পৃথিবীর মানুষকে রাসূল স. একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান উপহার দিয়েছেন। অন্যান্য নবী-রাসূলগণের সাথে রাসূল স. এর একটি বিশেষ পার্থক্য হলো, অন্যান্য নবীর উম্মত নবীর মৃত্যুর পর তাদের ধর্ম ভুলে গেছে। ধর্মের বিধি-বিধান পালনে শৈথিল্য প্রদর্শন করেছে। কিন্তু রাসূল স. এর আনীত দ্বীনের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এটি কিয়ামত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে। সর্বদা একটি দল রাসূল স. এর সুন্নাহ ও সাহাবায়ে কেরামের জামাতকে আকড়ে থাকবে। রাসূল স. এর ইন্তেকালের পরে সাহাবায়ে কেরাম রা. দ্বীনকে সম্পূর্ণ অবিকৃত অবস্থায় তাবেয়ীগণের নিকট পৌছে দিয়েছেন। একইভাবে তাবেয়ীগণ তাবে-তাবেয়ীগণের নিকট দ্বীন পৌছে দিয়েছেন। সাহাবায়ে কেরাম রাসূল স. এর কথা, কাজ ও সম্মতিকে শুধু বক্তব্যের মাধ্যমেই অন্যের কাছে পৌছে দেননি। বরং রাসূল স. এর আমল অন্যের কাছে পৌছানোর সবচেযে গুরুত্বপূণর্ মাধ্যম হলো, বাস্তব জীবনে হুবহু রাসূল স. এর সুন্নাহের উপর আমল। সাহাবায়ে কেরাম শুধু মৌখিক বণর্নার মাধ্যমেই দ্বীনের বিধানাবলী বণর্না করেননি, বরং তারা সকলে রাসূল স. এর সুন্নাহের উপর পরিপূণর্ আমল করে অন্যদেরকে রাসূল স. এর আমল শিক্ষা দিয়েছেন।
সাহাবাযে কেরাম সম্পর্কে কখনও এটা কল্পনাও করা যায় না যে, তারা রাসূল স. কে একটি আমল করতে দেখে নিজেরা তার বিপরীত আমল করবেন। একারণেই ইমাম মালিক রহ. মদীনার আমলকে শরীয়তের একটি দলিল মনে করতেন। কারণ অনেক হাদীস মাত্র এক ব্যক্তির বণর্না দ্বারা বর্ণিত, কিন্তু প্রচলিত আমলগুলো হাজার সাহাবা ও তাবেয়ীগণের মাধ্যমে বণির্ত। হাজার হাজার সাহাবায়ে কেরামের আমলের বিপরীতে একক বর্ণনার কোন হাদীস দলিল হতে পারে না। এজন্যই মুহাদ্দিসগণের একটি নীতি হলো, ألف عن ألف خير من واحد عن واحد অর্থাৎ এক হাজার লোক যখন অপর এক হাজার লোক থেকে কোন একটি বিষয় বণর্না করে, এটি এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তি থেকে বনির্ত হাদীস বা আমলের চেয়ে অধিক শক্তিশালী। এক হাজার সাহাবার আমলের বিপরীতে একক সনদে বর্নিত হাদীস কখনও দলিল হতে পারে না।
শরীয়তে যেসব আমল এতো অধিক সংখ্যক লোকের মাধ্যমে বণির্ত যে, একই সাথে এতো সাহাবী ও তাবেয়ীকে ভুল সাব্যস্ত করা অসম্ভব, সেগুলোকে আমলে মুতাওয়ারিসা বলে। ইসলামের বিধি-বিধান সংরক্ষণে আমলে মুতাওয়ারিসার গুরুত্ব অপরিসীম। রাসূল স. এর থেকে মুতাওয়াতির বা অসংখ্য লোকের বর্ণনার মাধ্যমে যেমন পবিত্র কুরআন বর্ণিত হয়েছে, তেমনি হাজার হাজার সাহাবায়ে কেরামের আমল ও বর্ণনার মাধ্যমে রাসূল স. এর আমল বর্ণিত হয়েছে। এই ধারণা করা সম্পূর্ণ ভুল যে, রাসূল স. এর আমল কেবল বর্তমানের হাদীসের কিতাবে লিখিত হাদীসের মাধ্যমেই সংকলিত হয়েছে। বরং রাসূল স. এর আমল সংরক্ষণের সবচেয়ে বিশুদ্ধ পদ্ধতি ছিলো, প্রচলিত আমল বা আমলে মুতাওয়ারাস।
রাসূল স. এর থেকে সাহাবায়ে কেরাম নামাযের পদ্ধতি শিখেছেন, সাহাবায়ে কেরাম থেকে তাবেয়ীগণ, তাবেয়ী থেকে তাবে-তাবেয়ীগণ নামায শিখেছেন। নামায শেখার পদ্ধতিই হলো, দেখে দেখে শেখা। নামায বই পড়ে শেখার বিষয় নয় আর সুন্নাহসম্মত নামায বই পড়ে শিখাও সম্ভব নয়। যারা রাসূল স. এর থেকে দেখে নামায শিখেছে, এবং তাদের থেকে অন্যরা যখন দেখে নামায শিখেছে, তখন নামাযের পদ্ধতির মাঝে বিদয়াতের অনুপ্রবেশের সুযোগ কম ছিলো। বিভিন্ন নতুন নতুন ব্যাখ্যা উদ্ভাবনের সুযোগও কম ছিলো। কিন্তু বর্তমানে একটা শ্রেণি ইসলামে বিকৃতির হাত প্রসারিত করেছে। তারা হাদীস অনুসরণের নামে ইসলামের স্বত:সিদ্ধ বিষয়গুলোকে বিকৃত ব্যাখ্যা করে রাসূল স. এর সুন্নাহ বলে চালিয়ে দিচ্ছে। অথচ তাদের মস্তিষ্ট প্রসূত এই বিষয়গুলো আদৌ রাসূল স. এর সুন্নত নয়। এগুলো গর্হিত বিদয়াত আমল। তারা প্রচলিত আমল থেকে দূরে নিজের বিকৃত বুঝকে প্রাধান্য দিয়ে এগুলো করছে। এদের সাথে রাসুল স. এর সুন্নতের কোন সম্পর্ক নেই।
বর্তমানে নবীজী স. এর সুন্নাহসম্মত নামাযে বিদয়াত অনুপ্রবেশের মৌলিক কারণ দু’টি।
১. রাসূল স. এর থেকে প্রচলিত আমলের বিপরীতে নিজেদের মনগড়া মতবাদের প্রচলন।
২. কুরআন ও হাদীসের শব্দের প্রচলিত ও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা থেকে দূরে সরে নিজেদের বিকৃত ব্যাখ্যাকে রাসূল স. এর সুন্নতের নামে চালিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা। এক্ষেত্রে কুরআন সুন্নাহের শব্দ ব্যবহার করা হয়, কিন্তু অর্থ বা বুঝ কুরআন সুন্নাহের নয়। বরং এটি সম্পূর্ণ তার নিজের আবিষ্কৃত বুঝ। কুরআন ও হাদীসের বুঝের সাথে তার এই নব আবিষ্কৃত বুঝের দূরতম কোন সম্পর্ক নেই।
বর্তমানের অধিকাংশ বেদয়াতের ক্ষেত্রে এই দু’টি কারণই মৌলিক হিসেবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমরা মূল আলোচনা শুরুর পূর্বে এই দু’টি বিষয়ের গুরুত্ব প্রসঙ্গে সামান্য আলোচনা করবো।
সাহাবায়ে কেরাম রা. থেকে শুরু করে পূর্ববর্তী কেউ-ই শুধু হাদিস বর্ণনা আমলের জন্য যথেষ্ট মনে করতেন না। বরং তারা দেখনতেন, হাদিসের উপর আমল করা হয়েছে কি না? পূর্বে আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারি রহ. এর বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, ফিকাহের থেকে বিচ্ছিন্ন অনেক রাবির ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেছে। তারা কোন হাদিস আমলযোগ্য এবং কোনটি আমলযোগ্য নয়, তা পার্থক্য করতে পারত না।”[১]
এটি একটি বিস্তর বিষয়। এ বিষয়ে ইমাম ইবনে আবি যায়েদ কাইরাওয়ানী রহ. (৩৮৪ হি:) এর বক্তব্য কিতাবুল জামে থেকে উল্লেখ করবো। সেই সাথে কাজি ইয়াজ রহ. এর বক্তব্যও তারতিবুল মাদারেক থেকে উদ্ধৃত করবো। এখানে তারা সালাফে সালেহিনের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। সালাফে-সালেহিন কেবল সেসব হাদিসের উপর আমল করতেন, যার উপর পূর্বে কেউ আমল করেছে। কিন্তু যেসব হাদিসের উপর কেউ আমল করেনি, হাদিসগুলো বিশ্বস্ত সূত্রে বর্ণিত হলেও তারা তার উপর আমল করতেন না।ইমাম ইবনে আবি যায়েদ রহ. আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আক্বিদা, আদর্শ ও রীতির আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন,
والتسليم للسنن لا تعارض برأي ولا تدافع بقياس، وما تأوله منها السلف الصالح تأولناه وما عملوا به عملناه وما تركوه تركناه ويسعنا أن نمسك عما أمسكوا، ونتبعهم فيما بينوا، ونقتدي بهم فيما استنبطوه ورأوه في الحوادث، ولا نخرج من جماعتهم فيما اختلفوا فيه أو في تأويله، وكل ما قدمنا ذكره فهو قول أهل السنة وأئمة الناس في الفقه والحديث على ما بيناه وكله قول مالك، فمنه منصوص من قوله، ومنه معلوم من مذهبه
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদিস গ্রহণ করতে হবে। যুক্তি দ্বারা হাদিসের বিরোধিতা করা যাবে না। কিয়াস দ্বারা হাদিস প্রত্যাখ্যান করা হবে না। পূর্ববর্তী উলামায়ে কেরাম যার উপর আমল করেছেন, আমরাও তার উপর আমল করি। তারা যার উপর আমল করেননি, আমরাও তার উপর আমল করি না। তারা যা থেকে বিরত থেকেছেন, তা থেকে বিরত থাকা আমাদেরও কর্তব্য। তারা যেসব বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন, আমরা তার আনুগত্য করি। তারা বিভিন্ন বিষয়ে যেসব মাসআলা গ্রহণ করেছেন, আমরা তার অনুসরণ করি। যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করেছেন কিংবা যার ব্যাখ্যায় মতানৈক্য হয়েছে, সেক্ষেত্রে আমরা পূর্ববর্তীদের জামাত থেকে বের হই না।উপর্যুক্ত বক্তব্যগুলো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের বক্তব্য। এটি ফিকাহ ও হাদিসের ইমামগণের অভিমত। এগুলো ইমাম মালেকেরও বক্তব্য। কিছু বিষয় সরাসরি তাঁর থেকে বর্ণিত এবং কিছু বিষয় তাঁর গৃহীত মাজহাব থেকে আহরিত।ইমাম মালেক রহ. বলেন, একটি হাদিসের উপর ফকিহদের মতানুযায়ী আমল করা নিজস্ব মতানুযায়ী আমলের চেয়ে শক্তিশালী।
তিনি আরও বলেন, আমি যেসব হাদিসের উপর আমল করি, তার ব্যাপারে একথা বলা কঠিন যে, আমার কাছে এর বিপরীত অমুক অমুক বর্ণনা করেছে। কেননা তাবেয়িদের অনেকের কাছে বিভিন্ন সূত্রে হাদিস বর্ণিত হলেও তারা বলতেন, “আমি হাদিসটি সম্পর্র্কে সম্যক অবগত আছি। কিন্তু এর বিপরীত আমল চলে আসছে।”মুহাম্মাদ ইবনে আবু বকর ইবনে হাযাম রহ. তাঁর ভাইকে কখনও কখনও বলতেন, তুমি এ হাদিস অনুযায়ী কেন ফয়সালা করলে না? তিনি উত্তর দিতেন, আমি মানুষকে এর উপর আমল করতে দেখিনি।ইবরাহিম নাখয়ি রহ. বলেন, আমি যদি সাহাবাগণকে কব্জী পর্যন্ত ওজু করতে দেখতাম, তবে আমিও তাই করতাম; যদিও আমি কনুই পর্যন্ত ওযুর আয়াত পাঠ করি। কেননা তাদের ব্যাপারে সুন্নত পরিত্যাগের অভিযোগ করা সম্ভব নয়। তারা ইলমের দিক থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুসরণের ব্যাপারে সর্বাধিক আগ্রহী। সুতরাং নিজ ধর্মের ব্যাপারে সন্দেহপোষণকারী ছাড়া কেউ তাদের ব্যাপারে এ অভিযোগ করার দু:সাহস দেখাবে না।ইমাম আব্দুর রহমান ইবনে মাহদি বলেন, মদিনাবাসীর মাঝে প্রচলিত সুন্নত, হাদিসে বর্ণিত সুন্নত থেকে উত্তম। ইমাম ইবনে উয়াইনা বলেন, ফকিহগণ ব্যতীত অন্যদের জন্য হাদিস ভ্রষ্টতার কারণ। এর দ্বারা তিনি উদ্দেশ্য নিয়েছেন, অন্যরা হাদিসকে তার বাহ্যিক অর্থের উপর প্রয়োগ করে। অথচ অন্য হাদিসের আলোকে এ হাদিসের বিশেষ ব্যাখ্যা রয়েছে। অথবা, হাদিসের বিপরীতে সূক্ষ্ম দলিল রয়েছে যা তার কাছে অস্পষ্ট। হাদিসটি অন্য কোন দলিলের আলোকে পরিত্যাজ্য হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর এ সব বিষয়ে গভীর পান্ডিত্যের অধিকারী ফকিহ ছাড়া অন্যরা অবগত নয়।ইমাম ইবনে ওহাব রহ. বলেন, যে মুহাদ্দিসের কোন ফকিহ ইমাম নেই, সে ভ্রষ্ট। আল্লাহ পাক যদি আমাদেরকে ইমাম লাইস ইবনে সা’য়াদ ও ইমাম মালেকের দ্বারা মুক্তি না দিতেন, তবে আমরা পথভ্রষ্ট হয়ে যেতাম।[২]
ইমাম ইবুন আবি যায়েদ বলেন, ইমাম মালেক রহ. বলেছেন, মদিনায় এমন কোন মুহাদ্দিস ছিলেন না, যিনি কখনও দু’টি পরস্পর বিরোধী হাদিস বর্ণনা করেছেন। ইমাম আশহাব বলেন, ইমাম মালেক রহ. এর দ্বারা উদ্দেশ্য নিয়েছেন, কোন মুহাদ্দিস এমন হাদিস বর্ণনা করতেন না, যার উপর আমল করা হয় না।[৩]
কাজি ইয়াজ রহ. তারতিবুল মাদারেক-এ লিখেছেন,
باب ما جاء عن السلف والعلماء في الرجوع إلى عمل أهل المدينة في وجوب الرجوع إلى عمل أهل المدينة وكونه حجة عندهم وإن خالف الأكثر روي أن عمر بن الخطاب رضي الله تعالى عنه قال على المنبر: احرج بالله على رجل روى حديثاً العمل على خلافه.قال ابن القاسم وابن وهب رأيت العمل عند مالك أقوى من الحديث، قال مالك: وقد كان رجال من أهل العلم من التابعين يحدثون بالأحاديث وتبلغهم عن غيرهم فيقولون ما نجهل هذا ولكن مضى العمل على غيره، قال مالك: رأيت محمد بن أبي بكر ابن عمر بن حزم وكان قاضياً، وكان أخوه عبد الله كثير الحديث رجل صدق، فسمعت عبد الله إذا قضى محمد بالقضية قد جاء فيها الحديث مخالفاً للقضاء يعاتبه، ويقول له: ألم يأت في هذا حديث كذا؟ فيقول بلى.فيقول أخوه فما لك لا تقضي به؟ فيقول فأين الناس عنه، يعني ما أجمع عليه من العلماء بالمدينة، يريد أن العمل بها أقوى من الحديث، قال ابن المعذل سمعت إنساناً سأل ابن الماجشون لمَ رويتم الحديث ثم تركتموه؟ قال: ليعلم أنا على علم تركناه.
