আক্বিদা

আল্লাহর অবস্থান সম্পর্কে আহলে সুন্নতের আক্বিদা-বিশ্বাস

ইজহারুল ইসলাম শনি, 23 নভে., 2024

 

ইমাম আবু হানিফা রহ. এর আল-ফিকহুল আবসাতে রয়েছে,

:”قلتُ: أرأيتَ لو قيل أين الله تعالى؟ فقال ـ أي أبو حنيفة ـ : يقال له كان الله تعالى ولا مكان قبل أن يخلق الخلق، وكان الله تعالى ولم يكن أين ولا خَلْق ولا شىء، وهو خالق كل شىء”

অর্থ: যদি আপনাকে প্রশ্ন করা হয় আল্লাহ তায়ালা কোথায়? ইমাম আবু হানিফা রহ. এর উত্তরে বলেন, তাকে বলা হবে, সৃষ্টির অস্তিত্বের পূর্বে, যখন কোন স্থানই ছিলো না, তখনও আল্লাহ তায়ালা ছিলেন। আল্লাহ তায়লা তখনও ছিলেন যখন কোন সৃষ্টি ছিলো না, এমনকি ‘কোথায়’ বলার মতো স্থানও ছিলো না। সৃষ্টির একটি পরমাণুও যখন ছিলো না তখনও আল্লাহ তায়ালা ছিলেন। তিনিই সব কিছুর সৃষ্টা”

[ আল-ফিকহুল আবসাত, পৃ.৫৭, আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারীর তাহকীক]

الفقة الأبسط.png

imam.jpg

এটিই সমস্ত আহলে সুন্নতের আকিদা। যখন কোন স্থান ছিলো না, তখন আল্লাহ তায়ালা ছিলেন  কি না? অবশ্যই ছিলেন। আল্লাহর অবস্থানের জন্য কোন স্থানের প্রয়োজন হয়নি। তেমনি এখনও আল্লাহর অবস্থানের জন্য কোন স্থান ব দিকের প্রয়োজন নেই। কিছু অজ্ঞ লোক মনে করে থাকে, আল্লাহ তায়ালাকে স্থান ও দিক থেকে পবিত্র বিশ্বাস করলে তো আল্লাহ কোথাও নেই বলা হয়। এর দ্বারা আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্বই না কি অস্বীকার করা হয়। এদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে, যখন কোন স্থান বা দিকই ছিলো না,তখন আল্লাহ কোথায় ছিলেন? সে যদি এটা বিশ্বাস না করে যে, আল্লাহ তায়ালা স্থান ও দিক সৃষ্টির পূর্বে ছিলেন, তাহলে সে নিশ্চিতভাবে কাফের হয়ে যাবে। কোন সৃষ্টির অস্তিত্বের পূর্বে আল্লাহর অবস্থানের জন্য যখন কোন স্থানের প্রয়োজন হয়নি, তাহলে এখন কেন আল্লাহ তায়ালাকে স্থানের অনুগামী বানানো হবে? এসব লোকের  বোধোদয়ের  জন্য বিখ্যাত তাবেয়ী ও ইমাম আবু হানিফা রহ. তার ছোট্র একটি বক্তব্য দ্বারা বুঝিয়ে দিয়েছেন, আল্লাহ তায়ালা স্থান ও দিক থেকে পবিত্র।

ইমাম আবু হানিফা রহ. আরও বলেন,

“ولقاء الله تعالى لأهل الجنة بلا كيف ولا تشبيه ولا جهةٍ حقٌّ”

অর্থ: জান্নাতবাসীর জন্য কোন সাদৃশ্য, অবস্থা ও দিক ব্যতীত আল্লাহ তায়ালার দর্শন সত্য।

[কিতাবুল ওসিয়্যা, পৃ.৪, শরহে ফিকহুল আকবার, মোল্লা আলী কারী, পৃ.১৩৮]

وصية الإمام إبي حنيفة.png

وصية الإمام ٢.png

ইমাম আবু হানিফা রহ. স্পষ্ট লিখেছেন, আল্লাহ তায়ালা দিক থেকে মুক্ত। পরকালে আল্লাহ তায়ালাকে দেখা যাবে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালাকে দেখার জন্য বিশেষ কোন দিকে থাকার প্রয়োজন নেই। ইমাম আবু হানিফা রহ. এর মতো বিখ্যাত তাবেয়ীর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, তাবেয়ীগণের আকিদাও এমন  ছিলো। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা স্থান ও দিক থেকে মুক্ত।

ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেন,

ونقر بأن الله سبحانه وتعالى على العرش استوى من غير أن يكون له حاجة إليه واستقرار عليه، وهو حافظ العرش وغير العرش من غير احتياج، فلو كان محتاجا لما قدر على إيجاد العالم وتدبيره كالمخلوقين، ولو كان محتاجا إلى الجلوس والقرار فقبل خلق العرش أين كان الله، تعالى الله عن ذلك علوا كبيرا” اهـ.

আমরা স্বীকার করি যে, আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর কতর্ৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। আরশের প্রতি কোনরূপ প্রয়োজন ও আরশের উপর স্থিতিগ্রহণ ব‍্যতীত। তিনি আরশ ও অন‍্যান‍্য মাখলুকের । এগুলোর প্রতি তিনি বিন্দুমাত্র মুখাপেক্ষী নন। তিনি যদি আরশ ও অন‍্যান‍্য মাখলুকের মুখাপেক্ষী হতেন, তাহলে মহাবিশ্ব সৃষ্টি ও লালন-পালন করতে পারতেন না। কোন মাখলুক যেমন অন‍্যের মুখাপেক্ষী হওয়ার কারণে কোন কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। তিনি যদি আরশের উপর উপবেশন ও এর উপর স্থির হওয়ার মুখাপেক্ষী হতেন, তাহলে আরশ সৃষ্টির পূবর্ে তিনি কোথায় ছিলেন? মহান আল্লাহ এধরনের ধ‍্যান-ধারণা থেকে মহাপবিত্র। 

[আল-ওসিয়‍্যা, পৃ.২, তাহকীক, আল্লামা যাহিদ আল-কাউসারী রহ.]

উল্লেখ‍্য, দিকের ধারণা একটি আপেক্ষিক বিষয়। দিক বলতে আমাদের নিজেদের অবস্থানের সাপেক্ষে অন‍্য একটি স্থানকে আমরা বুঝিয়ে থাকি।  আমি যদি কোন বিল্ডিং এর দ্বিতীয় তলায় থাকি, তাহলে নীচের দিক বলতে আসলে আমার নীচের প্রথম তলার জায়গা বোঝায়। উপর বলতে আমার মাথার উপরের কোন একটি জায়গা বুঝিয়ে থাকি। এজন‍্য আরবীতে দিক বলতে আসলে তরফুল মাকান বা কোন জায়গার একটা অংশ বোঝায়। 

কোন জায়গার অংশ ব‍্যতীত দিকের পৃথক কোন অস্তিত্ব নেই।  যে দিকই বোঝানো হবে, সেটি মূলত: একটি জায়গা। 

আমরা জানি, মহাবিশ্বের সকল জায়গা আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেছেন।  সকল জায়গার একটি অংশ বা দিকও আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। মহাবিশ্বের কোন কিছুই ছিলো না। সব কিছুইকে আল্লাহ তায়ালা অস্তিত্ব দিয়েছেন। এমন কোন জায়গা নেই, যেটি আল্লাহর সৃষ্টি নয়। আবার কোন জায়গার এমন কোন অংশ বা দিকও নেই যাকে আল্লাহ তায়ালা অস্তিত্ব দেননি। 

সুতরাং যতো জায়গা, জায়গার অংশ বিশেষ বা দিক রয়েছে সব কিছুই মাখলুক বা আল্লাহর সৃষ্টি। কোন জায়গা বা দিকই অনাদি তথা অসীম থেকে বিদ‍্যমান নয়। কেউ যদি বিশ্বাস করে কোন জায়গা, জায়গার কোন অংশ তথা দিকও অসীম থেকে বিদ‍্যমান তাহলে সে অবশ‍্যই কাফের। 

আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। যখন কোন সৃষ্টি ছিলো না, তখনও আল্লাহ তায়ালা ছিলেন। আল্লাহর জন‍্য সৃষ্টির অস্তিত্ব আবশ‍্যক নয়। কেউ যদি মনে করে, আসমান-জমিন, আরশ-কুরসী ছাড়া আল্লাহর অস্তিত্ব সম্ভব নয়, তার জন‍্য তওবা করে ইমান নবায়ন করা জরুরি। 

কেউ যদি মনে করে, সৃষ্টির অস্তিত্বকে  অস্বীকার করলে আল্লাহরই কোন অস্তিত্ব থাকে না, তবে এ ব‍্যক্তিও আল্লাহ তায়ালাকে অস্বীকারকারী। 

কেউ যদি আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে বলে, “যে জিনিষ উপরে নয়, নীচে নয়, ডানে নয়, বামে নয়, সামনেও নয় পিছনেও নেই, আসলে সেই জিনিষের অস্তিত্বই নেই।”   আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে এধরনের বক্তব‍্য কুফুরী। কেউ যদি বুঝে-শুনে এভাবে আল্লাহর অস্তিত্বকে সৃষ্টির অস্তিত্বের উপর নিভর্রশীল বানিয়ে দেয়, তবে তার কুফুরীর ব‍্যাপারে কোন সন্দেহ থাকবে না। 

বাস্তবে সমস্ত দিক যেহেতু কোন স্থানেরই অংশ, সুতরাং আল্লাহ তায়ালা সমস্ত স্থান ও দিক থেকে মুক্ত। সমস্ত স্থান ও দিক মাখলুক হওয়ার কারণে আল্লাহ তায়ালার সত্তার মাঝে কোন স্থান বা জায়গা প্রবেশ করে না । আল্লাহর সত্তার মাঝে কোন স্থান, স্থানের কোন অংশ বা দিক প্রবেশ করেছে বলে কেউ যদি বিশ্বাস করে, তবে সেও কুফুরী করবে। একইভাবে আল্লাহ তায়ালা সমস্ত মাখলুক থেকে মুক্ত। তিনিও কোন মাখলুকে মাঝে প্রবেশ করেন না। 

কেউ যদি বিশ্বাস করে, কোন নিদির্ষ্ট দিক আল্লাহর সত্তার গুণ, তাহলে সে মূলত: একটি নির্দিষ্ট জায়গাকে আল্লাহর সত্তার অংশ বানিয়েছে। কোন সৃষ্টিকে আল্লাহর সত্তার গুণ বা অংশ মনে করাও কুফুরী। এই সৃষ্টি কোন জায়গা, জায়গার অংশ বা দিক, আরশ-কুরসী, মানুষ, গাছ-পালা যাই হোক না কেন। কেউ যদি বিশ্বাস করে, নীচের দিক অর্থাৎ নীচের কিছু জায়গা আল্লাহর সত্তার গুণ তবে এটি কুফুরী। একইভাবে কেউ যদি বলে উপরের দিক বা উপরের কোন জায়গা আল্লাহর সত্তার গুণ, তবে এটিও কুফুরী।

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, الله خالق كل شي 

অথর্: সকল কিছুর স্রষ্টা মহান আল্লাহ তায়ালা। 

সূরা জুমার, আয়াত নং ৬২

সমস্ত স্থান ও দিকের স্রষ্টাও আল্লাহ। কোন স্থান বা দিকই অসৃষ্ট নয়।  উপরের দিক, নীচের দিক, ডান-বাম সব কিছুর স্রষ্টা হলেন আল্লাহ। সুতরাং উপর বা নীচ যে কোন দিককে আল্লাহর সত্তার গুণ বলার অথর্ হলো, স্রষ্টা ও সৃষ্টিকে একাকার করা। এটি স্পষ্ট কুফুরী।

ইমাম আবু জা’ফর ত্বহাবী রহ. এর বক্তব‍্য

ইমাম ত্বহাবী রহ. বলেন,

تعالى عن الحدود والغايات ، والأركان والأعضاء والأدوات ، لا تحويه الجهات الست كسائر المبتدعات

মহান আল্লাহ তায়ালা সব ধরনের সীমা-পরিসীমা, অঙ্গ-প্রতঙ্গ, সহায়ক বস্তু ও উপায়-উপকরণ থেকে পবিত্র। অন্যান্য সৃষ্ট বস্তুর ন্যায় ছয় দিক তাকে বেষ্টন করে না। (অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা সব ধরণের দিক থেকেও পবিত্র)

10679507_378776758938409_7063479037322805588_o.jpg

10647099_378776795605072_2414260467907414723_n.jpg

সুতরাং আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে আমাদের আক্বিদা হলো, তিনি মাখলুক থেকে মুক্ত এক মহান সত্ত্বা। তিনি সময়, স্থান ও দিক থেকে পবিত্র। মাখলুকের সঙ্গে সামান্যতম সাদৃশ্যও দেয়াও কুফুরী। কেননা তিনি ইরশাদ করেছেন, তার সদৃশ কিছু নেই। তিনি মহা বিশ্ব সৃষ্টির পূর্বে যেমন ছিলেন,আরশ-কুরশী সৃষ্টির পূবের্ যেমন ছিলেন, এখনও আছেন। মহাবিশ্ব ধ্বংসের পরও থাকবেন। সৃষ্টির অস্তিত্বের পূর্বে যেমন সময় ও স্থান থেকে পবিত্র অবস্থায় ছিলেন, এখনও তিনি সব ধরনের স্থান ও সময় থেকে মুক্ত। এই কথাটি সংক্ষেপে রাসূল স. বলেছেন,

أَنْتَ الْأَوَّلُ فَلَيْسَ قَبْلَكَ شَيْءٌ ، وَأَنْتَ الْآخِرُ فَلَيْسَ بَعْدَكَ شَيْءٌ ، وَأَنْتَ الظَّاهِرُ فَلَيْسَ فَوْقَكَ شَيْءٌ ، وَأَنْتَ الْبَاطِنُ فَلَيْسَ دُونَكَ شَيْءٌ

” আপনিই প্রথম, আপনার পূর্বে কিছু নেই। আপনিই শেষ, আপনার পরে কিছু নেই। আপনিই প্রকাশ্য, আপনার উপরে কিছু নেই। আপনিই গোপন, আপনার নিচে কিছু নেই”

মুসলিম শরীফ, হাদীস নং২৭১৩

আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের এই সহীহ আকিদা পবিত্র কুরআন ও রাসূল স. এর বহু হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহ তায়ালা কোথায়? এর সহজ উত্তর হলো, আল্লাহ তায়ালা অনাদিকালে যেমন ছিলেন, এখনও আছেন। কোন সৃষ্টির অস্তিত্বের পূর্বে আল্লাহর অবস্থানের জন্য যেমন কোন স্থানের প্রয়োজন হয়নি, এখনও প্রয়োজন হয় না। আল্লাহ তায়ালা স্থান ও সময়ের উর্ধ্বে। স্থান ও সময় দু’টোই আল্লাহ পাকের সৃষ্টি। তিনি সৃষ্টি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নন, বরং সকল সৃষ্টি তার নিয়ন্ত্রণে। 

ইমাম আব মনসুর মাতুরিদি রহ.  (মৃত: ৩৩৩ হিজরী) এর বক্তব‍্য

আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের বিখ‍্যাত ইমাম হলেন ইমাম আবু মনসুর মাতুরিদী রহ.। সালাফে-সালেহীনের আকিদা-বিশ্বাস সংকলন ও ভ্রান্ত আকিদা খন্ডনে তাঁর অমর কীর্তি আজও অম্লান। মুসলিম বিশ্বের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মুসলামন আকিদার ক্ষেত্রে এই মহান ইমামের ব‍্যাখ‍্যা-বিশ্লেষণকে গ্রহণ করেছেন। প্রায় সমস্ত হানাফী এই ইমামের ব‍্যাখ‍্যা-বিশ্লেষণ গ্রহণ করে নিজেদেরকে ধন‍্য মনে করে থাকেন। কুরআন-হাদীস থেকে গৃহীত আকিদা-বিশ্বাস অত‍্যন্ত সুবিন‍্যস্ত ও সাবলীল ভাষায় সাধারণ মানুষের  কাছে উপস্থাপনের কারণে আজ তিনি কোটি মুসলমানের মহান ইমাম। মৌলিক দিক থেকে আশআরী ও মাতুরিদি আকিদা এক ও অভিন্ন হওয়াই একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, ইসালামী আকিদা বিশ্লেষণে ইমাম মাতুরিদীর অবস্থানের সাথে সহীহ আকিদার সমস্ত মুসলিম একমত  পোষণ করেছে। হাজার বছর ধরে এই আকিদা-বিশ্বাস লালন করে সমস্ত বাতিল ফেরকা থেকে মুক্ত থেকে জান্নাতের পথ সুগম করেছে। 

আকিদার  উপর ইমাম আবু মনসুর মাতুরিদী রহ. এর অসংখ‍্য কিতাব রয়েছে। কিছু কিতাব প্রকাশিত হয়েছে। অনেক কিতাব এখনও হস্তলিপিতে রয়েছে। ইমাম মাতুরিদী রহ. এর বিখ‍্যাত একটি কিতাব হলো, কিতাবুত তাউহীদ। আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের সঠিক আকিদা বর্ণনা ও বাতিল  ফেরকার দাঁতভাঙা জবাব প্রদানে এটি অদ্বিতীয় একটি কিতাব। ইসলামি আকিদার পাশাপাশি ইমাম মাতুরিদী রহ. ফিকহ ও তাফসীর শাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন। বৃহৎ কলেবরের বিখ‍্যাত তাফসীর লিখেছেন। তা’বিলাতু আহলিস সুন্নাহ।  তুরষ্ক থেকে এটি ১৮ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। 

ইমাম মাতুরিদি রহ. তার অবিস্মরণীয় গ্রন্থ কিতাবুত তাউহীদ-এ  লিখেছেন, 

“ আল্লাহর অবস্থানের ক্ষেত্রে মুসলমানদের মাঝে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। 

১. তাদের কেউ কেউ ধারণা করছে যে, আল্লাহ তায়ালা আরশে স্থিতি গ্রহণ করেছেন। তাদের নিকট আরশ হলো একটি সিংহাসন। যেটি ফেরেশতাগণ  বহন করে এবং এর চার দিকে প্রদক্ষিণ করে। কেননা আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, “সেদিন আপনার প্রভূর আরশকে আটজন ফেরেশতা বহন করবে”। (সূরা হাক্কা, আয়াত-১৭)। অপর আয়াতে রয়েছে, [অর্থ:] আপনি  ফেরেশতাদেরকে আরশ প্রদক্ষিণ করতে দেখবেন। (সূরা-ঝুমার, আয়াত-৭৫)। অন‍্য আয়াতে রয়েছে, যে সকল ফেরেশতা আরশ বহন করে এবং আরশের চার পাশে প্রদক্ষিণ করে….(সূরা মু’মিন, আয়াত-৭)। 

এরা পবিত্র কুরআনের আয়াত দ্বারা প্রমাণ পেশ করেছে। পবিত্র কুরআনের সূরা ত্বাহার পাঁচ নং আয়াতে রয়েছে, 

“দয়াময় আল্লাহ আরশের উপর ইস্তাওয়া করেছেন”। 

এছাড়া তাদের দলিল হলো, মানুষ দুয়ার সময় উপরের দিকে হাত উত্তোলন করে এবং উপর থেকে নিজেদের কল‍্যাণের আশা রাখে। এদের বক্তব‍্য হলো, আল্লাহ তায়ালা পূর্বে আরশে ছিলেন না, পরবর্তীতে আরশে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। কেননা, আল্লহা তায়ালা বলেছেন, “ অত:পর তিনি আরশে ইস্তাওয়া করলেন” (সূরা আ’রাফ, আয়াত নং ৫৪)। 

২. কেউ কেউ বিশ্বাস করে, আল্লাহ তায়ালা সব জায়গায় রয়েছেন। এরা পবিত্র কুরআনের কফেকটি আয়াত দ্বারা দলিল দিয়ে থাকে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, “ তিন ব‍্যক্তি যদি কথোপকথন করে, তবে আল্লাহ তায়ালা হলেন চতুর্থজন”। (সূরা মুজাদালা, আয়াত নং ৭)। অপর আয়াতে রয়েছে, “ আমি তাদের ঘাড়ের রগের চেয়েও অধিক নিকটবর্তী”। (সূরা ক্বাফ, আয়াত নং ১৬)। অন‍্য আয়াতে রয়েছে, “ আমি তোমাদের চেয়ে মৃত ব‍্যক্তির অধিক নিকটবর্তী। অথচ তোমরা দেখো না”। (সূরা ওয়াক্বিয়া, আয়াত নং ৮৫)। অন‍্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, [অথর্], তিনি সেই মহান আল্লাহ, যিনি আসমানেও প্রভূ, জমিনেও প্রভূ (সূরা জুখরুফ, আয়াত নং ৮৪)। এরা ধারণা করেছে যে, যদি আল্লাহ তায়ালাকে সব জায়গায় বিরাজমান না বলা হয়, তাহলে এর দ্বারা আল্লাহ তায়ালাকে সীমিত করা হয়। প্রত‍্যেক সীমিত জিনিস তার চেয়ে বড় জিনিস থেকে ছোট। এটি আল্লাহর জন‍্য একটি ত্রুটি হিসেবে বিবেচিত।

এদের এই অসার বক্তব‍্যে আল্লাহ তায়ালাকে স্থানের মুখাপেক্ষী সাব‍্যস্ত করা হয়েছে। সেই সাথে আল্লাহর জন‍্য সীমা সাব‍্যস্ত করা হয়েছে। কেননা, কোন কিছু যদি বাস্তবে কোন স্থানে অবস্থান করে, তাহলে উক্ত বস্তুটির ঐ স্থান থেকে বড় হওয়াটা সম্ভব নয়। কেননা, এটি যদি স্থান থেকে বড় হয়, তাহলে উক্ত স্থানে তার অবস্থান সম্ভব নয়। কোন একটি নির্দিষ্ট স্থানে থাকবে, অথচ সে স্থান থেকে বড় হবে, এটি একটি হাস‍্যকর বিষয়। সুতরাং যারা আল্লাহ তায়ালাকে সব জায়গায় বলেন, তারাও আল্লাহ তায়ালাকে সব জায়গার মধ‍্যে সীমিত করে দিয়েছেন। এদের বক্তব‍্য অনুযায়ী মহাবিশ্বের সীমা ও আল্লাহর সীমা একই হওয়া আবশ‍্যক হয়। আর মহান আল্লাহ তায়ালা এধরনের ধ‍্যান-ধারণা থেকে মহাপবিত্র। 

