আক্বিদা

আহলে সুন্নতের ইমামগণের প্রতি নজদী-তাইমীদের অপবাদ ও জুলুম (১ম পর্ব)

ইজহারুল ইসলাম বৃহঃ, 21 নভে., 2024

অনেকের ধারণা, ইবনে তাইমিয়া ও তাইমীদের সাথে আমাদের শাখাগত মাসআলা - মাসাইলের বিরোধ। চার ইমামসহ অন্যান্য ইমামদের মাঝে যেমন বহু মাসআলা-মাসাইলের মতবিরোধ আছে, এধরণেরই কিছু বিরোধ ইবনে তাইমিয়ার সাথে অন্যদের। 

বাস্তবতা হলো, উপরের ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। ইবনে তাইমিয়ার সাথে আহলে সুন্নতের মূল বিরোধ একেবারে আকিদার বুনিয়াদি বিষয়ে। মৌলিক আকিদার এই বিরোধের উপর মানুষের ঈমান ও কুফুর নির্ভরশীল। ইসলামের মূল মর্ম তাওহীদ, আল্লাহর একত্ববাদ, সৃষ্টির সাদৃশ্য থেকে মুক্ত হওয়া, পরকালের চিরস্থায়ী জান্নাত বা জাহান্নামের আকিদা থেকে শুরু করে দ্বীনের একেবারে মৌলিক অসংখ্য বিষয়ে তাইমীদের সাথে আহলে সুন্নতের বিরোধ। এসব বিরোধের যে কোন একটি বিষয়ই কারও কুফুরী বা ভ্রষ্টতার জন্য যথেষ্ট। ইবনে তাইমিয়ার মাঝে এজাতীয় অনেকগুলো বিষয়ের সমাবেশ ঘটেছে। যদিও আহলে সুন্নতের অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম তাকে কাফের বলেন না, তবে তার ভ্রষ্টতার বিষয়ে অসংখ্য ইমামের বক্তব্য রয়েছে। 

 

এই বিরোধ যে একেবারে মৌলিক বিষয়ে, সেটি অন্যান্য তাইমীরাও স্বীকার করেছে। পববর্তীতে আমরা তাদের বক্তব্য উল্লেখ করব ইনশা আল্লাহ। তাইমীদের সাথে যেহেতু আমাদের একেবারে মৌলিক আকিদার বিরোধ, এজন্য আমাদের প্রতি তাদের আচরণ কখনও শাখাগত বিরোধের মতো ছিলো না। একেবারে শুরু থেকে তারা আহলে সুন্নতের প্রতি গালাগালি, মিথ্যা অপবাদ ও  শিরক-বিদয়াত সন্ত্রাস  করে আসছে। বিষয়গুলো যে তার পরবর্তী অনুসরারীরা করেছে, এমন নয়। খোদ ইবনে তাইমিয়াও এজাতীয় কাজে লিপ্ত ছিলেন। পরবর্তী তার অনুসারী তাইমীদের অবস্থা তো আরও ভয়াবহ। তারা ইবনে তাইমিয়ার এই নতুন ভ্রষ্টতাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সারা মুসলিম উম্মাহকে কাফের-মুশরিক ও মুরতাদ আখ্যা দিয়ে তাদের রক্ত  ও সম্পদ হালাল করেছে। হাজার হাজার উলামায়ে কেরামকে হত্যা করেছে। লক্ষ্য লক্ষ্য সাধারণ মুসলমানদেরকে হত্যা করেছে। তাদের ঘরবাড়ি ও সম্পদ লুট করেছে। এগুলোর সবই তাদের নিজস্ব রচনা থেকে প্রমাণিত ঐতিহাসিক সত্য বিষয়। এমনকি এখনও পর্যন্ত তারা ইবনে তাইমিয়ার এই ভ্রষ্টতা অনুসরণ করে  উম্মাহের রক্ত ঝরিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে আইএস বা দায়েশ খারেজীরা ইরাক, সিরিয়া ও আফগানে অসংখ্য সাধারণ মুসলমানকে মুরতাদ আখ্যা দিয়ে তাদেরকে হত্যা করেছে। উলামায়ে কেরামকে তাদের দরসে, মসজিদে ও খানকায় বোমা মেরে হত্যা করছে। শত শত মুসল্লিতে ভরা মসজিদে নামাজরত অবস্থায় বোমা মেরে তাদের রক্ত নিয়ে হোলি খেলা হচ্ছে। এসব কিছুর মূলে রয়েছে ইবনে তাইমিয়া ও ইবনে আব্দিল ওয়াহহাবের আকিদাগত দর্শন ও তাদের চিন্তাগত ভ্রষ্টতা। 

 

মুসলমানদেরকে অন্যাভাবে কাফের ও মুরতাদ আখ্যা দেয়ার এই প্রবণতা যে নতুনভাবে শুরু হয়েছে এমন নয়। খোদ ইমাম আবু হানিফা রহ: কে নানা মিথ্যা অপবাদ দিয়ে কাফের ও মুরতাদ বলার চেষ্টা করা হয়েছে। পরবর্তীতে ইবনে তাইমিয়া এগুলোকে একটি সুসংগঠিত দর্শনের রুপ দিয়েছেন। যেখানে একজন সাধারণ মানুষ খুব সহজেই তাদের এই চিন্তা-চেতনা গ্রহণ করে রক্ত-পিপাসু তাকফিরী হয়ে ওঠে। 

 

এ বিষয়ে তাইমী - নজদী শায়খ আব্দুল্লাহ গুনাইমানের একটি বক্তব্য বিশেষভাবে উল্লেখ করাত মত। তিনি লিখেছেন,

 

وقد انتسب إلى الأشعري أكثر العالم الإسلامي اليوم من أتباع المذاهب الأربعة، وهم يعتمدون على تأويل نصوص الصفات تأويلاً يصل أحياناً إلى التحريف، وأحياناً يكون تأويلاً بعيداً جداً، وقد أمتلأت الدنيا بكتب هذا المذهب، وادعى أصحابها أنهم أهل السنة

 

অর্থাৎ “বর্তমান মুসলিম বিশ্বের চার মাজহাবের অধিকাংশ ইমাম আশয়ারীর আকিদা-বিশ্বাস অনুসরণ করে থাকে। আর এক্ষেত্রে তারা সিফাতের বিষয়গুলোকে তা’বীল করে। এই তা’বীল কখনও বিকৃতির পর্যায়ে চলে যায়। কখনও অনেক দূরবর্তী তা’বীল হয়। এই মাজহাবের কিতাবাদি দিয়ে পুরো দুনিয়া ভরে গেছে। আর এর অনুসারীরা নিজেদেরকে আহলে সুন্নত দাবী করে থাকে।”

 

এরপর নজদী শায়খ গুনাইমান যে কথাটি বলেছেন, সেটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন,

هذا ولابد لعلماء الإسلام -ورثة رسول الله – صلى الله عليه وسلم من مقاومة هذه التيارات الجارفة، على حسب ما تقتضيه الحال، من مناظرات، أو بالتأليف، وبيان الحق بالبراهين العقلية والنقلية، وقد يصل الأمر أحياناً إلى شهر السلاح

অর্থাৎ “সুতরাং বর্তমানে ইসলামের আলিম যারা আল্লাহর রাসূলের উত্তরসূরী তাদের জন্য আবশ্যক হল, তারা যেন ইসলাম বিধ্বংসী এই স্রোতের প্রতিরোধে সময়োপযোগী বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করে। যেমন, মুনাজারা (বিতর্ক), কিতাব সংকল, আকলী ও নকলী দলিলের আলোকে সত্য তুলে ধরা। কখনও কখনও প্রয়োজনে অস্ত্র ব্যবহার করা। 

[ শরহু কিতাবিত তাওহীদ মিন সহীহীল বোখারী , আব্দুল্লাহ গুনাইমান, খ: ১, পৃ: ২৬ ]



 

 

এই তাইমী-নজদী আব্দুল্লাহ গুনাইমানের বক্তব্য খুবই স্পষ্ট। অধিকাংশ মুসলিম উম্মাহকে আশয়ারী-মাতুরিদি আকিদার জন্য তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র-ধারণের অনুমতি দিচ্ছেন তিনি। ইন্নালিল্লাহ। 

 

দু:খজনক বিষয় হলো, এই মানসিকতা শুধু তাদের লেখনীতেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং তারা বাস্তবেও এর প্রয়োগ করে থাকে। কোথাও সামান্য ক্ষমতা পেলেই তারা আশয়ারী-মাতুরিদি আকিদার লোকদেরকে শিরক-বিদয়াতসহ নানা অপবাদ দিয়ে তাদেরকে মুরতাদ আখ্যা দিয়ে হত্যা করে থাকে। 

 

বিষয়টি বোঝার জন্য ছোট্র একটি উদাহরণ দিয়ে আমরা মূল আলোচনায় ফিরে যাব। নব্বইয়ের দশকে আল-জেরিয়াতে সালাফীপন্থী কিছু দল জি-হা-দ শুরু করে। এদের সাথে বি-ন লা-দেন ও আ-ইমান জা-ওয়াহেরী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছিল। এদের নাম ছিলো, Armed Islamic Group of Algeria বা সংক্ষেপে GIA. এই গ্রুপকে যে বি-ন-লাদেন ও আ-ই-মান জাওয়ারেহী সহযোগিতা করেছিল তার অনেক প্রমাণ রয়েছে। যেমন, শায়খ আবু মুসআব আস-সূরী যাকে আ-ল-কা-য়দার গ্লোবাল জি-হা-দ এর আর্কিটেক্ট বলা হয়ে থাকে, তিনি আল-জেরিয়ার ঘটনা বিশ্লেষণ করে একটি কিতাব লিখেছেন। এর নাম দিয়েছেন, ‘মুখতাসারু শাহাদাতি আলাল জি-হা-দি ফিল জাযাইর’।

 

কিতাবটিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ওঠেছে। এগুলো নিয়ে পরবর্তীতে আলোচনা করব ইনশা আল্লাহ। এ কিতাবে GIA এর সাথে বি-ন লা-দেন ও জা-ও-য়াহেরীর সহযোগিতা সম্পর্কে আবু মুসআব সূরী লিখেছেন,

 


 

এক পর্যায়ে আবু আব্দির রহমান আমীন নামের এক মুরগী বিক্রেতা এই GIA এর প্রধান হয়। যেহেতু এই গ্রুপটি শুরু থেকে তথাকথিত সালাফী দাওয়াত ও মানহাজের উপর ছিলো, তারা প্রতিপক্ষকে বিদয়াতের অভিযোগে হত্যা করতে শুরু করে। তাদের এই বিদয়াতের লিস্টে সবার উপরে ছিলো আশয়ারী-মাতুরিদি আকিদা, তাসাউফ ও চার মাজহাবের অনুসরণ। এমনকি তাদের সহযোগী মুজাহিদদেরকে এসব অভিযোগে হত্যা শুরু করে। আবু মুসআব আস-সূরীর খুব কাছের ব্যক্তি ছিলেন শাইখ মুহাম্মাদ সাইদ। যিনি আফ-গ-ান জি-হাদেও অংশ নিয়েছিলেন। শেখ মুহাম্মাদ সাইদকেও এক সময় তারা আশয়ারী, বিদয়াতীসহ আরও কিছু অভিযোগ করে হত্যা করে। মজার ব্যাপার হলো, মুহাম্মাদ সাইদ ও তার সহযোগিদের হত্যাকে জাস্টিফাই করার জন্য আবু কাতাদা ফিলিস্তিনী তাদের ‘নাশরাতুল আনসার’ ম্যাগাজিনে বেশ কয়েকটি আর্টিকেল প্রচার করে। এবং এধরণের বিদয়াতীদেরকে হত্যা করাটা প্রশংসনীয় কাজ হিসেবে তুলে ধরে। আর এর পক্ষে সাফাই দেয়ার জন্য খালিদ বিন আব্দুল্লাহ আল-কাসারী জায়াদ বিন দিরহামকে হত্যা করেছিল, সেই উদাহরণ টেনে বর্তমান যুগের বিদয়াতীদের হত্যার ব্যাপারেও উদ্বুদ্ধ করে। আবু মুসআব সূরী আবু কাতাদাহ ফিলিস্তীনী এই  ঘৃণ্য কাজটি তার বইয়ের ৪০ পৃষ্ঠা থেকে পরবর্তী বেশ কয়েক পৃষ্ঠায় তুলে ধরেছেন। 

 

আবু মুসআব সূরী তার বইয়ের ৫৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন,

“লি-বিয়ার সশস্ত্র ইসলামী জি-হা-দী গ্রুপের কিছু মু-জা-হিদ যারা GIA এর সাথে কাজ করত, তারা আল-জেরিয়া থেকে GIA এর ফাঁদ থেকে পলাতে সক্ষম হয়। তারা প্রায় মো’জিযার মতো করে আশ্চর্যজনকভাবে সেখান থেকে পালিয়ে বেঁচে তাদের জামায়াতের কাছে ফিরে আসে। এদেরই একজন পরবর্তীতে লন্ডনে এলে তার কাছ থেকে GIA এর ভয়ঙ্কর বাস্তবতা সামনে আসে। একই সময়ে GIA এরও কিছু সদস্য তাদের এই ন্যাক্কারজনক শাসন থেকে পালিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেয়। তাদের কাছ থেকেও মূল বিষয়টি আরও শক্তিশালীভাবে জানার সুযোগ হয়। আমরা যেই উপসংহারে পৌঁছেছিলাম, সেটি যে বাস্তব ছিলো তাও নিশ্চিৎ হয়ে যাই। মূল বিষয় ছিলো, GIA ও আবু আব্দির রহমান আমীনের গ্রুপটি শাইখ মুহাম্মাদ সাইদ ও তার দলবলকে ধোঁকা দিয়ে হত্যা করে। না তাদের কোন শরয়ী বিচার করেছে বা তাদের এই হত্যাকান্ড নিয়ে তারা চিন্তিত ছিলো। শাইখ ও তার দলবল যখন GIA এর নানা বিচ্যূতি নিয়ে আলাপ করতে আসে তখন তারা শাইখ ও তার সাথীদেরকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করে। একইভাবে তারা আফগান আরব মু-জ-াহিদদেরকেও হত্যা করে। এদের হত্যার পেছনে মূল অভিযোগ ছিলো, তারা বিদয়াতী ছিলো এবং বিশুদ্ধ সালাফী আকিদা লালন করত না। এবং তারা তাদের কিছু কাজের প্রতিবাদ করেছিল। একইভাবে তারা লিবিয়ান মু-জা-হিদীনদেরকেও ধোঁকা দিয়ে  হত্যা করে। এদেরকে হত্যার পেছনে মূল কারণ ছিল, বিদয়াতী হওয়া ও তাদের আমীরের হাতে বাইয়্যাত না হয়ে নিজেদের দলের আমীরের অধীনে থাকা। 

একইভাবে তারা সাধারণ আল-জেরিয়ান গ্রামবাসীদের উপর নৃশংস গণহত্যা চালায়। সরকারের সহযোগিতা ও অস্ত্রধারণ ছিলো এসব সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে গণহত্যার মূল অভিযোগ। এমনকি তারা মহিলাদের ইজ্জ লুন্ঠন করে,  জিনা করে ও সম্পদ লুন্ঠন করে।  এটাকে বৈধ করার জন্য তারা বলে, তাগুতের মহিলাদের বন্দী করা জায়েজ। এজাতীয় ভয়ঙ্কর বর্ণনাগুলো তাদের বক্তব্যে ওঠে আসে।”


 

 

[মুখতাসারু শাহাদাতি আলাল - জি-হাদী ফিল জা-যাইর, পৃ: ৫৩-৫৪ ]

 

আল-জেরিয়ান এই সালাফী - জি-হাদী গ্রুপ যেই বর্বরতা ও নৃশংসতা চালিয়েছিল, এটি বর্তমানের আইএস থেকে কোন অংশে কম ছিলো না। যদিও এদের এই গ্রুপে সরকারী গুপ্তচর ঢুকে যাওয়ার কথাও আবু মুসআব সূরী লিখেছেন, কিন্তু এরপরও মৌলিকভাবে এই জাময়াতের চিন্তা-চেতনাতেই মারাত্মক পর্যায়ের সমস্যা ছিলো। আল-জেরিয়ার ময়দানে GIA এসব বর্বরতা ও নৃশংসতা চালাত আর এদিকে লন্ডনে বসে কা-য়-দার সিনিয়র পর্যায়ের শায়খ আবু কা-তা-দা ফিলিস্তীনী এগুলোর ভূয়সী প্রশংসা করে তাদের সাফাই দিতে আর্টিকেল লিখতেন। এই বিষয়গুলো আমরা অন্য কোথাও আরও বিস্তারিত আলোচনা করব ইনশা আল্লাহ। 

 

এখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, GIA অন্যান্য মুজা-হিদীনকে বিভিন্ন বিদয়াতের অভিযোগে হত্যা করেছে। কী ছিলো এসব বিদয়াত? আর তাদের এজাতীয় চিন্তা-চেতনার মূলই বা কী ছিলো? এর সহজ উত্তর হলো, তাদের মানদন্ডের সালাফী না হওয়াটাই মূল অপরাধ ছিলো। সালাফী না হলেই তাকে বিদয়াতী অভিযোগে তারা হত্যা করেছে। তাদের এই বিদয়াতের বিষয়টিও আবু মুসআব সূরী কিছুটা খোলাসা করার চেষ্টা করেছেন। 

 

আবু মুসআব সূরী তার বইয়ের ৬৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, 

“ GIA এর এই দলটি মূলত: ছিল কিছু কুখ্যাত জাহিলদের দল। এদের নেতৃত্বে ছিলো, সালাফিয়াতের আশ্চর্যজনক বুঝ ধারণকারী কট্ররপন্থী কিছু লোক। তাদের এই আশ্চর্যজনক সালাফী দৃষ্টিভঙ্গির মাঝে ছিলো, তারা চার মাজহাবকে, ইসলামী অন্যান্য দলের চিন্তা-চেতনাকে এমনকি অন্য জিহাদী দলগুলোর চিন্তা-চেতনাকে বিদয়াত মনে করত। আর এসব চিন্তা-চেতনার অনুসারী সকলেই এদের কাছে সঠিক পথ থেকে বিচ্যূত বিদয়াতী। এদের এই বিদয়াতীর লিস্টে বর্তমান ও পূর্ববর্তী অসংখ্য বড় বড় ইমাম ও আলিম ছিলো। 

