আক্বিদা

মৃত্যুপরবর্তী কারামত ও কারামত অস্বীকারকারীদের মনস্তত্ব

ইজহারুল ইসলাম বৃহঃ, 21 নভে., 2024

আমরা বিশ্বাস করি, ওলীদের থেকে মৃত্যুর পূর্বে যেমন কারামত প্রকাশিত হতে পারে, তাদের মৃত্যুর পরেও কারামত প্রকাশিত হতে পারে। এটিই আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের আকিদা। মৃত্যুর পরে কারামত প্রকাশিত হবে না, বা হওয়া অসম্ভব, এজাতীয় ধ্যান-ধারণা রাখা কুরআন ও সুন্নাহের বড় একটি অংশ অস্বীকারের নামান্তর। একইভাবে নবীদের থেকে তাদের জীবদ্দশায় যেমন মু’জিযা প্রকাশিত হতে পারে, তাদের ইন্তেকালের পরেও প্রকাশিত হতে পারে।

কারণ কারামত একমাত্র আল্লাহর ক্ষমতা ও ইচ্ছায় সংঘঠিত হয়। এতে বান্দার ক্ষমতা ও ইচ্ছার কোন প্রভাব নেই। আল্লাহ কখন কার মাধ্যমে কোন কারামতের প্রকাশ ঘটাবেন তিনিই ভালো জানেন। এক্ষেত্রে বান্দা শুধুমাত্র উপলক্ষ। সুতরাং মৃত্যুর পূর্বেও যেমন আল্লাহর ক্ষমতা ও ইচ্ছায় কারামত প্রকাশিত হয়, তেমনি মৃত্যুর পরেও আল্লাহর ইচ্ছা ও ক্ষমতায় কারামত প্রকাশিত হতে পারে।

মূল আলোচনা শুরুর আগে একটি অভিযোগ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা জরুরি মনে করছি। প্রশ্নটি হল, অনেক ভন্ড লোকও তো কারামতের দাবী করে? সত্য ও ভন্ডদের কারামতের মাঝে পার্থক্য কীভাবে করব?

উত্তর: অস্বাভাবিক ঘটনা যে কারও হাতেই ঘটতে পারে। এমনকি দাজ্জালের হাতেও অনেক অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটবে। সে মৃতকে জীবিত করবে। একইভাবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান এদের হাতেও অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটতে পারে। অনেকেই জীন বশীভূত করে এধরনের ঘটনা ঘটিয়ে থাকে। অনেক ভন্ড যেমন, দেওয়ানবাগী, সুরেশ্বরী, আটরশি, চন্দ্রপাড়া, মাইজভান্ডারীরা অনেক করামাতের দাবী করে। কোনটি কারামত আর কোন ভেল্কিবাজী ও শয়তানের কর্মকান্ড, সেটা বোঝার মানদন্ড হল, যে ব্যক্তি থেকে কারামত প্রকাশিত হচ্ছে, সে কুরআন-সুন্নাহের অনুসারী কি না?  সে যদি শরীয়তের পরিপূর্ণ অনুসারী হয়,তাহলে তার নিকট থেকে প্রকাশিত কারামতকে কারামত গণ্য করা হবে।

এ বিষয়ে ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন,

” خرق العادة قد يقع للزنديق بطريق الإملاء والإغواء ، كما يقع للصديق بطريق الكرامة والإكرام ، وإنما تحصل التفرقة بينهما باتباع الكتاب والسنة “

অর্থ: কখনও যিন্দিক বা ধর্মদ্রোহীদের থেকে ভেল্কিবাজীর মাধ্যমে বিভন্ন অপ্রাকৃতিক বিষয় প্রকাশিত হতে পারে। একইভাবে সত্যবাদী বুজুর্গদের থেকে কারামত প্রকাশিত হয়। তবে উভয়ের মাঝে পার্থক্য করা হয় কুরআন ও সুন্নাহের অনুসরণ দ্বারা। (অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাহের অনুসারী হলে, সেটি কারামত, নতুবা সেটি পরিত্যাজ্য)

[ফাতহুল বারী, খ.১২, ৩৮৫]

ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন,

” تجد كثيرا من هؤلاء عمدتهم في اعتقاد كونه وليا لله : أنه قد صدر عنه مكاشفة في بعض الأمور ، أو بعض التصرفات الخارقة للعادة ، مثل أن يشير إلى شخص فيموت ؛ أو يطير في الهواء إلى مكة ، أو غيرها ، أو يمشي على الماء أحيانا ؛ أو يملأ إبريقا من الهواء ؛ أو ينفق بعض الأوقات من الغيب ، أو أن يختفي أحيانا عن أعين الناس ؛ أو أن بعض الناس استغاث به وهو غائب أو ميت فرآه قد جاءه فقضى حاجته ؛ أو يخبر الناس بما سرق لهم ؛ أو بحال غائب لهم ، أو مريض ، أو نحو ذلك من الأمور .

وليس في شيء من هذه الأمور ما يدل على أن صاحبها ولي لله . بل قد اتفق أولياء الله على أن الرجل لو طار في الهواء ، أو مشى على الماء ، لم يغتر به حتى ينظر متابعته لرسول الله صلى الله عليه وسلم ، وموافقته لأمره ونهيه .

وكرامات أولياء الله تعالى أعظم من هذه الأمور ؛ وهذه الأمور الخارقة للعادة – وإن كان قد يكون صاحبها وليا لله – فقد يكون عدوا لله ؛ فإن هذه الخوارق تكون لكثير من الكفار والمشركين وأهل الكتاب والمنافقين ، وتكون لأهل البدع ، وتكون من الشياطين .

فلا يجوز أن يظن أن كل من كان له شيء من هذه الأمور أنه ولي لله ؛ بل يعتبر أولياء الله بصفاتهم وأفعالهم وأحوالهم التي دل عليها الكتاب والسنة ، ويعرفون بنور الإيمان والقرآن ، وبحقائق الإيمان الباطنة ، وشرائع الإسلام الظاهرة ” .

অর্থ: অনেককে দেখতে পাবে, তাদের নিকট কেউ ওলী বা বুজুর্গ হওয়ার মানদন্ড হল, তাদের কাছ থেকে কিছু কাশফ প্রকাশিত হওয়া। অস্বাভাবিক ও অপ্রাকৃতিক ঘটনা সংঘঠিত হওয়া। যেমন, কারও দিকে ইঙ্গিত করলে সাথে সাথে মৃত্যুবরণ করা।  অথবা বাতাসে উড়ে মক্কায় বা অন্য কোথাও যাওয়া । অথবা কখনও পানির উপর হাটা। বাতাস থেকে পাত্র পানি দ্বারা পূর্ণ করা। অদৃশ্য থেকে টাকা-পয়সা এনে খরচ করা।  অথবা হঠাৎ মানুষের চোখ থেকে অদৃশ্য হওয়া। অথাব তার অনুপস্থিতে কিংবা তার মৃত্যুর পরে তাকে কেউ ডাক দিলে উপস্থিত হওয়া এবং ঐ ব্যক্তির প্রয়োজন পুরণ করা।  মানুষের চুরি হয়ে যাওয়া জিনিসের সংবাদ বলে দেয়া। অদৃশ্য কোন বিষয়ের বর্ণনা দেয়া। অসুস্থ কারও সম্পর্কে সংবাদ দেয়া। ইত্যাদি।

এগুলোর কোনটি সংগঠিত হওয়া কখনও এটা প্রমাণ করে না যে, এ ব্যক্তি আল্লাহর ওলী।  বরং সমস্ত ওলী-বুজুর্গ এ বিষয়ে একমত যে, কেউ যদি বাতাসে উড়ে, পানির উপর চলে তাহলে দেখতে হবে, সে রাসূল স. এর  প্রকৃত অনুসারী কি না? শরীয়তের প্রকাশ্য বিধি-বিধান সে অনুসরণ করছে কি না? যদি এগুলো না থাকে তাহলে তার মাধ্যমে ধোকায় পড়া যাবে না। ওলীদের কারামত এসব বিষয় থেকে অনেক বড়।  এধরনের অস্বাভাবিক বিষয় যার থেকে প্রকাশিত হয়, সে কখনও আল্লাহর ওলী হতে পারে, আবার আল্লাহর শত্রুও হতে পারে।  কেননা এধরনে বিষয় অনেক কাফের, মুশরিক, আহলে কিতাব ও মুনাফিক থেকে প্রকাশিত হয়ে থাকে। অনেক বিদয়াতী থেকে এগুলো প্রকাশিত হয়। কখনও এগুলো শয়তানের পক্ষ থেকে হয়ে থাকে।

সুতরাং এই ধারণা করা সমীচিন নয় যে, এধরনের কোন ঘটনা কারও থেকে প্রকাশিত হলেই সে আল্লাহর ওলী। বরং কোন ব্যক্তিকে তার গুণাবলী, কুরআন-সুন্নাহের অনুসরণের দ্বারা আল্লাহর ওলী গণ্য করা হবে। ইমানের নূর ও কুরআনের নূর দ্বারা তাদেরকে চেনা সম্ভব। এবং বাতেনী ইমানের হাকিকত দ্বারা তাদের বাস্তবতা অনুধাবন করা হয়। সেই সাথে প্রকাশ্য শরীয়তের বিধি-বিধান ওলী হওয়ার অপরিহার্য অংশ।

[মাজমুয়াতুল ফাতাওয়া, খ.১১, পৃ.২১৩]

ইবনে তাইমিয়া রহ. এর দীর্ঘ এ বক্তব্যটি দু’টি উদ্দেশ্য এখানে উল্লেখ করেছি।

 প্রথমত: ভন্ডদের কারামতের দাবীর বাস্তবতা অনুধাবন। আমাদের দেশের যেসব বিদয়াতীরা কারামতের দাবী করে, তাদের সকলেই প্রকাশ্য শরীয়ত বিরোধী হারাম ও গর্হিত কাজে লিপ্ত । সুতরাং এদের থেকে বাস্তবে কোন অস্বাভাবিক কাজ প্রকাশিত হলেও এরা ভন্ড। কখনও এরা বুজুর্গ নয়। এদের থেকে প্রকাশিত অস্বাভাবিক বিষয় কখনও কারামতের মর্যাদা পাবে না।

দ্বিতীয়ত: ইবনে তাইমিয়া রহ. কিছু অস্বাভাবিক ঘটনার উদাহরণ দিয়েছেন, যেগুলো অপ্রাকৃতিক ঘটনা হিসেবে ঘটতে পারে। তিনি স্পষ্টভাষায় বলেছেন, ওলীদের কারামত এসব উদাহরণ থেকেও অনেক বড়। ইবনে তাইমিয়া রহ. যেসব উদাহরণ দিয়েছেন, এর মাঝে আমাদের আলোচ্য বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি উদাহরণ রয়েছে। সেটি হল, কোন মৃত ব্যক্তি উপস্থিত হওয়া। একজন মৃতব্যক্তি কারও সামনে উপস্থিত হওয়াটা সম্ভব। এটি কারামত হিসেবে যে কোন ওলীর ক্ষেত্রে ঘটতে পারে। এধরনের কারামত প্রকাশিত হওয়া শরীয়তে অসম্ভব নয়। বরং এর চেযে বড় কারামত সংঘঠিত হতে পারে। ইবনে তাইমিয়া রহ. এর বক্তব্য থেকে বিষয়টি সুস্পষ্ট।

আমরা বেশ কয়েক পর্বে মৃত্যুপরবর্তী কারামতসমূহ বিশুদ্ধ উৎস থেকে আলোচনা করব। সালাফে-সালেহীন ও মুহাদ্দিসগণের কিতাব থেকে বিভিন্ন ঘটনা উদ্ধৃত করবো। বিশেষভাবে ইবনে কাসীর রহ. এর আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া থেকে, ইবনুল কাইয়্যিম রহ. এর কিতাব থেকে, ইবনে তাইমিয়া রহ. , বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনে আবিদ দুনিয়া রহ. এর কিতাব থেকে এগুলো উল্লেখ করবো।

এধরণের ঘটনা তাদের কিতাবে উল্লেখ করার অর্থই হল, তারা এটাকে কোনভাবেই শরীয়ত বিরোধী মনে করেন না। এগুলো ঘটা সম্ভব এবং আহলে সুন্নতের আকিদার অনুগামী, এজন্যই তারা এগুলো উল্লেখ করেছেন। এগুলো কুফুরী-শিরকী হওয়া তো অকল্পনীয়। সুতরাং এগুলো যদি শরীয়ত বিরোধী বা কুফুরী-শিরকী হতো, তাহলে তারা কখনও স্বেচ্ছায় এধরনের কুফুরী-শিরকী কাজে লিপ্ত হতেন না। বিশেষভাবে যুগ যুগ ধরে বিখ্যাত ইমামগণ একের পর এক এগুলো কখনও তাদের কিতাবে বর্ণনা করতেন না। সুতরাং এসব ঘটনা যদি, কুফুরী-শিরকী হয়, তাহলে যারা এগুলো উল্লেখ করেছেন, তাদের উপর যেমন কুফুরী-শিরকের অপবাদ দেয়া হয়, তেমনি পরবর্তী যেসব আলেম এসব থেকে বিভিন্ন ঘটনা উদ্ধৃত করেছেন, তারা কুফুরী-শিরকীতে লিপ্ত হয়েছেন। অথচ এটি একটি অকল্পনীয় বিষয়।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনে আবিদ দুনিয়া রহ.  ( ২০৮-২৮১ হি:)  একটি বিখ্যাত কিতাব লিখেছেন। কিতাবের নাম, মান আশা বা’দাল মাউত (মৃত্যুর পরে যারা জীবিত হয়েছেন)। এই কিতাবটি একজন বিখ্যাত সালাফের। যিনি মুহাদ্দিস হিসেবে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য।পরবর্তীতে ইমাম বাইহাকী, ইবনে কাসীর, জালালুদ্দীন সূযূতী, ইবনে রজব হাম্বলীসহ অসংখ্য মুহাদ্দিস ও আলেম তার কিতাব থেকে বিভিন্ন ঘটনা উদ্ধৃত করেছেন। সুতরাং মৃত্যুপরবর্তী কারামতে বিশ্বাস স্থাপন যেমন সালাফের মানহাজ, তেমন পরবর্তী আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য।

আমাদের দেশে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত একদল বস্তুবাদীদের আবির্ভাব হয়েছে, যারা কুরআন-হাদীস অনুসরণের ছদ্মবেশে কারামতকে কুফুরী-শিরকী হওয়ার মতো জঘন্য বিষয় সমাজে প্রচার করছে। এরা নিজেদেরকে আহলে হাদীস ও সালাফী হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। কারামত অস্বীকারকারী এই বস্তুবাদী দলটি বিভিন্ন সময়ে তাদের খোলস পরিবর্তন করেছে।  কারামত বিষয়ে বর্তমানের সালাফী ও আহলে হাদীস ভাইয়েরা  তাদের অসুরর্ণীয় আলেমদের থেকেও নিজেদেরকে মুক্ত ঘোষণা করেছে। এরা নিজেদেরকে ইবনে তাইমিয়া রহ. ও ইবনুল কাইয়্যিম রহ. ও মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাব নজদীর অনুসারী হিসেবে প্রকাশ করে থাকে। অথচ কারামত বিষয়ে এদের থেকে মুক্ত হয়ে অনেক ক্ষেত্রে এসব শায়খদেরকেও কুফুরী-শিরকের অপবাদ দিচ্ছে। বস্তুপূজারী এই ভয়ংকর ফেতনাটি এতটা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, আফগান মুজাহিদদের বিশ্বস্ত কারামতকেও এরা হাশি-তামাশার বস্তু বানিয়েছে। এদের এই অবস্থানটি বস্তুবাদ ও নাস্তিকতার পূর্বলক্ষণ। কেননা, যেসব ঘটনাকে তারা কুফুরী-শিরকী আখ্যা দিচ্ছে, হুবহু একই ধরনের ঘটনা কুরআন ও হাদীসে রয়েছে। সুতরাং এসব ঘটনাকে কুফুরী শিরকী বলার অর্থ কুরআন ও হাদীসকে পরোক্ষভাবে কুফুরী শিরকী বলা। যেটা পরোক্ষ নাস্তিকতার একটি অংশ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইবনে আবিদ দুনিয়া  রহ. একটি কারামত উল্লেখ করেছেন। এক ব্যক্তির গাধা মৃত্যুবরণ করলে সে আল্লাহর কাছে দুয়া করার পর সেটি আল্লাহ তায়ালা জীবিত করে দেন।  এখন আমাদের এই আহলে হাদীস ভাইদের নিকট এটি কুফুরী। এটি যদি কুফুরী হয়, তাহলে পবিত্র কুরআনে হযরত উযাইর রা. এর গাধা জীবিত হওয়ার ঘটনা কুফুরী নয় কেন? উভয়ের মাঝে পার্থক্যটা কী?

এধরনের বিভিন্ন বিষয় কারামত অস্বীকারকারীদের মনস্তত্ব শিরোনামে পূর্বে আলোচনা করেছি। নব্য এই ফেতনা মোকাবেলার জন্য সেগুলো পড়ার অনুরোধ করছি। এই সিরিজে ইনশাআল্লাহ মৃত্যুপরবর্তী কারামত সম্পর্কে বিস্তারিত ঘটনা উল্লেখ করব। দ্বিতীয় পর্ব এসব বিষয়ে বিভিন্ন ঘটনা ও অস্বীকারকারীদের মনস্তত্ব তুলে ধরবো। ইনশা আল্লাহ।

কারামত অস্বীকারকারীদের মনস্তত্ব হল, যাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদের পক্ষ থেকে কারামত সংগঠিত হওয়া সম্ভব নয। তাদের মতে মৃত্যুপরবর্তী কারামতে বিশ্বাস কুফুরী। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একজন মৃত্যুবরণ করেছেন। তার কবর থেকে সালামের উত্তর শোনা সম্ভব নয়। এটা ভ্রান্ত ও কুফুরী। তাকে কবরের মাঝে সরাসরি দেখতে পাওয়া অথবা কবর থেকে তার হাতবের হতে পারে, এধরনের বিশ্বাস রাখা শিরক। কারামত অস্বীকারকারীরা এগুলোকে কুফুরী ও শিরকী আকিদা বলে থাকেন। বিশেষভাবে মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে দুনিয়াতে যে কোন ধরনের ঘটনা প্রকাশিত হওয়া তাদের নিকট কুফুরী ও শিরক। এটা হল, তাদের মৌলিক বিশ্বাস।  

হায়াতুন্নবী বাহাসে কারামত অস্বীকারকারী মুরাদ বিন আমজাদ ও তার সঙ্গীরা এধরনের কারামতকে কুফুরী শিরকী আখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছে। তাদের মতে এগুলো ভ্রান্ত আকিদ। এগুলো ছাটাই করার  মিশনে নেমেছেন তথাকথিত আহলে হাদীস ও সালাফীরা । আল্লাহ এসব কারামত অস্বীকারকারীদের ফেতনা থেকে উম্মাহকে হেফাজত করু।

আমরা আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত বিশ্বাস করি, আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা ও ক্ষমতায় কারামত সংঘঠিত হয়। সুতরাং কেউ মৃত্যুবরণ করলে আল্লাহ তায়ালা তার রুহ, দেহ বা প্রতিচ্ছবির মাধ্যমে যে কোন কারামত প্রকাশ করতে সক্ষম। এধরনের কোন মৃত ব্যক্তি থেকে দুনিয়াতে কোন কারামত প্রকাশিত হলে এটি সম্পূর্ণ শরীযতসম্মত। বিকৃত মস্তিষ্কের কারামত অস্বীকারকারীই কেবল এধরনের কারামতকে অস্বীকার করতে পারে। নতুবা কুরআন-হাদীস ও সালাফ থেকে এধরনের অসংখ্য ঘটনা বর্ণিত আছে।

উদাহরণ হিসেবে নিজের ঘটনাগুলো লক্ষ্য করুন।

১. হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল স. বলেন,

حَدَّثَنَا إِسْحَاقُ بْنُ إِسْمَاعِيلَ ، حَدَّثَنَا وَكِيعٌ ، وَعَبْدُ اللَّهِ بْنُ نُمَيْرٍ , عَنِ الرَّبِيعِ بْنِ سَعْدٍ الْجُعْفِيِّ ، عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ سَابِطٍ ، عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ ، قَالَ : قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ” حَدِّثُوا عَنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ ، فَإِنَّهُ كَانَتْ فِيهِمُ الأَعَاجِيبُ ، ثُمَّ أَنْشَأَ يُحَدِّثُ ، قَالَ : خَرَجَتْ رُفْقَةٌ مَرَّةً يَسِيرُونَ فِي الأَرْضِ فَمَرُّوا بِمَقْبَرَةٍ ، فَقَالَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ : لَوْ صَلَّيْنَا رَكْعَتَيْنِ ثُمَّ دَعَوْنَا اللَّهَ لَعَلَّهُ يُخْرِجُ لَنَا بَعْضَ أَهْلِ هَذِهِ الْمَقْبَرَةِ فَيُخْبِرُنَا عَنِ الْمَوْتِ ، قَالَ : فَصَلُّوا رَكْعَتَيْنِ ثُمَّ دَعَوْا ، فَإِذَا هُمْ بِرَجُلٍ خِلاسِيٍّ قَدْ خَرَجَ مِنْ قَبْرٍ يَنْفُضُ رَأْسَهُ ، بَيْنَ عَيْنَيْهِ أَثَرُ السُّجُودِ ، فَقَالَ : يَا هَؤُلاءِ مَا أَرَدْتُمْ إِلَى هَذَا ؟ لَقَدْ مِتُّ مُنْذُ مِائَةِ سَنَةٍ فَمَا سَكَنَتْ عَنِّي حَرَارَةُ الْمَوْتِ إِلَى السَّاعَةِ ، فَادْعُوا اللَّهَ أَنْ يُعِيدَنِي كَمَا كُنْتُ ” .

“তোমরা বনী ইসরাইলদের ঘটনা বর্ণনা করো। কেননা তাদের মাঝে অনেক আশ্চর্যজনক ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। এরপর রাসূল স. একটি ঘটনা বর্ণনা করলেন,

একদা বনী ইসরাইলের কয়েকজন বন্ধু ভ্রমণে বের হল।  তারা একটি কবরস্থান দিয়ে অতিক্রম করছিল । তারা একে -অপরকে বলল, “আমর যদি, দু’রাকাত নামায আদায় করে আল্লাহর কাছে দুয়া করি, তাহলে আল্লাহ তায়ালা হয়তো কবরের কোন ব্যক্তিকে আমাদের সামনে উপস্থিত করবেন। সে মৃত্যু সম্পর্কে আমাদেরকে বলবে।

তারা দু’রাকাত নামায আদায় করল। এরপর আল্লাহর কাছে দুয়া করল। হঠাৎ এক ব্যক্তি মাথা থেকে মাটি পরিষ্কার করতে করতে কবর থেকে বের হয়ে এল। তার কপালে সিজদার চিহ্ন ছিল।  সে বলল, তোমরা কী চাও? আমি একশ বছর পূর্বে মৃত্যুবরণ করেছি। এখনও আমার দেহ থেকে মৃত্যুর যন্ত্রনা উপশমিত হয়নি।  আল্লাহর কাছে দুয়া করো, যেন তিনি আমাকে পূর্বের স্থানে (কবরে) ফেরত পাঠিয়ে দেন”

যেসব বিখ্যাত মুহাদ্দিস হাদীসটি তাদের কিতাবে উল্লেখ করেছেন,

১.  ইবনে আবিদ দুনিয়া রহ., মান আশা বা’দাল মাউত। হাদীস নং ৫৮

২. মুসনাদে আব্দ ইবনে হুমাইদ, হাদীস নং ১১৬৪

৩.ফাওয়াইদু তামাম আর-রাজী, হাদীস নং ২১৭

৪. আল-জামে লি আখলাকির রাবী, খতীব বাগদাদী, হাদীস নং ১৩৭৮

৫. আল-বা’স, ইবনে আবি দাউদ, হা.৫

৬.আজ-জুহদ, ইমাম ওকী ইবনুল জাররাহ, হাদীস নং৮৮

৭. আজ-জুহদ, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ.