৩. তৃতীয় দলের বক্তব‍্য হলো, আল্লাহ তায়ালা সকল স্থান ও জায়গা থেকে মুক্ত ও পবিত্র। রুপক অর্থের কখনও কোন স্থানের দিকে আল্লাহ তায়ালাকে সম্পৃক্ত করলেও এর দ্বারা উদ্দেশ‍্য হলো, আল্লাহ তায়ালা উক্ত স্থানের সংরক্ষণ ও লালন-পালনকারী। 

[ কিতাবুত তাউহীদ, ইমাম আবু মনসুর মাতুরিদি রহ.(মৃত:৩৩৩ হিজরী), পৃ.১৩১, প্রকাশনী, মাকতাবাতুল ইরশাদ, ইস্তাম্বুল, প্রকাশকাল, ২০০১]

আহলে সুন্নতের বরেণ‍্য ইমাম আবু মনসুর মাতুরিদি রহ. পরবর্তীতে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের  আকিদা-বিশ্বাস স্পষ্টভাষায় তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন,

“ আল্লাহ তায়ালার অবস্থানের ক্ষেত্রে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের মূলনীতি হলো, যখন কোন স্থান ছিলো না, তখনও আল্লাহ তায়ালা ছিলেন। কোন জায়গার অস্থিত্ব না থাকলেও আল্লাহর অস্তিত্ব সম্ভব। আল্লাহ তায়ালা অনাদি থেকে বিদ‍্যামন রয়েছেনা। কোন সৃষ্টি বা স্থান যখন ছিলো না, তখনও আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্ব ছিলো। সুতরাং আল্লাহ তায়ালা এখনও স্থান থেকে মুক্ত অবস্থায় বিদ‍্যমান রয়েছে। যেমন কোন স্থানের অস্তিত্ব না থাকা সত্বেও আজালী তথা অসীম থেকে ছিলেন। মহান আল্লাহর সত্বা বা গুণাবলী পবিবর্তন-পরিবর্ধন, সংযোজন-বিয়োজন, হ্রাস-বৃদ্ধি ও বিলুপ্তি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত”।

[ কিতাবুত তাউহীদ, ইমাম আবু মনসুর মাতুরিদি রহ.(মৃত:৩৩৩ হিজরী), পৃ.১৩২, প্রকাশনী, মাকতাবাতুল ইরশাদ, ইস্তাম্বুল, প্রকাশকাল, ২০০১]

tawhid.png

ইমাম মাতুরিদি১.png

ইমাম মাতুরিদি২.png

এই আলোচনার পর ইমাম মাতুরিদি রহ. আহলে সুন্নতের বিরোধী আকিদা পোষণকারী উভয় দলের বক্তব‍্য খন্ডন করেছেন তার কিতাবুত তাউহীদে। যারা আল্লাহ তায়ালাকে আরশে বিশ্বাস করে এবং যারা আল্লাহর তায়ালাকে সব জায়গায় বিশ্বাস করে, উভয় দলের বক্তব‍্য তিনি অত‍্যন্ত জোরালো ভাষায় খন্ডন ও প্রত‍্যাখ‍্যান করেছেন। উলামায়ে কেরামের জন‍্য মাতুরিদি রহ. এর আলোচনাটি দলিল সমৃদ্ধ একটি সুপাঠ‍্য গবেষণা বলে মনে করি। আগ্রহী পাঠকগণ অবশ‍্যই ইমাম মাতুরিদি রহ: আলোচনাগুলি দেখে নিবেন। 

ইমাম আবুল লাইস সমরকন্দী রহ. (মৃত: ৩৭৩ হিজরী) এর বক্তব‍্য

বিখ‍্যাত ইমাম, ফকীহ ও মুহাদ্দিস আবুল লাইস সমরকন্দী রহ.  (মৃত: ৩৭৩ হিজরী) বলেন, 

“ আল্লাহর অবস্থান সম্পর্কে কিছু লোক মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছে। কাররামিয়া ও মুশাব্বিহাদের বক্তব‍্য হলো, আল্লাহ তায়ালা স্থানগতভাবে আরশের উপর রয়েছেন। তাদের নিকট নশ্বর আরশ হলো আল্লাহর অবস্থান বা অধিষ্ঠানের জায়গা। তারা স্থানের দিক থেকে আল্লাহ তায়ালার জন‍্য এখান থেকে অবতরণ, চলা-ফেরা এগুলো সাব‍্যস্ত করেছে। তারা বলে, আল্লাহ তায়ালা দেহবিশিষ্ট। তবে তিনি অন‍্যান‍্য দেহবিশিষ্টদের মতো নন। মহান আল্লাহ তায়ালা তাদের এসব ভ্রান্ত আকিদা থেকে মহাপবিত্র। তারা তাদের মতবাদ প্রমাণে কুরআনের সূরা ত্ব-হার পাঁচ নং আয়াত ব‍্যবহার করে। এখানে রয়েছে, আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর ইস্তাওয়া করেছেন। 

আমরা তাদের এই মতবাদ এভাবে খন্ডন করি, আরশ এক সময় ছিলো না। আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টির মাধ‍্যমে এটি অস্তিত্ব লাভ করেছে। এখন নশ্বর আরশের উপর হয়তো  আল্লাহ তায়ালা নিজের ক্ষমতা, বড়ত্ব ও কতৃর্ত্ব প্রকাশ করবেন অথবা নিজের বসার প্রয়োজনে সেখানে আসন গ্রহণ করবেন। অকাট‍্যভাবে প্রমাণিত সত‍্য হলো, অন‍্যের মুখাপেক্ষী কেউ কখনও স্রষ্টা হতে পারে না। সে তো নিজের প্রয়োজনেই অন‍্যের দ্বারস্থ। সে কীভাবে অন‍্যের উপর ক্ষমতাবান হবে ? অন‍্যের দ্বারস্থ ব‍্যক্তি তো নেতা হওয়ারও যোগ‍্য না, সে কীভাবে প্রভূ হবে? আরশে বসা বা এর উপর অবস্থান গ্রহণের সম্ভাবনা যখন ভ্রান্ত প্রমাণিত হলো, তখন প্রথম সম্ভবনাই সঠিক। অর্থাৎ আরশ আল্লাহর সৃষ্টি হওয়ার কারণে এটি আল্লাহর ক্ষমতা ও কতৃত্বের সামনে তুচ্ছ। এর প্রতি কোনরূপ প্রয়োজন ব‍্যতীত আল্লাহ তায়ালা নিজের কতৃর্ত্ব ও বড়ত্ব প্রকাশ করেছেন। 

(শরহুল ফিকহিল আবসাত, ইমাম আবু হানিফা রহ. এর আল-ফিকহুল আবসাতের ব‍্যাখ‍্যা, পৃ.২৫-২৬)। 

ইমাম আবুল লাইস সমরকন্দী আরও বলেন, 

“আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের আকিদা হলো, আল্লাহ তায়ালা নিজের মহত্ব, বড়ত্ব ও প্রভূত্বের দিক থেকে আরশের উপর সমুন্নত। স্থান, দূরত্ব ও উচ্চতার দিক থেকে তিনি আরশের উপর সমুন্নত নন। যেমনটি ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেছেন। তিনি আল্লাহর মর্যাদাগত সমুন্নত হওয়ার কথা বলেছেন। কেননা, মর্যাদা ও বড়ত্বের দিক থেকে সমুন্নত হওয়াটা মহান প্রভূর গুণ”। 

(শরহুল ফিকহিল আবসাত, ইমাম আবু হানিফা রহ. এর আল-ফিকহুল আবসাতের ব‍্যাখ‍্যা, পৃ.২৫-২৬)। 

somorkandi.png

somorkondi.png

শামসুল আইম্মা সারাখসী রহ. (৪৯০ হিজরী) এর বক্তব‍্য

হানাফী মাজহাবের মুজতাহিদ ফিল মাজহাব বিখ‍্যাত ইমাম শামসুল আইম্মা সারাখসী রহ.  (৪৯০ হিজরী) তাঁর বিখ‍্যাত কিতাব উসুলুস সারাখসী-তে লিখেছেন, 

رؤية الله بالأبصار في الآخرة حق معلوم ثابت بالنص ، وهو قوله “وجوه يومئذ ناضرة ، إلى ربها ناظرة” القيامة 23 – 24 ، ثم هو موجود بصفة الكمال ، وفي كونه مرئياً لنفسه ولغيره معنى الكمال ، إلا أن الجهة ممتنعة ، فإن الله تعالى لا جهة له

অথর্: পরকালে আল্লাহ তায়ালাকে চোখে দেখা সত‍্য। কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, “সেদিন চেহারাসমূহ প্রতীক্ষায় থাকবে, তাদের  প্রভূর দর্শনের”। (সূরা ক্বিয়ামাহ, আয়াত, ২৩-২৪)। আল্লাহ তায়ালা পরিপূর্ণতায় গুণান্বিত মহান সত্তা। আল্লাহ তায়ালা নিজের ও অ‍ন‍্যের দৃষ্টিগ্রাহ‍্য হওয়াটা তার পরিপূর্ণতার প্রমাণ। তবে  আল্লাহ তায়ালা দিক থেকে মুক্ত। আল্লাহর বিশেষ কোন দিক নেই। 

[উসুলুস সারাখসী, খ.১, পৃ.১৮৫]

মুসলিম শরীফের বাঁদীর হাদীস সম্পর্কে ইমাম সারাখসী রহ. বলেছেন,

مع أن في صحة ذلك الحديث كلاماً ؛ فقد رُوي أن النبي صلى الله عليه وسلم قال : أين الله ؟ فأشارت إلى السماء ، ولا نظن برسول الله صلى الله عليه وسلم أنه يطلب من أحد أن يثبت لله تعالى جهة ومكاناً 

অথর্: বাঁদীর হাদীসটি সহীহ হওয়ার ব‍্যাপারে অভিযোগ রয়েছে। রাসূল স. থেকে এই হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বাঁদীকে জিজ্ঞাসা করেছেন, আল্লাহ কোথায়? বাঁদী আকাশের দিকে ইঙ্গিত করেছে। আমরা রাসূল স. এর ব‍্যাপারে এই ধারণা রাখি না যে, তিনি কাউকে আল্লাহর জন‍্য দিক ও স্থান সাব‍্যস্ত করতে বলবেন। 

[আল-মাবসুত, খ.৪, পৃ.৭]

ইমাম নুরুদ্দীন আহমাদ ইবনে মাহমুদ আস-সাবুনী রহ. (মৃত:৫৮০ হিজরী) এর বক্তব‍্য

ইমাম নুরুদ্দীন সাবুনী রহ.(মৃত: ৫৮০ হিজরী) বলেন, 

“ মহাবিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহর দেহ, আকার-আকৃতি বিশিষ্ট হওয়া অসম্ভব। একইভাবে কোন দিকে বা স্থানে থাকাও । ইহুদী, মারাত্মক শিয়া-রাফেজী, মুশাব্বিহা (সাদৃশ‍্যবাদী) ও কাররামিয়াদের আকিদা হলো, আল্লাহ তায়ালা দেহবশিষ্ট। 

হিশাম ইবনে হাকামের মতবাদ হলো, আল্লাহ তায়ালা আকার-আকৃতি বিশিষ্ট। মুশাব্বিহা (সাদৃশ‍্যবাদী) ও কাররামিয়াদের মতবাদ হলো, আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর অবস্থান করেন বা আরশের উপর অধিষ্ঠান গ্রহণ করেছেন। তাদের কেউ কেউ বলে, আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর অবস্থান গ্রহণ ব‍্যতীত আরশের উপর রয়েছেন। নাজ্জারিয়া ফেরকার বিশ্বাস হলো, আল্লাহ তায়ালার সত্ত্বা সব জায়গা রয়েছে। মু’তাজিলাদের বক্তব‍্য হলো, আল্লাহ তায়ালা ইলমের মাধ‍্যমে সব জায়গায় রয়েছেন। সত্ত্বাগতভাবে তিনি সবজায়গায় নন। এদের সকলের মতবাদই ভ্রান্ত। 

[আল-বিদায়া মিনাল কিফায়া ফিল হিদায়া ফি উসুলীদ্দীন, পৃ.৪৪-৪৫]

 ইমাম ইবনে ফুরাক রহ. (মৃত: ৪০৬ হিজরী) এর বক্তব‍্য

اعلم أن الثلجي كان يذهب مذهب النجار في القول بأن الله في كل مكان وهو مذهب المعتزلة وهذا التأويل عندنا منكر من أجل أنه لا يجوز أن يقال إن الله تعالى في مكان أو في كل مكان

অর্থ: জেনে রেখো, সালজী মূলত: নাজ্জারের আকিদা-বিশ্বাস লালন করতো। নাজ্জারিয়া ফেরকার বিশ্বাস ছিলো, আল্লাহ সবর্ত্র বিরাজমান।  এটি মূলত: মু’তাজিলাদের মতবাদ।  আমাদের নিকট এই বক্তব‍্যটি নিন্দনীয়। কেননা, আল্লাহর তায়ালার ক্ষেত্রে এটি বলা বৈধ নয় যে, আল্লাহ তায়ালা সব জায়গায় অথবা কোন একটি নিদির্ষ্ট জায়গায় রয়েছেন। 

[ইবনে ফুরাক, মুশকিলুল হাদীস।  প্রকাশনী: দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত। পৃ.৬৫]

ইবনে ফুরাক রহ. আরও বলেন,

فمتى ما رجعوا في معنى إطلاق ذلك إلى العلم والتدبير كان معناهم صحيحًا واللفظ ممنوعًا ألا ترى أنه لا يسوغ أن يقال إن الله تعالى مجاور لكل مكان أو مماس له أو حال أو متمكن فيه على معنى أنه عالم بذلك مدبرٌ له

অর্থ: কেউ যদি “সর্বত্র  বিরাজমান” দ্বারা উদ্দেশ‍্য নেয় যে, আল্লাহ তায়ালা ইলম, ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের মাধ‍্যমে সবর্ত্র বিরাজমান, তাহলে তাদের উদ্দেশ‍্য সঠিক।  তবে “সর্বত্র  বিরাজমান” শব্দটি ব‍্যবহার করার অনুমতি নেই। আপনি এ ব‍্যাপারে সচেতন যে, কেউ যদি বলে, “আল্লাহ সব জায়গার সাথে রয়েছেন” অথবা “সব জায়গা স্পর্শ করে আছেন”,  “সকল জায়গায় মিশ্রিত আছেন”, “সব জায়গায় অবস্থান করছেন” এবং এসব ব‍্যবহার দ্বারা সে উদ্দেশ‍্য নেয় যে, আল্লাহ তায়ালা এগুলো সম্পর্কে অবগত রয়েছেন এবং এগুলো প্রতিপালন করছেন; এরপরও আল্লাহর তায়ালার ক্ষেত্রে এজাতীয় শব্দ ব‍্যবহার কখনও শোভনীয় নয়। 

ইমাম বাইহাকী রহ. (মৃত:৪৫৮ হি:) এর বক্তব‍্য

وفيما كتبنا من الآيات دلالة على إبطال قول من زعم من الجهمية أن الله سبحانه وتعالى بذاته في كل مكان وقوله عز وجل: ((وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنتُمْ)) إنما أراد به بعلمه لا بذاته

অথর্: আমি যেসমস্ত আয়াত উল্লেখ করেছি, এগুলো কিছু কিছু জাহমিয়াদের বক্তব‍্য বাতিল প্রমাণ করছে। তারা বলে, আল্লাহ তায়ালা সত্ত্বাগতভাবে সর্বত্র বিরাজমান। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, [অথর্:] “তোমরা যেখানেই থাকো, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের সাথে রয়েছেন”। এই আয়াত দ্বারা উদ্দেশ‍্য হলো, আল্লাহ তায়ালা জ্ঞানের দিক থেকে আমাদের সাথে রয়েছেন। এর দ্বারা সত্ত্বাগতভাবে আমাদের সাথে রয়েছেন, এটি উদ্দেশ‍্য নয়।

[আল-ই’তিকাদ ওয়াল হিদায়া ইলা সাবিলির রাশাদ, পৃ.৭০, আ’লামুল কুতুব, বইরুত]

ইমাম গাজালী রহ. (মৃত: ৫০৫ হি:) এর বক্তব‍্য

হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজালী রহ. জাহাম ইবনে সাফওয়ানের বক্তব‍্য খন্ডন করতে গিয়ে বলেন,

ولا ترتبك في مواقع غلطه فمنه غلط من قال: إنه في كل مكان. وكل من نسبه إلى مكان أو جهة فقد زلّ فضلّ ورجع غاية نظره إلى التصرف في محسوسات البهائم ولم يجاوز الأجسام وعلائقها

অথর্: তুমি জাহাম জাহাম ইবনে সাফওয়ানের আকিদাগত ভ্রান্তি থেকে বেঁচে থাকো। কিছু লোকের ভ্রান্ত বিশ্বাস হলো, আল্লাহ তায়ালা সব জায়গায় রয়েছেন। যারা আল্লাহ তায়ালাকে কোন জায়গা অথবা দিকের সাথে সম্পৃক্ত করেছে, তাদের পদস্খলন হয়েছে। তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে। সে তার সমস্ত চিন্তাভাবনাকে জীব-জন্তুর ইন্দ্রিয় ক্ষমতার মধ‍্যেই কেন্দ্রীভূত করে রেখেছে। তার চিন্তাশক্তি দেহ ও দেহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের গণ্ডি থেকেও মুক্ত হয়নি। 

[আল-আরবায়ীন ফি উসুলীদ্দীন, পৃ.১৯৮]

ইমাম ইবনে কাসীর রহ. (মৃত: ৭৭৪ হি:) এর বক্তব‍্য:

اتفق المفسرون على إنكار قول الجهمية الأول القائل تعالى عن قولهم علوًّا كبيرًا بأنه في كل مكان

      অথর্: জাহমিয়ারা সর্বপ্রথম আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে এই মতবাদ প্রচার করে যে, তিনি সর্বত্র বিরাজমান। আল্লাহ তায়ালা এর থেকে মহা পবিত্র। সমস্ত মুফাসসির জাহমিয়াদের এই বক্তব‍্য খন্ডনে একমত পোষণ করেছেন। 

[তাফসীরে ইবনে কাসীর, খ.৩, পৃ.৭ ]

ইমাম আবুল ইয়াসার বাজদাবী রহ. (৪২১-৪৯৩ হি:) এর বক্তব‍্য

হানাফী মাজহাবের বিখ‍্যাত ইমাম, আকিদা বিশারদ, ফকীহ ও উসুলবিদ ইমাম ইমাম আবুল ইয়াসার বাজদাবী রহ. বলেন, 

“ আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের আকিদা-বিশ্বাস হলো, আল্লাহ তায়ালা স্থান থেকে মুক্ত। তিনি আরশে বা অন‍্য কোন স্থানে নন। তিনি আরশের উপরেও নন। আল্লাহ তায়ালা সমস্ত দিক থেকেও সম্পূর্ণ মুক্ত। 

ভ্রান্ত আকিদায় নিপতিত কিছু হাম্বলী, কাররামিয়া, ইহুদী ও যারা আল্লাহ তায়ালাকে দেহবিশিষ্ট বিশ্বাস করে, তাদের আকিদা হলো, আল্লাহ তায়ালা আরশে অবস্থান করেন বা অধিষ্ঠান গ্রহণ করেন। তাদের কেউ কেউ বলে, অন‍্যান‍্য দেহবিশিষ্ট বস্তুর ন‍্যায় আল্লাহ তায়ালা ছয় দিক রয়েছে। 

তাদের কেউ কেউ বলে, আল্লাহ তায়ালার একটি দিক রয়েছে (উপরের দিক)। আর এই দিকের কারণে তিনি আরশে অবস্থান গ্রহণ করেছেন। 

কিছু কিছু মু’তাজিলাদের বিশ্বাস হলো, আল্লাহ তায়ালা সব জায়গায় রয়েছেন। তারা বলে, এর দ্বারা আমাদের উদ্দেশ‍্য হলো, আল্লাহ সকল জায়গা সম্পর্কে অবগত রয়েছেন। 

দার্শনিক বা ফিলোসফারদের বক্তব‍্য হলো, প্রকৃত অর্থে আল্লাহ তায়ালা সব জায়গায় রয়েছেন। হুসাইন আন-নাজ্জার নামক মু’তাজিলার আকিদাও এমন ছিলো। তার মতে, বাস্তবেই আল্লাহ সব জায়গায় রয়েছেন। তার বক্তব‍্যটি দার্শনিকদের বক্তব‍্যের অনুরূপ”। 

[উসুলুদ্দীন, ইমাম আবুল ইয়াসার বাজদাবী রহ, পৃ.৪০, প্রকাশকাল, ২০০৩, প্রকাশনী, আল-মাকতাবাতুল আজহারিয়‍্যা লিত-তুরাস, মিশর]

الأمام البزدوي.png

ইমাম সা’দুদ্দীন তাফতাজানী রহ. এর বক্তব‍্য

দারুল উলুম দেওবন্দ ও এর অনুসারী সকল মাদ্রাসায় ইমাম সা’দুদ্দীন তাফতাজানী রহ. এর বিখ‍্যাত আকিদার কিতাব শরহুল আকাইদনিন নাসাফিয়‍্যা পড়ানো হয়। বাংলাদেশ কওমী মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের সিলেবাসভুক্ত এই আকিদার কিতাবটি পৃথিবীর অন‍্যান‍্য দেশের বিশ্ব বিদ‍্যালয়গুলোতেও আকিদা বিভাগে পড়ানো হয়। এই কিতাবে ইমাম নাসাফী রহ. বলেন, 

لا يتمكن في مكان 

অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা কোন স্থানে অবস্থান করেন না। 

ইমাম সা’দুদ্দীন তাফতাজানী রহ. এই বক্তব‍্যের ব‍্যাখ‍্যা ও দলিল লিখেছেন শরহুল আকাইদে। উক্ত আলোচনার শেষে ইমাম তাফতাজানী রহ. বলেন, 

و إذا لم يكن في مكان لم يكن في جهة، لا في علو ولا في سفل ولا في غيرهما

“আল্লাহ তায়ালা যেহেতু স্থান থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত, একারণে তিনি কোন দিকেও অবস্থান করেন না। উপরেও নয়। নীচেও নয়। অন‍্য কোন দিকেও নয়”।

[শরহুল আকাইদিন নাসাফিয়‍্যা, পৃ.১৩২, মাকতাবাতুল মদীনা, করাচী, পাকিস্তান]

অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা স্থান ও দিক থেকে মুক্ত। তিনি পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ, উপর-নীচ সকল দিক থেকে মুক্ত। স্থান ও দিক সব কিছুই আল্লাহর সৃষ্টি। আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টির মাঝে প্রবেশ ও এগুলোর মাঝে অবস্থান থেকে মহাপবিত্র। 

sharhe aqaed1.png

sharheaqed2.png

shorheaqaed.png

আবুল মুঈন নাসাফী রহ. (মৃত: ৫০৮ হি:) এর বক্তব‍্য

ইমাম আবুল মুঈন নাসাফী রহ. মাতুরিদি আকিদার অন‍্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম ছিলেন। ইমাম আবু মনসুর মাতুরিদি রহ. এর কিতাব সমূহের পর তার কিতাবগুলোকে মাতুরিদি আকিদার মৌলিক কিতাব মনে করা হয়। ইমাম গাজালী রহ. ও ইমাম বাকিল্লানী রহ. যেমন আশআরী আকিদার ব‍্যাখ‍্যাকার ছিলেন, একই পর্যায়ের ইমাম ছিলেন আবুল মুইন নাসাফী রহ.। আকিদার দলিল বণর্না এবং ভ্রান্ত আকিদা সমূহের খন্ডনে তার মতো মহান ব‍্যক্তিত্ব বিরল। আকিদার উপর তার বিশাল কলেবরের কয়েকটি কিতাব রয়েছে। বিশেষভাবে তাবসিরাতুল আদিল্লা কিতাবটি সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। মাতুরিদি আকিদার মৌলিক কিতাব হিসেবে এটি সর্বমহলে পরিচিত। 

ইমাম আবুল মুঈন নাসাফী রহ. তার অদ্বিতীয় কিতাব তাবসিরাতুল আদিল্লা-তে  আল্লাহর অবস্থান সম্পর্কে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের আকিদা উল্লেখ করেছেন। সেই সাথে বিভিন্ন ফেরকার আকিদা উল্লেখ করে সেগুলো খন্ডন করেছেন।  ইমাম আবুল মুঈন নাসাফী রহ. লিখেছেন, 

“পূর্বের আলোচনা থেকে অকাট‍্য প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, আল্লাহ তায়ালা মহাবিশ্বের একটি অণু-পরমাণুর সাথেও বিন্দুমাত্র সাদৃশ‍্য রাখেন না। কেননা, মহাবিশ্বের কোন কিছুর সাথে সাদৃশ‍্য বা সমপর্যায়ের হলে মহাবিশ্বের মতো তিনি সৃষ্ট ও  নশ্বর হয়ে যাবেন। আল্লাহ তায়ালার ক্ষেত্রে সৃষ্ট বা নশ্বর হওয়া অকল্পনীয়। আমাদের সামনে  গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিষয় রয়েছে,  আল্লাহ তায়ালা কি কোন স্থানে অবস্থান করেন? কোন জায়গা বা দিক কি আল্লাহ তায়ালাকে ধারণ করতে পারে? অকাট‍্য প্রমাণ দ্বারা আমাদের নিকট স্পষ্ট হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালার জন‍্য স্থান ও দিক সাব‍্যস্ত করা অসম্ভব ও অকল্পনীয়। 

আল্লাহর জন‍্য জায়গা ও স্থান সাব‍্যস্তকারীদের অসার বক্তব‍্য:

আল্লাহ তায়ালা স্থান ও দিক থেকে মুক্ত হওয়ার বিষয়ে কিছু ভ্রান্ত ফেরকা আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের আকিদা বিশ্বাসের বিপরীত আকিদা পোষণ করে । 

একদল বিশ্বাস করে আল্লাহ তায়ালা সুনির্দিষ্ট একটি জায়গায় অবস্থান করেন। এই মতবাদের অনুসারী হলো, মারাত্মক পর্যায়ের শিয়া-রাফেজী, ইহুদী, কাররামিয়া ও সকল দেহবাদী (মুজাসসিমা-মুশাব্বিহা)। এদের মতবাদ হলো, আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর রয়েছেন। আর আল্লাহর ফেরেশতাগণ আরশ বহন ও পরিবেষ্টন করে থাকেন। কেননা আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, সেদিন আপনার প্রভূর আরশকে আটজন ফেরেশতা বহন করবে। (সূরা হাক্কা, আয়াত-১৭)। অপর আয়াতে রয়েছে, [অর্থ] আপনি  ফেরেশতাদেরকে আরশ প্রদক্ষিণ করতে দেখবেন। (সূরা-ঝুমার, আয়াত-৭৫)। ভ্রান্ত ফেরকা কাররামিয়ারা আরশে অবস্থান সম্পর্কে বিভিন্ন ধরণের দর্শন পেশ করেছে। তাদের কেউ বলে, আল্লাহ আরশে অধিষ্ঠান গ্রহণ করেছেন বা আরশে স্থির হয়েছেন। কেউ বলে, আল্লাহ তায়ালা আরশ স্পর্শ করে আছেন। তাদের কারও বিশ্বাস হলো, আল্লহা তায়ালা আরশের কাছাকাছি রয়েছেন। কেউ কেউ এধরণের শব্দ ব‍্যবহারে থেকে বিরত থাকে। এদের বিশ্বাস হলো, আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর রয়েছেন। তবে আরশ ও আল্লাহর মাঝে বিশেষ কোন সম্পর্ক নেই।  

এসকল কাররামিয়া তাদের এসব ভ্রান্ত আকিদার সাথে সাথে আরেকটি বিষয়ে মতনৈক‍্য করেছে। তাদের একদলের বিশ্বাস হলো, আল্লাহ তায়ালা পাঁচ দিকের  থেকে অসীম। একদিক তথা নীচের দিক থেকে  সসীম। আল্লাহর এই নিচের দিক আরশের সাথে  স্পর্শ করে আছে। আল্লাহ তায়ালা আরশের উপরিভাগ পূর্ণ করে অবস্থান করেন। তবে আরশের চার দিক থেকে কিছু কিছু অংশ ফাঁকা থাকে। কিছু কিছু কাররামিয়া বিশ্বাস করে, আল্লাহ তায়ালা সম্পূর্ণ আরশ জুড়েই অবস্থান করেন। একটুও জায়গা খালি থাকে না। কিছু কাররামিয়া বিশ্বাস করে, আল্লাহ তায়ালা আরশের একটি অংশের উপর রয়েছেন। কেউ বলে, আল্লাহ এক। তবে অনেক বড় হওয়ার কারণে সম্পূর্ণ আরশ জুড়ে অবস্থান করেন। কিছু কিছু সাদৃশ‍্যবাদীর (মুশাব্বিহা) আকিদা হলো, আল্লাহ আরশের উপর রয়েছেন এবং তার উভয় পা কুরসীর উপর রয়েছে। আল্লাহ এধরনের নিকৃষ্ট জালেমদের ভ্রান্ত বক্তব‍্য থেকে মহাপবিত্র। 

মু’তাজিলাদের আকিদা: আল্লাহ তায়ালা ইলম ও লালন-পালনের দিক থেকে সব জায়গায় রয়েছেন

আরেকটি ভ্রান্ত ফেরকা মু’তাজিলা আল্লাহর স্থান ও দিক থেকে মুক্ত হওয়ার আকিদার বিপরীত আকিদা পোষণ করেছে ।

মু’তাজিলারা বলে থাকে, আল্লাহ তায়ালা কোন সুনির্দিষ্ট স্থানে নন। বরং তিনি সব জায়গায় রয়েছেন। তারা আল্লাহর সব জায়গায় থাকার ব‍্যাখ‍্যা করে এভাবে, আমরা একথা বলি না যে, আল্লাহর সত্ত্বা সব জায়গায় রয়েছে। বরং আমাদের উদ্দেশ‍্য হলো, আল্লাহ তায়ালা সব জায়গা সম্পর্কে অবগত রয়েছেন এবং এগুলো লালন-পালন করছেন। এটি হলো মু’তাজিলা  ফেরকা ও এদের শাখা নাজ্জারিয়ার আকিদা। তবে আবু মুহাম্মাদ নু’বুখতী বর্ণনা করেছেন, তিনি হুসাইন আন-নাজ্জারের এক অনুসারীরের সাথে মোনাজারা (বিতর্ক) করেছেন। হুসাইন আন-নাজ্জারের এই অনুসারীর আকিদা ছিলো, আল্লাহ তায়ালার সত্ত্বা সব জায়গায় রয়েছে। এদের বিশ্বাস হলো, আল্লাহ তায়ালা ইলম ও  লালন পালনের দিক থেকে নয়, বরং সত্তার দিক থেকেই সব জায়গায় রয়েছেন। 

আহলে সুন্নতের আকিদা বিরোধী তৃতীয় দল হলো, পরবর্তী কাররামিয়াদের একটি অংশ। এদের আকিদা হলো, আল্লাহ তায়ালা আরশের উপরে নন। বরং তিনি আরশ থেকে উর্ধ্বে । আরশ ও আল্লহর মাঝে দূরত্ব রয়েছে। তবে এরা আল্লাহর জন‍্য দিক সাব‍্যস্ত করে থাকে।  আরশের উপর স্থিতিগ্রহণ ও আরশ স্পর্শ করে অবস্থান করার ভ্রান্তি বিষয়ে এরা আমাদের সাথে একমত পোষণ করেছে। 

(তাবসিরাতুল আদিল্লাহ, ইমাম আবুল মুঈন নাসাফী রহ. (মৃত:৫০৮ হিজরী), খ.১, পৃ.৩২৫-৩২৬. প্রকাশনী, আল-মাকতাবুল আজহারিয়‍্যা লিত তুরাস, মিশর। প্রথম প্রকাশ:২০১১, তাহকীক, ড.মুহাম্মাদ আনোয়ার হামেদ ঈসা) 

أب المعين النسفي.png

abul mueen nasafi.png

abul mueen2.png

কাজী শরফুদ্দীন ইসমাইল ইবনে ইব্রাহীম শাইবানী রহ. (মৃত:৬২৯ হিজরী) এর বক্তব‍্য

মাউসীল বা দামেশকের মোসেল শহরের বিখ‍্যাত হানাফী ইমাম কাজী শরফুদ্দীন রহ. ইমাম ত্বহাবী রহ. এর আকিদাতুত ত্বহাবীর ব‍্যাখ‍্যা লিখেছেন। আকিদাতুত ত্বহাবীর ব‍্যাখ‍্যাকার হিসেবে  ইমাম শরফুদ্দীন বিখ‍্যাত হয়ে আছেন। ইমাম শরফুদ্দীন শাইবানী রহ. তার আকিদাতু ত্বহাবীর ব‍্যাখ‍্যায় লিখেছেন, 

“ আহলে হক বা সত‍্যের অনুসারীগণের বিশ্বাস হলো, আল্লাহ তায়ালা স্থান থেকে মুক্ত ও পবিত্র। কোন স্থানে তিনি অবস্থান করেন না। কোন দিকের দিকে তিনি সম্পৃক্ত নন। কাররামিয়া, মুজাসসিমা (দেহবাদী),  ও মারাত্মক পর্যায়ের রাফেজী শিয়ারা আহলে সুন্নতের এই আকিদার বিরোধীতা করেছে। তাদের মতবাদ হলো, আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর রয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর থাকা থেকে মহাপবিত্র । 

[ শরহু মাতানিল আকিদাতিত্ব ত্বহাবীয়া, পৃ.৪৪]

ইমাম জালালুদ্দীন উমর ইবনে মুহাম্মাদ আল-খুজান্দী রহ.(মৃত:৬৯১হিজরী) এর বক্তব‍্য

ইসলামী আকিদা বিষয়ে ইমাম জালালুদ্দীন খুজান্দীর খুবই উপকারী একটি গ্রন্থ রয়েছে। আল-হাদী  ফি উসুলুদ্দীন। এই কিতাবে একটি পরিচ্ছেদের শিরোনাম হলো, আল্লাহ তায়ালা কোন দিকে নন। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা স্থান ও দিক থেকে মুক্ত।  ইমাম জালালুদ্দীন খুজান্দী রহ. লিখেছেন, 

“মহাবিশ্বের স্রষ্টা মহান আল্লাহ তায়ালা কোন দিক ও স্থানে নন। কেননা স্থান ও দিক বা এগুলোতে অবস্থান ধ্বংসশীল ও নশ্বর হওয়ার প্রমাণ”। 

[আল-হাদী ফি উসুলুদ্দীন, পৃ.৪৭]

আল্লামা আব্দুল গণী মায়দানী রহ. (মৃত: ১২৯৮ হিজরী) এর বক্তব‍্য

হানাফী মাজহাবের বিখ‍্যাত কিতাব আল-লুবাব ফি শরহিল কিতাব  এর লেখক আল্লামা আব্দুল গণী মায়দানী রহ. আকিদাতুত ত্বহাবীর বিখ‍্যাত একটি ব‍্যাখ‍্যা লিখেছেন। ইমাম মায়দানী রহ. এ কিতাবে লিখেছেন, 

“ আল্লাহ তায়ালাকে ছয় দিক পরিবেষ্টন করে না। কেননা এগুলো সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহ তায়ালা ছিলেন। এগুলো সৃষ্টির পূর্বে যেমন ছিলেন, এখনও তিনি তেমনই রয়েছেন”। 

[শরহুল আকিদাতিত ত্বহাবীয়া, পৃ.৭৫]

ইবনে হাজার আসকালানী রহ. এর বক্তব‍্য

বিখ‍্যাত হাদিস বিশারদ আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহ. (মৃত: ৮৫২ হি:) বলেন, 

وقد نزع به بعض المعتزلة القائلين بأن الله في كل مكان وهو جهل واضح 

অথর্: উক্ত হাদীস সম্পর্কে মু’তাজিলা সম্পদ্রায় মতবিরোধ করেছে। মু’তাজিলাদের একটি মতবাদ হলো, আল্লাহ তায়ালা সবর্ত্র বিরাজমান। এটি সুস্পষ্ট অজ্ঞতা। 

[ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার আসকালানী রহ, খ.১, পৃ.৫০৮]

ইমাম আব্দুল ওহাব শা’রানীর বক্তব‍্য

ইমাম শা’রানী রহ. তার বিখ‍্যাত কিতাব আল-ইওয়াকিত ওয়াল জাওয়াহির কিতাবে ইমাম আলী আল-খাওয়াস রহ. এর একটি বক্তব‍্য উল্লেখ করেছেন। আলী আল-খাওয়াস রহ. বলেন, 

لا يجوز أن يقال إنه تعالى في كل مكان كما تقول المعتزلة والقدرية

অথর্: একথা বলা বৈধ নয় যে, আল্লাহ তায়ালা সব জায়গায় রয়েছেন বা সর্বত্র বিরাজমান। সর্বত্র বিরাজমানের বক্তব‍্যটি মূলত: মু’তাজিলা ও কাদিরিয়া ফেরকার মতবাদ। 

[আল-ইওয়াকিত ওয়াল জাওয়াহির, খ.১, পৃ.৬৫]

আল্লামা বদরুদ্দীন আইনি রহ. (মৃত:৮৫৫ হিজরী)  এর বক্তব‍্য

বিখ‍্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা বদরুদ্দীন আইনি রহ. বোখারী শরীফের শে্রষ্ঠ ব‍্যাখ‍্যাকারদের অন‍্যতম। তার অমর কীর্তি উমদাতুল কারী । বোখারী শরীফের বিখ‍্যাত এই ব‍্যাখ‍্যাগ্রন্থে আল্লামা বদরুদ্দীন আইনি রহ. বলেন, 

“আবুল আলিয়া বলেছেন, ইস্তাওয়া এর অর্থ হলো উঁচু হওয়া। তার এই ব‍্যাখ‍্যায় ত্রুটি রয়েছে। কেননা আল্লাহ তায়ালা কখনও নিজের সম্পর্কে ইরতাফায়া বা উঁচু হওয়ার গুণ ব‍্যবহার করেননি। মুজাসসিমাদের (দেহবাদী) বিশ্বাস হলো, আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর স্থির হয়েছেন বা স্থিতি গ্রহণ করেছেন। তাদের এই বক্তব‍্যটি ভ্রান্ত। কেননা স্থির হওয়া বা স্থিতি গ্রহণ করা নশ্বর দেহের বৈশিষ্ট‍্য।  এর দ্বারা কোন কিছুর মাঝে প্রবেশ ও সীমাবদ্ধ হওয়া আবশ‍্যক হয়। আল্লাহর ক্ষেত্রে এগুলো অবাস্তব ও অকল্পনীয়”। 

[বোখারী শরীফের ব‍্যাখ‍্যাগ্রন্থ উমদাতুল কারী, খ.২৫, পৃ.১১১]

আল্লামা ইবনে নুজাইম রহ. (৯৭০ হিজরী) এর বক্তব‍্য

হানাফী মাজহাবের বিখ‍্যাত ফকীহ ও ইমাম আল্লামা ইবনে নুজাইম রহ. তার বিখ‍্যাত কিতাব আল-বাহরুর রায়েক -এ লিখেছেন, “ আল্লাহর জন‍্য স্থান সাব‍্যস্তের কারণে কাফের হয়ে যাবে। কেউ যদি বলে, আল্লাহ তায়ালা আসমানে বা আকাশে রয়েছেন। এটি যদি সে বাহ্যিক হাদীসের বক্তব‍্য উদ্ধৃত করার উদ্দেশ‍্য বলে তবে সে কাফের হবে না। কিন্তু বাস্তবেই আল্লাহ তায়ালা আকাশে রয়েছেন, এধরণের বিশ্বাস রাখে, তবে সে কাফের হয়ে যাবে। এ বক্তব‍্য দ্বারা যদি তার বিশেষ কোন নিয়ত না থাকে, তবুও অধিকাংশের নিকট কুফুরী হবে। এটাই সঠিক। এবং এর উপর ফতোয়া”। 

[আল-বাহরুর রায়েক, খ.৫, পৃ.১২৯]

মোল্লা আলী কারী রহ. (মৃত: ১০১৪ হিজরী) এর বক্তব‍্য

হানাফী মাজহাবের বিখ‍্যাত ইমাম মোল্লা আলী কারী রহ. বলেন, 

“ আল্লাহ তায়ালার কোন সীমা ও পরিসমাপ্তি নেই। আল্লাহ তায়ালা সীমাবদ্ধ নন। কোন স্থানে নন। তার কোন পরিসমপ্তিও নেই। এগুলো সবই নশ্বর দেহের বৈশিষ্ট‍্য। আল্লাহ তায়ালা কোন স্থানে অবস্থান করেন না। উপর-নীচ বা অন‍্য কোন দিকেও নন। আল্লাহ তায়ালা কোন সময় দ্বারা সীমাবদ্ধ নন। এগুলো সব মুশাব্বিহা (সাদৃশ‍্যবাদী), মুজাসসিমা (দেহবাদী) ও হুলুলিয়া (অনুপ্রবেশবাদী) ফেরকার ভ্রান্ত আকিদা-বিশ্বাস”। 

[শরহুল ফিকহিল আকবর, পৃ.৫৭]

আল্লামা কামাল ইবনুল হুমাম রহ. (৭৯০-৮৬১ হিজরী) এর বক্তব‍্য:

হানাফী মাজহাবের বিখ‍্যাত ইমাম কামাল ইবনুল হুমাম রহ. (৭৯০-৮৬১ হিজরী) ইসলামী আকিদার উপর গুরুতপূণর্ একটি কিতাব লিখেছেন। ইবনুল হুমাম রহ. এর আল-মুসায়ারা কিতাবটি মূলত: ইমাম গাজালী রহ. (৪৫০-৫০৫ হিজরী) এর আর-রিসালাতুল কুদসিয়া এর সংক্ষিপ্ত ব‍্যাখ‍্যা। ইমাম ইবনুল হুমাম রহ. এর আল-মুসায়ারা কিতাবটির ব‍্যাখ‍্যা লিখেছেন তার দু’জন বিখ‍্যাত ছাত্র।  আল্লামা কামালুদ্দীন ইবনে আবি শরীফ আল-মাকদিসী (৮২২-৯০৬ হিজরী) ও আল্লামা কাসিম ইবনে কুতলুবুগা রহ.(৮০২-৮৭৯ হিজরী)। আল্লামা কামালুদ্দীন ইবনে আবী শরীফ রহ. (৮২২-৯০৬ হিজরী) এর  ব‍্যাখ‍্যাগ্রন্থটির নাম আল-মুসামারা। কাসেম ইবনে কুতলুবুগা এবং কামালুদ্দীন ইবনে শরফী রহ. এর ব‍্যাখ‍্যাসহ মিশরের মাকতাবাতুল আজহারিয়‍্যা ইমাম ইবনুল হুমামের আকিদাগ্রন্থটি প্রকাশ করেছে। 

ইবনুল হুমাম রহ.  আল্লাহর অবস্থান সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, 

“ সপ্তম মূলনীতি: আল্লাহ তায়ালা কোন নির্দিষ্ট দিকে সম্পৃক্ত নন। আল্লাহর পবিত্র সত্তা ছয় দিকের কোন দিকে বা কোন স্থানে অবস্থান করে না। কেননা ছয়দিক যেমন, উপর-নীচ, ডান-বাম, আগে-পিছে এগুলো মানুষ ও মানুষের মত দু’পা বিশিষ্ট প্রাণির নিজস্ব সৃষ্টি। কেননা, উপর দিক হলো, মানুষের মাথার দিকের কোন জায়গা। নীচের দিক হলো, মানুষের পায়ের দিকের অংশ। ডান দিক হলো, মানুষের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতের দিকের অংশ। বাম দিক হলো, দুর্বল হাতের দিকের অংশ। সামনের দিক হলো, মানুষের বুকের দিকের অংশ। সাধারণত বুকের সামনের অংশে দৃষ্টি থাকে এবং এ দিকে মানুষ অগ্রসর  হয়। পিছনের দিক হলো, মানুষের পিঠের দিকের অংশ। 

যেসমস্ত প্রাণি চার পা’ বিশিষ্ট অথবা পেটের উপর ভর করে চলে, তাদের উপরের দিক  হলো, তাদের পিঠের দিকের অংশ। মহাবিশ্ব সৃষ্টির পূর্বে উপর-নীচ, ডান-বাম কিছুই ছিলো না। তখন কোন প্রাণি ছিলো না। কারও মাথা, পা, পিঠ কিছুই ছিলো না। সুতরাং এগুলোর নির্ভরশীল দিকের কোন ধারণাও একসময় ছিলো না। 