 

আমি যখন তাদের চিন্তা-চেতনা ও শরয়ী ফয়সালার উৎস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম, তখন বলল, তাদের একটি শরয়ী বোর্ড ছিলো। এই শরয়ী বোর্ডই তাদের বিকৃত চিন্তা-চেতনা অনুযায়ী সব ধরণের ফতোয়া ও দলিল দিত। এক্ষেত্রে হয়ত তারা কুরআন - সুন্নাহের বক্তব্য অনুধাবনে অক্ষম নিজেদের বিকৃত ও সংকীর্ণ বুঝ অনুযায়ী মাসআলা দিত। যাকে এরা নাম দিত কুরআন-হাদীসের ‘দলিল’। অথচ এই অথর্বদের অধিকাংশ সঠিকভাবে আরবীও উচ্চারণ করতে পারত না। অথবা তারা ইমাম ইবনে তাইমিয়ার কিতাব থেকে দলিল দিত। যাকে তারা আল-জেরিও ভাষায় বলত ‘শেখ আহমাদ’। এই দু’টি উৎসই মূলত: তাদের এই শরয়ী বোর্ডের চিন্তা-চেতনার মূল ছিলো। আর এটিই ছিলো তাদের পুরো দ্বীন ও ইসলাম। 

 

এদের এই চিন্তা-চেতনা উৎসারিত বহু অতি আশ্চর্যজনক মাসআলা - মাসাইল আমাকে শুনিয়েছে। জি-হা-দ, রাজনীতির বাইরেও পাক-পবিত্রতা, নামাজ ও ইবাদত সংক্রান্ত বহু আশ্চর্যজনক বিচ্ছিন্ন মতামত তাদের ছিলো। তাদের সেসব আশ্চর্যজনক মাসআলাসমূহের একটি মাসআলা এখনও আমার মনে আছে। তাদের মতে শুধু জি-হা-দ এ গেলেই তায়াম্মুম জায়েজ। যদিও নিরাপদে পানি, ঝর্ণার পাশে থাকুক। 

 

আমি যখন তাদেরকে লন্ডন থেকে আবু কা-তাদা ফিলিস্তিনীর প্রচারণার প্রভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তখন বলল, তারা আল-জেরিয়াতে এদের কথা তেমন শোনেনি। বরং সেখানে তাদের শরয়ী বোর্ডই মূল ছিলো। আর সেখানে GIA এর প্রধানী আবু আব্দির রহমান আমীনের পক্ষ থেকে নিযুক্ত একজন ভয়ঙ্কর শরয়ী কাজী ছিলো। এদের মাধ্যমে আমীন তার অনুসারীদেরকে নিয়ে হাসান সাব্বাহ ও হাশাশীনদের মতো নীতি অনুযায়ী চলত। আর এদের ভাষা ছিল অস্ত্র ও হত্যা।” 

[মুখতাসারু শাহাদাতি আলাল - জি-হাদী ফিল জা-যাইর, পৃ: ৬৩ ]


 



 

এখানে মজার বিষয় হলো, এই যে GIA হাসান সাব্বাহ এর মতো রক্তপিপাসু ড্রাকুলা হয়ে ওঠল, এর পেছনে কারা?   আবু মুসআব আস-সূরী বইয়ের শুরু দিকে লিখেছেন, আবু আব্দির রহমান আমীনকে জাওয়াহেরীরা একটা সময় পর্যন্ত সাপোর্ট দিয়ে গেছে। এমনকি আবু কা-তাদা ফিলিস্তীনী এদের এসব হত্যা ও লুন্ঠনের ভূয়সী প্রশংসা করে নিয়মিত আর্টিকেল লিখে গেছে। আবু কা-তাদার কাছে তো  GIA এর শাসন আব্বাসী, সালাহুদ্দীন আইয়ূবীদের চেয়েও সুশান ছিলো। যা সে প্রায় তার আর্টিকেলে বিভিন্নভাবে প্রকাশ করত। যার বিবরণ সূরী তার বইয়ে সবিস্তারে এনেছেন। বি-ন লা-দেন, ও জা-ও-য়াহেরীরা এজাতীয় প্রত্যেকটি গ্রুপের প্রায় শুরু থেকে এদের চরম রক্ত-পিপাসু হয়ে ওঠা পর্যন্ত সাহায্য-সহযোগিতা করে থাকে। এবং যতক্ষণ পর্যন্ত এরা সাধারণ জনগণ ও প্রতিপক্ষ মুসলমানদেরকে হত্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, ততক্ষণ এরা এদের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে এবং সাহায্যও করতে থাকে। কিন্তু যখনই এই জতায়ী সংগঠনগুলো শক্তিশালী হয়ে খোদ মু-জা-হিদদেরকেই হত্যা শুরু করে এবং এগুলো জনসম্মুখে প্রচারিত হয়, তখন তারা নিজেদেরকে সরিয়ে নিয়ে ঘোষণা দেয়, আমরা এদের এসব কর্মকান্ড থেকে মুক্ত। অথচ মুজা-হিদদেরকে হত্যার আগ পর্যন্ত তারা যেসব অপরাধ করে আসছিল, সেগুলোর মূলনীতি ও ধরণ একই ছিলো। এবং তারা এর নীরব সমর্থকও ছিলো। একই কাজ তারা GIA, আইএস, আশ-শাবাব সহ প্রত্যেকটি সংগঠনের সাথে করে আসছে। জনসাধারণ বা অন্যান্য মুসলমানের আক্রান্ত হওয়ার সময় নীরব দর্শকের ভূমিকায় থেকে নিজেরা আক্রান্ত হলে বা নিজেদের মতের সাথে না মিললে সম্পর্ক ছিন্ন করাটা হলো এই গ্রুপগুলোর বহু পুরনো স্ট্রেটেজি। 

 

এবার আসি, আ-ল-কায়-দা এবং এদের মাধ্যমে গড়ে ওঠা সংগঠন যেমন GIA, আইএস বা আশ-শাবাবদের ‘হাসান সাব্বাহ’ হয়ে ওঠার পেছনের মূল কারণ কী? এদের চিন্তা-চেতনায় এই উগ্রতার মূল উপাদান কোথা থেকে এলো? এরা কি সরাসরি কুরআন - হাদীস থেকে এগুলো পেয়েছে নাকি কারও নির্দিষ্ট ফিলোসফি বা দর্শনের কারণে এরা বিভিন্ন সময় ‘হাসান সাব্বাহ’ হয়ে ওঠছে? 

 

এই প্রশ্নটি এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর উত্তরে আমাদের সামনে দু’টি নাম বার বার ওঠে আসে। আর মজার বিষয় হলো, উপরের সবগুলো সংগঠন এবং এদের বাইরেও এই মতবাদের যতো অনুসারী আছে, তারা সকলেই এই দু’টি নামকে তাদের চিন্তা-চেতনা ও তাদের দ্বীন ইসলামের মূল মনে করে থাকে। তারা হলেন,

 

১। তাদের ভাষায় ‘শেখ আহমাদ’ বা ইবনে তাইমিয়া। 

২। ইবনে আব্দিল ওয়াহহাব নজদী। 

 

এখানে একটি যুক্তি অনেকে পেশ করে থাকেন, অনুসারীদের ভুলের কারণে কি অনুসরণীয় ব্যক্তিকে দোষ দেয়া যায়? যদি এমনই হতো তাহলে তো মুসলমানদের দোষ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর, শিয়াদের দোষ আলী রাজি: এর উপর এবং মাজহাবের অনুসারীদের দোষ তাদের ইমামদের উপর দেয়া হতো। এসব ক্ষেত্রে যেহেতু দোষ দেয়া হচ্ছে না, সুতরাং অনুসারীদের ভুলের দোষ অনুসরণীয় ব্যক্তিদের উপর চাপান ঠিক হবে না। এটি হবে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপান। যা খুবই অন্যায়। 

 

এখানে আরেকটি যুক্তি দেয়া হয় এমন, এসব কাজের জন্য  ইবনে আব্দিল ওয়াহহাব নজদীর চিন্তা - চেতনা দায়ী হলেও ‘শেখ আহমাদ’ বা ইবনে তাইমিয়ার এখানে কোন দায় নেই। উনার অনুসরণের নামে উনাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করছে। সমস্ত সমস্যা নজদীর। তাইমীদের কোন সমস্যা নেই। এধরণের মতাদর্শ প্রচার করে থাকেন ইয়াসির কাদি গং। যারা নজদীবাদ ছাড়লেও তাইমীবাদ পুরোপুরি ছাড়তে পারছেন না। এবং তারা নানা ছল-চাতুরী করে নজদীবাদ ও তাইমীবাদকে আলাদা করে দেখানোর চেষ্টা করে থাকেন। 

 

মৌলিকভাবে আমাদের এই পর্যালোচনার উদ্দেশ্যই হলো, এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যে, ‘শেখ আহমাদ’ (ইবনে তাইমিয়া) কি আসলেই এই বিকৃত সালাফীবাদের মূল নাকি এখানে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপান হচ্ছে? আজকে সারাবিশ্বে নজদী-সালাফীরা যেই ফেতনা করছে, পুরো উম্মতের উপর শিরক-বিদয়াতের সন্ত্রাস চালাচ্ছে, অন্যায়ভাবে তাকফীর - তাবদী করছে, মুসলমানদের রক্ত ও সম্পদ নিয়ে হোলি খেলছে, এগুলোর পেছনে তাইমীবাদের ভূমিকা কতটুকু? মূল ইমাম ঠিক ছিলেন কিন্তু অনুসারীরা বিপথে চলে গেছে নাকি মূল ইমামই সমস্ত ফেতনার মূল? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা। 

 

উসূলীভাবে এই প্রশ্নের উত্তর বের করা বেশ সহজ। অনুসরণীয় ব্যক্তি বা ইমাম যদি অনুসারীদের চিন্তা-চেতনা থেকে মুক্ত হোন, তাহলে দোষ শুধু অনুসারীদেরই হবে। অনুসরণীয় ব্যক্তি বা ইমামের দোষ দেয়া হবে না। কিন্তু মূল চিন্তা-চেতনার বিকৃতি যদি খোদ অনুসরণীয় ব্যক্তির মাঝে পাওয়া যায়, তাহলে এখানে মূল দোষী হবেন অনুসরণীয় ব্যক্তি। আর তখন অনুসারীদের ভুলের দায় অনুসরণীয় ব্যক্তির উপরও বর্তাবে। এক্ষেত্রে একথা বলার সুযোগ থাকবে না যে, উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপান হচ্ছে। এবং অনুসারীদের ভুলের দোষ কেন তাদের ইমামের উপর চাপান হচ্ছে? এই অভিযোগই এখানে অবান্তর।

সুতরাং আমরা পুরো বিষয়টা অনুসন্ধানের চেষ্টা করব যে, নজদী-তাইমী ফেতনার মূলে আসলে কারা? তথাকথিত অনুসারীরা নাকি এদের চিন্তা-চেতনার মূলে যারা রয়েছে তারা? অনুসারীরা মূলত: তাদের অনুসরণীয়দের তাকলীদ করে যাচ্ছে। মূল সমস্যা আসলে তাদের নয়? তারা এই চিন্তা-দর্শনের জনকও নয়? মূল সমস্যা আসলে তাদের অনুসরণীয় ব্যক্তিদের। 

 

একথা অনস্বীকার্য যে ইসলামের হাজার বছর ধরে মূল আকিদা - বিশ্বাস ও চিন্তা - চেতনা সংরক্ষণ করে আসছে আহলে সুন্নতের উলামায়ে কেরাম তথা আশয়ারী-মাতুরিদিগণ। নজদী-তাইমীদের আকিদা দর্শন মূলত: প্রাচীন বাতিল ফেরকা কাররামিয়া, হাশাবিয়াসহ বিভিন্ন দেহবাদী ফেরকার নতুন সংস্করণ। এটি কখনও উম্মাহের মূল ধারার আকিদা ছিলো না। যদিও এরা নিজেদেরকে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলের অনুসরণের দাবী করে কিন্তু বাস্তবে এরা হাম্বলী বা আছারী নয়। বরং এরা দেহবাদী - মুজাসসিমা। 

 

এই বিচ্ছিন্ন দেহবাদী চিন্তা-চেতনা যে ইসলামের মূল ধারা থেকে সর্বদা বিচ্ছিন্ন ছিলো, এর সাক্ষী খোদ নজদী-তাইমীরাই তাদের বিভিন্ন লেখনীতে উল্লেখ করেছে। যেমন,  নজদী-তাইমী সালাফী শায়খ মুহাম্মাদ বিন রবী আল-মাদখালী ষষ্ঠ হিজরী শতাব্দী সম্পর্কে লিখেছেন,

 

 كان الأشاعرة يلقبون أنفسهم أهل السنة والجماعة، وكاد يختفي المنهج السلفي منهج أحمد بن حنبل ومن سبقه من أئمة الإسلام، وأصبحت عقيدة السلف غريبة، يعد أتباعها في أنحاء العالم الإسلامي على الأصابع

অর্থাৎ তখন আশয়ারীরা নিজেদেরকে আহলুস সুন্নাহ উপাধি দিত। সালাফী মানহাজ বা ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল ও পূর্ববর্তী ইমামদের মানহাজ প্রায় বিস্মৃত হতে থাকে। সালাফের আকিদা বিরল বা বিলুপ্তপ্রায় হয়ে যায়। পুরো বিশ্বে সালাফী আকিদার অনুসারীদেরকে হাতের আঙ্গুল দিয়ে গোনা যেত। 

 

[আল-হুজ্জা ফি বয়ানিল মাহাজ্জা এর উপর তা’লীক, খ: ১, পৃ: ৪০ ]




















 

ষষ্ঠ হিজরী শতাব্দীতেই যদি তথাকথিত সালাফী আকিদা বিরল হয়ে যায়, তাহলে পরবর্তী সময়ের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। 

 

একই ধরণের কথা লিখেছেন, নজদী শায়খ সফর আল-হাওয়ালী। তিনি লিখেছেন,

 

وليكن معلومًا أنّ هذا الرد الموعود ليس مقصودًا به الصابوني ولا غيره من الأشخاص، فالمسألة أكبر من ذلك وأخطر، إنها مسألة مذهب بدعي له وجوده الواقعي الضخم في الفكر الإسلامي، حيث تمتلئ به كثير من كتب التفسير وشروح الحديث وكتب اللغة والبلاغة والأصول، فضلًا عن كتب العقائد والفكر، كما أن له جامعاته الكبرى ومعاهده المنتشرة في أكثر بلاد الإسلام، من الفلبين إلى السنغال

অর্থাৎ এটা জেনে রাখা দরকার যে, আমরা (আশয়ারী-মাতুরিদিদের) যেই খন্ডন লিখছি এর মূল উদ্দেশ্য মূলত: শায়খ সাবুনী বা অন্যান্য নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি নয়। বিষয়টি আরও বড় ও বেশি ভয়ঙ্কর। বরং বিষয়টি একটি বিদয়াতী(?) চিন্তা-ধারা সম্পর্কিত, ইসলামী চিন্তা-চেতনায় যার বিশাল উপস্থিতি রয়েছে যা বাস্তবও বটে। বহু তাফসীর, হাদীসের ব্যাখ্যাগ্রন্থ, আরবী ভাষা ও ব্যাকরণের কিতাবাদি, আরবী অলংকার, উসূলের কিতাবাদি সহ অসংখ্য কিতাব এই চিন্তাধারা দিয়ে ভরা। আকীদা ও ইসলামী বিশ্বাসের কথা বাদই দিলাম। এমনকি অধিকাংশ মুসলিম দেশে এই চিন্তাধারার  উপর প্রতিষ্ঠিত বড় বড় ইউনিভার্সিটি ও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেই ফিলিপাইন থেকে শুরু করে সেনেগাল পর্যন্ত একই চিত্র।

 

[মানহাজুল আশায়েরা ফিল আকিদাহ, পৃ: ৪ ]

 

 

উম্মাহের হাজার বছরের আকিদা-বিশ্বাসের বাইরে গিয়ে সফর আল-হাওয়ালী সাহেব কোন আকিদা জীবিত করতে চাচ্ছেন? অধিকাংশ তাফসীর, হাদীসের ব্যাখ্যাগ্রন্থ, অধিকাংশ আরবী ভাষা, উসূলের কিতাব, অধিকাংশ আকিদার কিতাবের বিপরীতে একটি বিচ্ছিন্ন চিন্তা-চেতনাকে জীবিত করে ফেতনা করার প্রয়োজন কেন দেখা দিল তাদের?