৮. মাজালিস মিন আমালি ইবনে মান্দাহ, ইবনে মান্দাহ, হাদীস নং ৩৯৩

৯. আল-মাতালিবুল আলিয়া, ইবনে হাজার আসকালানী রহ. হাদীস নং ৮০৭

১০. ফুনুনুল আজাইব, হা.১৯

১১. শরহুস সুদুর, জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহ. পৃ.৪২-৪৩

ঘটনাটি বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত। তামাম আর-রাজী এটি সরাসরি রাসূল স. থেকে বর্ণনা করেছেন। ইবনে হাজার আসকালানী রহ. হযরত জাবির রা. থেকে মওকুফ সূত্রে বর্ণনা করেছেন, যেটি মরফু এর হুকুমে। সুতরাং ঘটনার প্রামাণ্যতার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।  

কারামত অস্বীকারকারী ভাইদের কাছে, আমাদের প্রশ্ন,

১. রাসূল স. এধরনের ঘটনা বর্ণনা করে উম্মতকে কুফুরী শিক্ষা দিয়েছেন?

২. মুহাদ্দিসগণ ঘটনাটি তাদের কিতাবে উল্লেখ করে কুফুরী প্রচার করেছেন?

৩. বিখ্যাত ইমামগণ এই ঘটনার মূল বিষয় তথা কবর থেকে কেউ বের হয়ে কথা বলার উপর কোন আপত্তি করেননি। এটি অসম্ভব কিংবা এটি কুফুরী-শিরকী বলা তো দূরের বিষয়। সুতরাং নতুনভাবে এটাকে কুফুরী -শিরকী বলে সেসব ইমামদেরকে কেন অভিযুক্ত করছেন?

৪. ঘটনাটি যদি কুফুরী-শিরকী হয়, তাহলে যেসব মুহাদ্দিস এই ঘটনা তাদের কিতাবে উল্লেখ করেছেন, এবং এর উপর কোন অভিযোগ করেননি, তারা সকলেই কি কুফুরী-শিরকী করেছেন?

৫. মূল ঘটনা যদি কুফুরী-শিরকী হয়, তাহলে এর সনদ দেখার কোন প্রয়োজন নেই। কেননা, কুফুরী বিষয় বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত হলেও কুফুরী, দুর্বল সনদে রর্ণিত হলেও কুফুরী। সুতরাং মূল ঘটনা যদি কুফুরী-শিরকী হয়, তাহলে উপর্যুক্ত ইমাম ও মুহাদ্দিসগণ সম্পর্কে আপনাদের ফতোয়া জানতে চাই।

মৃত্যুর পর কথোপকথন

ইমাম বাইহাকী রহ. হযরত সাইদ ইবনুল মুসাইয়্যাব থেকে  বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, হযরত উসমান রা. এর সময় যায়েদ ইবনে খারিজা আল-আনসারী রা. ইন্তেকাল  করেন। তাকে কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। পরবর্তীতে তিনি কথা বলে উঠেন। এবং বলেন, রাসূল স. এর কথা পূর্ববতী আসমানী কিতাবে রয়েছে। আবু বকর সত্য বলেছেন। উমর সত্য বলেছেন। উসমান সত্য বলেছেন।

ঘটনার সনদ বা সূত্র বিশুদ্ধ। দেখুন,

১. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া,  ইবনে কাসীর রহ. খ.৬, পৃ.২৯৩

২.দালাইলুন নুবুওয়াহ, ইমাম বাইহাকী রহ.। হাদীস নং ২৩০৫

৩.আল-ইস্তেয়াব, ইবনে আব্দুল বার রহ. বর্ণনা নং ৮৪৪ ।

৪. ত্ববরানী ফিল কাবীর, বর্ণনা নং ৫১৪৪

৬.তাহজীবুল কামাল।

৭. আস-সিকাত, ইবনে হিব্বান রহ.।

৮. ইমাম আবু হাতিম, মাশাহিরু উলামায়িল আমসার।

এছাড়াও বহুগ্রন্থে এটি উল্লেখ করা হয়েছে। এই ঘটনার সনদ সহীহ।  কারামত অস্বীকারকারীদের মতে এটি অসম্ভব। কারামত অস্বীকারকারীরা ফাজায়েলে আমলের এজাতীয় দু’একটি ঘটনা উল্লেখ করে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত  করার চেষ্টা করেছে। এধরনের ঘটনার কারণে তারা সমাজে জঘন্য অপপ্রচার চালিয়েছে, ফাজায়েলে আমলে কুফুরী-শিরকী বিষয় রয়েছে। নাউযুবিল্লাহ। নিজেদের বস্তুবাদী বিকৃত মানসিকতার পরিচয় দিয়ে তারা সাধারণ মানুষকে কারামতে অবিশ্বাসী হওয়ার দাওয়াত দিচ্ছে। অথচ পবিত্র কুরআনের সুরা বাকারাতে মৃত্যুর পরে কথোপকথনের স্পষ্ট ঘটনা রয়েছে। কারামত হিসেবে মৃত্যুর পর কথা বলাতে বিশ্বাস করা যদি কুফুরী-শিরকী হয়, তাহলে তাদের দাবী অনুযায়ী পবিত্র কুরআনে কুফুরী-শিরকী বিষয় রয়েছে। নাউযুবিল্লাহ। একই বিষয় ফাজায়েলে আমলে থাকলে যদি শিরক হয়, তাহলে কুরআনে থাকলে শিরক নয় কেন?

কারামত অস্বীকারকারীরা কি বলতে চায়, কুরআন মানুষকে শিরক শিখিয়েছে? নাউযুবিল্লাহ। তাদের আরেকটি যুক্তি হল, ঘটনার সত্যতা কি? ঘটনা সত্য বা মিথ্যা হওয়ার সাথে কুফুরী শিরকীর কী সম্পর্ক? বিশুদ্ধ সনদে কুফুরী-শিরকী বর্ণনা করা সঠিক আর দুর্বল সনদে কুফুরী শিরকী বর্ণনা অন্যায়? তাদের দাবী কি এটাই? তারা বলে, কুরআন-হাদীসে থাকলে ঠিক আছে। কিন্তু একই জিনিস ফাজায়েলে আমলে থাকলে শিরক। এরা আসলে পরোক্ষভাবে কুরআন ও হাদীসে কারামত থাকার কারণে কুরআন-হাদীসকে কুফুরী-শিরকের উৎস বলতে চায়। কিন্তু সাধারণ মানুষের ভয়ে সেটা প্রকাশ করতে পারে না। নতুবা হুবহু একই বিষয়কে কুফুরী-শিরকের বলার তাৎপর্যটা কী?

ইবনে আব্দুল বার রহ. উক্ত ঘটনা বর্ণনা করার লিখেছেন,

وهو الذي تكلم بعد الموت لا يختلفون في ذلك

যায়েদ ইবনে খারিজা রা. যিনি মৃত্যুর পর কথা বলেছেন। এ ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণ মতবিরোধ করেননি।

ঘটনা-২:

ইমাম বাইহাকী রহ. দালাইলুন নুবুওয়াহতে বর্ণনা করেছেন, হযরত রিবয়ী ইবনে খিরাশ বলেন,

“আমার এক ভাই মৃত্যুবরণ করল।  সে আমাদের মাঝে সবচেয়ে দীর্ঘ নামায আদায় করতো। ঘরমের দিনে সবচেয়ে বেশি রোজা রাখতো।  আমরা তাকে কাপড় আবৃত করলাম। সকলে তার পাশে বসে ছিলাম। হঠাৎ সে চেহারার কাপড় সরিয়ে দিয়ে বলল, আস-সালামু আলাইকুম।  আমি বললাম, সুবহানাল্লাহ, মৃত্যুর পরেও? সে বলল, আমি আমার প্রভূর সাথে সাক্ষাৎ করেছি। দয়াময় প্রভূ আমাকে জান্নাত দান করেছেন। তিনি আমার প্রতি রাগান্নিত নন। তিনি আমাকে মণি-মুক্তা খচিত কাপড় পরিধান করিয়েছেন। তোমরা খুব দ্রুত আমাকে রাসূল স. এর কাছে পৌছে দেও। কেননা তিনি আল্লাহর শপথ করেছেন, আমি তার কাছে  না পৌছা পর্যন্ত তিনি স্থান ত্যাগ করবেন  না। “

ঘটনাটি বিশুদ্ধ সূত্রে রর্ণিত। ঘটনাটি যেসব বিখ্যাতু মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন,

১. ইমাম বাইহাকী, দালাইলুন নুবওয়াহ, খ.৬, পৃ.৪৫৪

২.ইবনে সায়াদ, আত-ত্ববাকাত, খ.৬, পৃ.১৬০।

৩.আল-ইস্তেয়াব, ইবনে আব্দিল বার, যায়েদ ইবনে খারিজা এর জীবনী।

৪.ইবনে আবিদ দুনিয়া, মান আশা বা’দাল মাউত, বর্ণনা নং ৯ ।

৫. ইবনে হিব্বান, আস-সিকাত, খ.৪, পৃ.৩২৬

উক্ত ঘটনাটি খুবই আশ্চর্যজনক। এধরনের কোন ঘটনা ফাজায়েলে আমল কিংবা দেওবন্দী কোন আলেমের কিতাবে থাকলে এটা অবশ্যই শিরক হতো। এবং এটা নিয়ে যারপর নাই হাশি-তামাশা করতো কারামত অস্বীকারকারী সালাফী ও আহলে হাদীস। আহলে সুন্নত বহির্ভূত বিকৃত মানসিকতার কিছু শায়খ যেমন, তাউসীফুর রহমান রাশেদী, উমর সিদ্দিক, আবু যায়েদ জমীর, তলিবুর রহমান, মতিউর রহমান মাদানী, মুরাদ বিন আমজাদ, আকরামুজ্জামান বিন আব্দুস সালামসহ সালাফী মানহাজ থেকে বিচ্যুত লোকেরা সাধারণ মানুষকে কারামত বিদ্বেষী করছে। আর এভাবেই কুরআন-হাদীস ও সালাফে-সালেহীনের কারামতকে হাশি-তামাশার বস্তু বানিয়েছে। নাউযুবিল্লাহ। এরা হকপন্থী আলেমদের উপর কুফুরী-শিরকের যতগুলো অপবাদ দিয়েছে, এর অধিকাংশ এজাতীয় কারামত। কারামতকে কুফুরী শিরকী আখ্যা দেয়ার পাশাপাশি এরা কারামতকে উপহাস করে মূলত: কুরআন-সুন্নাহ নিয়ে উপহাস করেছে। কারণ যেসব কারামত নিয়ে এরা উপহাস করেছে, হুবহু একই ধরনের কারামত কুরআন-হাদীসে রয়েছে। সুতরাং একটিকে নিয়ে উপহাসের অর্থ একই ধরনের অপরটিকেও উপহাসের পাত্র বানানো। এজন্যই আমরা দেখতে পাই, এদের সামনে কিংবা এদের অনুসারীদের সামনে যখন বিশুদ্ধ সূত্রে এজাতীয় কারামত উল্লেখ করা হয়, তখন নির্দ্বিধায় সেগুলো অস্বীকার করে।

কারামত অস্বীকারের ক্ষেত্রে আহলে সুন্নত ও সালাফী মানহাজ বহির্ভূত নব্য মু’তাজিলীদের বাস্তবতা দেখতে এদের লেখা যে কোন বই দেখতে পারেন। বিশেষভাবে আকরামুজ্জামান বিন আব্দুস সালাম সম্পাদিত তাবলীগ জামাত ও দেওবন্দীগণ, মুরাদ বিন আমজাদের লেখা সহীহ আকিদার মানদন্ডে তাবলীগি নেসাব । কারামত অস্বীকার, এগুলো নিয়ে হাশি-তামাশা, একে কুফুরী -শিরকী আখ্যা দেয়ার মাধ্যমে এরা মূলত: বিভ্রান্ত ফেরকা মু’তাজেলাদের  ভ্রান্ত  মতবাদ সমাজে প্রচার করছে। পশ্চিমাদের বস্তুবাদে প্রভাবিত তথাকথিত এসব শায়খদের কিতাব প্রমাণ করছে, পূর্ববর্তী  আলেমগণ ও সালাফের অধিকাংশ  কুফুরী-শিরকী আকিদা লালন করেছেন। নাউযুবিল্লাহ। কেননা, ইতিহাস, তাফসীর, হাদিস, রাবীদের জীবনীর উপর লেখা এমন কোন কিতাব পাওয়া যাবে না যেখানে এধরনের কারামত নেই। সুতরাং এজাতীয় কারামত লেখা, সেগুলো প্রচার করা যদি কুফুরী-শিরকী হয়, তাহলে সালাফের কেউ  এই অপবাদ থেকে বাচবেন কি না সন্দেহ। আমরা এধরনের বিকৃত মানসিকতা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি।

উপর্যুক্ত ঘটনাটি উল্লেখ করার পর ইমাম বাইহাকী রহ. লিখেছেন,

هذا إسناد صحيح، لا يشك حديثيُّ في صحته

অর্থ: ঘটনার সনদ সহীহ। এটি সহীহ হওয়ার ব্যাপারে কোন মুহাদ্দিস সন্দেহ করতে পারে না।

ঘটনাটি সালাফীদের অনুসরণীয় শায়খ নাসীরুদ্দীন আলবানী তার কিতাবে উল্লেখ করেছেন। ঘটনাটি উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন,

وبالجملة؛ فالقصة صحيحة بلا شك، والله على كل شيء قدير

অর্থ: “মোট কথা, নি:সন্দেহে ঘটনাটি বিশুদ্ধ (সহীহ)। আল্লাহ তায়ালা সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাবান”

[সিলসিলাতুস জয়ীফা,  ৬৬৭৩ নং হাদীসের আলোচনা দ্রষ্টব্য]

কারামত অস্বীকারকারীদের বাস্তবতা উপলব্ধির জন্য একটি পরীক্ষা করতে পারেন। এসব শায়খদের কাউকে জিজ্ঞাসা করুন, এক দেওবন্দী আলেম উক্ত ঘটনাটি লিখেছেন। এ ঘটনা সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী? কোন কোন কিতাবে আছে, সেটি না বলে এধরনের পরীক্ষা করতে পারেন। তবে যদি বলেন, শায়খ নাসীরুদ্দীন আলবানী একে নি:সন্দেহে সত্য বলে স্বীকার করেছেন, তাহলে শায়খদের বুলি পাল্টে যাবে। সুতরাং ঘুণাক্ষরে তাদের সামনে এটা বলা যাবে না।

এধরনের কারামতকে অস্বীকার, একে কুফুরী শিরকী বলার ধৃষ্টতা এ পর্যায়ে পৌছেছে যে, আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের সর্বসম্মত হায়াতুন্নবীর আকিদাকে কুফুরী আকিদা আখ্যা দিচ্ছে। নাউযুবিল্লাহ। এদের এই তাকফিরী মনোভাব উম্মাহকে বিভক্ত করছে। সাধারণ মানুষকে সরল সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করে আলেম বিদ্বেষী করছে। আল্লাহ তায়ালা সাধারণ মানুষকে হেফাজত করুন।আমীন।

ঘটনা -৩:

বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক ইবনে আসাকির তার তারীখে লিখেছেন,

عن عبد الله بن عتبة الأنصاري ، قال بينما ثم يثورون القتلى يوم مسيلمة إذ تكلم رجل من الأنصار من القتلى ، فقال : محمد رسول الله أبو بكر الصديق عمر الشهيد عثمان الرحيم ثم سكت

আব্দুল্লাহ ইবনে উতবা আল-আনসারী রা. বলেন, মুসালাইমাতুল কাজ্জাবের সাথে যখন ঘোরতর লড়াই চলছিল, আনসারী এক শহীদ  কথা বলে উঠল। সে বলল, “মুহাম্মাদ স. আল্লাহর রাসূল। আবু বকর হলেন সিদ্দিক (সত্যবাদী), উমর রা. হলেন শহীদ। উসমান রা. হলেন নম্র ও কোমল হৃদয়ের অধিকারী। এরপর সে চুপ করল।

তারীখে দিমাশক, খ.৩০, পৃ.৪০৮

মান আশা বা’দাল মাউত, পৃ.১৭, বর্ণনা নং ৮

ঘটনা-৪: জঙ্গে সিফফীন অথবা জঙ্গে জামালে মৃতের কথোপকথন:

ইমাম ইবনে কাসীর রহ. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়াতে লিখেছেন,

عن عبد الله بن عبيد الأنصاري ، قال : بينما هم يثورون القتلى يوم صفين أو يوم الجمل إذ تكلم رجلٌ من الأنصار من القتلى فقال محمد رسول الله أبو بكر الصديق عمر الشهيد عثمان الرحيم ثم سكت

“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উবায়েদ আল-আনসারী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জঙ্গে জামাল অথবা সিফফীনে  যখন ঘোরতর লড়াই চলছিল, হঠাৎ এক আনসারী শহীদ কথা বলে উঠল। সে বলল, মুহাম্মদ স. আল্লাহর রাসূল ।  আবু বকর হলেন, সত্যবাদী। উমর হলেন শহীদ।  উসমান কোমল হৃদয়ের অধিকারী। এরপর সে চুপ করল। “

[আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খ.৬, পৃ.১৫৮]

তারীখে দিমাশক, খ.৩৯, পৃ.২২২

মৃত্যুর পর হাসি:

বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনে আবিদ দুনিয়া রহ. বর্ণনা করেছেন,  হারিস আল-গানাবী বর্ণনা করেন, রবী ইবনে খিরাশ কসম খেয়েছিলেন, তিনি পরকালে তার অবস্থান না জানা পর্যন্ত দাঁত বের করে কখনও হাসবেন না। তার মৃত্যুর পরেই কেবল তিনি হেসেছিলেন।  রবী ইবনে খিরাশের ভাই রিবয়ী ইবনে খিরাশও একই কসম খেয়েছিলেন। তিনি জান্নাতী না কি জাহান্নামী সেটা না জানা পর্যন্ত হাসবেন না। হারেস আল-গানাবী বলেন, রিবয়ী ইবনে খিরাশের গোসলদাতা আমাকে বলেছে,  আমরা যতক্ষণ তাকে গোসল দিচ্ছিলাম ততক্ষণ তিনি খাটের উপর মুচকী হাসছিলেন।

মান-আশা বা’দাল মাউত, পৃ.২০, বর্ণনা নং ১২ ।

মৃত্যুর পর হাসি সংক্রান্ত সাম্প্রতিক কারামত

শহীদ ড. আব্দুল্লাহ আজজাম রহ. তার আয়াতুর রহমানে আফগান মুজাহিদগণের অনেক কারামত উল্লেখ করেছেন। শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করার পর অনেক শহীদ হেসেছেন। এধরনে কিছু ঘটনা শায়খের কিতাব থেকে,

১.  আমার নিকট আরসালান বর্ণনা করেছে, মুজাহিদ আব্দুল জলিল ত্বালিবে ইলম (ছাত্র) ছিল। খুব নেককার ছেলে ছিল।  বোম্বিং  এ সে  শাহাদাৎ বরণ করে।  আসর সময় তার জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। আসরের পরে তাকে তার পিতার ঘরে দাফনের জন্য নেয়া হয়। সকাল পর্যন্ত তার লাশ সেখানে ছিল। মুজাহিদগণ তার কাছেই ছিল। সকাল পর্যন্ত সে চোখ খুলছিল, আর মুচকী হাসছিল। মুজাহিদগণ আরসালানের নিকট এসে বলল, আব্দুল জলিল তো মৃত্যুবরণ করেনি। আরসালান বললেন, সে শহীদ হয়েছে। অন্যরা বলল, তার মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে কীভাবে দাফন করব? সে জীবিত থাকলে তার উপর নতুনভাবে জানাযা পড়তে হবে।  আরসালান বললেন, সে গতকালই ইন্তেকাল করেছে। তবে এটি শহীদের বিশেষ কারামত।

-আয়াতুর রহমান, পৃ.১২৭

২.  বাগমানের প্রধান কমান্ডার মুহাম্মদ উমর আমার কাছে বর্ণনা করেছে, আমাদের সাথী হামিদুল্লাহ শহীদ হল। দাফনের সময় আমি তাকে হাসতে দেখলাম। আমি প্রথমে মনে করেছিলাম, এটা আমার চোখের ভুল। পরবর্তীতে ভালোভাবে লক্ষ্য করলাম, সে আসলেই হাসছিল।

-আয়াতুর রহমান, পৃ.১২৭

৩. বিখ্যাত কমরান্ডার ফাতহুল্লাহ আমার কাছে বর্ণনা করেছেন, মুজাহিদ সুহাইত খানের দাফনের চার দিন পর আমরা তার কবর উন্মুক্ত করি।  কবর খুড়ে দেখি, সে মুচকী হাসছে। আল্লাহু আকবার, আমি দেখেছি,  সে  চোখ খুলে আমাদেরকে দেখছিল।

-আয়াতুর রহমান, পৃ.১২৭

কারামত অস্বীকারকারী ভাইয়েরা এসব কারামত থেকে নিশ্চয় শিরকের গন্ধ পেয়ে গেছেন।  ইমাম ইবনে আবিদ দুনিয়া, ইবনে কাসীর, ইবনে আসাকির, আব্দুল্লাহ আজ্জাম উম্মতের মাঝে শিরক প্রচার করেননি। আবার তারা নিজেরাও এসব বিশ্বাস করে শিরক করেননি। এধরনের কারামতে বিশ্বাস যদি শিরক হয়, তাহলে ইবনে কাসীর রহ. শিরকে লিপ্ত ছিলেন, এই ফতোয়া দিয়ে দিন। তাফসীরে ইবনে কাসীর পড়া নিষিদ্ধ করুন। আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া নিষিদ্ধ করুন। কারণ আল-বিদায়াতে এধরনের অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। আমরা পর্বে পর্বে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। যেসব সহীহ আকিদার কারামত অস্বীকারকারী ভাইয়েরা ফাজায়েলে আমলের এধরনের ঘটনা থেকে শিরকের গন্ধ পান, তারা কি আল-বিদায়ার একই ঘটনা থেকে তাউহীদের গন্ধ পান? তাদের এই স্ববিরোধী আচরণ আমাদেরকে বিস্মিত করে। শুধু বিরোধীতার জন্যই যে বিরোধীতা হয়, এই বাস্তবতা আরও প্রকট করে তোলে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে দীনের সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন।