মোটকথা, দিক হলো একটি ধারণাপ্রসূত, কল্পিত ও আপেক্ষিক বিষয়।  দিক কোন বাস্তব ও অপরিবর্তনশীল কিছুই নয়। একটি পিঁপড়া যখন কোন ছাদে হাঁটে, তখন তার উপরের দিক হলো পৃথিবীর পৃষ্ঠের দিক।  কেননা, পৃথিবী পৃষ্ঠ তার পিঠের দিকে থাকে। সব সৃষ্টি যদি ফুটবলের মতো গোলাকার হতো, তাহলে এসব দিক বলতে কিছুই থাকতো না। কেননা, তখন মাথা, পা, ডান হাত, বাম হাত বলে কিছু থাকতো না। মহান আল্লাহ তায়ালা অসীম সময় থেকে বিদ্যমান। অসীমে কোন সৃষ্টি ছিলো না। আল্লাহ তায়ালা ছাড়া সব কিছুই নশ্বর ও সসীম সময়ে সৃষ্ট। আল্লাহ তায়ালা অসীমে বিদ্যমান ছিলেন, তখন কোন দিকই ছিলো না। 

[আল-মুসামারা, আল্লামা কামালুদ্দীন ইবনে আবি শরীফ, পৃ.৩০, প্রকাশনী, আল-মাকতাবাতুল আজহারিয়্যা, মিশর, প্রকাশকাল, ২০০৬]

إبن الهمام.png

ইবনুল হুমাম২.png

ইবনুল হুমাম৩.png

ইমাম আবুল বারাকাত নাসাফী রহ (মৃত: ৭১০ হিজরী)  এর বক্তব্য:

হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত একজন ইমাম হলেন আবুল বারাকাত নাসাফী রহ.। তিনি একাধারে আকিদা ও ফিকহের ইমাম ছিলেন। ইসলামী আকিদার উপর ইমাম আবুল বারাকাত নাসাফী রহ. এর বিখ্যাত একটি কিতাব রয়েছে। আল-ই’তিমাদ ফিল ই’তিকাদ ।  এ কিতাবে আকিদার মৌলিক বিষয়গুলো অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরেছেন।

         ইমাম আবুল বারাকাত নাসাফী রহ. আল্লাহর অবস্থান সম্পর্কে লিখেছেন,

“ মহাবিশ্বের স্রষ্টা মহান আল্লাহ তায়ালা কোন জায়গায় অবস্থান করেন না।  ভ্রান্ত দল মুশাব্বিহা, মুজাসসিমা ও কাররামিয়াদের মতবাদ হলো, আল্লাহ তায়ালা আরশে রয়েছেন”।

[আল-ই’তেমাদ ফিল ই’তেকাদ, ইমাম আবুল বারাকাত নাসাফী রহ., পৃ.১৬৪, প্রকাশকাল, ২০১২, প্রকাশনী, আল-মাকতাবাতুল আজহারিয়্যা,  কায়রো, তাহকীক, ড.আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ ইসমাইল]

এরপর তিনি এদের দলিল উল্লেখ করে সেগুলো খন্ডন করে এদের ভ্রান্তি তুলে ধরেছেন।আল্লাহর অবস্থান সম্পর্কে মু’তাজিলাদের অবস্থান সম্পর্কে তিনি লিখেছেন,

“মু’তাজিলা ও নাজ্জারিয়া ফেরকার আকিদা হলো, আল্লাহ তায়ালা স্বীয় উলম, কুদরত ও প্রতিপালনের মাধ্যমে সবজায়গায় রয়েছেন। মু’তাজিলা ও নাজ্জারিয়াদের এ বক্তব্যও বাতিল। কেউ কোন জায়গা সম্পর্কে অবগত হলে কখনও একথা বলা হয় না যে, ইলমের মাধ্যমে তিনি সে জায়গায় রয়েছেন”

[[আল-ই’তেমাদ ফিল ই’তেকাদ, ইমাম আবুল বারাকাত নাসাফী রহ., পৃ.১৬৯, প্রকাশকাল, ২০১২, প্রকাশনী, আল-মাকতাবাতুল আজহারিয়্যা,  কায়রো, তাহকীক, ড.আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ ইসমাইল]

আল্লামা আলাউদ্দীন হানাফী রহ. (মৃত: ১৩০৬ হিজরী) এর বক্তব‍্য:

হানাফী মাজহাবের বিখ‍্যাত ফতোয়ার কিতাব ফতোয়ায়ে শামী এর লেখক ইবনে আবেদীন রহ. এর ছেলে আলাউদ্দীন রহ. এর বিখ‍্যাত কয়েকটি কিতাব রয়েছে। কুররাতু উয়ূনিল আখয়ার, নুরুল ইযাহ এর ব‍্যাখ‍্যা মি’রাজুন নাজাহ ও আল-হাদিয়‍্যাতুল আলাবিয়‍্যা তার বিখ‍্যাত কয়েকটি গ্রন্থ।  তিনি আল-হাদিয়‍্যাতুল আলাবিয়‍্যা-তে লিখেছেন, “প্রত‍্যেক বুদ্ধিসম্পন্ন, প্রাপ্ত বয়ষ্ক নারী-পুরুষের উপর প্রথম ফরজ হলো, অন্তরের গভীর থেকে অকাট‍্য ও দৃঢ় বিশ্বাস রাখবে, মুখে অকপটে স্বীকার করবে যে, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা অনাদি ও অসীম থেকে স্বাধীন ও একচ্ছত্রভাবে বিদ‍্যমান রয়েছেন। তিনি অনন্তকাল থাকবেন। তার অস্তিত্ব কোন সৃষ্টির অস্তিত্বের মতো নয়। কেননা সৃষ্টির অস্তিত্ব নির্ভরশীল ও অধীন। সৃষ্টি তার অস্তিত্বের সময়, স্থান, পরিমাপ-পরিমিতি, পরিবর্তনশীল অবস্থার  উপর নির্ভরশীল। এগুলো ব‍্যতীত সৃষ্টির অস্তিত্ব সম্ভব নয়। মহান আল্লাহ তায়ালা এসব কিছু থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত”। 

[আল-হাদিয়‍্যাতুল আলাবিয়‍্যা, পৃ.৪২৬]

ফতোয়ায়ে-আলমগীরির ফতোয়া :

হানাফী মাজহাবের বিখ‍্যাত ফতোয়ার কিতাব ফতোয়া-এ আলমগীরি-তে রয়েছে, 

“কেউ যদি বলে, আল্লাহ তায়ালা আসমানে বা আকাশে রয়েছেন। এটি যদি সে বাহ্যিক হাদীসের বক্তব‍্য উদ্ধৃত করার উদ্দেশ‍্য বলে তবে সে কাফের হবে না। কিন্তু বাস্তবেই আল্লাহ তায়ালা আকাশে রয়েছেন, এধরণের বিশ্বাস রাখে, তবে সে কাফের হয়ে যাবে। এ বক্তব‍্য দ্বারা যদি তার বিশেষ কোন নিয়ত না থাকে, তবুও অধিকাংশের নিকট কুফুরী হবে। এটাই সঠিক। এবং এর উপর ফতোয়া”। 

[ফতোয়ায়ে আলমগীরি বা আল-ফতোয়াল হিন্দিয়া, খ.২, পৃ.২৫৯]

আল্লাহ তায়ালার অবস্থান সম্পর্কে দেওবন্দী আলেমগণের সুস্পষ্ট বক্তব‍্য

বিখ‍্যাত মুফাসসির আব্দুল হক হক্কানী রহ (১২৬৭-১৩৩৫ হিজরী). এর বক্তব‍্য:

ইসলামী আকিদা বিষয়ে আব্দুল হক দেহলবী রহ.  (তাফসীরে হক্কানী এর লেখক) এর বিখ‍্যাত একটি কিতাব রয়েছে। আকাইদুল ইসলাম।  এটি ১৩০২ হিজরী সালে উদুর্তে ছাপা হয়। মাতবায়ে আনসারে দিল্লী থেকে এটি প্রকাশিত হয়। এই কিতাবের শুরুতে দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা কাসেম নানুতুবী রহ. এর সংক্ষিপ্ত অভিমত রয়েছে। কিতাবটি সম্পর্কে কাসেম নানুতুবী রহ. বলেন, 

“উদুর্ ভাষায় এটি একটি অদ্বিতীয় কিতাব। আমি কিতাবের শুরু থেকে শেষ পযর্ন্ত পড়েছি। সত‍্য কথা হলো, উদুর্ ভাষায় ইতোপূর্বে এধরণের কোন কিতাব লেখা হয়নি। বিষয়বস্তুর দিক থেকেও এধরনের কোন কিতাব প্রকাশিত হয়নি। কিতাবটি লেখকের গভীর পান্ডিত‍্যের উজ্জল সাক্ষর। প্রবাদ রয়েছে, মানুষকে তার বক্তব‍্য ও লেখনী থেকে চেনা যায়। অতিরিক্ত ভূমিকা লেখা অর্থহীন। পাঠক নিজেই দেখে নিন, কিতাবটি কতো অসাধারণ”। 

উলামায়ে দেওবন্দের অনুসরণীয় ব‍্যক্তিত্ব বিখ‍্যাত মুহাদ্দিস ও সুফী আব্দুল হক দেহলবী রহ. তার আকাইদুল ইসলাম -এ লিখেছেন, 

অথর্: আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্ব ও অবস্থানের জন‍্য কোন স্থানের প্রয়োজন নেই।  কেননা দেহবিশিষ্ট ও স্থানিক বস্তুর জন‍্যই কেবল অবস্থানের জন‍্য জায়গার প্রয়োজন হয়। মহান আল্লাহ তায়ালা দেহ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র। সুতরাং তিনি আসমানে থাকেন না। তিনি জমিনে অবস্থান করেন না। পূর্ব-পশ্চিম কোথাও তিনি থাকেন না। বরং সমগ্র মহাবিশ্ব তাঁর নিকট একটি অণু-পরমাণুতুল‍্য। সুতরাং তিনি এই ক্ষুদ্র সৃষ্টির মাঝে কেন অবস্থান করবেন? তবে সৃষ্টির সব কিছুই আল্লাহর সামনে পূর্ণ উদ্ভাসিত। কোন কিছুই তাঁর থেকে সুপ্ত বা অজ্ঞাত নয়। সকল স্থান ও জায়গা আল্লাহর নিকট সমান।  

[আকাইদুল ইসলাম, আব্দুল হক দেহলভী রহ.। পৃ.৩২,  প্রকাশকাল, ১৩০২ হিজরী, প্রকাশনী, মাতবায়ে আনসারে দিল্লী, ইন্টারনেটে এই সংস্করণের স্ক‍্যানিং কপি রয়েছে। ডাউনলোড লিংক: https://ia801006.us.archive.org/8/items/AqaidUlIslam_201312/Aqaid%20ul%20Islam%20By%20Maulana%20Abdul%20Haq%20Haqqani.pdf]

আব্দুল হক দেহলবী রহ. বলেন, 

অর্থ: আল্লাহ তায়ালা কারও সমগোত্রীয় নন। তাঁর সাথে তুলনীয় কিছুই নেই। তিনি কোন বস্তুর সাথে মিশ্রিত বা একীভূতও নন। 

আল্লাহর সত্তা কোন কিছুর সাথে মিশ্রিত বা একীভূত নন, এই কথার ব‍্যাখ‍্যায় তিনি বলেন, 

“ আল্লাহর সত্তার সাথে কোন কিছু একীভূত নয়। কেননা, আল্লাহর সত্তা ছাড়া সব কিছুই সৃষ্টি। আর সৃষ্টির কোন কিছু আল্লাহর সত্তার সাথে মিশ্রিত হতে পারে, এধরণের ধারণা রাখা সুস্পষ্ট ভ্রান্তি। কিছু অজ্ঞ লোক বলে থাকে, মানুষ, গাছ-পালা, পাথর  সব কিছুই আল্লাহ। তাদের এধরণের বিশ্বাস সুস্পষ্ট কুফুরী। কিছু কিছু সূফী ওয়াহদাতুল উজুদের কথা বলেছেন। তাদের থেকেও একথা প্রমাণিত নয় যে,  সমস্ত সৃষ্টিই আল্লাহ। কেননা এসব সূফীগণ জিদ্দাতুল উজুদের প্রবক্তা। জিদ্দাতুল উজুদের অর্থ হলো, প্রকৃত, স্বাধীন ও একচ্ছত্র অস্তিত্ব একমাত্র আল্লাহ তায়ালার। আল্লাহর দেয়া অস্তিত্বের কারণে সৃষ্টি ক্ষণস্থায়ী অস্তিত্ব লাভ করেছে। বাস্তবে সৃষ্টির অস্তিত্ব স্বাধীন ও মৌলিক নয়। সুতরাং ওয়াহদাতুল উজুদের প্রবক্তা সূফীগণ স্রষ্টা ও সৃষ্টিকে অভিন্ন বিশ্বাস করেন না। কারণ, এটি সুস্পষ্ট কুফুরী। “

[আকাইদুল ইসলাম, আব্দুল হক দেহলভী রহ.।  পৃ.৩৬, প্রকাশকাল ১৩০২, প্রকাশনী, মাকতাবায়ে আনসারে দিল্লী]

আব্দুল হক দেহলবী রহ. আরও স্পষ্টভাষায় লিখেছেন,

অর্থ: “কেউ যদি বলে, ওয়াহদাতুল উজুদের মাধ‍্যমে স্রষ্টা ও সৃষ্টি এক ও অভিন্ন হওয়া প্রমাণিত হয়, তাহলে আমরা বলব, এটি সুস্পষ্ট কুফুরী। যেই এ মতবাদের প্রবক্তা হোক, আমরা এটিকে অবশ‍্যই কুফুরী বিশ্বাস করি। আমরা পবিত্র কুরআনের উপর ইমান এনেছি। এ ব‍্যক্তি এর সম্পূণর্ বিরোধী”।

একটি জিনিস অন‍্য কিছুর মাঝে প্রবেশ ও এর সাথে মিশে যাওয়াকে পরিভাষায় হুলুল বলে। যেমন কাপড়ের সাথে কালো বা সাদা রঙ  মিশে যায়। আল্লাহ তায়ালার ক্ষেত্রে সৃষ্টির মাঝে প্রবেশ ও মিশে যাওয়া অবাস্তব ও অসম্ভব। একটি বস্তু অন‍্য কিছুর মাঝে প্রবেশ করলে এটি প্রবেশকৃত বস্তুর মুখাপেক্ষী হয়। একইভাবে আল্লাহ তায়ালা যদি কোন সৃষ্টির মাঝে প্রবেশ করেন, তাহলে তিনিও উক্ত সৃষ্টির মুখাপেক্ষী হবেন। অথচ আল্লাহ তায়ালা সমস্ত সৃষ্টি থেকে সম্পূণর্ অমুখাপেক্ষী। 

একইভাবে আল্লাহ তায়ালার মাঝেও কোন সৃষ্টি প্রবেশ করে না। কোন সৃষ্টি যদি আল্লাহর সত্ত্বার মাঝে প্রবেশ করতো, তাহলে তিনি নশ্বর সৃষ্টির অবস্থানের জায়গা ও ধারক হতেন। আর কোন সৃষ্টি বা নশ্বর বস্তুর ধারক বা পাত্রও একটি সৃষ্টি। আল্লাহ তায়ালা এগুলো থেকে সম্পূণর্ পবিত্র ও মুক্ত। 

সুতরাং পাত্রের মাঝে যেভাবে পানি থাকে অথবা কাপড়ের সাথে রঙ মিশে থাকে, এভাবে আল্লাহ তায়ালা কোন সৃষ্টির মাঝে অনুপ্রবেশ থেকে পবিত্র।  গরম পানি ঠান্ডা পানির সাথে মিশে যেভাবে একাকার হয়ে যায় অথবা বরফ গলে যেমন পানি হয়ে যায়, এভাবে কোন সৃষ্টি আল্লাহর সত্তার মাঝে প্রবেশ ও মিশে যায় না। কিছু অজ্ঞ লোক বলে থাকে, সৃষ্টি বিশেষভাবে কামেল আল্লাহর ওলী, আল্লাহর সত্তার সাথে এমনভাবে মিশে যায়, যেমন বরফ পানির সাথে মিশে যায়, অথবা একফোঁটা পানি মহাসমুদ্রের মাঝে হারিয়ে যায়। তাদের কেউ কেউ বিশ্বাস করে, আল্লাহর ওলী ও আল্লাহ এক ও অভিন্ন। কেননা, আল্লাহর ওলীরা আল্লাহর সত্তার মাঝে প্রবেশ করে একীভূত হয়ে যায়। এধরনের সকল আকিদা-বিশ্বাস সম্পূণর্ ভ্রান্ত ও সুস্পষ্ট কুফুরী। 

[আকাইদুল ইসলাম, আব্দুল হক দেহলভী রহ.।  পৃ.৩৬-৩৭, প্রকাশকাল, ১৩০২হিজরী, প্রকাশনী, মাকতাবায়ে আনসারে দিল্লী]

abdul haq dehlabi1.png

abdul haq dehlabi2.png

abdul haq dehlabi3.png

abdul haq dehlabi4.png

aqaeed.png

ইদ্রীস কান্ধলবী রহ এর বক্তব‍্য:

বিখ‍্যাত আলেম ইদ্রীস কান্ধলবী রহ. তাঁর বিখ‍্যাত কিতাব আকাইদুল ইসলামে  লিখেছেন, 

“মহান আল্লাহ তায়ালা সমস্ত অপূর্ণতা, দোষ-ত্রুটি, নশ্বরতা ও ধ্বংসশীল সব ধরনের বিষয় থেকে মুক্ত ও পবিত্র। তিনি দেহ বিশিষ্ট নন। তিনি কোন স্থানে অবস্থান করেন না। সময়ের সীমাবদ্ধতা দ্বারাও তিনি সীমিত নন। মৌল উপাদান (অণু-পরমাণু), দেহ (দৈঘ‍্য-প্রস্থ বিশিষ্ট বস্তু) ও আপেক্ষিক উপাদান এ এগুলোর আনুষঙ্গিক বৈশিষ্ট‍্য থেকেও আল্লাহ তায়ালা মুক্ত ও পবিত্র। আল্লাহ তায়ালার ক্ষেত্রে স্থানে অবস্থান ও সময়ের দ্বারা সীমিত হওয়ার বিষয়টি অবাস্তব ও অকল্পনীয়। এসব কিছুই মহান আল্লাহর সৃষ্টি। 

[আকাইদুল ইসলাম, পৃ.৫৯, প্রকাশনী, ইদারায়ে ইসলামিয়াত, লাহোর, পাকিস্তান]

ইদ্রীস কান্ধলবী রহ. আরও লিখেছেন, 

“আল্লাহ তায়ালা কোন সৃষ্টির সাথে একীভূত নন। কোন সৃষ্টিও আল্লাহর সাথে একীভূত নয়। কোন সৃষ্টি আল্লাহর সত্তার মাঝে প্রবেশ করতে পারে না। আল্লাহ তায়ালাও কোন সৃষ্টির মাঝে প্রবেশ করেন না। খ্রিস্টানদের নিকট আল্লাহ তায়ালা ইসা আ. এর মাঝে প্রবেশ করেছে। হিন্দুদের নিকট আল্লাহ তায়ালা মানুষ, জীব-জন্তু, গাছ-পালা ও পাহাড়-পর্বতের মাঝে প্রবেশ করে। সামেরীর বিশ্বাস ছিলো, আল্লাহ তায়ালা বাছুরের মাঝে প্রবেশ করেছে। ইন্ডিয়ার গাভী পূজারীরা মূলত: মিশরের সামেরীর অনুসারী।  হিন্দুদের অস্পৃশ‍্যতার ধারণাটাও সামেরীর থেকে এসেছে। সে বলতো, আমাকে কেউ স্পর্শ করো না। একইভাবে হিন্দুরা কোন মুসলমানকে দেখলে বলে, আমাকে স্পর্শ করো না। মোটকথা, হিন্দুদের গরুপূজা, অস্পৃশ‍্যতা এগুলোর উৎসমূল মুসা আ. এর সময়ের সামেরী থেকে পাওয়া যায়। 

ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী রহ. সামেরীর আলোচনায় লিখেছেন, সে হুলুলিয়া ফেরকার অন্তর্ভূক্ত ছিলো। যারা সৃষ্টির মাঝে আল্লাহর প্রবেশের বিশ্বাস রাখে। ভারত উপমহাদেশের হিন্দুরাও তার  অনুসারী। বরং উপমহাদেশের হিন্দুরা তার চেয়েও অগ্রসর। কেননা, সামেরী থেকে একথা প্রমাণিত নয় যে, সে গাভীর পেশাব পান করতো। গরু-গাভী নির্বুদ্ধিতার উপমা হিসেবে ব‍্যবহৃত হয়। কাউকে যদি নির্বোধ বলতে হয়, তাহলে আমরা তাকে গরু বলি। হিন্দুদের অবস্থা দেখো। এক দিকে তো একটা অবলা প্রাণিকে নিজেদের প্রভূ বানিয়েছে। আবার জীব-জন্তুর মধ‍্যে এমন একটাকে বাছাই করেছে যেটি নির্বুদ্ধিতার ক্ষেত্রে বিশেষ উপমা। হিন্দুদের এই প্রভূ বাছাই থেকে এটি প্রমাণিত হয় যে, নির্বুদ্ধিতার দিক থেকে এরা গরু-গাভীর থেকে অধম। অথচ কোন দিক থেকে সৃষ্টি বা মানুষ স্রষ্টা থেকে উন্নত ও পরিপূর্ণ হওয়া অসম্ভব ও অকল্পনীয়। 

[আকাইদুল ইসলাম, পৃ.৫৯-৬০, প্রকাশনী , ইদারায়ে ইসলামিয়াত, লাহোর, পাকিস্তান]

idris kandholo aqaede islam1.png

idris kandholo aqaede islam2.png

তাসাউফের বিখ‍্যাত ইমামগনের আকিদা-বিশ্বাস

বিখ্যাত সূফী ইমাম জুন-নুন মিসরী রহ. [মৃত: ২৪৫ হি:] বলেন,

“ربي تعالى فلا شىء يحيط به * وهْو المحيط بنا في كل مرتصد

لا الأين والحيث والتكييف يدركه * ولا يحد بمقدار ولا أمد

وكيف يدركه حد ولم تره * عين وليس له في المثل من أحد

أم كيف يبلغه وهم بلا شبه * وقد تعالى عن الأشباه والولد”

অর্থাৎ মহান আল্লাহ তায়ালাকে কোন কিছু পরিবেষ্টন করে না।

তিনি সর্বাবস্থায় আমাদেরকে পরিবেষ্টন ও নিয়ন্ত্রণ করছেন।

কোথায়, কেমন, কীভাবে, কী অবস্থা.. এগুলো থেকে আল্লাহ পবিত্র।

কোন পরিমাপ-পরিমিতি দ্বারা তিনি সীমাবদ্ধও নন।

আল্লাহ তায়ালার সীমা কীভাবে নির্ধারণ করবে? অথচ তাকে চক্ষু দেখেনি এবং তার তুলনীয় কিছুই নেই?

