শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা হাফিজাহুল্লাহ
একজন প্রাথমিক স্তরের তালিবুল ইলমও অবগত রয়েছে, শরিয়তের অনেক মাসআলায় পরস্পর বিরোধী একাধিক হাদিস থাকে। কখনও একই বিষয়ে দু’য়ের অধিক অর্থের সম্ভাবনা থাকে। এই বিরোধ নিরসনে উলামায়ে কেরাম নীচের পদ্ধতিগুলো আলোচনা করেছেন,
প্রথম পদ্ধতি:
১. পরস্পর বিরোধী হাদিস দু’টির মাঝে এমনভাবে সমন্বয় করা যে উভয়টার উপর আমল করা সম্ভব হয়।
২. অথবা উভয়টা ব্যাখ্যা করা।
৩. অর্থের মাঝে সমন্বয় করার চেষ্টা করা।
দ্বিতীয় পদ্ধতি: উভয়টার মাঝে সমন্বয় সাধন সম্ভব না হলে একটিকে রহিত সাব্যস্ত করা।
তৃতীয় পদ্ধতি: আর যদি একটাকে রহিত প্রমাণ করা সম্ভব না হয় এবং রহিত হওয়ার দলিল না পাওয়া যায়, তবে দু’টোর যে কোন একটাকে প্রাধান্য দেয়া।
আলেমদের মাঝে কেউ কেউ তৃতীয় পদ্ধতিকে দ্বিতীয় পদ্ধতির উপর প্রাধান্য দিয়েছেন। অর্থাৎ প্রথমে সমন্বয় সাধন এরপর, প্রাধান্য দান অত:পর, রহিতকরণ।
এই মাসলাক বা পদ্ধতিগুলোর বিস্তারিত বিবরণ বেশ দীর্ঘ। আমি নীচে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করছি,
১. দু’টি বিরোধপূর্ণ হাদিসের মাঝে সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রে মানুষের বুঝশক্তি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। পরস্পর বিরোধী দু’টি হাদিসের ক্ষেত্রে কিছু আলেম দাবি করতে পারেন, এদের মাঝে সমন্বয় সাধন অসম্ভব, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা অন্য কোন আলেমের নিকট বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়ে থাকেন। ফলে তিনি উভয়ের মাঝে সমন্বয় সাধনের উপযুক্ত কারণ বিশ্লেষণ করেন। একারণে বাহ্যিকভাবে পরস্পর বিরোধী দু’টি হাদিসের মাঝে সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রে উলামায়ে কেরাম খুবই সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন এবং বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পরই ফয়সালা দিতে বলেছেন।
২. বিরোধপূর্ণ হাদিস দু’টির মাঝে সমন্বয় সাধন সম্ভব না হলে ইমাম যেকোন একটা রহিত হওয়ার দিকে মনোনিবেশ করেন। সুনির্দিষ্ট দলিল ছাড়া রহিত হওয়ার দাবি গ্রহণযোগ্য নয়। রহিত হওয়ার প্রমাণগুলোকে মুয়াররিফাতুন নসখ বা রহিত হওয়ার পরিচয়ক বলা হয়। রহিত হওয়ার পরিচয়ক চারটি,
এক. রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্পষ্ট বর্ণনার দ্বারা রহিত হওয়ার বিষয়টি সম্পর্র্কে অবগত হওয়া।
যেমন, মুসলিম শরীফে বর্ণিত হাদিস,
كنت نهيتكم عن زيارة القبور، فزوروها
অর্থ: আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। এখন তোমরা কবর যিয়ারত করো।
দুই. কোন সাহাবির বক্তব্য দ্বারা রহিত হওয়া সম্পর্র্কে অবগত হওয়া। যেমন, আবু দাউদ ও নাসায়ী শরীফে বর্ণিত হজরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা. এর হাদিস,
كان آخر الأمرين من رسول الله صلي الله عليه وسلم ترك الوضوء مما مست النار
অর্থ: আগুনে স্পর্শকৃত বস্তু আহারের ক্ষেত্রে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সর্বশেষ আমল ছিলো ওজু না করা।
তিন. তারিখ বা সময়ের ব্যবধানের মাধ্যমে রহিত হওয়া সম্পর্র্কে অবগত হওয়া। যেমন, হজরত শাদ্দাদ ইবনে আওস রা. থেকে বর্ণিত, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
أفطر الحاجم و المحجوم
অর্থ: যে শিঙা লাগায় এবং যাকে শিঙা লাগানো হয়, উভয়ের রোজা ভেঙ্গে যাবে।
কোন কোন বর্ণনায় রয়েছে, এটি অষ্টম হিজরীতে বর্ণিত হাদিস। এটি হযতর ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত হাদিস দ্বারা রহিত হবে। হজরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন,
إحتجم النبي صلي الله عليه وسلم وهو محرم صائم
অর্থ: রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোজা রেখে ইহরাম বাঁধা অবস্থায় শিঙা লাগিয়েছেন।
এটি বিদায় হজের সময়কার ঘটনা। বিদায় হজ হয়েছিলো দশম হিজরীতে।
অনেক ক্ষেত্রে সময়ের ব্যবধান নির্দেশক কিছু প্রমাণ দ্বারা রহিত হওয়ার বিষয়টি অবগত হওয়া যায়। যেমন, বর্ণনাকারী সাহাবি পূর্বে বর্ণিত হাদিসের পরে ইসলাম গ্রহণ করেছন এবং তিনি সরাসরি হাদিসটি রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট থেকে শোনার বিষয়টিও স্পষ্ট করেছেন। সুতরাং পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবির হাদিসটি পূর্বে ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবির হাদিস রহিত করবে।
এছাড়াও অনেক সূক্ষ্ম ও তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিত রয়েছে, যার মাধ্যমে রহিত হওয়ার বিষয়টি নির্ণয় করা সম্ভব। তবে এর উপর খুবই তাত্ত্বিক ও বিশ্লেষণমূলক গবেষণা হওয়া আবশ্যক।
চার. হাদিস রহিত হওয়ার বিষয়টি এর বিপরীতে সঙ্ঘঠিত ইজমা দ্বারা সুস্পষ্ট হওয়া। কিন্তু ইজমা সঙ্ঘঠিত হওয়ার ব্যাপারটি প্রমাণ করা এবং কেউ এর বিরোধিতা করেনি এটা নিশ্চিত হওয়া কঠিন।
৩. যদি কোন একটি হাদিস রহিত প্রমাণ করা করা সম্ভব না হয়, তবে ইমামগণ দু’টির যে কোন একটিকে প্রাধান্য দেয়ার চেষ্টা করেন। দু’টি হাদিসের একটিকে প্রাধান্য দেয়া খুবই জটিল।
বিরোধপূর্ণ হাদিসের প্রথম ধাপ তথা উভয়ের মাঝে সমন্বয় সাধনের জন্য বিশেষ বুঝ ও উপযুক্ত আকল প্রয়োজন। দ্বিতীয় ধাপ তথা কোন একটা হাদিসকে রহিত প্রমাণের জন্য উক্ত হাদিস সম্পর্র্কে পূর্ণ ধারণা থাকা জরুরি। তৃতীয় ধাপ তথা একটিকে প্রাধান্য দেয়ার ক্ষেত্রে বর্ণিত হাদিসের সম্পর্র্কে রেওয়াত ও দিরায়াত উভয় পদ্ধতির জ্ঞান থাকতে হবে। দিরায়াত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো হাদিসটি সম্পর্র্কে সম্যক জ্ঞান, ফিকাহ ও প্রখর বুঝ। আর রিওয়াতের জ্ঞান হলো, হাদিসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল বিষয় সম্পর্র্কে সম্যক অবগত হওয়া অর্থাৎ হাদিসের সনদ বিশ্লেষণ। সনদ বিশ্লেষণের বিষয়টি সবচেয়ে বেশি কষ্টকর। অত:পর, বর্ণনাকারী সাহাবিদের জীবনী, তাদের ইতিহাস, বর্ণনাকারীদের গুণাগুন, হাদিসে বর্ণিত শব্দ ইত্যাদি বিশ্লেষণ করা আবশ্যক।
আমি প্রথম সংস্করণে যখন এই বিষয়টা লিখি তখন উপর আমার মাথায় একটা উপযুক্ত উদাহরণ ছিলো। সেটি এখন উল্লেখ করছি,
কোন পাত্রে কুকুর মুখ দিলে তা পবিত্র করার পদ্ধতির ব্যাপারে অধিকাংশ ইমাম হজরত আবু হুরাইরা রা. এর হাদিসের উপর আমল করে থাকেন। নবি কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إذا ولغ الكلب في إناء أحدكم فليغسله سبع مرات
অর্থ: তোমাদের কারও পাত্রে কুকুর মুখ দিলে সে যেন তা সাতবার ধৌত করে।
হানাফীগণ বলেন, তিনবার ধৌত করার দ্বারা পাত্র পবিত্র হয়ে যাবে। হাদিসের বর্ণনাকারী সাহাবি হজরত আবু হুরাইরা রা. এর উপরই আমল করেছেন এবং ফতোয়া দিয়েছেন। হানাফীদের মূলনীতি হলো, হাদিসের বর্ণনাকারী যদি বর্ণিত হাদিসের বিপরীত আমল করে, তবে উক্ত হাদিসের উপর আমল করা বিশুদ্ধ নয়। কেননা এক্ষেত্রে হাদিসে মা’লুল বা অভিযুক্ত হয়ে যায়।
বিশিষ্ট গবেষক ও মুহাদ্দিস আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারি রহ. লেখেন,
إن التسبيع أي غسل الإناء سبع مرات هو المنسوخ، دون التثليث لتدرجه في أمر الكلاب من التشدد إلي التخفيف دون العكس ، فأمر بقتلها مطلقا لقلع عادة الناس في الألف بها، ثم بقتل الأسود البهيم خاصة، ثم بالترخيص في كلب الصيد و الماشية و الزرع ونهوها. فالتسبيع هو المناسب لأيام التشدد، و التثليث هو المناسب لأيام التخفيف وهو آخر الأمرين
অর্থ: সাতবার ধে? ত করার বিষয়টি রহিত (মানসুখ)। কিন্তু তিনবার ধে? ত করার বিষয়টি রহিত নয়। কেননা রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুকুরের ক্ষেত্রে কঠোর বিধান থেকে ধীরে ধীরে সহজ বিধান গ্রহণ করেছেন। বিষয়টি এর উল্টো নয়। অর্থাৎ সহজ থেকে কঠোরতার দিকে যাননি। প্রথম দিকে সব কুকুর হত্যার নির্দেশ দেন। ফলে কুকুরের প্রতি মানুষের হৃদ্যতা ও দুর্বলতা শেষ হয়ে যায়। অত:পর ঘন কালো কুকুর গুলো হত্যার নির্দেশ দেন। এরপর ক্ষেত, পাহারা বা শিকারের জন্য কুকুর রাখার অনুমতি দেন। সুতরাং সাতবার ধে? ত করার বিধানটি কঠোরতার সময় আরোপকৃত বিধানের সাথে সংশ্লিষ্ট। এবং তিনবার ধে? ত করার বিধানটি শিথিলতার সময়ের। আর এটি ছিল সর্বশেষ আমল। সুতরাং পূর্বেরটি রহিত সাব্যস্ত হবে।
এর থেকে স্পষ্ট, বিষয়টি শুধু সাতবার ধৌত করা এবং অষ্টম বার মাটি দ্বারা পরিষ্কার করার মাঝে সীমাবদ্ধ নয় এবং এটি আবু হুরাইরা রা. এর ফতোয়া ও আমলের মাঝেও সীমাবদ্ধ নয়; বরং এখানে প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, কুকুরের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল বিধানে সহজতা আরোপ করা হয়েছে। পরবর্তীতে কুকুর হত্যা থেকেও নিষেধ করেছেন। সুতরাং এখানে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উদ্দেশ্যও স্পষ্ট যে তিনি কী চান, সহজতা নাকি কঠোরতা? যখন মূল উদ্দেশ্যটি জানা গেলো, তখন উদ্দেশ্যের আলোকে হুকুমের মাঝেও পরিবর্তন হবে।
ইমামগণ দু’টি পরস্পর বিরোধী হাদিসের মাঝে সমন্বয় সাধনের জন্য যেসব পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন, সেগুলোর বাস্তব প্রয়োগ খুবই কঠিন। ইমামরা তাঁদের কিতাবে এগুলো বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
এই বিষয়ে সর্বপ্রথম কলম ধরেছেন, ইমাম শাফেয়ি রহ.। তিনি তাঁর আর-রিসালা -তে এক আলোচকের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে বলেছেন,
إن أصل ما نبني نحن و أنتم عليه : أن الأحاديث إذا اختلفت لم نذهب إلي واحد منها دون غيره إلا بسبب يدل علي أن الذين ذهبنا إليه أقوي من الذين تركنا. قال محاوره: وما ذلك السبب؟ قلت-الشافعي : أن يكون أحد الحديثين أشبه بكتاب الله ، فإذا أشبه كتاب الله كانت فيه الحجة..فإن لم يكن فيه نص كتاب الله كان أولاهما بنا الأثبت منهما، وذلك أن يكون من رواه أعرف إسنادا و أشهر بالعلم وأحفظ له. أو يكون روي الحديث الذي ذهبنا إليه من وجهين أو أكثر، و الذي تركنا من وجه ، فيكون الأكثر أولي بالحفظ من الأقل .أو يكون الذي ذهبنا إليه أشبه بمعني كتاب الله أو أشبه بما سواهما من سنن رسول الله ، أو أولي بما يعرف أهل العلم ، أو أصح في القياس ، و الذي عليه الأكثر من أصحاب رسول الله صلي الله عليه وسلم.