 

একই ধরণের কথা নজদী-তাইমী শায়খ খালিদ আল-গামেদী তার ‘নকজু আকাইদিল আশায়েরা ওয়াল মাতুরিদিয়্যাহ’ কিতাবের ভূমিকায় লিখেছেন। কিতাব লেখার কারণ লিখতে গিয়ে তিনি বলেন,

“ এই কিতাব রচনার মূল প্রথম কারণ হলো, আশয়ারী-মাতুরিদি আকিদা অধিকাংশ মুসলিম দেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি এমন হানাফী  পাওয়া দুষ্কর যে  মাতুরিদি নয়। এমন শাফেয়ী বা মালেকী পাওয়া দুষ্কর যারা আশয়ারী নয়। আহলুস সুন্নাহ ও সালাফের মাজহাব হাম্বলীদের মাঝে সীমিত হয়ে পড়েছে। বরং উল্টো তারা এই সত্য মাজহাবকে দেহবাদী ও হাশাবিয়া হিসেবে আখ্যা দেয়। কারণ, এটি খুবই বিরল হয়ে পড়েছে এবং এর অনুসারীদের সংখ্যাও কমে গেছে। লা হাওলা ওলা কুয়াতা ইল্লা বিল্লাহ”

 


 

শাইখ আব্দুল্লাহ গুনাইমান, শায়খ মুহাম্মাদ বিন রবী আল-মাদখালী, শায়খ সফর আল-হাওয়ালী, শাখ খালেদ আল-গামেদী প্রত্যেকেই একটি বিষয় স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন যে, পুরো উম্মতে মুসলিমার আকিদা বিশ্বাস এক দিকে। আর তাদের এই তথাকথিত সালাফী মানহাজ আরেক দিকে। এই সালাফী মানহাজ একেবারে শুরু থেকে এতো বিরল হয়ে পড়েছে যে, আঙ্গুলের মাথায় এদের অনুসারীদেরকে গোনা যায়।  আর এটি যে শুধু এক দুই যুগে হয়েছে এমন নয়, পুরো বার-তের শ’ বছর ধরে এটি চলে আসছে। তথাকথিত এই সালাফী চিন্তা-ধারায় তাদের সনদ হলো এমন, শুরুতে ইবনে আব্দিল ওয়াহাব নজদী।  এরপর এক লাফে প্রায় ৪০০ বছর অতিক্রম করে ইবনে তাইমিয়া। আর ইবনে তাইমিয়ার পূর্বে বিভিন্ন দেহবাদী বিচ্ছিন্ন কিছু ফেরকা যেমন কাররামিয়া, সালেমিয়্যাহ, হাশাবিয়্যাহ ইত্যাদি। 

 

একথা তারা কীভাবে চিন্তা করতে পারে যে, পুরো উম্মতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান হাজার বছর ধরে গোমরাহি ও ভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে আর তাদের বিলুপ্তপ্রায় আকিদাটি একমাত্র হক্ব আকিদা। যেই হক্বের অনুসারীরা আবার সর্বদা ইতিহাসের পাতায় থাকে না, মাঝে মাঝে বুদবুদের মতো ভেসে ওঠে। এই বুদবুদগুলোই সঠিক আর পুরো নদী ও সাগর সব মিথ্যা ও বাতিল। এই চিন্তাটি এক দিকে যেমন হাস্যকর ও অবাস্তব, অন্য দিকে কুরআন-সুন্নাহের সুস্পষ্ট বিরোধী। কারণ, এটি হাদীসে খুবই শক্তিশালীভাবে প্রমাণিত যে, আল্লাহর রাসূলের উম্মত ভ্রষ্টতার উপর একমত হবে না। এই একমত হওয়াটা আবার এক দু’শ বছর নয়, বরং হাজার বছর ধরে ভ্রষ্টতার উপর একমত হয়েছে, এটা বলা সুস্পষ্টভাবে হাদীসের বিরোধিতা। আর যদি ধরেও নেয়া হয়, পুরো উম্মত আশয়ারী-মাতুরিদি হয়ে  ভ্রষ্টতা ও বিদয়াতে নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিল, তাহলে বুদ বুদের মতো মাঝে মাঝে জেগে ওঠা এই তথাকথিত হক্বপন্থীদের কাছে ইসলাম এলো কীভাবে? তাদের কাছে ইসলাম পৌঁছানোর সনদ কী? ইয়াহুদী - খ্রিষ্টানরা কি তাদের কাছে ইসলাম এনে দিয়েছে? নাকি তাদের মতে কাফের, মুশরিক, মুরতাদ, বিদয়াতী ও ভ্রষ্টরাই তাদের কাছে ইসলাম এনে দিয়েছে? আর তাদের ফতোয়া অনুযায়ী আশয়ারী-মাতুরিদিরা যেহেতু সকলেই ভ্রষ্ট, তাদের এনে দেয়া ইসলামই বা কতুটুকু নির্ভরযোগ্য থাকে? 


 

এই প্রশ্নগুলোর বাইরে চলুন দেখা যাক, উম্মতের এই হক্বের বুদ বুদ পুরো উম্মতের সাথে কী ধরণের আচরণ করে তার কিছু নমুনা দেখা যাক। 

 

তথাকথিত এই সালাফী মানহাজের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব হলেন আল-জেরিওদের ‘শেখ আহমাদ’ বা শায়খ ইবনে তাইমিয়া ( ৬৬১ - ৭২৮ হি:)। ইবনে তাইমিয়া সম্পর্কে ইবনে হাজার আসকালানী রহ: লিখেছেন,

 

فصار يردّ على صغير العلماء وكبيرهم، قديمهم وحديثهم… وكان لتعصبه لمذهب الحنابلة يقع في الأشاعرة، حتى أنه سب الغزالي فقام عليه قوم كادوا يقتلونه

 

অর্থাৎ ইবনে তাইমিয়া ছোট-বড়, বর্তমান ও পূর্ববর্তী  সব আলিমদের খন্ডন শুরু করেন। হাম্বলী মাজহাবের প্রতি তার গোঁড়ামীর কারণে আশয়ারীদের নিন্দা - মন্দ করতেন। এমনকি ইমাম গাজালী রহ: কে তিনি গালি দেন। ফলে সেসময়ের লোকেরা তার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে হত্যার উপক্রম হয়। 

 

[আদ-দুরারুল কামিনা, খ: ১, পৃ: ১৭৯ ]

 

আশয়ারী-মাতুরিদি ইমামগণের সমালোচনায় ইবনে তাইমিয়া খুব বাজে শব্দ ব্যবহার করতেন। তার ছাত্র ইবনুল কাইয়্যিমও খুব বাজে ভাষায় গালি দিয়েছেন তার বিভিন্ন কিতাবে। যেমন আশয়ারীদের সম্পর্কে ইবনে 

তাইমিয়া বলতেন, 

الأشعرية مخانيث المعتزلة

অর্থাৎ আশয়ারীরা হলো হিজড়া মু’তাজেলী। 

 

[মাজমুউল ফাতাওয়া, খ: ৬, পৃ: ৩৫৯]

 

ইমাম রাজী রহ: কে নানা মিথ্যা অপবাদ দিয়ে মুরতাদ আখ্যা দিয়েছে। পরবর্তীতে আমরা দেখব ইমাম রাজী রহ: এর মতো একজন মহান ইমামকে কত জায়গায় কতো রকম মিথ্যা ও বানান অভিযোগ দিয়ে ইবনে তাইমিয়া তাকে মুরতাদ বলেছেন। নাউজুবিল্লাহ। 

 

তাতারীদের আগ্রাসন প্রতিরোধে আলিমদের মাঝে সবচেয়ে বড় ভূমিকা  রেখেছিলেন ইজ্জুদ্দীন বিন আব্দুস সালাম রহ:। তার সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া লিখেছেন,

 

وأبو محمد وأمثاله قد سلكوا مسلك الملاحدة، الذين يقولون إن الرسول لم يبين الحق في باب التوحيد، ولا بين للناس ما هو الأمر عليه في نفسه، بل أظهر للناس خلاف الحق، والحق إما كَتَمه وإما أنه كان غير عالم به

অর্থাৎ আবু মুহাম্মাদ ইজ্জুদ্দীন বিন আব্দুস সালাম ও তার মতো অন্যরা ধর্মদ্রোহী মুলহিদদের পথ অনুসরণ করেছে। তারা বলে থাকে, তাওহীদের বিষয়ে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্য বর্ণনা করে যাননি। এমনকি মানুষকে সঠিক বিষয়টা জানিয়ে যাননি। বরং সত্যের বিপরীতটা প্রকাশ করেছেন। এদের বক্তবয়  হয় তিনি সত্য গোপন করেছেন অথবা তিনি সত্য জানতেন না। 

[মাজমুউল ফাতাওয়া, খ: ৪, পৃ: ১৫৯] 

 

আহলে সুন্নতের বরেণ্য ইমাম ছিলেন, ইমাম গাজালী রহ:। ইমাম আবু বকর বাকিল্লানী, ইমাম আবুল মায়ালী জুয়াইনী রহ, ইমাম আবু বকর ইবনুল আরাবী রহ:। দারউ তায়ারুজিল আকলি ওয়ান নক্বলি এর শুরুতে এই চার ইমামের একটি মূলনীতি এনেছেন। যেই মূলনীতি খন্ডনের জন্য মূলত: তিনি আট-দশ খন্ড লিখলেও সেটি মৌলিকভাবে খন্ডন করতে পারেননি। উনাদের মূলনীতির মত নিজেও একই কথাই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলেছেন। অথচ কিতাবের শুরুতে  আহলে সুন্নতের এই চারজন বিখ্যাত ইমামের নাম উল্লেখ করে তাদের সম্পর্কে লিখেছেন,

 

وأما هؤلاء فوضعوا قوانينهم على ما رأوه بعقولهم، وقد غلطوا في الرأي والعقل، فالنصارى أقرب إلى تعظيم الأنبياء والرسل من هؤلاء  …

অর্থাৎ উপরের চার ব্যক্তি তাদের নিজস্ব আক্বল অনুযায়ী মূলনীতি বানিয়েছে। তাদের চিন্তা ও আক্বলের ক্ষেত্রে তারা ভুল করেছে। আম্বিয়া - কেরাম ও নবী-রাসূলগণের প্রতি খ্রিষ্টানরা এসব আলিমদের থেকে বেশি সম্মান  প্রদর্শন করে থাকে … 

[দারউ তায়ারুজিল আকলি ওয়ান নক্বল, পৃ: ৭ ]

 



 

ইবনে তাইমিয়ার এই আক্রমণ থেকে বাদ পড়েনি ইমাম বাইহাকী, ইমাম বাজী সহ অন্যান্য বিখ্যাত ইমামগণ। দারউ তায়ারুজিল আকলি ওয়ান নক্বল কিতাবে ‘সিফাত অস্বীকারকারী জাহমী’ দের একটি তালিকা করেছেন তিনি। ‘সিফাত অস্বীকারকারী’ জাহমীদের তালিকায় স্থান পেয়েছেন ইমাম বাইহাকী সহ আহলে সুন্নতের বরেণ্য ইমামগণ। 

 

‘সিফাত অস্বীকারকারী’ বা ‘নুফাতুল জাহমিয়া’ (জাহমী সিফাত অস্বীকারকারী) দের নিয়ে তার লম্বা আলোচনাটি আমরা মূল কিতাব থেকে নিচে উল্লেখ করছি। দারউ তায়ারুজিল আকলি ওয়ান নক্বলের ৭ম খন্ডে এই তালিকা তিনি পেশ করেছেন। শুরুতেই তিনি একটি প্রশ্ন উত্থাপন করে এর জওয়াব দিয়েছেন,

 

প্রশ্ন: আপনি বলেছেন, জাহমী-মু’তাজেলীদের মাঝে অধিকাংশ সিফাত অস্বীকারকারীরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনীত দ্বীন, কুরআন - সুন্নাহের ব্যাখ্যায় সালাফের বক্তব্য ও আকিদার বিষয়ে তাদের অবস্থান সম্পর্কে কম জ্ঞান রাখত। সিফাত অস্বীকারকারীদের মাঝে তো এমন অনেকেই রয়েছে যাদের এসব বিষয়ে জ্ঞান ছিল?

 

উত্তর: এসব সিফাত অস্বীকারকারীদের অনেক প্রকার রয়েছে। 

১ম প্রকার: এদের আকলিয়াত বা যুক্তিবিদ্যায় তেমন অভিজ্ঞতা ছিলো না। বরং এক্ষেত্রে তারা সিফাত অস্বীকারকারীদের বক্তব্য ও তাদের দলিল গ্রহণ করে থাকে। আর এগুলোকে তারা অকাট্য দলিল মনে করে। এক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব যৌক্তিক সক্ষমতা নেই। বরং তারা মূলত: মুকাল্লিদ। তারা সিফাত অস্বীকারকারীদের বক্তব্যগুলোই বিশ্বাস করে আছে তাদের অনুসরণ হিসেবে। তারা কুরআন - হাদীস, ও সালাফের যতো বক্তব্য শোনে, এর সব কিছুকেই তাদের জানা এই নীতিমালার উপর প্রয়োগ করে। এর বাইরে তারা যায় না। কখনও তারা মনে করে, কুরআন-সুন্নাহের বক্তব্যটি সিফাত অস্বীকারকারীদের দেয়া হুকুমের অনুগামী অথবা তারা এর অর্থকে আল্লাহর উপর ন্যস্ত করে দেয় ( তাফবীজ করে)। 

 

এই প্রকারের উদাহরণ হলো, আবু হাতিম আল-বুস্তী, আবু সায়াদ সাম্মান আল-মু’তাজেলী, আবু জর আল-হারাবী, আবু বকর আল-বাইহাকী, কাজী ইয়াজ, আবুল ফরজ ইবনুল জাওজী, আবুল হাসান আলী ইবনে মুফাদ্দল আল-মাকদেসী ও অন্যান্যরা। 

 

২য় প্রকার: সিফাত অস্বীকারকারীদের দ্বিতীয় প্রকার হলো, যারা আকলিয়াত বা যৌক্তিক বিষয়ে ইজতিহাদের পথ অবলম্বন করেছে। এবং এক্ষেত্রে অন্যান্য যুক্তিবোদ্ধাদের মত তারাও ভুল করেছে। এবং জাহমিয়াদের বিভিন্ন বাতিল মূলনীতির সাথে একমত হয়েছে। অথচ তাদের এ বিষয়ে সালাফের বক্তব্যের বিষয়ে তেমন জানা-শোনা ছিলো না যেমনটি  আহলে সুন্নতের অন্য ইমামদের ছিলো। যদিও তারা বোখারী-মুসলিম সহ অন্যান্য হাদীসের কিতাব সম্পর্কে অবগত ছিলো। 

 

এই প্রকারের উদাহরণ হল,  আবু মুহাম্মাদ ইবনে হাজাম, আবুল ওয়ালীদ আল-বাজী, কাজী আবু বকর ইবনুল আরাবী ও অন্যান্যরা। 

 

সিফাত অস্বীকারকারীদের এই প্রকারের মধ্যেই রয়েছে বিশর আল-মিররিসী, মুহাম্মাদ বিন শুজা আল-সালজী ও অন্যান্যরা। 

 

৩য় প্রকার: 

 

যারা হাদীস ও আসার সংগ্রহ করেছে। সালাফের মাজহাবকেও সম্মান করে। কিন্তু তারা জাহমী-কালামীদের  বিভিন্ন নীতিমালার সাথে একমত পোষণ করেছে। কুরআন-হাদীস ও আসার সম্পর্কে আহলে সুন্নত ও মুহাদ্দিসীনদের মতো তাদের অভিজ্ঞতা ও জানা-শোনা ছিলো না। সহীহ - জয়ীফ পার্থক্য করার দিক থেকে না আবার সেগুলোর মর্ম উদ্ধারের ক্ষেত্রেও না। তারা ‘সিফাত অস্বীকারকারী জাহমীদের’ বিভিন্ন আকলী উসূলকে সঠিক মনে করেছে এবং এসব উসূলের মধ্যকার স্ববিরোধিতাও উপলব্ধি করেছে। 

 

এই প্রকারের উদাহরণ হলো, আবু বকর ইবনু ফু’রাক, কাজী আবু ইয়া’লা আল-ফাররা, ইবনে আকীল হাম্বলী ও অন্যান্যরা। 

 

এজন্য কখনও কখনও এরা সিফাতের বিষয়ে তা’বীলের পথ অবলম্বন করে। যেমন ইবনে ফু’রাক ও তার মতো অন্যরা মুশকিলুল আসার (স্ববিরোধী হাদীসের পর্যালোচনা) - এ  এজাতীয় কাজ করেছেন। কখনও আবার সিফাতের অর্থকে আল্লাহর দিকে ন্যস্ত করেন ( তাফবীদ করেন)। 

 

আবার কখনও কখনও বলেন, সিফাত তার বাহ্যিক অর্থে থাকবে। যেমনটি করেছেন কাজী আবু ই’য়ালী আল-ফাররা ও অন্যরা। 

আবার কখনও তাদের ইজতিহাদ একেক ক্ষেত্রে একেক রকম হয়। কখনও তারা তা’বীলকে প্রাধান্য দেন আবার কখনও তাফয়ীদকে ( আল্লাহর দিকে অর্থ ন্যস্ত করা)। যেমনটি ইবনে আক্বীল হাম্বলী ও অন্যরা করেছেন। 

 

তারা কখনও কখনও স্ববিরোধী হাদীসের ক্ষেত্রে জাল হাদীসও ঢুকিয়ে দেয়। অথচ তারা জানে না যে, এটি জাল হাদীস। এমনকি এই হাদীসের ভিন্ন একটি শব্দ আছে যা হাদীসের বিরোধকে নিরসন করে দেয়। অথচ তারা এটি জানে না। যেমন কোন হাদীস হয়ত আল্লাহর রাসূলের স্বপ্ন ছিলো তারা মনে করেছে এটি মি’রাজের রাতের ঘটনা। 

 

(৪র্থ প্রকার) 

 

কেউ কেউ আছেন, যাদের জাহমী ও অন্যদের কাছ থেকে নেয়া যৌক্তিক বিষয়ের দক্ষতা আছে। এবং জাহমীদের কোন কোন মূলনীতিতে তারা একমতও হয়েছেন। তবে তারা জাহমী ও অন্যান্যদের সেসব বক্তব্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, যেগুলো আহলে সুন্নতের প্রসিদ্ধ মতের বিপরীত। যেমন, খালকে কুরআ ( কুরআন সৃষ্ট হওয়া বা না হওয়া), পরকালে আল্লাহ তায়ালাকে দেখা। কারণ, সর্ব-সাধারণ সবার কাছে এটি প্রসিদ্ধ ছিলো যে, আহলে সুন্নতের মত হলো, কুরআন আল্লাহর কালাম ও অসৃষ্ট। আর আল্লাহ তায়ালাকে পরকালে দেখা যাবে।

 