মৃত্যুপরবর্তী কার্যক্রম ও দুনিয়াতে এর প্রতিক্রিয়া

আর রুহ ইবনুল কাইয়্যিম রহ. এর বিখ্যাত একটি কিতাব। ইবনে তাইমিয়া রহ. এর ইন্তেকালের পরে তিনি কিতাবটি লিখেছিলেন।

ইবনুল কাইয়্যিম রহ. কিতাবুর রুহে লিখেছেন,

وأما من حصل له الشفاء بإستعمال دواء رأى من وصفه له في منامه فكثير جدا وقد حدثنى غير واحد ممن كان غير مائل إلي شيخ الإسلام ابن تيمية أنه رآه بعد موته وسأله عن شيء كان يشكل عليه من مسائل الفرائض وغيرها فأجابه بالصواب

وبالجملة فهذا أمر لا ينكره إلا من هو أجهل الناس بالأرواح وأحكامها وشأنها وبالله التوفيق

অর্থ: স্বপ্নের মাধ্যমে প্রাপ্ত ওষুধের দ্বারা আরোগ্য লাভের অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। ইবনে তাইমিয়া রহ. এর ভক্ত ছিল না, এমন অনেকেই আমার কাছে বর্ণনা করেছে, তার মৃত্যুর পরে তাকে স্বপ্নে দেখেছে। তার কাছে বিভিন্ন জটিল মাসআলা-মাসাইল জিজ্ঞাসা করেছেন। যেমন, উত্তরাধিকার (ফারাইজ) বন্টন সম্পর্কিত মাসআলা। তিনি এগুলোর সঠিক উত্তর দিয়েছেন। মোটকথা, এ বিষয়গুলি যারা অস্বীকার করে, তারা রুহ ও এর বিভিন্ন কার্য সম্পর্কে সবচেয়ে মূর্খ।

[কিতাবুর রুহ, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, পৃ.৪৮]

http://islamport.com/w/qym/Web/3173/30.htm

মৃত্যুপরবর্তী কার্যক্রম ও এর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ইবনুল কাইয়্যিম রহ. লিখেছেন,

 ومما ينبغي أن يعلم أن ما ذكرنا من شأن الروح يختلف بحسب حال الأرواح من القوة والضعف والكبر والصغر، فللروح العظيمة الكبيرة من ذلك ما ليس لمن هو دونها. وأنت ترى أحكام الأرواح في الدنيا كيف تتفاوت أعظم تفاوت بحسب تفارق الأرواح في كيفياتها وقواها وإبطائها وإسراعها والمعاونة لها، فللروح المطلقة من أسر البدن وعلائقه وعوائقه من التصرف والقوة والنفاذ والهمة وسرعة الصعود إلى الله والتعلق بالله ما ليس للروح المهينة المحبوسة في علائق البدن وعوائقه، فإذا كان هذا وهي محبوسة في بدنها فكيف إذا تجردت وفارقته واجتمعت فيها قواها وكانت في أصل شأنها روحا علية زكية كبيرة ذات همة عالية، فهذه لها بعد مفارقة البدن شأن آخر وفعل آخر. وقد تواترت الرؤيا في أصناف بني آدم على فعل الأرواح بعد موتها ما لا تقدر على مثله حال اتصالها بالبدن من هزيمة الجيوش الكثيرة بالواحد والاثنين والعدد القليل ونحو ذلك، وكم قد رئي النبي (صلى الله عليه وسلم) ومعه أبو بكر وعمر في النوم قد هزمت أرواحهم عساكر الكفر والظلم فإذا بجيوشهم مغلوبة مكسورة مع كثرة عَدَدهم وعُدَدهم وضعف المؤمنين وقلتهم

অর্থ: জেনে রাখা উচিৎ যে, পূর্বে আমরা রুহের বিভিন্ন অবস্থা সম্পর্কে  আলোচনা করেছি।  রুহের বিভিন্ন অবস্থা  যেমন, শক্তি, ছোট-বড় হওয়া বা অন্যান্য অবস্থার প্রেক্ষিতে  রুহের কার্যক্রম ভিন্ন ভিন্ন হয়।  তুমি দেখে থাকবে, দুনিয়াতে রুহের অবস্থার কারণে কার্যক্রমের মাঝেও ব্যাপক তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। রুহের শক্তি ও অবস্থার করণে এর গতি, কার্যক্রম, চলাচল ও প্রতিক্রিয়ার মাঝে পার্থক্য দেখা যায়। দেহের বন্ধন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত মর্যাদাসম্পন্ন রুহের ব্যাপক কার্যক্রম, শক্তি, গতিশীলতা, হিম্মত ও আল্লাহর দিকে ধাবিত হওয়ার ক্ষমতা থাকে, যেটা দেহের বন্ধনে আবদ্ধ  বন্দী  রুহের থাকে না। দেহের বন্ধনে আবদ্ধ থাকার পরও রুহের অনেক অপ্রাকৃতিক কার্যক্রম দেখা যায়, সুতরাং এটি দেহের বন্ধ মুক্ত হয়ে এর পরিপূর্ণ শক্তি ও প্রকৃত বাস্তবতায় যখন ফিরে যায়, পবিত্র  ও অধিক শক্তিসম্পন্ন এসব রুহের কার্যক্রম তাহলে কেমন হবে? দেহের বন্ধনে আবদ্ধ রুহের কার্যক্রম থেকে দেহের বন্ধ মুক্ত রুহের কার্যক্রম ভিন্ন।  রুহের কার্যক্রম সম্পর্কে এতো অধিক বর্ণনা রয়েছে যে, এগুলো অস্বীকারের উপায় নেই।  মৃত্যুর পরে রুহের কার্যক্রম সম্পর্কে অসংখ্য স্বপ্ন বর্ণিত হয়েছে।  মৃত্যুর পরে রুহের মাধ্যমে এমন সব ঘটনা ঘটেছে, যেটি জীবিত থাকা অবস্থায় সম্ভব নয়। যেমন, একজন, দু’জন অথবা সামান্য কিছু লোক বিশাল সেনাবাহিনীকে পরাজিত করা। অসংখ্য লোক রাসূল স. কে স্বপ্নে দেখেছে,  তার সাথে হযরত আবু বকর ও হযরত উমর রা. রয়েছেন।  তাদের রুহ কাফেরদের সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত করে দিয়েছে। কাফেরদের পরাজিত ছিন্ন-ভিন্ন সেনাদের লাশ ছড়িয়ে থাকে। অথচ তাদের সংখ্যা মুসলমানদের তুলনায় বহুগুণ বেশি ছিল। মুসলমানরা সংখ্যা ও শক্তিতে ছিল খুবই নগন্য ।

ইবনুল কাইয়্যিম রহ. মৃত্যুর পর রুহের কার্যক্রম ও  এর প্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত অনেক ঘটনা উল্লেখ করেছেন।  এজাতীয় কিছু ঘটনা নীচে উল্লেখ করা হল।

ইবনুল কাইয়্যিম রহ. ‘আর-রুহ’ কিতাবে লিখেছেন,

في كتاب المنامات لابن أبي الدنيا عن

شيخ من قريش قال : رأيت رجلاً بالشام قد أسود نصف وجهه وهو يغطيه ، فسألته عن ذلك فقال : قد جعلت لله على أن لا يسألني أحد عن ذلك إلا أخبرته به ، كنت شديد الوقيعة في علي بن أبي طالب  رضي الله عنه ، فبينا أنا ذات ليلة نائم إذ أتاني آت في منامي فقال لي : أنت صاحب الوقيعة فيّ ؟ فضرب شق وجهي ، فأصبحت وشق وجهي أسود كما ترى

অর্থ: ইবনে আবিদ দুনিয়া রহ. এর আল-মানামাত গ্রন্থে রয়েছে, জনৈক  কুরাইশি ব্যক্তি থেকে বর্ণিত, তিনি  বলেন, আমি শামে এক ব্যক্তিকে দেখলাম, তার চেহারার অর্ধেক অংশ কালো হয়ে গেছে। সে এই অংশটা ঢেকে রাখার চেষ্টা করছে।  আমি তাকে চেহারা কালো হওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলাম।  সে বলল, আমি আল্লাহর কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে,  এ বিষয়ে কেউ আমাকে প্রশ্ন করলে আমি তাকে বিষয়টি বলব। আমি হযরত আলী রা. খুব গালাগালি করতাম। আমি এক রাতে ঘুমিয়েছিলাম। স্বপ্নে এক ব্যক্তি আমার কাছে এল । এসে আমাকে বলল, তুমি কি আমাকে গালাগালি করো? এরপর তিনি আমার মুখে চড় মারলেন। সকালে উঠে দেখি মুখের একাংশ কালো হয়ে আছে।

কিতাবুর রুহ, পৃ.১৮৯

ঘটনাটি স্পষ্ট। হযরত আলী রা. তার ইন্তেকালের পরে একজনের স্বপ্নে আগমন করলেন। তাকে চড় মারার কারণে তার মুখে চড়ের প্রভাব রইল । ঘটনাটি সালাফীদের ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহ. লিখেছেন। এধরনের বিশ্বাস শরীয়ত বিরোধী না কি শরীয়ত সম্মত? এটা যদি শরীয়ত বিরোধী হয়, তাহলে তার অবস্থান কী? এটা কুফুরী, শিরকী, না কি বিদয়াত?

কিছু সালাফী ভাই বলবেন, আমরা ইবনুল কাইয়্যিমকে মানি না। ভালো কথা। আপনারা শুধু ইবনুল কাইয়্যিম নয়, আরও অনেক আলেম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবেন। সেই সময়টাও আসছে ইনশাআল্লাহ। এই তালিকা দীর্ঘ হতে থাকবে।  তবে আমাদের প্রশ্ন হল, তিনি ভুল করেছেন, তাকে অনুসরণ করি না, এগুলো আমরা শুনতে চাই না? এধরনের বিশ্বাস রাখার কারণে ইবনুল কাইয়্যিম সম্পর্কে সুস্পষ্ট বক্তব্য দিন। তিনি কি কুফুরী না কি শিরকী করেছে?

দেওবন্দী আলেম যখন রাসূল স. কে স্বপ্ন দেখল, এবং সেই স্বপ্নের বাস্তব প্রভাব পরবর্তীতে দেখা গেল, সেটা তো আপনাদের কাছে মহা শিরক। তাহলে এই ঘটনা শিরক নয় কেন? রাসূল স. স্বপ্নে দারুল উলুম দেওবন্দের পরিধি একে দিলেন, বাস্তবে তার প্রভাব দেখা গেল, এটা আপনাদের কাছে শিরক।  তাহলে ইবনুল কাইয়্যিম রহ. যে ঘটনা লিখলেন সেটা শিরক নয় কি?

ঘটনা-২:

ইবনুল কাইয়্যিম রহ. কিতাবুর রুহে লিখেছেন,

: وذكر ابن أبي الدنيا عن أبي حاتم الرازي ، عن محمد بن علي ، قال : كنا بمكة في المسجد الحرام قعوداً ، فقام رجل نصف وجهه أسود ونصفه أبيض ، فقال : يا أيها الناس اعتبروا بي ، فإني كنت أتناول الشيخين وأشتمهما ، فبينما أنا ذات ليلة نائم إذ أتاني آت ، فرفع يده فلطم وجهي وقال لي : يا عدو الله ، يا فاسق ، ألست تسب أبا بكر وعمر رضي الله عنهما ، فأصبحت وأنا على هذه الحالة .

অর্থ: বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনে আবিদ দুনিয়া রহ. আবু হাতিম রাজী রহ. থেকে বর্ণনা করেছে, তিনি মুহাম্মাদ বিন আলী থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমরা মক্কায় মসজিদুল হারামে বসা ছিলাম।  সেখানে এক ব্যক্তি দাড়াল, যার চেহারার অর্ধেক কালো ও অর্ধেক সাদা ছিল। লোকটি দাড়িয়ে বলল, লোক সকল, আমাকে দেখে শিক্ষা গ্রহণ করো। আমি হযরত আবু বকর ও হযরত উমর রা.কে অসম্মান ও গালাগালি করতাম।  আমি এক রাতে ঘুমিয়েছিলাম। আমার কাছে এক ব্যক্তি এল। সে হাত উঠিয়ে আমার মুখে চড় মারল। আমাকে বলল, হে আল্লাহর শত্রু, ফাসিক, তুমি কি আবু বকর রা. ও উমর রা. কে গালাগালি করো না? আমি সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, আমার মুখের এই অবস্থা।

[কিতাবুর রুহ, পৃ.২১৭, মাকতাবাতুস সফা]

এধরনের আরও অনেক ঘটনা কিতাবুর রুহে রয়েছে।  উদাহরণ হিসেবে এ’দুটিই যথেষ্ট। স্বপ্নে বা রুহের জগতে কোন কিছু সংঘঠিত হওয়া এবং বাস্তবে এর প্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত বিভিন্ন ঘটনার জন্য আর-রুহ কিতাবটি দেখতে পারেন। ইবনে তাইমিয়া রহ. এর দীর্ঘ সংশ্রবের পর ইবনুল কাইয়্যিম রহ. যে কিতাব সংকলন করেছেন, সেগুলোতে এসব ঘটনা রয়েছে। এসব ঘটনা তিনি কিতাবে উল্লেখ করেছেন। এগুলো থেকে রুহের বিভিন্ন কার্যক্রম ব্যাখ্যা করেছেন। আমাদের প্রশ্ন হল, হুবহু একই বিষয় দেওবন্দী আলেমের কিতাবে থাকার পরেও সেটি যদি কুফুরী-শিরকী হয়, তাহলে ইবনুল কাইয়্যিম রহ. এর কিতাব কীভাবে সহীহ আকিদা হয়? তাহলে কি দেওবন্দী আলেমদের বক্তব্য পরিমাপের দাড়িপাল্লা একটি, আর সালাফী আলেমদের বক্তব্য মাপার দাড়িপাল্লা আরেকটি? স্বপ্নে কিছু সংগঠিত হওয়া এবং বাস্তবে তার প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হওয়া যদি কুফুরী-শিরকী হয়, তাহলে এই ফতোয়াটি ইবনুল কাইয়্যিমের উপর আরোপ করুন। ইবনুল কাইয়্যিম রহ. এর কুফুরী-শিরকী আকিদা নামে লেকচার তৈরি করুন। আমরা দেখতে চাই, সহীহ আকিদার দাবীদারগণ কতটা নিরপেক্ষ এবং তারা সত্যিকার দাওয়াতী মেহনত করছে না কি পেট্র-ডলার অপছায়া তাদেরকে গ্রাস করেছে?

পরিশেষে আমরা একটা নিবেদন রাখতে চাই, যে বিষয়গুলো সম্পূর্ণ শরীয়ত সম্মত, যেখানে শরীয়ত বিরোধী কোন কিছুরই সম্পৃক্ততা নেই, সেটা কীসের ভিত্তিতে কুফুরী শিরকী বলেন? আল্লাহ তায়ালা কি বলেছেন, স্বপ্নের ঘটনার বাস্তব প্রতিক্রিয়ায় কেউ বিশ্বাস করলে সে কাফের? রাসূল স. কী বলেছেন, তোমরা স্বপ্নের ঘটে যাওয়া কোন কিছুর বাস্তব প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বাস করবে না। কারণ এটি শিরক? শরীয়তের কোন দলিলের ভিত্তিতে এটা কুফুরী বা শিরকী? আপনারা যেহেতু কুরআন ও হাদীস ছাড়া কিছুই দলিলযোগ্য মনে করেন না, তাহলে বলুন, কুরআন ও হাদীসের কোথায় এগুলোকে কুফুরী-শিরকী বলা আছে। সুস্পষ্ট বক্তব্য আনুন। যদি কুরআন ও হাদীসের এধরনের সুস্পষ্ট কোন বক্তব্য দেখাতে পারেন, তাহলে ফতোয়া দিন। আর সেই ফতোয়াটি শুধু দেওবন্দী আলেমের বিরুদ্ধে নয়, সেটা নিজেদের ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. ও ইবনুল কাইয়্যিম রহ. এর উপর আগে আরোপ করতে হবে। এটাই ইনসাফের দাবী।

মৃত্যুর পর পুনরায় জীবন লাভ

ইবনে কাসীর রহ. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়াতে বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনে আবিদ দুনিয়ার সূত্রে ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন। ইবনে আবিদ দুনিয়া রহ. নিজ সনদে বর্ণনা করেন, রবীয়া ইবনে কুলসুম জনৈক ব্যক্তি থেকে বর্ণনা করেছেন, উক্ত ব্যক্তির এক বৃদ্ধা প্রতিবেশী ছিল। তিনি অন্ধ ও কিছুটা বধির ছিলেন। হাটা-চলা করতে পারতেন না। তার একটি মাত্র ছেলে ছিল। ছেলেটি তার দেখা-শোনা করতো। ছেলেটি মৃত্যুবরণ করল। আমরা এসে বৃদ্ধাকে  বললাম, মুসীবতে আল্লাহর উপর সবর করুন। তিনি বললেন, কী হয়েছে? আমার ছেলে কি মারা গেছে? হে আমার মাওলা, আমার উপর রহম করো। আমার থেকে আমার ছেলেকে নিও না। আমি অন্ধ, বধির ও অচল। আমার দুনিয়াতে আর কেউ নেই। মাওলা, আমার উপর রহম করুন।

আমি বললাম, বৃদ্ধার স্মৃতিভ্রম হয়েছে। এই বলে আমি বাজারে গেলাম। আমি তার কাফনের কাপড় ক্রয় করে নিয়ে এলাম। ফিরে এসে দেখি সে জীবিত হয়ে বসে আছে।

১. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খ.৬, পৃ.১৫৪।

২.দালাইলুন নুবুওয়া, খ.৬, পৃ.৫০-৫১

ইবনে কাসীর রহ. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়াতে নীচের ঘটনাটি লিখেছেন। ঘটনাটি ইবনে আবিদ দুনিয়া রহ. মান আশা বা’দাল মাউত কিতাবে উল্লেখ করেছেন,

এক দল লোক ইয়ামান থেকে আল্লাহর পথে বের হল। পথিমধ্যে তাদের একজনের গাধা মৃত্যুবরণ করল। তার সহযাত্রীরা তাকে অন্য গাধার উপর আরোহরণের অনুরোধ জানাল। কিন্তু সে অস্বীকার করল। সে উঠে উজু করল। নামায আদায় করে দুয়া করল,

” হে আল্লাহ, আমি দাফিনা শহর থেকে আপনার পথে জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হয়েছি। আমি একমাত্র আপনার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এসেছি। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি মৃতকে জীবিত করেন।  আপনি কররবাসীকে পুনরায় জীবন দান করবেন। সুতরাং আমাকে কারও অনুগ্রহের মুখাপেক্ষী করবেন না। আমি আপনার কাছে দুয়া করছি, আপনি আমার গাধা জীবিত করে দিন।  এরপর সে গাধার কাছে গেল। গাধাকে উঠার জন্য একটি আঘাত করল। গাধাটি দাড়িয়ে কান ঝাড়তে শুরু করল। সে পুনরায় গাধায় তার সফরের পাথেয় উঠিয়ে যাত্রা করল।  কিছুদূর গিয়ে তার সঙ্গীদের সাথে মিলিত হল।  তারা তাকে জিজ্ঞাসা করল, এটা কীভাবে হল?

সে বলল, আল্লাহ তায়ালা আমার গাধা জীবিত করে দিয়েছেন। ইমাম শা’বী বলেন, আমি সেই গাধাটি কান্নাসা নামক বাজারে বিক্রি হতে দেখেছি।

সূত্র: আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খ.৬, পৃ.১৫৪

২. মান আশা বা’দাল মাউত, বর্ণনা নং ২৯।

৩. দালাইলুন নুবুওয়াহ, খ.৬, পৃ.৪৯

এধরনের একটি ঘটনা ইবনে তাইমিয়া রহ. তার মাজমুয়াতুল ফাতাওয়া-তে লিখেছেন। ইবনে তাইমিয়া রহ. লেখেন,

ورجل من النخع كان له حمار فمات في الطريق فقال له أصحابه : هلم نتوزع متاعك على رحالنا، فقال لهم : أمهلوني هنيئة ، ثم توضأ فأحسن الوضوء وصلى ركعتين ودعا الله تعالى فأحيا حماره فحمل عليه متعاه .