কোন সাদৃশ্য ছাড়া কেউ আল্লাহ তায়ালাকে কীভাবে কল্পনা করবে? অথচ আল্লাহ তায়ালা সব ধরনের সাদৃশ্য ও সন্তান থেকে পবিত্র।

[হিলয়াতুল আউলিয়া, খ.৯, পৃ.৩৮৮]

10645080_378775978938487_644304096465822319_n.jpg

শাইখে আকবার মুহিউদ্দীন ইবনে আরাবীর আকিদা-বিশ্বাস:

يا إخواني ويا أحبابي أشهدكم أني أشهد الله تعالى وأشهد ملائكته وأنبياءه ومن حضر أو سمع أني أقول قولاً جازماً بقلبي إن الله تعالى واحد لا ثاني له منزه عن الصاحبة والولد . مالكٌ لا شريك له ، ملك لا وزير له ، صانع لا مدبر معه ، موجود بذاته من غير افتقار إلى موجود يوجده ، بل كل موجود مفتقر إليه في وجوده . فالعالم كله موجود به ( أي وجد بإيجاد الله له ) وهو تعالى موجود بنفسه لا افتتاح لوجوده ولا نهاية لبقائه بل وجوده مطلق قائم بنفسه ، ليس بجوهر فيقدر له المكان ولا بعرض فيستحيل عليه البقاء ولا بجسم فيكون له الجهة والتلقاء ، مقدس عن الجهات والأقطار . استوى على عرشه كما قاله وعلى المعنى الذي أراده كما أن العرش وما حواه به استوى وله الآخرة والأولى . لا يحده زمان ولا يحويه مكان بل كان ولا مكان وهو الآن على ما عليه كان لأنه خلق المتمكن والمكان وأنشأ الزمان . تعالى الله أن تحله الحوادث أو يحلها أو تكون قبله أو يكون بعدها ، بل يقال كان ولا شيء معه إذ القبل والبعد من صيغ الزمان الذي أبدعه ، فهو القيوم الذي لا ينام والقهار الذي لا يرام ، ليس كمثله شيء وهو السميع البصير 

অথর্: প্রিয় ভ্রাতা ও বন্ধুগণ, আমি তোমাদেরকে সাক্ষী রেখে ঘোষণা করছি, আমি আল্লাহ তায়ালা, ফেরেশতাগণ, নবীগণ এবং উপস্থিত-অনুপস্থিত শ্রোতা ও পাঠককে সাক্ষী রেখে ঘোষণা করছি যে, আমি আমার অন্তরের গভীর থেকে দৃঢ় ও সুনিশ্চিত বিশ্বাস রাখি যে, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা এক। তার সাথে তুলনীয় দ্বিতীয় কেউ নেই। তিনি স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি থেকে মুক্ত ও পবিত্র। তিনি মহান বাদশাহ। তার কোন অংশীদার নেই। তিনি এমন বাদশাহ যার কোন পরামশর্দাতা নেই। তিনি মহান কারিগর। তার সহযোগী কোন কারিগর নেই। তিনি অনাদি থেকে নিজেই অস্তিত্বশীল। তার অস্তিত্ত্বের জন‍্য কোন অস্তিত্বদানকারীর মুখাপেক্ষী নন। তিনি ছাড়া সকল বিদ‍্যমান বস্তুই অস্তিত্বের জন‍্য তার মুখাপেক্ষী। সমগ্র মহাবিশ্ব আল্লাহর অস্তিত্বদানের কারণেই বিদ‍্যমান। কিন্তু মহান আল্লাহ তায়ালা নিজেই অনাদি থেকে বিদ‍্যমান। তার অস্তিত্বের কোন সূচনা নেই। তার কোন অন্ত নেই। আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পূর্ণ মৌলিক ও স্বাধীন। তিনি স্বয়ং বিদ‍্যমান সত্ত্বা। তিনি কোন জওহার (মৌল উপাদান) নন। সকল জওহর বা মৌল উপাদান স্থানের মুখাপেক্ষী। আল্লাহ তায়ালা স্থানের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত।  তিনি কোন আরজ বা আপেক্ষিক উপাদান নন। সকল আরজই অস্তিত্বের জন‍্য অন‍্যের উপর নিভর্রশীল। আল্লাহ তায়ালা দেহবিশিষ্ট নন। প্রত‍্যেক দেহবিশিষ্ট বস্তুর একটি দিক রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা সকল দিক থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র। আল্লাহ তায়ালা তার আরশের উপর ইস্তাওয়া করেছেন, যেমনটি তিনি পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন। এই ইস্তাওয়া শব্দের প্রকৃত অর্থ ও উদ্দেশ‍্য একমাত্র আল্লাহ ভালো জানেন। আরশ ও আরশ সংশ্লিষ্ট বস্তুসমূহ আল্লাহ তায়ালার ক্ষমতা ও কুদরতের মাধ‍্যমেই অস্তিত্বশীল। সূচনা ও অন্ত সব কিছুর মালিকই আল্লাহ তায়ালা। কোন সময় আল্লাহ তায়ালাকে সীমিত করতে পারে না। কোন স্থান তাকে পরিবেষ্টন করতে পারে না । যখন কোন স্থানেরই অস্তিত্ব ছিলো না, তখনও আল্লাহ তায়ালা বিদ‍্যমান ছিলেন। স্থান সৃষ্টির পূর্বে যেমন আল্লাহ তায়ালা স্থান থেকে মুক্ত অবস্থায় বিদ‍্যমান ছিলেন, তিনি এখনও স্থান থেকে মুক্ত অবস্থায় বিদ‍্যমান রয়েছেন। কেননা সকল স্থান ও স্থানে আবদ্ধ সব কিছুরই স্রষ্টা তিনি। তিনিই সময়কে সৃষ্টি করেছেন।  আল্লাহর সত্ত্বার মাঝে নশ্বর বিষয়ের অনুপ্রবেশ থেকে আল্লাহ তায়ালা মহাপবিত্র। কোন সৃষ্টিই আল্লাহর পূর্বে অস্তিত্বশীল নয়। বরং আমাদের বিশ্বাস হলো, অনাদিকাল থেকে আল্লাহ তায়ালা বিদ‍্যমান রয়েছেন। কোন সৃষ্টি তার সঙ্গে অনাদি থেকে অস্তিত্বশীল নয়। কেননা “পূর্ব” ও “পর” সময়সূচক দু’টি শব্দ। আর সময়ের স্রষ্টা হলেন আল্লাহ তায়ালা। তিনি চিরঞ্জীব। কখনো  নিদ্রাগমন করেন না। তিনিই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। কখনও দুর্বল হন না। তার সাথে তুলনীয় কিছুই নেই। তিনিই সর্বশে্রাতা ও সর্বদ্রষ্টা।

শাইখে আকবার মুহিউদ্দীন ইবনে আরাবী 

باب وصل في أسرار أمّ القرآن

অধ্যায়েবলেন,

ذات الحق ليست ذات العبد ، إذ لا طاقة للمحدَث على حمل القديم

অথর্আল্লাহরসত্ত্বাওবান্দার সত্ত্বা এক নয়। কেননা নশ্বর সৃষ্টির পক্ষে অবিনশ্বর স্রষ্টাকে ধারণ করার ক্ষমতা নেই।

শাইখে আকবার আরও বলেন,

من قال بالحلول فهو معلول، فإِن القول بالحلول مرض لا يزول، وما قال بالاتحاد إِلا أهل الإِلحاد، كما أن القائل بالحلول من أهل الجهل والفضول

অর্থ: যে ব‍্যক্তি হুলুলের (সৃষ্টির মাঝে আল্লাহর অনুপ্রবেশ) বিশ্বাস রাখল, সে সঠিক পথ থেকে বিচ‍্যুত। কেননা হুলুলের আকিদা একটি চিরস্থায়ী রোগ। একইভাবে স্রষ্টা ও সৃষ্টিকে এক বলার কথা কেবল কাফেররাই বলে থাকে। তেমনি হুলুলে আকিদা পোষণকারী ব‍্যক্তিও অজ্ঞ ও মূর্খ। 

(আল-ফুতুহাতুল মাক্কিয়া, আল-ইয়াকিত ওয়াল জাওয়াহির, ইমাম শা’রানী রহ. খ.১, পৃ.৮০-৮১)

তিনি আরও বলেন,

الحادث لا يخلو عن الحوادث، ولو حل بالحادثِ القديمُ لصح قول أهل التجسيم، فالقديم لا يحل ولا يكون محلاً

অর্থ : নশ্বর বস্তু বিভিন্ন নশ্বর উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত। অবিনশ্বর সত্ত্বা আল্লাহ তায়ালা যদি নশ্বর বস্তুর মাঝে প্রবেশ করেন, তাহলে দেহবাদীদের (মুজাসসিমা) বক্তব‍্য সঠিক হতো (অথচ তাদের এই বক্তব‍্য কুফুরী)। সুতরাং অবিনশ্বর সত্ত্বা কোন সৃষ্টির মাঝে প্রবেশ করেন না, তার সত্ত্বাও কোন নশ্বর বস্তু সৃষ্টির অনুপ্রবেশ ঘটে না।

আল-ইয়াকিত ওয়াল জাওয়াহির, খ.১, পৃ.৮০-৮১

وهذا يدلك على أن العالم ما هو عين الحق، ولا حل فيه الحق، إِذ لو كان عينَ الحق، أو حلَّ فيه لما كان تعالى قديماً ولا بديعاً

অর্থ: আলোচনাটি তোমাকে  নিশ্চিত প্রমাণ দিবে যে, সৃষ্টি বা মহাবিশ্ব কখনও হুবহু আল্লাহর সত্ত্বা নয়; সৃষ্টির মাঝেও আল্লাহ প্রবেশ করেন না।  আল্লাহ তায়ালা ও মহাবিশ্ব যদি একই হতো অথবা বিশ্বের মাঝে আল্লাহ যদি প্রবেশ করতেন, তাহলে আল্লাহ তায়ালা কখনও অবিনশ্বর ও অতুলনীয় স্রষ্টা হতেন না। 

আল-ইয়াকিত ওয়াল জাওয়াহির, খ.১, পৃ.৮০-৮১

শাইখে আকবার বলেন,

لو صحَّ أن يرقى الإِنسان عن إِنسانيته، والمَلكُ عن ملكيته، ويتحد بخالقه تعالى، لصحَّ انقلاب الحقائق، وخرج الإِله عن كونه إِلهاً، وصار الحق خلقاً، والخلق حقاً، وما وثق أحد بعلم، وصار المحال واجباً، فلا سبيل إِلى قلب الحقائق أبداً

অর্থ: মানুষ তার মানবীয় গুণ থেকে মুক্ত হয়ে এবং ফেরেশতা তার ফেরেশতাসুলভ সত্ত্বাগত বৈশিষ্ট‍্য থেকে মুক্ত হয়ে যদি আল্লাহর সত্ত্বার সাথে মিশে যাওয়ার কথা সঠিক হতো, তাহলে বস্তুর মৌল উপাদানে পরিবতর্নের ধারণা সঠিক হতো। ফলে আল্লাহ তায়ালা স্রষ্টার বৈশিষ্ট‍্য থেকে বের হয়ে যেতেন। স্রষ্টা তখন সৃষ্টিতে পরিণত হতো। সৃষ্টি হয়ে যেত স্রষ্টা। কাউকে তার মূল পরিচয়ে সনাক্ত করা সম্ভব হতো না। অসম্ভব বিষয় আবশ‍্যকীয় হয়ে যেতো। সুতরাং এভাবে কলবে হাকাইক বা বস্তুর মৌল উপাদানে পরিবতর্নের ধারণা কখনও সঠিক হতে পারে না। 

আল-ইয়াকিত ওয়াল জাওয়াহির, খ.১, পৃ.৮০-৮১

শাইখে আকবার মুহিউদ্দীন ইবনে আরাবী বলেন,

إذ يستحيل تبدّل الحقائق؛ فالعبد عبد، والرب رب، والحق حق، والخلق خلق

সুতরাং মৌল উপাদানে পরিবতর্নের ধারণাটি অবাস্তব ও অসম্ভব। সুতরাং বান্দা অবশ‍্যই বান্দা। স্রষ্টা অবশ‍্যই স্রষ্টা। আল্লাহ তায়ালা সদা-সবর্দাই আল্লাহ। একইভাবে সৃষ্টিও সবর্দা সৃষ্টি। 

[আল-ফুতুহাতুল মক্কিয়া, খ.২, পৃ.৩৭১]

তিনি আরও বলেন,

فلا يجتمع الخلق والحق أبداً في وجه من الوجوه، فالعبدُ عبدٌ لنفسه، والربُّ ربٌّ لنفسه، فالعبودية لا تصح إلا لمن يعرفها فيعلم أنه ليس فيها من الربوبية شيء، والربوبية لا تصح إلا لمن يعرفها فيعرف أنه ليس فيها من العبودية 

شيء.

অর্থকোনভাবেইস্রষ্টাওসৃষ্টিকখনওএকহতেপারেনা।বান্দামৌলিকভাবেইসেবান্দা।স্রষ্টামৌলিকভাবেইস্রষ্টা।বান্দা নিজের অবস্থান সম্পর্কে অবগত থাকা জরুরি। বান্দা এব‍্যাপারে নিশ্চিত থাকা আবশ‍্যক যে, তার মাঝে স্রষ্টার কোন গুণ নেই। একইভাবে স্রষ্টা ও রব তার অবস্থান সম্পর্কে অবগত। এটিও সুনিশ্চিত যে, স্রষ্টার মাঝে বান্দা বা সৃষ্ট হওয়ার কোন গুণ নেই। 

[আল-ফুতুহাতুল মক্কিয়া, খ.৩, পৃ.৩৭৮]

শাইখেআকবারবলেন,

“ومن قال بالحلول فهو معلول”.

অর্থযেব্যক্তি সৃষ্টির মাঝে আল্লাহর প্রবেশের ধারণা রাখে, সে অবশ‍্যই অভিযুক্ত ও জ্বরাগ্রস্ত”

[আল-ফুতুহাতুল মক্কিয়া, খ.৪, পৃ.৩৭৯]

তিনি বলেন,

“والحق تعالى منزّه الذات عن الحلول في الذوات”

অর্থ– মহানআল্লাহর সত্ত্বা নশ্বর সৃষ্টির মাঝে প্রবেশ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র। 

[আল-ফুতুহাতুল মক্কিয়া, খ.৩, পৃ.৫২, আরও দেখুন, খ.২, পৃ.৬১৪]

মনসুর হাল্লাজের আকিদা-বিশ্বাস :

 আশরাফ আলী থানবী রহ. মনসুর হাল্লাজের আকিদা-বিশ্বাস ও তার জীবনী সম্পর্কে প্রচলিত অনেক মিথ্যা ও বানোয়াট বর্ণনার চুল-চেরা বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি এই  কিতাবের নাম দিয়েছেন, আল-কাউলুল মানসুর ফি ইবনিল মানসুর। 

এই কিতাবে থানবী রহ. স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন, আমাদের আকিদা-বিশ্বাস হুলুল ও ইত্তেহাদ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। তিনি এই কিতাবে একটা পুস্তিকার শিরোনাম দিয়েছেন, ত্বরিকুস সাদাদ ফি ইসবাতিল ওয়াহদাতি ও নাফইল ইত্তেহাদ অর্থাৎ ওয়াহদাতুল উজুদ ও স্রষ্টা ও সৃষ্টি এক নয়, এ বিষয়ে সঠিক পথ”

আশরাফ আলী থানবী রহ. লিখেছেন,

 “মনসুর হাল্লাজের তাউহীদ বিষয়ক আকিদা:

অনেকেই মনসুর হাল্লাজের এমন কিছু কথার কারণে ধোকায় নিপতিত হয়েছে, যা তার ভ্রমগ্রস্ত অবস্থা বা অধিক মহব্বতের অবস্থায় প্রকাশিত হয়েছে। তার সেসব কথার দিকে ভ্রুক্ষেপ করা হয়নি যেগুলো সে তার সুস্পষ্ট আকিদা বর্ণনার জন্য বলেছে। ইবনে মানসুরের বক্তব্য সংকলন অধ্যায়ে আমরা সর্ব প্রথম মনসুর হাল্লাজের এধরনের সুস্পষ্ট তাউহীদ বিষয়ক বক্তব্য উল্লেখ করেছি। সেসব বক্তব্য  থেকে দিবালোকের ন্যায় স্পস্ট যে, মনসুর হাল্লাজ পরিপূর্ণ তাউহীদে বিশ্বাসী এবং তাউহীদের বিষয়ে একজন গবেষক ছিলেন। মনসুর হাল্লাজ স্পষ্ট বলেছেন,

[আরবীর অনুবাদ] ” আল্লাহ তায়ালা ক্বাদীম বা অনাদির গুণের মাধ্যমে সমস্ত সৃষ্টি থেকে পৃথক হয়েছেন, তেমনি সমস্ত সৃষ্টি নশ্বর গুণের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা থেকে পৃথক হয়েছে ” 

 

এখানে তিনি দ্ব্যর্থহীন  ভাষায় বলেছেন যে, আল্লাহ তায়ালা মাখলুকের সাথে ইত্তেহাদ বা একীভূত নন, তেমনি তিনি সৃষ্টির মাঝেও প্রবেশ করেন না। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা হুলুল ও ইত্তেহাদ থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। 

এরপর মনসুর হাল্লাজ বলেন,

[আরবীর অনুবাদ] ” আল্লাহর পরিচয় লাভ করা হলো তাউহীদ। আর আল্লাহর তাউহীদ হলো আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টি থেকে পৃথক বিশ্বাস করা। “

 

সুতরাং যারা সূফীদেরকে অথবা তাদের মধ্যে মনসুর হাল্লাজ সম্পর্কে এই বলে দুর্নাম করার চেষ্টা করে যে, তারা স্রষ্টা ও সৃষ্টিকে এক কিংবা স্রস্টা সৃষ্টির মাঝে প্রবেশ করেছেন এধরনের আকিদার রাখে; এটি তাদের উপর সুষ্পষ্ট মিথ্যা অপবাদ “

[সিরাতে মনসুর হাল্লাজ, পৃ.২২]

আশরাফ আলী থানবী রহ. এর বক্তব্য থেকে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো, দেওবন্দী আলেমরা হুলুল ও ইত্তেহাদ তথা স্রষ্টা ও সৃষ্টি এক, এধরনের আকিদা কোন আকিদা কখনও রাখে না।  

মূল বইয়ের ডাউনলোড লিংক:https://ia600800.us.archive.org/24/items/Seerat-e-MansoorHallajShaykhZafarAhmadUsmanir.a/Seerat-e-MansoorHallajShaykhZafarAhmadUsmanir.a.pdf

মনসুর.jpg

মনসুর২.jpg

মনসুর৩.jpg

 

 

------ ------

লেখকের আরো ব্লগ

আক্বিদা

ইলমের সফর অব্যাহত থাকুক

ইজহারুল ইসলাম শনি, 23 নভে., 2024

খতীব বাগদাদী রহ. তার ‘আল-জামে লি-আখলাকির রাবি ও আদাবিস সামে’ কিতাবে ইমাম আবু ইউসুফ রহ. থেকে একটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন।
الْعِلْمُ شَيْءٌ لا يُعْطِيكَ بَعْضَهُ حَتَّى تُعْطِيَهُ كُلَّكَ
অর্থ: ইলম এমন একটি জিনিস, সে তোমাকে তার কিছু অংশও দিবে না যতক্ষণ না তুমি নিজেকে পূর্ণভাবে তার কাছে সমর্পণ না করবে।

অন্যান্য সৃষ্টি থেকে মানুষের শ্রেষ্ঠত্যের একটি বিশেষ দিক হলো ইলম অর্জনের ক্ষমতা। এটি মানুষের জন্য আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।

ইলমের জন্য যে…

বাকি অংশ পড়তে সাবস্ক্রাইব করুন
আক্বিদা

ইবনে তাইমিয়া রহ. এর কারামত

ইজহারুল ইসলাম শনি, 23 নভে., 2024

ইবনে তাইমিয়া রহ. এর জীবনী আলোচনা করেছেন তার বিশিষ্ট ছাত্র ইবনুল কাইয়্যিম রহ। তার পৃথক জীবনী লিখেছেন ইবনে তাইমিয়া রহ. এর বিশিষ্ট দুই ছাত্র। একজন হলেন, হাফেজ আবু হাফস উমর ইবনে আলি আল-বাযযার (মৃত:৭৪৯ হি:) তিনি আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া লিখেছেন। ইবনে তাইমিয়া রহ. আরেক ছাত্র ইবনে আব্দুল হাদী রহ. (মৃত: ৭৪৪ হি:) আরেকটি জীবনী লিখেছেন। তার লিখিত জীবনীর নাম আল-উকুদুল দুররিয়া মিন মানাকিবি শাইখিল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া।

আমি এখানে ইবনে তাইমিয়া রহ. এর বিশিষ্ট ছাত্রদের বর্ণনায় তার কিছু উল্লেখযোগ্য কারামত উল্লেখ করছি।

কারামত-১:

লওহে মাহফুজ দেখে বিজয়ের সংবাদ:

গায়েবসম্পর্কেইবনেতাইমিয়ারহএরকারামত:

আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) “মাদারিজুস সালিকিন শরহু মানাযিলিস সাঈরিন” নামক কিতাবে আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) এর কারামতের কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) লিখেছেন-

أخبر الناس والأمراء سنة اثنتين وسبعمائة لما تحرك التتار وقصدوا الشام : أن الدائرة والهزيمة عليهم وأن الظفر والنصر للمسلمين وأقسم على ذلك أكثر من سبعين يمينا فيقال له : قل إن شاء الله فيقول : إن شاء الله تحقيقا لا تعليقا  وسمعته يقول ذلك قال : فلما أكثروا علي قلت : لا تكثروا كتب الله تعالى في اللوح المحفوظ : أنهم مهزومون في هذه الكرة وأن النصر لجيوش الإسلام

“তাতারীরা যখন মুসলিম উম্মাহের বিভিন্ন অঞ্চলে সেনা অভিযান পরিচালনা করে এবং শামে আক্রমণের উদ্যোাগ গ্রহণ করে তখন ৭০২ হিঃ সনে শায়েখ (রহঃ) সাধারণ মানুষ এবং আমীর-উমারাদেরকে সংবাদ দিলেন যে, “তাতারীরা পরাজিত হবে এবং মুসলমানরা বিজয় ও সাহায্য লাভ করবে।”। তিনি তাঁর কথার উপর সত্তরটিরও বেশি কসম খেয়েছেন। তাঁকে বলা হল, আপনি ইনশাআল্লাহ বলুন! অতঃপর তিনি বলেন, নিশ্চিতভাবে ইনশাআল্লাহ বলছি, সম্ভাবনা হিসেবে নয়। আমি তাঁকে বলতে শুনেছি, যখন তারা আমার উপর পীড়াপীড়ি করল, আমি তাদেরকে বললাম, তোমরা পীড়াপীড়ি কর না, আল্লাহ তায়ালা লউহে মাহফুজে লিখে রেখেছেন যে, তারা পরাজিত হবে এবং মুসলমানরা বিজয়ী হবে।

[মাদারিজুস সালিকিন, খ–২, পৃষ্ঠা-৪৮৯]

আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) আরও অনেক কারামতের কথা উল্লেখ করেছেন, ইবনে আব্দুল হাদী মুকাদ্দেসী (রহঃ) এবং আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ)। বিস্তারিত জানার জন্য আগ্রহী পাঠক, মাদারিজুস সালিকীন ও আ’লামুল আলিয়্যা গ্রন্থদ্বয় দেখতে পারেন।

¬

কারামত-২: ইবনে তাইমিয়া রহ. এর ভবিষ্যৎবাণী:

আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) এর বিশেষ ছাত্র আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) লিখেছেন-

وأخبرني غير مرة بأمور باطنة تختص بي مما عزمت عليه ولم ينطق به لساني وأخبرني ببعض حوادث كبار تجري في المستقبل ولم يعين أوقاتها وقد رأيت بعضها وأنا أنتظر بقيتها وما شاهده كبار أصحابه من ذلك أضعاف أضعاف ما شاهدته والله أعلم

“তিনি আমাকে অনেকবার অনেক বাতেনি বিষয়ের সংবাদ দিয়েছেন। তিনি শুধু আমাকে এগুলো বলেছেন এবং এ বিষয় সম্পর্কে আমি কাউকে কিছু বলি নি। তিনি আমাকে ভবিষ্যতের অনেক ঘটনার সংবাদ দিয়েছেন কিন্তু তিনি সময় নির্দিষ্ট করে দেননি। তাঁর ভবিষ্যৎ বাণীর কিছু কিছু আমি ঘটতে দেখেছি এবং অবশিষ্টগুলো সংঘটিত হওয়ার অপেক্ষায় আছি। তাঁর বড় বড় সাগরেদগণ আমি যা দেখেছি, তার চেয়ে বহু বহু গুণ বেশি দেখেছেন”

[মাদারিজুস সালিকিন, খ–২, পৃষ্ঠা-৪৯০]

কারামত-৩: অন্তরের বিষয় সম্পর্কে অবগত হওয়া:

ইবনে তাইমিয়া রহ. এর ছাত্র আবু হাফস উমর আল-বাযযার বলেন,

أنه جرى بيني وبين بعض الفضلاء منازعة في عدة مسائل وطال كلامنا فيها وجعلنا نقطع الكلام في كل مسألة بأن نرجع إلى الشيخ وما يرجحه من القول فيها

ثم أن الشيخ رضي الله عنه حضر فلما هممنا بسؤاله عن ذلك سبقنا هو وشرع يذكر لنا مسألة مسألة كما كنا فيه وجعل يذكر غالب ما أوردناه في كل مسأله ويذكر أقوال العلماء ثم يرجح منها ما يرجحه الدليل حتى أتى على آخر ما أردنا أن نسأله عنه وبين لنا ما قصدنا أن نستعلمه منه فبقيت أنا وصاحبي ومن حضرنا أولا مبهوتين متعجبين مما كاشفنا به وأظهره الله عليه مما كان في خواطرنا.”