অর্থ: হাদিসের গ্রহণের ক্ষেত্রে আমাদের সবার মূলনীতি হলো, কয়েকটি হাদিস যখন পরস্পর বিরোধী হয়, তখন আমরা একটাকে ছেড়ে অন্যটাকে গ্রহণ করি না। একটা ছেড়ে অন্যটা গ্রহণের উপযুক্ত কারণ পেলেই শুধু দ্বিতীয়টা গ্রহণ করি। আমাদের দ্বিতীয় হাদিসটা প্রমাণ করে যে, সেটি পরিত্যক্ত হাদিস থেকে মজবুত ও শক্তিশালী।
প্রশ্নকারী জিজ্ঞাসা করলো, একটা হাদিস প্রাধান্য দেয়ার কারণ কী কী? ইমাম শাফেয়ি রহ. বললেন, দু’টি হাদিসের মাঝে একটির বক্তব্য যখন কুরআনের সাথে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ হবে, তখন অন্যটির উপর একে প্রাধান্য দেয়া হবে। যদি পবিত্র কুরআন থেকে এধরণের কোন প্রমাণ না পাওয়া যায়, তবে হাদিস দু’টির মাঝে যেটি শক্তিশালী সেটি গ্রহণ করা হবে। হাদিসটি অধিক শক্তিশালী হওয়ার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, উক্ত হাদিসের বর্ণনাকারীগণ মুহাদ্দিসদের নিকট গ্রহণযোগ্য ও প্রসিদ্ধ হবে। ইলম ও স্মরণশক্তির ক্ষেত্রেও তারা অন্যের চেয়ে অগ্রগামী হবে। সুতরাং বর্ণনাকারীর মুখস্থশক্তি প্রাধান্য দেয়ার অন্যতম কারণ। একইভাবে ইলমের ক্ষেত্রে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হওয়াটাও প্রাধান্য দেয়ার একটা বিশেষ ভিত্তি। এভাবে যে হাদিসটি দুই বা দু’য়ের অধিক সনদে বর্ণিত হয়েছে, সেটি এক সনদে বর্ণিত হাদিসের উপর প্রাধান্য পাবে। সুতরাং অধিক সংখ্যক ব্যক্তি কম সংখ্যকের উপর হেফজ বা মুখস্থের দিক থেকে প্রাধান্য পাবে। সুতরাং
১. কুরআনের অর্থের সঙ্গে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ ও নিকটবর্তী হওয়ার কারণে একটি প্রাধান্য পাবে।
২. বিরোধপূর্ণ হাদিসগুলির যেটি অন্যান্য হাদিসের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ হবে, সেটি প্রাধান্য পাবে।
৩. মুজতাহিদ ইমাম নিজের অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতার আলোকে একটিকে অপরটির উপর প্রাধান্য দেবে।
৪. যেটা কিয়াস ও যুক্তির অধিক নিকটবর্তী সেটা প্রাধান্য পাবে।
৫.একটা হাদিসের উপর অধিকাংশ সাহাবিদের আমল রয়েছে, কিন্তু অপরটির উপর আমল কম, তবে যেই হাদিসের উপর অধিকাংশ সাহাবির আমল রয়েছে, সেটি প্রাধান্য পাবে।[১] ইমাম শাফেয়ি রহ. এর পরে ইমাম হাযিমি রহ. পরস্পর বিরোধী নসের মাঝে প্রাধান্য দেয়ার বিষয়ে তার আল-ই’তেবার ফিন নাসিখি ওয়াল মানসুখি মিনাল আসার-এ প্রাধান্য দেয়ার পঞ্চাশটি পদ্ধতি আলোচনা করেছেন এবং এগুলোর অধিকাংশ পদ্ধতির উদাহরণ উল্লেখ করেছেন।
আলোচনার শেষে তিনি লিখেছেন,
وثم وجوه كثيرة أضربنا عن ذكرها كيلا يطول بها هذا المختصر
অর্থ: এছাড়াও প্রাধান্য দেয়ার অনেক কারণ রয়েছে। সংক্ষিপ্ত কিতাবের কলেবর বড় হওয়ার আশঙ্কায় এগুলোর আলোচনা থেকে বিরত থেকেছি।[২]
অত:পর, হাফেজ ইরাকী রহ. ইবনুস সালাহ এর মুকাদ্দামার টীকায় ইমাম হাযিমি রহ. উক্ত বক্তব্যটি উল্লেখ করে লিখেছেন,
وجوه الترجيحات تزيد علي المأة ، و قد رأيت عدها مختصرا فأبدا بالخمسين التي عدها الحازمي، ثم أسرد بقيتها علي الولاء
অর্থ: প্রাধান্য দেয়ার কারণ ও পদ্ধতি একশ’ এর বেশি। ইমাম হাযিমি রহ. যে পঞ্চাশটি উল্লেখ করেছেন সেগুলো সংক্ষেপে উল্লেখ করে অবশিষ্টগুলো তিনি ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ করেছেন। হাফেজ ইরাকী রহ. একশ’ দশটি পদ্ধতি উল্লেখ করে লিখেছেন, প্রাধান্য দেয়ার আরও পদ্ধতি রয়েছে।তবে এর কিছু পদ্ধতি সম্পর্র্কে বিতর্ক রয়েছে।[৩]
আল্লামা কাজি শাওকানি ইরশাদুল ফুহুলে প্রাধান্য দেয়ার কারণগুলিকে বারটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করেছেন। এবং এই বারটির অধীনে মোট একশ’ ষাটটি পদ্ধতি সম্পর্র্কে আলোচনা করেছেন। প্রত্যেক প্রকারের আলোচনার শেষে তিনি লিখেছেন, এক্ষেত্রে প্রাধান্য দেয়ার আরও পদ্ধতি রয়েছে।[৪]
উক্ত আলোচনা থেকে বর্তমানে কিছু লোকের অজ্ঞতা ও উদাসীনতা স্পষ্ট। এদের সামনে বাহ্যিকভাবে পরস্পর বিরোধী দু’টি হাদিস পেশ করা হলে এরা বোখারি ও মুসলিমে বর্ণিত হাদিসকে অন্যান্য কিতাবের হাদিসের উপর প্রাধান্য দেয়। প্রাধান্য দেয়ার অন্যান্য কারণগুলোর দিকে মোটেও ভ্রুক্ষেপ করে না। অথচ আল্লামা ইরাকী রহ. প্রাধান্য দেয়ার কারণগুলি ধারাবাহিকভাবে আলোচনার ক্ষেত্রে ১১০ টি পদ্ধতি বা কারণের মধ্যে ১০২ নং কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, বোখারি ও মুসলিমে বর্ণিত হাদিসটি অন্যের উপর প্রাধান্য পাবে। সুতরাং এই মূর্খরা হাদিস প্রাধান্য দেয়ার ১০১টি কারণ বাতিল করেছে। এটি হয়তো তারা অজ্ঞতাবশত করেছে, নতুবা ইচ্ছাকৃতভাবে অজ্ঞতার ভান করেছে। এই উভয় শ্রেণির বাহ্যিক সৌন্দর্যগুলোও পরিণামে তিক্ত হয়।কাজি শাওকানি রহ. হাদিসের সনদের মাধ্যমে প্রাধান্য দেয়ার যে ৪২ টি পদ্ধতি আলোচনা করেছেন, তন্মধ্যে ৪১ নং কারণ হলো, বোখারি ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হাদিস অন্য কিতাবে বর্ণিত হাদিসের উপর প্রাধান্য পাবে। সুতরাং ধোঁকাবাজদের এই প্রতারণায় নিজেকে নিপতিত করবেন না যে, ইমাম ইবনুস সালাহ বোখারি ও মুসলিমে সমষ্টিগতভাবে বর্ণিত হাদিসকে সবচেয়ে সহিহ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এবং একে বোখারির এককভাবে বর্ণিত হাদিসের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি বোখারির এককভাবে বর্ণিত হাদিসকে ইমাম মুসলিম রহ. এর এককভাবে বর্ণিত হাদিসের উপরও প্রাধান্য দিয়েছেন।
ইমাম ইরাকী প্রাধান্য দেয়ার অন্যান্য ১০০ টি পদ্ধতি আলোচনার পরে বোখারি ও মুসলিমে সমষ্টিগতভাবে বর্ণিত হাদিস প্রাধান্য দেয়ার কথা বলেছেন। এটি তিনি ইমাম ইবনুস সালাহ এর কিতাবের টীকায় উল্লেখ করেছেন। সুতরাং ইবনুস সালাহ রহ. এর বক্তব্য ও প্রাধান্য দানের পদ্ধতি সম্পর্র্কে হাফেজ ইরাকী রহ. সম্যক অববগত ছিলেন। সুতরাং একথা বলা আদৌ সংগত হবে না যে, হাফেজ ইরাকী রহ. ইবনুস রহ. এর বক্তব্য সম্পর্র্কে উদাসীন ছিলেন অথবা ভুলে গেছেন। এটি একটি অসম্ভব কথা। বরং ইমাম ইবনুস সালাহ রহ. এর বক্তব্যটি খুবই সীমাবদ্ধ ও সংকীর্ণ পরিসরের। পক্ষান্তরে হাফেজ ইরাকী রহ. ও উসুলবিদগণের বক্তব্যের পরিসর অত্যন্ত দীর্ঘ ও যথার্থ। আল্লাহ তায়ালা তৌফিক দিলে ইনশাআল্লাহ এবিষয়ে অন্য কোন গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
বোখারি ও মুসলিম শরীফে হাদিস উল্লেখের পদ্ধতি দ্বারাও বিষয়টি আমাদের সামনে স্পষ্ট হবে, তারা সংশ্লিষ্ট অধ্যায়ে উল্লেখিত হাদিসগুলোর কোনটি গ্রহণ করছেন আবার কোনটি ছেড়ে দিয়েছেন। যেমন ইমাম মুসলিম রহ. মুসলিম শরীফে প্রথমে জানাযার উদ্দেশ্যে দন্ডায়মান হওয়ার হাদিস উল্লেখ করেছেন।[৫]
অত:পর এটি রহিত হওয়ার হাদিস উল্লেখ করেছেন।[৬]
ইমাম কুরতুবী রহ. তাফসিরে কুরতুবী-তে লিখেছেন, ইমাম মুসলিম রহ. যেই হাদিসকে বিধান হিসেবে গ্রহণ করেন, সেটি অধ্যায়ের শেষে উল্লেখ করে থাকেন।[৭]
এ বিষয়ে আমরা সবাই একমত যে, হাদীসের শুদ্ধাশুদ্ধি যাচাইয়ে আমরা ইমাম মুসলিমের অনুসরণ করি, তবে কোন হাদীসের ফিকহ বা বুঝ নির্বাচনে আমরা তার অনুসরণ করি না।
ইমাম বোখারি রহ. শুধু জানাযার উদ্দেশ্যে দাঁড়ানোর হাদিসটি উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এটি রহিত হওয়ার হাদিসটি উল্লেখ করেননি।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে দৃষ্টি আকষর্ণ করতে চাই। বিখ্যাত ফকিহ ও মুহাদ্দিস আল্লামা ইউসুফ বান-নূরী রহ. তিরমিযি শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ মায়ারিফুস সুনানে লিখেছেন,
وقد قلت قديما و أقول: هؤلاء الأئمة الكبار أربار الصحاح:من البخاري ومسلم و غيرهما قد إنحازوا إلي جهة: تفقها و إجتهادا، أو إتباعا لأئمتهم في دقائق الفقه و الإجتهاد و غوامض المسائل ، و اختاروا جانبا في الخلافيات، ثم لما ألفوا أخرجوا في في تآليفهم ما يوافق مذاهبهم الفقهية و سري فقههم إلي الحديث و تركوا ما عداها، حيث لم يذهبوا إليها، إلا من التزم إخراج أحاديث الفريقين، كالإمام الترمذي غالبا و كإبن شيبة و عبد الرزاق في مصنفيهما، و أحمد في مسنده..