অর্থ: নাখ’ এর অধিবাসী এক ব্যক্তির একটি গাধা ছিল।  যাত্রাপথে গাধাটি মৃত্যুবরণ করে। তার সহযাত্রীরা বলল, আমরা তোমার মাল-সামানা ও পাথেয় আমাদের গাধাগুলোতে বন্টন করে নেই। সে তাদেরকে বলল।  আমাকে কিছুক্ষণ সময় দাও। এরপর সে উত্তমরূপে ওজু করল। দু’রাকাত নামায আদায় করে আল্লাহর কাছে দুয়া করল। আল্লাহ তায়ালা তার গাধা জীবিত করে দিলেন।  এরপর সে গাধার উপর তার পাথেয় উঠালো।

মাজমুউল ফাতাওয়া, খ.১১, ২৮১।

একই ধরনের একটি ঘটনা ইমাম শা’বী থেকে ইবনে হাজার আসকালানী রহ. তার আল-ইসাবা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। ঘটনাটি হযরত উমর রা. এর সময় সংগঠিত হয়। এক্ষেত্রে শাইবান নামক এক ব্যক্তির গাধা মৃত্যুবরণ করলে পরবর্তীতে সে নামায আদায় করে দুয়া করে। আল্লাহ তায়ালা তার গাধাটি জীবিত করে দেন।

[আল-ইসাবা, খ.৩, পৃ.২২৭, বর্ণনা নং ৩৯৮৮]

হযরত হামজা রা. এর কবর থেকে সালামের উত্তর:

ইমাম ইবনে কাসীর রহ. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়াতে ঘটনাটি লিখেছেন। হযরত আত্তাফ বিন খালিদ তার খালা থেকে বর্ণনা করেন, এক দিন আমি উহুদের শহীদগণের কবরের দিকে যাই। (তিনি প্রায়ই তাদের কবর জিয়ারত করতেন)।  তিনি বলেন, আমি হযরত হামরা রা. এর কবরের নিকট বাহন থেকে নামলাম। আল্লাহর তৌফিকে সেখানে কিছু নামায আদায় করলাম। উপত্যকায় আর সাড়া-শব্দ দেয়ার মতো কেউ ছিল না। আমার বাহনের লাগাম ধরে ছিল ছোট্র একটি ছেলে ছিল।  আমি কবরের উদ্দেশ্যে আস-সালামু আলাইকুম বললাম। আমি স্পষ্ট মাটির নীচ থেকে সালামের উত্তর পেলাম। ওয়ালাইকুমুস সালাম। আমার কাছে উত্তরটি এতটা স্পষ্ট ও সুনিশ্চিত যেমন, আল্লাহ আমাকে সৃষ্টি করেছেন, এটা সুনিশ্চিত। রাত্র-দিনের পার্থক্য যেমন সুস্পষ্ট, এই সালামের উত্তরও তেমনি সুস্পষ্ট। সালামের উত্তর শুনে আমার প্রত্যেকটি লোমকূপ দাড়িয়ে গেল। আমার শরীর ভয়ে শিহরিত হল।

[আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খ.৪, পৃ.৪৫, দালাইলুন নুবুওয়াহ, ইমাম বাইহাকী রহ. খ.৩, পৃ.৩০৮]

হযরত হামজা রা. এর কবর থেকে সালামের উত্তর আসার ঘটনাটি কারামত অস্বীকারকারীদের নিকট শিরক। মৃত্যুর পরে কবর থেকে কীভাবে সালামের উত্তর দেয়? সুতরাং এটি ইবনে কাসীর রহ. উল্লেখ করলেও তাদের নিকট এটি শিরক।  ইমাম বাইহাকী, ইবনে কাসীর ও ইবনে আবিদ দুনিয়া রহ. এর থেকে শিরকের গন্ধ না পেলেও কারামত অস্বীকারকারী সালাফী আহলে-হাদীসরা ঠিকই এর থেকে শিরকের গন্ধ পায়।

বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনে আবিদ দুনিয়া রহ. মৃত্যুর পরে জীবন লাভের উপর পৃথক একটি কিতাব লিখেছেন। এখানে তিনি সনদসহ ৬৪ টি ঘটনা ও বর্ণনা এনেছেন। তার বিখ্যাত কিতাবের নাম হল, মান আশা বা’দাল মাউত (মৃত্যুপর পরে যারা জীবন লাভ করেছে)। এই কিতাব থেকে ইবনে কাসীর রহ, ইমাম বাইহাকি রহ, ইমাম সূয়ূতী রহ, ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী রহ. তাদের কিতাবে বিভিন্ন ঘটনা উল্লেখ করেছেন। সুতরাং এসকল কারামতকে কুফুরী-শিরকী আখ্যা দিয়ে এসকল সালাফী ও আহলে হাদীস ভাইয়েরা এসব ইমাম ও মুহাদ্দিসকে কুফুরী -শিরকীর অপবাদ দিয়েছে। এধরনের তাকফিরী মানসিকতা থেকে অধিকাংশ ইমামই মুক্ত নয়। আল্লাহ তায়ালা সালাফী-আহলে হাদীসদের তাকফিরের ফেতনা থেকে উম্মাহকে হেফাজত করুন। আমীন।

মৃত্যুর পর বিভিন্ন আমল

বিখ্যাত ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী রহ. কবরের বিভিন্ন অবস্থা সম্পর্কে বিখ্যাত একটি কিতাব লিখেছেন। আহওয়ালুল কুবুর কিতাবের নাম।  রুহ, বারজাখ ও কবর সম্পর্কে অনেকেই কিতাব রচনা করেছেন। এর মধ্যে বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনে আবিদ দুনিয়া রহ. আল-কুবুর কিতাবটি সবচেয়ে প্রাচীন। এছাড়া ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. আজ-জুহদ কিতাবে এসম্পর্কিত বেশ কিছু বর্ণনা রয়েছে। এ বিষয়ে পৃথক কিতাব লিখেছেন, ইবনুল কাইয়্যিম রহ.। ইবনুল কাইয়্যিম রহ. এর আর-রুহ কিতাবটি বিখ্যাত। এছাড়াও জালালুদ্দীন সূয়ূতী রহ.  শরহুস সুদুর নামে বারজাখ বা কবরের জীবনের উপর কিতাব লিখেছেন। জালালুদ্দীন সূয়ূতী রহ. এর কিতাবটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল, এতে পূর্ববর্তী লিখিত বিভিন্ন কিতাবের সার নির্যাস তুলে ধরেছেন।

মৃত্যুর পর বিভিন্ন আমল সম্পর্কে উপর্যুক্ত কিতাবগুলোর প্রত্যেকটিতেই আলোচনা রয়েছে। আমরা ইবনে রজব হাম্বলী রহ. এর কিতাব থেকে আলোচনার মৌলিক অংশটি তুলে ধরব।

মূত্যুপরবর্তী  আমল সম্পর্কে আমাদের আকিদা:

এ বিষয়ে ইবনে রজব হাম্বলী রহ. বলেন,

بعض أهل البرزخ يكرمه الله بأعماله الصالحة عليه في البرزخ وإن لم يحصل له ثواب تلك الأعمال لانقطاع عمله بالموت لكن إنما يبقى عمله عليه ليتنعم بذكر الله وطاعته كم يتنعم بذلك الملائكة وأهل الجنة في الجنة وإن لم يكن لهم ثواب على ذلك لأن نفس الذكر والطاعة نعيما عند أهلها من نعيم جميع أهل الدنيا ولذاتها

অর্থ: আল্লাহ তায়ালা কিছু কিছু কবরবাসীকে কবরে নেক আমল করার সুযোগ দিয়ে সম্মানিত করেন। তারা এসব আমলের কোন সওয়াব পান না। মৃত্যুর মাধ্যমে তারা আমলের সওয়াব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে (তিনটি ব্যতিক্রম ব্যতীত)। তবে কবরের জীবনে তাদেরক আমলের সুযোগ দেয়া হবে। এসব আমল তথা আল্লাহর জিকির ও আনুগত্যের মাধ্যমে তারা বিশেষ স্বাদ পেতে থাকবে। যেমন ফেরেশতা ও জান্নাতবাসীগণ আল্লাহর ইবাদত ও জিকিরের মাধ্যমে বিশেষ স্বাদ আস্বাদন করে থাকে। যদিও তারা এর কোন সওয়াব পান না। কেননা মূল জিকির ও  ইবাদতও অনেক বড় নেয়ামত। দুনিয়ার সকল ইবাদত ও স্বাদ এর তুলনায় নগন্য ও তুচ্ছ।

-আহওয়ালুল কুবুর, পৃ.৬৮, ৬৯।

এ সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন,

” هذه الصلاة ونحوها مما يتمتع بها الميت ويتنعم بها كما يتنعم أهل الجنة بالتسبيح ، فإنهم يلهمون التسبيح كما يلهم الناس في الدنيا النَّفَس ؛ فهذا ليس من عمل التكليف الذي يطلب له ثواب منفصل ، بل نفس هذا العمل هو من النعيم الذي تتنعم به الأنفس وتتلذذ به “

অর্থ: এধরনের নামায ও ইবাদত দ্বারা মৃত্য ব্যক্তি বিশেষ স্বাদ উপভোগ করে থাকে। যেমন জান্নাতবাসীগণ তাসবীহ পড়ার মাধ্যমে স্বাদ উপভোগ করবে। দুনিয়াতে প্রত্যেক মানুষ যেমন শ্বাস-প্রশাস নেয়, তেমনি জান্নাতে মানুষ তাসবীহ পাঠ করবে।  এগুলো তাদের উপর অপরিহার্য কোন শরয়ী নির্দেশনা নয়। এর জন্য পৃথক কোন সওয়াবও থাকবে না। বরং মূল আমলই বিশেষ নেয়ামত, যার মাধ্যমে অতুলনীয় স্বাদ আস্বাদন করবে।

[মাজমুয়াতুল ফাতাওয়া, খ.৪, পৃ.৩৩০]

এ বিষয়ে ইমাম কুরতুবী রহ. সহ আরও অনেক ইমামের বক্তব্য রয়েছে।  ইবনে রজব রহ. হাম্বলী রহ. মৃত্যুর পর ইবাদত সম্পর্কে বেশ কিছু ঘটনা উল্লেখ করেছেন। আমরা এখানে কয়েকটি উল্লেখ করছি।

১. আল্লামা আবু নুয়াইম নিজ সনদে ইয়াসার ইবনে হুবাইশ থেকে, তিনি তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন,

عن يسار بن حبيش عن أبيه قال أنا والذي لا إله إلا هو أدخلت ثابت البناني في لحده ومعي حميد ورجل غيره فلما سوينا عليه اللبن سقطت لبنه فإذا به يصلي في قبره فقلت للذي معي ألا تراه قال اسكت فلما سوينا عليه وفرغنا أتينا ابنته فقلنا لها ما كان عمل ثابت قال وما رأيتم فأخبرناها فقالت كان يقوم الليل خمسين سنة فإذا كان السحر قال في دعائه اللهم إن كنت أعطيت أحدا الصلاة في قبره فأعطينها فما كان الله ليرد ذلك الدعاء

অর্থ: একমাত্র ইলাহ আল্লাহ তায়ালার শপথ, আমি, হুমাইদ ও আরেক ব্যক্তি সাবেত আল-বুনানীকে দাফন করার উদ্দেশ্যে তার কবরে অবতরণ করি। আমরা যখন দাফন সমাধা করে কবরে ইট বিছিয়ে দিলাম। উপর থেকে একটি ইট সরে গেল। আমরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম যে সে কবরে নামায আদায় করছে। আমি আমার সঙ্গীকে বললাম, তুমি তাকে দেখছো? সে বলল, চুপ করো। আমরা সঠিকভাবে দাফন সম্পন্ন করে তার মেয়ের নিকট এলাম। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, সাবেতের আমল কী ছিল? আমরা যা দেখেছি, তার কাছে বলা হল। সে বলল, সে পঞ্চাশ বছর যাবৎ রাত জেগে নামায আদায় করতো। ফজর হলে সে দুয়া করতো, হে আল্লাহ, আপনি যদি কবরে কাউকে নামায পড়ার সুযোগ দেন, তাহলে আমাকে সেই সুযোগ দিন। সুতরাং আল্লাহ তার দুয়া প্রত্যাখ্যান করেননি।

-আহওয়ালুল কুবুর, পৃ.৭০

-শরহুস সুদুর, জালালুদ্দীন সুয়ূতী, পৃ.১৮৮ ।

-মুখতাসারু সাফওয়াতিস সাফওয়া, খ.১, পৃ.২৯৬।

আশ্চর্যের বিষয় হল, সালাফীদের অনুসরণীয় শায়খ  মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাব নজদী তার ‘আহকামু তামান্নিল মাউত’ কিতাবে এই বর্ণনাটি উল্লেখ করেছেন।  আহকামু তামান্নিল মাউত শায়খ নজদীর  নিজের হাতের লেখা। এটি তাহকীক করেছে আব্দুর রহমান ইবনে মুহাম্মাদ সাদহান ও শায়খ আব্দুল্লাহ ইবনে জিবরীন। সৌদি থেকে আব্দুল ওহাব নজদীর সকল বই ও রচনা একত্রে প্রকাশ করা হয়েছে মুয়াল্লাফাতুশ শাইখিল ইমাম নামে।  মুহাম্মাদ বিন সউদ ইউনিভার্সিটিতে শায়খ আব্দুল ওহাব নজদীর উপর একটি সেমিনার করা হয়। শায়খের বিভিন্ন রচনা ও চিঠি ইত্যাদি সংকলনের উদ্দেশ্যে বোর্ড গঠন করা হয়। এই বোর্ডের তত্ত্বাবধানে তার রচনাসমগ্র ১৩ খন্ডে প্রকাশিত হয়।  রচনা সমগ্রের ৩ খন্ডে আহকামু তামান্নিল মাউত কিতাবটি রয়েছে।  যে কেউ ডাউন লোক করতে পারবেন নীচের লিংক থেকে। http://waqfeya.com/book.php?bid=3697

এই কিতাবের চল্লিশ পৃষ্ঠায় শায়খ আব্দুল ওহাব নজদী লিখেছেন,

ইমাম আবু নয়াইম নিজ সনদে জুবাইর থেকে বর্ণনা করেছেন,  সেই আল্লাহর শপথ, যিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই, আমি ও হুমাইদ আত-তবীল সাবেত আল-বুনানী রহ. এর কবরে প্রবেশ করি। আমরা দাফন শেষে যখন ইট বিছিয়ে দিচ্ছিলাম।, একটি ইট পড়ে গেল।  আমি দেখলাম, সাবেত আল-বুনানী কবরে নামায আদায় করছে।

-আহকামু তামান্নিল মাউত, পৃ.৪০, শায়খ আব্দুল ওহাব নজদী।

তিনি আরও লিখেছেন, ইমাম আবু নুয়াইম ও ইমাম ইবনে জারীর নিজ সনদে ইব্রাহীম আল-মুহাল্লাবী থেকে বর্ণনা করেছেন, জাস নামক স্থান দিয়ে ভোরে যাতায়াতকারীরা আমার কাছে বর্ণনা করেছে যে, আমরা যখন ভোরে সাবেত আল-বুনানীর কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করতাম, তার কবর থেকে কুরআন তেলাওয়াতের শব্দ শুনতে পেতাম।

-আহকামু তামান্নিল মাউত, পৃ.৪০, শায়খ আব্দুল ওহাব নজদী।

ইমাম তিরমিজী রহ. ইবনে আব্বাস রা. থেকে নীচের হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং একে হাসান বলেছেন। ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসূল স. এর এক সাহাবী একটি কবরের উপর তাবু গাড়ল। তিনি জানতেন না যে সেখানে কবর রয়েছে। হঠাৎ তিনি কবর থেকে শুনতে পেলেন, এক ব্যক্তি সূরা মুলুক তেলাওয়াত করছে। সে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তেলাওয়াত করল।  সাহাবী এসে রাসূল স. কে ঘটনাটি বলল। রাসূল স. বললেন, সূরা মুলুক করবের আজাব থেকে মুক্তিদানকারী, করবের আজাব থেকে প্রতিরোধক।

ইমাম তিরমিজী রহ. এর হাদীসটি দুর্বল। এরপরও শায়খ আব্দুল ওহাব নজদী এটি প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এবং ইমাম তিরমিজীর হাসান হওয়ার বক্তব্যটি গ্রহণ করেছেন। এই ঘটনা ও হাদীস দেওবন্দী কোন আলেমের কিতাবে থাকলে তাকে নিশ্চিত কবরপূজারী উপাধি দেয়া হতো। শুধু নয়, তাকে কুফুরী-শিরকের অপবাদও দেয়া হতো। অথচ সালাফীদের ইমাম শায়খ আব্দুল ওহাব নজদী এটি তার কিতাবে লিখেছেন। তার সম্পর্কে যখন প্রশ্ন করবেন, তখন একেবারে মুখে কুলুপ এঁটে থাকবে।

বর্তমানে কিছু সালাফী তো নিজেদেরকে বাচানোর জন্য এগুলো অস্বীকার করা শুরু করেছে।  এদের এই অস্বীকারনীতির তালিকা অনেক লম্বা। ইমাম বোখারী রহ. সূরা কাসাসের  ৮৮ নং আয়াতে আল্লাহর ওয়াজহ বা চেহারার ব্যাখ্যা করেছেন রাজত্ব। এটি বোখারীর সকল নুসখা বা কপিতে রয়েছে। যেহেতু এটি সালাফীদের মতের বিরোধী এজন্য আলবানী সাহেব ইমাম বোখারীর বক্তব্যটাই অস্বীকার করে বসেছেন। একে অমুসলিমদের কথা আখ্যা দিয়েছেন।

কিতাবুর রুহ  ইবনুল কাইয়্যিম রহ. এর কিতাব। এটি ইবনে তাইমিয়া রহ. এর ইন্তেকালের পরে লেখা। প্রথম দিকে এরা অপপ্রচার চালাতো ইবনে তাইমিয়া রহ. এর সাথে সাক্ষাতের পূর্বে এটি তিনি লিখেছেন। এই অপপ্রচার যখন মিথ্যা প্রমাণিত হল, তখন কিতাবটি ইবনুল কাইয়্যিমের লেখা নয় বলে মিথ্যাচার শুরু করল। এই হল সহীহ আকিদার ভাইদের আমানত। আস্তাগফিরুল্লাহ। অথচ কিতাবটি ইবনুল কাইয়্যিম রহ. এর হওয়ার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

আহকামু তামান্নিল মাউত কিতাবটি শায়খ আব্দুল ওহাব নজদীর নিজ হাতে লেখা। তার হস্তলিপির কপি এখনও সংরক্ষিত আছে। এটি শায়খ সালেহ আলুশ শায়খ স্বীকার করেছেন। কিন্তু কিতাবে বর্তমান সালাফীদের মতবাদের বিরোধী অনেক বক্তব্য থাকায় কেউ কেউ এটি অস্বীকার করা শুরু করেছে। এটি শায়খ নজদীর কিতাব নয়। যেমন শায়খ সালেহ আল-ফাউজান এটি অস্বীকার করে কিতাব লিখেছেন। শায়খ আব্দুর রাজ্জাক বদরও এটি অস্বীকার করেছেন, এই যুক্তিতে যে, এতে অনেক বাতিল দলিল ও আশ্চর্যজনক ঘটনা  রয়েছে। এগুলো বিদয়াতের প্রতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। সুতরাং এটি শায়খ নজদীর কিতাব হতে পারে না।

যদি মুহূর্তের জন্য ধরেও নেই যে, এটি নজদীর কিতাব নয়, তাহলে যেসব শায়খ একে শায়খ নজদীর কিতাব মনে করেন, তাদের ব্যাপারে কী ফয়সালা হবে? তারা সকলেই কি কবরপূজারী? যেমন শায়খ ইবনে জিবরী ও শায়খ আব্দুর রহমান ইবনে সাদহান? এছাড়াও যারা শায়খের রচনাসমগ্র প্রকাশ করেছে তাদের ব্যাপারে কি ফতোয়া হবে? তারা কুফুরী-শিরকী প্রচার করছে? হকপন্থী আলেমদেরকে নির্দ্বিধায় কুফুরী শিরকের অপবাদ দিলেও সালাফী আলেমদের ব্যাপারে তারা বরাররই নীরবতা ও মিথ্যাচারের আশ্রয় নিচ্ছে। এটি তাদের মারাত্মক খিয়ানত ও দ্বিমুখী চরিত্র আরও প্রকট করে তুলছে।

২. ইবনে রজব হাম্বলী রহ. ইমাম খাল্লাল রহ. থেকে বর্ণনা করেছেন। ইমাম খাল্লালের আস-সুন্নাহ কিতাবটি সালাফীদের মৌলিক আকিদার কিতাব।  ইমাম সূয়ূতী বর্ণনাটি ইবনে মান্দা রহ. থেকে উল্লেখ করেছেন। ইবনে মান্দা রহ. এর আত-তাউহীদ কিতাবটি সালাফীদের মৌলিক আকিদার কিতাব।  ইমাম খাল্লাল নিজ সনদে হাম্মাদ আল-হাফফার থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,

আমি এক জুমুয়ার দিনে কবর স্থানে প্রবেশ করলাম। আমি যতোগুলো কবরের নিকটে গিয়েছি প্রত্যেকটি কবর থেকে কুরআন তেলাওয়াতের আওয়াজ শুনেছি।

-আহওয়ালুল কুবুর, ইবনে রজব হাম্বলী রহ, পৃ.৭০।

-শরহুস সুদুর, সূয়ূতী রহ, পৃ.১৮৮-১৮৯

৩. ইবনে রজব হাম্বলী রহ. আবুল হাসান ইবনুল বারা এর আর-রওজা কিতাব থেকে নীচের ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন। ইবনুল বারা নিজ সনদে ইব্রাহীম আল-হাফফার থেকে বর্ণনা করেন, ” আমি একটি কবর খনন করলাম। সেখানে একটি ইট বেরিয়ে এল।  ইট বের হওয়ার সাথে সাথে সেখান থেকে মেশকের সুঘ্রাণ পাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি  একজন বৃদ্ধ তার কবরে বসে বসে কুরআন তেলাওয়াত করছে।

-আহওয়ালুল কুবুর, ইবনে রজব হাম্বলী রহ, পৃ.৭১।

-শরহুস সুদুর, সূয়ূতী রহ, পৃ.-১৮৯

৪. ইমাম লালকায়ী রহ. এর শরহুস সুন্নাহ কিতাবটি সালাফীদের মৌলিক আকিদার কিতাব।  ইমাম লালকায়ী নিজ সনদে বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মাইন থেকে বর্ণনা করেছেন, ইমাম ইবনে মাইন বলেন, আমাকে কবর খননকারী বলেছে, আমি কবরে অনেক আশ্চর্যজনক জিনিস দেখেছি। এর মাঝে সবচেয়ে আশ্চর্যের হল, এক কবর থেকে মৃদু কান্নার আওয়াজ শুনেছি, যেমন অসুস্থ রোগী কেঁদে থাকে। আর এক মুয়াজ্জিনের কবর থেকে আমি আজানের জওয়াব দিতে শুনেছি।

ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন,

ولا يدخل في هذا الباب: ما يروى من أن قوما سمعوا رد السلام من قبر النبي صلى الله عليه وسلم، أو قبور غيره من الصالحين. وأن سعيد بن المسيب كان يسمع الأذان من القبر ليالي الحرة. ونحو ذلك. فهذا كله حق ليس مما نحن فيه، والأمر أجل من ذلك وأعظم.

অর্থাৎ রাসূল স. এর হাদীস রয়েছে, আল্লাহ তায়ালা ইহুদীদের ধ্বংস করুন। তারা তাদের নবীদের কবরকে সিজদার জায়গা বানিয়েছে।এই হাদীসের ব্যাখ্যায় ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, হাদীসের আলোচনায় নিম্নের বিষয়গুলো অন্তর্ভূক্ত হবে না।

 বর্ণিত আছে, অনেকেই রাসূল স. এর কবর থেকে সালামের উত্তর শুনেছেন। অথবা অন্যান্য বুজুর্গদের কবর থেকে সালামের উত্তর পেয়েছেন। একইভাবে বর্ণিত আছে, হযরত সাইদ ইবনুল মুসায়্যিব রহ. (বিখ্যাত তাবেয়ী) হাররা এর ফেতনার সময় রাসূল স. এর কবর থেকে আজান শুনতেন। এসবই সত্য। আমাদের আলোচ্য বিষয় এটি নয়। বরং আমাদের আলোচ্য বিষয় এর চেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ।

-ইকতেজাউস সিরাতিল মুস্তাকীম। খ.২, পৃ.২৫৪ (শামেলা)

http://shamela.ws/browse.php/book-11620/page-792

রাসূল স. এর কবর থেকে সালামের উত্তর শুনতে পাওয়া সত্য। রাসূল স. এর কবর থেকে আজান শুনে নামায আদায় করা ইবনে তাইমিয়া রহ. এর নিকট সত্য। অথচ তার অনুসারী সালাফীদের  নিকট এটি কুফুরী-শিরকী। তাহলে কি ইবনে তাইমিয়া রহ. ও কুফুরী-শিরকীতে লিপ্ত ছিলেন? সালাফীদের মনস্তত্ব অনুযায়ী ইবনে তাইমিয়া, ইবনুল কাইয়্যিম, ইবনে কাসীর, ইবনে রজব হাম্বলী ও শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাব নজদী সকলেই কবর পূজারী ও কুফুরী-শিরকীতে লিপ্ত ছিলেন। নতুবা একই বিষয় দেওবন্দী আলেমদের কিতাবে থাকলে শিরক হয, অথচ এসব শায়খদের কিতাবে থাকলে শিরক হবে না কেন?