“পরিচ্ছেদ: অধিকাংশের আমল বিপরীত হওয়া সত্ত্বেও মদিনা বাসীর আমল গহণ ও তা হুজ্জত হওয়া প্রসঙ্গে উলামায়ে কেরাম ও সালাফে সালেহিনের বক্তব্য।বর্ণিত আছে, হজরত উমর রা. মিম্বারে ভাষণ দেয়ার সময় বলেছেন, আল্লাহর শপথ, আমি ঐ ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করবো, যে এমন হাদিস বর্ণনা কওে যার উপর সাহাবাদের আমল নেই।ইমাম ইবনে কাসেম ও ইবনে ওহাব রহ. বলেন, ইমাম মালেক রহ. এর কাছে প্রচলিত আমল বর্ণিত হাদিস থেকে অধিক শক্তিশালী। ইমাম মালেক রহ. বলেন, অনেক তাবেয়ি এমন ছিলেন যারা হাদিস বর্ণনা করতেন, এরপর তাদের কাছে এর বিপরীত হাদিস উল্লেখ করা হলে তারা বলতেন, আমি হাদিসটি সম্পর্র্কে সম্যক অবগত আছি। কিন্তু এর বিপরীত আমল চলে আসছে।ইমাম মালেক রহ. বলেছেন, আমি মুহাম্মাদ বিন আবু বকর ইবনে হাযাম রহ. কে দেখেছি, তিনি একজন বিশিষ্ট কাজি ছিলেন। তাঁর ভাই আব্দুল্লা ছিলেন সত্যবাদী ও বড় মাপের মুহাদ্দিস। মুহাম্মাদ ইবনে আবু বকর রহ. যখন এমন কোন ফয়সালা করতেন, যার বিপরীতে হাদিস রয়েছে, তখন আব্দুল্লাহ রহ. তাকে ভর্ৎসনা করে বলতেন, এ ব্যাপারে তো এই হাদিসটি বর্ণিত আছে? তিনি বলতেন, হ্যাঁ। আব্দুল্লাহ রহ. জিজ্ঞাসা করতেন, তাহলে এ অনুযায়ী বিচার করলেন না কেন? তিনি বলতেন, এ ব্যাপারে মদিনাবাসীর আমল কি? অর্থাৎ মদিনার আলেমগণ কোনটির উপর আমলের ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। তাঁর মূল উদ্দেশ্য হলো, মদিনার আলেমগণের মাঝে প্রচলিত ঐকমত্যপূর্ণ বিষয়ের উপর আমল করা হাদিসের উপর আমলের চেয়ে শক্তিশালী।ইমাম ইবনুল মুয়াজ্জাল বলেন, এক ব্যক্তি ইবনুল মাজিশুনকে জিজ্ঞাসা করলো, তোমরা হাদিস বর্ণনা করে তা পরিত্যাগ করো কেন? তিনি উত্তর দিলেন, যেন লোকদেরকে এ বিষয়ে জানিয়ে দেই যে, হাদিসটি সম্পর্র্কে আমাদের অবগতি থাকা সত্ত্বেও আমরা তার উপর আমল করিনি।ইমাম ইবনে মাহদি রহ. বলেন, মদিনাবাসীর মাঝে পূর্ব থেকেই প্রচলিত সুন্নত হাদিস থেকে উত্তম। তিনি আরও বলেন, একটি বিষয়ে অনেক হাদিস আমার সংগ্রহে থাকে। কিন্তু ইসলামের শুরু থেকে প্রচলিত আমল যদি এর বিপরীত হয়, তখন হাদীসগুলি আমার কাছে দুর্বল বিবেচিত হয়।ইমাম রবীয়া’ রহ. বলেন, আমার কাছে এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তির বর্ণনার চেয়ে এক হাজারের লোক থেকে অপর এক হাজার লোকের বর্ণনা অধিক উত্তম। কেননা আমার আশঙ্কা হয় এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তির বর্ণনা তোমাদের থেকে সুন্নত ছিনিয়ে নেবে।ইবনে আবি হাযেম রহ. বলেন, আবু দারদা রহ. কে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করা হতো। তিনি প্রশ্নের উত্তর প্রদান করতেন। অত:পর তাঁকে বলা হতো, আমাদের কাছে তো এই হাদিস এভাবে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলতেন, আমিও হাদিসটি শুনেছি, কিন্তু প্রচলিত আমল এর বিপরীত।ইমাম ইবনে আবিয যিনাদ রহ. বলেন, উমর বিন আব্দুল আযিয রহ. ফকিহদেরকে একত্র করতেন। যেসব হাদিস ও সুন্নতের উপর আমল করা হয়, তাদেরকে সেসম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেন। এরপর তিনি তাদের বক্তব্য অনুযায়ী ফয়সালা করতেন। যেসব হাদিসের উপর আমল করা হয় না, সেগুলো পরিত্যাগ করতেন, যদিও তা বিশ্বস্ত সূত্রে বর্ণিত হতো।[৪]উপর্যুক্ত বক্তব্যগুলো কাযি ইয়াজ রহ. বর্ণনা করেছেন। এবার খতিব বাগদাদি রহ. এর বক্তব্যের প্রতি লক্ষ করুন। তিনি আল-ফকিহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ-এ শিরোনাম দিয়েছেন, “যেসব কারণে খবরে ওয়াহিদকে পরিত্যাগ করা হবে।” তিনি ইমাম মুহাম্মাদ বিন ঈসা তাব্বা’ রহ. এর বক্তব্য দিয়ে পরিচ্ছেদটি শুরু করেছেন। ইমাম মুহাম্মাদ বিন ঈসা রহ. ছিলেন ইমাম মালেক রহ. এর বিশিষ্ট ছাত্র; একজন বিশিষ্ট ফকিহ ও মুহাদ্দিস। তিনি বলেন,“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত প্রত্যেকটি হাদিসের উপর আমলের ব্যাপারে কোন সাহাবি থেকে যদি কোন বর্ণনা না পাওয়া যায়, তবে হাদিসটি পরিত্যাগ করো।”[৫] [১] ইমাম হাযেমী রহ. কৃত শুরুতুল আইম্মাতিল খামসা এর উপর ইমাম যাহেদ আল-কাউসারী রহ. এর টীকা সংযোজন। পৃ.৩৬।
[২] কিতাবুল জামে, পৃ.১১৭।
[৩] কিতাবুল জামে’. পৃ.১৪৬।
[৪] তারতীবুল মাদারেক, খ.১, পৃ.৬৬।
[৫] আল-ফকীহ ওয়াল মুতাফাক্কীহ। খ.১, পৃ.১৩২।
ইসলামের বিশুদ্ধ বিধি-বিধানকে বিকৃত করার জন্য এই পদ্ধতিটি বাতিল দলগুলো লুফে নিয়েছে। তারা তাদের নতুন আবিষ্কৃত বিদয়াত চালুর জন্য কুরআনের আয়াত কিংবা হাদীস ব্যবহার করে, কিন্ত এর ব্যাখ্যা তারা নিজেরা করে। তাদের এসব নতুন নতুন বিকৃত ব্যাখ্যার সাথে তাদের ব্যবহৃত কুরআন ও হাদীসের আদৌ কোন সম্পর্ক থাকে না। অনেক বাতিল দলগুলো তাদের বিদয়াত চালুর জন্য বিকৃত ব্যাখ্যার পাশাপাশি মিথ্যাচারের আশ্রয় নেই। নবীজী স. এর সুন্নাহের মাঝে নিজেদের আবিষ্কৃত বিদয়াত চালু করার ক্ষেত্রে বিকৃত ব্যাখ্যা ও মিথ্যাচার বর্তমানে একটি স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সাধারণ মানুষের পক্ষে তাদের এই বিকৃত ব্যাখ্যা এবং মিথ্যা উদ্ধৃতি যাচাই করার সুযোগ হয় না। একারণে সাধারণ মানুষ কুরআন ও হাদীসের উদ্ধৃতি দেখে ধোকায় পড়ে যায়।
আসুন কুরআন ও হাদীসের নামে কীভাবে ইসলামকে বিকৃত করার চেষ্টা করা হচ্ছে তার কিছু নমুনা দেখে নেই। এসব বিকৃতির ক্ষেত্রে কুরআনের শব্দ ব্যবহার করছে, হাদীসের শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে, কিন্তু ব্যাখ্যা করা হচ্ছে সম্পূর্ণ নিজের মস্তিষ্ক থেকে। এখানের বাতিলপন্থীদের সাথে আমাদের মতভেদ। আমরা বলি, আমরা কুরআন ও হাদীস যেমন সাহাবায়ে কেরাম থেকে নিয়েছি,কুরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যাও সাহাবা, তাবেয়ী ও তাবেয়ীন থেকে নিবো। বাতিল পন্থীদের দাবী হলো, কুরআন ও হাদীস তারা সাহাবাদের কাছ থেকে নিবে, কিন্তু কুরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যা তারা নিজেরা করবে। আর এভাবেই তারা ইসলামকে বিকৃত করে চলেছে।
আমরা জানি যে, ইহুদী, খ্রিষ্টান প্রত্যেক ধর্মের লোকের জন্য কুরআন বোঝার অধিকার আছে। মুসলিম বিশ্বে যে সমস্ত খ্রিষ্টান মিশনারী কাজ করে, তাদের সম্পর্কে যারা জানেন তাদের নিকট বিষয়টি অস্পষ্ট নয় যে, তারা মুসলমানদেরকে খ্রিষ্টবাদের দিকে আহক্ষান করার সময় কুরআন থেকে প্রমাণ পেশ করে। কুরআন থেকে ব্যাখ্যা প্রদান করে থাকে। তারা বলে, কুরআনে হযরত ঈসা (আঃ) কে “কালিমাতুল্লাহ” বলা হয়েছে। আল্লাহর একটি সত্তাগত গুণ হল, সিফতে কালাম। সুতরাং হযরত ঈসা (আঃ) আল্লাহর সত্তার একটি অংশ বা সিফত। কুরআনে হযরত ঈসা (আঃ) কে “রুহুল্লাহ” বা আল্লাহর রূহ বলা হয়েছে। হযরত ঈসা (আঃ) আল্লাহর রুহ ছিলেন। আর হযরত ঈসা (আঃ) এর সাথে আল্লাহর সম্পর্ক এমন যেমন দেহ ও আত্মার সম্পর্ক। আর কুরআনে বলা হয়েছে, আমি ঈসা (আঃ) কে রুহুল কুদুস দ্বারা শক্তিশালী করেছি। আর এর দ্বারা তারা ঐ ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত দেয়, যা বাইবেলে বর্ণিত হয়েছে যে, রুহুল কুদুস হযরত ঈসা (আঃ) এর উপর কবুতরের আকৃতিতে অবতীর্ণ হয়েছিল। দেখুন! খোদা, কালেমা ও রুহুল কুদুস এ তিনটি মৌলিক উপাদানই কুরআন দ্বারা প্রমাণিত হল। অর্থাৎ যে কুরআন ত্রিত্ববাদের ঘোর বিরোধী, এই নতুন ব্যাখ্যার বদৌলতে স্বয়ং কুরআনের দ্বারাই এ অসার আক্বীদার প্রমাণ মিলে গেল। এখন শুধু থেকে গেল, কুরআনের ঐ আয়াত যাতে স্পষ্টভাবে ত্রিত্ববাদের কথা নিষেধ করা হয়েছে। সুতরাং যেহেতু ত্রিত্ববাদের আক্বীদা প্রমাণিত হয়ে গেল, তাহলে বলা যায়, এই আয়াতে প্রকৃত ত্রিত্ববাদের কথা নিষেধ করা হয়েছে। আর একথা খোদ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরাও স্বীকার করে যে, খোদা মূলতঃ তিন জন নয় বরং এ তিনটি মৌল উপাদানের সমন্বয়ে মূলতঃ একজনই। আর কুরআনে যে বলা হয়েছে, যারা মসীহ ইবনে মরিয়মকে আল্লাহ বলবে, তারা কাফের’ এটা মূলতঃ মনোফেসি ফেরকার বিরুদ্ধাচরণ করা হয়েছে। যেখানে যেখানে নাসারাদের জাহান্নামের আযাবের কথা বলে ভয় প্রদর্শন করা হয়েছে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য ক্যাথলিক ফেরকা নয় বরং এর দ্বারা মনোফেসি ফেরকাকে সম্বোধন করা হয়েছে। বাকী রইল একথা যে, কুরআনে কারীমে বলা হয়েছে যে, হযরত ঈসা (আঃ) কে শূলিতে চড়ান হয়নি, এটাও ঠিক। খ্রিস্টানদের সাধারণ আক্বীদা হচ্ছে, হযরত ঈসা (আঃ) এর মধ্যে নিহিত খোদায়ী মৌল উপাদান শূলিতে চড়ান হয় নি। শুধু পেট্রিপেশন ফেরকা এই আক্বীদা পোষণ করে যে, হযরত ঈসা (আঃ) এর মধ্যে নিহিত খোদায়ী মৌল উপাদানের সমষ্টিকে শূলিতে চড়ান হয়েছিল। কুরআনে এটাই প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। আর হযরত ঈসা (আঃ) এর শরীর সম্পর্কে কথা হল, কুরআনে তার গঠানাকৃতিকে ফাঁসিতে ঝুলানোর কথা অস্বীকার করা হয় নি।[১]
এই ধারাবাহিকতায় খ্রিষ্টধর্মের অন্যান্য বিষয়গুলিও তারা খুব সহজে কুরআনের দ্বারা ব্যাখ্যা ও প্রমাণ করে থাকে। আল্লামা মুফতী তাকী উসমানী “আাসরে হাজের মে ইসলাম কেইসে নাফেয হোঁ” নামক কিতাবে পাকিস্তানে কুরআন ব্যাখ্যার নতুন ধারা সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখেছেন,“পাকিস্তানে ‘ইসলামী গবেষণা পরিষদের মহাপরিচালক ড.ফজলুর রহমান তার লিখিত ‘ইসলাম’ গ্রন্থে অত্যন্ত জোরালোভাবে ইসলামের নতুন ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন।
তার মতে ইসলামে মৌলিকভাবে মূলতঃ তিন ওয়াক্তের নামায ফরয করা হয়েছে। নবী করীম (সাঃ) এর জীবনের শেষ বছরে আরও দু‘ওয়াক্তের নামায সংযোজন করা হয়। এজন্য নামাযের রাকাতেও পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে। এর কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ‘মোট কথা এই সত্যতা যে মৌলিকভাবে শুধু তিন ওয়াক্তের নামাযই ফরয ছিল, এর সাক্ষ্য ঐ ঘটনা দ্বারা দেয়া সম্ভব যে, এক বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে, রাসূল (সঃ) কোন কারণ ছাড়াই চার নামাযকে দু’ওয়াক্তের নামাযে জমা করেছিলেন। সুতরাং নববী যুগের পরে নামাযের সংখ্যা অত্যন্ত কঠোরভাবে পাঁচ ওয়াক্ত নির্ধারণ করা হয়। আর সত্য কথা হল, মৌলিকভাবে নামায তিন ওয়াক্ত, হাদীসের ¯্রােতের টানে যা পাঁচ ওয়াক্তের বর্ণনায় তলিয়ে গেছে।”
অতঃপর আল্লামা তাকী উসমানী সাহেব (দাঃ বাঃ) লিখেছেন,“সংস্কারবাদীদেও তাফসীরের নমুনা দেখনু! সেখানে আপনি নতুন ব্যাখ্যার স্বরূপ দেখতে পাবেন। ওই লোকদের কাছে ‘ওহী’ হচ্ছে রাসূল (সঃ) এর কালাম, ফেরেশতা দ্বারা উদ্দেশ্য হল, পানি বিদ্যুৎ ইত্যাদি। ইবলিস দ্বারা উদ্দেশ্য হল, পশুত্ব শক্তি। ইনসান দ্বারা উদ্দেশ্য হল, সত্যলোক। মৃত্যু দ্বারা উদ্দেশ্য হল, তন্দ্রা, জিল্লতি ও কুফর। জিন্দা হওয়া দ্বারা উদ্দেশ্য হল, সম্মান ফিরে পাওয়া, হুশ ফিরে আসা বা ইসলাম গ্রহণ করা। পাথরে লাঠি দ্বারা আঘাত করার অর্থ হল, লাঠির উপর ভর করে পাহাড়ে আরোহণ করা। এই তাফসীরের কথা মাথায় রেখে চিন্তা করুণ যে, খ্রিষ্টানদের ব্যাখ্যার সাথে এদের ব্যাখ্যার মধ্যে যে কোন পার্থক্য নেই’ এ বিষয়ে আমি অতিরঞ্জিত কিছু বলেছি কি না?”[২]
মদীনা পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত কাজী জাহান মিয়ার আল-কুরআন দ্য চ্যলেঞ্জ সমকাল পর্ব-১। নিচে সমকাল পর্ব-১ থেকে কয়েকটি বিষয় আলোচনা করা হল-মেজর কাজী জাহান মিয়ার সমকাল পর্ব-১ এ লিখেছেন,