অর্থ: আমি পূর্বেও বলেছি, এখনও বলছি, বোখারি ও মুসলিম রহ. সহ সহিহ হাদিস সমূহের সঙ্কলক বড় বড় ইমামগণ ফিকাহ ও ইজতেহাদের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট মতের দিকে ঝোঁক রাখতেন। ফিকাহের বিভিন্ন বিষয় ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মাস-আলার ক্ষেত্রে তাদের অনুসরণীয ইমামের মতাদর্শ গ্রহণ করেছেন। মতবিরোধপূর্র্ণ মাস-আলায় তাঁরা সুনির্দিষ্ট মাজহাবের অনুসারী ছিলন। এরপর তারা হাদিসের কিতাবসমূহ সংকলনের সময় তাদের ফিকহি মাজহাব অনুযায়ী সংকলন করেছেন। হাদিসের সংকলনের ক্ষেত্রে তারা নিজেদের ইজতেহাদও কাজে লাগাতেন। যেসব হাদিস তাদের ইজতিহাদ ও গৃহীত মাজহাবের অনুগামী হতো না, সেগুলো উল্লেখ থেকে বিরত থাকতেন। তবে অনেক মুহাদ্দিস উভয় পক্ষের হাদিস সংকলন করেছেন। যেমন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইমাম তিরমিযি রহ, ইমাম ইবনে আবি শাইবা, ইমাম আব্দুর রাজ্জাক এবং ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ।[৮]
হাদিস সংকলনের ক্ষেত্রে তাদের ফিকাহ ব্যবহারের একটি উদাহরণ পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ জানাযার উদ্দেশ্যে দাঁড়াবে কি না, এ বিষয়ে ইমাম মুসলিম রহ. এর হাদিস বর্ণনার পদ্ধতি আলোচনা করা হয়েছে। ইমাম মুসলিম রহ. প্রথমে দন্ডায়মান হওয়ার হাদিস উল্লেখ করেছেন। অত:পর এটি রহিত হওয়ার হাদিস উল্লেখ করেছেন। একইভাবে ইমাম নাসায়ী রহ.ও রহিত হওয়ার হাদিস উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ইমাম বোখারি রহ. শুধু দন্ডায়মান হওয়ার হাদিস উল্লেখ করেছেন। ইমাম মুসলিম রহ. যে হাদিস দ্বারা এটি রহিত হওয়ার দলিল দিয়েছেন, সে হাদিস থেকে ইমাম বোখারি রহ. রহিত হওয়ার বিষয়টি বোঝেননি। একারণে তিনি হাদিসটি উল্লেখ করা থেকে বিরত থেকেছেন। সুতরাং ইমাম মুসলিম ও নাসায়ী রহ. তাদের ফিকাহ অনুযায়ী রহিত হওয়ার হাদিস উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ইমাম বোখারি রহ. রহিত হওয়ার মতটি গ্রহণ না করায় হাদিসটি উল্লেখ করেননি।
এবিষয়ে আরেকটি উদাহরণ হলো, হজরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
من صلي علي جنازة في المسجد فلا شيئ له
অর্থাৎ যে ব্যক্তি মসজিদে কারও জানাযা পড়লো, তার কোন সওয়াব নেই।
পূর্বে হাদিসটি সম্পর্র্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। হাদিসটি ইমাম মুসলিম রহ. উল্লেখ করেননি। কিন্তু এবিষয়ে হজরত আয়েশা রা. এর হাদিসটি উল্লেখ করেছেন, তিনি বলেন,
ما أسرع ما نسي الناس: ما صلي رسول الله صلي الله عليه وسلم علي سهيل بن البيضاء إلا في المسجد
অর্থ: “মানুষ কত দ্রুত ভুলে যায়! নিশ্চয় রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুহাইল ইবনুল বায়যা এর জানাযা মসজিদে আদায় করেছেন।” [৯]
একইভাবে ইমাম নাসায়ী রহ. আয়েশা রা. এর হাদিসটি উল্লেখ করেছেন।[১০]
এটি হলো ইমাম মুসলিম ও নাসায়ী রহ. এর ফিকাহ। কিন্তু ইমাম আবু দাউদ রহ. প্রথমে হজরত আয়েশা রা. এর হাদিসটি উল্লেখ করেছেন। অত:পর, তিনি হজরত আবু হুরাইরা রা. এর হাদিসের মাধ্যমে পরিচ্ছেদ শেষ করেছেন।[১১]
এটি হলো ইমাম আবু দাউদ রহ. এর ফিকাহ ও বুঝ। ইমাম ইবনে মাজা রহ. ঠিক এর উল্টো করেছেন অর্থাৎ তিনি প্রথমে হজরত আবু হুরাইরা রা. এর হাদিস উল্লেখ করেছেন, এরপর হজরত আয়েশা রা. এর হাদিস উল্লেখ করে লিখেছেন,
حديث عائشة أقوي
হজরত আয়েশা রা. এর হাদিসটি শক্তিশালী।[১২]
এটি ইমাম ইবনে মাজা রহ. ফিকাহ ও বুঝ। সুতরাং এসমস্ত হাদিসের ইমামদের বুঝ ও ফিকাহের অনুসরণ না করে বিখ্যাত ফকিহ ইমামগণের অনুসরণ উত্তম নয় কি? বরং তাঁদের অনুসরণের চেয়ে ফকিহ ইমামগণের অনুসরণ অধিক উত্তম। পূর্বে ইমাম তিরমিযি রহ. এর বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি বলেছেন, ফকিহগণ হাদিসের অর্থ ও উদ্দেশ্য সম্পর্র্কে অধিক জ্ঞাত। এটি এমন দ্ব্যর্থহীন বিষয়, যাতে কোন অস্পষ্টতা নেই।
ইমাম বোখারি রহ. একটা হাদিস বর্ণনা করলে তা থেকে একটি মাসআলা প্রমাণিত হয়। সুতরাং ইমাম বোখারি বর্ণিত হাদিস থেকে যে বিধান গ্রহণ করা হয়েছে একে ইমাম আবু দাউদ বর্ণিত হাদিস থেকে গৃহীত হুকুমের উপর প্রাধান্য দেয়া সঠিক নয়। কেননা, এর দ্বারা মূলত: ইমাম বোখারি রহ. এর ইজতিহাদ ও মাজহাবকে অন্য কোন মুহাদ্দিসের মাজহাবের উপর প্রাধান্য দেয়া হয়। বাস্তব কথা হলো, ইমাম বোখারি রহ. সংশ্লিষ্ট মাস-আলায় যেই হাদিসটা তার মাজহাব অনুযায়ী পেয়েছেন, সেটা বর্ণনা করেছেন। সুতরাং প্রত্যেক ক্ষেত্রে বোখারি বর্ণিত হাদিসকে প্রাধান্য দেয়ার অর্থ হলো, ইমাম বোখারির মাজহাবকে অন্যদের উপর প্রাধান্য দেয়া। প্রত্যেক মাস-আলায় বোখারি বর্ণিত হাদিসকে প্রাধান্য দেয়ার যে রীতি সংশয় সৃষ্টিকারীরা তৈরি করেছে, বাস্তবতা এর সম্পূর্ণ বিপরীত।
হাদিসে বুঝ অর্জনের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণের পারস্পরিক ব্যাবধান ও মতবিরোধ খুবই বিস্তৃত। তাদের মতবিরোধের এই বিস্তর পরিসর থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, একটি ফিকহি মাস-আলার বিধান আহরণ কতটা কষ্টসাধ্য। এর মাধ্যমে এটাও অনুধাবন করা যাবে যে, ইমামগণ ইলমের কতো উচ্চ শিখরে আরোহণ করেছিলেন। আমি যে বিষয়টি আলোচনা করছি, এটি মূলত: ইজতেহাদের জন্য প্রয়োজনীয় ইলম সমূহের একটি ইলমের প্রাথমিক কিছু অংশ। সুতরাং ইজতেহাদের জন্য আবশ্যক অন্যান্য ইলমের ক্ষেত্রে তাদের অবস্থানের ব্যাপারে কী ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি রাখা উচিত? বিষয়টি সম্পর্র্কে পরবর্তীতে সামান্য আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।
সূত্র:
ইমামগণের মতভেদে হাদীসের ভূমিকা
মূল: শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা
অনুবাদ: মুফতী ইজহারুল ইসলাম আল-কাউসারী
উদ্ধৃতিসমূহ:
[১] আর-রিসালা, পৃ.২৮৪।
[২] ইমাম হাযিমী রহ. কৃত আল-ই’তেবার ফিন নাসিখি ওয়াল মানসুখি মিনাল আসার, পৃ.৯-২৩
[৩] ইবনুস সালাহ এর উপর আল্লামা ইরাকীর হাশিয়া, পৃ.২৪৫।
[৪] ইরশাদুল ফুহুল, পৃ.২৭৬-২৮৪।
[৫] মুসলিম শরীফ, খ.২, পৃ.৬৫৯।
[৬] মুসলিম শরীফ, খ.২,পৃ.৬৬১।
[৭] তাফসীরে কুরতুবী, খ.৩, পৃ.২১২।
[৮] মায়ারিফুস সুনান, খ.৬,পৃ.৩৭৯-৩৮০
[৯] সহীহ মুসলিম শরীফ, খ.২, পৃ.৬৬৮
[১০] নাসায়ী শরীফ, খ.১, পৃ.৬৩৯।
[১১] আবু দাউদ শরীফ, খ.৩, পৃ.৫৩০-৫৩১।
[১২] ইবনে মাজা শরীফ, খ.১, পৃ.৪৮৬
সূত্র: ইমামগণের মতভেদে হাদীসের ভূমিকা, অনুবাদ: মুফতী ইজহারুল ইসলাম আল-কাউসারী
------ ------
খতীব বাগদাদী রহ. তার ‘আল-জামে লি-আখলাকির রাবি ও আদাবিস সামে’ কিতাবে ইমাম আবু ইউসুফ রহ. থেকে একটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন।
الْعِلْمُ شَيْءٌ لا يُعْطِيكَ بَعْضَهُ حَتَّى تُعْطِيَهُ كُلَّكَ
অর্থ: ইলম এমন একটি জিনিস, সে তোমাকে তার কিছু অংশও দিবে না যতক্ষণ না তুমি নিজেকে পূর্ণভাবে তার কাছে সমর্পণ না করবে।
অন্যান্য সৃষ্টি থেকে মানুষের শ্রেষ্ঠত্যের একটি বিশেষ দিক হলো ইলম অর্জনের ক্ষমতা। এটি মানুষের জন্য আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
ইলমের জন্য যে…
ইবনে তাইমিয়া রহ. এর জীবনী আলোচনা করেছেন তার বিশিষ্ট ছাত্র ইবনুল কাইয়্যিম রহ। তার পৃথক জীবনী লিখেছেন ইবনে তাইমিয়া রহ. এর বিশিষ্ট দুই ছাত্র। একজন হলেন, হাফেজ আবু হাফস উমর ইবনে আলি আল-বাযযার (মৃত:৭৪৯ হি:) তিনি আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া লিখেছেন। ইবনে তাইমিয়া রহ. আরেক ছাত্র ইবনে আব্দুল হাদী রহ. (মৃত: ৭৪৪ হি:) আরেকটি জীবনী লিখেছেন। তার লিখিত জীবনীর নাম আল-উকুদুল দুররিয়া মিন মানাকিবি শাইখিল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া।
আমি এখানে ইবনে তাইমিয়া রহ. এর বিশিষ্ট ছাত্রদের বর্ণনায় তার কিছু উল্লেখযোগ্য কারামত উল্লেখ করছি।
কারামত-১:
লওহে মাহফুজ দেখে বিজয়ের সংবাদ:
গায়েবসম্পর্কেইবনেতাইমিয়ারহ. এরকারামত:
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) “মাদারিজুস সালিকিন শরহু মানাযিলিস সাঈরিন” নামক কিতাবে আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) এর কারামতের কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) লিখেছেন-
أخبر الناس والأمراء سنة اثنتين وسبعمائة لما تحرك التتار وقصدوا الشام : أن الدائرة والهزيمة عليهم وأن الظفر والنصر للمسلمين وأقسم على ذلك أكثر من سبعين يمينا فيقال له : قل إن شاء الله فيقول : إن شاء الله تحقيقا لا تعليقا وسمعته يقول ذلك قال : فلما أكثروا علي قلت : لا تكثروا كتب الله تعالى في اللوح المحفوظ : أنهم مهزومون في هذه الكرة وأن النصر لجيوش الإسلام
“তাতারীরা যখন মুসলিম উম্মাহের বিভিন্ন অঞ্চলে সেনা অভিযান পরিচালনা করে এবং শামে আক্রমণের উদ্যোাগ গ্রহণ করে তখন ৭০২ হিঃ সনে শায়েখ (রহঃ) সাধারণ মানুষ এবং আমীর-উমারাদেরকে সংবাদ দিলেন যে, “তাতারীরা পরাজিত হবে এবং মুসলমানরা বিজয় ও সাহায্য লাভ করবে।”। তিনি তাঁর কথার উপর সত্তরটিরও বেশি কসম খেয়েছেন। তাঁকে বলা হল, আপনি ইনশাআল্লাহ বলুন! অতঃপর তিনি বলেন, নিশ্চিতভাবে ইনশাআল্লাহ বলছি, সম্ভাবনা হিসেবে নয়। আমি তাঁকে বলতে শুনেছি, যখন তারা আমার উপর পীড়াপীড়ি করল, আমি তাদেরকে বললাম, তোমরা পীড়াপীড়ি কর না, আল্লাহ তায়ালা লউহে মাহফুজে লিখে রেখেছেন যে, তারা পরাজিত হবে এবং মুসলমানরা বিজয়ী হবে।
[মাদারিজুস সালিকিন, খ–২, পৃষ্ঠা-৪৮৯]
আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) আরও অনেক কারামতের কথা উল্লেখ করেছেন, ইবনে আব্দুল হাদী মুকাদ্দেসী (রহঃ) এবং আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ)। বিস্তারিত জানার জন্য আগ্রহী পাঠক, মাদারিজুস সালিকীন ও আ’লামুল আলিয়্যা গ্রন্থদ্বয় দেখতে পারেন।
¬
কারামত-২: ইবনে তাইমিয়া রহ. এর ভবিষ্যৎবাণী:
আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) এর বিশেষ ছাত্র আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) লিখেছেন-
وأخبرني غير مرة بأمور باطنة تختص بي مما عزمت عليه ولم ينطق به لساني وأخبرني ببعض حوادث كبار تجري في المستقبل ولم يعين أوقاتها وقد رأيت بعضها وأنا أنتظر بقيتها وما شاهده كبار أصحابه من ذلك أضعاف أضعاف ما شاهدته والله أعلم
“তিনি আমাকে অনেকবার অনেক বাতেনি বিষয়ের সংবাদ দিয়েছেন। তিনি শুধু আমাকে এগুলো বলেছেন এবং এ বিষয় সম্পর্কে আমি কাউকে কিছু বলি নি। তিনি আমাকে ভবিষ্যতের অনেক ঘটনার সংবাদ দিয়েছেন কিন্তু তিনি সময় নির্দিষ্ট করে দেননি। তাঁর ভবিষ্যৎ বাণীর কিছু কিছু আমি ঘটতে দেখেছি এবং অবশিষ্টগুলো সংঘটিত হওয়ার অপেক্ষায় আছি। তাঁর বড় বড় সাগরেদগণ আমি যা দেখেছি, তার চেয়ে বহু বহু গুণ বেশি দেখেছেন”
[মাদারিজুস সালিকিন, খ–২, পৃষ্ঠা-৪৯০]
কারামত-৩: অন্তরের বিষয় সম্পর্কে অবগত হওয়া:
ইবনে তাইমিয়া রহ. এর ছাত্র আবু হাফস উমর আল-বাযযার বলেন,
“أنه جرى بيني وبين بعض الفضلاء منازعة في عدة مسائل وطال كلامنا فيها وجعلنا نقطع الكلام في كل مسألة بأن نرجع إلى الشيخ وما يرجحه من القول فيها
ثم أن الشيخ رضي الله عنه حضر فلما هممنا بسؤاله عن ذلك سبقنا هو وشرع يذكر لنا مسألة مسألة كما كنا فيه وجعل يذكر غالب ما أوردناه في كل مسأله ويذكر أقوال العلماء ثم يرجح منها ما يرجحه الدليل حتى أتى على آخر ما أردنا أن نسأله عنه وبين لنا ما قصدنا أن نستعلمه منه فبقيت أنا وصاحبي ومن حضرنا أولا مبهوتين متعجبين مما كاشفنا به وأظهره الله عليه مما كان في خواطرنا.”