মৃত ব্যক্তি একে-অপরের সাথে সাক্ষাৎ

মৃত ব্যক্তি একে -অপরের সাথে সাক্ষাতের বিষয়টি রাসূল স. এর হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। রাসূল স.বলেন,

” إذا ولي أحدكم أخاه فليحسن كفنه , فإنهم يبعثون في أكفانهم و يتزاورون في

أكفانهم “

অর্থ: তোমরা যখন তোমাদের মৃত ভাইকে বিদায় করবে, তখন তার কাফন সুন্দর করো। কেননা তাদের কাফনে তারা পুনরুত্থিত হবে  এবং তাদের কাফনে তারা একে-অপরের সাথে সাক্ষাৎ করে।

হাদীসটিকে শেইখ নাসীরুদ্দীন আলবানী সহীহ বলেছেন।  সিলসিলাতুস সহীহা, খ.৩, পৃ.৪১১

সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত বিষয়টি যদিও আমাদের জ্ঞানের উর্ধ্বে, তবুও আমরা এটি বিশ্বাস করি।

কবরের বিভিন্ন নেয়ামত ও সংক্রান্ত কারামত:

এ বিষয়ে ইবনে রজব হাম্বলী রহ. বলেন,

و ما شوهد من نعيم القبر و كرامة أهله فكثير أيضا

অর্থ: কবরের বিভিন্ন নেয়ামত ও কবরবাসীর কারামতের উপর বহু ঘটনা  প্রত্যক্ষ করা হয়েছে।

-আহওয়ালুল কুবুর, পৃ.১২১

এরপর এ বিষয়ে তিনি অনেক কারামত ও ঘটনা উল্লেখ করেছেন তার আহওয়ালুল কুবুর কিতাবে।

এ বিষয়ে আমরা শুরুতেই শায়খ ইবনে উসাইমিন রহ. এর বর্ণিত একটি ঘটনা উল্লেখ করছি।  কবরের আজাব রুহের উপর হবে না কি দেহের উপর ?  এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মূল হল, রুহের উপর আজাব হবে।  তবে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, রুহ দেহের সাথে সম্পর্ক রাখে বা মিলিত থাকে। তখন দেহও রুহের সাথে সাথে শাস্তি ও নেয়ামত ভোগ করতে থাকে।  এ বিষয়ে আহলে সু্ন্নত ওয়াল জামাতের আরেকটি বক্তব্য রয়েছে। সেটি হল, কবরের আজাব দেহের উপর হবে। রুহের উপর নয়।  এক্ষেত্রে তাদের দলিল হল, বাস্তবে এটি প্রত্যক্ষ করা হয়েছে। অনেক কবর উন্মোচিত হলে দেখা গেছে, দেহের উপর শাস্তির চিহ্ন রয়েছে। কারও কারও দেহের উপর নেয়ামতের চিহ্ন দেখা গেছে। আমার কাছে কিছু লোক বর্ণনা করেছে। তারা উনাইজাতে ড্রেন খননের কাজ করতো। খনন করতে করতে তারা একটি কবর পেল। কবরে একটি লাশ দেখতে পেল। মাটি লাশের কাফন খেয়ে ফেলেছে। কিন্তু দেহটি এখনও তরু-তাজা রয়েছে।  তারা বলেছে, তারা  এ ব্যক্তির দাড়ীতে মেহেদী দেখেছে। তার কবর থেকে এতো সুঘ্রাণ বের হচ্ছিল যে, এটি মেশকের চেয়েও উন্নত ছিল। তারা এটি রেখে জনৈক শায়খের কাছে গেল।  তিনি তাদেরকে এভাবে রেখে আশে-পাশে খনন করতে বললেন।

-মাজমুউ ফাতাওয়া ও রাসাইল, পৃ.৬৬ ।

http://kl28.com/house_of_knowledge/page/Mjmwa_Ftawa_Wrsaail_Abn_Athymyn_page_66

এধরনের ঘটনা বর্ণনা তথাকথিত আহলে হাদীস ও সালাফীদের নিকট কুসংস্কার প্রচার। মতিউর রহমান মাদানী , তাউসিফুর রহমান রাশেদী, মুরাদ বিন আমজাদ, আকরামুজ্জামানের নিকট এগুলো হল খুরাফাত। এগুলোকে উপলক্ষ্য করে তারা তাবলীগ জামাত ও দেওবন্দী আলেমদেরকে কুফুরী-শিরকীর অপবাদ দিয়ে থাকে। এসব পাতি সালাফীদের বিকৃত মানসিকতার কারণে আজ যেসব কারামত ছিল তাউহীদের প্রমাণ, সেগুলি হয়েছে আজগুবি গল্প, কুফুরী-শিরকী বিশ্বাস। নাউযুবিল্লাহ।

কবরে বিভিন্ন নেয়ামত ও কারামতের কথা অসংখ্য আলেম লিখেছেন।  সম্প্রতি আফগান মুজাহিদদের এধরনের কারামত সংকলন করেছেন শায়খ আব্দুল্লাহ আজ্জাম রহ.। তিনি এজাতীয় বেশ কিছু কারামত উল্লেখ করেছেন তার কিতাবে। আমরা আলোচনার শেষে সেগুলো উল্লেখ করবো।

ইবনে রজব হাম্বলী রহ. কবরের বিভিন্ন নেয়ামত সংক্রান্ত যেসব কারামত লিখেছেন, এগুলো থেকে কয়েকটি নীচে উল্লেখ করা হল।

১.  খতীব বাগদাদী রহ. নিজ সনদে মুহাম্মাদ ইবনে মাখলাদ থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমার মা ইন্তেকাল করেন। আমি তাকে দাফন করার জন্য কবরে অবতরণ করলাম। হঠাৎ পাশের কবরের দিকে একটি ছিদ্র সৃষ্টি হল। আমে দেখতে পেলাম, এক ব্যক্তির লাশ রয়েছে। তার কাফনটি একেবারে নতুন। তার বুকের উপর ইয়াসমীন  নামক সুগন্ধির একটি পাত্র  রয়েছে। আমি সেটি উঠালাম। আমি ও অন্যান্যরা এর সুঘ্রান পাচ্ছিলাম। এটি মেশক থেকে বেশি সুগন্ধিময় ছিল। আমার সাথে একদল লোক ছিল। তারা সকলেই এর ঘ্রাণ শুকেছে।  আমি পাত্রটি পূর্বের জায়গায় রেখে দিলাম। আর গর্তটি বন্ধ করে দিলাম।

-আহওয়ালুল কুবুর, পৃ.১২১

২. ইমাম ইবনুল জাওযী রহ.  নিজ সনদে আবু জা’ফর আস-সাররাজের উস্তাদ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. এর কবরের কাছে এক ব্যক্তির কবর উন্মোচিত হল।  মৃত ব্যক্তির বুকের উপর একটি প্রস্ফুটিত ফুল দেখা গেল।

৩. ইমাম ইবনে সায়াদ তার ত্ববাকাতে নিজ সনদে আবু সাইদ খুদরী রা. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি  জান্নাতুল বাকীতে সায়াদ ইবনে মুয়াজ রা. এর কবর খননকারীদের একজন ছিলাম।  আমরা যখনই কবর থেকে সামান্য মাটি তুলছিলাম, সেখান থেকে মেশকের ঘ্রাণ বের হচ্ছিল।

-আহওয়ালুল কুবুর, পৃ.১২২

৪.  ইমাম ইবনে আবিদ দুনিয়া নিজ সনদে মুগীরা ইবনে হাবিবা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে গালিব আল-হাররানীকে যখন দাফন করা হয়, তখন তার কবর থেকে মেশকের ঘ্রাণ বের হচ্ছিল।

-শরহুস সুদুর, পৃ.১৫৬

সাম্প্রতিক কারামত :

ড. আব্দুল্লাহ আজ্জাম রহ. তার ‘আয়াতুর রহমান’ কিতাবে একটি পরিচ্ছেদের শিরোনাম দিয়েছেন, রাইহাতুশ শুহাদা (শহীদদের সুঘ্রাণ)।  এ পরিচ্ছেদে তিনি অনেকগুলো কারামত উল্লেখ করেছেন।

১. আমার কাছে নাসরুল্লাহ মানসুর বর্ণনা করেছে, তিনি বলেন, আমার কাছে হাবীবুল্লাহ বর্ণনা করেছে, তিনি বলেন,  আমার ভাই যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করে।  তিন মাস পর আমার আম্মা তাকে স্বপ্ন দেখে।  সে স্বপ্নে মাকে বলল, আমার সব ক্ষত সেরেছে, কিন্তু মাথার একটি ক্ষত এখনও শুকায়নি। পরবর্তীতে আমার আম্মা কবর খনেনর জন্য খুব জোরাজুরি করেন। আমরা কবর খুড়তে শুরু করি। আমার ভাইয়ের কবরটি আরেক ব্যক্তির কবরের পাশে ছিল।  খননের সময় একটি গর্ত হয়ে পাশের কবরটি বের হয়ে গেল। আমরা লাশের উপর একটি সাপ দেখতে পেলাম।  আমার আম্মা বললেন, এ কবরটি আর খুড়ো না।  আমি বললাম, আমার ভাই শহীদ হয়েছে। সুতরাং তার কবরে কখনও সাপ থাকতে পারে না। আমরা যখন ভাইয়ের কবরটি খুড়লাম, সেখান থেকে সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ল। আমাদের নাকে ঘ্রাণ মৌ মৌ করছিল। ঘ্রাণের আতিশয্যে আমরা মাতাল হয়ে যাচ্ছিলাম।  আমরা ভাইয়ের মাথায় ক্ষত দেখতে পেলাম। সেখান থেকে রক্ত বের হচ্ছিল।  আমার মা তার রক্তে আঙ্গুল দিলেন।  তার আঙ্গুল সুগন্ধিময় হয়ে গেল।  তিন মাস গত হয়েছে, এখনও আমার মায়ের আঙ্গুল থেকে সুঘ্রাণ বের হয়।

-আয়াতুর রহমান, পৃ.১২৫ ।

২. মুহাম্মাদ শিরীন আমার কাছে বর্ণনা করেছে, আমাদের চারজন মুজাহিদ বুত ওরদাক নামক জায়গায় শাহাদাত বরণ করল।  চার মাস পরে আমরা তাদের থেকে মেশকের মতো সুগন্ধি পেলাম।

-আয়াতুর রহমান, পৃ.১২৫ ।

৩. আমার কাছে আরসালান বর্ণনা করেছে, “আমি অন্ধকার রাতে শহীদ আব্দুল বাসীরকে তার সুগন্ধির মাধ্যমে খুজে বের করেছি।”

-আয়াতুর রহমান, পৃ.১২৪

এগুলো আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ নেয়ামত ও কারামত। এগুলো কোন কাল্পনিক গল্প নয়। এগুলো বাস্তব  সত্য। যাদের কাছে এগুলো গাজাখুরী গল্প ও সূফীদের ভন্ডামি মনে হয়, তারা মূলত: পশ্চিমাদের মতো বস্তুপূজার অতল তলে নিমজ্জিত। আল্লাহর কুদরত ও ক্ষমতায় বিশ্বাসী কোন মু’মিন এগুলোকে কখনও গাজাখুরী বলতে পারে না। তবে  বস্তুপূজা ও পশ্চিমাদের বিকৃত চেতনায় গড়ে ওঠা ব্যক্তিরাই কেবল এগুলো নিয়ে তামাশা ও হাসি ঠাট্রা করে। আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন।

------ ------

লেখকের আরো ব্লগ

আক্বিদা

ইলমের সফর অব্যাহত থাকুক

ইজহারুল ইসলাম রবি, 24 নভে., 2024

খতীব বাগদাদী রহ. তার ‘আল-জামে লি-আখলাকির রাবি ও আদাবিস সামে’ কিতাবে ইমাম আবু ইউসুফ রহ. থেকে একটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন।
الْعِلْمُ شَيْءٌ لا يُعْطِيكَ بَعْضَهُ حَتَّى تُعْطِيَهُ كُلَّكَ
অর্থ: ইলম এমন একটি জিনিস, সে তোমাকে তার কিছু অংশও দিবে না যতক্ষণ না তুমি নিজেকে পূর্ণভাবে তার কাছে সমর্পণ না করবে।

অন্যান্য সৃষ্টি থেকে মানুষের শ্রেষ্ঠত্যের একটি বিশেষ দিক হলো ইলম অর্জনের ক্ষমতা। এটি মানুষের জন্য আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।

ইলমের জন্য যে…

বাকি অংশ পড়তে সাবস্ক্রাইব করুন
আক্বিদা

ইবনে তাইমিয়া রহ. এর কারামত

ইজহারুল ইসলাম রবি, 24 নভে., 2024

ইবনে তাইমিয়া রহ. এর জীবনী আলোচনা করেছেন তার বিশিষ্ট ছাত্র ইবনুল কাইয়্যিম রহ। তার পৃথক জীবনী লিখেছেন ইবনে তাইমিয়া রহ. এর বিশিষ্ট দুই ছাত্র। একজন হলেন, হাফেজ আবু হাফস উমর ইবনে আলি আল-বাযযার (মৃত:৭৪৯ হি:) তিনি আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া লিখেছেন। ইবনে তাইমিয়া রহ. আরেক ছাত্র ইবনে আব্দুল হাদী রহ. (মৃত: ৭৪৪ হি:) আরেকটি জীবনী লিখেছেন। তার লিখিত জীবনীর নাম আল-উকুদুল দুররিয়া মিন মানাকিবি শাইখিল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া।

আমি এখানে ইবনে তাইমিয়া রহ. এর বিশিষ্ট ছাত্রদের বর্ণনায় তার কিছু উল্লেখযোগ্য কারামত উল্লেখ করছি।

কারামত-১:

লওহে মাহফুজ দেখে বিজয়ের সংবাদ:

গায়েবসম্পর্কেইবনেতাইমিয়ারহএরকারামত:

আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) “মাদারিজুস সালিকিন শরহু মানাযিলিস সাঈরিন” নামক কিতাবে আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) এর কারামতের কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) লিখেছেন-

أخبر الناس والأمراء سنة اثنتين وسبعمائة لما تحرك التتار وقصدوا الشام : أن الدائرة والهزيمة عليهم وأن الظفر والنصر للمسلمين وأقسم على ذلك أكثر من سبعين يمينا فيقال له : قل إن شاء الله فيقول : إن شاء الله تحقيقا لا تعليقا  وسمعته يقول ذلك قال : فلما أكثروا علي قلت : لا تكثروا كتب الله تعالى في اللوح المحفوظ : أنهم مهزومون في هذه الكرة وأن النصر لجيوش الإسلام

“তাতারীরা যখন মুসলিম উম্মাহের বিভিন্ন অঞ্চলে সেনা অভিযান পরিচালনা করে এবং শামে আক্রমণের উদ্যোাগ গ্রহণ করে তখন ৭০২ হিঃ সনে শায়েখ (রহঃ) সাধারণ মানুষ এবং আমীর-উমারাদেরকে সংবাদ দিলেন যে, “তাতারীরা পরাজিত হবে এবং মুসলমানরা বিজয় ও সাহায্য লাভ করবে।”। তিনি তাঁর কথার উপর সত্তরটিরও বেশি কসম খেয়েছেন। তাঁকে বলা হল, আপনি ইনশাআল্লাহ বলুন! অতঃপর তিনি বলেন, নিশ্চিতভাবে ইনশাআল্লাহ বলছি, সম্ভাবনা হিসেবে নয়। আমি তাঁকে বলতে শুনেছি, যখন তারা আমার উপর পীড়াপীড়ি করল, আমি তাদেরকে বললাম, তোমরা পীড়াপীড়ি কর না, আল্লাহ তায়ালা লউহে মাহফুজে লিখে রেখেছেন যে, তারা পরাজিত হবে এবং মুসলমানরা বিজয়ী হবে।

[মাদারিজুস সালিকিন, খ–২, পৃষ্ঠা-৪৮৯]

আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) আরও অনেক কারামতের কথা উল্লেখ করেছেন, ইবনে আব্দুল হাদী মুকাদ্দেসী (রহঃ) এবং আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ)। বিস্তারিত জানার জন্য আগ্রহী পাঠক, মাদারিজুস সালিকীন ও আ’লামুল আলিয়্যা গ্রন্থদ্বয় দেখতে পারেন।

¬

কারামত-২: ইবনে তাইমিয়া রহ. এর ভবিষ্যৎবাণী:

আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) এর বিশেষ ছাত্র আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) লিখেছেন-

وأخبرني غير مرة بأمور باطنة تختص بي مما عزمت عليه ولم ينطق به لساني وأخبرني ببعض حوادث كبار تجري في المستقبل ولم يعين أوقاتها وقد رأيت بعضها وأنا أنتظر بقيتها وما شاهده كبار أصحابه من ذلك أضعاف أضعاف ما شاهدته والله أعلم

“তিনি আমাকে অনেকবার অনেক বাতেনি বিষয়ের সংবাদ দিয়েছেন। তিনি শুধু আমাকে এগুলো বলেছেন এবং এ বিষয় সম্পর্কে আমি কাউকে কিছু বলি নি। তিনি আমাকে ভবিষ্যতের অনেক ঘটনার সংবাদ দিয়েছেন কিন্তু তিনি সময় নির্দিষ্ট করে দেননি। তাঁর ভবিষ্যৎ বাণীর কিছু কিছু আমি ঘটতে দেখেছি এবং অবশিষ্টগুলো সংঘটিত হওয়ার অপেক্ষায় আছি। তাঁর বড় বড় সাগরেদগণ আমি যা দেখেছি, তার চেয়ে বহু বহু গুণ বেশি দেখেছেন”

[মাদারিজুস সালিকিন, খ–২, পৃষ্ঠা-৪৯০]

কারামত-৩: অন্তরের বিষয় সম্পর্কে অবগত হওয়া:

ইবনে তাইমিয়া রহ. এর ছাত্র আবু হাফস উমর আল-বাযযার বলেন,

أنه جرى بيني وبين بعض الفضلاء منازعة في عدة مسائل وطال كلامنا فيها وجعلنا نقطع الكلام في كل مسألة بأن نرجع إلى الشيخ وما يرجحه من القول فيها

ثم أن الشيخ رضي الله عنه حضر فلما هممنا بسؤاله عن ذلك سبقنا هو وشرع يذكر لنا مسألة مسألة كما كنا فيه وجعل يذكر غالب ما أوردناه في كل مسأله ويذكر أقوال العلماء ثم يرجح منها ما يرجحه الدليل حتى أتى على آخر ما أردنا أن نسأله عنه وبين لنا ما قصدنا أن نستعلمه منه فبقيت أنا وصاحبي ومن حضرنا أولا مبهوتين متعجبين مما كاشفنا به وأظهره الله عليه مما كان في خواطرنا.”

অর্থাৎ আমার সাথে একজন সম্মানিত আলেমের কয়েকটি মাসআলা নিয়ে বিতর্ক হলো। এ বিষয়ে আমাদের আলোচনা অনেক দীঘর্ হলো। প্রত্যেক মাসআলায় আমরা এভাবে কথা শেষ করলাম যে, মাসআলার সমাধান ইবনে তাইমিয়া রহ. এর কাছ থেকে জেনে নিবো।

এরপর শায়খ রহ. আমাদের নিকট উপস্থিত হলেন। আমরা যখন মাসআলাগুলো সম্পর্কে শায়খকে জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছা করলাম তিনি আমাদের জিজ্ঞাসার পূর্বেই আলোচনা শুরু করলেন। তিনি আমাদের আলোচনা অনুযায়ী একের পর এক মাসআলার সমাধান বলতেছিলেন। প্রত্যেক মাসআলায় আমাদের কাঙ্খিত উত্তর প্রদান করছিলেন। এভাবে তিনি প্রত্যেকটি মাসআলায় উলামায়ে কেরামের বক্তব্য এবং দলিল অনুযায়ী প্রাধান্য পাওয়া মাসআলাটি উল্লেখ করছিলেন। অবশেষে তিনি আমাদের আলোচিত সর্বশেষ মাসআলাটির সমাধান প্রদান করলেন। আমাদের অন্তরের বিষয়গুলো আল্লাহ তায়ালা এভাবে সুস্পষ্ট করে প্রকাশ করায় উপস্থিত লোকজন, আমার সঙ্গী ও আমি আশ্চর্যন্বিত ও বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৩, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

নিচের স্ক্রিনশট দেখুন,

এছাড়া আবু হাফস আল-বাযযার অন্তরের বিষয়ে ইবনে তাইমিয়া রহ. এর অবগত হওয়া সম্পর্কে আরও বলেন,

و كنت في خلال الأيام التي صحبته فيها إذا بحث مسألة يحضر لي إيراد فما يستتم خاطري به حتي يشرع فيرده و يذكر الجواب من عدة وجوه

অর্থাৎ আমি যখন যেসময়ে তার সংস্পর্শে ছিলাম, তখন আমার মনে কোন বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ার সঙ্গে তিনি এর জওয়াব দিতে শুরু করতেন এবং কয়েকভাবে এর উত্তর প্রদান করতেন।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৩, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কারামত-৪: অন্যের সাহায্য

“وحدثني الشيخ الصالح المقريء أحمد بن الحريمي أنه سافر إلى دمشق قال فاتفق أنى لما قدمتها لم يكن معي شئ من النفقة البتة وأنا لا اعرف أحدا من أهلها فجعلت أمشي في زقاق منها كالحائر فإذا بشيخ قد أقبل نحوي مسرعا فسلم وهش في وجهي ووضع في يدي صرة فيها دراهم صالحة وقال لي انفق هذه الآن وخلي خاطرك مما أنت فيه فإن الله لا يضيعك ثم رد على أثره كأنه ما جاء إلا من أجلي فدعوت له وفرحت بذلك، وقلت لبعض من رأيته من الناس من هذا الشيخ؟ فقال وكأنك لا تعرفه هذا ابن تيمية

আমার নিকট শায়খ সালেহ আল –মুকরী বর্ণনা করেন, তিনি  দামেশকের উদ্দেশে সফর করেন। তিনি বলেন, ঘটনাক্রমে ঐ সফরে আমার সঙ্গে কোন চলার মতো কোন খাবার বা অর্থ ছিলো না। আমি ওখানকার কাউকে চিনতাম না। এ অবস্থায় আমি উদভ্রান্তের মতো  দামেশকের অলি-গলিতে ঘুরছিলাম। হঠাৎ একজন শায়খ আমার দিকে দ্রুত গতিতে হেঁটে এলেন। তিনি হাস্যোজ্জল মুখে সালাম দিলেন। তিনি আমার হাতে একটা থলি দিলেন যাতে কিছু খাটি দিরহাম ছিলো। এরপর বললেন, “ এগুলো ব্যবহার করো। তোমার অন্তরে যেই পেরেশানী আছে এগুলো ঝেড়ে ফেলো।  আল্লাহ তায়ালা তোমাকে ধ্বংস করবেন না।” একথা বলে তিনি একই পথে ফিরে গেলেন। তিনি যেন শুধু আমার কাছেই এসেছিলেন। আমি তার জন্য দুয়া করলাম এবং এতে আনন্দি হলাম। আমি অন্যান্য মানুষকে জিজ্ঞেস করলাম, এই শায়খ কে? তারা বললো, তুমি মনে হয় শায়খকে চেনো না, তিনি হলেন ইবনে তাইমিয়া।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৪, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কারামত-৫:

وحدثني الشيخ العالم المقريء تقي الدين عبد الله ابن الشيخ الصالح المقريء احمد بن سعيد قال سافرت إلى مصر حين كان الشيخ مقيما بها فاتفق أني قدمتها ليلا وأنا مثقل مريض فأنزلت في بعض الأمكنة فلم ألبث أن سمعت من ينادي باسمي وكنيتي فأجبته وأنا ضعيف فدخل إلي جماعة من أصحاب الشيخ ممن كنت قد اجتمعت ببعضهم في دمشق فقلت كيف عرفتم بقدومي وأنا قدمت هذه الساعة فذكروا أن الشيخ أخبرنا بأنك قدمت وأنت مريض وأمرنا أن نسرع بنقلك وما رأينا أحدا جاء ولا أخبرنا بشيء، فعلمت أن ذلك من كرامات الشيخ رضي الله عنه.”