“ইয়াজুজ-মাজুজ কোন অতিপ্রাকৃতিক জীব নয়, সাধারণ মানুষ। যারা আবিষ্কার ও অর্থনৈতিক শক্তির দ্বারা আল্লাহর দুনিয়া হতে আল্লাহর আইনকে মুছে দিয়ে তাদের নিজস্ব আইন প্রচলন করে এবং সম্পদের একচ্ছত্র ব্যবহার নিশ্চিত করে এবং সাধারণ মানুষের রিযিক হরণ ও জন জীবন অশান্তি ও ক্ষতি সৃষ্টির কারণ হয় এবং পরিণামে ইসলামের মূলোৎপাটন যাদের কার্যক্রম ধাবিত হয়, কোরআনের পরিভাষায় তারাই ইয়াজুজ! প্রচলিত ধারণায় পাহাড় হতে লাফিয়ে পড়ার ভয়ঙ্কর জীবদের তথা সত্য নয়Ñ কল্পনাপ্রসূত! সিঙ্গার ফুৎকারে কিয়ামত হয়ে যাওয়া (ইয়াজুজ-মাজুজের সাথে সংশ্লি আয়াত ১৮:৯৯) এর ধারণাও সত্য নয়। সুস্পষ্টভাবে এটি এষড়নধষরুধঃরড়হ বা এক বিশ্বায়নের চিত্র।”[৩]
এখানে তিনি তাঁর বিকৃত, মনগড়া, কল্পনাপ্রসূত একটি ধারণাকে প্রমাণ করতে গিয়ে ইসলামে প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত সকল বিষয়কে অস্বীকার করেছেন। এমনকি সিঙ্গা ফুৎকারে কিয়ামত হওয়ার বিষয়টিও অস্বীকার করেছেন (নাউযুবিল্লাহ)আল-কুরআন দ্য চ্যলেঞ্জ এর প্রথম অধ্যায়ের শিরোনাম হল,“এই সেই ফিইফা”কাযী জাহান মিয়া তার বক্তব্যের প্রমাণ হিসেবে কুরআনের ১৭ নং সুরার ১০৪ নং আয়াতকে উপস্থাপন করেছেন। কুরআনের আয়াত ও তার অর্থ নি¤েœ প্রদান করা হল-وَقُلْناَ مِنْ بَعْدِهِ لِبَنِيْ إِسْرَائِيلَ اسْكُنُوا الْاَرْضَ فَأِذاَ جَاءَ وعْدُ الآخِرَةِ جِئْناَ بِكُمْ لَفِيْفاًঅর্থঃ অতঃপর আমি বনী ইসরাইলকে বললাম, তোমরা ভূ-পৃষ্ঠে বসবাস কর, এরপর যখন পরকালের প্রতিশ্র“তিকাল এসে পড়বে, তখন আমি সবাইকে একত্রিত করে উপস্থিত করবো। আর কাযী জাহান মিয়াঁ এ আয়াতের অনুবাদ করেছেন,“অতঃপর আমি বনি ইসরাইলকে বলিলাম, পৃথিবীতে তোমরা বসবাস করিতে থাকে এবং যখন তোমাদের প্রতি আল্লাহর শেষ প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হইবে তষন তিনি তোমাদের সকলকে “ফিইফা”-তে একত্রিত করিবেন। (১৭:১০৪) পরবর্তীতে তিনি বলেছেন, কোরআন প্রতিশ্র“ত ফি-ই -ফা কি? (فِيْفاً) (faifa/faifan) এর আভিধানিক অর্থ হলো অর্থ মরুভূমি। কিন্তু (فيفة) (ভধরভধ/ভধরভধহ) শব্দটির আরো সুনির্দিষ্ট অর্থ প্রদান করেছেন F.Steingass-dangerous desert কিংবা dangerous plain সুতরাং ১৭:১০৪ আয়াতে বনি ইসরাইলের একত্রিকরণের প্রতিশ্র“ত বিষয়টি অবশ্যই একটি বিপজ্জনক একত্রিকরণ, যা মূলত ইসরাইল জাতির সর্বনাশের সঙ্গে জড়িত।”[৪]
সুধি পাঠক! কুরআন ব্যখ্যার কারিশমা দেখুন! কাজী জাহান মিয়া কোন কুরআন পাঠ করেছেন আল্লাহ পাকই ভাল জানেন। আমরা জানি না, তার উপর নতুন কোন কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে কি না। আমরা যে কুরআন পাঠ করি এবং রাসুলের (সঃ) উপর যে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে, তাতে “লা ফি ফা” আছে। অথচ জাহান মিয়ার কুরআনে লাম নেই। তিনি এ নতুন কুরআন কোথায় পেলেন কে জানে? লাম বাদ দিয়ে “ফি-ইফা” নিয়ে কত কী না লিখেছেন।সুধি পাঠক! পৃথিবীর সব কুরআনে লাফিফা আছে। আর আরবী ভাষায় ‘লাফিফা’ অর্থ হল, একত্র করা। মূল ধাতু হলো, ل – ف- ف (লাম-ফা-ফা)। আরবী জানা একটা শিশুও বুঝবে যে, ধাতুর মূল অক্ষর ফেলে দিয়ে শব্দ-ই ঠিক থাকে না। নিজের মতকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে এধরণের গবেষক বুদ্ধিজীবিরা কত কিছুরই না আশ্রয় নিয়ে থাকেন। মাঝে মাঝে কুরআন তৈরি করেন। কুরআনের অর্থ তৈরি করেন। কখনও হাদীস অস্বীকার করেন। কুরআন অস্বীকার করে থাকেন। কাজী জাহান মিয়া তার বইয়ে এয়াজুজ মা’জুজ সম্পর্কে লিখেছেন,কাজী জাহান মিয়া আহমদ, তিরমিযী বর্ণিত হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। যেখানে বলা হয়েছে, সর্বশেষ ইনশাআল্লাহ বলার বদৌলতে ইয়াজুজÑমাজুজ দেওয়াল ভাঙতে পারবে। এ সম্পর্কে কাজী জাহান মিয়া লিখেছেন,“আহমেদ, তিরমিযী ইত্যাদি হাদীসের উদ্ধৃতিতে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) এর রেয়ায়েত হতে বর্ণিত একটি হাদীস এ যুগে একটি বিস্ময় ও জিজ্ঞাসাবাদের সৃষ্টি করে। (এর পর তিনি হাদীসটি উল্লেখ করেছেন, অবশেষে তিনি লিখেছেন)“ এ হাদীস বা উদ্ধৃতিগুলো কি সত্য?”এর সহজ উত্তরÑ না।” (নাউযুবিল্লাহ)[৫]ইয়াজুজ মা‘জুজের ব্যপারে তিনি একটা সূত্র দিয়েছেন,বনি ইসরাইলের একত্রিকরণ ইয়াজুজ মা‘জুজের দুনিয়া জোড়া নিয়ন্ত্রণ!অর্থাৎ ইয়াজুজ-মা‘জুজ= দুনিয়ার শীর্ষতম নিয়ন্ত্রণে রয়েছে যারা (রাষ্ট্র, জাতি, সম্প্রদায়, ব্যক্তি) প্রচলিত তাফসীরসমূহের কতকে ইয়াজুজÑমাজুজ সম্পর্কে এমন ধারণা দেওয়া হয়েছে যে, উঁচু উঁচু পাহাড় হতে লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে আসবে একটি বিশেষ জীব যার লক্ষ্যবস্তু হবে মুসলমান। তারা এসে এক সঙ্গে পৃথিবীর সমস্ত পানি চুষে খেয়ে ফেলবে। কোরআন এমন সব ব্যাখ্যায় কোন দায়িত্ব বহন করে না।” একই পৃষ্ঠায় পরবর্তীতে তিনি লিখেছেন, “অতএব গ্রেট ব্রিটেন ও আমেরিকার সাথে সংশ্লিষ্ট জাতি সত্তাই হবে কোরআনের উপসর্গ অনুযায়ী ইয়াজুজÑমাজুজ।”[৬]
কাজী জাহান মিয়া লিখেছেন, বলা দরকার যে ইয়াজুজ-মাজুজ সম্পর্কে ইবনে খালদুন হতে প্রাপ্ত শিক্ষায় জ্ঞানী সম্প্রদায়ের সুবিশাল অংশ একে একটি হযরত ঈসা (আঃ) বা তার পরবর্তী ঘটনা বলে মনে করেন। মূলতঃ এমন কতিপয় হাদীস আছে, যে সব হাদীস সমূহকে ভুল বোঝা হয়েছে এই কারণে যে, এখন থেকে মাত্র ১০ কিংবা ৫ বছর পূর্বেও ঐসব হাদীসের আবেদন সুস্পষ্ট ছিল না। কারণ হিসেবে ঘটনার সাদৃশ্যহীনতা এবং আকস্মিক বৈচিত্র এবং যুক্তিযুক্ততা প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্তের অভাব। বর্তমানে বিবিধ ঘটনাসমূহ ঘটার কারণেই কেবল ঐ হাদীসগুলোর নিঁখুত সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়েছে। হাদীসসমূহ মূলত দাজ্জাল, ইয়াজুজ মাজুজ ও শেষকালে খৃষ্টান-ইহুদী আক্রমণ ও মুসলমানদের নির্ঘাত-পরাজয় সংক্রান্ত”[৭]
প্রিয় পাঠক! এবার আসুন, আরেকজন বুদ্ধিজীবির কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করি। তিনি হলেন, ডক্টর মোহাম্মাদ আলী খান মজলিশ। বইয়ের নাম হলো, “কুরআনের আলোকে সত্যের সন্ধান”। লেখক পরিচিতি দেওয়া আছে, প্রথম জীবনে শিক্ষকতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগে, পরবর্তীতে পাট গবেষণাগারে গবেষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পূর্বোক্ত বইয়ে লিখেছেন,“ইবলিশ বা শয়তান এবং গন্ধম খাওয়া হল রূপক। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, ইবলিশকে সৃষ্টি করলে ইবলিশের কি করে ক্ষমতা হলো সৃষ্টিকর্তার আদেশ অমান্য করার?……এর ব্যাখ্যায় পরবর্তীতে তিনি লিখেছেন,“ ইবলিশ বা শয়তান হলো, মানুষের দেহে বিভিন্ন প্রকারের হরমোন সৃষ্টি হওয়ার ফলে মানুষের মধ্যে যে “ইচ্ছা” সৃষ্টি হয়। এই ইচ্ছাটিকে যখন অন্যভাবে ব্যবহার করা হয় তখন তাকেই বলা হয় ইবলিশ বা শয়তান। আদম (অর্থাৎ প্রথম পুরুষ) এবং হাওয়া (প্রথম নারী) যখন ছোট ছিল, তখন তাদের মধ্যে কোন সেক্স ছিল না। এরা বড় হওয়ার সাথে সাথে তাদের মধ্যে সেক্স হরমোন সৃষ্টি হয় প্রাকৃতিক সংবিধান অনুযায়ী।”[৮]
তিনি অন্য জায়গায় লিখেছেন, “ফেরেস্তা এবং হুর পরীও রূপক। ফেরেস্তা হলো রেকর্ডিং এজেন্ট। কোরআনেই উল্লেখ আছে, আমরা যা করছি বা বলছি তা ফেরেস্তা রেকর্ড করে রাখছে। কারও কারও মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, ফেরেস্তার কাগজ কলম কোথায় এবং তারা কি সব ভাষাই জানে? প্রকৃত ঘটনা হল, ফেরেস্তা হলো, আলো ও বাতাস।”[৯] তিনি লিখেছেন,“ পরিবেশ নষ্টের মূল কারণ পৃথিবীতে মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং মানুষের নৈতিক চরিত্রের সীমাহীন অবক্ষয়, রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থপরতা এবং ধর্ম প্রচারকগণ কর্তৃক মানুষের কাছে ধর্মগ্রন্থের মূল বাণী প্রচার না করে ও রূপকের অর্থ না বুঝে রূপককেই সত্য বলে প্রচার করা। উদাহরণ স্বরূপ, পবিত্র কুরআনের ছুরা ইমরান আয়াত-৭ কতকবাণী সংবিধান, এটিই মূল কিতাব ও অপর অংশ রূপক। রূপক নিয়েই যত মতবিরোধ, ফেরেস্তাদের আবির্ভাব, হযরত মুছার নদী পার হওয়া ও ফেরাউনদের ডুবানো, হযরত ঈসার জন্ম, শবে-মেরাজ, আদমের গন্ধম খাওয়া, বেহেস্ত দোযখের বিবরণ, মৃত্যুর পর পুনরায় শরীর গঠন, (পুনঃজন্ম), কবরের যাওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদ এবং আজাব। আত্মা ও রূহ সৃষ্টিকর্তার আদেশ হলে বৈধ অবৈধ বলি কেন? এবং তা নিয়ে এত হট্টগোল কেন?[১০]
ডঃ মোহাম্মাদ আলী খান মজলিশের বইটি পড়ে মনে হয়েছিল, মৃত্তিকা বিজ্ঞানী হয়ে তিনি যদি মাটি নিয়ে গবেষণায় ব্যস্ত থাকতেন, তাহলে হয়ত এভাবে তার জীবনটা মাটি হয়ে যেত না।
নবীজী স. এর নামাযের মধ্যেও যে বিভিন্ন ধরনের বিদয়াত চালু করা হয়েছে, এগুলোও কুরআন ও হাদীসের রেফারেন্স দিয়ে করা হয়েছে। বিদয়াত চালুর ক্ষেত্রেও হাদীসের উদ্ধৃতি দেয়া হয়, কিন্তু ব্যাখ্যা করা হয় নিজেদের পক্ষ থেকে। এসব বিকৃত ব্যাখ্যার সাথে রাসূল স. এর সুন্নতের আদৌ কোন সম্পর্ক থাকে না। এজন্য দ্বীন পালনে কে কতোগুলো আয়াত মুখস্থ বলল, কিংবা কে কতগুলো হাদীস মুখস্থ এগুলো মুখ্য বিষয় নয়, বরং কে কুরআন সবচেয়ে বিশুদ্ধভাব বুঝেছে এবং কে হাদীসের সঠিক বুঝ অর্জন করেছে এটিই মুখ্য বিষয়। বর্তমানে মুখস্থ উদ্ধৃতি বলা, সম্পর্কহীন রেফারেন্স বলা একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। অথচ বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায়, এসব মুখস্থ উদ্ধৃতি শুধু তোতা-পাখির মতো বলা হচ্ছে। কুরআন ও সুন্নাহের বুঝের সাথে এসব তোতা-পাখিদের কোন সম্পর্ক নেই। পূববর্তী মুহাদ্দিস ও ফকীহগণ হাদীসের বুঝকেই সর্বদা প্রাধান্য দিতেন। তাদের নিকট এটিই ছিলো মূখ্য বিষয়। কুরআন ও হাদীসের সহীহ বুঝই হলো মৌলিক বিষয়। ইসলামে যতো বাতিল ফেরকার উদ্ভব হয়েছে, সব বাতিল ফেরকার একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো, এরা কুরআন ও সুন্নাহকে নিজেদের উদ্ভাবিত বুঝ দ্বারা ব্যাখ্যা করেছে। তারাও কুরআন ও হাদীস থেকে দলিল দিয়েছে, কিন্তু তাদের বুঝ ছিলো সম্পূর্ণ নিজস্ব বিকৃত বুঝ। এজন্য ইসলামে কে কোন আয়াত বা হাদীসের উদ্ধৃতি দিচ্ছে, সেটি মুখ্য নয়, বরং আয়াত ও হাদীস সম্পর্কে কার বুঝ বিশুদ্ধ সেটিই মূখ্য ও মৌলিক।
রেফারেন্স:
[১] আধুনিক যুগে ইসলাম। পৃষ্ঠা-১৪১
[২]আধুনিক যুগে ইসলাম, মুফতী তাকী উসমানী, পৃষ্ঠা-১৪২
[৩] পৃষ্ঠা-১৮ [৪] পৃষ্ঠা-১৯ [৫] পৃষ্ঠা-৩৯ [৬] আল-কোরআন দ্য চ্যলেঞ্জ সমকাল পর্ব-১, পৃষ্ঠাÑ৩৫ [৭] আল-কোরআন দ্য চ্যালেঞ্জ সমকাল পর্ব-১, পৃষ্ঠা-৩০ [৮] কোরআনের আলোকে সত্যের সন্ধান, ড. মোহাম্মাদ আলী খান মজলিশ, পৃষ্ঠা-২৭,২৮ [৯] কোরআনের আলোকে সত্যের স›ন্ধান, ড. মোহাম্মাদ আলী �
�
------ ------
খতীব বাগদাদী রহ. তার ‘আল-জামে লি-আখলাকির রাবি ও আদাবিস সামে’ কিতাবে ইমাম আবু ইউসুফ রহ. থেকে একটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন।
الْعِلْمُ شَيْءٌ لا يُعْطِيكَ بَعْضَهُ حَتَّى تُعْطِيَهُ كُلَّكَ
অর্থ: ইলম এমন একটি জিনিস, সে তোমাকে তার কিছু অংশও দিবে না যতক্ষণ না তুমি নিজেকে পূর্ণভাবে তার কাছে সমর্পণ না করবে।
