত না। আর এটি অসম্ভব। সাথে সাথে তাদের কারও ইচ্ছায় যদি বাস্তবায়ন করা না হয়, তখন তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, তাদের কেউ-ই নিজ ইচ্ছা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম নয়। ফলে প্রত্যেকেই প্রভূ হওয়ার যোগ্যতা হারাবে।

দ্বিতীয় বক্তব্য অনুযায়ী, যদি দু’জনের মধ্য থেকে একজনের ইচ্ছা বাস্তবায়ন করা হয়, এবং অপরজনের ইচ্ছা পরিত্যাগ করা হয়, তবে তিনিই হবেন একক প্রভূ। যার ইচ্ছা পরিত্যাগ করা হয়েছে, সে প্রভূ হওয়ার যোগ্য থাকবে না। উপর্যুক্ত বক্তব্য দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, এই ভারসাম্যপূর্ণ মহাবিশ্বের একজন মাত্র প্রভূ থাকা সম্ভব, যিনি অসীম ইচ্ছার অধিকারী এবং একক ক্ষমতার অধিকারী।

৩. ধারণাগত বৈচিত্র

আমরা কিভাবে দু’টি জিনিসকে পরস্পর থেকে পৃথক করে থাকি? দু’জন ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে আমরা তাদের মধ্যে পার্থক্য করি কীভাবে। এর উত্তর হল, আমরা এটা করে থাকি, কনসেপ্চুয়াল ডিফারেনসিয়েশন বা ধারণাগত বৈচিত্রের মাধ্যমে। এই ধারণাগুলো হল, স্থান, পারম্পরিক দূরত্ব, গঠন ও আকার-আকৃতিগত তারতম্য।

আমরা যে কোন দু’টি বস্তুর মাঝে পার্থক্য করতে পারি, তাদের পারস্পরিক দূরত্ব, বর্ণ ও আকার-আকৃতিগত বৈচিত্রের মাধ্যমে। দু’টি বিষয়ের মধ্যে যখন উপরোক্ত বিষয়গুলো না পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে কি আপনি উক্ত বস্তু দু’টির মাঝে কোন পার্থক্য করতে সক্ষম হবেন? আপনি পারবেন না। এবিষয়টি শুধু দু’য়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং অসংখ্য বস্তুর ক্ষেত্রে পার্থক্য নির্ণয় করতে হলে, উপরোক্ত বিষয়গুলো থাকা আবশ্যক। 

প্রাসঙ্গিকভাবে বলে নেয়া আবশ্যক যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি মহাবিশ্ব থেকে বহির্গত হওয়া আবশ্যক। কেননা সৃষ্টির কারণ যদি মহাবিশ্বের ভিতরগত কিংবা মহাবিশ্বেরই কোন অংশ হয়, তখন এর অর্থ হয় যে, মহাবিশ্ব নিজেই নিজের স্রষ্টা। আর এটি অসম্ভব। মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ যেহেতু বহির্গত, আপনি সহজেই অনুমান করতে পারবেন যে, আপনি মহাবিশ্বের বহির্গত বিষয়ের মধ্যে অবস্থান, আকার-আকৃতি ও বর্ণগত পার্থক্য করতে পারবেন না। কেননা এ বিষয়গুলো কেবল মহাবিশ্বের অভ্যন্তরে বিশেষ অর্থ প্রদান করে, এর বাইরে নয়। কেননা উপর্যুক্ত বিষয় তথা দূরত্ব, আকার-আকৃতি বা বর্ণ প্রত্যেকটি সৃষ্ট। মহাবিশ্বের বাইরে সৃষ্ট কোন বস্তু নেই। মহাবিশ্বের বাইরে উপর্যুক্ত বিষয়ের অনুপস্থিতির কারণে সৃষ্টির পিছে ক্রিয়াশীল দু’টি কারণের মধ্যে পার্থক্য করাও সম্ভব নয়। এজন্য সৃষ্টির পিছে দু’টি বা অসংখ্য কারণের কথা বলাটাও ভিত্তিহীন, অযৌক্তি ও ধারণাপ্রসূত একটি বক্তব্য মাত্র। 

৪. অনন্যতা

মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি ইউনিক বা অনন্য হওয়া আবশ্যক। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “তাঁর কোন সমকক্ষ নেই”। মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি যদি অনন্য না হয়, তবে এর অর্থ হবে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ ও মহাবিশ্বের মাঝে একটি সিমিলারিটি বা সাদৃশ্য রয়েছে। কেননা এর দ্বারা এটি প্রমাণিত হয় যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি এর মাঝে রয়েছে। যার অর্থ এই দাঁড়াল যে, মহাবিশ্ব নিজেই নিজের স্রষ্টা। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি মহাবিশ্বের সাদৃশ্যপূর্ণ হতে পারবে না কেন? এর উত্তরটি খুবই সহজ। আমরা জানি মহাবিশ্ব অসংখ্য বস্তুর সমষ্টি। সুতরাং মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি অবশ্যই ইম্যাটেরিয়াল বা বস্তুজগতের ঊর্ধ্বে হতে হবে। নতুবা মহাবিশ্ব নিজেই নিজের স্রষ্টা হওয়া আবশ্যক হবে। সুতরাং বস্তু সৃষ্টির কারণটিও যদি বস্তুর মতো হয়, তবে বস্তু নিজেই নিজের স্রষ্টা হওয়া আবশ্যক, যা অসম্ভব। সুতরাং উপসংহারে আপনাকে অবশ্যই বলতে হবে যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি অবশ্যই ইম্যাটেরিয়াল ও ইউনিক হতে হবে। আমাদের এ বক্তব্যটি স্রষ্টার এককত্বের প্রমাণ হয় কিভাবে? আমরা বলব, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ যদি একাধিক হয়, তবে তার কোনটিই ইউনিক বা অনন্য হবে না। ফলে স্রষ্টা একজন হওয়াটাই নির্দিষ্ট।