শায়খ সালেহ আল-মুকরী এর ছেলে শায়খ তাকিউদ্দীন আব্দুল্লাহ আল-মুকরী আমাকে বলেছেন, শায়খ ইবনে তাইমিয়া রহ. যখন মিশরে ছিলেন তখন আমি মিশরে সফর করি। আমি রাতে মিশরে গিয়ে উপস্থিত হলাম। তখন আমার কাছে ভারী বোঝা ছিল আর আমি অসুস্থ ছিলাম। আমি এক জায়গায় গিয়ে বাহন থেকে নামলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে শুনতে পেলাম এক ব্যক্তি আমার নাম ও উপনাম ধরে ডাকছে। আমি দুর্বল শরীরে তার ডাকে সাড়া দিলাম। তখন শায়খ ইবনে তাইমিয়ার একদল ছাত্র আমার নিকট এলো। তাদের সাথে আমি পূর্বে দামেশকে সাক্ষাৎ করেছিলাম। আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা আমার আগমন সম্পর্কে কীভাবে জানলে; অথচ আমি মাত্র এলাম? তারা বলল, শায়খ ইবনে তাইমিয়া তাদেরকে বলেছে যে, আপনি এসেছেন এবং আপনার শরীর অসুস্থ। আমাদেরকে দ্রুত আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন। আমরা কাউকে আসতেও দেখিনি এবং আপনার সম্পর্কে কেউ পূর্বে সংবাদও দেয়নি। আমি তখন বুঝলাম এটি শায়খের কারামত।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৪, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কারামত-৬:                                  

“وحدثني أيضا قال مرضت بدمشق إذ كنت فيها مرضة شديدة منعتني حتى من الجلوس فلم اشعر إلا والشيخ عند رأسي وأنا مثقل مشتد بالحمى والمرض فدعا لي وقال جاءت العافية، فما هو إلا أن فارقني وجاءت العافية وشفيت من وقتي”

শায়খ সালেহ আল-মুকরী এর ছেলে শায়খ তাকিউদ্দীন আব্দুল্লাহ আল-মুকরী আরও বলেন, আমি দামেশকে কঠিন রোগে আক্রান্ত হলাম। এমনকি আমি বসতেও পারতাম না। হঠাৎ আমার মাথার নিকট শায়খকে দেখতে পেলাম।তখন আমি মারাত্মক জ্বর ও রোগে আক্রান্ত ছিলাম।তিনি আমার জন্য দুয়া করলেন এবং বললেন, সুস্থতা চলে এসেছে।তিনি আমার কাছ থেকে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি সুস্থ হয়ে গেলাম।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৫, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কারামত-৭:

“وحدثني أيضا قال أخبرني الشيخ ابن عماد الدين المقرئ المطرز قال قدمت على الشيخ ومعي حينئذ نفقة فسلمت عليه فرد علي ورحب بي وأدناني ولم يسألني هل معك نفقة أم لا، فلما كان بعد أيام ونفدت نفقتي أردت أن اخرج من مجلسه بعد أن صليت مع الناس وراءه فمنعني وأجلسني دونهم فلما خلا المجلس دفع إلي جملة دراهم وقال أنت الآن بغير نفقة فارتفق بهذه فعجبت من ذلك وعلمت أن الله كشفه على حالي أولا لما كان معي نفقة وآخرا لما نفدت واحتجت إلى نفقة.”

আমার নিকট তিনি আরও বর্ণনা করেছেন, আমার নিকট শায়খ ইবনে ইমাদুদ্দিন আল-মুকরী আল-মুতাররায বর্ণনা করেন, তিনি বলেন আমি একবার শায়খের নিকট আগমন করলাম। তখন আমার কাছে খরচের টাকা-পয়সা ছিলো। আমি তাকে সালাম দিলাম, তিনি উত্তর দিলেন এবং আমাকে স্বাগত জানালেন। আমাকে তিনি তার নিকটে বসালেন। এবার তিনি আমার জীবিকা নির্বাহের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন না। কিছুদিন পর আমার খরচের উপকরণ শেষ হয়ে গেল। তখন আমি তার পিছে নামায আদায় করে তার মজলিশ থেকে বের হতে উদ্যত হলাম। তিনি আমাকে বাধা দিয়ে বসতে বললেন। এরপর যখন মজলিশ শেষ হলো, তখন তিনি আমাকে কিছু দিরহাম দিয়ে বললেন, এখন তোমার কোন খরচের টাকা-পয়সা নেই। এগুলো ব্যবহার করতে থাকে। এ ঘটনায় আমি বিস্মিত হলাম। বুঝলাম যে আল্লাহ তায়ালা আমার পূর্বের ও বর্তমান অবস্থা শায়খের নিকট প্রকাশ করে দিয়েছেন।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৬, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কারামত-৮: মৃত সম্পর্কে সংবাদ:

“وحدثني من لا أتهمه أن الشيخ رضي الله عنه حين نزل المغل بالشام لأخذ دمشق وغيرها رجف أهلها وخافوا خوفا شديدا، وجاء إليه جماعة منهم وسألوه الدعاء للمسلمين فتوجه إلى الله ثم قال أبشروا فإن الله يأتيكم بالنصر في اليوم الفلاني بعد ثالثة حتى ترون الرؤوس معبأة بعضها فوق بعض.قال الذي حدثني فوالذي نفسي بيده أو كما حلف ما مضى إلا ثلاث مثل قوله حتى رأينا رؤوسهم كما قال الشيخ على ظاهر دمشق معبأة بعضها فوق بعض.”

আমার নিকট বিশ্বস্ত এক ব্যক্তি বর্ণনা করেছেন, যখন মোগলরা দামেশক ও অন্যান্য অন্চল দখলের জন্য শামে আক্রমণ করলো, দামেশকের অধিবাসীরা খুবই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। এসময় একদল মুসলমান শায়খ ইবনে তাইমিয়া রহ. এর নিকট আগমন করলেন এবং তাকে মুসলমানদের জন্য দুয়া করার অনুরোধ করলেন। তিনি আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করলেন। এরপর বললেন, তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ করো, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা  তিন দিন পর তোমাদেরকে সাহায্য করবেন, এমনকি তোমরা দেখবে যে একটার উপর আরেকটা মাথা স্তুপ হয়ে থাকবে। ঘটনার বর্ণনাকারী বলেন, আল্লাহর শপথ, তৃতীয় দিন দামেশকের প্রবেশ মুখে শত্রুদের মাথাগুলো একটার উপর আরেকটা স্তুপ হয়েছিলো যেমন শায়খ বলেছিলেন।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৬, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কারামত-৯:

“وحدثني الشيخ الصالح الورع عثمان بن احمد بن عيسى النساج أن الشيخ رضي الله عنه كان يعود المرضى بالبيمارستان بدمشق في كل أسبوع فجاء على عادته فعادهم فوصل إلى شاب منهم فدعا له فشفي سريعا وجاء إلى الشيخ يقصد السلام عليه فلما رآه هش له وأدناه ثم دفع إليه نفقة وقال قد شفاك الله فعاهد الله أن تعجل الرجوع إلى بلدك أيجوز أن تترك زوجتك وبناتك أربعا ضيعة وتقيم هاهنا؟ فقبل يده وقال يا سيدي أنا تائب إلى الله على يدك وقال الفتى وعجبت مما كاشفني به وكنت قد تركتهم بلا نفقة ولم يكن قد عرف بحالي أحد من أهل دمشق.”

শায়খ উসমান ইবনে আহমাদ ইবনে ইসা আন-নাসসাজ আমার নিকট বর্ণনা করেছেন, শায়খ ইবনে তাইমিয়া রহ. দামেশকের বিমারিস্তান নামক জায়গায় প্রত্যেক সপ্তাহে রোগীদের দেখতে আসতেন। অভ্যাস অনুযায়ী তিনি রোগী দেখতে এলেন। তাদের মধ্যে এক যুবককে তিনি দেখলেন এবং তার জন্য দুয়া করলেন। সে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠল। যুবকটি শায়খকে সালাম দেয়ার জন্য এলো। তাকে দেখে শায়খ হাসিমুখে নিকটে বসালেন। তার কাছে কিছু খরচের টাকা-পয়সা দিলেন এবং বলেন, আল্লাহ তায়ালা তোমাকে সুস্থ করেছেন। সুতরাং তুমি আল্লাহর কাছে ওয়াদা করো যে তুমি দ্রুত পরিবারের কাছে ফিরে যাবে। তোমার জন্য কখনও বৈধ হবে যে তোমার স্ত্রী ও চার কন্যাকে ধ্বংসের মুখে রেখে এখানে অবস্থান করবে? যুবকটি বলল, আমি তার হাতে চুমু দিলাম এবং বললাম, শায়খ, আমি আল্লাহর নিকট আপনার হাতে তওবা করছি।

আমি তার কাশফ দেখে বিস্মিত হলাম। বাস্তবেই আমি আমার পরিবারকে সহায়-সম্বলহীন রেখে এসেছিলাম।দামেশকের কেউ আামার পরিবার সম্পর্কে অবগত ছিলো না।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৬, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

এই কারামতগুলো লিখে আবু হাফস আল-বাযযার রহ. লিখেছেন,

و كرامات الشيخ رضي الله عنه  كثيرة جدا لا يليق بهذا المختصر أكثر من ذكر هذا القدر منها . ومن أظهر كراماته أنه ما سمع بأحد عاداه أو غض عنه إلا و أبتلي بعدة بلايا غالبها في دينه وهذا ظاهر مشهور لا يحتاج فيه إلي شرح صفته

শায়খ রহ. অনেক কারামত রয়েছে। এই সংক্ষিপ্ত বইয়ে সেগুলো উল্লেখ করা সঙ্গত নয়। তার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ করামত হলো যে কেউ শায়খের বিরোধীতা করেছে বা তার সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক রয়েছে, সে বিভিন্ন ধরনের বালা-মুসীবতে নিপতিত হয়েছে। বেশিরভাগ মুসীবত দীন সম্পর্কীয়। বিষয়গুলো স্পষ্ট ও প্রকাশিত। এগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা অনাবশ্যক।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৮, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কাশফ ও ইলহাম সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া রহ. এর অনেক কারামত রয়েছে। এ বিষয়ে তার অনেক বক্তব্যও আছে। এগুলোর কিছু কিছু ইবনে তাইমিয়া রহ. এর দৃষ্টিতে তাসাউফ বইয়ে উল্লেখ করেছি। দু:খজনক বিষয় হলো, আমাদের আজকের আলোচনার মূল বিষয় এখনও শুরু করা হয়নি। আজ এখানেই ইতি টানছি। পরবর্তী আলোচনায় গায়েব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করা হবে। 

------ ------

আক্বিদা

আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাকার ইবনে আবিল ইয রহ: হানাফী না কি হাশাবী?

ইজহারুল ইসলাম রবি, 24 নভে., 2024

[বর্তমানে  ইবনে আবিল ইযের  আকিদাতুত ত্বহাবীর  ব্যাখ্যাগ্রন্থটি ব্যাপকভাবে প্রচারের চেষ্টা করা হচ্ছে। যেমন, সালাফী আলেম আব্দুল্লাহ শাহেদ মাদানী এর বাংলা অনুবাদ করে অনলাইনে প্রচার করছেন। সুতরাং এই কিতাবের বাস্তবতা ও এর লেখক সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাগুলো সুস্পষ্ট করা আবশ্যক। আকিদাতুত ত্বহাবীর উপর দরসের নিয়ত ব্যক্ত করেছিলাম কিছু দিন আগে। উক্ত দরসের প্রয়োজনে আজকের আলোচনাটি লেখা। যারা উক্ত দরস দেখবেন, আশা করি বিষয়টি তাদের উপকারে আসবে।  ]

সৌদি আরবের কল্যাণে কাররামিয়াদের ভ্রান্ত দেহবাদী আকিদাগুলো সালাফী মতবাদের মোড়কে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। পেট্র-ডলারের সহায়তায় তারা এক্ষেত্রে অনেকটা অগ্রসর। সালাফীদের ভ্রান্ত আকিদা সম্পর্কে বেশ কিছু প্রবন্ধ লেখার সুযোগ হয়েছে আল-হামদুলিল্লাহ। আমাদের আইডিয়ার ওয়েবসাইটে লেখাগুলো পাবেন। সালাফী মতবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে থাকে। এর মধ্যে একটি বিশেষ কৌশল হল, বিভিন্ন ইমামের আকিদার কিতাব ব্যাখ্যার নামে নিজেদের ভ্রান্ত আকিদা ছড়িয়ে দেয়া। উদাহরণ হিসেবে ইমাম ত্বহাবীর আকিদাতুত ত্বহাবীর কথা বলা যায়। একটু খোজ নিলে দেখবেন, প্রায় প্রত্যেক সালাফী শায়খই আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখেছেন, কেউ অডিও বা ভিডিও লেকচার দিয়েছেন। অন্তত বিশ-পজিশজন বা এর চেয়ে বেশি সালাফী শায়খের ব্যাখ্যা পাবেন। একটি মৌলিক প্রশ্ন হল,  এসব সালাফী আলেমরা কি ইমাম ত্বহাবীর আকিদা পোষণ করেন? ধ্রুব সত্য হল, ইমাম ত্বহাবীর আকিদার সাথে এদের আকিদার দূরতম কোন সম্পর্ক নেই। ইমাম ত্বহাবী রহ. এর আকিদার ও এদের আকিদার মাঝে আসমান-জমিনের ফারাক। আরেকটি প্রশ্ন মনে উকি দেয়, এরা যেহেতু ইমাম ত্বাহাবীর আকিদা পোষণ করে না, তাহলে এর ব্যাখ্যা করে কেন? সহজ উত্তর হল, ইমাম ত্বহাবীর আকিদা প্রচারের ছদ্মাবরণে নিজেদের ভ্রান্ত আকিদা প্রচার। এদের যে কোন একটা ব্যাখ্য পড়লেই এই বাস্তবতা উপলব্ধি করবেন। 

সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে ইমাম ত্বহাবী রহ. এর আকিদাকে বিকৃত করার লক্ষ্যে লিখিত একটি বেনামী ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৩৪৯ হিজরীতে।  বে-নামী ব্যাখ্যা এজন্য বললাম, উক্ত ব্যাখ্যার উপর লেখকের নাম ছিল না। আর প্রশাকগণ নিশ্চিত ছিলেন না যে, ব্যাখ্যাগ্রন্থটি মূলত: কার। পরবর্তীতে তারা তত্ব-তালাশ করে উদ্ধার করেন, এটি ইবনে আবিল ইয আল-হানাফীর লেখা। বর্তমানে এটি ইবনে আবিল ইযের ব্যাখ্যা হিসেবে প্রচার করা হয়। আমাদের আলোচ্য বিষয় শিরোনাম থেকে কিছুটা স্পষ্ট। তবে দু’টি বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করার চেষ্টা করব। ১. ইবনে আবিল ইযের নামে প্রচারিত আকিদা কি আসলেই ইবনে আবিল ইযের লেখা?২. ইবনে আবিল ইযকে হানাফী হিসেবে প্রচার করা হয়। তিনি কি হানাফী ছিলেন না কি দেহবাদী আকিদায় বিশ্বাসী হাশাবী ছিলেন?

প্রচলিত আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যা কি ইবনে আবিল ইযের?

বিষয়টি বোঝার জন্য ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রকাশের ইতিহাসের দিকে ফিরে যেতে হবে। আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যাগ্রন্থটি ১৩৪৯ হিজরীতে মক্কায় সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়।

এই প্রকাশনায় কিতাবের উপর লেখকের কোন নাম ছিল না। বরং প্রকাশকরা লেখেন,

 راجعنا ما في أيدينا من كتب التراجم والفنون، فلم نجد ما يمكننا معه الجزم بنسبته لشخص بعينه، وإنا نثبت هنا أسماء شارحي هذه العقيدة الذين عدهم صاحب كشف الظنون وهم سبعة ……. ومنهم صدر الدين علي بن محمد بن أبي العز الأذرعي الدمشقي الحنفي المتوفى سنة 746هـ وهو الذي يترجح الظن أنه الشارح” আমাদের কাছে বিদ্যমান বিভিন্ন জীবনীগ্রন্থ ও রিজালের কিতাবে আমরা অনুসন্ধান চালিয়েছি। আমরা এমন কোন তথ্য পাইনি, যার আলোকে সুনিশ্চিতভাবে ব্যাখ্যাগ্রন্থটিকে সুনির্দিষ্ট কোন লেখকের দিকে সম্পৃক্ত করা সম্ভব। কাশফুজ জুনুন এর লেখকের বক্তব্য অনুযায়ী আমরা এখানে আকিদাত্ব ত্বহাবীর সমস্ত ব্যাখ্যাকারের নাম উল্লেখ করছি। তারা হলেন সাতজন…….। এদের মাঝে একজন ব্যাখ্যাকার হলেন, সদরুদ্দিন আলী ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবিল ইয হানাফী (মৃত:৭৪৬ হি:)। আমাদের বিশেষ ধারণা হল, সাতজন ব্যাখ্যাকারের মাঝে তিনি হলেন আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাকার। “

এখানে প্রবল ধারণা হিসেবে সদরুদ্দিন আলী ইবনে মুহাম্মাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যার মৃত্যু তারিখ হল, ৭৪৬ হিজরী। আর বর্তমানে প্রচারিত ব্যাখ্যাকার হলেন, আলী ইবনে আলী ইবনে আবিল ইয। যার মৃত্যু তারিখ হল, ৭৯২ হিজরী। এখানে প্রবল ধারণা হিসেবে যার কথা বলা হয়েছে, তিনি হলেন বর্তমানে প্রচারিত লেখকের পিতা। ছেলে আর পিতা কখনও এক হতে পারে না। উভয়ের মৃত্যু তারিখ থেকেও বিষয়টি স্পষ্ট। মোটকথা, ব্যাখ্যাগ্রন্থটি কার সেটা সুনিশ্চিতভাবে বলার মত কোন তথ্য তখনকার উলামায়ে কেরাম পাননি। পরবর্তীতে সৌদি আরবের শায়খগণ বিখ্যাত আলেম আহমাদ শাকেরকে এটি তাহকীক করার অনুরোধ করেন। শায়খ আহমাদ শাকের পরবর্তীতে এটি তাহকীক করে প্রকাশ করেন।

তিনি এর ভূমিকায় লেখেন, ” এ কিতাবের যে মাখতুতা বা হস্তলিপি আমি পেয়েছি, সেখানে মূল লেখকের নেই। সুতরাং কিতাবের লেখক আসলে কে সেটা জানা সম্ভব হয়নি। ” 

শায়খ আহমাদ শাকের তার ভূমিকায় কয়েকবার বলেছেন যে, তিনি এই কিতাবের নির্ভরযোগ্য কোন মাখতুতা বা হস্তলিপি পাননি।

তিনি তার সাধ্য অনুযায়ী এটি তাহকীক করার চেষ্টা করেছেন। শায়খ আহমাদ শাকের আশা ব্যক্ত করেছেন, তিনি যদি নির্ভরযোগ্য কোন হস্তলিপি পান, তাহলে পরবর্তীতে এটি সংশোধনের চেষ্টা করবেন।

শায়খ আহমাদ শাকের বলেন,

 ولكني لا أزال أرى هذه الطبعة مؤقتة أيضا، حتى يوفقنا الله إلى أصل محفوظ للشرح صحيح، يكون عمدة في التصحيح فنعيد طبعه

“আমি এখনও মনে করি, এই সংস্করণ অস্থায়ী। আল্লাহ তায়ালা যদি নির্ভরযোগ্য বিশুদ্ধ কোন হস্তলিপি মিলিয়ে দেন, তাহলে এটি সংশোধন করে নতুনভাবে প্রকাশ করার করব। শায়খ আহমাদ শাকের আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. [মৃত: ১২০৫ হি:] এর একটি বক্তব্য পান ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিনে। সেখানে মোর্তজা যাবিদি রহ. ব্যাখ্যাকারের নাম লিখেছেন, আলী ইবনে আলী ইবনে মুহাম্মাদ আল-গাজ্জী আল-হানাফী। মোর্তজা যাবিদি রহ. এর উদ্ধৃতিতে লেখকের সঠিক পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি।

শায়খ আহমাদ শাকের বলেন, মোর্তজা যাবিদি রহ. লেখকের নামের নিসবতে ভুল করেছেন। তিনি লিখেছেন, আলী ইবনে আলী আল-গাজ্জী, বাস্তবে হওয়ার কথা ছিল, আলী ইবনে আলী ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী। মোটকথা, শায়খ আহমাদ শাকেরের সামনে মোর্তজা যাবিদি রহ. এর উদ্ধৃতি ছিল, বেশ কয়েকটি মাখতুতা ছিল এরপরেও ব্যাখ্যাকার সম্পর্কে সুনিশ্চিতভাবে বলেননিন যে, অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে, উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের লেখক ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী। শায়খ আহমাদ শাকের মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্যের আলোকে তার ধারণা অনুযায়ী কিতাবে লেখকের নাম লিখেছেন, আলী ইবনে আলী ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী। পরবর্তীতে মাকতাবাতুল ইসলামী থেকে শায়খ আলবানীর তাহকীকে ব্যাখ্যাগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। সেখানে কিছু মাখতুতা বা হস্তলিপি এর চিত্র দেয়া হয়েছে। এসকল হস্তলিপিতে স্পষ্টভাবে লেখকের নাম লেখা হয়েছে, আলী ইবনে মুহাম্মাদ। যার মৃত্যু তারিখ, ৭৪৬ হি:। সুতরাং মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্য অনুযায়ী, লেখকের নাম হওয়ার কথা ছিল, আলী ইবনে আলী আল-গাজ্জী। মাকতাবাতুল ইসলামী এর মাখতুতা অনুযায়ী, লেখকের নাম আলী ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবিল ইয। সুতরাং একথা সুনিশ্চিতভাবে বলার অবকাশ নেই যে, উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের প্রকৃত লেখক কে। এরপরেও শায়খ আলবানী ও যুহাইর আশ-শাবীশ দাবী করেন, সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হল, উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের লেখক ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী।