অন্যান্য সৃষ্টি থেকে মানুষের শ্রেষ্ঠত্যের একটি বিশেষ দিক হলো ইলম অর্জনের ক্ষমতা। এটি মানুষের জন্য আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
ইলমের জন্য যে…
ইবনে তাইমিয়া রহ. এর জীবনী আলোচনা করেছেন তার বিশিষ্ট ছাত্র ইবনুল কাইয়্যিম রহ। তার পৃথক জীবনী লিখেছেন ইবনে তাইমিয়া রহ. এর বিশিষ্ট দুই ছাত্র। একজন হলেন, হাফেজ আবু হাফস উমর ইবনে আলি আল-বাযযার (মৃত:৭৪৯ হি:) তিনি আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া লিখেছেন। ইবনে তাইমিয়া রহ. আরেক ছাত্র ইবনে আব্দুল হাদী রহ. (মৃত: ৭৪৪ হি:) আরেকটি জীবনী লিখেছেন। তার লিখিত জীবনীর নাম আল-উকুদুল দুররিয়া মিন মানাকিবি শাইখিল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া।
আমি এখানে ইবনে তাইমিয়া রহ. এর বিশিষ্ট ছাত্রদের বর্ণনায় তার কিছু উল্লেখযোগ্য কারামত উল্লেখ করছি।
কারামত-১:
লওহে মাহফুজ দেখে বিজয়ের সংবাদ:
গায়েবসম্পর্কেইবনেতাইমিয়ারহ. এরকারামত:
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) “মাদারিজুস সালিকিন শরহু মানাযিলিস সাঈরিন” নামক কিতাবে আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) এর কারামতের কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) লিখেছেন-
أخبر الناس والأمراء سنة اثنتين وسبعمائة لما تحرك التتار وقصدوا الشام : أن الدائرة والهزيمة عليهم وأن الظفر والنصر للمسلمين وأقسم على ذلك أكثر من سبعين يمينا فيقال له : قل إن شاء الله فيقول : إن شاء الله تحقيقا لا تعليقا وسمعته يقول ذلك قال : فلما أكثروا علي قلت : لا تكثروا كتب الله تعالى في اللوح المحفوظ : أنهم مهزومون في هذه الكرة وأن النصر لجيوش الإسلام
“তাতারীরা যখন মুসলিম উম্মাহের বিভিন্ন অঞ্চলে সেনা অভিযান পরিচালনা করে এবং শামে আক্রমণের উদ্যোাগ গ্রহণ করে তখন ৭০২ হিঃ সনে শায়েখ (রহঃ) সাধারণ মানুষ এবং আমীর-উমারাদেরকে সংবাদ দিলেন যে, “তাতারীরা পরাজিত হবে এবং মুসলমানরা বিজয় ও সাহায্য লাভ করবে।”। তিনি তাঁর কথার উপর সত্তরটিরও বেশি কসম খেয়েছেন। তাঁকে বলা হল, আপনি ইনশাআল্লাহ বলুন! অতঃপর তিনি বলেন, নিশ্চিতভাবে ইনশাআল্লাহ বলছি, সম্ভাবনা হিসেবে নয়। আমি তাঁকে বলতে শুনেছি, যখন তারা আমার উপর পীড়াপীড়ি করল, আমি তাদেরকে বললাম, তোমরা পীড়াপীড়ি কর না, আল্লাহ তায়ালা লউহে মাহফুজে লিখে রেখেছেন যে, তারা পরাজিত হবে এবং মুসলমানরা বিজয়ী হবে।
[মাদারিজুস সালিকিন, খ–২, পৃষ্ঠা-৪৮৯]
আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) আরও অনেক কারামতের কথা উল্লেখ করেছেন, ইবনে আব্দুল হাদী মুকাদ্দেসী (রহঃ) এবং আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ)। বিস্তারিত জানার জন্য আগ্রহী পাঠক, মাদারিজুস সালিকীন ও আ’লামুল আলিয়্যা গ্রন্থদ্বয় দেখতে পারেন।
¬
কারামত-২: ইবনে তাইমিয়া রহ. এর ভবিষ্যৎবাণী:
আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) এর বিশেষ ছাত্র আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) লিখেছেন-
وأخبرني غير مرة بأمور باطنة تختص بي مما عزمت عليه ولم ينطق به لساني وأخبرني ببعض حوادث كبار تجري في المستقبل ولم يعين أوقاتها وقد رأيت بعضها وأنا أنتظر بقيتها وما شاهده كبار أصحابه من ذلك أضعاف أضعاف ما شاهدته والله أعلم
“তিনি আমাকে অনেকবার অনেক বাতেনি বিষয়ের সংবাদ দিয়েছেন। তিনি শুধু আমাকে এগুলো বলেছেন এবং এ বিষয় সম্পর্কে আমি কাউকে কিছু বলি নি। তিনি আমাকে ভবিষ্যতের অনেক ঘটনার সংবাদ দিয়েছেন কিন্তু তিনি সময় নির্দিষ্ট করে দেননি। তাঁর ভবিষ্যৎ বাণীর কিছু কিছু আমি ঘটতে দেখেছি এবং অবশিষ্টগুলো সংঘটিত হওয়ার অপেক্ষায় আছি। তাঁর বড় বড় সাগরেদগণ আমি যা দেখেছি, তার চেয়ে বহু বহু গুণ বেশি দেখেছেন”
[মাদারিজুস সালিকিন, খ–২, পৃষ্ঠা-৪৯০]
কারামত-৩: অন্তরের বিষয় সম্পর্কে অবগত হওয়া:
ইবনে তাইমিয়া রহ. এর ছাত্র আবু হাফস উমর আল-বাযযার বলেন,
“أنه جرى بيني وبين بعض الفضلاء منازعة في عدة مسائل وطال كلامنا فيها وجعلنا نقطع الكلام في كل مسألة بأن نرجع إلى الشيخ وما يرجحه من القول فيها
ثم أن الشيخ رضي الله عنه حضر فلما هممنا بسؤاله عن ذلك سبقنا هو وشرع يذكر لنا مسألة مسألة كما كنا فيه وجعل يذكر غالب ما أوردناه في كل مسأله ويذكر أقوال العلماء ثم يرجح منها ما يرجحه الدليل حتى أتى على آخر ما أردنا أن نسأله عنه وبين لنا ما قصدنا أن نستعلمه منه فبقيت أنا وصاحبي ومن حضرنا أولا مبهوتين متعجبين مما كاشفنا به وأظهره الله عليه مما كان في خواطرنا.”
অর্থাৎ আমার সাথে একজন সম্মানিত আলেমের কয়েকটি মাসআলা নিয়ে বিতর্ক হলো। এ বিষয়ে আমাদের আলোচনা অনেক দীঘর্ হলো। প্রত্যেক মাসআলায় আমরা এভাবে কথা শেষ করলাম যে, মাসআলার সমাধান ইবনে তাইমিয়া রহ. এর কাছ থেকে জেনে নিবো।
এরপর শায়খ রহ. আমাদের নিকট উপস্থিত হলেন। আমরা যখন মাসআলাগুলো সম্পর্কে শায়খকে জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছা করলাম তিনি আমাদের জিজ্ঞাসার পূর্বেই আলোচনা শুরু করলেন। তিনি আমাদের আলোচনা অনুযায়ী একের পর এক মাসআলার সমাধান বলতেছিলেন। প্রত্যেক মাসআলায় আমাদের কাঙ্খিত উত্তর প্রদান করছিলেন। এভাবে তিনি প্রত্যেকটি মাসআলায় উলামায়ে কেরামের বক্তব্য এবং দলিল অনুযায়ী প্রাধান্য পাওয়া মাসআলাটি উল্লেখ করছিলেন। অবশেষে তিনি আমাদের আলোচিত সর্বশেষ মাসআলাটির সমাধান প্রদান করলেন। আমাদের অন্তরের বিষয়গুলো আল্লাহ তায়ালা এভাবে সুস্পষ্ট করে প্রকাশ করায় উপস্থিত লোকজন, আমার সঙ্গী ও আমি আশ্চর্যন্বিত ও বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৩, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
নিচের স্ক্রিনশট দেখুন,
এছাড়া আবু হাফস আল-বাযযার অন্তরের বিষয়ে ইবনে তাইমিয়া রহ. এর অবগত হওয়া সম্পর্কে আরও বলেন,
و كنت في خلال الأيام التي صحبته فيها إذا بحث مسألة يحضر لي إيراد فما يستتم خاطري به حتي يشرع فيرده و يذكر الجواب من عدة وجوه
অর্থাৎ আমি যখন যেসময়ে তার সংস্পর্শে ছিলাম, তখন আমার মনে কোন বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ার সঙ্গে তিনি এর জওয়াব দিতে শুরু করতেন এবং কয়েকভাবে এর উত্তর প্রদান করতেন।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৩, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
কারামত-৪: অন্যের সাহায্য
“وحدثني الشيخ الصالح المقريء أحمد بن الحريمي أنه سافر إلى دمشق قال فاتفق أنى لما قدمتها لم يكن معي شئ من النفقة البتة وأنا لا اعرف أحدا من أهلها فجعلت أمشي في زقاق منها كالحائر فإذا بشيخ قد أقبل نحوي مسرعا فسلم وهش في وجهي ووضع في يدي صرة فيها دراهم صالحة وقال لي انفق هذه الآن وخلي خاطرك مما أنت فيه فإن الله لا يضيعك ثم رد على أثره كأنه ما جاء إلا من أجلي فدعوت له وفرحت بذلك، وقلت لبعض من رأيته من الناس من هذا الشيخ؟ فقال وكأنك لا تعرفه هذا ابن تيمية
আমার নিকট শায়খ সালেহ আল –মুকরী বর্ণনা করেন, তিনি দামেশকের উদ্দেশে সফর করেন। তিনি বলেন, ঘটনাক্রমে ঐ সফরে আমার সঙ্গে কোন চলার মতো কোন খাবার বা অর্থ ছিলো না। আমি ওখানকার কাউকে চিনতাম না। এ অবস্থায় আমি উদভ্রান্তের মতো দামেশকের অলি-গলিতে ঘুরছিলাম। হঠাৎ একজন শায়খ আমার দিকে দ্রুত গতিতে হেঁটে এলেন। তিনি হাস্যোজ্জল মুখে সালাম দিলেন। তিনি আমার হাতে একটা থলি দিলেন যাতে কিছু খাটি দিরহাম ছিলো। এরপর বললেন, “ এগুলো ব্যবহার করো। তোমার অন্তরে যেই পেরেশানী আছে এগুলো ঝেড়ে ফেলো। আল্লাহ তায়ালা তোমাকে ধ্বংস করবেন না।” একথা বলে তিনি একই পথে ফিরে গেলেন। তিনি যেন শুধু আমার কাছেই এসেছিলেন। আমি তার জন্য দুয়া করলাম এবং এতে আনন্দি হলাম। আমি অন্যান্য মানুষকে জিজ্ঞেস করলাম, এই শায়খ কে? তারা বললো, তুমি মনে হয় শায়খকে চেনো না, তিনি হলেন ইবনে তাইমিয়া।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৪, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
কারামত-৫:
وحدثني الشيخ العالم المقريء تقي الدين عبد الله ابن الشيخ الصالح المقريء احمد بن سعيد قال سافرت إلى مصر حين كان الشيخ مقيما بها فاتفق أني قدمتها ليلا وأنا مثقل مريض فأنزلت في بعض الأمكنة فلم ألبث أن سمعت من ينادي باسمي وكنيتي فأجبته وأنا ضعيف فدخل إلي جماعة من أصحاب الشيخ ممن كنت قد اجتمعت ببعضهم في دمشق فقلت كيف عرفتم بقدومي وأنا قدمت هذه الساعة فذكروا أن الشيخ أخبرنا بأنك قدمت وأنت مريض وأمرنا أن نسرع بنقلك وما رأينا أحدا جاء ولا أخبرنا بشيء، فعلمت أن ذلك من كرامات الشيخ رضي الله عنه.”
শায়খ সালেহ আল-মুকরী এর ছেলে শায়খ তাকিউদ্দীন আব্দুল্লাহ আল-মুকরী আমাকে বলেছেন, শায়খ ইবনে তাইমিয়া রহ. যখন মিশরে ছিলেন তখন আমি মিশরে সফর করি। আমি রাতে মিশরে গিয়ে উপস্থিত হলাম। তখন আমার কাছে ভারী বোঝা ছিল আর আমি অসুস্থ ছিলাম। আমি এক জায়গায় গিয়ে বাহন থেকে নামলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে শুনতে পেলাম এক ব্যক্তি আমার নাম ও উপনাম ধরে ডাকছে। আমি দুর্বল শরীরে তার ডাকে সাড়া দিলাম। তখন শায়খ ইবনে তাইমিয়ার একদল ছাত্র আমার নিকট এলো। তাদের সাথে আমি পূর্বে দামেশকে সাক্ষাৎ করেছিলাম। আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা আমার আগমন সম্পর্কে কীভাবে জানলে; অথচ আমি মাত্র এলাম? তারা বলল, শায়খ ইবনে তাইমিয়া তাদেরকে বলেছে যে, আপনি এসেছেন এবং আপনার শরীর অসুস্থ। আমাদেরকে দ্রুত আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন। আমরা কাউকে আসতেও দেখিনি এবং আপনার সম্পর্কে কেউ পূর্বে সংবাদও দেয়নি। আমি তখন বুঝলাম এটি শায়খের কারামত।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৪, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
কারামত-৬:
“وحدثني أيضا قال مرضت بدمشق إذ كنت فيها مرضة شديدة منعتني حتى من الجلوس فلم اشعر إلا والشيخ عند رأسي وأنا مثقل مشتد بالحمى والمرض فدعا لي وقال جاءت العافية، فما هو إلا أن فارقني وجاءت العافية وشفيت من وقتي”
শায়খ সালেহ আল-মুকরী এর ছেলে শায়খ তাকিউদ্দীন আব্দুল্লাহ আল-মুকরী আরও বলেন, আমি দামেশকে কঠিন রোগে আক্রান্ত হলাম। এমনকি আমি বসতেও পারতাম না। হঠাৎ আমার মাথার নিকট শায়খকে দেখতে পেলাম।তখন আমি মারাত্মক জ্বর ও রোগে আক্রান্ত ছিলাম।তিনি আমার জন্য দুয়া করলেন এবং বললেন, সুস্থতা চলে এসেছে।তিনি আমার কাছ থেকে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি সুস্থ হয়ে গেলাম।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৫, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
কারামত-৭:
“وحدثني أيضا قال أخبرني الشيخ ابن عماد الدين المقرئ المطرز قال قدمت على الشيخ ومعي حينئذ نفقة فسلمت عليه فرد علي ورحب بي وأدناني ولم يسألني هل معك نفقة أم لا، فلما كان بعد أيام ونفدت نفقتي أردت أن اخرج من مجلسه بعد أن صليت مع الناس وراءه فمنعني وأجلسني دونهم فلما خلا المجلس دفع إلي جملة دراهم وقال أنت الآن بغير نفقة فارتفق بهذه فعجبت من ذلك وعلمت أن الله كشفه على حالي أولا لما كان معي نفقة وآخرا لما نفدت واحتجت إلى نفقة.”