অর্থাৎ আমার সাথে একজন সম্মানিত আলেমের কয়েকটি মাসআলা নিয়ে বিতর্ক হলো। এ বিষয়ে আমাদের আলোচনা অনেক দীঘর্ হলো। প্রত্যেক মাসআলায় আমরা এভাবে কথা শেষ করলাম যে, মাসআলার সমাধান ইবনে তাইমিয়া রহ. এর কাছ থেকে জেনে নিবো।

এরপর শায়খ রহ. আমাদের নিকট উপস্থিত হলেন। আমরা যখন মাসআলাগুলো সম্পর্কে শায়খকে জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছা করলাম তিনি আমাদের জিজ্ঞাসার পূর্বেই আলোচনা শুরু করলেন। তিনি আমাদের আলোচনা অনুযায়ী একের পর এক মাসআলার সমাধান বলতেছিলেন। প্রত্যেক মাসআলায় আমাদের কাঙ্খিত উত্তর প্রদান করছিলেন। এভাবে তিনি প্রত্যেকটি মাসআলায় উলামায়ে কেরামের বক্তব্য এবং দলিল অনুযায়ী প্রাধান্য পাওয়া মাসআলাটি উল্লেখ করছিলেন। অবশেষে তিনি আমাদের আলোচিত সর্বশেষ মাসআলাটির সমাধান প্রদান করলেন। আমাদের অন্তরের বিষয়গুলো আল্লাহ তায়ালা এভাবে সুস্পষ্ট করে প্রকাশ করায় উপস্থিত লোকজন, আমার সঙ্গী ও আমি আশ্চর্যন্বিত ও বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৩, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

নিচের স্ক্রিনশট দেখুন,

এছাড়া আবু হাফস আল-বাযযার অন্তরের বিষয়ে ইবনে তাইমিয়া রহ. এর অবগত হওয়া সম্পর্কে আরও বলেন,

و كنت في خلال الأيام التي صحبته فيها إذا بحث مسألة يحضر لي إيراد فما يستتم خاطري به حتي يشرع فيرده و يذكر الجواب من عدة وجوه

অর্থাৎ আমি যখন যেসময়ে তার সংস্পর্শে ছিলাম, তখন আমার মনে কোন বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ার সঙ্গে তিনি এর জওয়াব দিতে শুরু করতেন এবং কয়েকভাবে এর উত্তর প্রদান করতেন।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৩, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কারামত-৪: অন্যের সাহায্য

“وحدثني الشيخ الصالح المقريء أحمد بن الحريمي أنه سافر إلى دمشق قال فاتفق أنى لما قدمتها لم يكن معي شئ من النفقة البتة وأنا لا اعرف أحدا من أهلها فجعلت أمشي في زقاق منها كالحائر فإذا بشيخ قد أقبل نحوي مسرعا فسلم وهش في وجهي ووضع في يدي صرة فيها دراهم صالحة وقال لي انفق هذه الآن وخلي خاطرك مما أنت فيه فإن الله لا يضيعك ثم رد على أثره كأنه ما جاء إلا من أجلي فدعوت له وفرحت بذلك، وقلت لبعض من رأيته من الناس من هذا الشيخ؟ فقال وكأنك لا تعرفه هذا ابن تيمية

আমার নিকট শায়খ সালেহ আল –মুকরী বর্ণনা করেন, তিনি  দামেশকের উদ্দেশে সফর করেন। তিনি বলেন, ঘটনাক্রমে ঐ সফরে আমার সঙ্গে কোন চলার মতো কোন খাবার বা অর্থ ছিলো না। আমি ওখানকার কাউকে চিনতাম না। এ অবস্থায় আমি উদভ্রান্তের মতো  দামেশকের অলি-গলিতে ঘুরছিলাম। হঠাৎ একজন শায়খ আমার দিকে দ্রুত গতিতে হেঁটে এলেন। তিনি হাস্যোজ্জল মুখে সালাম দিলেন। তিনি আমার হাতে একটা থলি দিলেন যাতে কিছু খাটি দিরহাম ছিলো। এরপর বললেন, “ এগুলো ব্যবহার করো। তোমার অন্তরে যেই পেরেশানী আছে এগুলো ঝেড়ে ফেলো।  আল্লাহ তায়ালা তোমাকে ধ্বংস করবেন না।” একথা বলে তিনি একই পথে ফিরে গেলেন। তিনি যেন শুধু আমার কাছেই এসেছিলেন। আমি তার জন্য দুয়া করলাম এবং এতে আনন্দি হলাম। আমি অন্যান্য মানুষকে জিজ্ঞেস করলাম, এই শায়খ কে? তারা বললো, তুমি মনে হয় শায়খকে চেনো না, তিনি হলেন ইবনে তাইমিয়া।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৪, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কারামত-৫:

وحدثني الشيخ العالم المقريء تقي الدين عبد الله ابن الشيخ الصالح المقريء احمد بن سعيد قال سافرت إلى مصر حين كان الشيخ مقيما بها فاتفق أني قدمتها ليلا وأنا مثقل مريض فأنزلت في بعض الأمكنة فلم ألبث أن سمعت من ينادي باسمي وكنيتي فأجبته وأنا ضعيف فدخل إلي جماعة من أصحاب الشيخ ممن كنت قد اجتمعت ببعضهم في دمشق فقلت كيف عرفتم بقدومي وأنا قدمت هذه الساعة فذكروا أن الشيخ أخبرنا بأنك قدمت وأنت مريض وأمرنا أن نسرع بنقلك وما رأينا أحدا جاء ولا أخبرنا بشيء، فعلمت أن ذلك من كرامات الشيخ رضي الله عنه.”

শায়খ সালেহ আল-মুকরী এর ছেলে শায়খ তাকিউদ্দীন আব্দুল্লাহ আল-মুকরী আমাকে বলেছেন, শায়খ ইবনে তাইমিয়া রহ. যখন মিশরে ছিলেন তখন আমি মিশরে সফর করি। আমি রাতে মিশরে গিয়ে উপস্থিত হলাম। তখন আমার কাছে ভারী বোঝা ছিল আর আমি অসুস্থ ছিলাম। আমি এক জায়গায় গিয়ে বাহন থেকে নামলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে শুনতে পেলাম এক ব্যক্তি আমার নাম ও উপনাম ধরে ডাকছে। আমি দুর্বল শরীরে তার ডাকে সাড়া দিলাম। তখন শায়খ ইবনে তাইমিয়ার একদল ছাত্র আমার নিকট এলো। তাদের সাথে আমি পূর্বে দামেশকে সাক্ষাৎ করেছিলাম। আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা আমার আগমন সম্পর্কে কীভাবে জানলে; অথচ আমি মাত্র এলাম? তারা বলল, শায়খ ইবনে তাইমিয়া তাদেরকে বলেছে যে, আপনি এসেছেন এবং আপনার শরীর অসুস্থ। আমাদেরকে দ্রুত আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন। আমরা কাউকে আসতেও দেখিনি এবং আপনার সম্পর্কে কেউ পূর্বে সংবাদও দেয়নি। আমি তখন বুঝলাম এটি শায়খের কারামত।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৪, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কারামত-৬:                                  

“وحدثني أيضا قال مرضت بدمشق إذ كنت فيها مرضة شديدة منعتني حتى من الجلوس فلم اشعر إلا والشيخ عند رأسي وأنا مثقل مشتد بالحمى والمرض فدعا لي وقال جاءت العافية، فما هو إلا أن فارقني وجاءت العافية وشفيت من وقتي”

শায়খ সালেহ আল-মুকরী এর ছেলে শায়খ তাকিউদ্দীন আব্দুল্লাহ আল-মুকরী আরও বলেন, আমি দামেশকে কঠিন রোগে আক্রান্ত হলাম। এমনকি আমি বসতেও পারতাম না। হঠাৎ আমার মাথার নিকট শায়খকে দেখতে পেলাম।তখন আমি মারাত্মক জ্বর ও রোগে আক্রান্ত ছিলাম।তিনি আমার জন্য দুয়া করলেন এবং বললেন, সুস্থতা চলে এসেছে।তিনি আমার কাছ থেকে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি সুস্থ হয়ে গেলাম।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৫, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কারামত-৭:

“وحدثني أيضا قال أخبرني الشيخ ابن عماد الدين المقرئ المطرز قال قدمت على الشيخ ومعي حينئذ نفقة فسلمت عليه فرد علي ورحب بي وأدناني ولم يسألني هل معك نفقة أم لا، فلما كان بعد أيام ونفدت نفقتي أردت أن اخرج من مجلسه بعد أن صليت مع الناس وراءه فمنعني وأجلسني دونهم فلما خلا المجلس دفع إلي جملة دراهم وقال أنت الآن بغير نفقة فارتفق بهذه فعجبت من ذلك وعلمت أن الله كشفه على حالي أولا لما كان معي نفقة وآخرا لما نفدت واحتجت إلى نفقة.”

আমার নিকট তিনি আরও বর্ণনা করেছেন, আমার নিকট শায়খ ইবনে ইমাদুদ্দিন আল-মুকরী আল-মুতাররায বর্ণনা করেন, তিনি বলেন আমি একবার শায়খের নিকট আগমন করলাম। তখন আমার কাছে খরচের টাকা-পয়সা ছিলো। আমি তাকে সালাম দিলাম, তিনি উত্তর দিলেন এবং আমাকে স্বাগত জানালেন। আমাকে তিনি তার নিকটে বসালেন। এবার তিনি আমার জীবিকা নির্বাহের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন না। কিছুদিন পর আমার খরচের উপকরণ শেষ হয়ে গেল। তখন আমি তার পিছে নামায আদায় করে তার মজলিশ থেকে বের হতে উদ্যত হলাম। তিনি আমাকে বাধা দিয়ে বসতে বললেন। এরপর যখন মজলিশ শেষ হলো, তখন তিনি আমাকে কিছু দিরহাম দিয়ে বললেন, এখন তোমার কোন খরচের টাকা-পয়সা নেই। এগুলো ব্যবহার করতে থাকে। এ ঘটনায় আমি বিস্মিত হলাম। বুঝলাম যে আল্লাহ তায়ালা আমার পূর্বের ও বর্তমান অবস্থা শায়খের নিকট প্রকাশ করে দিয়েছেন।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৬, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কারামত-৮: মৃত সম্পর্কে সংবাদ:

“وحدثني من لا أتهمه أن الشيخ رضي الله عنه حين نزل المغل بالشام لأخذ دمشق وغيرها رجف أهلها وخافوا خوفا شديدا، وجاء إليه جماعة منهم وسألوه الدعاء للمسلمين فتوجه إلى الله ثم قال أبشروا فإن الله يأتيكم بالنصر في اليوم الفلاني بعد ثالثة حتى ترون الرؤوس معبأة بعضها فوق بعض.قال الذي حدثني فوالذي نفسي بيده أو كما حلف ما مضى إلا ثلاث مثل قوله حتى رأينا رؤوسهم كما قال الشيخ على ظاهر دمشق معبأة بعضها فوق بعض.”

আমার নিকট বিশ্বস্ত এক ব্যক্তি বর্ণনা করেছেন, যখন মোগলরা দামেশক ও অন্যান্য অন্চল দখলের জন্য শামে আক্রমণ করলো, দামেশকের অধিবাসীরা খুবই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। এসময় একদল মুসলমান শায়খ ইবনে তাইমিয়া রহ. এর নিকট আগমন করলেন এবং তাকে মুসলমানদের জন্য দুয়া করার অনুরোধ করলেন। তিনি আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করলেন। এরপর বললেন, তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ করো, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা  তিন দিন পর তোমাদেরকে সাহায্য করবেন, এমনকি তোমরা দেখবে যে একটার উপর আরেকটা মাথা স্তুপ হয়ে থাকবে। ঘটনার বর্ণনাকারী বলেন, আল্লাহর শপথ, তৃতীয় দিন দামেশকের প্রবেশ মুখে শত্রুদের মাথাগুলো একটার উপর আরেকটা স্তুপ হয়েছিলো যেমন শায়খ বলেছিলেন।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৬, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কারামত-৯:

“وحدثني الشيخ الصالح الورع عثمان بن احمد بن عيسى النساج أن الشيخ رضي الله عنه كان يعود المرضى بالبيمارستان بدمشق في كل أسبوع فجاء على عادته فعادهم فوصل إلى شاب منهم فدعا له فشفي سريعا وجاء إلى الشيخ يقصد السلام عليه فلما رآه هش له وأدناه ثم دفع إليه نفقة وقال قد شفاك الله فعاهد الله أن تعجل الرجوع إلى بلدك أيجوز أن تترك زوجتك وبناتك أربعا ضيعة وتقيم هاهنا؟ فقبل يده وقال يا سيدي أنا تائب إلى الله على يدك وقال الفتى وعجبت مما كاشفني به وكنت قد تركتهم بلا نفقة ولم يكن قد عرف بحالي أحد من أهل دمشق.”

শায়খ উসমান ইবনে আহমাদ ইবনে ইসা আন-নাসসাজ আমার নিকট বর্ণনা করেছেন, শায়খ ইবনে তাইমিয়া রহ. দামেশকের বিমারিস্তান নামক জায়গায় প্রত্যেক সপ্তাহে রোগীদের দেখতে আসতেন। অভ্যাস অনুযায়ী তিনি রোগী দেখতে এলেন। তাদের মধ্যে এক যুবককে তিনি দেখলেন এবং তার জন্য দুয়া করলেন। সে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠল। যুবকটি শায়খকে সালাম দেয়ার জন্য এলো। তাকে দেখে শায়খ হাসিমুখে নিকটে বসালেন। তার কাছে কিছু খরচের টাকা-পয়সা দিলেন এবং বলেন, আল্লাহ তায়ালা তোমাকে সুস্থ করেছেন। সুতরাং তুমি আল্লাহর কাছে ওয়াদা করো যে তুমি দ্রুত পরিবারের কাছে ফিরে যাবে। তোমার জন্য কখনও বৈধ হবে যে তোমার স্ত্রী ও চার কন্যাকে ধ্বংসের মুখে রেখে এখানে অবস্থান করবে? যুবকটি বলল, আমি তার হাতে চুমু দিলাম এবং বললাম, শায়খ, আমি আল্লাহর নিকট আপনার হাতে তওবা করছি।

আমি তার কাশফ দেখে বিস্মিত হলাম। বাস্তবেই আমি আমার পরিবারকে সহায়-সম্বলহীন রেখে এসেছিলাম।দামেশকের কেউ আামার পরিবার সম্পর্কে অবগত ছিলো না।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৬, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

এই কারামতগুলো লিখে আবু হাফস আল-বাযযার রহ. লিখেছেন,

و كرامات الشيخ رضي الله عنه  كثيرة جدا لا يليق بهذا المختصر أكثر من ذكر هذا القدر منها . ومن أظهر كراماته أنه ما سمع بأحد عاداه أو غض عنه إلا و أبتلي بعدة بلايا غالبها في دينه وهذا ظاهر مشهور لا يحتاج فيه إلي شرح صفته

শায়খ রহ. অনেক কারামত রয়েছে। এই সংক্ষিপ্ত বইয়ে সেগুলো উল্লেখ করা সঙ্গত নয়। তার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ করামত হলো যে কেউ শায়খের বিরোধীতা করেছে বা তার সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক রয়েছে, সে বিভিন্ন ধরনের বালা-মুসীবতে নিপতিত হয়েছে। বেশিরভাগ মুসীবত দীন সম্পর্কীয়। বিষয়গুলো স্পষ্ট ও প্রকাশিত। এগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা অনাবশ্যক।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৮, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কাশফ ও ইলহাম সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া রহ. এর অনেক কারামত রয়েছে। এ বিষয়ে তার অনেক বক্তব্যও আছে। এগুলোর কিছু কিছু ইবনে তাইমিয়া রহ. এর দৃষ্টিতে তাসাউফ বইয়ে উল্লেখ করেছি। দু:খজনক বিষয় হলো, আমাদের আজকের আলোচনার মূল বিষয় এখনও শুরু করা হয়নি। আজ এখানেই ইতি টানছি। পরবর্তী আলোচনায় গায়েব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করা হবে। 

------ ------

আক্বিদা

আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাকার ইবনে আবিল ইয রহ: হানাফী না কি হাশাবী?

ইজহারুল ইসলাম শনি, 23 নভে., 2024

[বর্তমানে  ইবনে আবিল ইযের  আকিদাতুত ত্বহাবীর  ব্যাখ্যাগ্রন্থটি ব্যাপকভাবে প্রচারের চেষ্টা করা হচ্ছে। যেমন, সালাফী আলেম আব্দুল্লাহ শাহেদ মাদানী এর বাংলা অনুবাদ করে অনলাইনে প্রচার করছেন। সুতরাং এই কিতাবের বাস্তবতা ও এর লেখক সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাগুলো সুস্পষ্ট করা আবশ্যক। আকিদাতুত ত্বহাবীর উপর দরসের নিয়ত ব্যক্ত করেছিলাম কিছু দিন আগে। উক্ত দরসের প্রয়োজনে আজকের আলোচনাটি লেখা। যারা উক্ত দরস দেখবেন, আশা করি বিষয়টি তাদের উপকারে আসবে।  ]

সৌদি আরবের কল্যাণে কাররামিয়াদের ভ্রান্ত দেহবাদী আকিদাগুলো সালাফী মতবাদের মোড়কে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। পেট্র-ডলারের সহায়তায় তারা এক্ষেত্রে অনেকটা অগ্রসর। সালাফীদের ভ্রান্ত আকিদা সম্পর্কে বেশ কিছু প্রবন্ধ লেখার সুযোগ হয়েছে আল-হামদুলিল্লাহ। আমাদের আইডিয়ার ওয়েবসাইটে লেখাগুলো পাবেন। সালাফী মতবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে থাকে। এর মধ্যে একটি বিশেষ কৌশল হল, বিভিন্ন ইমামের আকিদার কিতাব ব্যাখ্যার নামে নিজেদের ভ্রান্ত আকিদা ছড়িয়ে দেয়া। উদাহরণ হিসেবে ইমাম ত্বহাবীর আকিদাতুত ত্বহাবীর কথা বলা যায়। একটু খোজ নিলে দেখবেন, প্রায় প্রত্যেক সালাফী শায়খই আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখেছেন, কেউ অডিও বা ভিডিও লেকচার দিয়েছেন। অন্তত বিশ-পজিশজন বা এর চেয়ে বেশি সালাফী শায়খের ব্যাখ্যা পাবেন। একটি মৌলিক প্রশ্ন হল,  এসব সালাফী আলেমরা কি ইমাম ত্বহাবীর আকিদা পোষণ করেন? ধ্রুব সত্য হল, ইমাম ত্বহাবীর আকিদার সাথে এদের আকিদার দূরতম কোন সম্পর্ক নেই। ইমাম ত্বহাবী রহ. এর আকিদার ও এদের আকিদার মাঝে আসমান-জমিনের ফারাক। আরেকটি প্রশ্ন মনে উকি দেয়, এরা যেহেতু ইমাম ত্বাহাবীর আকিদা পোষণ করে না, তাহলে এর ব্যাখ্যা করে কেন? সহজ উত্তর হল, ইমাম ত্বহাবীর আকিদা প্রচারের ছদ্মাবরণে নিজেদের ভ্রান্ত আকিদা প্রচার। এদের যে কোন একটা ব্যাখ্য পড়লেই এই বাস্তবতা উপলব্ধি করবেন। 

সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে ইমাম ত্বহাবী রহ. এর আকিদাকে বিকৃত করার লক্ষ্যে লিখিত একটি বেনামী ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৩৪৯ হিজরীতে।  বে-নামী ব্যাখ্যা এজন্য বললাম, উক্ত ব্যাখ্যার উপর লেখকের নাম ছিল না। আর প্রশাকগণ নিশ্চিত ছিলেন না যে, ব্যাখ্যাগ্রন্থটি মূলত: কার। পরবর্তীতে তারা তত্ব-তালাশ করে উদ্ধার করেন, এটি ইবনে আবিল ইয আল-হানাফীর লেখা। বর্তমানে এটি ইবনে আবিল ইযের ব্যাখ্যা হিসেবে প্রচার করা হয়। আমাদের আলোচ্য বিষয় শিরোনাম থেকে কিছুটা স্পষ্ট। তবে দু’টি বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করার চেষ্টা করব। ১. ইবনে আবিল ইযের নামে প্রচারিত আকিদা কি আসলেই ইবনে আবিল ইযের লেখা?২. ইবনে আবিল ইযকে হানাফী হিসেবে প্রচার করা হয়। তিনি কি হানাফী ছিলেন না কি দেহবাদী আকিদায় বিশ্বাসী হাশাবী ছিলেন?