এই দল তখন চেষ্টা করল, আহলে সুন্নত ও মুহাদ্দিসগণের নিকট প্রসিদ্ধ মতামতকে শক্তিশালী করা এবং জাহমিয়াদের কাছ থেকে যেই যৌক্তিক উসূল বা নীতিমালাগুলোকে সঠিক মনে করে  নিয়েছিল, এই দু’টির মাঝে সমন্বয় সাধন করতে। তাদের মাঝে কুরআন ও তার মর্মের সুবিস্তার জ্ঞান ও দক্ষতা ছিলো না। আহলে সুন্নতের ইমাম ও মুহাদ্দিসগণের তুলনায় তাদের হাদীস ও সাহাবীদের বক্তব্যের ব্যাপারেও তাদের জানা-শোনা ও দক্ষতার স্বল্পতা ছিলো।  তখন তারা মুহাদ্দিস ও জাহমিদের একটি সমন্বিত মাজহাব গড়ে তোলেন। অথচ উভয় দল ( মুহাদ্দিস ও জাহমীরা) তাদেরকে স্ববিরোধিতার অভিযোগ করে থাকে। 

 

এটি ছিলো আবুল হাসান আশয়ারী ও তার অনুসারীদের পথ ও পন্থা। যেমন কাজী আবু বকর বাকিল্লানী, আবু ইসহাক ইস্ফ্রাইনী ও অন্যরা। 

 

তারা যেহেতু উভয় মাজহাবের মধ্যে সমন্বয় করেছেন, এজন্য তাদের মাঝে দেখবা তাদের সবচেয়ে ভালো আলিম যেমন আবুল হাসান আশয়ারী যখন আহলে সুন্নত ও মুহাদ্দিসদের মত উল্লেখ করে তখন খুব সংক্ষেপে উল্লেখ করে। তিনি যতটুকু প্রয়োজন মনে করেন ততটুকু উল্লেখ করে মনে করেন, তিনি মুহাদ্দিসগণের পুরো মতটিই উল্লেখ করেছেন। এর বিপরীতে যখন কালামীদের বক্তব্য যেমন মু’তাজিলা ও অন্যান্যদের মতামত উল্লেখ করেন, তখন অত্যন্ত নিপুণতার সাথে সুবিস্তারে তা তুলে ধরেন। 

 

মু’তাজিলা ও অন্যান্যদের স্ববিরোধিতা ও তাদের ভুল-ভ্রান্তি  জানতে এদের আলোচনা উপকারী।  তবে আল্লাহর রাসূলের আনীত দ্বীন ও সাহাবা ও তাবেয়ীদের সঠিক অবস্থান সম্পর্কে তাদের জ্ঞান ত্রুটিপূর্ণ। 

 

নতুবা তারা যদি আসার, সাহাবা-তাবেয়দীর অবস্থান, আল্লাহর রাসূলের আনীত দ্বীন সম্পর্কে সম্যক অবগত থাকত এবং এগুলোর বিপরীত বিষয়ে সুধারণা না রাখত, তাহলে তাদের দলে (জাহমী-মু’তাজেলীদের) কখনও ভিড়ত না। কারণ, এক্ষেত্রে তারা হয়ত সামগ্রিকভাবে ধারণা রাখে যে, এসব বিদয়াতীরা  অকাট্যভাবে রাসূলের বিরোধী। আর এটা তো সবার জানা যে, যে রাসূলের সা: বিরোধিতা সে পথভ্রষ্ট। বিদয়াতীদের বিষয়ে এধরণের সামগ্রিক বিশ্বাস রাখতেন অধিকাংশ মুহাদ্দিস।

 

অথবা তারা এই সামগ্রিক বিশ্বাসের পাশাপাশি এসব বিদয়াতীদের বাতিল চিন্তা-চেতনা ও স্ববিরোধিতা সুবিস্তারেও হয়ত জানত। যেমনটি বড় বড় মুহাদ্দিসরা জানতের। যাদের মত অন্যরা জানত না। যেমন, ইমাম মালেক, আব্দুল আজিজ মাজিশুন, হাম্মাদ বিন জায়েদ, হাম্মাদ বিন সালামা, সুফইয়ান বিন উয়াইনা, ইবনুল মুবারক, ওকী ইবনুল জাররাহ, আব্দুল্লাহ ইবনে ইদ্রীস, আব্দুর রহমান ইবনে মাহদী, মুয়াজ বিন মু’য়াজ, ইয়াজীদ বিন হারুন আল-ওয়াসেতী, ইয়াহইয়া বিন সাইদ আল-কাত্তান, সাইদ বিন আমের, শাফেয়ী, আহমাদ বিন হাম্বল, ইসহাক বিন ইব্রাহীম, আবু আব্দির রহমান কাসেম সাল্লাম,  মুহাম্মাদ বিন ইসমাইল আল-বোখারী, মুসলিম বিন হাজ্জাজ নাইশাপুরী, উভয় দারেমী, আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহমান, উসমান বিন সাইদ, আবু হাতেম ও আবু জুরয়া রাজী, আবু দাউদ সিজিস্তানী, আবু বকর আসরম, হারব, আল-কিরমানী। এরকম আরও অসংখ্য ইমাম, যাদের সংখ্যা আল্লাহ ছাড়া কেউ গণনা করতে পারবে না। যারা ছিলেন ইসলামের ইমাম, নবীর উত্তরাধিকারী ও রাসূলের খুলাফা। 

 

উপরের সকলেই ‘সিফাত অস্বীকারকারীদের’ বিরোধিতায় একমত ছিলেন। যেমনটি তারা ও তাদের বাইরে সালাফের অন্যান্য ইমাম থেকে অসংখ্য আসার তাওয়াতুরের সাথে বর্ণিত হয়েছে। আর এ বিষয়ে তাদের মাঝে কোনও বিরোধ নেই। 

 

[দারউ তায়ারুজিল আকলি ওয়ান নক্বলি, খ: ৭, পৃ: ৩২-৩৭ ] 

 

এই ছিলো সালাফীদের শেখ আহমাদ বা ইবনে তাইমিয়ার ভাষায়  ‘সিফাত অস্বীকারকারী জাহমীদের’ তালিকা। এই তালিকা থেকে মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে গেছে, ইবনে তাইমিয়ার মতে দু’শ তিন শ’ হিজরী পর্যন্ত  মুহাদ্দিসরা ছাড়া পরবর্তী আহলে সুন্নতের প্রায় সকলেই ‘সিফাত অস্বীকারকারী জাহমী’ ছিলো অথবা জাহমীদের মূলনীতির সাথে একমত ছিলেন। আর যেসব মুহাদ্দিসদের নাম উল্লেখ করে নিজের দল ভারী করার চেষ্টা করেছেন, তারা কতুটুকু তার মতের পক্ষের ছিলেন, সেটাও বিবেচ্য। একথা হলফ করে বলা যায়, উপরের মুহাদ্দিসদের মাঝে কিছু কিছু হাশাবিয়া বা দেহবাদ প্রভাবের বাইরে কেউ-ই ইবনে তাইমিয়ার পক্ষের নন। অধিকাংশ থেকেই ইবনে তাইমিয়র আকিদার সুস্পষ্ট বিপরীত আকিদা ও বর্ণনা দেখান সম্ভব। যার বহু বর্ণনা ডক্টর সাইফ আল-আসরীর ‘আল-কাউলুত তামাম’ ও এজাতীয় কিতাবে চলে এসেছে। 

 

মোটকথা, ইবনে তাইমিয়া যেভাবে পুরো উম্মতের উলামায়ে কেরাম ও তাদের অনুসারীদেরকে ‘সিফাত অস্বীকারকারী জাহমী’ বানিয়েছে তা খুবই আশ্চর্যজনক। ইমাম আশয়ারী  থেকে শুরু করে ইমাম বাইহাকী, ইবনুল জাওজী, কাজী ইয়াজ সহ মোটাদাগের কেউ-ই ইবনে তাইমিয়ার সিফাত অস্বীকারকারী তালিকার বাইরে নয়। বিষয়টি বেশ আশ্চর্যজনক ও হাস্যকর। দুনিয়ার সকলেই যদি সিফাত অস্বীকারকারী হয়, তাহলে তার দাবী অনুযায়ী প্রাথমিক যুগের মুহাদ্দিসদের পরে সিফাত স্বীকারকারী কারা? হাজার বছর ধরে মুসলমানদের সকলেই কি সিফাত অস্বীকারকারী? লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ। 



 



 




 

 

ইবনে তাইমিয়ার ছাত্র ইবনুল কাইয়্যিমও কোন অংশে কম যান না। আহলে সুন্নতের বরেণ্য ইমাম সাইফুদ্দীন আমিদী রহ: কে ‘সাউরুন কাবীর’ বা  বড় ষাড় বা বলদ বলেছেন। সেই সাথে বলেছেন, হাকীরুশ শান বা খুবই নিচু পর্যায়ের লোক। আরও একটি অপবাদ যোগ করেছেন এই বলে যে, ইমাম আমিদী আল্লাহর অস্তিত্ব নিয়ে সন্দিহান ছিলেন।  ইবনুল কাইয়্যিমের এই আদবের সাথে তার কিতাব ‘নু’নিয়ার’ ব্যাখ্যাকার সালাফী শায়খ খলিল হাররাস ইমাম আমিদীর বিখ্যাত আকিদার কিতাব ‘আবকারুল আফকার’ কে নাম দিয়েছেন ‘আবয়ারুল আফকার’। যার অর্থ হলো, চিন্তা-চেতনার গরুর লাদি। এই হলো বড় বড় ইমামদের সাথে নজদী-তাইমীদের আদব ও ব্যবহার। 






 

এই পর্বে এতটুকুই। পরবর্তী পর্বে ইনশা আল্লাহ নজদী-তাইমীদের অপবাদ ও জুলুমের আরও অনেক উপাখ্যান থাকবে ইনশা আল্লাহ। বিশেষ করে, ইবনে তাইমিয়া  ইমাম রাজী রহ: এর উপর কতো জায়গায় কীভাবে মিথ্যাচার করে তাকে মুরতাদ আখ্যা দিয়েছে তার বিস্তারিত বিবরণও ইনশা আল্লাহ পেশ করব। 

------ ------

লেখকের আরো ব্লগ

আক্বিদা

ইলমের সফর অব্যাহত থাকুক

ইজহারুল ইসলাম বৃহঃ, 21 নভে., 2024

খতীব বাগদাদী রহ. তার ‘আল-জামে লি-আখলাকির রাবি ও আদাবিস সামে’ কিতাবে ইমাম আবু ইউসুফ রহ. থেকে একটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন।
الْعِلْمُ شَيْءٌ لا يُعْطِيكَ بَعْضَهُ حَتَّى تُعْطِيَهُ كُلَّكَ
অর্থ: ইলম এমন একটি জিনিস, সে তোমাকে তার কিছু অংশও দিবে না যতক্ষণ না তুমি নিজেকে পূর্ণভাবে তার কাছে সমর্পণ না করবে।

অন্যান্য সৃষ্টি থেকে মানুষের শ্রেষ্ঠত্যের একটি বিশেষ দিক হলো ইলম অর্জনের ক্ষমতা। এটি মানুষের জন্য আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।

ইলমের জন্য যে…

বাকি অংশ পড়তে সাবস্ক্রাইব করুন
আক্বিদা

ইবনে তাইমিয়া রহ. এর কারামত

ইজহারুল ইসলাম বৃহঃ, 21 নভে., 2024

ইবনে তাইমিয়া রহ. এর জীবনী আলোচনা করেছেন তার বিশিষ্ট ছাত্র ইবনুল কাইয়্যিম রহ। তার পৃথক জীবনী লিখেছেন ইবনে তাইমিয়া রহ. এর বিশিষ্ট দুই ছাত্র। একজন হলেন, হাফেজ আবু হাফস উমর ইবনে আলি আল-বাযযার (মৃত:৭৪৯ হি:) তিনি আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া লিখেছেন। ইবনে তাইমিয়া রহ. আরেক ছাত্র ইবনে আব্দুল হাদী রহ. (মৃত: ৭৪৪ হি:) আরেকটি জীবনী লিখেছেন। তার লিখিত জীবনীর নাম আল-উকুদুল দুররিয়া মিন মানাকিবি শাইখিল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া।

আমি এখানে ইবনে তাইমিয়া রহ. এর বিশিষ্ট ছাত্রদের বর্ণনায় তার কিছু উল্লেখযোগ্য কারামত উল্লেখ করছি।

কারামত-১:

লওহে মাহফুজ দেখে বিজয়ের সংবাদ:

গায়েবসম্পর্কেইবনেতাইমিয়ারহএরকারামত:

আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) “মাদারিজুস সালিকিন শরহু মানাযিলিস সাঈরিন” নামক কিতাবে আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) এর কারামতের কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) লিখেছেন-

أخبر الناس والأمراء سنة اثنتين وسبعمائة لما تحرك التتار وقصدوا الشام : أن الدائرة والهزيمة عليهم وأن الظفر والنصر للمسلمين وأقسم على ذلك أكثر من سبعين يمينا فيقال له : قل إن شاء الله فيقول : إن شاء الله تحقيقا لا تعليقا  وسمعته يقول ذلك قال : فلما أكثروا علي قلت : لا تكثروا كتب الله تعالى في اللوح المحفوظ : أنهم مهزومون في هذه الكرة وأن النصر لجيوش الإسلام

“তাতারীরা যখন মুসলিম উম্মাহের বিভিন্ন অঞ্চলে সেনা অভিযান পরিচালনা করে এবং শামে আক্রমণের উদ্যোাগ গ্রহণ করে তখন ৭০২ হিঃ সনে শায়েখ (রহঃ) সাধারণ মানুষ এবং আমীর-উমারাদেরকে সংবাদ দিলেন যে, “তাতারীরা পরাজিত হবে এবং মুসলমানরা বিজয় ও সাহায্য লাভ করবে।”। তিনি তাঁর কথার উপর সত্তরটিরও বেশি কসম খেয়েছেন। তাঁকে বলা হল, আপনি ইনশাআল্লাহ বলুন! অতঃপর তিনি বলেন, নিশ্চিতভাবে ইনশাআল্লাহ বলছি, সম্ভাবনা হিসেবে নয়। আমি তাঁকে বলতে শুনেছি, যখন তারা আমার উপর পীড়াপীড়ি করল, আমি তাদেরকে বললাম, তোমরা পীড়াপীড়ি কর না, আল্লাহ তায়ালা লউহে মাহফুজে লিখে রেখেছেন যে, তারা পরাজিত হবে এবং মুসলমানরা বিজয়ী হবে।

[মাদারিজুস সালিকিন, খ–২, পৃষ্ঠা-৪৮৯]

আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) আরও অনেক কারামতের কথা উল্লেখ করেছেন, ইবনে আব্দুল হাদী মুকাদ্দেসী (রহঃ) এবং আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ)। বিস্তারিত জানার জন্য আগ্রহী পাঠক, মাদারিজুস সালিকীন ও আ’লামুল আলিয়্যা গ্রন্থদ্বয় দেখতে পারেন।

¬

কারামত-২: ইবনে তাইমিয়া রহ. এর ভবিষ্যৎবাণী:

আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) এর বিশেষ ছাত্র আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) লিখেছেন-

وأخبرني غير مرة بأمور باطنة تختص بي مما عزمت عليه ولم ينطق به لساني وأخبرني ببعض حوادث كبار تجري في المستقبل ولم يعين أوقاتها وقد رأيت بعضها وأنا أنتظر بقيتها وما شاهده كبار أصحابه من ذلك أضعاف أضعاف ما شاهدته والله أعلم

“তিনি আমাকে অনেকবার অনেক বাতেনি বিষয়ের সংবাদ দিয়েছেন। তিনি শুধু আমাকে এগুলো বলেছেন এবং এ বিষয় সম্পর্কে আমি কাউকে কিছু বলি নি। তিনি আমাকে ভবিষ্যতের অনেক ঘটনার সংবাদ দিয়েছেন কিন্তু তিনি সময় নির্দিষ্ট করে দেননি। তাঁর ভবিষ্যৎ বাণীর কিছু কিছু আমি ঘটতে দেখেছি এবং অবশিষ্টগুলো সংঘটিত হওয়ার অপেক্ষায় আছি। তাঁর বড় বড় সাগরেদগণ আমি যা দেখেছি, তার চেয়ে বহু বহু গুণ বেশি দেখেছেন”

[মাদারিজুস সালিকিন, খ–২, পৃষ্ঠা-৪৯০]

কারামত-৩: অন্তরের বিষয় সম্পর্কে অবগত হওয়া:

ইবনে তাইমিয়া রহ. এর ছাত্র আবু হাফস উমর আল-বাযযার বলেন,

أنه جرى بيني وبين بعض الفضلاء منازعة في عدة مسائل وطال كلامنا فيها وجعلنا نقطع الكلام في كل مسألة بأن نرجع إلى الشيخ وما يرجحه من القول فيها

ثم أن الشيخ رضي الله عنه حضر فلما هممنا بسؤاله عن ذلك سبقنا هو وشرع يذكر لنا مسألة مسألة كما كنا فيه وجعل يذكر غالب ما أوردناه في كل مسأله ويذكر أقوال العلماء ثم يرجح منها ما يرجحه الدليل حتى أتى على آخر ما أردنا أن نسأله عنه وبين لنا ما قصدنا أن نستعلمه منه فبقيت أنا وصاحبي ومن حضرنا أولا مبهوتين متعجبين مما كاشفنا به وأظهره الله عليه مما كان في خواطرنا.”