আমার নিকট তিনি আরও বর্ণনা করেছেন, আমার নিকট শায়খ ইবনে ইমাদুদ্দিন আল-মুকরী আল-মুতাররায বর্ণনা করেন, তিনি বলেন আমি একবার শায়খের নিকট আগমন করলাম। তখন আমার কাছে খরচের টাকা-পয়সা ছিলো। আমি তাকে সালাম দিলাম, তিনি উত্তর দিলেন এবং আমাকে স্বাগত জানালেন। আমাকে তিনি তার নিকটে বসালেন। এবার তিনি আমার জীবিকা নির্বাহের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন না। কিছুদিন পর আমার খরচের উপকরণ শেষ হয়ে গেল। তখন আমি তার পিছে নামায আদায় করে তার মজলিশ থেকে বের হতে উদ্যত হলাম। তিনি আমাকে বাধা দিয়ে বসতে বললেন। এরপর যখন মজলিশ শেষ হলো, তখন তিনি আমাকে কিছু দিরহাম দিয়ে বললেন, এখন তোমার কোন খরচের টাকা-পয়সা নেই। এগুলো ব্যবহার করতে থাকে। এ ঘটনায় আমি বিস্মিত হলাম। বুঝলাম যে আল্লাহ তায়ালা আমার পূর্বের ও বর্তমান অবস্থা শায়খের নিকট প্রকাশ করে দিয়েছেন।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৬, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
কারামত-৮: মৃত সম্পর্কে সংবাদ:
“وحدثني من لا أتهمه أن الشيخ رضي الله عنه حين نزل المغل بالشام لأخذ دمشق وغيرها رجف أهلها وخافوا خوفا شديدا، وجاء إليه جماعة منهم وسألوه الدعاء للمسلمين فتوجه إلى الله ثم قال أبشروا فإن الله يأتيكم بالنصر في اليوم الفلاني بعد ثالثة حتى ترون الرؤوس معبأة بعضها فوق بعض.قال الذي حدثني فوالذي نفسي بيده أو كما حلف ما مضى إلا ثلاث مثل قوله حتى رأينا رؤوسهم كما قال الشيخ على ظاهر دمشق معبأة بعضها فوق بعض.”
আমার নিকট বিশ্বস্ত এক ব্যক্তি বর্ণনা করেছেন, যখন মোগলরা দামেশক ও অন্যান্য অন্চল দখলের জন্য শামে আক্রমণ করলো, দামেশকের অধিবাসীরা খুবই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। এসময় একদল মুসলমান শায়খ ইবনে তাইমিয়া রহ. এর নিকট আগমন করলেন এবং তাকে মুসলমানদের জন্য দুয়া করার অনুরোধ করলেন। তিনি আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করলেন। এরপর বললেন, তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ করো, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তিন দিন পর তোমাদেরকে সাহায্য করবেন, এমনকি তোমরা দেখবে যে একটার উপর আরেকটা মাথা স্তুপ হয়ে থাকবে। ঘটনার বর্ণনাকারী বলেন, আল্লাহর শপথ, তৃতীয় দিন দামেশকের প্রবেশ মুখে শত্রুদের মাথাগুলো একটার উপর আরেকটা স্তুপ হয়েছিলো যেমন শায়খ বলেছিলেন।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৬, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
কারামত-৯:
“وحدثني الشيخ الصالح الورع عثمان بن احمد بن عيسى النساج أن الشيخ رضي الله عنه كان يعود المرضى بالبيمارستان بدمشق في كل أسبوع فجاء على عادته فعادهم فوصل إلى شاب منهم فدعا له فشفي سريعا وجاء إلى الشيخ يقصد السلام عليه فلما رآه هش له وأدناه ثم دفع إليه نفقة وقال قد شفاك الله فعاهد الله أن تعجل الرجوع إلى بلدك أيجوز أن تترك زوجتك وبناتك أربعا ضيعة وتقيم هاهنا؟ فقبل يده وقال يا سيدي أنا تائب إلى الله على يدك وقال الفتى وعجبت مما كاشفني به وكنت قد تركتهم بلا نفقة ولم يكن قد عرف بحالي أحد من أهل دمشق.”
শায়খ উসমান ইবনে আহমাদ ইবনে ইসা আন-নাসসাজ আমার নিকট বর্ণনা করেছেন, শায়খ ইবনে তাইমিয়া রহ. দামেশকের বিমারিস্তান নামক জায়গায় প্রত্যেক সপ্তাহে রোগীদের দেখতে আসতেন। অভ্যাস অনুযায়ী তিনি রোগী দেখতে এলেন। তাদের মধ্যে এক যুবককে তিনি দেখলেন এবং তার জন্য দুয়া করলেন। সে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠল। যুবকটি শায়খকে সালাম দেয়ার জন্য এলো। তাকে দেখে শায়খ হাসিমুখে নিকটে বসালেন। তার কাছে কিছু খরচের টাকা-পয়সা দিলেন এবং বলেন, আল্লাহ তায়ালা তোমাকে সুস্থ করেছেন। সুতরাং তুমি আল্লাহর কাছে ওয়াদা করো যে তুমি দ্রুত পরিবারের কাছে ফিরে যাবে। তোমার জন্য কখনও বৈধ হবে যে তোমার স্ত্রী ও চার কন্যাকে ধ্বংসের মুখে রেখে এখানে অবস্থান করবে? যুবকটি বলল, আমি তার হাতে চুমু দিলাম এবং বললাম, শায়খ, আমি আল্লাহর নিকট আপনার হাতে তওবা করছি।
আমি তার কাশফ দেখে বিস্মিত হলাম। বাস্তবেই আমি আমার পরিবারকে সহায়-সম্বলহীন রেখে এসেছিলাম।দামেশকের কেউ আামার পরিবার সম্পর্কে অবগত ছিলো না।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৬, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
এই কারামতগুলো লিখে আবু হাফস আল-বাযযার রহ. লিখেছেন,
و كرامات الشيخ رضي الله عنه كثيرة جدا لا يليق بهذا المختصر أكثر من ذكر هذا القدر منها . ومن أظهر كراماته أنه ما سمع بأحد عاداه أو غض عنه إلا و أبتلي بعدة بلايا غالبها في دينه وهذا ظاهر مشهور لا يحتاج فيه إلي شرح صفته
শায়খ রহ. অনেক কারামত রয়েছে। এই সংক্ষিপ্ত বইয়ে সেগুলো উল্লেখ করা সঙ্গত নয়। তার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ করামত হলো যে কেউ শায়খের বিরোধীতা করেছে বা তার সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক রয়েছে, সে বিভিন্ন ধরনের বালা-মুসীবতে নিপতিত হয়েছে। বেশিরভাগ মুসীবত দীন সম্পর্কীয়। বিষয়গুলো স্পষ্ট ও প্রকাশিত। এগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা অনাবশ্যক।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৮, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
কাশফ ও ইলহাম সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া রহ. এর অনেক কারামত রয়েছে। এ বিষয়ে তার অনেক বক্তব্যও আছে। এগুলোর কিছু কিছু ইবনে তাইমিয়া রহ. এর দৃষ্টিতে তাসাউফ বইয়ে উল্লেখ করেছি। দু:খজনক বিষয় হলো, আমাদের আজকের আলোচনার মূল বিষয় এখনও শুরু করা হয়নি। আজ এখানেই ইতি টানছি। পরবর্তী আলোচনায় গায়েব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করা হবে।
------ ------
[বর্তমানে ইবনে আবিল ইযের আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাগ্রন্থটি ব্যাপকভাবে প্রচারের চেষ্টা করা হচ্ছে। যেমন, সালাফী আলেম আব্দুল্লাহ শাহেদ মাদানী এর বাংলা অনুবাদ করে অনলাইনে প্রচার করছেন। সুতরাং এই কিতাবের বাস্তবতা ও এর লেখক সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাগুলো সুস্পষ্ট করা আবশ্যক। আকিদাতুত ত্বহাবীর উপর দরসের নিয়ত ব্যক্ত করেছিলাম কিছু দিন আগে। উক্ত দরসের প্রয়োজনে আজকের আলোচনাটি লেখা। যারা উক্ত দরস দেখবেন, আশা করি বিষয়টি তাদের উপকারে আসবে। ]
সৌদি আরবের কল্যাণে কাররামিয়াদের ভ্রান্ত দেহবাদী আকিদাগুলো সালাফী মতবাদের মোড়কে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। পেট্র-ডলারের সহায়তায় তারা এক্ষেত্রে অনেকটা অগ্রসর। সালাফীদের ভ্রান্ত আকিদা সম্পর্কে বেশ কিছু প্রবন্ধ লেখার সুযোগ হয়েছে আল-হামদুলিল্লাহ। আমাদের আইডিয়ার ওয়েবসাইটে লেখাগুলো পাবেন। সালাফী মতবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে থাকে। এর মধ্যে একটি বিশেষ কৌশল হল, বিভিন্ন ইমামের আকিদার কিতাব ব্যাখ্যার নামে নিজেদের ভ্রান্ত আকিদা ছড়িয়ে দেয়া। উদাহরণ হিসেবে ইমাম ত্বহাবীর আকিদাতুত ত্বহাবীর কথা বলা যায়। একটু খোজ নিলে দেখবেন, প্রায় প্রত্যেক সালাফী শায়খই আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখেছেন, কেউ অডিও বা ভিডিও লেকচার দিয়েছেন। অন্তত বিশ-পজিশজন বা এর চেয়ে বেশি সালাফী শায়খের ব্যাখ্যা পাবেন। একটি মৌলিক প্রশ্ন হল, এসব সালাফী আলেমরা কি ইমাম ত্বহাবীর আকিদা পোষণ করেন? ধ্রুব সত্য হল, ইমাম ত্বহাবীর আকিদার সাথে এদের আকিদার দূরতম কোন সম্পর্ক নেই। ইমাম ত্বহাবী রহ. এর আকিদার ও এদের আকিদার মাঝে আসমান-জমিনের ফারাক। আরেকটি প্রশ্ন মনে উকি দেয়, এরা যেহেতু ইমাম ত্বাহাবীর আকিদা পোষণ করে না, তাহলে এর ব্যাখ্যা করে কেন? সহজ উত্তর হল, ইমাম ত্বহাবীর আকিদা প্রচারের ছদ্মাবরণে নিজেদের ভ্রান্ত আকিদা প্রচার। এদের যে কোন একটা ব্যাখ্য পড়লেই এই বাস্তবতা উপলব্ধি করবেন।
সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে ইমাম ত্বহাবী রহ. এর আকিদাকে বিকৃত করার লক্ষ্যে লিখিত একটি বেনামী ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৩৪৯ হিজরীতে। বে-নামী ব্যাখ্যা এজন্য বললাম, উক্ত ব্যাখ্যার উপর লেখকের নাম ছিল না। আর প্রশাকগণ নিশ্চিত ছিলেন না যে, ব্যাখ্যাগ্রন্থটি মূলত: কার। পরবর্তীতে তারা তত্ব-তালাশ করে উদ্ধার করেন, এটি ইবনে আবিল ইয আল-হানাফীর লেখা। বর্তমানে এটি ইবনে আবিল ইযের ব্যাখ্যা হিসেবে প্রচার করা হয়। আমাদের আলোচ্য বিষয় শিরোনাম থেকে কিছুটা স্পষ্ট। তবে দু’টি বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করার চেষ্টা করব। ১. ইবনে আবিল ইযের নামে প্রচারিত আকিদা কি আসলেই ইবনে আবিল ইযের লেখা?২. ইবনে আবিল ইযকে হানাফী হিসেবে প্রচার করা হয়। তিনি কি হানাফী ছিলেন না কি দেহবাদী আকিদায় বিশ্বাসী হাশাবী ছিলেন?
প্রচলিত আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যা কি ইবনে আবিল ইযের?