শায়খ যুহাইর আশ-শাবীস নবম সংস্করণের ভূমিকায় ( পৃ.৯) লিখেছেন, 

وأما نسختنا فقد كان اسم مؤلفها مثبتا على الورقة الأولى منها، إلا أن بعض الأيدي قد لعبت فيه بالمحو والكتابة أكثر من مرة، وأخيرا أثبت عليه ما أثبته الشيخ أحمد شاكرঅর্থ: আমাদের মূল হস্তলিপিতে লেখকের নাম প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা ছিল। তবে অজ্ঞাত কেউ উক্ত নাম কয়েকবার ঘষা-মাজা করে নতুনভাবে লিখেছে। অবশেষে আমি শায়খ আহমাদ শাকেরের তথ্য অনুযায়ী লেখকের নাম উল্লেখ করেছি।মোটকথা, এই ব্যাখ্যাগ্রন্থের মূল হস্তলিপিতে লেখকের নাম উল্লেখ নেই। পরবর্তীতে বিভিন্ন ঘষা-মাজার মাধ্যমে অজ্ঞাত কেউ হস্তলিপিতে লেখকের নাম সংযুক্ত করেছে। ঘষা-মাজা করে নাম সংযুক্ত করার পরও বর্তমানে প্রচলিত লেখকের নাম উক্ত হস্তলিপিতে নেই। বরং প্রচলিত লেখকের পিতার নাম ও তার মৃত্যু তারিখ দেয়া রয়েছে।

 চূড়ান্ত কথা:

ইবনে আবিল ইয এধরণের ব্যাখ্যাগ্রন্থ লেখাটা অসম্ভব নয়। প্রবল ধারণা মতে হয়ত তিনি এটি লিখেছেন। কিন্তু ইবনে ইয এর লেখক হওয়ার ব্যাপারে অকাট্য কোন প্রমাণ কারও কাছে নেই, যার আলোকে নি:সন্দেহে বলা যাবে, এটি ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী লিখেছেন। ইবনে আবিল ইয আল-হানাফীর জীবনী থেকে একটা ধারণা সৃষ্টি হয়, হয়ত তিনি এটি লিখেছেন। আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. এর উদ্ধৃতি থেকে হয়ত ধারণাটি আরেকটু মজবুত হয়। কিন্তু এটা সুনিশ্চিত বা অকাট্য কোন প্রমাণ বলার সুযোগ নেই। উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের লেখক ইবনে আবিল ইয হলেও আমাদের কোন আপত্তি নেই। না হলেও এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই। কিতাবটি ছেলে লিখেছে না কি তার পিতা লিখেছে সেটাও মৌলিক কোন বিষয় নয়।

 আমাদের নিকট মূল বিবেচ্য বিষয় হল, ইবনে আবিল ইযকে হানাফী হিসেবে প্রচার করা হয়। সেই সাথে এটাও বোঝানো হয় যে, তিনি হানাফীদের আকিদার প্রতিনিধত্ব করেন। অন্যান্য হানাফীগণ তার বিরোধীতা করে মূলত: হানাফীদের মৌলিক আকিদার বিরোধিতা করে থাকে।

আমাদের সামনে মৌলিক কয়েকটি প্রশ্ন দেখা দিয়েছে,

১. ইবনে আবিল ইয বাস্তবেই কি হানাফী ছিলেন?

২. তিনি আদৌ কি হানাফী মাজহাবের সুপ্রতিষ্ঠিত আকিদার অনুসারী ছিলেন?৩. তার লেখা ব্যাখ্যাগ্রন্থ ইমাম ত্বহাবী বা হানাফী মাজহাবের মৌলিক আকিদার প্রতিনিধিত্ব করে কি?৪. ইবনে আবিল ইযের আকিদা হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমদের নিকট নির্ভরযোগ্য কি?

৫. ইবনে আবিল ইযকে হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণ নির্ভরযোগ্য আলেম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন কি?

৬. হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণ ইবনে আবিল ইযের আকিদার সাথে সহমত পোষণ করেন না কি তার প্রবল বিরোধীতা করেন?

৭. হানাফী মাজহাবের উলামায়ে কেরামের জীবনীর উপর বিভিন্ন গ্রন্থ লেখা হয়েছে। এসকল কিতাবে হানাফী আলেম হিসেবে তার জীবনী বা নির্ভরযোগ্য আলেম হিসেবে কোথাও  তস্বীকৃতি দেয়া হয়েছে কি?আমরা ইনশাআল্লাহ প্রত্যেকটি বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করব। 

ইবনে আবিল ইযের মাজহাব:

শরহে আকিদাতু ত্বহাবীর তাহকীক করেছেন, শায়খ শুয়াইব আরনাউত ও শায়খ আব্দুল্লাহ তুরকী। তারা উক্ত তাহকীকে ইবনে আবিল ইযের জীবনী আলোচনা করেছেন। তার জীবনী আলোচনা করতে গিয়ে তারা লিখেছেন, ইবনে আবিল ইযকে হানাফী মাজহাবের দিকে সম্পৃক্ত করা হয়। তবে বাস্তবে তিনি নিজের গর্দানকে তাকলীদের (মাজহাব অনুসরণ) বন্ধন থেকে মুক্ত করেন।  শায়খ শুয়াইব আরনাউত ও শায়খ আব্দুল্লাহ তুরকীর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ইবনে আবিল ইয একজন গাইরে মুকাল্লিদ, লা-মাজহাবী বা যাহেরী ছিল। 

ইবনে আবিল ইয পারিবারিকভাবে হানাফী ছিল। যেমন শায়খ আলবানী পারিবারিকভাবে হানাফী ছিল। কিন্তু কেউ হানাফী পরিবারে জন্মগ্রহণ করলে, কিংবা হানাফী মাদ্রাসায় পড়লে বা পড়ালে সে হানাফী হয়ে যায় না। আমাদের দেশের অধিকাংশ লা-মাজহাবী হানাফী পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও তারা গাইরে মুকাল্লিদ। একইভাবে বর্তমানে আহলে হাদীসদের অধিকাংশ শায়খ হানাফী মাজহাবের মাদ্রাসায় পড়া-লেখা করেছে, কিন্তু তারা হানাফী নয়। সুতরাং কারও হানাফী হওয়াটা তার পরিবার, পিতা-মাতা বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করে না। ইবনে আবিল ইয জন্মগতভাবে হানাফী হলেও বাস্তবে সে হানাফী নয়। বরং  ইবনে আবিল ইয একজন গাইরে মুকাল্লিদ বা লা-মাজহাবী।সুতরাং তাকে হানাফী হিসেবে প্রচার করে তাকে হানাফী মাজহাব বা আকিদার প্রতিনিধি হিসেবে প্রকাশ করা একটি মারাত্মক ভুল। 

যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেই যে, ইবনে আবিল ইয হানাফী ফিকহের অনুসারী ছিল, কারণ সে হানাফী মাজহাবের মাদ্রাসায় শিক্ষতা করেছে, তাহলে এটি কখনও বলা সম্ভব নয় যে, সে আকিদার দিক থেকেও হানাফী ছিলা। মু’তাজিলা সম্প্রদায়ের অনেকেই হানাফী মাজহাবের অনুসারী ছিল, কিন্তু তাদের কাউকে হানাফী বলা হয় না। একইভাবে কাররামিয়াদের অনেকেই হানাফী মাজহাব অনুসরণ করত। কিন্তু তাদেরকেও হানাফী বলা হয় না। ফিকহের দিক থেকে কেউ হানাফী ফিকহ অনুসরণ করলেই তাকে হানাফী হিসেবে পরিচয় দেয়া হয় না। কারণ হানাফী হিসেবে কারও পরিচিতি এটা প্রমাণ করে যে, সে আকিদা ও ফিকহ উভয় ক্ষেত্রে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অন্তর্ভূক্ত। কেউ যদি ফিকহের ক্ষেত্রে হানাফী মাজহাব অনুসরণ করে, কিন্তু আকিদার ক্ষেত্রে আহলে সু্ন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত আকিদা পোষণ করে তাকে হানাফী বলা হয় না। বরং আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত আকিদার দিকে তাকে সম্পৃক্ত করা হয়। কাররামিয়া মতবাদের অনুসারী কারও নামের শেষে হানাফী লাগিয়ে দিয়ে আকিদা ও ফিকহে তাকে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অন্তর্ভূক্ত করার অপচেষ্টা কেউ করলে সেটি অবশ্যই বাস্তবতা বিরোধী। সুতরাং ফিকহ ও আকিদা উভয় ক্ষেত্রে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত ইবনে আবিল ইযকে কীভাবে হানাফী হিসেবে পরিচয় দেয়া হয়? তার বাহ্যিক অবস্থা বিবেচনা করে হানাফী লিখলেও তাকে যদি কেউ হানাফী ফিকহ বা আকিদার প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন করে, তাহলে অবশ্যই আমরা বলব, প্রকৃতপক্ষে ইবনে আবিল ইয ফিকহ ও আকিদা কোন ক্ষেত্রেই হানাফী ছিল না। বরং সে কাররামিয়াদের অনুসারী হাশাবী বা দেহবাদী আকিদায় বিশ্বাসী ছিল। ইবনে আবিল ইযের যেসকল কিতাব তার দিকে সম্পৃক্ত করা হয়, তার প্রত্যেকটি সে হানাফী মাজহাবের বিরুদ্ধে লিখেছে। হানাফী মাজহাবের পক্ষে তার বিশেষ কোন খেদমত নেই।

ইবনে আবিল ইযের গাইরে মুকাল্লিদ হওয়ার আরেকটি প্রমাণ হল, তার একটি কিতাব বর্তমানের আহলে লা-মাজহাবীরা প্রচার করে থাকে। আহলে হাদীস আলেম আতাউল্লাহ হানীফ ইবনে আবিল ইযের “আল-ইত্তেবা” কিতাবটি তাহকীক করে প্রকাশ করেছে। পরবর্তীতে আবু সুহাইব আসিম ইবনে আব্দুল্লাহ  আল-কারইউতী এটি তাহকীক করেছে। আবু সুহাইব এই কিতাবের ভূমিকায় হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেম আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. ও আল্লামা যফর আহমাদ উসমানী রহ. এর বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছে এবং এসমস্ত বিখ্যাত আলেমদের বিরুদ্ধে ইবনে আবিল ইযের বক্তব্য উপস্থাপন করেছে। যেখানে ইবনে আবিল ইয সুনিদিষ্ট একটি মাজহাবের অনুসারীকে শিয়াদের সাথে তুলনা করেছে। নাউযুবিল্লাহ। ইবনে আবিল ইযের অবস্থা থেকে বাংলা ভাষার প্রসিদ্ধ একটি প্রবাদবাক্য মনে পড়ে গেল।  “মার চেয়ে মাসির দরদ বেশি” ।ইবনে আবিল ইযের প্রতি সালাফী ও আহলে হাদীসদের অতিশয় আগ্রহ এটিই প্রমাণ করে।  বর্তমানের সালাফীরা হানাফী মাজহাবের উলামায়ে কেরামকে তাদের আকিদার বিরোধী হওয়ার কারণে কাফের, বিদযাতী, জাহমী, মুয়াত্তিলা ইত্যাদি আখ্যায়িত করে। এ বিষয়ে অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে।  হানাফী মাজহাবের অধিকাংশ আলেম যাদের কাছে কাফের ও বিদয়াতী, তারাই ইবনে আবিল ইযের আকিদা প্রচার করছে। আবার উপমহাদেশের লা-মাজহাবীরা মাজহাবের অনুসারীদেরকে মুশরিক বলে বিশ্বাস করে, অথচ তারাই আবার ইবনে আবিল ইযের কিতাব প্রকাশ ও প্রচার করছে। ইবনে আবিল ইয আসলেই যদি হানাফী হত, তাহলে হানাফীদেরকে যারা কাফের-মুশরিক আখ্যা দিচ্ছে, তারা কেন তার কিতাব নিয়ে এত মাতামাতি করে?

ইবনে আবিল ইয সম্পর্কে হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণের বক্তব্য:

মোল্লা আলী কারী রহ. এর বক্তব্য:

মোল্লা আলী কারী রহ. শরহে ফিকহুল আকবারে আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যাকার সম্পর্কে লিখেছেন, 

 والحاصل ان الشارح يقول بعلو المكان مع نفي التشبيه وتبع فيه طائفة من أهل البدعة

মোটকথা, আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যাকার  তাশবীহমুক্ত অবস্থায় আল্লাহ তায়ালা স্থানগতভাবে উপরের দিকে রয়েছেন বলে বিশ্বাস করে। এক্ষেত্রে সে একদল বিদয়াতীর অনুসরণ করেছে। তিনি আরও বলেন,

 و من الغريب أنه إستدل على مذهبه الباطل برفع الأيدي في الدعاء إلى السماء

 অর্থ: আশ্চর্যের বিষয় হল, সে তার ভ্রান্ত মতবাদ প্রমাণ করতে গিয়ে দুয়ার সময় হাত উপরের দিকে উঠানোর দলিল দিয়েছে। (শরহুল ফিকহিল আকবার, পৃ.১৭২. আল-ইলিময়া)মোল্লা আলী কারী রহ. এর বক্তব্য থেকে দু’টি বিষয় স্পষ্ট। তিনি ইবনে আবিল ইযকে বিদয়াতীদের অনুসারী বলেছেন। এবং তার মতবাদকে বাতিল বা ভ্রান্ত মতবাদ আখ্যায়িত করেছেন। 

আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্য:

আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিনে ইবনে আবিল ইয সম্পর্কে লিখেছেন,

“ولما تأملته حق التأمل؛ وجدته كلامًا مخالفًا لأصول مذهب إمامه!! وهو في الحقيقة كالرد على أئمة السنة، كأنه تكلم بلسان المخالفين، وجازف وتجاوز عن الحدود، حتى شبه قول أهل السنة بقول النصارى! فليتنبه لذلك”.

অর্থ: আমি  তার (ইবনে আবিল ইযের) বক্তব্য সম্পর্কে পরিপূর্ণ চিন্তা-ভাবনা করে দেখেছি, তার বক্তব্য তার ইমামের মাজহাবের মৌলিক নীতিমালার সম্পূর্ণ বিরোধী। বরং প্রকৃতপক্ষে তার বক্তব্য যেন আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের ইমামগণের বক্তব্য খন্ডনে লিখিত।  তার বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয়, সে যেন আহলে সুন্নতের ইমামগণের সাথে প্রতিপক্ষ হিসেবে কথা বলেছে। সে মারাত্মক বিকৃতির শিকার হয়েছে এবং সীমা অতিক্রম করেছে। এমনকি সে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের ইমামগণের বক্তব্যকে খ্রিষ্টানদের বক্তব্যের সাথে তুলনা করেছে। সুতরাং এ বিষয় সতর্ক থেক। [ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিন, খ.২, পৃ.১৪৬]

আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্য থেকে যেসকল বিষয় স্পষ্ট:

১. ইবনে আবিল ইয হানাফী মাজহাবের মৌলিক নীতিমালা অনুসরণ করত না।

২. তার লেখনী মূলত: হানাফী মাজহাব ও আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের বক্তব্য খন্ডনের উদ্দেশ্যে লিখিত।৩. হানাফী মাজহাব ও আহলে সুন্নতের উলামায়ে কেরামের সাথে যেন সে প্রতিপক্ষ হিসেবে কথা বলেছে।

৪.সে মারাত্মক প্রগলভতার  শিকার হয়ে সীমা অতিক্রম করেছে। 

৫. আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের উলামায়ে কেরামের বক্তব্যকে খ্রিষ্টানদের বক্তব্যের সাথে তুলনা করেছে।

 ৬. আল্লামা যাবিদি রহ. তার এসব বক্তব্যের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেছেন। 

আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. এর বক্তব্য:

হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত ইমাম আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাকার সম্পর্কে বলেন,

وطبع شرح لمجهول ينسب إلى المذهب الحنفي زورا ينادي صنع يده بأنه جاهل بهذا الفن وأنه حشوي مختل العيار

“আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যা হিসেবে একজন অজ্ঞাত ব্যক্তির একটি ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। যাকে বানোয়াটী করে হানাফী মাজহাবের দিকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এ লোকের লেখনী দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করে যে  সে আকিদা সম্পর্কে অজ্ঞ। সে একজন হাশাবী বা দেহবাদী এবং মারাত্মক বিচ্যুতির শিকার। “[আল-হাবী ফি সিরাতিল ইমামিত ত্বহাবী, পৃ. ৩৮]আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. এর বক্তব্য থেকে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট। প্রথমত: ইবনে আবিল ইযকে হানাফী মাজহাবের দিকে সম্পৃক্ত করা একটি বানোয়াট বা মিথ্যা। বাস্তবে সে হানাফী ছিল না। দ্বিতীয়ত: ইবনে আবিল ইয আকিদা বিষয়ে জাহেল বা অজ্ঞ ছিল এবং সে একজন মুজাসসিমা বা দেহবাদী আকিদার অনুসারী হাশাবী ছিল। আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. এর বক্তব্য অনুযায়ী আমরা ইবনে আবিল ইযকে হানাফী না বলে দেহবাদী আকিদার অনুসারী হাশাবী বলতে পারি। 

ইবনে আবিল ইযের সম-সাময়িক আলেমগণের বিরোধীতা:ইবনে আবিল ইযের ভ্রান্ত কিছু বক্তব্য প্রকাশিত হওয়ার তখনকার বিখ্যাত আলেমগণ তার প্রতিবাদ করেন। বিশেষভাবে অন্যান্য তিন মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণের সাথে হানাফী মাজহাবের আলেমগণও তার প্রতিবাদ করেন।

আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহ. তার ‘ইম্বাউল গুমর বি আবনায়িল উমর’ কিতাবে লিখেছেন,

وأن العلماء بالديار المصرية خصوصا أهل مذهبة من الحنفية أنكرواذلك عليه

অর্থ: মিশরের আলেমগণ বিশেষভাবে তার মাজহাব তথা হানাফী মাজহাবের উলামায়ে কেরাম তার বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন। [ইমবাউল গুমর, খ.২, পৃ.৯৬]

যেসব উলামায়ে কেরাম ইবনে আবিল ইযের বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন, এদের মাঝে বিখ্যাত কিছু আলেমের নাম উল্লেখ করেছেন ইবনে হাজার আসকালানী রহ.। যেমন, যাইনুদ্দীন ইবনে রজব রহ, তকীউদ্দীন ইবনে মুফলিহ রহ. শরফুদ্দীন ইবনে গাজ্জী রহ. ।

বর্তমানে সালাফীরা ইবনে আবিল ইযের আরেকটি কিতাব প্রকাশ করেছে। কিতাবের নাম হল, আত-তাম্বীহ আলা মুশকিলাতিল হিদায়াহ। সালাফী আলেমরা ইবনে আবিল ইযের রচনা হিসেবে এটি প্রকাশ করেছে। যদিও কিতাবটি ইবনে আবিল ইযের নাকি তার দাদার এটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সালাফীদের বক্তব্য অনুযায়ী কিতাবটি যদি ইবনে আবিল ইযের হয়, তাহলে তার সম্পর্কে হানাফী মাজহাবের আরও কিছু উলামায়ে কেরামের বক্তব্য শুনুন। 

ইমাম সাখাবী রহ. তার আজ-জাওউল লামে কিতাবে লিখেছেন, হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত ইমাম কাসেম ইবনে কুতলুবুগা ইবনে হেদায়া কিতাবের উপর ইবনুল ইযের অভিযোগ খন্ডন করে কিতাব লিখেছেন। “صنّف “أجوبةً عن اعتراضات ابن العزّ على الهداية”[আজ-জাওউল লামে, খ.৬, পৃ.১৮৭]

সালাফীরা ইবনে আবিল ইযের উক্ত কিতাবকে হেদায়ার ব্যাখ্যা হিসেবে প্রচারের চেষ্টা করলেও এটি মূলত: হেদায়া কিতাবের উপর তার অভিযোগ সংকলন। একারণে আল্লামা কাসেম ইবনে কুতলুবুগা তার অভিযোগ খন্ডন করেছেন। একইভাবে আল-বাহরুর রায়েকে রয়েছে ফাতহুল কাদীরে আল্লামা ইবনুল হুমাম ইবনুল ইযের বক্তব্য খন্ডন করেছেন।

 وَقَدْ أَطَالَ فِي فَتْحِ الْقَدِيرِ فِي بَيَانِهِ إطَالَةً حَسَنَةً وَتَعَرَّضَ لِلرَّدِّ عَلَى ابْنِ الْعِزِّ، وَلَسْنَا بِصَدَدِ ذَلِكَ

[আল-বাহরুর রায়েক, বাবুল ইয়ামীন ফিল আকলি ওয়াশ শুরব]

সালাফীদের বক্তব্য অনুযায়ী আত-তাম্বীহ আলা শরহিল হেদায়া কিতাবটি যদি আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাকার ইবনে আবিল ইযের হয়, তাহলে তার বক্তব্য আল্লামা হাসকাফী ও আল্লামা ইবনে আবিদীন খন্ডন করেছেন। তার বক্তব্যকে গরীব (আশ্চর্যজনক) আখ্যা দিয়েছেন। বিস্তারিত,

 “قال (ابن العز!): فحينئذ ينقض الوضوء، وهو فرع غريب وتخريج ظاهر.قال المصنف: ولظهوره عوّلنا عليه.قلت: قال شيخنا الرملي حفظه الله تعالى: كيف يعول عليه وهو مع غرابته لا يشهد له رواية ولا دراية، أما الاولى فظاهر إذا لم يرو عن أحد ممن يعتمد عليه، وأما الثانية فلعدم تسليم المقدمة الاولى ويشهد لبطلانها مسألة الجدي إذا غذي بلبن الخنزير فقد عللوا حل أكله بصيرورته مستهلكا لا يبقى له أثر، فكذلك نقول في عرق مدمن الخمر، ويكفينا في ضعفه غرابته”.[রদ্দুল মুহতার, খ.৬, পৃ.১৪৬-১৪৭]