অর্থাৎ আমার সাথে একজন সম্মানিত আলেমের কয়েকটি মাসআলা নিয়ে বিতর্ক হলো। এ বিষয়ে আমাদের আলোচনা অনেক দীঘর্ হলো। প্রত্যেক মাসআলায় আমরা এভাবে কথা শেষ করলাম যে, মাসআলার সমাধান ইবনে তাইমিয়া রহ. এর কাছ থেকে জেনে নিবো।

এরপর শায়খ রহ. আমাদের নিকট উপস্থিত হলেন। আমরা যখন মাসআলাগুলো সম্পর্কে শায়খকে জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছা করলাম তিনি আমাদের জিজ্ঞাসার পূর্বেই আলোচনা শুরু করলেন। তিনি আমাদের আলোচনা অনুযায়ী একের পর এক মাসআলার সমাধান বলতেছিলেন। প্রত্যেক মাসআলায় আমাদের কাঙ্খিত উত্তর প্রদান করছিলেন। এভাবে তিনি প্রত্যেকটি মাসআলায় উলামায়ে কেরামের বক্তব্য এবং দলিল অনুযায়ী প্রাধান্য পাওয়া মাসআলাটি উল্লেখ করছিলেন। অবশেষে তিনি আমাদের আলোচিত সর্বশেষ মাসআলাটির সমাধান প্রদান করলেন। আমাদের অন্তরের বিষয়গুলো আল্লাহ তায়ালা এভাবে সুস্পষ্ট করে প্রকাশ করায় উপস্থিত লোকজন, আমার সঙ্গী ও আমি আশ্চর্যন্বিত ও বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৩, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

নিচের স্ক্রিনশট দেখুন,

এছাড়া আবু হাফস আল-বাযযার অন্তরের বিষয়ে ইবনে তাইমিয়া রহ. এর অবগত হওয়া সম্পর্কে আরও বলেন,

و كنت في خلال الأيام التي صحبته فيها إذا بحث مسألة يحضر لي إيراد فما يستتم خاطري به حتي يشرع فيرده و يذكر الجواب من عدة وجوه

অর্থাৎ আমি যখন যেসময়ে তার সংস্পর্শে ছিলাম, তখন আমার মনে কোন বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ার সঙ্গে তিনি এর জওয়াব দিতে শুরু করতেন এবং কয়েকভাবে এর উত্তর প্রদান করতেন।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৩, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কারামত-৪: অন্যের সাহায্য

“وحدثني الشيخ الصالح المقريء أحمد بن الحريمي أنه سافر إلى دمشق قال فاتفق أنى لما قدمتها لم يكن معي شئ من النفقة البتة وأنا لا اعرف أحدا من أهلها فجعلت أمشي في زقاق منها كالحائر فإذا بشيخ قد أقبل نحوي مسرعا فسلم وهش في وجهي ووضع في يدي صرة فيها دراهم صالحة وقال لي انفق هذه الآن وخلي خاطرك مما أنت فيه فإن الله لا يضيعك ثم رد على أثره كأنه ما جاء إلا من أجلي فدعوت له وفرحت بذلك، وقلت لبعض من رأيته من الناس من هذا الشيخ؟ فقال وكأنك لا تعرفه هذا ابن تيمية

আমার নিকট শায়খ সালেহ আল –মুকরী বর্ণনা করেন, তিনি  দামেশকের উদ্দেশে সফর করেন। তিনি বলেন, ঘটনাক্রমে ঐ সফরে আমার সঙ্গে কোন চলার মতো কোন খাবার বা অর্থ ছিলো না। আমি ওখানকার কাউকে চিনতাম না। এ অবস্থায় আমি উদভ্রান্তের মতো  দামেশকের অলি-গলিতে ঘুরছিলাম। হঠাৎ একজন শায়খ আমার দিকে দ্রুত গতিতে হেঁটে এলেন। তিনি হাস্যোজ্জল মুখে সালাম দিলেন। তিনি আমার হাতে একটা থলি দিলেন যাতে কিছু খাটি দিরহাম ছিলো। এরপর বললেন, “ এগুলো ব্যবহার করো। তোমার অন্তরে যেই পেরেশানী আছে এগুলো ঝেড়ে ফেলো।  আল্লাহ তায়ালা তোমাকে ধ্বংস করবেন না।” একথা বলে তিনি একই পথে ফিরে গেলেন। তিনি যেন শুধু আমার কাছেই এসেছিলেন। আমি তার জন্য দুয়া করলাম এবং এতে আনন্দি হলাম। আমি অন্যান্য মানুষকে জিজ্ঞেস করলাম, এই শায়খ কে? তারা বললো, তুমি মনে হয় শায়খকে চেনো না, তিনি হলেন ইবনে তাইমিয়া।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৪, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কারামত-৫:

وحدثني الشيخ العالم المقريء تقي الدين عبد الله ابن الشيخ الصالح المقريء احمد بن سعيد قال سافرت إلى مصر حين كان الشيخ مقيما بها فاتفق أني قدمتها ليلا وأنا مثقل مريض فأنزلت في بعض الأمكنة فلم ألبث أن سمعت من ينادي باسمي وكنيتي فأجبته وأنا ضعيف فدخل إلي جماعة من أصحاب الشيخ ممن كنت قد اجتمعت ببعضهم في دمشق فقلت كيف عرفتم بقدومي وأنا قدمت هذه الساعة فذكروا أن الشيخ أخبرنا بأنك قدمت وأنت مريض وأمرنا أن نسرع بنقلك وما رأينا أحدا جاء ولا أخبرنا بشيء، فعلمت أن ذلك من كرامات الشيخ رضي الله عنه.”

শায়খ সালেহ আল-মুকরী এর ছেলে শায়খ তাকিউদ্দীন আব্দুল্লাহ আল-মুকরী আমাকে বলেছেন, শায়খ ইবনে তাইমিয়া রহ. যখন মিশরে ছিলেন তখন আমি মিশরে সফর করি। আমি রাতে মিশরে গিয়ে উপস্থিত হলাম। তখন আমার কাছে ভারী বোঝা ছিল আর আমি অসুস্থ ছিলাম। আমি এক জায়গায় গিয়ে বাহন থেকে নামলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে শুনতে পেলাম এক ব্যক্তি আমার নাম ও উপনাম ধরে ডাকছে। আমি দুর্বল শরীরে তার ডাকে সাড়া দিলাম। তখন শায়খ ইবনে তাইমিয়ার একদল ছাত্র আমার নিকট এলো। তাদের সাথে আমি পূর্বে দামেশকে সাক্ষাৎ করেছিলাম। আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা আমার আগমন সম্পর্কে কীভাবে জানলে; অথচ আমি মাত্র এলাম? তারা বলল, শায়খ ইবনে তাইমিয়া তাদেরকে বলেছে যে, আপনি এসেছেন এবং আপনার শরীর অসুস্থ। আমাদেরকে দ্রুত আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন। আমরা কাউকে আসতেও দেখিনি এবং আপনার সম্পর্কে কেউ পূর্বে সংবাদও দেয়নি। আমি তখন বুঝলাম এটি শায়খের কারামত।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৪, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কারামত-৬:                                  

“وحدثني أيضا قال مرضت بدمشق إذ كنت فيها مرضة شديدة منعتني حتى من الجلوس فلم اشعر إلا والشيخ عند رأسي وأنا مثقل مشتد بالحمى والمرض فدعا لي وقال جاءت العافية، فما هو إلا أن فارقني وجاءت العافية وشفيت من وقتي”

শায়খ সালেহ আল-মুকরী এর ছেলে শায়খ তাকিউদ্দীন আব্দুল্লাহ আল-মুকরী আরও বলেন, আমি দামেশকে কঠিন রোগে আক্রান্ত হলাম। এমনকি আমি বসতেও পারতাম না। হঠাৎ আমার মাথার নিকট শায়খকে দেখতে পেলাম।তখন আমি মারাত্মক জ্বর ও রোগে আক্রান্ত ছিলাম।তিনি আমার জন্য দুয়া করলেন এবং বললেন, সুস্থতা চলে এসেছে।তিনি আমার কাছ থেকে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি সুস্থ হয়ে গেলাম।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৫, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কারামত-৭:

“وحدثني أيضا قال أخبرني الشيخ ابن عماد الدين المقرئ المطرز قال قدمت على الشيخ ومعي حينئذ نفقة فسلمت عليه فرد علي ورحب بي وأدناني ولم يسألني هل معك نفقة أم لا، فلما كان بعد أيام ونفدت نفقتي أردت أن اخرج من مجلسه بعد أن صليت مع الناس وراءه فمنعني وأجلسني دونهم فلما خلا المجلس دفع إلي جملة دراهم وقال أنت الآن بغير نفقة فارتفق بهذه فعجبت من ذلك وعلمت أن الله كشفه على حالي أولا لما كان معي نفقة وآخرا لما نفدت واحتجت إلى نفقة.”

আমার নিকট তিনি আরও বর্ণনা করেছেন, আমার নিকট শায়খ ইবনে ইমাদুদ্দিন আল-মুকরী আল-মুতাররায বর্ণনা করেন, তিনি বলেন আমি একবার শায়খের নিকট আগমন করলাম। তখন আমার কাছে খরচের টাকা-পয়সা ছিলো। আমি তাকে সালাম দিলাম, তিনি উত্তর দিলেন এবং আমাকে স্বাগত জানালেন। আমাকে তিনি তার নিকটে বসালেন। এবার তিনি আমার জীবিকা নির্বাহের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন না। কিছুদিন পর আমার খরচের উপকরণ শেষ হয়ে গেল। তখন আমি তার পিছে নামায আদায় করে তার মজলিশ থেকে বের হতে উদ্যত হলাম। তিনি আমাকে বাধা দিয়ে বসতে বললেন। এরপর যখন মজলিশ শেষ হলো, তখন তিনি আমাকে কিছু দিরহাম দিয়ে বললেন, এখন তোমার কোন খরচের টাকা-পয়সা নেই। এগুলো ব্যবহার করতে থাকে। এ ঘটনায় আমি বিস্মিত হলাম। বুঝলাম যে আল্লাহ তায়ালা আমার পূর্বের ও বর্তমান অবস্থা শায়খের নিকট প্রকাশ করে দিয়েছেন।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৬, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কারামত-৮: মৃত সম্পর্কে সংবাদ:

“وحدثني من لا أتهمه أن الشيخ رضي الله عنه حين نزل المغل بالشام لأخذ دمشق وغيرها رجف أهلها وخافوا خوفا شديدا، وجاء إليه جماعة منهم وسألوه الدعاء للمسلمين فتوجه إلى الله ثم قال أبشروا فإن الله يأتيكم بالنصر في اليوم الفلاني بعد ثالثة حتى ترون الرؤوس معبأة بعضها فوق بعض.قال الذي حدثني فوالذي نفسي بيده أو كما حلف ما مضى إلا ثلاث مثل قوله حتى رأينا رؤوسهم كما قال الشيخ على ظاهر دمشق معبأة بعضها فوق بعض.”

আমার নিকট বিশ্বস্ত এক ব্যক্তি বর্ণনা করেছেন, যখন মোগলরা দামেশক ও অন্যান্য অন্চল দখলের জন্য শামে আক্রমণ করলো, দামেশকের অধিবাসীরা খুবই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। এসময় একদল মুসলমান শায়খ ইবনে তাইমিয়া রহ. এর নিকট আগমন করলেন এবং তাকে মুসলমানদের জন্য দুয়া করার অনুরোধ করলেন। তিনি আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করলেন। এরপর বললেন, তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ করো, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা  তিন দিন পর তোমাদেরকে সাহায্য করবেন, এমনকি তোমরা দেখবে যে একটার উপর আরেকটা মাথা স্তুপ হয়ে থাকবে। ঘটনার বর্ণনাকারী বলেন, আল্লাহর শপথ, তৃতীয় দিন দামেশকের প্রবেশ মুখে শত্রুদের মাথাগুলো একটার উপর আরেকটা স্তুপ হয়েছিলো যেমন শায়খ বলেছিলেন।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৬, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কারামত-৯:

“وحدثني الشيخ الصالح الورع عثمان بن احمد بن عيسى النساج أن الشيخ رضي الله عنه كان يعود المرضى بالبيمارستان بدمشق في كل أسبوع فجاء على عادته فعادهم فوصل إلى شاب منهم فدعا له فشفي سريعا وجاء إلى الشيخ يقصد السلام عليه فلما رآه هش له وأدناه ثم دفع إليه نفقة وقال قد شفاك الله فعاهد الله أن تعجل الرجوع إلى بلدك أيجوز أن تترك زوجتك وبناتك أربعا ضيعة وتقيم هاهنا؟ فقبل يده وقال يا سيدي أنا تائب إلى الله على يدك وقال الفتى وعجبت مما كاشفني به وكنت قد تركتهم بلا نفقة ولم يكن قد عرف بحالي أحد من أهل دمشق.”

শায়খ উসমান ইবনে আহমাদ ইবনে ইসা আন-নাসসাজ আমার নিকট বর্ণনা করেছেন, শায়খ ইবনে তাইমিয়া রহ. দামেশকের বিমারিস্তান নামক জায়গায় প্রত্যেক সপ্তাহে রোগীদের দেখতে আসতেন। অভ্যাস অনুযায়ী তিনি রোগী দেখতে এলেন। তাদের মধ্যে এক যুবককে তিনি দেখলেন এবং তার জন্য দুয়া করলেন। সে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠল। যুবকটি শায়খকে সালাম দেয়ার জন্য এলো। তাকে দেখে শায়খ হাসিমুখে নিকটে বসালেন। তার কাছে কিছু খরচের টাকা-পয়সা দিলেন এবং বলেন, আল্লাহ তায়ালা তোমাকে সুস্থ করেছেন। সুতরাং তুমি আল্লাহর কাছে ওয়াদা করো যে তুমি দ্রুত পরিবারের কাছে ফিরে যাবে। তোমার জন্য কখনও বৈধ হবে যে তোমার স্ত্রী ও চার কন্যাকে ধ্বংসের মুখে রেখে এখানে অবস্থান করবে? যুবকটি বলল, আমি তার হাতে চুমু দিলাম এবং বললাম, শায়খ, আমি আল্লাহর নিকট আপনার হাতে তওবা করছি।

আমি তার কাশফ দেখে বিস্মিত হলাম। বাস্তবেই আমি আমার পরিবারকে সহায়-সম্বলহীন রেখে এসেছিলাম।দামেশকের কেউ আামার পরিবার সম্পর্কে অবগত ছিলো না।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৬, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

এই কারামতগুলো লিখে আবু হাফস আল-বাযযার রহ. লিখেছেন,

و كرامات الشيخ رضي الله عنه  كثيرة جدا لا يليق بهذا المختصر أكثر من ذكر هذا القدر منها . ومن أظهر كراماته أنه ما سمع بأحد عاداه أو غض عنه إلا و أبتلي بعدة بلايا غالبها في دينه وهذا ظاهر مشهور لا يحتاج فيه إلي شرح صفته

শায়খ রহ. অনেক কারামত রয়েছে। এই সংক্ষিপ্ত বইয়ে সেগুলো উল্লেখ করা সঙ্গত নয়। তার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ করামত হলো যে কেউ শায়খের বিরোধীতা করেছে বা তার সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক রয়েছে, সে বিভিন্ন ধরনের বালা-মুসীবতে নিপতিত হয়েছে। বেশিরভাগ মুসীবত দীন সম্পর্কীয়। বিষয়গুলো স্পষ্ট ও প্রকাশিত। এগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা অনাবশ্যক।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৮, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কাশফ ও ইলহাম সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া রহ. এর অনেক কারামত রয়েছে। এ বিষয়ে তার অনেক বক্তব্যও আছে। এগুলোর কিছু কিছু ইবনে তাইমিয়া রহ. এর দৃষ্টিতে তাসাউফ বইয়ে উল্লেখ করেছি। দু:খজনক বিষয় হলো, আমাদের আজকের আলোচনার মূল বিষয় এখনও শুরু করা হয়নি। আজ এখানেই ইতি টানছি। পরবর্তী আলোচনায় গায়েব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করা হবে। 

------ ------

আক্বিদা

আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাকার ইবনে আবিল ইয রহ: হানাফী না কি হাশাবী?

ইজহারুল ইসলাম বৃহঃ, 21 নভে., 2024

[বর্তমানে  ইবনে আবিল ইযের  আকিদাতুত ত্বহাবীর  ব্যাখ্যাগ্রন্থটি ব্যাপকভাবে প্রচারের চেষ্টা করা হচ্ছে। যেমন, সালাফী আলেম আব্দুল্লাহ শাহেদ মাদানী এর বাংলা অনুবাদ করে অনলাইনে প্রচার করছেন। সুতরাং এই কিতাবের বাস্তবতা ও এর লেখক সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাগুলো সুস্পষ্ট করা আবশ্যক। আকিদাতুত ত্বহাবীর উপর দরসের নিয়ত ব্যক্ত করেছিলাম কিছু দিন আগে। উক্ত দরসের প্রয়োজনে আজকের আলোচনাটি লেখা। যারা উক্ত দরস দেখবেন, আশা করি বিষয়টি তাদের উপকারে আসবে।  ]

সৌদি আরবের কল্যাণে কাররামিয়াদের ভ্রান্ত দেহবাদী আকিদাগুলো সালাফী মতবাদের মোড়কে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। পেট্র-ডলারের সহায়তায় তারা এক্ষেত্রে অনেকটা অগ্রসর। সালাফীদের ভ্রান্ত আকিদা সম্পর্কে বেশ কিছু প্রবন্ধ লেখার সুযোগ হয়েছে আল-হামদুলিল্লাহ। আমাদের আইডিয়ার ওয়েবসাইটে লেখাগুলো পাবেন। সালাফী মতবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে থাকে। এর মধ্যে একটি বিশেষ কৌশল হল, বিভিন্ন ইমামের আকিদার কিতাব ব্যাখ্যার নামে নিজেদের ভ্রান্ত আকিদা ছড়িয়ে দেয়া। উদাহরণ হিসেবে ইমাম ত্বহাবীর আকিদাতুত ত্বহাবীর কথা বলা যায়। একটু খোজ নিলে দেখবেন, প্রায় প্রত্যেক সালাফী শায়খই আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখেছেন, কেউ অডিও বা ভিডিও লেকচার দিয়েছেন। অন্তত বিশ-পজিশজন বা এর চেয়ে বেশি সালাফী শায়খের ব্যাখ্যা পাবেন। একটি মৌলিক প্রশ্ন হল,  এসব সালাফী আলেমরা কি ইমাম ত্বহাবীর আকিদা পোষণ করেন? ধ্রুব সত্য হল, ইমাম ত্বহাবীর আকিদার সাথে এদের আকিদার দূরতম কোন সম্পর্ক নেই। ইমাম ত্বহাবী রহ. এর আকিদার ও এদের আকিদার মাঝে আসমান-জমিনের ফারাক। আরেকটি প্রশ্ন মনে উকি দেয়, এরা যেহেতু ইমাম ত্বাহাবীর আকিদা পোষণ করে না, তাহলে এর ব্যাখ্যা করে কেন? সহজ উত্তর হল, ইমাম ত্বহাবীর আকিদা প্রচারের ছদ্মাবরণে নিজেদের ভ্রান্ত আকিদা প্রচার। এদের যে কোন একটা ব্যাখ্য পড়লেই এই বাস্তবতা উপলব্ধি করবেন। 

সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে ইমাম ত্বহাবী রহ. এর আকিদাকে বিকৃত করার লক্ষ্যে লিখিত একটি বেনামী ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৩৪৯ হিজরীতে।  বে-নামী ব্যাখ্যা এজন্য বললাম, উক্ত ব্যাখ্যার উপর লেখকের নাম ছিল না। আর প্রশাকগণ নিশ্চিত ছিলেন না যে, ব্যাখ্যাগ্রন্থটি মূলত: কার। পরবর্তীতে তারা তত্ব-তালাশ করে উদ্ধার করেন, এটি ইবনে আবিল ইয আল-হানাফীর লেখা। বর্তমানে এটি ইবনে আবিল ইযের ব্যাখ্যা হিসেবে প্রচার করা হয়। আমাদের আলোচ্য বিষয় শিরোনাম থেকে কিছুটা স্পষ্ট। তবে দু’টি বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করার চেষ্টা করব। ১. ইবনে আবিল ইযের নামে প্রচারিত আকিদা কি আসলেই ইবনে আবিল ইযের লেখা?২. ইবনে আবিল ইযকে হানাফী হিসেবে প্রচার করা হয়। তিনি কি হানাফী ছিলেন না কি দেহবাদী আকিদায় বিশ্বাসী হাশাবী ছিলেন?