বিষয়টি বোঝার জন্য ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রকাশের ইতিহাসের দিকে ফিরে যেতে হবে। আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যাগ্রন্থটি ১৩৪৯ হিজরীতে মক্কায় সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়।
এই প্রকাশনায় কিতাবের উপর লেখকের কোন নাম ছিল না। বরং প্রকাশকরা লেখেন,
راجعنا ما في أيدينا من كتب التراجم والفنون، فلم نجد ما يمكننا معه الجزم بنسبته لشخص بعينه، وإنا نثبت هنا أسماء شارحي هذه العقيدة الذين عدهم صاحب كشف الظنون وهم سبعة ……. ومنهم صدر الدين علي بن محمد بن أبي العز الأذرعي الدمشقي الحنفي المتوفى سنة 746هـ وهو الذي يترجح الظن أنه الشارح” আমাদের কাছে বিদ্যমান বিভিন্ন জীবনীগ্রন্থ ও রিজালের কিতাবে আমরা অনুসন্ধান চালিয়েছি। আমরা এমন কোন তথ্য পাইনি, যার আলোকে সুনিশ্চিতভাবে ব্যাখ্যাগ্রন্থটিকে সুনির্দিষ্ট কোন লেখকের দিকে সম্পৃক্ত করা সম্ভব। কাশফুজ জুনুন এর লেখকের বক্তব্য অনুযায়ী আমরা এখানে আকিদাত্ব ত্বহাবীর সমস্ত ব্যাখ্যাকারের নাম উল্লেখ করছি। তারা হলেন সাতজন…….। এদের মাঝে একজন ব্যাখ্যাকার হলেন, সদরুদ্দিন আলী ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবিল ইয হানাফী (মৃত:৭৪৬ হি:)। আমাদের বিশেষ ধারণা হল, সাতজন ব্যাখ্যাকারের মাঝে তিনি হলেন আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাকার। “
এখানে প্রবল ধারণা হিসেবে সদরুদ্দিন আলী ইবনে মুহাম্মাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যার মৃত্যু তারিখ হল, ৭৪৬ হিজরী। আর বর্তমানে প্রচারিত ব্যাখ্যাকার হলেন, আলী ইবনে আলী ইবনে আবিল ইয। যার মৃত্যু তারিখ হল, ৭৯২ হিজরী। এখানে প্রবল ধারণা হিসেবে যার কথা বলা হয়েছে, তিনি হলেন বর্তমানে প্রচারিত লেখকের পিতা। ছেলে আর পিতা কখনও এক হতে পারে না। উভয়ের মৃত্যু তারিখ থেকেও বিষয়টি স্পষ্ট। মোটকথা, ব্যাখ্যাগ্রন্থটি কার সেটা সুনিশ্চিতভাবে বলার মত কোন তথ্য তখনকার উলামায়ে কেরাম পাননি। পরবর্তীতে সৌদি আরবের শায়খগণ বিখ্যাত আলেম আহমাদ শাকেরকে এটি তাহকীক করার অনুরোধ করেন। শায়খ আহমাদ শাকের পরবর্তীতে এটি তাহকীক করে প্রকাশ করেন।
তিনি এর ভূমিকায় লেখেন, ” এ কিতাবের যে মাখতুতা বা হস্তলিপি আমি পেয়েছি, সেখানে মূল লেখকের নেই। সুতরাং কিতাবের লেখক আসলে কে সেটা জানা সম্ভব হয়নি। ”
শায়খ আহমাদ শাকের তার ভূমিকায় কয়েকবার বলেছেন যে, তিনি এই কিতাবের নির্ভরযোগ্য কোন মাখতুতা বা হস্তলিপি পাননি।
তিনি তার সাধ্য অনুযায়ী এটি তাহকীক করার চেষ্টা করেছেন। শায়খ আহমাদ শাকের আশা ব্যক্ত করেছেন, তিনি যদি নির্ভরযোগ্য কোন হস্তলিপি পান, তাহলে পরবর্তীতে এটি সংশোধনের চেষ্টা করবেন।
শায়খ আহমাদ শাকের বলেন,
ولكني لا أزال أرى هذه الطبعة مؤقتة أيضا، حتى يوفقنا الله إلى أصل محفوظ للشرح صحيح، يكون عمدة في التصحيح فنعيد طبعه
“আমি এখনও মনে করি, এই সংস্করণ অস্থায়ী। আল্লাহ তায়ালা যদি নির্ভরযোগ্য বিশুদ্ধ কোন হস্তলিপি মিলিয়ে দেন, তাহলে এটি সংশোধন করে নতুনভাবে প্রকাশ করার করব। শায়খ আহমাদ শাকের আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. [মৃত: ১২০৫ হি:] এর একটি বক্তব্য পান ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিনে। সেখানে মোর্তজা যাবিদি রহ. ব্যাখ্যাকারের নাম লিখেছেন, আলী ইবনে আলী ইবনে মুহাম্মাদ আল-গাজ্জী আল-হানাফী। মোর্তজা যাবিদি রহ. এর উদ্ধৃতিতে লেখকের সঠিক পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি।
শায়খ আহমাদ শাকের বলেন, মোর্তজা যাবিদি রহ. লেখকের নামের নিসবতে ভুল করেছেন। তিনি লিখেছেন, আলী ইবনে আলী আল-গাজ্জী, বাস্তবে হওয়ার কথা ছিল, আলী ইবনে আলী ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী। মোটকথা, শায়খ আহমাদ শাকেরের সামনে মোর্তজা যাবিদি রহ. এর উদ্ধৃতি ছিল, বেশ কয়েকটি মাখতুতা ছিল এরপরেও ব্যাখ্যাকার সম্পর্কে সুনিশ্চিতভাবে বলেননিন যে, অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে, উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের লেখক ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী। শায়খ আহমাদ শাকের মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্যের আলোকে তার ধারণা অনুযায়ী কিতাবে লেখকের নাম লিখেছেন, আলী ইবনে আলী ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী। পরবর্তীতে মাকতাবাতুল ইসলামী থেকে শায়খ আলবানীর তাহকীকে ব্যাখ্যাগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। সেখানে কিছু মাখতুতা বা হস্তলিপি এর চিত্র দেয়া হয়েছে। এসকল হস্তলিপিতে স্পষ্টভাবে লেখকের নাম লেখা হয়েছে, আলী ইবনে মুহাম্মাদ। যার মৃত্যু তারিখ, ৭৪৬ হি:। সুতরাং মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্য অনুযায়ী, লেখকের নাম হওয়ার কথা ছিল, আলী ইবনে আলী আল-গাজ্জী। মাকতাবাতুল ইসলামী এর মাখতুতা অনুযায়ী, লেখকের নাম আলী ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবিল ইয। সুতরাং একথা সুনিশ্চিতভাবে বলার অবকাশ নেই যে, উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের প্রকৃত লেখক কে। এরপরেও শায়খ আলবানী ও যুহাইর আশ-শাবীশ দাবী করেন, সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হল, উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের লেখক ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী।
শায়খ যুহাইর আশ-শাবীস নবম সংস্করণের ভূমিকায় ( পৃ.৯) লিখেছেন,
وأما نسختنا فقد كان اسم مؤلفها مثبتا على الورقة الأولى منها، إلا أن بعض الأيدي قد لعبت فيه بالمحو والكتابة أكثر من مرة، وأخيرا أثبت عليه ما أثبته الشيخ أحمد شاكرঅর্থ: আমাদের মূল হস্তলিপিতে লেখকের নাম প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা ছিল। তবে অজ্ঞাত কেউ উক্ত নাম কয়েকবার ঘষা-মাজা করে নতুনভাবে লিখেছে। অবশেষে আমি শায়খ আহমাদ শাকেরের তথ্য অনুযায়ী লেখকের নাম উল্লেখ করেছি।মোটকথা, এই ব্যাখ্যাগ্রন্থের মূল হস্তলিপিতে লেখকের নাম উল্লেখ নেই। পরবর্তীতে বিভিন্ন ঘষা-মাজার মাধ্যমে অজ্ঞাত কেউ হস্তলিপিতে লেখকের নাম সংযুক্ত করেছে। ঘষা-মাজা করে নাম সংযুক্ত করার পরও বর্তমানে প্রচলিত লেখকের নাম উক্ত হস্তলিপিতে নেই। বরং প্রচলিত লেখকের পিতার নাম ও তার মৃত্যু তারিখ দেয়া রয়েছে।
চূড়ান্ত কথা:
ইবনে আবিল ইয এধরণের ব্যাখ্যাগ্রন্থ লেখাটা অসম্ভব নয়। প্রবল ধারণা মতে হয়ত তিনি এটি লিখেছেন। কিন্তু ইবনে ইয এর লেখক হওয়ার ব্যাপারে অকাট্য কোন প্রমাণ কারও কাছে নেই, যার আলোকে নি:সন্দেহে বলা যাবে, এটি ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী লিখেছেন। ইবনে আবিল ইয আল-হানাফীর জীবনী থেকে একটা ধারণা সৃষ্টি হয়, হয়ত তিনি এটি লিখেছেন। আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. এর উদ্ধৃতি থেকে হয়ত ধারণাটি আরেকটু মজবুত হয়। কিন্তু এটা সুনিশ্চিত বা অকাট্য কোন প্রমাণ বলার সুযোগ নেই। উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের লেখক ইবনে আবিল ইয হলেও আমাদের কোন আপত্তি নেই। না হলেও এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই। কিতাবটি ছেলে লিখেছে না কি তার পিতা লিখেছে সেটাও মৌলিক কোন বিষয় নয়।
আমাদের নিকট মূল বিবেচ্য বিষয় হল, ইবনে আবিল ইযকে হানাফী হিসেবে প্রচার করা হয়। সেই সাথে এটাও বোঝানো হয় যে, তিনি হানাফীদের আকিদার প্রতিনিধত্ব করেন। অন্যান্য হানাফীগণ তার বিরোধীতা করে মূলত: হানাফীদের মৌলিক আকিদার বিরোধিতা করে থাকে।
আমাদের সামনে মৌলিক কয়েকটি প্রশ্ন দেখা দিয়েছে,
১. ইবনে আবিল ইয বাস্তবেই কি হানাফী ছিলেন?
২. তিনি আদৌ কি হানাফী মাজহাবের সুপ্রতিষ্ঠিত আকিদার অনুসারী ছিলেন?৩. তার লেখা ব্যাখ্যাগ্রন্থ ইমাম ত্বহাবী বা হানাফী মাজহাবের মৌলিক আকিদার প্রতিনিধিত্ব করে কি?৪. ইবনে আবিল ইযের আকিদা হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমদের নিকট নির্ভরযোগ্য কি?
৫. ইবনে আবিল ইযকে হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণ নির্ভরযোগ্য আলেম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন কি?
৬. হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণ ইবনে আবিল ইযের আকিদার সাথে সহমত পোষণ করেন না কি তার প্রবল বিরোধীতা করেন?
৭. হানাফী মাজহাবের উলামায়ে কেরামের জীবনীর উপর বিভিন্ন গ্রন্থ লেখা হয়েছে। এসকল কিতাবে হানাফী আলেম হিসেবে তার জীবনী বা নির্ভরযোগ্য আলেম হিসেবে কোথাও তস্বীকৃতি দেয়া হয়েছে কি?আমরা ইনশাআল্লাহ প্রত্যেকটি বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করব।
ইবনে আবিল ইযের মাজহাব:
শরহে আকিদাতু ত্বহাবীর তাহকীক করেছেন, শায়খ শুয়াইব আরনাউত ও শায়খ আব্দুল্লাহ তুরকী। তারা উক্ত তাহকীকে ইবনে আবিল ইযের জীবনী আলোচনা করেছেন। তার জীবনী আলোচনা করতে গিয়ে তারা লিখেছেন, ইবনে আবিল ইযকে হানাফী মাজহাবের দিকে সম্পৃক্ত করা হয়। তবে বাস্তবে তিনি নিজের গর্দানকে তাকলীদের (মাজহাব অনুসরণ) বন্ধন থেকে মুক্ত করেন। শায়খ শুয়াইব আরনাউত ও শায়খ আব্দুল্লাহ তুরকীর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ইবনে আবিল ইয একজন গাইরে মুকাল্লিদ, লা-মাজহাবী বা যাহেরী ছিল।
ইবনে আবিল ইয পারিবারিকভাবে হানাফী ছিল। যেমন শায়খ আলবানী পারিবারিকভাবে হানাফী ছিল। কিন্তু কেউ হানাফী পরিবারে জন্মগ্রহণ করলে, কিংবা হানাফী মাদ্রাসায় পড়লে বা পড়ালে সে হানাফী হয়ে যায় না। আমাদের দেশের অধিকাংশ লা-মাজহাবী হানাফী পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও তারা গাইরে মুকাল্লিদ। একইভাবে বর্তমানে আহলে হাদীসদের অধিকাংশ শায়খ হানাফী মাজহাবের মাদ্রাসায় পড়া-লেখা করেছে, কিন্তু তারা হানাফী নয়। সুতরাং কারও হানাফী হওয়াটা তার পরিবার, পিতা-মাতা বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করে না। ইবনে আবিল ইয জন্মগতভাবে হানাফী হলেও বাস্তবে সে হানাফী নয়। বরং ইবনে আবিল ইয একজন গাইরে মুকাল্লিদ বা লা-মাজহাবী।সুতরাং তাকে হানাফী হিসেবে প্রচার করে তাকে হানাফী মাজহাব বা আকিদার প্রতিনিধি হিসেবে প্রকাশ করা একটি মারাত্মক ভুল।
যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেই যে, ইবনে আবিল ইয হানাফী ফিকহের অনুসারী ছিল, কারণ সে হানাফী মাজহাবের মাদ্রাসায় শিক্ষতা করেছে, তাহলে এটি কখনও বলা সম্ভব নয় যে, সে আকিদার দিক থেকেও হানাফী ছিলা। মু’তাজিলা সম্প্রদায়ের অনেকেই হানাফী মাজহাবের অনুসারী ছিল, কিন্তু তাদের কাউকে হানাফী বলা হয় না। একইভাবে কাররামিয়াদের অনেকেই হানাফী মাজহাব অনুসরণ করত। কিন্তু তাদেরকেও হানাফী বলা হয় না। ফিকহের দিক থেকে কেউ হানাফী ফিকহ অনুসরণ করলেই তাকে হানাফী হিসেবে পরিচয় দেয়া হয় না। কারণ হানাফী হিসেবে কারও পরিচিতি এটা প্রমাণ করে যে, সে আকিদা ও ফিকহ উভয় ক্ষেত্রে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অন্তর্ভূক্ত। কেউ যদি ফিকহের ক্ষেত্রে হানাফী মাজহাব অনুসরণ করে, কিন্তু আকিদার ক্ষেত্রে আহলে সু্ন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত আকিদা পোষণ করে তাকে হানাফী বলা হয় না। বরং আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত আকিদার দিকে তাকে সম্পৃক্ত করা হয়। কাররামিয়া মতবাদের অনুসারী কারও নামের শেষে হানাফী লাগিয়ে দিয়ে আকিদা ও ফিকহে তাকে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অন্তর্ভূক্ত করার অপচেষ্টা কেউ করলে সেটি অবশ্যই বাস্তবতা বিরোধী। সুতরাং ফিকহ ও আকিদা উভয় ক্ষেত্রে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত ইবনে আবিল ইযকে কীভাবে হানাফী হিসেবে পরিচয় দেয়া হয়? তার বাহ্যিক অবস্থা বিবেচনা করে হানাফী লিখলেও তাকে যদি কেউ হানাফী ফিকহ বা আকিদার প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন করে, তাহলে অবশ্যই আমরা বলব, প্রকৃতপক্ষে ইবনে আবিল ইয ফিকহ ও আকিদা কোন ক্ষেত্রেই হানাফী ছিল না। বরং সে কাররামিয়াদের অনুসারী হাশাবী বা দেহবাদী আকিদায় বিশ্বাসী ছিল। ইবনে আবিল ইযের যেসকল কিতাব তার দিকে সম্পৃক্ত করা হয়, তার প্রত্যেকটি সে হানাফী মাজহাবের বিরুদ্ধে লিখেছে। হানাফী মাজহাবের পক্ষে তার বিশেষ কোন খেদমত নেই।
ইবনে আবিল ইযের গাইরে মুকাল্লিদ হওয়ার আরেকটি প্রমাণ হল, তার একটি কিতাব বর্তমানের আহলে লা-মাজহাবীরা প্রচার করে থাকে। আহলে হাদীস আলেম আতাউল্লাহ হানীফ ইবনে আবিল ইযের “আল-ইত্তেবা” কিতাবটি তাহকীক করে প্রকাশ করেছে। পরবর্তীতে আবু সুহাইব আসিম ইবনে আব্দুল্লাহ আল-কারইউতী এটি তাহকীক করেছে। আবু সুহাইব এই কিতাবের ভূমিকায় হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেম আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. ও আল্লামা যফর আহমাদ উসমানী রহ. এর বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছে এবং এসমস্ত বিখ্যাত আলেমদের বিরুদ্ধে ইবনে আবিল ইযের বক্তব্য উপস্থাপন করেছে। যেখানে ইবনে আবিল ইয সুনিদিষ্ট একটি মাজহাবের অনুসারীকে শিয়াদের সাথে তুলনা করেছে। নাউযুবিল্লাহ। ইবনে আবিল ইযের অবস্থা থেকে বাংলা ভাষার প্রসিদ্ধ একটি প্রবাদবাক্য মনে পড়ে গেল। “মার চেয়ে মাসির দরদ বেশি” ।ইবনে আবিল ইযের প্রতি সালাফী ও আহলে হাদীসদের অতিশয় আগ্রহ এটিই প্রমাণ করে। বর্তমানের সালাফীরা হানাফী মাজহাবের উলামায়ে কেরামকে তাদের আকিদার বিরোধী হওয়ার কারণে কাফের, বিদযাতী, জাহমী, মুয়াত্তিলা ইত্যাদি আখ্যায়িত করে। এ বিষয়ে অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। হানাফী মাজহাবের অধিকাংশ আলেম যাদের কাছে কাফের ও বিদয়াতী, তারাই ইবনে আবিল ইযের আকিদা প্রচার করছে। আবার উপমহাদেশের লা-মাজহাবীরা মাজহাবের অনুসারীদেরকে মুশরিক বলে বিশ্বাস করে, অথচ তারাই আবার ইবনে আবিল ইযের কিতাব প্রকাশ ও প্রচার করছে। ইবনে আবিল ইয আসলেই যদি হানাফী হত, তাহলে হানাফীদেরকে যারা কাফের-মুশরিক আখ্যা দিচ্ছে, তারা কেন তার কিতাব নিয়ে এত মাতামাতি করে?
ইবনে আবিল ইয সম্পর্কে হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণের বক্তব্য:
মোল্লা আলী কারী রহ. এর বক্তব্য:
মোল্লা আলী কারী রহ. শরহে ফিকহুল আকবারে আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যাকার সম্পর্কে লিখেছেন,
والحاصل ان الشارح يقول بعلو المكان مع نفي التشبيه وتبع فيه طائفة من أهل البدعة
মোটকথা, আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যাকার তাশবীহমুক্ত অবস্থায় আল্লাহ তায়ালা স্থানগতভাবে উপরের দিকে রয়েছেন বলে বিশ্বাস করে। এক্ষেত্রে সে একদল বিদয়াতীর অনুসরণ করেছে। তিনি আরও বলেন,
و من الغريب أنه إستدل على مذهبه الباطل برفع الأيدي في الدعاء إلى السماء
অর্থ: আশ্চর্যের বিষয় হল, সে তার ভ্রান্ত মতবাদ প্রমাণ করতে গিয়ে দুয়ার সময় হাত উপরের দিকে উঠানোর দলিল দিয়েছে। (শরহুল ফিকহিল আকবার, পৃ.১৭২. আল-ইলিময়া)মোল্লা আলী কারী রহ. এর বক্তব্য থেকে দু’টি বিষয় স্পষ্ট। তিনি ইবনে আবিল ইযকে বিদয়াতীদের অনুসারী বলেছেন। এবং তার মতবাদকে বাতিল বা ভ্রান্ত মতবাদ আখ্যায়িত করেছেন।
আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্য:
আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিনে ইবনে আবিল ইয সম্পর্কে লিখেছেন,
“ولما تأملته حق التأمل؛ وجدته كلامًا مخالفًا لأصول مذهب إمامه!! وهو في الحقيقة كالرد على أئمة السنة، كأنه تكلم بلسان المخالفين، وجازف وتجاوز عن الحدود، حتى شبه قول أهل السنة بقول النصارى! فليتنبه لذلك”.