৫. ঐশীবাণী

স্রষ্টার এককত্ব প্রমাণের সবচেয়ে সহজ উপায় হল, আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ঐশীবাণীর শরণাপন্ন হওয়া। এক্ষেত্রে যুক্তি হল, কোন বাণীর ব্যাপারে যদি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয় যে, এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত এবং এটি মানব রচিত নয়, তখন এ গ্রন্থের বক্তব্যের ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকে না। সুতরাং আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ঐশী গ্রন্থে আল্লাহ তায়ালা নিজের সম্পর্কে যে তথ্য প্রদান করবেন সেটি নিশ্চিতভাবে সত্য বলে বিবেচিত হবে। 

কেউ যদি আল্লাহ সম্পর্কে অজ্ঞ হয় তবে সে কিভাবে আল্লাহ সম্পর্কে বা তার প্রেরিত কিতাব সম্পর্কে ধারণা অর্জন করবে?

এর দু’টি পদ্ধতি রয়েছে-

১. ইন্টারন্যাল

২. এক্সটারন্যাল

আভ্যন্তরীণভাবে আল্লাহ তায়ালার পরিচয় পাওয়ার অর্থ হল, আপনি আত্মপরীক্ষা বা আত্মদর্শনের মাধ্যমে আল্লাহ সম্পর্কে অবগত হওয়ার চেষ্টা করবেন। অর্থাৎ নিজের আভ্যন্তরীণ শক্তি ব্যবহার করে আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা। আজব ব্যাপার হল, আল্লাহ সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন মানুষের নিজস্ব শক্তির দ্বারা সম্ভব নয়।

এর কিছু মৌলিক কারণ হল,

১. মানুষ সৃষ্টিগতভাবে বৈচিত্রময়। ব্যক্তি বৈচিত্রের এধারাটি মূলতঃ মানুষের মানসিক ভিন্নতারই বহিপ্রকাশ। সাইকোলজিক্যাল ভিন্নতার প্রধান কারণ হল, ডি.এন.এ এর ভিন্নতা, বাস্তব অভিজ্ঞতা, সামাজিক পূর্বসূত্র, বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানার্জনের ক্ষমতা, লিঙ্গের বৈষম্য ইত্যাদি নিয়ামক দ্বারা প্রভাবিত। আত্মদর্শনের মাধ্যমে স্রষ্টা সম্পর্কে ধারণা পেতে এবিষয়গুলো আপনাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে। সুতরাং আপনার আত্মপরীক্ষার মাধ্যমে যে ফলাফল পাওয়া যাবে সেটি অন্যদের থেকে ভিন্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। আপনি নিজেও এই বাস্তবতা উপলব্ধি করবেন যে, উপর্যুক্ত বিষয়ের উপস্থিতিতে আপনি একাকী যদি স্রষ্টা সম্পর্কে ধারণা পেতে চান তবে তা সত্য থেকে অনেক বিচ্যুত হতে পারে। এটি একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ বছর আগে পৃথিবীতে প্রায় ৩৭০০ হাজার দেবতার ধারণা মানুষের মনে জেঁকে বসেছিল।

২. দ্বিতীয় কারণ হল, বাস্তবতার বিবেচনায় মানুষ খুবই সীমাবদ্ধ। এজন্য মানুষ যদি নিজের পক্ষ থেকে স্রষ্টা সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করতে চায়, তবে তা অধিকাংশ সময় ভ্রান্তির কারণ হয়। দার্শনিকগণ ¯্রষ্টার অস্তিত্বের ব্যাপারে কিছু যুক্তিসঙ্গত দার্শনিক তত্ত্ব উপস্থাপন করে থাকেন। তবে তারা স্বতঃসিদ্ধ ও বাস্তব কোন তথ্য দিতে অক্ষম। প্রকৃতপক্ষে যদি আপনি স্রষ্টা সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা অর্জন করতে চান, তবে তা হবে ইঁদুরের পক্ষে হাতির শক্তিমত্তা সম্পর্কে ধারণা অর্জনের মতো হাস্যকর। এজন্য শুধু যুক্তি বা ধারণার উপর ভিত্তি করে স্রষ্টা সম্পর্কে কিছু বলা তার সম্পর্কে মিথ্যাচারের নামান্তর। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, “তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে যা জান না, তা বলো কেন?” সুতরাং আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে আমরা যদি জ্ঞান অর্জন করতে চাই তবে তা অবশ্যই এক্সটারন্যাল বা বহির্গত কোন মাধ্যমে হতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা ঐশীবাণীর মাধ্যমে আমাদেরকে যা জানিয়েছেন, সেটিই হবে বিশুদ্ধ জ্ঞান।

আর পবিত্র কুরআন থেকে আমরা একথা সুনিশ্চিতভাবে জানি যে, আল্লাহ তায়ালা হলেন এক ও অদ্বিতীয়। তার সমকক্ষ কেউ নেই। সুতরাং তার এককত্বের ব্যাপারে আর কোন সন্দেহ থাকে না।

------ ------