অর্থাৎ আমার সাথে একজন সম্মানিত আলেমের কয়েকটি মাসআলা নিয়ে বিতর্ক হলো। এ বিষয়ে আমাদের আলোচনা অনেক দীঘর্ হলো। প্রত্যেক মাসআলায় আমরা এভাবে কথা শেষ করলাম যে, মাসআলার সমাধান ইবনে তাইমিয়া রহ. এর কাছ থেকে জেনে নিবো।
এরপর শায়খ রহ. আমাদের নিকট উপস্থিত হলেন। আমরা যখন মাসআলাগুলো সম্পর্কে শায়খকে জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছা করলাম তিনি আমাদের জিজ্ঞাসার পূর্বেই আলোচনা শুরু করলেন। তিনি আমাদের আলোচনা অনুযায়ী একের পর এক মাসআলার সমাধান বলতেছিলেন। প্রত্যেক মাসআলায় আমাদের কাঙ্খিত উত্তর প্রদান করছিলেন। এভাবে তিনি প্রত্যেকটি মাসআলায় উলামায়ে কেরামের বক্তব্য এবং দলিল অনুযায়ী প্রাধান্য পাওয়া মাসআলাটি উল্লেখ করছিলেন। অবশেষে তিনি আমাদের আলোচিত সর্বশেষ মাসআলাটির সমাধান প্রদান করলেন। আমাদের অন্তরের বিষয়গুলো আল্লাহ তায়ালা এভাবে সুস্পষ্ট করে প্রকাশ করায় উপস্থিত লোকজন, আমার সঙ্গী ও আমি আশ্চর্যন্বিত ও বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৩, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
নিচের স্ক্রিনশট দেখুন,
এছাড়া আবু হাফস আল-বাযযার অন্তরের বিষয়ে ইবনে তাইমিয়া রহ. এর অবগত হওয়া সম্পর্কে আরও বলেন,
و كنت في خلال الأيام التي صحبته فيها إذا بحث مسألة يحضر لي إيراد فما يستتم خاطري به حتي يشرع فيرده و يذكر الجواب من عدة وجوه
অর্থাৎ আমি যখন যেসময়ে তার সংস্পর্শে ছিলাম, তখন আমার মনে কোন বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ার সঙ্গে তিনি এর জওয়াব দিতে শুরু করতেন এবং কয়েকভাবে এর উত্তর প্রদান করতেন।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৩, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
কারামত-৪: অন্যের সাহায্য
“وحدثني الشيخ الصالح المقريء أحمد بن الحريمي أنه سافر إلى دمشق قال فاتفق أنى لما قدمتها لم يكن معي شئ من النفقة البتة وأنا لا اعرف أحدا من أهلها فجعلت أمشي في زقاق منها كالحائر فإذا بشيخ قد أقبل نحوي مسرعا فسلم وهش في وجهي ووضع في يدي صرة فيها دراهم صالحة وقال لي انفق هذه الآن وخلي خاطرك مما أنت فيه فإن الله لا يضيعك ثم رد على أثره كأنه ما جاء إلا من أجلي فدعوت له وفرحت بذلك، وقلت لبعض من رأيته من الناس من هذا الشيخ؟ فقال وكأنك لا تعرفه هذا ابن تيمية
আমার নিকট শায়খ সালেহ আল –মুকরী বর্ণনা করেন, তিনি দামেশকের উদ্দেশে সফর করেন। তিনি বলেন, ঘটনাক্রমে ঐ সফরে আমার সঙ্গে কোন চলার মতো কোন খাবার বা অর্থ ছিলো না। আমি ওখানকার কাউকে চিনতাম না। এ অবস্থায় আমি উদভ্রান্তের মতো দামেশকের অলি-গলিতে ঘুরছিলাম। হঠাৎ একজন শায়খ আমার দিকে দ্রুত গতিতে হেঁটে এলেন। তিনি হাস্যোজ্জল মুখে সালাম দিলেন। তিনি আমার হাতে একটা থলি দিলেন যাতে কিছু খাটি দিরহাম ছিলো। এরপর বললেন, “ এগুলো ব্যবহার করো। তোমার অন্তরে যেই পেরেশানী আছে এগুলো ঝেড়ে ফেলো। আল্লাহ তায়ালা তোমাকে ধ্বংস করবেন না।” একথা বলে তিনি একই পথে ফিরে গেলেন। তিনি যেন শুধু আমার কাছেই এসেছিলেন। আমি তার জন্য দুয়া করলাম এবং এতে আনন্দি হলাম। আমি অন্যান্য মানুষকে জিজ্ঞেস করলাম, এই শায়খ কে? তারা বললো, তুমি মনে হয় শায়খকে চেনো না, তিনি হলেন ইবনে তাইমিয়া।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৪, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
কারামত-৫:
وحدثني الشيخ العالم المقريء تقي الدين عبد الله ابن الشيخ الصالح المقريء احمد بن سعيد قال سافرت إلى مصر حين كان الشيخ مقيما بها فاتفق أني قدمتها ليلا وأنا مثقل مريض فأنزلت في بعض الأمكنة فلم ألبث أن سمعت من ينادي باسمي وكنيتي فأجبته وأنا ضعيف فدخل إلي جماعة من أصحاب الشيخ ممن كنت قد اجتمعت ببعضهم في دمشق فقلت كيف عرفتم بقدومي وأنا قدمت هذه الساعة فذكروا أن الشيخ أخبرنا بأنك قدمت وأنت مريض وأمرنا أن نسرع بنقلك وما رأينا أحدا جاء ولا أخبرنا بشيء، فعلمت أن ذلك من كرامات الشيخ رضي الله عنه.”
শায়খ সালেহ আল-মুকরী এর ছেলে শায়খ তাকিউদ্দীন আব্দুল্লাহ আল-মুকরী আমাকে বলেছেন, শায়খ ইবনে তাইমিয়া রহ. যখন মিশরে ছিলেন তখন আমি মিশরে সফর করি। আমি রাতে মিশরে গিয়ে উপস্থিত হলাম। তখন আমার কাছে ভারী বোঝা ছিল আর আমি অসুস্থ ছিলাম। আমি এক জায়গায় গিয়ে বাহন থেকে নামলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে শুনতে পেলাম এক ব্যক্তি আমার নাম ও উপনাম ধরে ডাকছে। আমি দুর্বল শরীরে তার ডাকে সাড়া দিলাম। তখন শায়খ ইবনে তাইমিয়ার একদল ছাত্র আমার নিকট এলো। তাদের সাথে আমি পূর্বে দামেশকে সাক্ষাৎ করেছিলাম। আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা আমার আগমন সম্পর্কে কীভাবে জানলে; অথচ আমি মাত্র এলাম? তারা বলল, শায়খ ইবনে তাইমিয়া তাদেরকে বলেছে যে, আপনি এসেছেন এবং আপনার শরীর অসুস্থ। আমাদেরকে দ্রুত আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন। আমরা কাউকে আসতেও দেখিনি এবং আপনার সম্পর্কে কেউ পূর্বে সংবাদও দেয়নি। আমি তখন বুঝলাম এটি শায়খের কারামত।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৪, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
কারামত-৬:
“وحدثني أيضا قال مرضت بدمشق إذ كنت فيها مرضة شديدة منعتني حتى من الجلوس فلم اشعر إلا والشيخ عند رأسي وأنا مثقل مشتد بالحمى والمرض فدعا لي وقال جاءت العافية، فما هو إلا أن فارقني وجاءت العافية وشفيت من وقتي”
শায়খ সালেহ আল-মুকরী এর ছেলে শায়খ তাকিউদ্দীন আব্দুল্লাহ আল-মুকরী আরও বলেন, আমি দামেশকে কঠিন রোগে আক্রান্ত হলাম। এমনকি আমি বসতেও পারতাম না। হঠাৎ আমার মাথার নিকট শায়খকে দেখতে পেলাম।তখন আমি মারাত্মক জ্বর ও রোগে আক্রান্ত ছিলাম।তিনি আমার জন্য দুয়া করলেন এবং বললেন, সুস্থতা চলে এসেছে।তিনি আমার কাছ থেকে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি সুস্থ হয়ে গেলাম।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৫, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
কারামত-৭:
“وحدثني أيضا قال أخبرني الشيخ ابن عماد الدين المقرئ المطرز قال قدمت على الشيخ ومعي حينئذ نفقة فسلمت عليه فرد علي ورحب بي وأدناني ولم يسألني هل معك نفقة أم لا، فلما كان بعد أيام ونفدت نفقتي أردت أن اخرج من مجلسه بعد أن صليت مع الناس وراءه فمنعني وأجلسني دونهم فلما خلا المجلس دفع إلي جملة دراهم وقال أنت الآن بغير نفقة فارتفق بهذه فعجبت من ذلك وعلمت أن الله كشفه على حالي أولا لما كان معي نفقة وآخرا لما نفدت واحتجت إلى نفقة.”
আমার নিকট তিনি আরও বর্ণনা করেছেন, আমার নিকট শায়খ ইবনে ইমাদুদ্দিন আল-মুকরী আল-মুতাররায বর্ণনা করেন, তিনি বলেন আমি একবার শায়খের নিকট আগমন করলাম। তখন আমার কাছে খরচের টাকা-পয়সা ছিলো। আমি তাকে সালাম দিলাম, তিনি উত্তর দিলেন এবং আমাকে স্বাগত জানালেন। আমাকে তিনি তার নিকটে বসালেন। এবার তিনি আমার জীবিকা নির্বাহের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন না। কিছুদিন পর আমার খরচের উপকরণ শেষ হয়ে গেল। তখন আমি তার পিছে নামায আদায় করে তার মজলিশ থেকে বের হতে উদ্যত হলাম। তিনি আমাকে বাধা দিয়ে বসতে বললেন। এরপর যখন মজলিশ শেষ হলো, তখন তিনি আমাকে কিছু দিরহাম দিয়ে বললেন, এখন তোমার কোন খরচের টাকা-পয়সা নেই। এগুলো ব্যবহার করতে থাকে। এ ঘটনায় আমি বিস্মিত হলাম। বুঝলাম যে আল্লাহ তায়ালা আমার পূর্বের ও বর্তমান অবস্থা শায়খের নিকট প্রকাশ করে দিয়েছেন।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৬, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
কারামত-৮: মৃত সম্পর্কে সংবাদ:
“وحدثني من لا أتهمه أن الشيخ رضي الله عنه حين نزل المغل بالشام لأخذ دمشق وغيرها رجف أهلها وخافوا خوفا شديدا، وجاء إليه جماعة منهم وسألوه الدعاء للمسلمين فتوجه إلى الله ثم قال أبشروا فإن الله يأتيكم بالنصر في اليوم الفلاني بعد ثالثة حتى ترون الرؤوس معبأة بعضها فوق بعض.قال الذي حدثني فوالذي نفسي بيده أو كما حلف ما مضى إلا ثلاث مثل قوله حتى رأينا رؤوسهم كما قال الشيخ على ظاهر دمشق معبأة بعضها فوق بعض.”
আমার নিকট বিশ্বস্ত এক ব্যক্তি বর্ণনা করেছেন, যখন মোগলরা দামেশক ও অন্যান্য অন্চল দখলের জন্য শামে আক্রমণ করলো, দামেশকের অধিবাসীরা খুবই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। এসময় একদল মুসলমান শায়খ ইবনে তাইমিয়া রহ. এর নিকট আগমন করলেন এবং তাকে মুসলমানদের জন্য দুয়া করার অনুরোধ করলেন। তিনি আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করলেন। এরপর বললেন, তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ করো, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তিন দিন পর তোমাদেরকে সাহায্য করবেন, এমনকি তোমরা দেখবে যে একটার উপর আরেকটা মাথা স্তুপ হয়ে থাকবে। ঘটনার বর্ণনাকারী বলেন, আল্লাহর শপথ, তৃতীয় দিন দামেশকের প্রবেশ মুখে শত্রুদের মাথাগুলো একটার উপর আরেকটা স্তুপ হয়েছিলো যেমন শায়খ বলেছিলেন।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৬, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
কারামত-৯:
“وحدثني الشيخ الصالح الورع عثمان بن احمد بن عيسى النساج أن الشيخ رضي الله عنه كان يعود المرضى بالبيمارستان بدمشق في كل أسبوع فجاء على عادته فعادهم فوصل إلى شاب منهم فدعا له فشفي سريعا وجاء إلى الشيخ يقصد السلام عليه فلما رآه هش له وأدناه ثم دفع إليه نفقة وقال قد شفاك الله فعاهد الله أن تعجل الرجوع إلى بلدك أيجوز أن تترك زوجتك وبناتك أربعا ضيعة وتقيم هاهنا؟ فقبل يده وقال يا سيدي أنا تائب إلى الله على يدك وقال الفتى وعجبت مما كاشفني به وكنت قد تركتهم بلا نفقة ولم يكن قد عرف بحالي أحد من أهل دمشق.”