অর্থ: আমি তার (ইবনে আবিল ইযের) বক্তব্য সম্পর্কে পরিপূর্ণ চিন্তা-ভাবনা করে দেখেছি, তার বক্তব্য তার ইমামের মাজহাবের মৌলিক নীতিমালার সম্পূর্ণ বিরোধী। বরং প্রকৃতপক্ষে তার বক্তব্য যেন আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের ইমামগণের বক্তব্য খন্ডনে লিখিত। তার বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয়, সে যেন আহলে সুন্নতের ইমামগণের সাথে প্রতিপক্ষ হিসেবে কথা বলেছে। সে মারাত্মক বিকৃতির শিকার হয়েছে এবং সীমা অতিক্রম করেছে। এমনকি সে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের ইমামগণের বক্তব্যকে খ্রিষ্টানদের বক্তব্যের সাথে তুলনা করেছে। সুতরাং এ বিষয় সতর্ক থেক। [ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিন, খ.২, পৃ.১৪৬]
আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্য থেকে যেসকল বিষয় স্পষ্ট:
১. ইবনে আবিল ইয হানাফী মাজহাবের মৌলিক নীতিমালা অনুসরণ করত না।
২. তার লেখনী মূলত: হানাফী মাজহাব ও আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের বক্তব্য খন্ডনের উদ্দেশ্যে লিখিত।৩. হানাফী মাজহাব ও আহলে সুন্নতের উলামায়ে কেরামের সাথে যেন সে প্রতিপক্ষ হিসেবে কথা বলেছে।
৪.সে মারাত্মক প্রগলভতার শিকার হয়ে সীমা অতিক্রম করেছে।
৫. আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের উলামায়ে কেরামের বক্তব্যকে খ্রিষ্টানদের বক্তব্যের সাথে তুলনা করেছে।
৬. আল্লামা যাবিদি রহ. তার এসব বক্তব্যের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেছেন।
আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. এর বক্তব্য:
হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত ইমাম আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাকার সম্পর্কে বলেন,
وطبع شرح لمجهول ينسب إلى المذهب الحنفي زورا ينادي صنع يده بأنه جاهل بهذا الفن وأنه حشوي مختل العيار
“আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যা হিসেবে একজন অজ্ঞাত ব্যক্তির একটি ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। যাকে বানোয়াটী করে হানাফী মাজহাবের দিকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এ লোকের লেখনী দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করে যে সে আকিদা সম্পর্কে অজ্ঞ। সে একজন হাশাবী বা দেহবাদী এবং মারাত্মক বিচ্যুতির শিকার। “[আল-হাবী ফি সিরাতিল ইমামিত ত্বহাবী, পৃ. ৩৮]আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. এর বক্তব্য থেকে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট। প্রথমত: ইবনে আবিল ইযকে হানাফী মাজহাবের দিকে সম্পৃক্ত করা একটি বানোয়াট বা মিথ্যা। বাস্তবে সে হানাফী ছিল না। দ্বিতীয়ত: ইবনে আবিল ইয আকিদা বিষয়ে জাহেল বা অজ্ঞ ছিল এবং সে একজন মুজাসসিমা বা দেহবাদী আকিদার অনুসারী হাশাবী ছিল। আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. এর বক্তব্য অনুযায়ী আমরা ইবনে আবিল ইযকে হানাফী না বলে দেহবাদী আকিদার অনুসারী হাশাবী বলতে পারি।
ইবনে আবিল ইযের সম-সাময়িক আলেমগণের বিরোধীতা:ইবনে আবিল ইযের ভ্রান্ত কিছু বক্তব্য প্রকাশিত হওয়ার তখনকার বিখ্যাত আলেমগণ তার প্রতিবাদ করেন। বিশেষভাবে অন্যান্য তিন মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণের সাথে হানাফী মাজহাবের আলেমগণও তার প্রতিবাদ করেন।
আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহ. তার ‘ইম্বাউল গুমর বি আবনায়িল উমর’ কিতাবে লিখেছেন,
وأن العلماء بالديار المصرية خصوصا أهل مذهبة من الحنفية أنكرواذلك عليه
অর্থ: মিশরের আলেমগণ বিশেষভাবে তার মাজহাব তথা হানাফী মাজহাবের উলামায়ে কেরাম তার বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন। [ইমবাউল গুমর, খ.২, পৃ.৯৬]
যেসব উলামায়ে কেরাম ইবনে আবিল ইযের বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন, এদের মাঝে বিখ্যাত কিছু আলেমের নাম উল্লেখ করেছেন ইবনে হাজার আসকালানী রহ.। যেমন, যাইনুদ্দীন ইবনে রজব রহ, তকীউদ্দীন ইবনে মুফলিহ রহ. শরফুদ্দীন ইবনে গাজ্জী রহ. ।
বর্তমানে সালাফীরা ইবনে আবিল ইযের আরেকটি কিতাব প্রকাশ করেছে। কিতাবের নাম হল, আত-তাম্বীহ আলা মুশকিলাতিল হিদায়াহ। সালাফী আলেমরা ইবনে আবিল ইযের রচনা হিসেবে এটি প্রকাশ করেছে। যদিও কিতাবটি ইবনে আবিল ইযের নাকি তার দাদার এটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সালাফীদের বক্তব্য অনুযায়ী কিতাবটি যদি ইবনে আবিল ইযের হয়, তাহলে তার সম্পর্কে হানাফী মাজহাবের আরও কিছু উলামায়ে কেরামের বক্তব্য শুনুন।
ইমাম সাখাবী রহ. তার আজ-জাওউল লামে কিতাবে লিখেছেন, হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত ইমাম কাসেম ইবনে কুতলুবুগা ইবনে হেদায়া কিতাবের উপর ইবনুল ইযের অভিযোগ খন্ডন করে কিতাব লিখেছেন। “صنّف “أجوبةً عن اعتراضات ابن العزّ على الهداية”[আজ-জাওউল লামে, খ.৬, পৃ.১৮৭]
সালাফীরা ইবনে আবিল ইযের উক্ত কিতাবকে হেদায়ার ব্যাখ্যা হিসেবে প্রচারের চেষ্টা করলেও এটি মূলত: হেদায়া কিতাবের উপর তার অভিযোগ সংকলন। একারণে আল্লামা কাসেম ইবনে কুতলুবুগা তার অভিযোগ খন্ডন করেছেন। একইভাবে আল-বাহরুর রায়েকে রয়েছে ফাতহুল কাদীরে আল্লামা ইবনুল হুমাম ইবনুল ইযের বক্তব্য খন্ডন করেছেন।
وَقَدْ أَطَالَ فِي فَتْحِ الْقَدِيرِ فِي بَيَانِهِ إطَالَةً حَسَنَةً وَتَعَرَّضَ لِلرَّدِّ عَلَى ابْنِ الْعِزِّ، وَلَسْنَا بِصَدَدِ ذَلِكَ
[আল-বাহরুর রায়েক, বাবুল ইয়ামীন ফিল আকলি ওয়াশ শুরব]
সালাফীদের বক্তব্য অনুযায়ী আত-তাম্বীহ আলা শরহিল হেদায়া কিতাবটি যদি আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাকার ইবনে আবিল ইযের হয়, তাহলে তার বক্তব্য আল্লামা হাসকাফী ও আল্লামা ইবনে আবিদীন খন্ডন করেছেন। তার বক্তব্যকে গরীব (আশ্চর্যজনক) আখ্যা দিয়েছেন। বিস্তারিত,
“قال (ابن العز!): فحينئذ ينقض الوضوء، وهو فرع غريب وتخريج ظاهر.قال المصنف: ولظهوره عوّلنا عليه.قلت: قال شيخنا الرملي حفظه الله تعالى: كيف يعول عليه وهو مع غرابته لا يشهد له رواية ولا دراية، أما الاولى فظاهر إذا لم يرو عن أحد ممن يعتمد عليه، وأما الثانية فلعدم تسليم المقدمة الاولى ويشهد لبطلانها مسألة الجدي إذا غذي بلبن الخنزير فقد عللوا حل أكله بصيرورته مستهلكا لا يبقى له أثر، فكذلك نقول في عرق مدمن الخمر، ويكفينا في ضعفه غرابته”.[রদ্দুল মুহতার, খ.৬, পৃ.১৪৬-১৪৭]
আকিদার ক্ষেত্রে ইবনে আবিল ইযের বিচ্যুতি সুস্পষ্ট। অধিকাংশ বিষয়ে সে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত আকিদা পোষণ করে। এবং কাররামিয়া ও মুজাসসিমাদের ভ্রান্ত বক্তব্য প্রচার করেছে। আকিদাতুত ত্বহাবীর সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা ভিডিও আকারে প্রকাশের নিয়ত রয়েছে। আমাদের আলোচনায় ইবনে আবিল ইযের ভ্রান্ত মতবাদগুলি বিস্তারিত উল্লেখ করা হবে ইনশাআল্লাহ। এখানে সংক্ষেপে দু’একটি বিষয় উল্লেখ করা মুনাসিব মনে করছি। এসকল বিষয়ের কয়েকটি কুফুরী পর্যায়ের। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করেন।
১. কিছু সৃষ্টি কাদীম বা অবিনশ্বর। অনাদী থেকেই বিদ্যমান। এটি তাসালসুলুল হাওয়াদিস নামে পরিচিত। [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.১২৯, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]
২. আল্লাহ তায়ালার হদ বা সীমা রয়েছে। [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.২১৯, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]
৩. আল্লাহর সত্তার মাঝে নশ্বর বিষয় সৃষ্টি হয়। [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.১৭৭, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]
৪. আল্লাহর বক্তব্যের অক্ষর ও শব্দ রয়েছে। [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.১৬৯, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]
৫. আল্লাহ তায়ালা স্থানগতভাবে উপরের দিকে রয়েছেন। অর্থাৎ আল্লাহর দিক রয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে দেহবাদী আকিদার ভ্রান্তি থেকে হেফাজত করুন। আমীন।
------ ------
ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের মাঝে সর্বপ্রধান বিষয় হল, আল্লাহর তাওহীদ তথা একত্বের উপর ঈমান আনয়ন করা। এই বিশ্বাস করা যে, সৃষ্টা হিসেবে তিনি একক, গুণাবলীর বিবেচনায় তিনি একক এবং উপাসনার যোগ্য একমাত্র তিনিই। পবিত্র কুরআন ও রাসূল (সঃ) এর সমস্ত হাদীস তাওহীদ তথা আল্লাহর এককত্বের উপর ভিত্তি করেই আবর্তিত। কোন বিষয়ে আল্লাহর সমকক্ষ বা অংশীদার নেই, এটিই এ বিশ্বাসের মূলমন্ত্র। পবিত্র কুরআনের ১১২ নং সূরায় এ বিষয়টি সুষ্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষিত হয়েছে। সে প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর অস্তিত্ব অনুভব করে এবং আল্লাহর এককত্বের স্বাক্ষর প্রদান করে।
আমরা এখানে আল্লাহর এককত্বের উপর পাঁচটি যুক্তি উপস্থাপন করব।
কুরআন স্পষ্টভাষায় জিজ্ঞাসা করেছে, এই মহাবিশ্ব কি এমনিতেই সৃষ্টি হয়েছে? এর উত্তর খুবই সহজ ও স্পষ্ট। কেননা ভৌত পদার্থবিদ্যা এবং সকল দর্শন এবিষয়ে একমত যে, যে বস্তু অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এসেছে, তার অস্তিত্বের পিছে একটি কজ বা কারণ রয়েছে। আর মহাবিশ্ব যেহেতু অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এসেছে এজন্য এর পিছে একটি কারণ বা কজ রয়েছে। মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পিছে একটি সামগ্রিক কজ বা কারণ থাকাটাই যুক্তিযুক্ত। অসীম সংখ্যক কারণ থাকাটা অসম্ভব। কেননা বাস্তবে কখনও অসীম কোন কিছু থেকে আমরা কোন ফলাফল লাভ করি না।
উদাহরণ হিসেবে নীচের দু’টি বিষয় লক্ষ্য করুণ-
১. কোন কক্ষে যদি অসীম সংখ্যক মানুষ থাকে এবং সেখান থেকে যদি আমি দু’জনকে বাদ দেই, তাহলে কতজন থাকবে? আপনি উত্তর দিবেন, অসীম বিয়োগ দুই। অর্থাৎ অসীম থেকে দু’জনকে বাদ দিলে যা থাকে। এর দ্বারা বাস্তবে কোন অর্থ বোঝায় কি? অসীম থেকে যদি দুজনকে বাদ দেয়া হলেও কক্ষে অসীম সংখ্যক মানুষই থেকে যাবে। বাস্তবে এটি বিশেষ কোন অর্থ প্রদান করে না। আপনাকে যদি কক্ষের অসীম সংখ্যক লোক গণনা করতে বলা হয়, আপনার পক্ষে তা গণনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু লোকসংখ্যা যদি অসীম থেকে সামান্য কমিয়ে গণনা করতে বলা হয়, তবুও আপনার পক্ষে তা গণনা করা সম্ভব নয়। এর অর্থ হল, বাস্তব জীবনে অসীম সংখ্যা থেকে বিশেষ অর্থ বোঝা সম্ভব নয়।
২. মনে করুন, আমি একজন সৈনিক। আমি একটা শত্রুকে গুলি করতে চাই। আমার গুলি করার জন্য আমার পেছনের সৈনিকের অনুমতি নেয়া প্রয়োজন। আমার পিছের সৈনিকের জন্য আবার তার পেছনের সৈনিকের অনুমতি প্রয়োজন। এভাবে এ ধারা যদি চলতে থাকে এবং আমার গুলি করার জন্য অসীম সংখ্যক সৈনিকের অনুমতির প্রয়োজন হয়, তবে আমি কি আদৌ শত্রুকে গুলি করতে পারব? উত্তর খুবই সহজ ও স্বাভাবিক। একইভাবে আমি মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পিছে যদি অসীম সংখ্যক কারণ ধরে নেই, তবে আদৌ মহাবিশ্বের অস্তিত্ব সম্ভব হত না। এবং কখনও এটি অস্তিত্বে আসত না। সুতরাং মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পিছে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বাধীন ও একক কারণ থাকাটাই যুক্তিসঙ্গত।
আপনি এ যুক্তি দেখাতে পারেন যে, উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্য তথা স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বাধীন একাধিক কারণ একই সাথে ক্রিয়াশীল হলে সমস্যা কোথায়?