প্রচলিত আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যা কি ইবনে আবিল ইযের?

বিষয়টি বোঝার জন্য ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রকাশের ইতিহাসের দিকে ফিরে যেতে হবে। আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যাগ্রন্থটি ১৩৪৯ হিজরীতে মক্কায় সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়।

এই প্রকাশনায় কিতাবের উপর লেখকের কোন নাম ছিল না। বরং প্রকাশকরা লেখেন,

 راجعنا ما في أيدينا من كتب التراجم والفنون، فلم نجد ما يمكننا معه الجزم بنسبته لشخص بعينه، وإنا نثبت هنا أسماء شارحي هذه العقيدة الذين عدهم صاحب كشف الظنون وهم سبعة ……. ومنهم صدر الدين علي بن محمد بن أبي العز الأذرعي الدمشقي الحنفي المتوفى سنة 746هـ وهو الذي يترجح الظن أنه الشارح” আমাদের কাছে বিদ্যমান বিভিন্ন জীবনীগ্রন্থ ও রিজালের কিতাবে আমরা অনুসন্ধান চালিয়েছি। আমরা এমন কোন তথ্য পাইনি, যার আলোকে সুনিশ্চিতভাবে ব্যাখ্যাগ্রন্থটিকে সুনির্দিষ্ট কোন লেখকের দিকে সম্পৃক্ত করা সম্ভব। কাশফুজ জুনুন এর লেখকের বক্তব্য অনুযায়ী আমরা এখানে আকিদাত্ব ত্বহাবীর সমস্ত ব্যাখ্যাকারের নাম উল্লেখ করছি। তারা হলেন সাতজন…….। এদের মাঝে একজন ব্যাখ্যাকার হলেন, সদরুদ্দিন আলী ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবিল ইয হানাফী (মৃত:৭৪৬ হি:)। আমাদের বিশেষ ধারণা হল, সাতজন ব্যাখ্যাকারের মাঝে তিনি হলেন আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাকার। “

এখানে প্রবল ধারণা হিসেবে সদরুদ্দিন আলী ইবনে মুহাম্মাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যার মৃত্যু তারিখ হল, ৭৪৬ হিজরী। আর বর্তমানে প্রচারিত ব্যাখ্যাকার হলেন, আলী ইবনে আলী ইবনে আবিল ইয। যার মৃত্যু তারিখ হল, ৭৯২ হিজরী। এখানে প্রবল ধারণা হিসেবে যার কথা বলা হয়েছে, তিনি হলেন বর্তমানে প্রচারিত লেখকের পিতা। ছেলে আর পিতা কখনও এক হতে পারে না। উভয়ের মৃত্যু তারিখ থেকেও বিষয়টি স্পষ্ট। মোটকথা, ব্যাখ্যাগ্রন্থটি কার সেটা সুনিশ্চিতভাবে বলার মত কোন তথ্য তখনকার উলামায়ে কেরাম পাননি। পরবর্তীতে সৌদি আরবের শায়খগণ বিখ্যাত আলেম আহমাদ শাকেরকে এটি তাহকীক করার অনুরোধ করেন। শায়খ আহমাদ শাকের পরবর্তীতে এটি তাহকীক করে প্রকাশ করেন।

তিনি এর ভূমিকায় লেখেন, ” এ কিতাবের যে মাখতুতা বা হস্তলিপি আমি পেয়েছি, সেখানে মূল লেখকের নেই। সুতরাং কিতাবের লেখক আসলে কে সেটা জানা সম্ভব হয়নি। ” 

শায়খ আহমাদ শাকের তার ভূমিকায় কয়েকবার বলেছেন যে, তিনি এই কিতাবের নির্ভরযোগ্য কোন মাখতুতা বা হস্তলিপি পাননি।

তিনি তার সাধ্য অনুযায়ী এটি তাহকীক করার চেষ্টা করেছেন। শায়খ আহমাদ শাকের আশা ব্যক্ত করেছেন, তিনি যদি নির্ভরযোগ্য কোন হস্তলিপি পান, তাহলে পরবর্তীতে এটি সংশোধনের চেষ্টা করবেন।

শায়খ আহমাদ শাকের বলেন,

 ولكني لا أزال أرى هذه الطبعة مؤقتة أيضا، حتى يوفقنا الله إلى أصل محفوظ للشرح صحيح، يكون عمدة في التصحيح فنعيد طبعه

“আমি এখনও মনে করি, এই সংস্করণ অস্থায়ী। আল্লাহ তায়ালা যদি নির্ভরযোগ্য বিশুদ্ধ কোন হস্তলিপি মিলিয়ে দেন, তাহলে এটি সংশোধন করে নতুনভাবে প্রকাশ করার করব। শায়খ আহমাদ শাকের আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. [মৃত: ১২০৫ হি:] এর একটি বক্তব্য পান ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিনে। সেখানে মোর্তজা যাবিদি রহ. ব্যাখ্যাকারের নাম লিখেছেন, আলী ইবনে আলী ইবনে মুহাম্মাদ আল-গাজ্জী আল-হানাফী। মোর্তজা যাবিদি রহ. এর উদ্ধৃতিতে লেখকের সঠিক পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি।

শায়খ আহমাদ শাকের বলেন, মোর্তজা যাবিদি রহ. লেখকের নামের নিসবতে ভুল করেছেন। তিনি লিখেছেন, আলী ইবনে আলী আল-গাজ্জী, বাস্তবে হওয়ার কথা ছিল, আলী ইবনে আলী ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী। মোটকথা, শায়খ আহমাদ শাকেরের সামনে মোর্তজা যাবিদি রহ. এর উদ্ধৃতি ছিল, বেশ কয়েকটি মাখতুতা ছিল এরপরেও ব্যাখ্যাকার সম্পর্কে সুনিশ্চিতভাবে বলেননিন যে, অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে, উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের লেখক ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী। শায়খ আহমাদ শাকের মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্যের আলোকে তার ধারণা অনুযায়ী কিতাবে লেখকের নাম লিখেছেন, আলী ইবনে আলী ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী। পরবর্তীতে মাকতাবাতুল ইসলামী থেকে শায়খ আলবানীর তাহকীকে ব্যাখ্যাগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। সেখানে কিছু মাখতুতা বা হস্তলিপি এর চিত্র দেয়া হয়েছে। এসকল হস্তলিপিতে স্পষ্টভাবে লেখকের নাম লেখা হয়েছে, আলী ইবনে মুহাম্মাদ। যার মৃত্যু তারিখ, ৭৪৬ হি:। সুতরাং মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্য অনুযায়ী, লেখকের নাম হওয়ার কথা ছিল, আলী ইবনে আলী আল-গাজ্জী। মাকতাবাতুল ইসলামী এর মাখতুতা অনুযায়ী, লেখকের নাম আলী ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবিল ইয। সুতরাং একথা সুনিশ্চিতভাবে বলার অবকাশ নেই যে, উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের প্রকৃত লেখক কে। এরপরেও শায়খ আলবানী ও যুহাইর আশ-শাবীশ দাবী করেন, সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হল, উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের লেখক ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী।

শায়খ যুহাইর আশ-শাবীস নবম সংস্করণের ভূমিকায় ( পৃ.৯) লিখেছেন, 

وأما نسختنا فقد كان اسم مؤلفها مثبتا على الورقة الأولى منها، إلا أن بعض الأيدي قد لعبت فيه بالمحو والكتابة أكثر من مرة، وأخيرا أثبت عليه ما أثبته الشيخ أحمد شاكرঅর্থ: আমাদের মূল হস্তলিপিতে লেখকের নাম প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা ছিল। তবে অজ্ঞাত কেউ উক্ত নাম কয়েকবার ঘষা-মাজা করে নতুনভাবে লিখেছে। অবশেষে আমি শায়খ আহমাদ শাকেরের তথ্য অনুযায়ী লেখকের নাম উল্লেখ করেছি।মোটকথা, এই ব্যাখ্যাগ্রন্থের মূল হস্তলিপিতে লেখকের নাম উল্লেখ নেই। পরবর্তীতে বিভিন্ন ঘষা-মাজার মাধ্যমে অজ্ঞাত কেউ হস্তলিপিতে লেখকের নাম সংযুক্ত করেছে। ঘষা-মাজা করে নাম সংযুক্ত করার পরও বর্তমানে প্রচলিত লেখকের নাম উক্ত হস্তলিপিতে নেই। বরং প্রচলিত লেখকের পিতার নাম ও তার মৃত্যু তারিখ দেয়া রয়েছে।

 চূড়ান্ত কথা:

ইবনে আবিল ইয এধরণের ব্যাখ্যাগ্রন্থ লেখাটা অসম্ভব নয়। প্রবল ধারণা মতে হয়ত তিনি এটি লিখেছেন। কিন্তু ইবনে ইয এর লেখক হওয়ার ব্যাপারে অকাট্য কোন প্রমাণ কারও কাছে নেই, যার আলোকে নি:সন্দেহে বলা যাবে, এটি ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী লিখেছেন। ইবনে আবিল ইয আল-হানাফীর জীবনী থেকে একটা ধারণা সৃষ্টি হয়, হয়ত তিনি এটি লিখেছেন। আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. এর উদ্ধৃতি থেকে হয়ত ধারণাটি আরেকটু মজবুত হয়। কিন্তু এটা সুনিশ্চিত বা অকাট্য কোন প্রমাণ বলার সুযোগ নেই। উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের লেখক ইবনে আবিল ইয হলেও আমাদের কোন আপত্তি নেই। না হলেও এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই। কিতাবটি ছেলে লিখেছে না কি তার পিতা লিখেছে সেটাও মৌলিক কোন বিষয় নয়।

 আমাদের নিকট মূল বিবেচ্য বিষয় হল, ইবনে আবিল ইযকে হানাফী হিসেবে প্রচার করা হয়। সেই সাথে এটাও বোঝানো হয় যে, তিনি হানাফীদের আকিদার প্রতিনিধত্ব করেন। অন্যান্য হানাফীগণ তার বিরোধীতা করে মূলত: হানাফীদের মৌলিক আকিদার বিরোধিতা করে থাকে।

আমাদের সামনে মৌলিক কয়েকটি প্রশ্ন দেখা দিয়েছে,

১. ইবনে আবিল ইয বাস্তবেই কি হানাফী ছিলেন?

২. তিনি আদৌ কি হানাফী মাজহাবের সুপ্রতিষ্ঠিত আকিদার অনুসারী ছিলেন?৩. তার লেখা ব্যাখ্যাগ্রন্থ ইমাম ত্বহাবী বা হানাফী মাজহাবের মৌলিক আকিদার প্রতিনিধিত্ব করে কি?৪. ইবনে আবিল ইযের আকিদা হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমদের নিকট নির্ভরযোগ্য কি?

৫. ইবনে আবিল ইযকে হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণ নির্ভরযোগ্য আলেম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন কি?

৬. হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণ ইবনে আবিল ইযের আকিদার সাথে সহমত পোষণ করেন না কি তার প্রবল বিরোধীতা করেন?

৭. হানাফী মাজহাবের উলামায়ে কেরামের জীবনীর উপর বিভিন্ন গ্রন্থ লেখা হয়েছে। এসকল কিতাবে হানাফী আলেম হিসেবে তার জীবনী বা নির্ভরযোগ্য আলেম হিসেবে কোথাও  তস্বীকৃতি দেয়া হয়েছে কি?আমরা ইনশাআল্লাহ প্রত্যেকটি বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করব। 

ইবনে আবিল ইযের মাজহাব:

শরহে আকিদাতু ত্বহাবীর তাহকীক করেছেন, শায়খ শুয়াইব আরনাউত ও শায়খ আব্দুল্লাহ তুরকী। তারা উক্ত তাহকীকে ইবনে আবিল ইযের জীবনী আলোচনা করেছেন। তার জীবনী আলোচনা করতে গিয়ে তারা লিখেছেন, ইবনে আবিল ইযকে হানাফী মাজহাবের দিকে সম্পৃক্ত করা হয়। তবে বাস্তবে তিনি নিজের গর্দানকে তাকলীদের (মাজহাব অনুসরণ) বন্ধন থেকে মুক্ত করেন।  শায়খ শুয়াইব আরনাউত ও শায়খ আব্দুল্লাহ তুরকীর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ইবনে আবিল ইয একজন গাইরে মুকাল্লিদ, লা-মাজহাবী বা যাহেরী ছিল। 

ইবনে আবিল ইয পারিবারিকভাবে হানাফী ছিল। যেমন শায়খ আলবানী পারিবারিকভাবে হানাফী ছিল। কিন্তু কেউ হানাফী পরিবারে জন্মগ্রহণ করলে, কিংবা হানাফী মাদ্রাসায় পড়লে বা পড়ালে সে হানাফী হয়ে যায় না। আমাদের দেশের অধিকাংশ লা-মাজহাবী হানাফী পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও তারা গাইরে মুকাল্লিদ। একইভাবে বর্তমানে আহলে হাদীসদের অধিকাংশ শায়খ হানাফী মাজহাবের মাদ্রাসায় পড়া-লেখা করেছে, কিন্তু তারা হানাফী নয়। সুতরাং কারও হানাফী হওয়াটা তার পরিবার, পিতা-মাতা বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করে না। ইবনে আবিল ইয জন্মগতভাবে হানাফী হলেও বাস্তবে সে হানাফী নয়। বরং  ইবনে আবিল ইয একজন গাইরে মুকাল্লিদ বা লা-মাজহাবী।সুতরাং তাকে হানাফী হিসেবে প্রচার করে তাকে হানাফী মাজহাব বা আকিদার প্রতিনিধি হিসেবে প্রকাশ করা একটি মারাত্মক ভুল। 

যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেই যে, ইবনে আবিল ইয হানাফী ফিকহের অনুসারী ছিল, কারণ সে হানাফী মাজহাবের মাদ্রাসায় শিক্ষতা করেছে, তাহলে এটি কখনও বলা সম্ভব নয় যে, সে আকিদার দিক থেকেও হানাফী ছিলা। মু’তাজিলা সম্প্রদায়ের অনেকেই হানাফী মাজহাবের অনুসারী ছিল, কিন্তু তাদের কাউকে হানাফী বলা হয় না। একইভাবে কাররামিয়াদের অনেকেই হানাফী মাজহাব অনুসরণ করত। কিন্তু তাদেরকেও হানাফী বলা হয় না। ফিকহের দিক থেকে কেউ হানাফী ফিকহ অনুসরণ করলেই তাকে হানাফী হিসেবে পরিচয় দেয়া হয় না। কারণ হানাফী হিসেবে কারও পরিচিতি এটা প্রমাণ করে যে, সে আকিদা ও ফিকহ উভয় ক্ষেত্রে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অন্তর্ভূক্ত। কেউ যদি ফিকহের ক্ষেত্রে হানাফী মাজহাব অনুসরণ করে, কিন্তু আকিদার ক্ষেত্রে আহলে সু্ন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত আকিদা পোষণ করে তাকে হানাফী বলা হয় না। বরং আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত আকিদার দিকে তাকে সম্পৃক্ত করা হয়। কাররামিয়া মতবাদের অনুসারী কারও নামের শেষে হানাফী লাগিয়ে দিয়ে আকিদা ও ফিকহে তাকে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অন্তর্ভূক্ত করার অপচেষ্টা কেউ করলে সেটি অবশ্যই বাস্তবতা বিরোধী। সুতরাং ফিকহ ও আকিদা উভয় ক্ষেত্রে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত ইবনে আবিল ইযকে কীভাবে হানাফী হিসেবে পরিচয় দেয়া হয়? তার বাহ্যিক অবস্থা বিবেচনা করে হানাফী লিখলেও তাকে যদি কেউ হানাফী ফিকহ বা আকিদার প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন করে, তাহলে অবশ্যই আমরা বলব, প্রকৃতপক্ষে ইবনে আবিল ইয ফিকহ ও আকিদা কোন ক্ষেত্রেই হানাফী ছিল না। বরং সে কাররামিয়াদের অনুসারী হাশাবী বা দেহবাদী আকিদায় বিশ্বাসী ছিল। ইবনে আবিল ইযের যেসকল কিতাব তার দিকে সম্পৃক্ত করা হয়, তার প্রত্যেকটি সে হানাফী মাজহাবের বিরুদ্ধে লিখেছে। হানাফী মাজহাবের পক্ষে তার বিশেষ কোন খেদমত নেই।

ইবনে আবিল ইযের গাইরে মুকাল্লিদ হওয়ার আরেকটি প্রমাণ হল, তার একটি কিতাব বর্তমানের আহলে লা-মাজহাবীরা প্রচার করে থাকে। আহলে হাদীস আলেম আতাউল্লাহ হানীফ ইবনে আবিল ইযের “আল-ইত্তেবা” কিতাবটি তাহকীক করে প্রকাশ করেছে। পরবর্তীতে আবু সুহাইব আসিম ইবনে আব্দুল্লাহ  আল-কারইউতী এটি তাহকীক করেছে। আবু সুহাইব এই কিতাবের ভূমিকায় হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেম আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. ও আল্লামা যফর আহমাদ উসমানী রহ. এর বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছে এবং এসমস্ত বিখ্যাত আলেমদের বিরুদ্ধে ইবনে আবিল ইযের বক্তব্য উপস্থাপন করেছে। যেখানে ইবনে আবিল ইয সুনিদিষ্ট একটি মাজহাবের অনুসারীকে শিয়াদের সাথে তুলনা করেছে। নাউযুবিল্লাহ। ইবনে আবিল ইযের অবস্থা থেকে বাংলা ভাষার প্রসিদ্ধ একটি প্রবাদবাক্য মনে পড়ে গেল।  “মার চেয়ে মাসির দরদ বেশি” ।ইবনে আবিল ইযের প্রতি সালাফী ও আহলে হাদীসদের অতিশয় আগ্রহ এটিই প্রমাণ করে।  বর্তমানের সালাফীরা হানাফী মাজহাবের উলামায়ে কেরামকে তাদের আকিদার বিরোধী হওয়ার কারণে কাফের, বিদযাতী, জাহমী, মুয়াত্তিলা ইত্যাদি আখ্যায়িত করে। এ বিষয়ে অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে।  হানাফী মাজহাবের অধিকাংশ আলেম যাদের কাছে কাফের ও বিদয়াতী, তারাই ইবনে আবিল ইযের আকিদা প্রচার করছে। আবার উপমহাদেশের লা-মাজহাবীরা মাজহাবের অনুসারীদেরকে মুশরিক বলে বিশ্বাস করে, অথচ তারাই আবার ইবনে আবিল ইযের কিতাব প্রকাশ ও প্রচার করছে। ইবনে আবিল ইয আসলেই যদি হানাফী হত, তাহলে হানাফীদেরকে যারা কাফের-মুশরিক আখ্যা দিচ্ছে, তারা কেন তার কিতাব নিয়ে এত মাতামাতি করে?