শায়খ উসমান ইবনে আহমাদ ইবনে ইসা আন-নাসসাজ আমার নিকট বর্ণনা করেছেন, শায়খ ইবনে তাইমিয়া রহ. দামেশকের বিমারিস্তান নামক জায়গায় প্রত্যেক সপ্তাহে রোগীদের দেখতে আসতেন। অভ্যাস অনুযায়ী তিনি রোগী দেখতে এলেন। তাদের মধ্যে এক যুবককে তিনি দেখলেন এবং তার জন্য দুয়া করলেন। সে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠল। যুবকটি শায়খকে সালাম দেয়ার জন্য এলো। তাকে দেখে শায়খ হাসিমুখে নিকটে বসালেন। তার কাছে কিছু খরচের টাকা-পয়সা দিলেন এবং বলেন, আল্লাহ তায়ালা তোমাকে সুস্থ করেছেন। সুতরাং তুমি আল্লাহর কাছে ওয়াদা করো যে তুমি দ্রুত পরিবারের কাছে ফিরে যাবে। তোমার জন্য কখনও বৈধ হবে যে তোমার স্ত্রী ও চার কন্যাকে ধ্বংসের মুখে রেখে এখানে অবস্থান করবে? যুবকটি বলল, আমি তার হাতে চুমু দিলাম এবং বললাম, শায়খ, আমি আল্লাহর নিকট আপনার হাতে তওবা করছি।
আমি তার কাশফ দেখে বিস্মিত হলাম। বাস্তবেই আমি আমার পরিবারকে সহায়-সম্বলহীন রেখে এসেছিলাম।দামেশকের কেউ আামার পরিবার সম্পর্কে অবগত ছিলো না।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৬, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
এই কারামতগুলো লিখে আবু হাফস আল-বাযযার রহ. লিখেছেন,
و كرامات الشيخ رضي الله عنه كثيرة جدا لا يليق بهذا المختصر أكثر من ذكر هذا القدر منها . ومن أظهر كراماته أنه ما سمع بأحد عاداه أو غض عنه إلا و أبتلي بعدة بلايا غالبها في دينه وهذا ظاهر مشهور لا يحتاج فيه إلي شرح صفته
শায়খ রহ. অনেক কারামত রয়েছে। এই সংক্ষিপ্ত বইয়ে সেগুলো উল্লেখ করা সঙ্গত নয়। তার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ করামত হলো যে কেউ শায়খের বিরোধীতা করেছে বা তার সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক রয়েছে, সে বিভিন্ন ধরনের বালা-মুসীবতে নিপতিত হয়েছে। বেশিরভাগ মুসীবত দীন সম্পর্কীয়। বিষয়গুলো স্পষ্ট ও প্রকাশিত। এগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা অনাবশ্যক।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৮, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
কাশফ ও ইলহাম সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া রহ. এর অনেক কারামত রয়েছে। এ বিষয়ে তার অনেক বক্তব্যও আছে। এগুলোর কিছু কিছু ইবনে তাইমিয়া রহ. এর দৃষ্টিতে তাসাউফ বইয়ে উল্লেখ করেছি। দু:খজনক বিষয় হলো, আমাদের আজকের আলোচনার মূল বিষয় এখনও শুরু করা হয়নি। আজ এখানেই ইতি টানছি। পরবর্তী আলোচনায় গায়েব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করা হবে।
------ ------
[বর্তমানে ইবনে আবিল ইযের আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাগ্রন্থটি ব্যাপকভাবে প্রচারের চেষ্টা করা হচ্ছে। যেমন, সালাফী আলেম আব্দুল্লাহ শাহেদ মাদানী এর বাংলা অনুবাদ করে অনলাইনে প্রচার করছেন। সুতরাং এই কিতাবের বাস্তবতা ও এর লেখক সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাগুলো সুস্পষ্ট করা আবশ্যক। আকিদাতুত ত্বহাবীর উপর দরসের নিয়ত ব্যক্ত করেছিলাম কিছু দিন আগে। উক্ত দরসের প্রয়োজনে আজকের আলোচনাটি লেখা। যারা উক্ত দরস দেখবেন, আশা করি বিষয়টি তাদের উপকারে আসবে। ]
সৌদি আরবের কল্যাণে কাররামিয়াদের ভ্রান্ত দেহবাদী আকিদাগুলো সালাফী মতবাদের মোড়কে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। পেট্র-ডলারের সহায়তায় তারা এক্ষেত্রে অনেকটা অগ্রসর। সালাফীদের ভ্রান্ত আকিদা সম্পর্কে বেশ কিছু প্রবন্ধ লেখার সুযোগ হয়েছে আল-হামদুলিল্লাহ। আমাদের আইডিয়ার ওয়েবসাইটে লেখাগুলো পাবেন। সালাফী মতবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে থাকে। এর মধ্যে একটি বিশেষ কৌশল হল, বিভিন্ন ইমামের আকিদার কিতাব ব্যাখ্যার নামে নিজেদের ভ্রান্ত আকিদা ছড়িয়ে দেয়া। উদাহরণ হিসেবে ইমাম ত্বহাবীর আকিদাতুত ত্বহাবীর কথা বলা যায়। একটু খোজ নিলে দেখবেন, প্রায় প্রত্যেক সালাফী শায়খই আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখেছেন, কেউ অডিও বা ভিডিও লেকচার দিয়েছেন। অন্তত বিশ-পজিশজন বা এর চেয়ে বেশি সালাফী শায়খের ব্যাখ্যা পাবেন। একটি মৌলিক প্রশ্ন হল, এসব সালাফী আলেমরা কি ইমাম ত্বহাবীর আকিদা পোষণ করেন? ধ্রুব সত্য হল, ইমাম ত্বহাবীর আকিদার সাথে এদের আকিদার দূরতম কোন সম্পর্ক নেই। ইমাম ত্বহাবী রহ. এর আকিদার ও এদের আকিদার মাঝে আসমান-জমিনের ফারাক। আরেকটি প্রশ্ন মনে উকি দেয়, এরা যেহেতু ইমাম ত্বাহাবীর আকিদা পোষণ করে না, তাহলে এর ব্যাখ্যা করে কেন? সহজ উত্তর হল, ইমাম ত্বহাবীর আকিদা প্রচারের ছদ্মাবরণে নিজেদের ভ্রান্ত আকিদা প্রচার। এদের যে কোন একটা ব্যাখ্য পড়লেই এই বাস্তবতা উপলব্ধি করবেন।
সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে ইমাম ত্বহাবী রহ. এর আকিদাকে বিকৃত করার লক্ষ্যে লিখিত একটি বেনামী ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৩৪৯ হিজরীতে। বে-নামী ব্যাখ্যা এজন্য বললাম, উক্ত ব্যাখ্যার উপর লেখকের নাম ছিল না। আর প্রশাকগণ নিশ্চিত ছিলেন না যে, ব্যাখ্যাগ্রন্থটি মূলত: কার। পরবর্তীতে তারা তত্ব-তালাশ করে উদ্ধার করেন, এটি ইবনে আবিল ইয আল-হানাফীর লেখা। বর্তমানে এটি ইবনে আবিল ইযের ব্যাখ্যা হিসেবে প্রচার করা হয়। আমাদের আলোচ্য বিষয় শিরোনাম থেকে কিছুটা স্পষ্ট। তবে দু’টি বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করার চেষ্টা করব। ১. ইবনে আবিল ইযের নামে প্রচারিত আকিদা কি আসলেই ইবনে আবিল ইযের লেখা?২. ইবনে আবিল ইযকে হানাফী হিসেবে প্রচার করা হয়। তিনি কি হানাফী ছিলেন না কি দেহবাদী আকিদায় বিশ্বাসী হাশাবী ছিলেন?
প্রচলিত আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যা কি ইবনে আবিল ইযের?
বিষয়টি বোঝার জন্য ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রকাশের ইতিহাসের দিকে ফিরে যেতে হবে। আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যাগ্রন্থটি ১৩৪৯ হিজরীতে মক্কায় সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়।
এই প্রকাশনায় কিতাবের উপর লেখকের কোন নাম ছিল না। বরং প্রকাশকরা লেখেন,
راجعنا ما في أيدينا من كتب التراجم والفنون، فلم نجد ما يمكننا معه الجزم بنسبته لشخص بعينه، وإنا نثبت هنا أسماء شارحي هذه العقيدة الذين عدهم صاحب كشف الظنون وهم سبعة ……. ومنهم صدر الدين علي بن محمد بن أبي العز الأذرعي الدمشقي الحنفي المتوفى سنة 746هـ وهو الذي يترجح الظن أنه الشارح” আমাদের কাছে বিদ্যমান বিভিন্ন জীবনীগ্রন্থ ও রিজালের কিতাবে আমরা অনুসন্ধান চালিয়েছি। আমরা এমন কোন তথ্য পাইনি, যার আলোকে সুনিশ্চিতভাবে ব্যাখ্যাগ্রন্থটিকে সুনির্দিষ্ট কোন লেখকের দিকে সম্পৃক্ত করা সম্ভব। কাশফুজ জুনুন এর লেখকের বক্তব্য অনুযায়ী আমরা এখানে আকিদাত্ব ত্বহাবীর সমস্ত ব্যাখ্যাকারের নাম উল্লেখ করছি। তারা হলেন সাতজন…….। এদের মাঝে একজন ব্যাখ্যাকার হলেন, সদরুদ্দিন আলী ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবিল ইয হানাফী (মৃত:৭৪৬ হি:)। আমাদের বিশেষ ধারণা হল, সাতজন ব্যাখ্যাকারের মাঝে তিনি হলেন আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাকার। “
এখানে প্রবল ধারণা হিসেবে সদরুদ্দিন আলী ইবনে মুহাম্মাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যার মৃত্যু তারিখ হল, ৭৪৬ হিজরী। আর বর্তমানে প্রচারিত ব্যাখ্যাকার হলেন, আলী ইবনে আলী ইবনে আবিল ইয। যার মৃত্যু তারিখ হল, ৭৯২ হিজরী। এখানে প্রবল ধারণা হিসেবে যার কথা বলা হয়েছে, তিনি হলেন বর্তমানে প্রচারিত লেখকের পিতা। ছেলে আর পিতা কখনও এক হতে পারে না। উভয়ের মৃত্যু তারিখ থেকেও বিষয়টি স্পষ্ট। মোটকথা, ব্যাখ্যাগ্রন্থটি কার সেটা সুনিশ্চিতভাবে বলার মত কোন তথ্য তখনকার উলামায়ে কেরাম পাননি। পরবর্তীতে সৌদি আরবের শায়খগণ বিখ্যাত আলেম আহমাদ শাকেরকে এটি তাহকীক করার অনুরোধ করেন। শায়খ আহমাদ শাকের পরবর্তীতে এটি তাহকীক করে প্রকাশ করেন।
তিনি এর ভূমিকায় লেখেন, ” এ কিতাবের যে মাখতুতা বা হস্তলিপি আমি পেয়েছি, সেখানে মূল লেখকের নেই। সুতরাং কিতাবের লেখক আসলে কে সেটা জানা সম্ভব হয়নি। ”
শায়খ আহমাদ শাকের তার ভূমিকায় কয়েকবার বলেছেন যে, তিনি এই কিতাবের নির্ভরযোগ্য কোন মাখতুতা বা হস্তলিপি পাননি।
তিনি তার সাধ্য অনুযায়ী এটি তাহকীক করার চেষ্টা করেছেন। শায়খ আহমাদ শাকের আশা ব্যক্ত করেছেন, তিনি যদি নির্ভরযোগ্য কোন হস্তলিপি পান, তাহলে পরবর্তীতে এটি সংশোধনের চেষ্টা করবেন।
শায়খ আহমাদ শাকের বলেন,
ولكني لا أزال أرى هذه الطبعة مؤقتة أيضا، حتى يوفقنا الله إلى أصل محفوظ للشرح صحيح، يكون عمدة في التصحيح فنعيد طبعه
“আমি এখনও মনে করি, এই সংস্করণ অস্থায়ী। আল্লাহ তায়ালা যদি নির্ভরযোগ্য বিশুদ্ধ কোন হস্তলিপি মিলিয়ে দেন, তাহলে এটি সংশোধন করে নতুনভাবে প্রকাশ করার করব। শায়খ আহমাদ শাকের আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. [মৃত: ১২০৫ হি:] এর একটি বক্তব্য পান ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিনে। সেখানে মোর্তজা যাবিদি রহ. ব্যাখ্যাকারের নাম লিখেছেন, আলী ইবনে আলী ইবনে মুহাম্মাদ আল-গাজ্জী আল-হানাফী। মোর্তজা যাবিদি রহ. এর উদ্ধৃতিতে লেখকের সঠিক পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি।
শায়খ আহমাদ শাকের বলেন, মোর্তজা যাবিদি রহ. লেখকের নামের নিসবতে ভুল করেছেন। তিনি লিখেছেন, আলী ইবনে আলী আল-গাজ্জী, বাস্তবে হওয়ার কথা ছিল, আলী ইবনে আলী ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী। মোটকথা, শায়খ আহমাদ শাকেরের সামনে মোর্তজা যাবিদি রহ. এর উদ্ধৃতি ছিল, বেশ কয়েকটি মাখতুতা ছিল এরপরেও ব্যাখ্যাকার সম্পর্কে সুনিশ্চিতভাবে বলেননিন যে, অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে, উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের লেখক ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী। শায়খ আহমাদ শাকের মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্যের আলোকে তার ধারণা অনুযায়ী কিতাবে লেখকের নাম লিখেছেন, আলী ইবনে আলী ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী। পরবর্তীতে মাকতাবাতুল ইসলামী থেকে শায়খ আলবানীর তাহকীকে ব্যাখ্যাগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। সেখানে কিছু মাখতুতা বা হস্তলিপি এর চিত্র দেয়া হয়েছে। এসকল হস্তলিপিতে স্পষ্টভাবে লেখকের নাম লেখা হয়েছে, আলী ইবনে মুহাম্মাদ। যার মৃত্যু তারিখ, ৭৪৬ হি:। সুতরাং মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্য অনুযায়ী, লেখকের নাম হওয়ার কথা ছিল, আলী ইবনে আলী আল-গাজ্জী। মাকতাবাতুল ইসলামী এর মাখতুতা অনুযায়ী, লেখকের নাম আলী ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবিল ইয। সুতরাং একথা সুনিশ্চিতভাবে বলার অবকাশ নেই যে, উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের প্রকৃত লেখক কে। এরপরেও শায়খ আলবানী ও যুহাইর আশ-শাবীশ দাবী করেন, সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হল, উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের লেখক ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী।
শায়খ যুহাইর আশ-শাবীস নবম সংস্করণের ভূমিকায় ( পৃ.৯) লিখেছেন,
وأما نسختنا فقد كان اسم مؤلفها مثبتا على الورقة الأولى منها، إلا أن بعض الأيدي قد لعبت فيه بالمحو والكتابة أكثر من مرة، وأخيرا أثبت عليه ما أثبته الشيخ أحمد شاكرঅর্থ: আমাদের মূল হস্তলিপিতে লেখকের নাম প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা ছিল। তবে অজ্ঞাত কেউ উক্ত নাম কয়েকবার ঘষা-মাজা করে নতুনভাবে লিখেছে। অবশেষে আমি শায়খ আহমাদ শাকেরের তথ্য অনুযায়ী লেখকের নাম উল্লেখ করেছি।মোটকথা, এই ব্যাখ্যাগ্রন্থের মূল হস্তলিপিতে লেখকের নাম উল্লেখ নেই। পরবর্তীতে বিভিন্ন ঘষা-মাজার মাধ্যমে অজ্ঞাত কেউ হস্তলিপিতে লেখকের নাম সংযুক্ত করেছে। ঘষা-মাজা করে নাম সংযুক্ত করার পরও বর্তমানে প্রচলিত লেখকের নাম উক্ত হস্তলিপিতে নেই। বরং প্রচলিত লেখকের পিতার নাম ও তার মৃত্যু তারিখ দেয়া রয়েছে।
চূড়ান্ত কথা:
ইবনে আবিল ইয এধরণের ব্যাখ্যাগ্রন্থ লেখাটা অসম্ভব নয়। প্রবল ধারণা মতে হয়ত তিনি এটি লিখেছেন। কিন্তু ইবনে ইয এর লেখক হওয়ার ব্যাপারে অকাট্য কোন প্রমাণ কারও কাছে নেই, যার আলোকে নি:সন্দেহে বলা যাবে, এটি ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী লিখেছেন। ইবনে আবিল ইয আল-হানাফীর জীবনী থেকে একটা ধারণা সৃষ্টি হয়, হয়ত তিনি এটি লিখেছেন। আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. এর উদ্ধৃতি থেকে হয়ত ধারণাটি আরেকটু মজবুত হয়। কিন্তু এটা সুনিশ্চিত বা অকাট্য কোন প্রমাণ বলার সুযোগ নেই। উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের লেখক ইবনে আবিল ইয হলেও আমাদের কোন আপত্তি নেই। না হলেও এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই। কিতাবটি ছেলে লিখেছে না কি তার পিতা লিখেছে সেটাও মৌলিক কোন বিষয় নয়।
আমাদের নিকট মূল বিবেচ্য বিষয় হল, ইবনে আবিল ইযকে হানাফী হিসেবে প্রচার করা হয়। সেই সাথে এটাও বোঝানো হয় যে, তিনি হানাফীদের আকিদার প্রতিনিধত্ব করেন। অন্যান্য হানাফীগণ তার বিরোধীতা করে মূলত: হানাফীদের মৌলিক আকিদার বিরোধিতা করে থাকে।
আমাদের সামনে মৌলিক কয়েকটি প্রশ্ন দেখা দিয়েছে,
১. ইবনে আবিল ইয বাস্তবেই কি হানাফী ছিলেন?