আমি বলব, আপনার এ যুক্তিটা খুবই দুর্বল প্রকৃতির। চতুর্দশ শতাব্দীর দার্শনিক অকহ্যাম রেজর এর তত্ত্বের মাধ্যমে আপনার এ যুক্তির অসারতা প্রমাণিত হয়। অকহ্যাম রেজরের নীতি হল, প্রয়োজন ছাড়া বহু সংখ্যার ব্যবহার অনুচিৎ। আরেকটু সহজ করে বললে এভাবে বলা যায়, সবচেয়ে সরল ও সর্বাধিক অর্থবহ ব্যাখ্যা হল, সর্বোত্তম ব্যাখ্যা।
অতএব, কোন প্রমাণ ছাড়া কিংবা প্রয়োজন ছাড়া আমরা এটা বলতে পারি না যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির পিছে অনেকগুলো কারণ ক্রিয়াশীল। সুতরাং এক্ষেত্রে আমাদেরকে সবচেয়ে অর্থবহ ও সরল কারণ তথা মহাবিশ্ব সৃষ্টির একক কারণকেই গ্রহণ করতে হবে। কেননা এক্ষেত্রে আমাদেরকে কাছে কোন প্রমাণ নেই যে আমরা বলতে পারি, মহাবিশ্বের সৃষ্টি মূলতঃ দুটি, তিনটি, কিংবা কয়েক হাজার কারণের কম্বিনেশন বা সমন্বয়। একাধিক কারণ গ্রহণের দ্বারা একটি স্বাধীন, স্বয়ংসম্পূর্ণ কারণে অতিরিক্ত কোন মাত্রা যোগ হয় না।
যেমন, যখন বলা হল, মহাবিশ্ব একটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কারণের দ্বারা সৃষ্ট, এ কথা দ্বারা যে অর্থ স্পষ্ট হয়েছে, যদি বলা হয়, মহাবিশ্ব দু’টি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কারণের দ্বারা সৃষ্ট, এ কথার দ্বারা অতিরিক্ত কোন অর্থ প্রকাশ পায় না। কেননা আমি যখন বলছি, কারণটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী তখন অন্য কোন সর্বময় ক্ষমতার প্রয়োজন নেই। কারণটি যদি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী না হত, তবে সাহায্যকারী হিসেবে অন্য কোন কারণের প্রয়োজন পড়ত। এক্ষেত্রে কোন কারণই তখন স্বাধীন বা স্বয়ংসম্পূর্ণ কারণ থাকবে না।
সুতরাং মহাবিশ্ব সৃষ্টির পিছে আমাদের মূলতঃ একটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কারণের প্রয়োজন ছিল এবং এটুকুই যথেষ্ট কেননা কারণটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।
যুক্তির দাবি হল, মহাবিশ্ব সৃষ্টি যদি অনেক প্রভূ থাকত, তবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে মহাবিশ্ব ধ্বংস হয়েছে। এবং আমরা মহাবিশ্বে যে সুষম শৃঙ্খলা ও নিয়মতান্ত্রিকতার সর্বোচ্চ সমাবেশ লক্ষ্য করে থাকি, অনেক প্রভূ থাকলে তা পরিলক্ষিত হত না।
আপনি যুক্তি দেখাতে পারেন, আপনার গাড়িটি তৈরি করে অনেক মানুষ। যেমন, কেউ গাড়ীর বডি তৈরি করে, কেউ ইঞ্জিন আবার কেউ চাকা। কিন্তু পূর্ণ গাড়িটি তৈরি হলে সেটি একটি সুন্দর ও সুষম গাড়ি হয়ে থাকে। অতএব, একটি সৃষ্ট বস্তুর অনেক স্রষ্টা থাকলেও সেটি ভারসাম্যপূর্ণ হতে পারে।
আপনার এ প্রশ্নের উত্তর হল, মহাবিশ্ব সৃষ্টির পিছে আমরা যে কারণটি উল্লেখ করেছি সেটি হল, এমন একজন প্রভূ যিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং ইচ্ছার ক্ষেত্রে এককভাবে স্বাধীন। কেননা প্রভূ তো তিনিই হবেন, যার অসীম প্রয়োগিক ইচ্ছা রয়েছে। যদি অনেক প্রভূ থাকত, তবে প্রত্যেকের ইচ্ছা প্রয়োগের প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হত, আর এটিই মহাবিশ্বে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণ হতো।
আপনি যুক্তি দেখাতে পারেন, এ সম্ভাবনা রয়েছে যে, অনেকগুলো প্রভূ একটি বিষয়ে একমত পোষণ করতে পারে। অথবা এক একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে তাদের পৃথক পৃথক ক্ষমতা থাকবে। এক্ষেত্রে আমরা বলব, এ ধরণের প্রভূর ইচ্ছা অসীম ও স্বাধীন নয়। ফলে এরা প্রভূ হওয়ার যোগ্য নয়। সার কথা হল, যদি দু’জন স্রষ্টা থাকে, এবং তারা কোন বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে, যেমন একজন ক নামক ব্যক্তিকে স্থির রাখতে চাচ্ছে, আরেকজন তাকে গতিশীল করতে চাচ্ছে। অথবা একজন প্রভূ খ কে জীবন্ত প্রাণি বানাতে চাচ্ছে, আরেকজন চাচ্ছে যে, এটি জড়পদার্থ হিসেবে অবস্থান করবে।
যুক্তির আলোকে যদি বিশ্লেষণ করা হয়, তবে এখানে তিনটি অবস্থার কোন একটি ঘটতে বাধ্য-
১. উভয় প্রভূর ইচ্ছা বহাল রাখা হবে এবং তা বাস্তবায়ন করা হবে।
২. শুধু তাদের একজনের ইচ্ছা বহাল রাখা হবে।
৩. তাদের কারও ইচ্ছায় বাস্তবায়ন করা হবে না।প্রথমটি সম্ভব নয়।
কেননা এক্ষেত্রে দু’টি বিপরীত বিষয় একই সাথে অস্তিত্ব লাভ করা আবশ্যক হবে। যা অসম্ভব। অর্থাৎ একই সাথে একটি বস্তু জীবিত ও মৃত হতে পারে না। তৃতীয় বক্তব্যও বাতিল হয়ে যাবে। কেননা এর দ্বারা এটা আবশ্যক হয় যে, একটি বস্তু গতিশীলও না, আবার স্থিরও না। একইভাবে একটি বস্তু জীবিতও না, আবার মৃত না। আর এটি অসম্ভব। সাথে সাথে তাদের কারও ইচ্ছায় যদি বাস্তবায়ন করা না হয়, তখন তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, তাদের কেউ-ই নিজ ইচ্ছা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম নয়। ফলে প্রত্যেকেই প্রভূ হওয়ার যোগ্যতা হারাবে।
দ্বিতীয় বক্তব্য অনুযায়ী, যদি দু’জনের মধ্য থেকে একজনের ইচ্ছা বাস্তবায়ন করা হয়, এবং অপরজনের ইচ্ছা পরিত্যাগ করা হয়, তবে তিনিই হবেন একক প্রভূ। যার ইচ্ছা পরিত্যাগ করা হয়েছে, সে প্রভূ হওয়ার যোগ্য থাকবে না। উপর্যুক্ত বক্তব্য দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, এই ভারসাম্যপূর্ণ মহাবিশ্বের একজন মাত্র প্রভূ থাকা সম্ভব, যিনি অসীম ইচ্ছার অধিকারী এবং একক ক্ষমতার অধিকারী।
আমরা কিভাবে দু’টি জিনিসকে পরস্পর থেকে পৃথক করে থাকি? দু’জন ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে আমরা তাদের মধ্যে পার্থক্য করি কীভাবে। এর উত্তর হল, আমরা এটা করে থাকি, কনসেপ্চুয়াল ডিফারেনসিয়েশন বা ধারণাগত বৈচিত্রের মাধ্যমে। এই ধারণাগুলো হল, স্থান, পারম্পরিক দূরত্ব, গঠন ও আকার-আকৃতিগত তারতম্য।
আমরা যে কোন দু’টি বস্তুর মাঝে পার্থক্য করতে পারি, তাদের পারস্পরিক দূরত্ব, বর্ণ ও আকার-আকৃতিগত বৈচিত্রের মাধ্যমে। দু’টি বিষয়ের মধ্যে যখন উপরোক্ত বিষয়গুলো না পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে কি আপনি উক্ত বস্তু দু’টির মাঝে কোন পার্থক্য করতে সক্ষম হবেন? আপনি পারবেন না। এবিষয়টি শুধু দু’য়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং অসংখ্য বস্তুর ক্ষেত্রে পার্থক্য নির্ণয় করতে হলে, উপরোক্ত বিষয়গুলো থাকা আবশ্যক।
প্রাসঙ্গিকভাবে বলে নেয়া আবশ্যক যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি মহাবিশ্ব থেকে বহির্গত হওয়া আবশ্যক। কেননা সৃষ্টির কারণ যদি মহাবিশ্বের ভিতরগত কিংবা মহাবিশ্বেরই কোন অংশ হয়, তখন এর অর্থ হয় যে, মহাবিশ্ব নিজেই নিজের স্রষ্টা। আর এটি অসম্ভব। মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ যেহেতু বহির্গত, আপনি সহজেই অনুমান করতে পারবেন যে, আপনি মহাবিশ্বের বহির্গত বিষয়ের মধ্যে অবস্থান, আকার-আকৃতি ও বর্ণগত পার্থক্য করতে পারবেন না। কেননা এ বিষয়গুলো কেবল মহাবিশ্বের অভ্যন্তরে বিশেষ অর্থ প্রদান করে, এর বাইরে নয়। কেননা উপর্যুক্ত বিষয় তথা দূরত্ব, আকার-আকৃতি বা বর্ণ প্রত্যেকটি সৃষ্ট। মহাবিশ্বের বাইরে সৃষ্ট কোন বস্তু নেই। মহাবিশ্বের বাইরে উপর্যুক্ত বিষয়ের অনুপস্থিতির কারণে সৃষ্টির পিছে ক্রিয়াশীল দু’টি কারণের মধ্যে পার্থক্য করাও সম্ভব নয়। এজন্য সৃষ্টির পিছে দু’টি বা অসংখ্য কারণের কথা বলাটাও ভিত্তিহীন, অযৌক্তি ও ধারণাপ্রসূত একটি বক্তব্য মাত্র।
মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি ইউনিক বা অনন্য হওয়া আবশ্যক। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “তাঁর কোন সমকক্ষ নেই”। মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি যদি অনন্য না হয়, তবে এর অর্থ হবে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ ও মহাবিশ্বের মাঝে একটি সিমিলারিটি বা সাদৃশ্য রয়েছে। কেননা এর দ্বারা এটি প্রমাণিত হয় যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি এর মাঝে রয়েছে। যার অর্থ এই দাঁড়াল যে, মহাবিশ্ব নিজেই নিজের স্রষ্টা। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি মহাবিশ্বের সাদৃশ্যপূর্ণ হতে পারবে না কেন? এর উত্তরটি খুবই সহজ। আমরা জানি মহাবিশ্ব অসংখ্য বস্তুর সমষ্টি। সুতরাং মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি অবশ্যই ইম্যাটেরিয়াল বা বস্তুজগতের ঊর্ধ্বে হতে হবে। নতুবা মহাবিশ্ব নিজেই নিজের স্রষ্টা হওয়া আবশ্যক হবে। সুতরাং বস্তু সৃষ্টির কারণটিও যদি বস্তুর মতো হয়, তবে বস্তু নিজেই নিজের স্রষ্টা হওয়া আবশ্যক, যা অসম্ভব। সুতরাং উপসংহারে আপনাকে অবশ্যই বলতে হবে যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি অবশ্যই ইম্যাটেরিয়াল ও ইউনিক হতে হবে। আমাদের এ বক্তব্যটি স্রষ্টার এককত্বের প্রমাণ হয় কিভাবে? আমরা বলব, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ যদি একাধিক হয়, তবে তার কোনটিই ইউনিক বা অনন্য হবে না। ফলে স্রষ্টা একজন হওয়াটাই নির্দিষ্ট।
স্রষ্টার এককত্ব প্রমাণের সবচেয়ে সহজ উপায় হল, আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ঐশীবাণীর শরণাপন্ন হওয়া। এক্ষেত্রে যুক্তি হল, কোন বাণীর ব্যাপারে যদি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয় যে, এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত এবং এটি মানব রচিত নয়, তখন এ গ্রন্থের বক্তব্যের ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকে না। সুতরাং আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ঐশী গ্রন্থে আল্লাহ তায়ালা নিজের সম্পর্কে যে তথ্য প্রদান করবেন সেটি নিশ্চিতভাবে সত্য বলে বিবেচিত হবে।
কেউ যদি আল্লাহ সম্পর্কে অজ্ঞ হয় তবে সে কিভাবে আল্লাহ সম্পর্কে বা তার প্রেরিত কিতাব সম্পর্কে ধারণা অর্জন করবে?
এর দু’টি পদ্ধতি রয়েছে-
১. ইন্টারন্যাল
২. এক্সটারন্যাল
আভ্যন্তরীণভাবে আল্লাহ তায়ালার পরিচয় পাওয়ার অর্থ হল, আপনি আত্মপরীক্ষা বা আত্মদর্শনের মাধ্যমে আল্লাহ সম্পর্কে অবগত হওয়ার চেষ্টা করবেন। অর্থাৎ নিজের আভ্যন্তরীণ শক্তি ব্যবহার করে আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা। আজব ব্যাপার হল, আল্লাহ সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন মানুষের নিজস্ব শক্তির দ্বারা সম্ভব নয়।
এর কিছু মৌলিক কারণ হল,
১. মানুষ সৃষ্টিগতভাবে বৈচিত্রময়। ব্যক্তি বৈচিত্রের এধারাটি মূলতঃ মানুষের মানসিক ভিন্নতারই বহিপ্রকাশ। সাইকোলজিক্যাল ভিন্নতার প্রধান কারণ হল, ডি.এন.এ এর ভিন্নতা, বাস্তব অভিজ্ঞতা, সামাজিক পূর্বসূত্র, বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানার্জনের ক্ষমতা, লিঙ্গের বৈষম্য ইত্যাদি নিয়ামক দ্বারা প্রভাবিত। আত্মদর্শনের মাধ্যমে স্রষ্টা সম্পর্কে ধারণা পেতে এবিষয়গুলো আপনাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে। সুতরাং আপনার আত্মপরীক্ষার মাধ্যমে যে ফলাফল পাওয়া যাবে সেটি অন্যদের থেকে ভিন্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। আপনি নিজেও এই বাস্তবতা উপলব্ধি করবেন যে, উপর্যুক্ত বিষয়ের উপস্থিতিতে আপনি একাকী যদি স্রষ্টা সম্পর্কে ধারণা পেতে চান তবে তা সত্য থেকে অনেক বিচ্যুত হতে পারে। এটি একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ বছর আগে পৃথিবীতে প্রায় ৩৭০০ হাজার দেবতার ধারণা মানুষের মনে জেঁকে বসেছিল।
২. দ্বিতীয় কারণ হল, বাস্তবতার বিবেচনায় মানুষ খুবই সীমাবদ্ধ। এজন্য মানুষ যদি নিজের পক্ষ থেকে স্রষ্টা সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করতে চায়, তবে তা অধিকাংশ সময় ভ্রান্তির কারণ হয়। দার্শনিকগণ ¯্রষ্টার অস্তিত্বের ব্যাপারে কিছু যুক্তিসঙ্গত দার্শনিক তত্ত্ব উপস্থাপন করে থাকেন। তবে তারা স্বতঃসিদ্ধ ও বাস্তব কোন তথ্য দিতে অক্ষম। প্রকৃতপক্ষে যদি আপনি স্রষ্টা সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা অর্জন করতে চান, তবে তা হবে ইঁদুরের পক্ষে হাতির শক্তিমত্তা সম্পর্কে ধারণা অর্জনের মতো হাস্যকর। এজন্য শুধু যুক্তি বা ধারণার উপর ভিত্তি করে স্রষ্টা সম্পর্কে কিছু বলা তার সম্পর্কে মিথ্যাচারের নামান্তর। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, “তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে যা জান না, তা বলো কেন?” সুতরাং আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে আমরা যদি জ্ঞান অর্জন করতে চাই তবে তা অবশ্যই এক্সটারন্যাল বা বহির্গত কোন মাধ্যমে হতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা ঐশীবাণীর মাধ্যমে আমাদেরকে যা জানিয়েছেন, সেটিই হবে বিশুদ্ধ জ্ঞান।
আর পবিত্র কুরআন থেকে আমরা একথা সুনিশ্চিতভাবে জানি যে, আল্লাহ তায়ালা হলেন এক ও অদ্বিতীয়। তার সমকক্ষ কেউ নেই। সুতরাং তার এককত্বের ব্যাপারে আর কোন সন্দেহ থাকে না।
------ ------
© COPYRIGHT 2021 - Hasbi Academy - We Love Our Students