প্রচলিত আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যা কি ইবনে আবিল ইযের?

বিষয়টি বোঝার জন্য ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রকাশের ইতিহাসের দিকে ফিরে যেতে হবে। আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যাগ্রন্থটি ১৩৪৯ হিজরীতে মক্কায় সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়।

এই প্রকাশনায় কিতাবের উপর লেখকের কোন নাম ছিল না। বরং প্রকাশকরা লেখেন,

 راجعنا ما في أيدينا من كتب التراجم والفنون، فلم نجد ما يمكننا معه الجزم بنسبته لشخص بعينه، وإنا نثبت هنا أسماء شارحي هذه العقيدة الذين عدهم صاحب كشف الظنون وهم سبعة ……. ومنهم صدر الدين علي بن محمد بن أبي العز الأذرعي الدمشقي الحنفي المتوفى سنة 746هـ وهو الذي يترجح الظن أنه الشارح” আমাদের কাছে বিদ্যমান বিভিন্ন জীবনীগ্রন্থ ও রিজালের কিতাবে আমরা অনুসন্ধান চালিয়েছি। আমরা এমন কোন তথ্য পাইনি, যার আলোকে সুনিশ্চিতভাবে ব্যাখ্যাগ্রন্থটিকে সুনির্দিষ্ট কোন লেখকের দিকে সম্পৃক্ত করা সম্ভব। কাশফুজ জুনুন এর লেখকের বক্তব্য অনুযায়ী আমরা এখানে আকিদাত্ব ত্বহাবীর সমস্ত ব্যাখ্যাকারের নাম উল্লেখ করছি। তারা হলেন সাতজন…….। এদের মাঝে একজন ব্যাখ্যাকার হলেন, সদরুদ্দিন আলী ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবিল ইয হানাফী (মৃত:৭৪৬ হি:)। আমাদের বিশেষ ধারণা হল, সাতজন ব্যাখ্যাকারের মাঝে তিনি হলেন আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাকার। “

এখানে প্রবল ধারণা হিসেবে সদরুদ্দিন আলী ইবনে মুহাম্মাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যার মৃত্যু তারিখ হল, ৭৪৬ হিজরী। আর বর্তমানে প্রচারিত ব্যাখ্যাকার হলেন, আলী ইবনে আলী ইবনে আবিল ইয। যার মৃত্যু তারিখ হল, ৭৯২ হিজরী। এখানে প্রবল ধারণা হিসেবে যার কথা বলা হয়েছে, তিনি হলেন বর্তমানে প্রচারিত লেখকের পিতা। ছেলে আর পিতা কখনও এক হতে পারে না। উভয়ের মৃত্যু তারিখ থেকেও বিষয়টি স্পষ্ট। মোটকথা, ব্যাখ্যাগ্রন্থটি কার সেটা সুনিশ্চিতভাবে বলার মত কোন তথ্য তখনকার উলামায়ে কেরাম পাননি। পরবর্তীতে সৌদি আরবের শায়খগণ বিখ্যাত আলেম আহমাদ শাকেরকে এটি তাহকীক করার অনুরোধ করেন। শায়খ আহমাদ শাকের পরবর্তীতে এটি তাহকীক করে প্রকাশ করেন।

তিনি এর ভূমিকায় লেখেন, ” এ কিতাবের যে মাখতুতা বা হস্তলিপি আমি পেয়েছি, সেখানে মূল লেখকের নেই। সুতরাং কিতাবের লেখক আসলে কে সেটা জানা সম্ভব হয়নি। ” 

শায়খ আহমাদ শাকের তার ভূমিকায় কয়েকবার বলেছেন যে, তিনি এই কিতাবের নির্ভরযোগ্য কোন মাখতুতা বা হস্তলিপি পাননি।

তিনি তার সাধ্য অনুযায়ী এটি তাহকীক করার চেষ্টা করেছেন। শায়খ আহমাদ শাকের আশা ব্যক্ত করেছেন, তিনি যদি নির্ভরযোগ্য কোন হস্তলিপি পান, তাহলে পরবর্তীতে এটি সংশোধনের চেষ্টা করবেন।

শায়খ আহমাদ শাকের বলেন,

 ولكني لا أزال أرى هذه الطبعة مؤقتة أيضا، حتى يوفقنا الله إلى أصل محفوظ للشرح صحيح، يكون عمدة في التصحيح فنعيد طبعه

“আমি এখনও মনে করি, এই সংস্করণ অস্থায়ী। আল্লাহ তায়ালা যদি নির্ভরযোগ্য বিশুদ্ধ কোন হস্তলিপি মিলিয়ে দেন, তাহলে এটি সংশোধন করে নতুনভাবে প্রকাশ করার করব। শায়খ আহমাদ শাকের আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. [মৃত: ১২০৫ হি:] এর একটি বক্তব্য পান ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিনে। সেখানে মোর্তজা যাবিদি রহ. ব্যাখ্যাকারের নাম লিখেছেন, আলী ইবনে আলী ইবনে মুহাম্মাদ আল-গাজ্জী আল-হানাফী। মোর্তজা যাবিদি রহ. এর উদ্ধৃতিতে লেখকের সঠিক পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি।

শায়খ আহমাদ শাকের বলেন, মোর্তজা যাবিদি রহ. লেখকের নামের নিসবতে ভুল করেছেন। তিনি লিখেছেন, আলী ইবনে আলী আল-গাজ্জী, বাস্তবে হওয়ার কথা ছিল, আলী ইবনে আলী ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী। মোটকথা, শায়খ আহমাদ শাকেরের সামনে মোর্তজা যাবিদি রহ. এর উদ্ধৃতি ছিল, বেশ কয়েকটি মাখতুতা ছিল এরপরেও ব্যাখ্যাকার সম্পর্কে সুনিশ্চিতভাবে বলেননিন যে, অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে, উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের লেখক ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী। শায়খ আহমাদ শাকের মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্যের আলোকে তার ধারণা অনুযায়ী কিতাবে লেখকের নাম লিখেছেন, আলী ইবনে আলী ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী। পরবর্তীতে মাকতাবাতুল ইসলামী থেকে শায়খ আলবানীর তাহকীকে ব্যাখ্যাগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। সেখানে কিছু মাখতুতা বা হস্তলিপি এর চিত্র দেয়া হয়েছে। এসকল হস্তলিপিতে স্পষ্টভাবে লেখকের নাম লেখা হয়েছে, আলী ইবনে মুহাম্মাদ। যার মৃত্যু তারিখ, ৭৪৬ হি:। সুতরাং মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্য অনুযায়ী, লেখকের নাম হওয়ার কথা ছিল, আলী ইবনে আলী আল-গাজ্জী। মাকতাবাতুল ইসলামী এর মাখতুতা অনুযায়ী, লেখকের নাম আলী ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবিল ইয। সুতরাং একথা সুনিশ্চিতভাবে বলার অবকাশ নেই যে, উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের প্রকৃত লেখক কে। এরপরেও শায়খ আলবানী ও যুহাইর আশ-শাবীশ দাবী করেন, সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হল, উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের লেখক ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী।

শায়খ যুহাইর আশ-শাবীস নবম সংস্করণের ভূমিকায় ( পৃ.৯) লিখেছেন, 

وأما نسختنا فقد كان اسم مؤلفها مثبتا على الورقة الأولى منها، إلا أن بعض الأيدي قد لعبت فيه بالمحو والكتابة أكثر من مرة، وأخيرا أثبت عليه ما أثبته الشيخ أحمد شاكرঅর্থ: আমাদের মূল হস্তলিপিতে লেখকের নাম প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা ছিল। তবে অজ্ঞাত কেউ উক্ত নাম কয়েকবার ঘষা-মাজা করে নতুনভাবে লিখেছে। অবশেষে আমি শায়খ আহমাদ শাকেরের তথ্য অনুযায়ী লেখকের নাম উল্লেখ করেছি।মোটকথা, এই ব্যাখ্যাগ্রন্থের মূল হস্তলিপিতে লেখকের নাম উল্লেখ নেই। পরবর্তীতে বিভিন্ন ঘষা-মাজার মাধ্যমে অজ্ঞাত কেউ হস্তলিপিতে লেখকের নাম সংযুক্ত করেছে। ঘষা-মাজা করে নাম সংযুক্ত করার পরও বর্তমানে প্রচলিত লেখকের নাম উক্ত হস্তলিপিতে নেই। বরং প্রচলিত লেখকের পিতার নাম ও তার মৃত্যু তারিখ দেয়া রয়েছে।

 চূড়ান্ত কথা:

ইবনে আবিল ইয এধরণের ব্যাখ্যাগ্রন্থ লেখাটা অসম্ভব নয়। প্রবল ধারণা মতে হয়ত তিনি এটি লিখেছেন। কিন্তু ইবনে ইয এর লেখক হওয়ার ব্যাপারে অকাট্য কোন প্রমাণ কারও কাছে নেই, যার আলোকে নি:সন্দেহে বলা যাবে, এটি ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী লিখেছেন। ইবনে আবিল ইয আল-হানাফীর জীবনী থেকে একটা ধারণা সৃষ্টি হয়, হয়ত তিনি এটি লিখেছেন। আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. এর উদ্ধৃতি থেকে হয়ত ধারণাটি আরেকটু মজবুত হয়। কিন্তু এটা সুনিশ্চিত বা অকাট্য কোন প্রমাণ বলার সুযোগ নেই। উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের লেখক ইবনে আবিল ইয হলেও আমাদের কোন আপত্তি নেই। না হলেও এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই। কিতাবটি ছেলে লিখেছে না কি তার পিতা লিখেছে সেটাও মৌলিক কোন বিষয় নয়।

 আমাদের নিকট মূল বিবেচ্য বিষয় হল, ইবনে আবিল ইযকে হানাফী হিসেবে প্রচার করা হয়। সেই সাথে এটাও বোঝানো হয় যে, তিনি হানাফীদের আকিদার প্রতিনিধত্ব করেন। অন্যান্য হানাফীগণ তার বিরোধীতা করে মূলত: হানাফীদের মৌলিক আকিদার বিরোধিতা করে থাকে।

আমাদের সামনে মৌলিক কয়েকটি প্রশ্ন দেখা দিয়েছে,

১. ইবনে আবিল ইয বাস্তবেই কি হানাফী ছিলেন?

২. তিনি আদৌ কি হানাফী মাজহাবের সুপ্রতিষ্ঠিত আকিদার অনুসারী ছিলেন?৩. তার লেখা ব্যাখ্যাগ্রন্থ ইমাম ত্বহাবী বা হানাফী মাজহাবের মৌলিক আকিদার প্রতিনিধিত্ব করে কি?৪. ইবনে আবিল ইযের আকিদা হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমদের নিকট নির্ভরযোগ্য কি?

৫. ইবনে আবিল ইযকে হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণ নির্ভরযোগ্য আলেম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন কি?

৬. হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণ ইবনে আবিল ইযের আকিদার সাথে সহমত পোষণ করেন না কি তার প্রবল বিরোধীতা করেন?

৭. হানাফী মাজহাবের উলামায়ে কেরামের জীবনীর উপর বিভিন্ন গ্রন্থ লেখা হয়েছে। এসকল কিতাবে হানাফী আলেম হিসেবে তার জীবনী বা নির্ভরযোগ্য আলেম হিসেবে কোথাও  তস্বীকৃতি দেয়া হয়েছে কি?আমরা ইনশাআল্লাহ প্রত্যেকটি বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করব। 

ইবনে আবিল ইযের মাজহাব:

শরহে আকিদাতু ত্বহাবীর তাহকীক করেছেন, শায়খ শুয়াইব আরনাউত ও শায়খ আব্দুল্লাহ তুরকী। তারা উক্ত তাহকীকে ইবনে আবিল ইযের জীবনী আলোচনা করেছেন। তার জীবনী আলোচনা করতে গিয়ে তারা লিখেছেন, ইবনে আবিল ইযকে হানাফী মাজহাবের দিকে সম্পৃক্ত করা হয়। তবে বাস্তবে তিনি নিজের গর্দানকে তাকলীদের (মাজহাব অনুসরণ) বন্ধন থেকে মুক্ত করেন।  শায়খ শুয়াইব আরনাউত ও শায়খ আব্দুল্লাহ তুরকীর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ইবনে আবিল ইয একজন গাইরে মুকাল্লিদ, লা-মাজহাবী বা যাহেরী ছিল। 

ইবনে আবিল ইয পারিবারিকভাবে হানাফী ছিল। যেমন শায়খ আলবানী পারিবারিকভাবে হানাফী ছিল। কিন্তু কেউ হানাফী পরিবারে জন্মগ্রহণ করলে, কিংবা হানাফী মাদ্রাসায় পড়লে বা পড়ালে সে হানাফী হয়ে যায় না। আমাদের দেশের অধিকাংশ লা-মাজহাবী হানাফী পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও তারা গাইরে মুকাল্লিদ। একইভাবে বর্তমানে আহলে হাদীসদের অধিকাংশ শায়খ হানাফী মাজহাবের মাদ্রাসায় পড়া-লেখা করেছে, কিন্তু তারা হানাফী নয়। সুতরাং কারও হানাফী হওয়াটা তার পরিবার, পিতা-মাতা বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করে না। ইবনে আবিল ইয জন্মগতভাবে হানাফী হলেও বাস্তবে সে হানাফী নয়। বরং  ইবনে আবিল ইয একজন গাইরে মুকাল্লিদ বা লা-মাজহাবী।সুতরাং তাকে হানাফী হিসেবে প্রচার করে তাকে হানাফী মাজহাব বা আকিদার প্রতিনিধি হিসেবে প্রকাশ করা একটি মারাত্মক ভুল। 

যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেই যে, ইবনে আবিল ইয হানাফী ফিকহের অনুসারী ছিল, কারণ সে হানাফী মাজহাবের মাদ্রাসায় শিক্ষতা করেছে, তাহলে এটি কখনও বলা সম্ভব নয় যে, সে আকিদার দিক থেকেও হানাফী ছিলা। মু’তাজিলা সম্প্রদায়ের অনেকেই হানাফী মাজহাবের অনুসারী ছিল, কিন্তু তাদের কাউকে হানাফী বলা হয় না। একইভাবে কাররামিয়াদের অনেকেই হানাফী মাজহাব অনুসরণ করত। কিন্তু তাদেরকেও হানাফী বলা হয় না। ফিকহের দিক থেকে কেউ হানাফী ফিকহ অনুসরণ করলেই তাকে হানাফী হিসেবে পরিচয় দেয়া হয় না। কারণ হানাফী হিসেবে কারও পরিচিতি এটা প্রমাণ করে যে, সে আকিদা ও ফিকহ উভয় ক্ষেত্রে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অন্তর্ভূক্ত। কেউ যদি ফিকহের ক্ষেত্রে হানাফী মাজহাব অনুসরণ করে, কিন্তু আকিদার ক্ষেত্রে আহলে সু্ন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত আকিদা পোষণ করে তাকে হানাফী বলা হয় না। বরং আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত আকিদার দিকে তাকে সম্পৃক্ত করা হয়। কাররামিয়া মতবাদের অনুসারী কারও নামের শেষে হানাফী লাগিয়ে দিয়ে আকিদা ও ফিকহে তাকে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অন্তর্ভূক্ত করার অপচেষ্টা কেউ করলে সেটি অবশ্যই বাস্তবতা বিরোধী। সুতরাং ফিকহ ও আকিদা উভয় ক্ষেত্রে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত ইবনে আবিল ইযকে কীভাবে হানাফী হিসেবে পরিচয় দেয়া হয়? তার বাহ্যিক অবস্থা বিবেচনা করে হানাফী লিখলেও তাকে যদি কেউ হানাফী ফিকহ বা আকিদার প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন করে, তাহলে অবশ্যই আমরা বলব, প্রকৃতপক্ষে ইবনে আবিল ইয ফিকহ ও আকিদা কোন ক্ষেত্রেই হানাফী ছিল না। বরং সে কাররামিয়াদের অনুসারী হাশাবী বা দেহবাদী আকিদায় বিশ্বাসী ছিল। ইবনে আবিল ইযের যেসকল কিতাব তার দিকে সম্পৃক্ত করা হয়, তার প্রত্যেকটি সে হানাফী মাজহাবের বিরুদ্ধে লিখেছে। হানাফী মাজহাবের পক্ষে তার বিশেষ কোন খেদমত নেই।

ইবনে আবিল ইযের গাইরে মুকাল্লিদ হওয়ার আরেকটি প্রমাণ হল, তার একটি কিতাব বর্তমানের আহলে লা-মাজহাবীরা প্রচার করে থাকে। আহলে হাদীস আলেম আতাউল্লাহ হানীফ ইবনে আবিল ইযের “আল-ইত্তেবা” কিতাবটি তাহকীক করে প্রকাশ করেছে। পরবর্তীতে আবু সুহাইব আসিম ইবনে আব্দুল্লাহ  আল-কারইউতী এটি তাহকীক করেছে। আবু সুহাইব এই কিতাবের ভূমিকায় হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেম আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. ও আল্লামা যফর আহমাদ উসমানী রহ. এর বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছে এবং এসমস্ত বিখ্যাত আলেমদের বিরুদ্ধে ইবনে আবিল ইযের বক্তব্য উপস্থাপন করেছে। যেখানে ইবনে আবিল ইয সুনিদিষ্ট একটি মাজহাবের অনুসারীকে শিয়াদের সাথে তুলনা করেছে। নাউযুবিল্লাহ। ইবনে আবিল ইযের অবস্থা থেকে বাংলা ভাষার প্রসিদ্ধ একটি প্রবাদবাক্য মনে পড়ে গেল।  “মার চেয়ে মাসির দরদ বেশি” ।ইবনে আবিল ইযের প্রতি সালাফী ও আহলে হাদীসদের অতিশয় আগ্রহ এটিই প্রমাণ করে।  বর্তমানের সালাফীরা হানাফী মাজহাবের উলামায়ে কেরামকে তাদের আকিদার বিরোধী হওয়ার কারণে কাফের, বিদযাতী, জাহমী, মুয়াত্তিলা ইত্যাদি আখ্যায়িত করে। এ বিষয়ে অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে।  হানাফী মাজহাবের অধিকাংশ আলেম যাদের কাছে কাফের ও বিদয়াতী, তারাই ইবনে আবিল ইযের আকিদা প্রচার করছে। আবার উপমহাদেশের লা-মাজহাবীরা মাজহাবের অনুসারীদেরকে মুশরিক বলে বিশ্বাস করে, অথচ তারাই আবার ইবনে আবিল ইযের কিতাব প্রকাশ ও প্রচার করছে। ইবনে আবিল ইয আসলেই যদি হানাফী হত, তাহলে হানাফীদেরকে যারা কাফের-মুশরিক আখ্যা দিচ্ছে, তারা কেন তার কিতাব নিয়ে এত মাতামাতি করে?

ইবনে আবিল ইয সম্পর্কে হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণের বক্তব্য:

মোল্লা আলী কারী রহ. এর বক্তব্য:

মোল্লা আলী কারী রহ. শরহে ফিকহুল আকবারে আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যাকার সম্পর্কে লিখেছেন, 

 والحاصل ان الشارح يقول بعلو المكان مع نفي التشبيه وتبع فيه طائفة من أهل البدعة

মোটকথা, আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যাকার  তাশবীহমুক্ত অবস্থায় আল্লাহ তায়ালা স্থানগতভাবে উপরের দিকে রয়েছেন বলে বিশ্বাস করে। এক্ষেত্রে সে একদল বিদয়াতীর অনুসরণ করেছে। তিনি আরও বলেন,

 و من الغريب أنه إستدل على مذهبه الباطل برفع الأيدي في الدعاء إلى السماء

 অর্থ: আশ্চর্যের বিষয় হল, সে তার ভ্রান্ত মতবাদ প্রমাণ করতে গিয়ে দুয়ার সময় হাত উপরের দিকে উঠানোর দলিল দিয়েছে। (শরহুল ফিকহিল আকবার, পৃ.১৭২. আল-ইলিময়া)মোল্লা আলী কারী রহ. এর বক্তব্য থেকে দু’টি বিষয় স্পষ্ট। তিনি ইবনে আবিল ইযকে বিদয়াতীদের অনুসারী বলেছেন। এবং তার মতবাদকে বাতিল বা ভ্রান্ত মতবাদ আখ্যায়িত করেছেন। 

আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্য:

আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিনে ইবনে আবিল ইয সম্পর্কে লিখেছেন,

“ولما تأملته حق التأمل؛ وجدته كلامًا مخالفًا لأصول مذهب إمامه!! وهو في الحقيقة كالرد على أئمة السنة، كأنه تكلم بلسان المخالفين، وجازف وتجاوز عن الحدود، حتى شبه قول أهل السنة بقول النصارى! فليتنبه لذلك”.