২. তিনি আদৌ কি হানাফী মাজহাবের সুপ্রতিষ্ঠিত আকিদার অনুসারী ছিলেন?৩. তার লেখা ব্যাখ্যাগ্রন্থ ইমাম ত্বহাবী বা হানাফী মাজহাবের মৌলিক আকিদার প্রতিনিধিত্ব করে কি?৪. ইবনে আবিল ইযের আকিদা হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমদের নিকট নির্ভরযোগ্য কি?
৫. ইবনে আবিল ইযকে হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণ নির্ভরযোগ্য আলেম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন কি?
৬. হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণ ইবনে আবিল ইযের আকিদার সাথে সহমত পোষণ করেন না কি তার প্রবল বিরোধীতা করেন?
৭. হানাফী মাজহাবের উলামায়ে কেরামের জীবনীর উপর বিভিন্ন গ্রন্থ লেখা হয়েছে। এসকল কিতাবে হানাফী আলেম হিসেবে তার জীবনী বা নির্ভরযোগ্য আলেম হিসেবে কোথাও তস্বীকৃতি দেয়া হয়েছে কি?আমরা ইনশাআল্লাহ প্রত্যেকটি বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করব।
ইবনে আবিল ইযের মাজহাব:
শরহে আকিদাতু ত্বহাবীর তাহকীক করেছেন, শায়খ শুয়াইব আরনাউত ও শায়খ আব্দুল্লাহ তুরকী। তারা উক্ত তাহকীকে ইবনে আবিল ইযের জীবনী আলোচনা করেছেন। তার জীবনী আলোচনা করতে গিয়ে তারা লিখেছেন, ইবনে আবিল ইযকে হানাফী মাজহাবের দিকে সম্পৃক্ত করা হয়। তবে বাস্তবে তিনি নিজের গর্দানকে তাকলীদের (মাজহাব অনুসরণ) বন্ধন থেকে মুক্ত করেন। শায়খ শুয়াইব আরনাউত ও শায়খ আব্দুল্লাহ তুরকীর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ইবনে আবিল ইয একজন গাইরে মুকাল্লিদ, লা-মাজহাবী বা যাহেরী ছিল।
ইবনে আবিল ইয পারিবারিকভাবে হানাফী ছিল। যেমন শায়খ আলবানী পারিবারিকভাবে হানাফী ছিল। কিন্তু কেউ হানাফী পরিবারে জন্মগ্রহণ করলে, কিংবা হানাফী মাদ্রাসায় পড়লে বা পড়ালে সে হানাফী হয়ে যায় না। আমাদের দেশের অধিকাংশ লা-মাজহাবী হানাফী পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও তারা গাইরে মুকাল্লিদ। একইভাবে বর্তমানে আহলে হাদীসদের অধিকাংশ শায়খ হানাফী মাজহাবের মাদ্রাসায় পড়া-লেখা করেছে, কিন্তু তারা হানাফী নয়। সুতরাং কারও হানাফী হওয়াটা তার পরিবার, পিতা-মাতা বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করে না। ইবনে আবিল ইয জন্মগতভাবে হানাফী হলেও বাস্তবে সে হানাফী নয়। বরং ইবনে আবিল ইয একজন গাইরে মুকাল্লিদ বা লা-মাজহাবী।সুতরাং তাকে হানাফী হিসেবে প্রচার করে তাকে হানাফী মাজহাব বা আকিদার প্রতিনিধি হিসেবে প্রকাশ করা একটি মারাত্মক ভুল।
যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেই যে, ইবনে আবিল ইয হানাফী ফিকহের অনুসারী ছিল, কারণ সে হানাফী মাজহাবের মাদ্রাসায় শিক্ষতা করেছে, তাহলে এটি কখনও বলা সম্ভব নয় যে, সে আকিদার দিক থেকেও হানাফী ছিলা। মু’তাজিলা সম্প্রদায়ের অনেকেই হানাফী মাজহাবের অনুসারী ছিল, কিন্তু তাদের কাউকে হানাফী বলা হয় না। একইভাবে কাররামিয়াদের অনেকেই হানাফী মাজহাব অনুসরণ করত। কিন্তু তাদেরকেও হানাফী বলা হয় না। ফিকহের দিক থেকে কেউ হানাফী ফিকহ অনুসরণ করলেই তাকে হানাফী হিসেবে পরিচয় দেয়া হয় না। কারণ হানাফী হিসেবে কারও পরিচিতি এটা প্রমাণ করে যে, সে আকিদা ও ফিকহ উভয় ক্ষেত্রে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অন্তর্ভূক্ত। কেউ যদি ফিকহের ক্ষেত্রে হানাফী মাজহাব অনুসরণ করে, কিন্তু আকিদার ক্ষেত্রে আহলে সু্ন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত আকিদা পোষণ করে তাকে হানাফী বলা হয় না। বরং আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত আকিদার দিকে তাকে সম্পৃক্ত করা হয়। কাররামিয়া মতবাদের অনুসারী কারও নামের শেষে হানাফী লাগিয়ে দিয়ে আকিদা ও ফিকহে তাকে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অন্তর্ভূক্ত করার অপচেষ্টা কেউ করলে সেটি অবশ্যই বাস্তবতা বিরোধী। সুতরাং ফিকহ ও আকিদা উভয় ক্ষেত্রে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত ইবনে আবিল ইযকে কীভাবে হানাফী হিসেবে পরিচয় দেয়া হয়? তার বাহ্যিক অবস্থা বিবেচনা করে হানাফী লিখলেও তাকে যদি কেউ হানাফী ফিকহ বা আকিদার প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন করে, তাহলে অবশ্যই আমরা বলব, প্রকৃতপক্ষে ইবনে আবিল ইয ফিকহ ও আকিদা কোন ক্ষেত্রেই হানাফী ছিল না। বরং সে কাররামিয়াদের অনুসারী হাশাবী বা দেহবাদী আকিদায় বিশ্বাসী ছিল। ইবনে আবিল ইযের যেসকল কিতাব তার দিকে সম্পৃক্ত করা হয়, তার প্রত্যেকটি সে হানাফী মাজহাবের বিরুদ্ধে লিখেছে। হানাফী মাজহাবের পক্ষে তার বিশেষ কোন খেদমত নেই।
ইবনে আবিল ইযের গাইরে মুকাল্লিদ হওয়ার আরেকটি প্রমাণ হল, তার একটি কিতাব বর্তমানের আহলে লা-মাজহাবীরা প্রচার করে থাকে। আহলে হাদীস আলেম আতাউল্লাহ হানীফ ইবনে আবিল ইযের “আল-ইত্তেবা” কিতাবটি তাহকীক করে প্রকাশ করেছে। পরবর্তীতে আবু সুহাইব আসিম ইবনে আব্দুল্লাহ আল-কারইউতী এটি তাহকীক করেছে। আবু সুহাইব এই কিতাবের ভূমিকায় হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেম আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. ও আল্লামা যফর আহমাদ উসমানী রহ. এর বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছে এবং এসমস্ত বিখ্যাত আলেমদের বিরুদ্ধে ইবনে আবিল ইযের বক্তব্য উপস্থাপন করেছে। যেখানে ইবনে আবিল ইয সুনিদিষ্ট একটি মাজহাবের অনুসারীকে শিয়াদের সাথে তুলনা করেছে। নাউযুবিল্লাহ। ইবনে আবিল ইযের অবস্থা থেকে বাংলা ভাষার প্রসিদ্ধ একটি প্রবাদবাক্য মনে পড়ে গেল। “মার চেয়ে মাসির দরদ বেশি” ।ইবনে আবিল ইযের প্রতি সালাফী ও আহলে হাদীসদের অতিশয় আগ্রহ এটিই প্রমাণ করে। বর্তমানের সালাফীরা হানাফী মাজহাবের উলামায়ে কেরামকে তাদের আকিদার বিরোধী হওয়ার কারণে কাফের, বিদযাতী, জাহমী, মুয়াত্তিলা ইত্যাদি আখ্যায়িত করে। এ বিষয়ে অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। হানাফী মাজহাবের অধিকাংশ আলেম যাদের কাছে কাফের ও বিদয়াতী, তারাই ইবনে আবিল ইযের আকিদা প্রচার করছে। আবার উপমহাদেশের লা-মাজহাবীরা মাজহাবের অনুসারীদেরকে মুশরিক বলে বিশ্বাস করে, অথচ তারাই আবার ইবনে আবিল ইযের কিতাব প্রকাশ ও প্রচার করছে। ইবনে আবিল ইয আসলেই যদি হানাফী হত, তাহলে হানাফীদেরকে যারা কাফের-মুশরিক আখ্যা দিচ্ছে, তারা কেন তার কিতাব নিয়ে এত মাতামাতি করে?
ইবনে আবিল ইয সম্পর্কে হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণের বক্তব্য:
মোল্লা আলী কারী রহ. এর বক্তব্য:
মোল্লা আলী কারী রহ. শরহে ফিকহুল আকবারে আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যাকার সম্পর্কে লিখেছেন,
والحاصل ان الشارح يقول بعلو المكان مع نفي التشبيه وتبع فيه طائفة من أهل البدعة
মোটকথা, আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যাকার তাশবীহমুক্ত অবস্থায় আল্লাহ তায়ালা স্থানগতভাবে উপরের দিকে রয়েছেন বলে বিশ্বাস করে। এক্ষেত্রে সে একদল বিদয়াতীর অনুসরণ করেছে। তিনি আরও বলেন,
و من الغريب أنه إستدل على مذهبه الباطل برفع الأيدي في الدعاء إلى السماء
অর্থ: আশ্চর্যের বিষয় হল, সে তার ভ্রান্ত মতবাদ প্রমাণ করতে গিয়ে দুয়ার সময় হাত উপরের দিকে উঠানোর দলিল দিয়েছে। (শরহুল ফিকহিল আকবার, পৃ.১৭২. আল-ইলিময়া)মোল্লা আলী কারী রহ. এর বক্তব্য থেকে দু’টি বিষয় স্পষ্ট। তিনি ইবনে আবিল ইযকে বিদয়াতীদের অনুসারী বলেছেন। এবং তার মতবাদকে বাতিল বা ভ্রান্ত মতবাদ আখ্যায়িত করেছেন।
আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্য:
আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিনে ইবনে আবিল ইয সম্পর্কে লিখেছেন,
“ولما تأملته حق التأمل؛ وجدته كلامًا مخالفًا لأصول مذهب إمامه!! وهو في الحقيقة كالرد على أئمة السنة، كأنه تكلم بلسان المخالفين، وجازف وتجاوز عن الحدود، حتى شبه قول أهل السنة بقول النصارى! فليتنبه لذلك”.