ইবনে আবিল ইয সম্পর্কে হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণের বক্তব্য:

মোল্লা আলী কারী রহ. এর বক্তব্য:

মোল্লা আলী কারী রহ. শরহে ফিকহুল আকবারে আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যাকার সম্পর্কে লিখেছেন, 

 والحاصل ان الشارح يقول بعلو المكان مع نفي التشبيه وتبع فيه طائفة من أهل البدعة

মোটকথা, আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যাকার  তাশবীহমুক্ত অবস্থায় আল্লাহ তায়ালা স্থানগতভাবে উপরের দিকে রয়েছেন বলে বিশ্বাস করে। এক্ষেত্রে সে একদল বিদয়াতীর অনুসরণ করেছে। তিনি আরও বলেন,

 و من الغريب أنه إستدل على مذهبه الباطل برفع الأيدي في الدعاء إلى السماء

 অর্থ: আশ্চর্যের বিষয় হল, সে তার ভ্রান্ত মতবাদ প্রমাণ করতে গিয়ে দুয়ার সময় হাত উপরের দিকে উঠানোর দলিল দিয়েছে। (শরহুল ফিকহিল আকবার, পৃ.১৭২. আল-ইলিময়া)মোল্লা আলী কারী রহ. এর বক্তব্য থেকে দু’টি বিষয় স্পষ্ট। তিনি ইবনে আবিল ইযকে বিদয়াতীদের অনুসারী বলেছেন। এবং তার মতবাদকে বাতিল বা ভ্রান্ত মতবাদ আখ্যায়িত করেছেন। 

আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্য:

আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিনে ইবনে আবিল ইয সম্পর্কে লিখেছেন,

“ولما تأملته حق التأمل؛ وجدته كلامًا مخالفًا لأصول مذهب إمامه!! وهو في الحقيقة كالرد على أئمة السنة، كأنه تكلم بلسان المخالفين، وجازف وتجاوز عن الحدود، حتى شبه قول أهل السنة بقول النصارى! فليتنبه لذلك”.

অর্থ: আমি  তার (ইবনে আবিল ইযের) বক্তব্য সম্পর্কে পরিপূর্ণ চিন্তা-ভাবনা করে দেখেছি, তার বক্তব্য তার ইমামের মাজহাবের মৌলিক নীতিমালার সম্পূর্ণ বিরোধী। বরং প্রকৃতপক্ষে তার বক্তব্য যেন আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের ইমামগণের বক্তব্য খন্ডনে লিখিত।  তার বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয়, সে যেন আহলে সুন্নতের ইমামগণের সাথে প্রতিপক্ষ হিসেবে কথা বলেছে। সে মারাত্মক বিকৃতির শিকার হয়েছে এবং সীমা অতিক্রম করেছে। এমনকি সে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের ইমামগণের বক্তব্যকে খ্রিষ্টানদের বক্তব্যের সাথে তুলনা করেছে। সুতরাং এ বিষয় সতর্ক থেক। [ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিন, খ.২, পৃ.১৪৬]

আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্য থেকে যেসকল বিষয় স্পষ্ট:

১. ইবনে আবিল ইয হানাফী মাজহাবের মৌলিক নীতিমালা অনুসরণ করত না।

২. তার লেখনী মূলত: হানাফী মাজহাব ও আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের বক্তব্য খন্ডনের উদ্দেশ্যে লিখিত।৩. হানাফী মাজহাব ও আহলে সুন্নতের উলামায়ে কেরামের সাথে যেন সে প্রতিপক্ষ হিসেবে কথা বলেছে।

৪.সে মারাত্মক প্রগলভতার  শিকার হয়ে সীমা অতিক্রম করেছে। 

৫. আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের উলামায়ে কেরামের বক্তব্যকে খ্রিষ্টানদের বক্তব্যের সাথে তুলনা করেছে।

 ৬. আল্লামা যাবিদি রহ. তার এসব বক্তব্যের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেছেন। 

আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. এর বক্তব্য:

হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত ইমাম আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাকার সম্পর্কে বলেন,

وطبع شرح لمجهول ينسب إلى المذهب الحنفي زورا ينادي صنع يده بأنه جاهل بهذا الفن وأنه حشوي مختل العيار

“আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যা হিসেবে একজন অজ্ঞাত ব্যক্তির একটি ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। যাকে বানোয়াটী করে হানাফী মাজহাবের দিকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এ লোকের লেখনী দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করে যে  সে আকিদা সম্পর্কে অজ্ঞ। সে একজন হাশাবী বা দেহবাদী এবং মারাত্মক বিচ্যুতির শিকার। “[আল-হাবী ফি সিরাতিল ইমামিত ত্বহাবী, পৃ. ৩৮]আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. এর বক্তব্য থেকে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট। প্রথমত: ইবনে আবিল ইযকে হানাফী মাজহাবের দিকে সম্পৃক্ত করা একটি বানোয়াট বা মিথ্যা। বাস্তবে সে হানাফী ছিল না। দ্বিতীয়ত: ইবনে আবিল ইয আকিদা বিষয়ে জাহেল বা অজ্ঞ ছিল এবং সে একজন মুজাসসিমা বা দেহবাদী আকিদার অনুসারী হাশাবী ছিল। আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. এর বক্তব্য অনুযায়ী আমরা ইবনে আবিল ইযকে হানাফী না বলে দেহবাদী আকিদার অনুসারী হাশাবী বলতে পারি। 

ইবনে আবিল ইযের সম-সাময়িক আলেমগণের বিরোধীতা:ইবনে আবিল ইযের ভ্রান্ত কিছু বক্তব্য প্রকাশিত হওয়ার তখনকার বিখ্যাত আলেমগণ তার প্রতিবাদ করেন। বিশেষভাবে অন্যান্য তিন মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণের সাথে হানাফী মাজহাবের আলেমগণও তার প্রতিবাদ করেন।

আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহ. তার ‘ইম্বাউল গুমর বি আবনায়িল উমর’ কিতাবে লিখেছেন,

وأن العلماء بالديار المصرية خصوصا أهل مذهبة من الحنفية أنكرواذلك عليه

অর্থ: মিশরের আলেমগণ বিশেষভাবে তার মাজহাব তথা হানাফী মাজহাবের উলামায়ে কেরাম তার বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন। [ইমবাউল গুমর, খ.২, পৃ.৯৬]

যেসব উলামায়ে কেরাম ইবনে আবিল ইযের বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন, এদের মাঝে বিখ্যাত কিছু আলেমের নাম উল্লেখ করেছেন ইবনে হাজার আসকালানী রহ.। যেমন, যাইনুদ্দীন ইবনে রজব রহ, তকীউদ্দীন ইবনে মুফলিহ রহ. শরফুদ্দীন ইবনে গাজ্জী রহ. ।

বর্তমানে সালাফীরা ইবনে আবিল ইযের আরেকটি কিতাব প্রকাশ করেছে। কিতাবের নাম হল, আত-তাম্বীহ আলা মুশকিলাতিল হিদায়াহ। সালাফী আলেমরা ইবনে আবিল ইযের রচনা হিসেবে এটি প্রকাশ করেছে। যদিও কিতাবটি ইবনে আবিল ইযের নাকি তার দাদার এটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সালাফীদের বক্তব্য অনুযায়ী কিতাবটি যদি ইবনে আবিল ইযের হয়, তাহলে তার সম্পর্কে হানাফী মাজহাবের আরও কিছু উলামায়ে কেরামের বক্তব্য শুনুন। 

ইমাম সাখাবী রহ. তার আজ-জাওউল লামে কিতাবে লিখেছেন, হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত ইমাম কাসেম ইবনে কুতলুবুগা ইবনে হেদায়া কিতাবের উপর ইবনুল ইযের অভিযোগ খন্ডন করে কিতাব লিখেছেন। “صنّف “أجوبةً عن اعتراضات ابن العزّ على الهداية”[আজ-জাওউল লামে, খ.৬, পৃ.১৮৭]

সালাফীরা ইবনে আবিল ইযের উক্ত কিতাবকে হেদায়ার ব্যাখ্যা হিসেবে প্রচারের চেষ্টা করলেও এটি মূলত: হেদায়া কিতাবের উপর তার অভিযোগ সংকলন। একারণে আল্লামা কাসেম ইবনে কুতলুবুগা তার অভিযোগ খন্ডন করেছেন। একইভাবে আল-বাহরুর রায়েকে রয়েছে ফাতহুল কাদীরে আল্লামা ইবনুল হুমাম ইবনুল ইযের বক্তব্য খন্ডন করেছেন।

 وَقَدْ أَطَالَ فِي فَتْحِ الْقَدِيرِ فِي بَيَانِهِ إطَالَةً حَسَنَةً وَتَعَرَّضَ لِلرَّدِّ عَلَى ابْنِ الْعِزِّ، وَلَسْنَا بِصَدَدِ ذَلِكَ

[আল-বাহরুর রায়েক, বাবুল ইয়ামীন ফিল আকলি ওয়াশ শুরব]

সালাফীদের বক্তব্য অনুযায়ী আত-তাম্বীহ আলা শরহিল হেদায়া কিতাবটি যদি আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাকার ইবনে আবিল ইযের হয়, তাহলে তার বক্তব্য আল্লামা হাসকাফী ও আল্লামা ইবনে আবিদীন খন্ডন করেছেন। তার বক্তব্যকে গরীব (আশ্চর্যজনক) আখ্যা দিয়েছেন। বিস্তারিত,

 “قال (ابن العز!): فحينئذ ينقض الوضوء، وهو فرع غريب وتخريج ظاهر.قال المصنف: ولظهوره عوّلنا عليه.قلت: قال شيخنا الرملي حفظه الله تعالى: كيف يعول عليه وهو مع غرابته لا يشهد له رواية ولا دراية، أما الاولى فظاهر إذا لم يرو عن أحد ممن يعتمد عليه، وأما الثانية فلعدم تسليم المقدمة الاولى ويشهد لبطلانها مسألة الجدي إذا غذي بلبن الخنزير فقد عللوا حل أكله بصيرورته مستهلكا لا يبقى له أثر، فكذلك نقول في عرق مدمن الخمر، ويكفينا في ضعفه غرابته”.[রদ্দুল মুহতার, খ.৬, পৃ.১৪৬-১৪৭]

আকিদার ক্ষেত্রে ইবনে আবিল ইযের বিচ্যুতি সুস্পষ্ট। অধিকাংশ বিষয়ে সে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত আকিদা পোষণ করে। এবং কাররামিয়া ও মুজাসসিমাদের ভ্রান্ত বক্তব্য প্রচার করেছে। আকিদাতুত ত্বহাবীর সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা ভিডিও আকারে প্রকাশের নিয়ত রয়েছে। আমাদের আলোচনায় ইবনে আবিল ইযের ভ্রান্ত মতবাদগুলি বিস্তারিত উল্লেখ করা হবে ইনশাআল্লাহ। এখানে সংক্ষেপে দু’একটি বিষয় উল্লেখ করা মুনাসিব মনে করছি। এসকল বিষয়ের কয়েকটি কুফুরী পর্যায়ের। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করেন। 

১. কিছু সৃষ্টি কাদীম বা অবিনশ্বর। অনাদী থেকেই বিদ্যমান। এটি তাসালসুলুল হাওয়াদিস নামে পরিচিত। [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.১২৯, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]

২. আল্লাহ তায়ালার হদ বা সীমা রয়েছে।  [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.২১৯, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]

৩. আল্লাহর সত্তার মাঝে নশ্বর বিষয় সৃষ্টি হয়।  [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.১৭৭, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]

৪. আল্লাহর বক্তব্যের অক্ষর ও শব্দ রয়েছে।  [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.১৬৯, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]

৫. আল্লাহ তায়ালা স্থানগতভাবে উপরের দিকে রয়েছেন। অর্থাৎ আল্লাহর দিক রয়েছে। 

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে দেহবাদী আকিদার ভ্রান্তি থেকে হেফাজত করুন। আমীন।

------ ------

আক্বিদা

আল্লাহ তায়ালার এককত্বের প্রমাণ

ইজহারুল ইসলাম বৃহঃ, 21 নভে., 2024

ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের মাঝে সর্বপ্রধান বিষয় হল, আল্লাহর তাওহীদ তথা একত্বের উপর ঈমান আনয়ন করা। এই বিশ্বাস করা যে, সৃষ্টা হিসেবে তিনি একক, গুণাবলীর বিবেচনায় তিনি একক এবং উপাসনার যোগ্য একমাত্র তিনিই। পবিত্র কুরআন ও রাসূল (সঃ) এর সমস্ত হাদীস তাওহীদ তথা আল্লাহর এককত্বের উপর ভিত্তি করেই আবর্তিত। কোন বিষয়ে আল্লাহর সমকক্ষ বা অংশীদার নেই, এটিই এ বিশ্বাসের মূলমন্ত্র। পবিত্র কুরআনের ১১২ নং সূরায় এ বিষয়টি সুষ্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষিত হয়েছে। সে প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর অস্তিত্ব অনুভব করে এবং আল্লাহর এককত্বের স্বাক্ষর প্রদান করে।

আমরা এখানে আল্লাহর এককত্বের উপর পাঁচটি যুক্তি উপস্থাপন করব।

অকহ্যাম রেজর এর তত্ত্ব

কুরআন স্পষ্টভাষায় জিজ্ঞাসা করেছে, এই মহাবিশ্ব কি এমনিতেই সৃষ্টি হয়েছে? এর উত্তর খুবই সহজ ও স্পষ্ট। কেননা ভৌত পদার্থবিদ্যা এবং সকল দর্শন এবিষয়ে একমত যে, যে বস্তু অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এসেছে, তার অস্তিত্বের পিছে একটি কজ বা কারণ রয়েছে। আর মহাবিশ্ব যেহেতু অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এসেছে এজন্য এর পিছে একটি কারণ বা কজ রয়েছে। মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পিছে একটি সামগ্রিক কজ বা কারণ থাকাটাই যুক্তিযুক্ত। অসীম সংখ্যক কারণ থাকাটা অসম্ভব। কেননা বাস্তবে কখনও অসীম কোন কিছু থেকে আমরা কোন ফলাফল লাভ করি না।

উদাহরণ হিসেবে নীচের দু’টি বিষয় লক্ষ্য করুণ-

১. কোন কক্ষে যদি অসীম সংখ্যক মানুষ থাকে এবং সেখান থেকে যদি আমি দু’জনকে বাদ দেই, তাহলে কতজন থাকবে? আপনি উত্তর দিবেন, অসীম বিয়োগ দুই। অর্থাৎ অসীম থেকে দু’জনকে বাদ দিলে যা থাকে। এর দ্বারা বাস্তবে কোন অর্থ বোঝায় কি? অসীম থেকে যদি দুজনকে বাদ দেয়া হলেও কক্ষে অসীম সংখ্যক মানুষই থেকে যাবে। বাস্তবে এটি বিশেষ কোন অর্থ প্রদান করে না। আপনাকে যদি কক্ষের অসীম সংখ্যক লোক গণনা করতে বলা হয়, আপনার পক্ষে তা গণনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু লোকসংখ্যা যদি অসীম থেকে সামান্য কমিয়ে গণনা করতে বলা হয়, তবুও আপনার পক্ষে তা গণনা করা সম্ভব নয়। এর অর্থ হল, বাস্তব জীবনে অসীম সংখ্যা থেকে বিশেষ অর্থ বোঝা সম্ভব নয়। 

২. মনে করুন, আমি একজন সৈনিক। আমি একটা শত্রুকে গুলি করতে চাই। আমার গুলি করার জন্য আমার পেছনের সৈনিকের অনুমতি নেয়া প্রয়োজন। আমার পিছের সৈনিকের জন্য আবার তার পেছনের সৈনিকের অনুমতি প্রয়োজন। এভাবে এ ধারা যদি চলতে থাকে এবং আমার গুলি করার জন্য অসীম সংখ্যক সৈনিকের অনুমতির প্রয়োজন হয়, তবে আমি কি আদৌ শত্রুকে গুলি করতে পারব? উত্তর খুবই সহজ ও স্বাভাবিক। একইভাবে আমি মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পিছে যদি অসীম সংখ্যক কারণ ধরে নেই, তবে আদৌ মহাবিশ্বের অস্তিত্ব সম্ভব হত না। এবং কখনও এটি অস্তিত্বে আসত না। সুতরাং মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পিছে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বাধীন ও একক কারণ থাকাটাই যুক্তিসঙ্গত।

আপনি এ যুক্তি দেখাতে পারেন যে, উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্য তথা স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বাধীন একাধিক কারণ একই সাথে ক্রিয়াশীল হলে সমস্যা কোথায়? 