আকিদার ক্ষেত্রে ইবনে আবিল ইযের বিচ্যুতি সুস্পষ্ট। অধিকাংশ বিষয়ে সে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত আকিদা পোষণ করে। এবং কাররামিয়া ও মুজাসসিমাদের ভ্রান্ত বক্তব্য প্রচার করেছে। আকিদাতুত ত্বহাবীর সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা ভিডিও আকারে প্রকাশের নিয়ত রয়েছে। আমাদের আলোচনায় ইবনে আবিল ইযের ভ্রান্ত মতবাদগুলি বিস্তারিত উল্লেখ করা হবে ইনশাআল্লাহ। এখানে সংক্ষেপে দু’একটি বিষয় উল্লেখ করা মুনাসিব মনে করছি। এসকল বিষয়ের কয়েকটি কুফুরী পর্যায়ের। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করেন। 

১. কিছু সৃষ্টি কাদীম বা অবিনশ্বর। অনাদী থেকেই বিদ্যমান। এটি তাসালসুলুল হাওয়াদিস নামে পরিচিত। [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.১২৯, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]

২. আল্লাহ তায়ালার হদ বা সীমা রয়েছে।  [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.২১৯, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]

৩. আল্লাহর সত্তার মাঝে নশ্বর বিষয় সৃষ্টি হয়।  [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.১৭৭, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]

৪. আল্লাহর বক্তব্যের অক্ষর ও শব্দ রয়েছে।  [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.১৬৯, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]

৫. আল্লাহ তায়ালা স্থানগতভাবে উপরের দিকে রয়েছেন। অর্থাৎ আল্লাহর দিক রয়েছে। 

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে দেহবাদী আকিদার ভ্রান্তি থেকে হেফাজত করুন। আমীন।

------ ------

আক্বিদা

আল্লাহ তায়ালার এককত্বের প্রমাণ

ইজহারুল ইসলাম রবি, 24 নভে., 2024

ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের মাঝে সর্বপ্রধান বিষয় হল, আল্লাহর তাওহীদ তথা একত্বের উপর ঈমান আনয়ন করা। এই বিশ্বাস করা যে, সৃষ্টা হিসেবে তিনি একক, গুণাবলীর বিবেচনায় তিনি একক এবং উপাসনার যোগ্য একমাত্র তিনিই। পবিত্র কুরআন ও রাসূল (সঃ) এর সমস্ত হাদীস তাওহীদ তথা আল্লাহর এককত্বের উপর ভিত্তি করেই আবর্তিত। কোন বিষয়ে আল্লাহর সমকক্ষ বা অংশীদার নেই, এটিই এ বিশ্বাসের মূলমন্ত্র। পবিত্র কুরআনের ১১২ নং সূরায় এ বিষয়টি সুষ্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষিত হয়েছে। সে প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর অস্তিত্ব অনুভব করে এবং আল্লাহর এককত্বের স্বাক্ষর প্রদান করে।

আমরা এখানে আল্লাহর এককত্বের উপর পাঁচটি যুক্তি উপস্থাপন করব।

অকহ্যাম রেজর এর তত্ত্ব

কুরআন স্পষ্টভাষায় জিজ্ঞাসা করেছে, এই মহাবিশ্ব কি এমনিতেই সৃষ্টি হয়েছে? এর উত্তর খুবই সহজ ও স্পষ্ট। কেননা ভৌত পদার্থবিদ্যা এবং সকল দর্শন এবিষয়ে একমত যে, যে বস্তু অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এসেছে, তার অস্তিত্বের পিছে একটি কজ বা কারণ রয়েছে। আর মহাবিশ্ব যেহেতু অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এসেছে এজন্য এর পিছে একটি কারণ বা কজ রয়েছে। মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পিছে একটি সামগ্রিক কজ বা কারণ থাকাটাই যুক্তিযুক্ত। অসীম সংখ্যক কারণ থাকাটা অসম্ভব। কেননা বাস্তবে কখনও অসীম কোন কিছু থেকে আমরা কোন ফলাফল লাভ করি না।

উদাহরণ হিসেবে নীচের দু’টি বিষয় লক্ষ্য করুণ-

১. কোন কক্ষে যদি অসীম সংখ্যক মানুষ থাকে এবং সেখান থেকে যদি আমি দু’জনকে বাদ দেই, তাহলে কতজন থাকবে? আপনি উত্তর দিবেন, অসীম বিয়োগ দুই। অর্থাৎ অসীম থেকে দু’জনকে বাদ দিলে যা থাকে। এর দ্বারা বাস্তবে কোন অর্থ বোঝায় কি? অসীম থেকে যদি দুজনকে বাদ দেয়া হলেও কক্ষে অসীম সংখ্যক মানুষই থেকে যাবে। বাস্তবে এটি বিশেষ কোন অর্থ প্রদান করে না। আপনাকে যদি কক্ষের অসীম সংখ্যক লোক গণনা করতে বলা হয়, আপনার পক্ষে তা গণনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু লোকসংখ্যা যদি অসীম থেকে সামান্য কমিয়ে গণনা করতে বলা হয়, তবুও আপনার পক্ষে তা গণনা করা সম্ভব নয়। এর অর্থ হল, বাস্তব জীবনে অসীম সংখ্যা থেকে বিশেষ অর্থ বোঝা সম্ভব নয়। 

২. মনে করুন, আমি একজন সৈনিক। আমি একটা শত্রুকে গুলি করতে চাই। আমার গুলি করার জন্য আমার পেছনের সৈনিকের অনুমতি নেয়া প্রয়োজন। আমার পিছের সৈনিকের জন্য আবার তার পেছনের সৈনিকের অনুমতি প্রয়োজন। এভাবে এ ধারা যদি চলতে থাকে এবং আমার গুলি করার জন্য অসীম সংখ্যক সৈনিকের অনুমতির প্রয়োজন হয়, তবে আমি কি আদৌ শত্রুকে গুলি করতে পারব? উত্তর খুবই সহজ ও স্বাভাবিক। একইভাবে আমি মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পিছে যদি অসীম সংখ্যক কারণ ধরে নেই, তবে আদৌ মহাবিশ্বের অস্তিত্ব সম্ভব হত না। এবং কখনও এটি অস্তিত্বে আসত না। সুতরাং মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পিছে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বাধীন ও একক কারণ থাকাটাই যুক্তিসঙ্গত।

আপনি এ যুক্তি দেখাতে পারেন যে, উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্য তথা স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বাধীন একাধিক কারণ একই সাথে ক্রিয়াশীল হলে সমস্যা কোথায়? 

আমি বলব, আপনার এ যুক্তিটা খুবই দুর্বল প্রকৃতির। চতুর্দশ শতাব্দীর দার্শনিক অকহ্যাম রেজর এর তত্ত্বের মাধ্যমে আপনার এ যুক্তির অসারতা প্রমাণিত হয়। অকহ্যাম রেজরের নীতি হল, প্রয়োজন ছাড়া বহু সংখ্যার ব্যবহার অনুচিৎ। আরেকটু সহজ করে বললে এভাবে বলা যায়,  সবচেয়ে সরল ও সর্বাধিক অর্থবহ ব্যাখ্যা হল, সর্বোত্তম ব্যাখ্যা।

অতএব, কোন প্রমাণ ছাড়া কিংবা প্রয়োজন ছাড়া আমরা এটা বলতে পারি না যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির পিছে অনেকগুলো কারণ ক্রিয়াশীল। সুতরাং এক্ষেত্রে আমাদেরকে সবচেয়ে অর্থবহ ও সরল কারণ তথা মহাবিশ্ব সৃষ্টির একক কারণকেই গ্রহণ করতে হবে। কেননা এক্ষেত্রে আমাদেরকে কাছে কোন প্রমাণ নেই যে আমরা বলতে পারি, মহাবিশ্বের সৃষ্টি মূলতঃ দুটি, তিনটি, কিংবা কয়েক হাজার কারণের কম্বিনেশন বা সমন্বয়। একাধিক কারণ গ্রহণের দ্বারা একটি স্বাধীন, স্বয়ংসম্পূর্ণ কারণে অতিরিক্ত কোন মাত্রা যোগ হয় না।

যেমন, যখন বলা হল, মহাবিশ্ব একটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কারণের দ্বারা সৃষ্ট, এ কথা দ্বারা যে অর্থ স্পষ্ট হয়েছে, যদি বলা হয়, মহাবিশ্ব দু’টি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কারণের দ্বারা সৃষ্ট, এ কথার দ্বারা অতিরিক্ত কোন অর্থ প্রকাশ পায় না। কেননা আমি যখন বলছি, কারণটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী তখন অন্য কোন সর্বময় ক্ষমতার প্রয়োজন নেই। কারণটি যদি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী না হত, তবে সাহায্যকারী হিসেবে অন্য কোন কারণের প্রয়োজন পড়ত। এক্ষেত্রে কোন কারণই তখন স্বাধীন বা স্বয়ংসম্পূর্ণ কারণ থাকবে না।

সুতরাং মহাবিশ্ব সৃষ্টির পিছে আমাদের মূলতঃ একটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কারণের প্রয়োজন ছিল এবং এটুকুই যথেষ্ট কেননা কারণটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।

২. যৌক্তিক প্রমাণ

যুক্তির দাবি হল, মহাবিশ্ব সৃষ্টি যদি অনেক প্রভূ থাকত, তবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে মহাবিশ্ব ধ্বংস হয়েছে। এবং আমরা মহাবিশ্বে যে সুষম শৃঙ্খলা ও নিয়মতান্ত্রিকতার সর্বোচ্চ সমাবেশ লক্ষ্য করে থাকি, অনেক প্রভূ থাকলে তা পরিলক্ষিত হত না।

আপনি যুক্তি দেখাতে পারেন, আপনার গাড়িটি তৈরি করে অনেক মানুষ। যেমন, কেউ গাড়ীর বডি তৈরি করে, কেউ ইঞ্জিন আবার কেউ চাকা। কিন্তু পূর্ণ গাড়িটি তৈরি হলে সেটি একটি সুন্দর ও সুষম গাড়ি হয়ে থাকে। অতএব, একটি সৃষ্ট বস্তুর অনেক স্রষ্টা থাকলেও সেটি ভারসাম্যপূর্ণ হতে পারে। 

আপনার এ প্রশ্নের উত্তর হল, মহাবিশ্ব সৃষ্টির পিছে আমরা যে কারণটি উল্লেখ করেছি সেটি হল, এমন একজন প্রভূ যিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং ইচ্ছার ক্ষেত্রে এককভাবে স্বাধীন। কেননা প্রভূ তো তিনিই হবেন, যার অসীম প্রয়োগিক ইচ্ছা রয়েছে। যদি অনেক প্রভূ থাকত, তবে প্রত্যেকের ইচ্ছা প্রয়োগের প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হত, আর এটিই মহাবিশ্বে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণ হতো।

আপনি যুক্তি দেখাতে পারেন, এ সম্ভাবনা রয়েছে যে, অনেকগুলো প্রভূ একটি বিষয়ে একমত পোষণ করতে পারে। অথবা এক একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে তাদের পৃথক পৃথক ক্ষমতা থাকবে। এক্ষেত্রে আমরা বলব, এ ধরণের প্রভূর ইচ্ছা অসীম ও স্বাধীন নয়। ফলে এরা প্রভূ হওয়ার যোগ্য নয়। সার কথা হল, যদি দু’জন স্রষ্টা থাকে, এবং তারা কোন বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে, যেমন একজন ক নামক ব্যক্তিকে স্থির রাখতে চাচ্ছে, আরেকজন তাকে গতিশীল করতে চাচ্ছে। অথবা একজন প্রভূ খ কে জীবন্ত প্রাণি বানাতে চাচ্ছে, আরেকজন চাচ্ছে যে, এটি জড়পদার্থ হিসেবে অবস্থান করবে।

যুক্তির আলোকে যদি বিশ্লেষণ করা হয়, তবে এখানে তিনটি অবস্থার কোন একটি ঘটতে বাধ্য-

১. উভয় প্রভূর ইচ্ছা বহাল রাখা হবে এবং তা বাস্তবায়ন করা হবে।

২. শুধু তাদের একজনের ইচ্ছা বহাল রাখা হবে।

৩. তাদের কারও ইচ্ছায় বাস্তবায়ন করা হবে না।প্রথমটি সম্ভব নয়।

কেননা এক্ষেত্রে দু’টি বিপরীত বিষয় একই সাথে অস্তিত্ব লাভ করা আবশ্যক হবে। যা অসম্ভব। অর্থাৎ একই সাথে একটি বস্তু জীবিত ও মৃত হতে পারে না। তৃতীয় বক্তব্যও বাতিল হয়ে যাবে। কেননা এর দ্বারা এটা আবশ্যক হয় যে, একটি বস্তু গতিশীলও না, আবার স্থিরও না। একইভাবে একটি বস্তু জীবিতও না, আবার মৃত না। আর এটি অসম্ভব। সাথে সাথে তাদের কারও ইচ্ছায় যদি বাস্তবায়ন করা না হয়, তখন তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, তাদের কেউ-ই নিজ ইচ্ছা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম নয়। ফলে প্রত্যেকেই প্রভূ হওয়ার যোগ্যতা হারাবে।

দ্বিতীয় বক্তব্য অনুযায়ী, যদি দু’জনের মধ্য থেকে একজনের ইচ্ছা বাস্তবায়ন করা হয়, এবং অপরজনের ইচ্ছা পরিত্যাগ করা হয়, তবে তিনিই হবেন একক প্রভূ। যার ইচ্ছা পরিত্যাগ করা হয়েছে, সে প্রভূ হওয়ার যোগ্য থাকবে না। উপর্যুক্ত বক্তব্য দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, এই ভারসাম্যপূর্ণ মহাবিশ্বের একজন মাত্র প্রভূ থাকা সম্ভব, যিনি অসীম ইচ্ছার অধিকারী এবং একক ক্ষমতার অধিকারী।

৩. ধারণাগত বৈচিত্র

আমরা কিভাবে দু’টি জিনিসকে পরস্পর থেকে পৃথক করে থাকি? দু’জন ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে আমরা তাদের মধ্যে পার্থক্য করি কীভাবে। এর উত্তর হল, আমরা এটা করে থাকি, কনসেপ্চুয়াল ডিফারেনসিয়েশন বা ধারণাগত বৈচিত্রের মাধ্যমে। এই ধারণাগুলো হল, স্থান, পারম্পরিক দূরত্ব, গঠন ও আকার-আকৃতিগত তারতম্য।

আমরা যে কোন দু’টি বস্তুর মাঝে পার্থক্য করতে পারি, তাদের পারস্পরিক দূরত্ব, বর্ণ ও আকার-আকৃতিগত বৈচিত্রের মাধ্যমে। দু’টি বিষয়ের মধ্যে যখন উপরোক্ত বিষয়গুলো না পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে কি আপনি উক্ত বস্তু দু’টির মাঝে কোন পার্থক্য করতে সক্ষম হবেন? আপনি পারবেন না। এবিষয়টি শুধু দু’য়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং অসংখ্য বস্তুর ক্ষেত্রে পার্থক্য নির্ণয় করতে হলে, উপরোক্ত বিষয়গুলো থাকা আবশ্যক। 

প্রাসঙ্গিকভাবে বলে নেয়া আবশ্যক যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি মহাবিশ্ব থেকে বহির্গত হওয়া আবশ্যক। কেননা সৃষ্টির কারণ যদি মহাবিশ্বের ভিতরগত কিংবা মহাবিশ্বেরই কোন অংশ হয়, তখন এর অর্থ হয় যে, মহাবিশ্ব নিজেই নিজের স্রষ্টা। আর এটি অসম্ভব। মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ যেহেতু বহির্গত, আপনি সহজেই অনুমান করতে পারবেন যে, আপনি মহাবিশ্বের বহির্গত বিষয়ের মধ্যে অবস্থান, আকার-আকৃতি ও বর্ণগত পার্থক্য করতে পারবেন না। কেননা এ বিষয়গুলো কেবল মহাবিশ্বের অভ্যন্তরে বিশেষ অর্থ প্রদান করে, এর বাইরে নয়। কেননা উপর্যুক্ত বিষয় তথা দূরত্ব, আকার-আকৃতি বা বর্ণ প্রত্যেকটি সৃষ্ট। মহাবিশ্বের বাইরে সৃষ্ট কোন বস্তু নেই। মহাবিশ্বের বাইরে উপর্যুক্ত বিষয়ের অনুপস্থিতির কারণে সৃষ্টির পিছে ক্রিয়াশীল দু’টি কারণের মধ্যে পার্থক্য করাও সম্ভব নয়। এজন্য সৃষ্টির পিছে দু’টি বা অসংখ্য কারণের কথা বলাটাও ভিত্তিহীন, অযৌক্তি ও ধারণাপ্রসূত একটি বক্তব্য মাত্র। 

৪. অনন্যতা

মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি ইউনিক বা অনন্য হওয়া আবশ্যক। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “তাঁর কোন সমকক্ষ নেই”। মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি যদি অনন্য না হয়, তবে এর অর্থ হবে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ ও মহাবিশ্বের মাঝে একটি সিমিলারিটি বা সাদৃশ্য রয়েছে। কেননা এর দ্বারা এটি প্রমাণিত হয় যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি এর মাঝে রয়েছে। যার অর্থ এই দাঁড়াল যে, মহাবিশ্ব নিজেই নিজের স্রষ্টা। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি মহাবিশ্বের সাদৃশ্যপূর্ণ হতে পারবে না কেন? এর উত্তরটি খুবই সহজ। আমরা জানি মহাবিশ্ব অসংখ্য বস্তুর সমষ্টি। সুতরাং মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি অবশ্যই ইম্যাটেরিয়াল বা বস্তুজগতের ঊর্ধ্বে হতে হবে। নতুবা মহাবিশ্ব নিজেই নিজের স্রষ্টা হওয়া আবশ্যক হবে। সুতরাং বস্তু সৃষ্টির কারণটিও যদি বস্তুর মতো হয়, তবে বস্তু নিজেই নিজের স্রষ্টা হওয়া আবশ্যক, যা অসম্ভব। সুতরাং উপসংহারে আপনাকে অবশ্যই বলতে হবে যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি অবশ্যই ইম্যাটেরিয়াল ও ইউনিক হতে হবে। আমাদের এ বক্তব্যটি স্রষ্টার এককত্বের প্রমাণ হয় কিভাবে? আমরা বলব, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ যদি একাধিক হয়, তবে তার কোনটিই ইউনিক বা অনন্য হবে না। ফলে স্রষ্টা একজন হওয়াটাই নির্দিষ্ট।

৫. ঐশীবাণী

স্রষ্টার এককত্ব প্রমাণের সবচেয়ে সহজ উপায় হল, আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ঐশীবাণীর শরণাপন্ন হওয়া। এক্ষেত্রে যুক্তি হল, কোন বাণীর ব্যাপারে যদি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয় যে, এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত এবং এটি মানব রচিত নয়, তখন এ গ্রন্থের বক্তব্যের ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকে না। সুতরাং আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ঐশী গ্রন্থে আল্লাহ তায়ালা নিজের সম্পর্কে যে তথ্য প্রদান করবেন সেটি নিশ্চিতভাবে সত্য বলে বিবেচিত হবে। 

কেউ যদি আল্লাহ সম্পর্কে অজ্ঞ হয় তবে সে কিভাবে আল্লাহ সম্পর্কে বা তার প্রেরিত কিতাব সম্পর্কে ধারণা অর্জন করবে?

এর দু’টি পদ্ধতি রয়েছে-

১. ইন্টারন্যাল

২. এক্সটারন্যাল

আভ্যন্তরীণভাবে আল্লাহ তায়ালার পরিচয় পাওয়ার অর্থ হল, আপনি আত্মপরীক্ষা বা আত্মদর্শনের মাধ্যমে আল্লাহ সম্পর্কে অবগত হওয়ার চেষ্টা করবেন। অর্থাৎ নিজের আভ্যন্তরীণ শক্তি ব্যবহার করে আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা। আজব ব্যাপার হল, আল্লাহ সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন মানুষের নিজস্ব শক্তির দ্বারা সম্ভব নয়।

এর কিছু মৌলিক কারণ হল,

১. মানুষ সৃষ্টিগতভাবে বৈচিত্রময়। ব্যক্তি বৈচিত্রের এধারাটি মূলতঃ মানুষের মানসিক ভিন্নতারই বহিপ্রকাশ। সাইকোলজিক্যাল ভিন্নতার প্রধান কারণ হল, ডি.এন.এ এর ভিন্নতা, বাস্তব অভিজ্ঞতা, সামাজিক পূর্বসূত্র, বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানার্জনের ক্ষমতা, লিঙ্গের বৈষম্য ইত্যাদি নিয়ামক দ্বারা প্রভাবিত। আত্মদর্শনের মাধ্যমে স্রষ্টা সম্পর্কে ধারণা পেতে এবিষয়গুলো আপনাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে। সুতরাং আপনার আত্মপরীক্ষার মাধ্যমে যে ফলাফল পাওয়া যাবে সেটি অন্যদের থেকে ভিন্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। আপনি নিজেও এই বাস্তবতা উপলব্ধি করবেন যে, উপর্যুক্ত বিষয়ের উপস্থিতিতে আপনি একাকী যদি স্রষ্টা সম্পর্কে ধারণা পেতে চান তবে তা সত্য থেকে অনেক বিচ্যুত হতে পারে। এটি একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ বছর আগে পৃথিবীতে প্রায় ৩৭০০ হাজার দেবতার ধারণা মানুষের মনে জেঁকে বসেছিল।

২. দ্বিতীয় কারণ হল, বাস্তবতার বিবেচনায় মানুষ খুবই সীমাবদ্ধ। এজন্য মানুষ যদি নিজের পক্ষ থেকে স্রষ্টা সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করতে চায়, তবে তা অধিকাংশ সময় ভ্রান্তির কারণ হয়। দার্শনিকগণ ¯্রষ্টার অস্তিত্বের ব্যাপারে কিছু যুক্তিসঙ্গত দার্শনিক তত্ত্ব উপস্থাপন করে থাকেন। তবে তারা স্বতঃসিদ্ধ ও বাস্তব কোন তথ্য দিতে অক্ষম। প্রকৃতপক্ষে যদি আপনি স্রষ্টা সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা অর্জন করতে চান, তবে তা হবে ইঁদুরের পক্ষে হাতির শক্তিমত্তা সম্পর্কে ধারণা অর্জনের মতো হাস্যকর। এজন্য শুধু যুক্তি বা ধারণার উপর ভিত্তি করে স্রষ্টা সম্পর্কে কিছু বলা তার সম্পর্কে মিথ্যাচারের নামান্তর। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, “তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে যা জান না, তা বলো কেন?” সুতরাং আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে আমরা যদি জ্ঞান অর্জন করতে চাই তবে তা অবশ্যই এক্সটারন্যাল বা বহির্গত কোন মাধ্যমে হতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা ঐশীবাণীর মাধ্যমে আমাদেরকে যা জানিয়েছেন, সেটিই হবে বিশুদ্ধ জ্ঞান।

আর পবিত্র কুরআন থেকে আমরা একথা সুনিশ্চিতভাবে জানি যে, আল্লাহ তায়ালা হলেন এক ও অদ্বিতীয়। তার সমকক্ষ কেউ নেই। সুতরাং তার এককত্বের ব্যাপারে আর কোন সন্দেহ থাকে না।

------ ------