অর্থ: আমি তার (ইবনে আবিল ইযের) বক্তব্য সম্পর্কে পরিপূর্ণ চিন্তা-ভাবনা করে দেখেছি, তার বক্তব্য তার ইমামের মাজহাবের মৌলিক নীতিমালার সম্পূর্ণ বিরোধী। বরং প্রকৃতপক্ষে তার বক্তব্য যেন আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের ইমামগণের বক্তব্য খন্ডনে লিখিত। তার বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয়, সে যেন আহলে সুন্নতের ইমামগণের সাথে প্রতিপক্ষ হিসেবে কথা বলেছে। সে মারাত্মক বিকৃতির শিকার হয়েছে এবং সীমা অতিক্রম করেছে। এমনকি সে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের ইমামগণের বক্তব্যকে খ্রিষ্টানদের বক্তব্যের সাথে তুলনা করেছে। সুতরাং এ বিষয় সতর্ক থেক। [ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিন, খ.২, পৃ.১৪৬]
আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্য থেকে যেসকল বিষয় স্পষ্ট:
১. ইবনে আবিল ইয হানাফী মাজহাবের মৌলিক নীতিমালা অনুসরণ করত না।
২. তার লেখনী মূলত: হানাফী মাজহাব ও আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের বক্তব্য খন্ডনের উদ্দেশ্যে লিখিত।৩. হানাফী মাজহাব ও আহলে সুন্নতের উলামায়ে কেরামের সাথে যেন সে প্রতিপক্ষ হিসেবে কথা বলেছে।
৪.সে মারাত্মক প্রগলভতার শিকার হয়ে সীমা অতিক্রম করেছে।
৫. আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের উলামায়ে কেরামের বক্তব্যকে খ্রিষ্টানদের বক্তব্যের সাথে তুলনা করেছে।
৬. আল্লামা যাবিদি রহ. তার এসব বক্তব্যের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেছেন।
আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. এর বক্তব্য:
হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত ইমাম আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাকার সম্পর্কে বলেন,
وطبع شرح لمجهول ينسب إلى المذهب الحنفي زورا ينادي صنع يده بأنه جاهل بهذا الفن وأنه حشوي مختل العيار
“আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যা হিসেবে একজন অজ্ঞাত ব্যক্তির একটি ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। যাকে বানোয়াটী করে হানাফী মাজহাবের দিকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এ লোকের লেখনী দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করে যে সে আকিদা সম্পর্কে অজ্ঞ। সে একজন হাশাবী বা দেহবাদী এবং মারাত্মক বিচ্যুতির শিকার। “[আল-হাবী ফি সিরাতিল ইমামিত ত্বহাবী, পৃ. ৩৮]আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. এর বক্তব্য থেকে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট। প্রথমত: ইবনে আবিল ইযকে হানাফী মাজহাবের দিকে সম্পৃক্ত করা একটি বানোয়াট বা মিথ্যা। বাস্তবে সে হানাফী ছিল না। দ্বিতীয়ত: ইবনে আবিল ইয আকিদা বিষয়ে জাহেল বা অজ্ঞ ছিল এবং সে একজন মুজাসসিমা বা দেহবাদী আকিদার অনুসারী হাশাবী ছিল। আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. এর বক্তব্য অনুযায়ী আমরা ইবনে আবিল ইযকে হানাফী না বলে দেহবাদী আকিদার অনুসারী হাশাবী বলতে পারি।
ইবনে আবিল ইযের সম-সাময়িক আলেমগণের বিরোধীতা:ইবনে আবিল ইযের ভ্রান্ত কিছু বক্তব্য প্রকাশিত হওয়ার তখনকার বিখ্যাত আলেমগণ তার প্রতিবাদ করেন। বিশেষভাবে অন্যান্য তিন মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণের সাথে হানাফী মাজহাবের আলেমগণও তার প্রতিবাদ করেন।
আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহ. তার ‘ইম্বাউল গুমর বি আবনায়িল উমর’ কিতাবে লিখেছেন,
وأن العلماء بالديار المصرية خصوصا أهل مذهبة من الحنفية أنكرواذلك عليه
অর্থ: মিশরের আলেমগণ বিশেষভাবে তার মাজহাব তথা হানাফী মাজহাবের উলামায়ে কেরাম তার বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন। [ইমবাউল গুমর, খ.২, পৃ.৯৬]
যেসব উলামায়ে কেরাম ইবনে আবিল ইযের বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন, এদের মাঝে বিখ্যাত কিছু আলেমের নাম উল্লেখ করেছেন ইবনে হাজার আসকালানী রহ.। যেমন, যাইনুদ্দীন ইবনে রজব রহ, তকীউদ্দীন ইবনে মুফলিহ রহ. শরফুদ্দীন ইবনে গাজ্জী রহ. ।
বর্তমানে সালাফীরা ইবনে আবিল ইযের আরেকটি কিতাব প্রকাশ করেছে। কিতাবের নাম হল, আত-তাম্বীহ আলা মুশকিলাতিল হিদায়াহ। সালাফী আলেমরা ইবনে আবিল ইযের রচনা হিসেবে এটি প্রকাশ করেছে। যদিও কিতাবটি ইবনে আবিল ইযের নাকি তার দাদার এটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সালাফীদের বক্তব্য অনুযায়ী কিতাবটি যদি ইবনে আবিল ইযের হয়, তাহলে তার সম্পর্কে হানাফী মাজহাবের আরও কিছু উলামায়ে কেরামের বক্তব্য শুনুন।
ইমাম সাখাবী রহ. তার আজ-জাওউল লামে কিতাবে লিখেছেন, হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত ইমাম কাসেম ইবনে কুতলুবুগা ইবনে হেদায়া কিতাবের উপর ইবনুল ইযের অভিযোগ খন্ডন করে কিতাব লিখেছেন। “صنّف “أجوبةً عن اعتراضات ابن العزّ على الهداية”[আজ-জাওউল লামে, খ.৬, পৃ.১৮৭]
সালাফীরা ইবনে আবিল ইযের উক্ত কিতাবকে হেদায়ার ব্যাখ্যা হিসেবে প্রচারের চেষ্টা করলেও এটি মূলত: হেদায়া কিতাবের উপর তার অভিযোগ সংকলন। একারণে আল্লামা কাসেম ইবনে কুতলুবুগা তার অভিযোগ খন্ডন করেছেন। একইভাবে আল-বাহরুর রায়েকে রয়েছে ফাতহুল কাদীরে আল্লামা ইবনুল হুমাম ইবনুল ইযের বক্তব্য খন্ডন করেছেন।
وَقَدْ أَطَالَ فِي فَتْحِ الْقَدِيرِ فِي بَيَانِهِ إطَالَةً حَسَنَةً وَتَعَرَّضَ لِلرَّدِّ عَلَى ابْنِ الْعِزِّ، وَلَسْنَا بِصَدَدِ ذَلِكَ
[আল-বাহরুর রায়েক, বাবুল ইয়ামীন ফিল আকলি ওয়াশ শুরব]
সালাফীদের বক্তব্য অনুযায়ী আত-তাম্বীহ আলা শরহিল হেদায়া কিতাবটি যদি আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাকার ইবনে আবিল ইযের হয়, তাহলে তার বক্তব্য আল্লামা হাসকাফী ও আল্লামা ইবনে আবিদীন খন্ডন করেছেন। তার বক্তব্যকে গরীব (আশ্চর্যজনক) আখ্যা দিয়েছেন। বিস্তারিত,
“قال (ابن العز!): فحينئذ ينقض الوضوء، وهو فرع غريب وتخريج ظاهر.قال المصنف: ولظهوره عوّلنا عليه.قلت: قال شيخنا الرملي حفظه الله تعالى: كيف يعول عليه وهو مع غرابته لا يشهد له رواية ولا دراية، أما الاولى فظاهر إذا لم يرو عن أحد ممن يعتمد عليه، وأما الثانية فلعدم تسليم المقدمة الاولى ويشهد لبطلانها مسألة الجدي إذا غذي بلبن الخنزير فقد عللوا حل أكله بصيرورته مستهلكا لا يبقى له أثر، فكذلك نقول في عرق مدمن الخمر، ويكفينا في ضعفه غرابته”.[রদ্দুল মুহতার, খ.৬, পৃ.১৪৬-১৪৭]
আকিদার ক্ষেত্রে ইবনে আবিল ইযের বিচ্যুতি সুস্পষ্ট। অধিকাংশ বিষয়ে সে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত আকিদা পোষণ করে। এবং কাররামিয়া ও মুজাসসিমাদের ভ্রান্ত বক্তব্য প্রচার করেছে। আকিদাতুত ত্বহাবীর সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা ভিডিও আকারে প্রকাশের নিয়ত রয়েছে। আমাদের আলোচনায় ইবনে আবিল ইযের ভ্রান্ত মতবাদগুলি বিস্তারিত উল্লেখ করা হবে ইনশাআল্লাহ। এখানে সংক্ষেপে দু’একটি বিষয় উল্লেখ করা মুনাসিব মনে করছি। এসকল বিষয়ের কয়েকটি কুফুরী পর্যায়ের। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করেন।
১. কিছু সৃষ্টি কাদীম বা অবিনশ্বর। অনাদী থেকেই বিদ্যমান। এটি তাসালসুলুল হাওয়াদিস নামে পরিচিত। [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.১২৯, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]
২. আল্লাহ তায়ালার হদ বা সীমা রয়েছে। [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.২১৯, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]
৩. আল্লাহর সত্তার মাঝে নশ্বর বিষয় সৃষ্টি হয়। [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.১৭৭, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]
৪. আল্লাহর বক্তব্যের অক্ষর ও শব্দ রয়েছে। [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.১৬৯, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]
৫. আল্লাহ তায়ালা স্থানগতভাবে উপরের দিকে রয়েছেন। অর্থাৎ আল্লাহর দিক রয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে দেহবাদী আকিদার ভ্রান্তি থেকে হেফাজত করুন। আমীন।
------ ------
ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের মাঝে সর্বপ্রধান বিষয় হল, আল্লাহর তাওহীদ তথা একত্বের উপর ঈমান আনয়ন করা। এই বিশ্বাস করা যে, সৃষ্টা হিসেবে তিনি একক, গুণাবলীর বিবেচনায় তিনি একক এবং উপাসনার যোগ্য একমাত্র তিনিই। পবিত্র কুরআন ও রাসূল (সঃ) এর সমস্ত হাদীস তাওহীদ তথা আল্লাহর এককত্বের উপর ভিত্তি করেই আবর্তিত। কোন বিষয়ে আল্লাহর সমকক্ষ বা অংশীদার নেই, এটিই এ বিশ্বাসের মূলমন্ত্র। পবিত্র কুরআনের ১১২ নং সূরায় এ বিষয়টি সুষ্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষিত হয়েছে। সে প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর অস্তিত্ব অনুভব করে এবং আল্লাহর এককত্বের স্বাক্ষর প্রদান করে।
আমরা এখানে আল্লাহর এককত্বের উপর পাঁচটি যুক্তি উপস্থাপন করব।
কুরআন স্পষ্টভাষায় জিজ্ঞাসা করেছে, এই মহাবিশ্ব কি এমনিতেই সৃষ্টি হয়েছে? এর উত্তর খুবই সহজ ও স্পষ্ট। কেননা ভৌত পদার্থবিদ্যা এবং সকল দর্শন এবিষয়ে একমত যে, যে বস্তু অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এসেছে, তার অস্তিত্বের পিছে একটি কজ বা কারণ রয়েছে। আর মহাবিশ্ব যেহেতু অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এসেছে এজন্য এর পিছে একটি কারণ বা কজ রয়েছে। মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পিছে একটি সামগ্রিক কজ বা কারণ থাকাটাই যুক্তিযুক্ত। অসীম সংখ্যক কারণ থাকাটা অসম্ভব। কেননা বাস্তবে কখনও অসীম কোন কিছু থেকে আমরা কোন ফলাফল লাভ করি না।
উদাহরণ হিসেবে নীচের দু’টি বিষয় লক্ষ্য করুণ-
১. কোন কক্ষে যদি অসীম সংখ্যক মানুষ থাকে এবং সেখান থেকে যদি আমি দু’জনকে বাদ দেই, তাহলে কতজন থাকবে? আপনি উত্তর দিবেন, অসীম বিয়োগ দুই। অর্থাৎ অসীম থেকে দু’জনকে বাদ দিলে যা থাকে। এর দ্বারা বাস্তবে কোন অর্থ বোঝায় কি? অসীম থেকে যদি দুজনকে বাদ দেয়া হলেও কক্ষে অসীম সংখ্যক মানুষই থেকে যাবে। বাস্তবে এটি বিশেষ কোন অর্থ প্রদান করে না। আপনাকে যদি কক্ষের অসীম সংখ্যক লোক গণনা করতে বলা হয়, আপনার পক্ষে তা গণনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু লোকসংখ্যা যদি অসীম থেকে সামান্য কমিয়ে গণনা করতে বলা হয়, তবুও আপনার পক্ষে তা গণনা করা সম্ভব নয়। এর অর্থ হল, বাস্তব জীবনে অসীম সংখ্যা থেকে বিশেষ অর্থ বোঝা সম্ভব নয়।
২. মনে করুন, আমি একজন সৈনিক। আমি একটা শত্রুকে গুলি করতে চাই। আমার গুলি করার জন্য আমার পেছনের সৈনিকের অনুমতি নেয়া প্রয়োজন। আমার পিছের সৈনিকের জন্য আবার তার পেছনের সৈনিকের অনুমতি প্রয়োজন। এভাবে এ ধারা যদি চলতে থাকে এবং আমার গুলি করার জন্য অসীম সংখ্যক সৈনিকের অনুমতির প্রয়োজন হয়, তবে আমি কি আদৌ শত্রুকে গুলি করতে পারব? উত্তর খুবই সহজ ও স্বাভাবিক। একইভাবে আমি মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পিছে যদি অসীম সংখ্যক কারণ ধরে নেই, তবে আদৌ মহাবিশ্বের অস্তিত্ব সম্ভব হত না। এবং কখনও এটি অস্তিত্বে আসত না। সুতরাং মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পিছে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বাধীন ও একক কারণ থাকাটাই যুক্তিসঙ্গত।
আপনি এ যুক্তি দেখাতে পারেন যে, উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্য তথা স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বাধীন একাধিক কারণ একই সাথে ক্রিয়াশীল হলে সমস্যা কোথায়?