আমি বলব, আপনার এ যুক্তিটা খুবই দুর্বল প্রকৃতির। চতুর্দশ শতাব্দীর দার্শনিক অকহ্যাম রেজর এর তত্ত্বের মাধ্যমে আপনার এ যুক্তির অসারতা প্রমাণিত হয়। অকহ্যাম রেজরের নীতি হল, প্রয়োজন ছাড়া বহু সংখ্যার ব্যবহার অনুচিৎ। আরেকটু সহজ করে বললে এভাবে বলা যায়,  সবচেয়ে সরল ও সর্বাধিক অর্থবহ ব্যাখ্যা হল, সর্বোত্তম ব্যাখ্যা।

অতএব, কোন প্রমাণ ছাড়া কিংবা প্রয়োজন ছাড়া আমরা এটা বলতে পারি না যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির পিছে অনেকগুলো কারণ ক্রিয়াশীল। সুতরাং এক্ষেত্রে আমাদেরকে সবচেয়ে অর্থবহ ও সরল কারণ তথা মহাবিশ্ব সৃষ্টির একক কারণকেই গ্রহণ করতে হবে। কেননা এক্ষেত্রে আমাদেরকে কাছে কোন প্রমাণ নেই যে আমরা বলতে পারি, মহাবিশ্বের সৃষ্টি মূলতঃ দুটি, তিনটি, কিংবা কয়েক হাজার কারণের কম্বিনেশন বা সমন্বয়। একাধিক কারণ গ্রহণের দ্বারা একটি স্বাধীন, স্বয়ংসম্পূর্ণ কারণে অতিরিক্ত কোন মাত্রা যোগ হয় না।

যেমন, যখন বলা হল, মহাবিশ্ব একটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কারণের দ্বারা সৃষ্ট, এ কথা দ্বারা যে অর্থ স্পষ্ট হয়েছে, যদি বলা হয়, মহাবিশ্ব দু’টি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কারণের দ্বারা সৃষ্ট, এ কথার দ্বারা অতিরিক্ত কোন অর্থ প্রকাশ পায় না। কেননা আমি যখন বলছি, কারণটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী তখন অন্য কোন সর্বময় ক্ষমতার প্রয়োজন নেই। কারণটি যদি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী না হত, তবে সাহায্যকারী হিসেবে অন্য কোন কারণের প্রয়োজন পড়ত। এক্ষেত্রে কোন কারণই তখন স্বাধীন বা স্বয়ংসম্পূর্ণ কারণ থাকবে না।

সুতরাং মহাবিশ্ব সৃষ্টির পিছে আমাদের মূলতঃ একটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কারণের প্রয়োজন ছিল এবং এটুকুই যথেষ্ট কেননা কারণটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।

২. যৌক্তিক প্রমাণ

যুক্তির দাবি হল, মহাবিশ্ব সৃষ্টি যদি অনেক প্রভূ থাকত, তবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে মহাবিশ্ব ধ্বংস হয়েছে। এবং আমরা মহাবিশ্বে যে সুষম শৃঙ্খলা ও নিয়মতান্ত্রিকতার সর্বোচ্চ সমাবেশ লক্ষ্য করে থাকি, অনেক প্রভূ থাকলে তা পরিলক্ষিত হত না।

আপনি যুক্তি দেখাতে পারেন, আপনার গাড়িটি তৈরি করে অনেক মানুষ। যেমন, কেউ গাড়ীর বডি তৈরি করে, কেউ ইঞ্জিন আবার কেউ চাকা। কিন্তু পূর্ণ গাড়িটি তৈরি হলে সেটি একটি সুন্দর ও সুষম গাড়ি হয়ে থাকে। অতএব, একটি সৃষ্ট বস্তুর অনেক স্রষ্টা থাকলেও সেটি ভারসাম্যপূর্ণ হতে পারে। 

আপনার এ প্রশ্নের উত্তর হল, মহাবিশ্ব সৃষ্টির পিছে আমরা যে কারণটি উল্লেখ করেছি সেটি হল, এমন একজন প্রভূ যিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং ইচ্ছার ক্ষেত্রে এককভাবে স্বাধীন। কেননা প্রভূ তো তিনিই হবেন, যার অসীম প্রয়োগিক ইচ্ছা রয়েছে। যদি অনেক প্রভূ থাকত, তবে প্রত্যেকের ইচ্ছা প্রয়োগের প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হত, আর এটিই মহাবিশ্বে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণ হতো।

আপনি যুক্তি দেখাতে পারেন, এ সম্ভাবনা রয়েছে যে, অনেকগুলো প্রভূ একটি বিষয়ে একমত পোষণ করতে পারে। অথবা এক একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে তাদের পৃথক পৃথক ক্ষমতা থাকবে। এক্ষেত্রে আমরা বলব, এ ধরণের প্রভূর ইচ্ছা অসীম ও স্বাধীন নয়। ফলে এরা প্রভূ হওয়ার যোগ্য নয়। সার কথা হল, যদি দু’জন স্রষ্টা থাকে, এবং তারা কোন বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে, যেমন একজন ক নামক ব্যক্তিকে স্থির রাখতে চাচ্ছে, আরেকজন তাকে গতিশীল করতে চাচ্ছে। অথবা একজন প্রভূ খ কে জীবন্ত প্রাণি বানাতে চাচ্ছে, আরেকজন চাচ্ছে যে, এটি জড়পদার্থ হিসেবে অবস্থান করবে।

যুক্তির আলোকে যদি বিশ্লেষণ করা হয়, তবে এখানে তিনটি অবস্থার কোন একটি ঘটতে বাধ্য-

১. উভয় প্রভূর ইচ্ছা বহাল রাখা হবে এবং তা বাস্তবায়ন করা হবে।

২. শুধু তাদের একজনের ইচ্ছা বহাল রাখা হবে।

৩. তাদের কারও ইচ্ছায় বাস্তবায়ন করা হবে না।প্রথমটি সম্ভব নয়।

কেননা এক্ষেত্রে দু’টি বিপরীত বিষয় একই সাথে অস্তিত্ব লাভ করা আবশ্যক হবে। যা অসম্ভব। অর্থাৎ একই সাথে একটি বস্তু জীবিত ও মৃত হতে পারে না। তৃতীয় বক্তব্যও বাতিল হয়ে যাবে। কেননা এর দ্বারা এটা আবশ্যক হয় যে, একটি বস্তু গতিশীলও না, আবার স্থিরও না। একইভাবে একটি বস্তু জীবিতও না, আবার মৃত না। আর এটি অসম্ভব। সাথে সাথে তাদের কারও ইচ্ছায় যদি বাস্তবায়ন করা না হয়, তখন তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, তাদের কেউ-ই নিজ ইচ্ছা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম নয়। ফলে প্রত্যেকেই প্রভূ হওয়ার যোগ্যতা হারাবে।

দ্বিতীয় বক্তব্য অনুযায়ী, যদি দু’জনের মধ্য থেকে একজনের ইচ্ছা বাস্তবায়ন করা হয়, এবং অপরজনের ইচ্ছা পরিত্যাগ করা হয়, তবে তিনিই হবেন একক প্রভূ। যার ইচ্ছা পরিত্যাগ করা হয়েছে, সে প্রভূ হওয়ার যোগ্য থাকবে না। উপর্যুক্ত বক্তব্য দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, এই ভারসাম্যপূর্ণ মহাবিশ্বের একজন মাত্র প্রভূ থাকা সম্ভব, যিনি অসীম ইচ্ছার অধিকারী এবং একক ক্ষমতার অধিকারী।

৩. ধারণাগত বৈচিত্র

আমরা কিভাবে দু’টি জিনিসকে পরস্পর থেকে পৃথক করে থাকি? দু’জন ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে আমরা তাদের মধ্যে পার্থক্য করি কীভাবে। এর উত্তর হল, আমরা এটা করে থাকি, কনসেপ্চুয়াল ডিফারেনসিয়েশন বা ধারণাগত বৈচিত্রের মাধ্যমে। এই ধারণাগুলো হল, স্থান, পারম্পরিক দূরত্ব, গঠন ও আকার-আকৃতিগত তারতম্য।

আমরা যে কোন দু’টি বস্তুর মাঝে পার্থক্য করতে পারি, তাদের পারস্পরিক দূরত্ব, বর্ণ ও আকার-আকৃতিগত বৈচিত্রের মাধ্যমে। দু’টি বিষয়ের মধ্যে যখন উপরোক্ত বিষয়গুলো না পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে কি আপনি উক্ত বস্তু দু’টির মাঝে কোন পার্থক্য করতে সক্ষম হবেন? আপনি পারবেন না। এবিষয়টি শুধু দু’য়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং অসংখ্য বস্তুর ক্ষেত্রে পার্থক্য নির্ণয় করতে হলে, উপরোক্ত বিষয়গুলো থাকা আবশ্যক। 

প্রাসঙ্গিকভাবে বলে নেয়া আবশ্যক যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি মহাবিশ্ব থেকে বহির্গত হওয়া আবশ্যক। কেননা সৃষ্টির কারণ যদি মহাবিশ্বের ভিতরগত কিংবা মহাবিশ্বেরই কোন অংশ হয়, তখন এর অর্থ হয় যে, মহাবিশ্ব নিজেই নিজের স্রষ্টা। আর এটি অসম্ভব। মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ যেহেতু বহির্গত, আপনি সহজেই অনুমান করতে পারবেন যে, আপনি মহাবিশ্বের বহির্গত বিষয়ের মধ্যে অবস্থান, আকার-আকৃতি ও বর্ণগত পার্থক্য করতে পারবেন না। কেননা এ বিষয়গুলো কেবল মহাবিশ্বের অভ্যন্তরে বিশেষ অর্থ প্রদান করে, এর বাইরে নয়। কেননা উপর্যুক্ত বিষয় তথা দূরত্ব, আকার-আকৃতি বা বর্ণ প্রত্যেকটি সৃষ্ট। মহাবিশ্বের বাইরে সৃষ্ট কোন বস্তু নেই। মহাবিশ্বের বাইরে উপর্যুক্ত বিষয়ের অনুপস্থিতির কারণে সৃষ্টির পিছে ক্রিয়াশীল দু’টি কারণের মধ্যে পার্থক্য করাও সম্ভব নয়। এজন্য সৃষ্টির পিছে দু’টি বা অসংখ্য কারণের কথা বলাটাও ভিত্তিহীন, অযৌক্তি ও ধারণাপ্রসূত একটি বক্তব্য মাত্র। 

৪. অনন্যতা

মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি ইউনিক বা অনন্য হওয়া আবশ্যক। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “তাঁর কোন সমকক্ষ নেই”। মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি যদি অনন্য না হয়, তবে এর অর্থ হবে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ ও মহাবিশ্বের মাঝে একটি সিমিলারিটি বা সাদৃশ্য রয়েছে। কেননা এর দ্বারা এটি প্রমাণিত হয় যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি এর মাঝে রয়েছে। যার অর্থ এই দাঁড়াল যে, মহাবিশ্ব নিজেই নিজের স্রষ্টা। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি মহাবিশ্বের সাদৃশ্যপূর্ণ হতে পারবে না কেন? এর উত্তরটি খুবই সহজ। আমরা জানি মহাবিশ্ব অসংখ্য বস্তুর সমষ্টি। সুতরাং মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি অবশ্যই ইম্যাটেরিয়াল বা বস্তুজগতের ঊর্ধ্বে হতে হবে। নতুবা মহাবিশ্ব নিজেই নিজের স্রষ্টা হওয়া আবশ্যক হবে। সুতরাং বস্তু সৃষ্টির কারণটিও যদি বস্তুর মতো হয়, তবে বস্তু নিজেই নিজের স্রষ্টা হওয়া আবশ্যক, যা অসম্ভব। সুতরাং উপসংহারে আপনাকে অবশ্যই বলতে হবে যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি অবশ্যই ইম্যাটেরিয়াল ও ইউনিক হতে হবে। আমাদের এ বক্তব্যটি স্রষ্টার এককত্বের প্রমাণ হয় কিভাবে? আমরা বলব, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ যদি একাধিক হয়, তবে তার কোনটিই ইউনিক বা অনন্য হবে না। ফলে স্রষ্টা একজন হওয়াটাই নির্দিষ্ট।

৫. ঐশীবাণী

স্রষ্টার এককত্ব প্রমাণের সবচেয়ে সহজ উপায় হল, আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ঐশীবাণীর শরণাপন্ন হওয়া। এক্ষেত্রে যুক্তি হল, কোন বাণীর ব্যাপারে যদি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয় যে, এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত এবং এটি মানব রচিত নয়, তখন এ গ্রন্থের বক্তব্যের ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকে না। সুতরাং আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ঐশী গ্রন্থে আল্লাহ তায়ালা নিজের সম্পর্কে যে তথ্য প্রদান করবেন সেটি নিশ্চিতভাবে সত্য বলে বিবেচিত হবে। 

কেউ যদি আল্লাহ সম্পর্কে অজ্ঞ হয় তবে সে কিভাবে আল্লাহ সম্পর্কে বা তার প্রেরিত কিতাব সম্পর্কে ধারণা অর্জন করবে?

এর দু’টি পদ্ধতি রয়েছে-

১. ইন্টারন্যাল

২. এক্সটারন্যাল

আভ্যন্তরীণভাবে আল্লাহ তায়ালার পরিচয় পাওয়ার অর্থ হল, আপনি আত্মপরীক্ষা বা আত্মদর্শনের মাধ্যমে আল্লাহ সম্পর্কে অবগত হওয়ার চেষ্টা করবেন। অর্থাৎ নিজের আভ্যন্তরীণ শক্তি ব্যবহার করে আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা। আজব ব্যাপার হল, আল্লাহ সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন মানুষের নিজস্ব শক্তির দ্বারা সম্ভব নয়।

এর কিছু মৌলিক কারণ হল,

১. মানুষ সৃষ্টিগতভাবে বৈচিত্রময়। ব্যক্তি বৈচিত্রের এধারাটি মূলতঃ মানুষের মানসিক ভিন্নতারই বহিপ্রকাশ। সাইকোলজিক্যাল ভিন্নতার প্রধান কারণ হল, ডি.এন.এ এর ভিন্নতা, বাস্তব অভিজ্ঞতা, সামাজিক পূর্বসূত্র, বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানার্জনের ক্ষমতা, লিঙ্গের বৈষম্য ইত্যাদি নিয়ামক দ্বারা প্রভাবিত। আত্মদর্শনের মাধ্যমে স্রষ্টা সম্পর্কে ধারণা পেতে এবিষয়গুলো আপনাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে। সুতরাং আপনার আত্মপরীক্ষার মাধ্যমে যে ফলাফল পাওয়া যাবে সেটি অন্যদের থেকে ভিন্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। আপনি নিজেও এই বাস্তবতা উপলব্ধি করবেন যে, উপর্যুক্ত বিষয়ের উপস্থিতিতে আপনি একাকী যদি স্রষ্টা সম্পর্কে ধারণা পেতে চান তবে তা সত্য থেকে অনেক বিচ্যুত হতে পারে। এটি একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ বছর আগে পৃথিবীতে প্রায় ৩৭০০ হাজার দেবতার ধারণা মানুষের মনে জেঁকে বসেছিল।

২. দ্বিতীয় কারণ হল, বাস্তবতার বিবেচনায় মানুষ খুবই সীমাবদ্ধ। এজন্য মানুষ যদি নিজের পক্ষ থেকে স্রষ্টা সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করতে চায়, তবে তা অধিকাংশ সময় ভ্রান্তির কারণ হয়। দার্শনিকগণ ¯্রষ্টার অস্তিত্বের ব্যাপারে কিছু যুক্তিসঙ্গত দার্শনিক তত্ত্ব উপস্থাপন করে থাকেন। তবে তারা স্বতঃসিদ্ধ ও বাস্তব কোন তথ্য দিতে অক্ষম। প্রকৃতপক্ষে যদি আপনি স্রষ্টা সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা অর্জন করতে চান, তবে তা হবে ইঁদুরের পক্ষে হাতির শক্তিমত্তা সম্পর্কে ধারণা অর্জনের মতো হাস্যকর। এজন্য শুধু যুক্তি বা ধারণার উপর ভিত্তি করে স্রষ্টা সম্পর্কে কিছু বলা তার সম্পর্কে মিথ্যাচারের নামান্তর। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, “তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে যা জান না, তা বলো কেন?” সুতরাং আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে আমরা যদি জ্ঞান অর্জন করতে চাই তবে তা অবশ্যই এক্সটারন্যাল বা বহির্গত কোন মাধ্যমে হতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা ঐশীবাণীর মাধ্যমে আমাদেরকে যা জানিয়েছেন, সেটিই হবে বিশুদ্ধ জ্ঞান।

আর পবিত্র কুরআন থেকে আমরা একথা সুনিশ্চিতভাবে জানি যে, আল্লাহ তায়ালা হলেন এক ও অদ্বিতীয়। তার সমকক্ষ কেউ নেই। সুতরাং তার এককত্বের ব্যাপারে আর কোন সন্দেহ থাকে না।

------ ------