আমি বলব, আপনার এ যুক্তিটা খুবই দুর্বল প্রকৃতির। চতুর্দশ শতাব্দীর দার্শনিক অকহ্যাম রেজর এর তত্ত্বের মাধ্যমে আপনার এ যুক্তির অসারতা প্রমাণিত হয়। অকহ্যাম রেজরের নীতি হল, প্রয়োজন ছাড়া বহু সংখ্যার ব্যবহার অনুচিৎ। আরেকটু সহজ করে বললে এভাবে বলা যায়, সবচেয়ে সরল ও সর্বাধিক অর্থবহ ব্যাখ্যা হল, সর্বোত্তম ব্যাখ্যা।
অতএব, কোন প্রমাণ ছাড়া কিংবা প্রয়োজন ছাড়া আমরা এটা বলতে পারি না যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির পিছে অনেকগুলো কারণ ক্রিয়াশীল। সুতরাং এক্ষেত্রে আমাদেরকে সবচেয়ে অর্থবহ ও সরল কারণ তথা মহাবিশ্ব সৃষ্টির একক কারণকেই গ্রহণ করতে হবে। কেননা এক্ষেত্রে আমাদেরকে কাছে কোন প্রমাণ নেই যে আমরা বলতে পারি, মহাবিশ্বের সৃষ্টি মূলতঃ দুটি, তিনটি, কিংবা কয়েক হাজার কারণের কম্বিনেশন বা সমন্বয়। একাধিক কারণ গ্রহণের দ্বারা একটি স্বাধীন, স্বয়ংসম্পূর্ণ কারণে অতিরিক্ত কোন মাত্রা যোগ হয় না।
যেমন, যখন বলা হল, মহাবিশ্ব একটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কারণের দ্বারা সৃষ্ট, এ কথা দ্বারা যে অর্থ স্পষ্ট হয়েছে, যদি বলা হয়, মহাবিশ্ব দু’টি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কারণের দ্বারা সৃষ্ট, এ কথার দ্বারা অতিরিক্ত কোন অর্থ প্রকাশ পায় না। কেননা আমি যখন বলছি, কারণটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী তখন অন্য কোন সর্বময় ক্ষমতার প্রয়োজন নেই। কারণটি যদি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী না হত, তবে সাহায্যকারী হিসেবে অন্য কোন কারণের প্রয়োজন পড়ত। এক্ষেত্রে কোন কারণই তখন স্বাধীন বা স্বয়ংসম্পূর্ণ কারণ থাকবে না।
সুতরাং মহাবিশ্ব সৃষ্টির পিছে আমাদের মূলতঃ একটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কারণের প্রয়োজন ছিল এবং এটুকুই যথেষ্ট কেননা কারণটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।
যুক্তির দাবি হল, মহাবিশ্ব সৃষ্টি যদি অনেক প্রভূ থাকত, তবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে মহাবিশ্ব ধ্বংস হয়েছে। এবং আমরা মহাবিশ্বে যে সুষম শৃঙ্খলা ও নিয়মতান্ত্রিকতার সর্বোচ্চ সমাবেশ লক্ষ্য করে থাকি, অনেক প্রভূ থাকলে তা পরিলক্ষিত হত না।
আপনি যুক্তি দেখাতে পারেন, আপনার গাড়িটি তৈরি করে অনেক মানুষ। যেমন, কেউ গাড়ীর বডি তৈরি করে, কেউ ইঞ্জিন আবার কেউ চাকা। কিন্তু পূর্ণ গাড়িটি তৈরি হলে সেটি একটি সুন্দর ও সুষম গাড়ি হয়ে থাকে। অতএব, একটি সৃষ্ট বস্তুর অনেক স্রষ্টা থাকলেও সেটি ভারসাম্যপূর্ণ হতে পারে।
আপনার এ প্রশ্নের উত্তর হল, মহাবিশ্ব সৃষ্টির পিছে আমরা যে কারণটি উল্লেখ করেছি সেটি হল, এমন একজন প্রভূ যিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং ইচ্ছার ক্ষেত্রে এককভাবে স্বাধীন। কেননা প্রভূ তো তিনিই হবেন, যার অসীম প্রয়োগিক ইচ্ছা রয়েছে। যদি অনেক প্রভূ থাকত, তবে প্রত্যেকের ইচ্ছা প্রয়োগের প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হত, আর এটিই মহাবিশ্বে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণ হতো।
আপনি যুক্তি দেখাতে পারেন, এ সম্ভাবনা রয়েছে যে, অনেকগুলো প্রভূ একটি বিষয়ে একমত পোষণ করতে পারে। অথবা এক একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে তাদের পৃথক পৃথক ক্ষমতা থাকবে। এক্ষেত্রে আমরা বলব, এ ধরণের প্রভূর ইচ্ছা অসীম ও স্বাধীন নয়। ফলে এরা প্রভূ হওয়ার যোগ্য নয়। সার কথা হল, যদি দু’জন স্রষ্টা থাকে, এবং তারা কোন বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে, যেমন একজন ক নামক ব্যক্তিকে স্থির রাখতে চাচ্ছে, আরেকজন তাকে গতিশীল করতে চাচ্ছে। অথবা একজন প্রভূ খ কে জীবন্ত প্রাণি বানাতে চাচ্ছে, আরেকজন চাচ্ছে যে, এটি জড়পদার্থ হিসেবে অবস্থান করবে।
যুক্তির আলোকে যদি বিশ্লেষণ করা হয়, তবে এখানে তিনটি অবস্থার কোন একটি ঘটতে বাধ্য-
১. উভয় প্রভূর ইচ্ছা বহাল রাখা হবে এবং তা বাস্তবায়ন করা হবে।
২. শুধু তাদের একজনের ইচ্ছা বহাল রাখা হবে।
৩. তাদের কারও ইচ্ছায় বাস্তবায়ন করা হবে না।প্রথমটি সম্ভব নয়।
কেননা এক্ষেত্রে দু’টি বিপরীত বিষয় একই সাথে অস্তিত্ব লাভ করা আবশ্যক হবে। যা অসম্ভব। অর্থাৎ একই সাথে একটি বস্তু জীবিত ও মৃত হতে পারে না। তৃতীয় বক্তব্যও বাতিল হয়ে যাবে। কেননা এর দ্বারা এটা আবশ্যক হয় যে, একটি বস্তু গতিশীলও না, আবার স্থিরও না। একইভাবে একটি বস্তু জীবিতও না, আবার মৃত না। আর এটি অসম্ভব। সাথে সাথে তাদের কারও ইচ্ছায় যদি বাস্তবায়ন করা না হয়, তখন তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, তাদের কেউ-ই নিজ ইচ্ছা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম নয়। ফলে প্রত্যেকেই প্রভূ হওয়ার যোগ্যতা হারাবে।
দ্বিতীয় বক্তব্য অনুযায়ী, যদি দু’জনের মধ্য থেকে একজনের ইচ্ছা বাস্তবায়ন করা হয়, এবং অপরজনের ইচ্ছা পরিত্যাগ করা হয়, তবে তিনিই হবেন একক প্রভূ। যার ইচ্ছা পরিত্যাগ করা হয়েছে, সে প্রভূ হওয়ার যোগ্য থাকবে না। উপর্যুক্ত বক্তব্য দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, এই ভারসাম্যপূর্ণ মহাবিশ্বের একজন মাত্র প্রভূ থাকা সম্ভব, যিনি অসীম ইচ্ছার অধিকারী এবং একক ক্ষমতার অধিকারী।
আমরা কিভাবে দু’টি জিনিসকে পরস্পর থেকে পৃথক করে থাকি? দু’জন ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে আমরা তাদের মধ্যে পার্থক্য করি কীভাবে। এর উত্তর হল, আমরা এটা করে থাকি, কনসেপ্চুয়াল ডিফারেনসিয়েশন বা ধারণাগত বৈচিত্রের মাধ্যমে। এই ধারণাগুলো হল, স্থান, পারম্পরিক দূরত্ব, গঠন ও আকার-আকৃতিগত তারতম্য।
আমরা যে কোন দু’টি বস্তুর মাঝে পার্থক্য করতে পারি, তাদের পারস্পরিক দূরত্ব, বর্ণ ও আকার-আকৃতিগত বৈচিত্রের মাধ্যমে। দু’টি বিষয়ের মধ্যে যখন উপরোক্ত বিষয়গুলো না পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে কি আপনি উক্ত বস্তু দু’টির মাঝে কোন পার্থক্য করতে সক্ষম হবেন? আপনি পারবেন না। এবিষয়টি শুধু দু’য়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং অসংখ্য বস্তুর ক্ষেত্রে পার্থক্য নির্ণয় করতে হলে, উপরোক্ত বিষয়গুলো থাকা আবশ্যক।
প্রাসঙ্গিকভাবে বলে নেয়া আবশ্যক যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি মহাবিশ্ব থেকে বহির্গত হওয়া আবশ্যক। কেননা সৃষ্টির কারণ যদি মহাবিশ্বের ভিতরগত কিংবা মহাবিশ্বেরই কোন অংশ হয়, তখন এর অর্থ হয় যে, মহাবিশ্ব নিজেই নিজের স্রষ্টা। আর এটি অসম্ভব। মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ যেহেতু বহির্গত, আপনি সহজেই অনুমান করতে পারবেন যে, আপনি মহাবিশ্বের বহির্গত বিষয়ের মধ্যে অবস্থান, আকার-আকৃতি ও বর্ণগত পার্থক্য করতে পারবেন না। কেননা এ বিষয়গুলো কেবল মহাবিশ্বের অভ্যন্তরে বিশেষ অর্থ প্রদান করে, এর বাইরে নয়। কেননা উপর্যুক্ত বিষয় তথা দূরত্ব, আকার-আকৃতি বা বর্ণ প্রত্যেকটি সৃষ্ট। মহাবিশ্বের বাইরে সৃষ্ট কোন বস্তু নেই। মহাবিশ্বের বাইরে উপর্যুক্ত বিষয়ের অনুপস্থিতির কারণে সৃষ্টির পিছে ক্রিয়াশীল দু’টি কারণের মধ্যে পার্থক্য করাও সম্ভব নয়। এজন্য সৃষ্টির পিছে দু’টি বা অসংখ্য কারণের কথা বলাটাও ভিত্তিহীন, অযৌক্তি ও ধারণাপ্রসূত একটি বক্তব্য মাত্র।
মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি ইউনিক বা অনন্য হওয়া আবশ্যক। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “তাঁর কোন সমকক্ষ নেই”। মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি যদি অনন্য না হয়, তবে এর অর্থ হবে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ ও মহাবিশ্বের মাঝে একটি সিমিলারিটি বা সাদৃশ্য রয়েছে। কেননা এর দ্বারা এটি প্রমাণিত হয় যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি এর মাঝে রয়েছে। যার অর্থ এই দাঁড়াল যে, মহাবিশ্ব নিজেই নিজের স্রষ্টা। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি মহাবিশ্বের সাদৃশ্যপূর্ণ হতে পারবে না কেন? এর উত্তরটি খুবই সহজ। আমরা জানি মহাবিশ্ব অসংখ্য বস্তুর সমষ্টি। সুতরাং মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি অবশ্যই ইম্যাটেরিয়াল বা বস্তুজগতের ঊর্ধ্বে হতে হবে। নতুবা মহাবিশ্ব নিজেই নিজের স্রষ্টা হওয়া আবশ্যক হবে। সুতরাং বস্তু সৃষ্টির কারণটিও যদি বস্তুর মতো হয়, তবে বস্তু নিজেই নিজের স্রষ্টা হওয়া আবশ্যক, যা অসম্ভব। সুতরাং উপসংহারে আপনাকে অবশ্যই বলতে হবে যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি অবশ্যই ইম্যাটেরিয়াল ও ইউনিক হতে হবে। আমাদের এ বক্তব্যটি স্রষ্টার এককত্বের প্রমাণ হয় কিভাবে? আমরা বলব, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ যদি একাধিক হয়, তবে তার কোনটিই ইউনিক বা অনন্য হবে না। ফলে স্রষ্টা একজন হওয়াটাই নির্দিষ্ট।
স্রষ্টার এককত্ব প্রমাণের সবচেয়ে সহজ উপায় হল, আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ঐশীবাণীর শরণাপন্ন হওয়া। এক্ষেত্রে যুক্তি হল, কোন বাণীর ব্যাপারে যদি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয় যে, এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত এবং এটি মানব রচিত নয়, তখন এ গ্রন্থের বক্তব্যের ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকে না। সুতরাং আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ঐশী গ্রন্থে আল্লাহ তায়ালা নিজের সম্পর্কে যে তথ্য প্রদান করবেন সেটি নিশ্চিতভাবে সত্য বলে বিবেচিত হবে।
কেউ যদি আল্লাহ সম্পর্কে অজ্ঞ হয় তবে সে কিভাবে আল্লাহ সম্পর্কে বা তার প্রেরিত কিতাব সম্পর্কে ধারণা অর্জন করবে?
এর দু’টি পদ্ধতি রয়েছে-
১. ইন্টারন্যাল
২. এক্সটারন্যাল
আভ্যন্তরীণভাবে আল্লাহ তায়ালার পরিচয় পাওয়ার অর্থ হল, আপনি আত্মপরীক্ষা বা আত্মদর্শনের মাধ্যমে আল্লাহ সম্পর্কে অবগত হওয়ার চেষ্টা করবেন। অর্থাৎ নিজের আভ্যন্তরীণ শক্তি ব্যবহার করে আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা। আজব ব্যাপার হল, আল্লাহ সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন মানুষের নিজস্ব শক্তির দ্বারা সম্ভব নয়।
এর কিছু মৌলিক কারণ হল,
১. মানুষ সৃষ্টিগতভাবে বৈচিত্রময়। ব্যক্তি বৈচিত্রের এধারাটি মূলতঃ মানুষের মানসিক ভিন্নতারই বহিপ্রকাশ। সাইকোলজিক্যাল ভিন্নতার প্রধান কারণ হল, ডি.এন.এ এর ভিন্নতা, বাস্তব অভিজ্ঞতা, সামাজিক পূর্বসূত্র, বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানার্জনের ক্ষমতা, লিঙ্গের বৈষম্য ইত্যাদি নিয়ামক দ্বারা প্রভাবিত। আত্মদর্শনের মাধ্যমে স্রষ্টা সম্পর্কে ধারণা পেতে এবিষয়গুলো আপনাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে। সুতরাং আপনার আত্মপরীক্ষার মাধ্যমে যে ফলাফল পাওয়া যাবে সেটি অন্যদের থেকে ভিন্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। আপনি নিজেও এই বাস্তবতা উপলব্ধি করবেন যে, উপর্যুক্ত বিষয়ের উপস্থিতিতে আপনি একাকী যদি স্রষ্টা সম্পর্কে ধারণা পেতে চান তবে তা সত্য থেকে অনেক বিচ্যুত হতে পারে। এটি একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ বছর আগে পৃথিবীতে প্রায় ৩৭০০ হাজার দেবতার ধারণা মানুষের মনে জেঁকে বসেছিল।
২. দ্বিতীয় কারণ হল, বাস্তবতার বিবেচনায় মানুষ খুবই সীমাবদ্ধ। এজন্য মানুষ যদি নিজের পক্ষ থেকে স্রষ্টা সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করতে চায়, তবে তা অধিকাংশ সময় ভ্রান্তির কারণ হয়। দার্শনিকগণ ¯্রষ্টার অস্তিত্বের ব্যাপারে কিছু যুক্তিসঙ্গত দার্শনিক তত্ত্ব উপস্থাপন করে থাকেন। তবে তারা স্বতঃসিদ্ধ ও বাস্তব কোন তথ্য দিতে অক্ষম। প্রকৃতপক্ষে যদি আপনি স্রষ্টা সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা অর্জন করতে চান, তবে তা হবে ইঁদুরের পক্ষে হাতির শক্তিমত্তা সম্পর্কে ধারণা অর্জনের মতো হাস্যকর। এজন্য শুধু যুক্তি বা ধারণার উপর ভিত্তি করে স্রষ্টা সম্পর্কে কিছু বলা তার সম্পর্কে মিথ্যাচারের নামান্তর। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, “তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে যা জান না, তা বলো কেন?” সুতরাং আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে আমরা যদি জ্ঞান অর্জন করতে চাই তবে তা অবশ্যই এক্সটারন্যাল বা বহির্গত কোন মাধ্যমে হতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা ঐশীবাণীর মাধ্যমে আমাদেরকে যা জানিয়েছেন, সেটিই হবে বিশুদ্ধ জ্ঞান।
আর পবিত্র কুরআন থেকে আমরা একথা সুনিশ্চিতভাবে জানি যে, আল্লাহ তায়ালা হলেন এক ও অদ্বিতীয়। তার সমকক্ষ কেউ নেই। সুতরাং তার এককত্বের ব্যাপারে আর কোন সন্দেহ থাকে না।
------ ------
© COPYRIGHT 2021 - Hasbi Academy - We Love Our Students