অর্থ: আমি  তার (ইবনে আবিল ইযের) বক্তব্য সম্পর্কে পরিপূর্ণ চিন্তা-ভাবনা করে দেখেছি, তার বক্তব্য তার ইমামের মাজহাবের মৌলিক নীতিমালার সম্পূর্ণ বিরোধী। বরং প্রকৃতপক্ষে তার বক্তব্য যেন আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের ইমামগণের বক্তব্য খন্ডনে লিখিত।  তার বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয়, সে যেন আহলে সুন্নতের ইমামগণের সাথে প্রতিপক্ষ হিসেবে কথা বলেছে। সে মারাত্মক বিকৃতির শিকার হয়েছে এবং সীমা অতিক্রম করেছে। এমনকি সে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের ইমামগণের বক্তব্যকে খ্রিষ্টানদের বক্তব্যের সাথে তুলনা করেছে। সুতরাং এ বিষয় সতর্ক থেক। [ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিন, খ.২, পৃ.১৪৬]

আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্য থেকে যেসকল বিষয় স্পষ্ট:

১. ইবনে আবিল ইয হানাফী মাজহাবের মৌলিক নীতিমালা অনুসরণ করত না।

২. তার লেখনী মূলত: হানাফী মাজহাব ও আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের বক্তব্য খন্ডনের উদ্দেশ্যে লিখিত।৩. হানাফী মাজহাব ও আহলে সুন্নতের উলামায়ে কেরামের সাথে যেন সে প্রতিপক্ষ হিসেবে কথা বলেছে।

৪.সে মারাত্মক প্রগলভতার  শিকার হয়ে সীমা অতিক্রম করেছে। 

৫. আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের উলামায়ে কেরামের বক্তব্যকে খ্রিষ্টানদের বক্তব্যের সাথে তুলনা করেছে।

 ৬. আল্লামা যাবিদি রহ. তার এসব বক্তব্যের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেছেন। 

আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. এর বক্তব্য:

হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত ইমাম আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাকার সম্পর্কে বলেন,

وطبع شرح لمجهول ينسب إلى المذهب الحنفي زورا ينادي صنع يده بأنه جاهل بهذا الفن وأنه حشوي مختل العيار

“আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যা হিসেবে একজন অজ্ঞাত ব্যক্তির একটি ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। যাকে বানোয়াটী করে হানাফী মাজহাবের দিকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এ লোকের লেখনী দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করে যে  সে আকিদা সম্পর্কে অজ্ঞ। সে একজন হাশাবী বা দেহবাদী এবং মারাত্মক বিচ্যুতির শিকার। “[আল-হাবী ফি সিরাতিল ইমামিত ত্বহাবী, পৃ. ৩৮]আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. এর বক্তব্য থেকে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট। প্রথমত: ইবনে আবিল ইযকে হানাফী মাজহাবের দিকে সম্পৃক্ত করা একটি বানোয়াট বা মিথ্যা। বাস্তবে সে হানাফী ছিল না। দ্বিতীয়ত: ইবনে আবিল ইয আকিদা বিষয়ে জাহেল বা অজ্ঞ ছিল এবং সে একজন মুজাসসিমা বা দেহবাদী আকিদার অনুসারী হাশাবী ছিল। আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. এর বক্তব্য অনুযায়ী আমরা ইবনে আবিল ইযকে হানাফী না বলে দেহবাদী আকিদার অনুসারী হাশাবী বলতে পারি। 

ইবনে আবিল ইযের সম-সাময়িক আলেমগণের বিরোধীতা:ইবনে আবিল ইযের ভ্রান্ত কিছু বক্তব্য প্রকাশিত হওয়ার তখনকার বিখ্যাত আলেমগণ তার প্রতিবাদ করেন। বিশেষভাবে অন্যান্য তিন মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণের সাথে হানাফী মাজহাবের আলেমগণও তার প্রতিবাদ করেন।

আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহ. তার ‘ইম্বাউল গুমর বি আবনায়িল উমর’ কিতাবে লিখেছেন,

وأن العلماء بالديار المصرية خصوصا أهل مذهبة من الحنفية أنكرواذلك عليه

অর্থ: মিশরের আলেমগণ বিশেষভাবে তার মাজহাব তথা হানাফী মাজহাবের উলামায়ে কেরাম তার বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন। [ইমবাউল গুমর, খ.২, পৃ.৯৬]

যেসব উলামায়ে কেরাম ইবনে আবিল ইযের বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন, এদের মাঝে বিখ্যাত কিছু আলেমের নাম উল্লেখ করেছেন ইবনে হাজার আসকালানী রহ.। যেমন, যাইনুদ্দীন ইবনে রজব রহ, তকীউদ্দীন ইবনে মুফলিহ রহ. শরফুদ্দীন ইবনে গাজ্জী রহ. ।

বর্তমানে সালাফীরা ইবনে আবিল ইযের আরেকটি কিতাব প্রকাশ করেছে। কিতাবের নাম হল, আত-তাম্বীহ আলা মুশকিলাতিল হিদায়াহ। সালাফী আলেমরা ইবনে আবিল ইযের রচনা হিসেবে এটি প্রকাশ করেছে। যদিও কিতাবটি ইবনে আবিল ইযের নাকি তার দাদার এটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সালাফীদের বক্তব্য অনুযায়ী কিতাবটি যদি ইবনে আবিল ইযের হয়, তাহলে তার সম্পর্কে হানাফী মাজহাবের আরও কিছু উলামায়ে কেরামের বক্তব্য শুনুন। 

ইমাম সাখাবী রহ. তার আজ-জাওউল লামে কিতাবে লিখেছেন, হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত ইমাম কাসেম ইবনে কুতলুবুগা ইবনে হেদায়া কিতাবের উপর ইবনুল ইযের অভিযোগ খন্ডন করে কিতাব লিখেছেন। “صنّف “أجوبةً عن اعتراضات ابن العزّ على الهداية”[আজ-জাওউল লামে, খ.৬, পৃ.১৮৭]

সালাফীরা ইবনে আবিল ইযের উক্ত কিতাবকে হেদায়ার ব্যাখ্যা হিসেবে প্রচারের চেষ্টা করলেও এটি মূলত: হেদায়া কিতাবের উপর তার অভিযোগ সংকলন। একারণে আল্লামা কাসেম ইবনে কুতলুবুগা তার অভিযোগ খন্ডন করেছেন। একইভাবে আল-বাহরুর রায়েকে রয়েছে ফাতহুল কাদীরে আল্লামা ইবনুল হুমাম ইবনুল ইযের বক্তব্য খন্ডন করেছেন।

 وَقَدْ أَطَالَ فِي فَتْحِ الْقَدِيرِ فِي بَيَانِهِ إطَالَةً حَسَنَةً وَتَعَرَّضَ لِلرَّدِّ عَلَى ابْنِ الْعِزِّ، وَلَسْنَا بِصَدَدِ ذَلِكَ

[আল-বাহরুর রায়েক, বাবুল ইয়ামীন ফিল আকলি ওয়াশ শুরব]

সালাফীদের বক্তব্য অনুযায়ী আত-তাম্বীহ আলা শরহিল হেদায়া কিতাবটি যদি আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাকার ইবনে আবিল ইযের হয়, তাহলে তার বক্তব্য আল্লামা হাসকাফী ও আল্লামা ইবনে আবিদীন খন্ডন করেছেন। তার বক্তব্যকে গরীব (আশ্চর্যজনক) আখ্যা দিয়েছেন। বিস্তারিত,

 “قال (ابن العز!): فحينئذ ينقض الوضوء، وهو فرع غريب وتخريج ظاهر.قال المصنف: ولظهوره عوّلنا عليه.قلت: قال شيخنا الرملي حفظه الله تعالى: كيف يعول عليه وهو مع غرابته لا يشهد له رواية ولا دراية، أما الاولى فظاهر إذا لم يرو عن أحد ممن يعتمد عليه، وأما الثانية فلعدم تسليم المقدمة الاولى ويشهد لبطلانها مسألة الجدي إذا غذي بلبن الخنزير فقد عللوا حل أكله بصيرورته مستهلكا لا يبقى له أثر، فكذلك نقول في عرق مدمن الخمر، ويكفينا في ضعفه غرابته”.[রদ্দুল মুহতার, খ.৬, পৃ.১৪৬-১৪৭]

আকিদার ক্ষেত্রে ইবনে আবিল ইযের বিচ্যুতি সুস্পষ্ট। অধিকাংশ বিষয়ে সে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত আকিদা পোষণ করে। এবং কাররামিয়া ও মুজাসসিমাদের ভ্রান্ত বক্তব্য প্রচার করেছে। আকিদাতুত ত্বহাবীর সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা ভিডিও আকারে প্রকাশের নিয়ত রয়েছে। আমাদের আলোচনায় ইবনে আবিল ইযের ভ্রান্ত মতবাদগুলি বিস্তারিত উল্লেখ করা হবে ইনশাআল্লাহ। এখানে সংক্ষেপে দু’একটি বিষয় উল্লেখ করা মুনাসিব মনে করছি। এসকল বিষয়ের কয়েকটি কুফুরী পর্যায়ের। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করেন। 

১. কিছু সৃষ্টি কাদীম বা অবিনশ্বর। অনাদী থেকেই বিদ্যমান। এটি তাসালসুলুল হাওয়াদিস নামে পরিচিত। [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.১২৯, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]

২. আল্লাহ তায়ালার হদ বা সীমা রয়েছে।  [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.২১৯, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]

৩. আল্লাহর সত্তার মাঝে নশ্বর বিষয় সৃষ্টি হয়।  [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.১৭৭, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]

৪. আল্লাহর বক্তব্যের অক্ষর ও শব্দ রয়েছে।  [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.১৬৯, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]

৫. আল্লাহ তায়ালা স্থানগতভাবে উপরের দিকে রয়েছেন। অর্থাৎ আল্লাহর দিক রয়েছে। 

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে দেহবাদী আকিদার ভ্রান্তি থেকে হেফাজত করুন। আমীন।

------ ------

আক্বিদা

আল্লাহ তায়ালার এককত্বের প্রমাণ

ইজহারুল ইসলাম শনি, 23 নভে., 2024

ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের মাঝে সর্বপ্রধান বিষয় হল, আল্লাহর তাওহীদ তথা একত্বের উপর ঈমান আনয়ন করা। এই বিশ্বাস করা যে, সৃষ্টা হিসেবে তিনি একক, গুণাবলীর বিবেচনায় তিনি একক এবং উপাসনার যোগ্য একমাত্র তিনিই। পবিত্র কুরআন ও রাসূল (সঃ) এর সমস্ত হাদীস তাওহীদ তথা আল্লাহর এককত্বের উপর ভিত্তি করেই আবর্তিত। কোন বিষয়ে আল্লাহর সমকক্ষ বা অংশীদার নেই, এটিই এ বিশ্বাসের মূলমন্ত্র। পবিত্র কুরআনের ১১২ নং সূরায় এ বিষয়টি সুষ্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষিত হয়েছে। সে প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর অস্তিত্ব অনুভব করে এবং আল্লাহর এককত্বের স্বাক্ষর প্রদান করে।

আমরা এখানে আল্লাহর এককত্বের উপর পাঁচটি যুক্তি উপস্থাপন করব।

অকহ্যাম রেজর এর তত্ত্ব

কুরআন স্পষ্টভাষায় জিজ্ঞাসা করেছে, এই মহাবিশ্ব কি এমনিতেই সৃষ্টি হয়েছে? এর উত্তর খুবই সহজ ও স্পষ্ট। কেননা ভৌত পদার্থবিদ্যা এবং সকল দর্শন এবিষয়ে একমত যে, যে বস্তু অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এসেছে, তার অস্তিত্বের পিছে একটি কজ বা কারণ রয়েছে। আর মহাবিশ্ব যেহেতু অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এসেছে এজন্য এর পিছে একটি কারণ বা কজ রয়েছে। মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পিছে একটি সামগ্রিক কজ বা কারণ থাকাটাই যুক্তিযুক্ত। অসীম সংখ্যক কারণ থাকাটা অসম্ভব। কেননা বাস্তবে কখনও অসীম কোন কিছু থেকে আমরা কোন ফলাফল লাভ করি না।

উদাহরণ হিসেবে নীচের দু’টি বিষয় লক্ষ্য করুণ-

১. কোন কক্ষে যদি অসীম সংখ্যক মানুষ থাকে এবং সেখান থেকে যদি আমি দু’জনকে বাদ দেই, তাহলে কতজন থাকবে? আপনি উত্তর দিবেন, অসীম বিয়োগ দুই। অর্থাৎ অসীম থেকে দু’জনকে বাদ দিলে যা থাকে। এর দ্বারা বাস্তবে কোন অর্থ বোঝায় কি? অসীম থেকে যদি দুজনকে বাদ দেয়া হলেও কক্ষে অসীম সংখ্যক মানুষই থেকে যাবে। বাস্তবে এটি বিশেষ কোন অর্থ প্রদান করে না। আপনাকে যদি কক্ষের অসীম সংখ্যক লোক গণনা করতে বলা হয়, আপনার পক্ষে তা গণনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু লোকসংখ্যা যদি অসীম থেকে সামান্য কমিয়ে গণনা করতে বলা হয়, তবুও আপনার পক্ষে তা গণনা করা সম্ভব নয়। এর অর্থ হল, বাস্তব জীবনে অসীম সংখ্যা থেকে বিশেষ অর্থ বোঝা সম্ভব নয়। 

২. মনে করুন, আমি একজন সৈনিক। আমি একটা শত্রুকে গুলি করতে চাই। আমার গুলি করার জন্য আমার পেছনের সৈনিকের অনুমতি নেয়া প্রয়োজন। আমার পিছের সৈনিকের জন্য আবার তার পেছনের সৈনিকের অনুমতি প্রয়োজন। এভাবে এ ধারা যদি চলতে থাকে এবং আমার গুলি করার জন্য অসীম সংখ্যক সৈনিকের অনুমতির প্রয়োজন হয়, তবে আমি কি আদৌ শত্রুকে গুলি করতে পারব? উত্তর খুবই সহজ ও স্বাভাবিক। একইভাবে আমি মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পিছে যদি অসীম সংখ্যক কারণ ধরে নেই, তবে আদৌ মহাবিশ্বের অস্তিত্ব সম্ভব হত না। এবং কখনও এটি অস্তিত্বে আসত না। সুতরাং মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পিছে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বাধীন ও একক কারণ থাকাটাই যুক্তিসঙ্গত।

আপনি এ যুক্তি দেখাতে পারেন যে, উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্য তথা স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বাধীন একাধিক কারণ একই সাথে ক্রিয়াশীল হলে সমস্যা কোথায়? 

আমি বলব, আপনার এ যুক্তিটা খুবই দুর্বল প্রকৃতির। চতুর্দশ শতাব্দীর দার্শনিক অকহ্যাম রেজর এর তত্ত্বের মাধ্যমে আপনার এ যুক্তির অসারতা প্রমাণিত হয়। অকহ্যাম রেজরের নীতি হল, প্রয়োজন ছাড়া বহু সংখ্যার ব্যবহার অনুচিৎ। আরেকটু সহজ করে বললে এভাবে বলা যায়,  সবচেয়ে সরল ও সর্বাধিক অর্থবহ ব্যাখ্যা হল, সর্বোত্তম ব্যাখ্যা।

অতএব, কোন প্রমাণ ছাড়া কিংবা প্রয়োজন ছাড়া আমরা এটা বলতে পারি না যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির পিছে অনেকগুলো কারণ ক্রিয়াশীল। সুতরাং এক্ষেত্রে আমাদেরকে সবচেয়ে অর্থবহ ও সরল কারণ তথা মহাবিশ্ব সৃষ্টির একক কারণকেই গ্রহণ করতে হবে। কেননা এক্ষেত্রে আমাদেরকে কাছে কোন প্রমাণ নেই যে আমরা বলতে পারি, মহাবিশ্বের সৃষ্টি মূলতঃ দুটি, তিনটি, কিংবা কয়েক হাজার কারণের কম্বিনেশন বা সমন্বয়। একাধিক কারণ গ্রহণের দ্বারা একটি স্বাধীন, স্বয়ংসম্পূর্ণ কারণে অতিরিক্ত কোন মাত্রা যোগ হয় না।

যেমন, যখন বলা হল, মহাবিশ্ব একটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কারণের দ্বারা সৃষ্ট, এ কথা দ্বারা যে অর্থ স্পষ্ট হয়েছে, যদি বলা হয়, মহাবিশ্ব দু’টি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কারণের দ্বারা সৃষ্ট, এ কথার দ্বারা অতিরিক্ত কোন অর্থ প্রকাশ পায় না। কেননা আমি যখন বলছি, কারণটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী তখন অন্য কোন সর্বময় ক্ষমতার প্রয়োজন নেই। কারণটি যদি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী না হত, তবে সাহায্যকারী হিসেবে অন্য কোন কারণের প্রয়োজন পড়ত। এক্ষেত্রে কোন কারণই তখন স্বাধীন বা স্বয়ংসম্পূর্ণ কারণ থাকবে না।

সুতরাং মহাবিশ্ব সৃষ্টির পিছে আমাদের মূলতঃ একটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কারণের প্রয়োজন ছিল এবং এটুকুই যথেষ্ট কেননা কারণটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।

২. যৌক্তিক প্রমাণ

যুক্তির দাবি হল, মহাবিশ্ব সৃষ্টি যদি অনেক প্রভূ থাকত, তবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে মহাবিশ্ব ধ্বংস হয়েছে। এবং আমরা মহাবিশ্বে যে সুষম শৃঙ্খলা ও নিয়মতান্ত্রিকতার সর্বোচ্চ সমাবেশ লক্ষ্য করে থাকি, অনেক প্রভূ থাকলে তা পরিলক্ষিত হত না।

আপনি যুক্তি দেখাতে পারেন, আপনার গাড়িটি তৈরি করে অনেক মানুষ। যেমন, কেউ গাড়ীর বডি তৈরি করে, কেউ ইঞ্জিন আবার কেউ চাকা। কিন্তু পূর্ণ গাড়িটি তৈরি হলে সেটি একটি সুন্দর ও সুষম গাড়ি হয়ে থাকে। অতএব, একটি সৃষ্ট বস্তুর অনেক স্রষ্টা থাকলেও সেটি ভারসাম্যপূর্ণ হতে পারে। 

আপনার এ প্রশ্নের উত্তর হল, মহাবিশ্ব সৃষ্টির পিছে আমরা যে কারণটি উল্লেখ করেছি সেটি হল, এমন একজন প্রভূ যিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং ইচ্ছার ক্ষেত্রে এককভাবে স্বাধীন। কেননা প্রভূ তো তিনিই হবেন, যার অসীম প্রয়োগিক ইচ্ছা রয়েছে। যদি অনেক প্রভূ থাকত, তবে প্রত্যেকের ইচ্ছা প্রয়োগের প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হত, আর এটিই মহাবিশ্বে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণ হতো।

আপনি যুক্তি দেখাতে পারেন, এ সম্ভাবনা রয়েছে যে, অনেকগুলো প্রভূ একটি বিষয়ে একমত পোষণ করতে পারে। অথবা এক একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে তাদের পৃথক পৃথক ক্ষমতা থাকবে। এক্ষেত্রে আমরা বলব, এ ধরণের প্রভূর ইচ্ছা অসীম ও স্বাধীন নয়। ফলে এরা প্রভূ হওয়ার যোগ্য নয়। সার কথা হল, যদি দু’জন স্রষ্টা থাকে, এবং তারা কোন বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে, যেমন একজন ক নামক ব্যক্তিকে স্থির রাখতে চাচ্ছে, আরেকজন তাকে গতিশীল করতে চাচ্ছে। অথবা একজন প্রভূ খ কে জীবন্ত প্রাণি বানাতে চাচ্ছে, আরেকজন চাচ্ছে যে, এটি জড়পদার্থ হিসেবে অবস্থান করবে।

যুক্তির আলোকে যদি বিশ্লেষণ করা হয়, তবে এখানে তিনটি অবস্থার কোন একটি ঘটতে বাধ্য-

১. উভয় প্রভূর ইচ্ছা বহাল রাখা হবে এবং তা বাস্তবায়ন করা হবে।

২. শুধু তাদের একজনের ইচ্ছা বহাল রাখা হবে।

৩. তাদের কারও ইচ্ছায় বাস্তবায়ন করা হবে না।প্রথমটি সম্ভব নয়।

কেননা এক্ষেত্রে দু’টি বিপরীত বিষয় একই সাথে অস্তিত্ব লাভ করা আবশ্যক হবে। যা অসম্ভব। অর্থাৎ একই সাথে একটি বস্তু জীবিত ও মৃত হতে পারে না। তৃতীয় বক্তব্যও বাতিল হয়ে যাবে। কেননা এর দ্বারা এটা আবশ্যক হয় যে, একটি বস্তু গতিশীলও না, আবার স্থিরও না। একইভাবে একটি বস্তু জীবিতও না, আবার মৃত না। আর এটি অসম্ভব। সাথে সাথে তাদের কারও ইচ্ছায় যদি বাস্তবায়ন করা না হয়, তখন তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, তাদের কেউ-ই নিজ ইচ্ছা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম নয়। ফলে প্রত্যেকেই প্রভূ হওয়ার যোগ্যতা হারাবে।

দ্বিতীয় বক্তব্য অনুযায়ী, যদি দু’জনের মধ্য থেকে একজনের ইচ্ছা বাস্তবায়ন করা হয়, এবং অপরজনের ইচ্ছা পরিত্যাগ করা হয়, তবে তিনিই হবেন একক প্রভূ। যার ইচ্ছা পরিত্যাগ করা হয়েছে, সে প্রভূ হওয়ার যোগ্য থাকবে না। উপর্যুক্ত বক্তব্য দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, এই ভারসাম্যপূর্ণ মহাবিশ্বের একজন মাত্র প্রভূ থাকা সম্ভব, যিনি অসীম ইচ্ছার অধিকারী এবং একক ক্ষমতার অধিকারী।

৩. ধারণাগত বৈচিত্র

আমরা কিভাবে দু’টি জিনিসকে পরস্পর থেকে পৃথক করে থাকি? দু’জন ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে আমরা তাদের মধ্যে পার্থক্য করি কীভাবে। এর উত্তর হল, আমরা এটা করে থাকি, কনসেপ্চুয়াল ডিফারেনসিয়েশন বা ধারণাগত বৈচিত্রের মাধ্যমে। এই ধারণাগুলো হল, স্থান, পারম্পরিক দূরত্ব, গঠন ও আকার-আকৃতিগত তারতম্য।

আমরা যে কোন দু’টি বস্তুর মাঝে পার্থক্য করতে পারি, তাদের পারস্পরিক দূরত্ব, বর্ণ ও আকার-আকৃতিগত বৈচিত্রের মাধ্যমে। দু’টি বিষয়ের মধ্যে যখন উপরোক্ত বিষয়গুলো না পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে কি আপনি উক্ত বস্তু দু’টির মাঝে কোন পার্থক্য করতে সক্ষম হবেন? আপনি পারবেন না। এবিষয়টি শুধু দু’য়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং অসংখ্য বস্তুর ক্ষেত্রে পার্থক্য নির্ণয় করতে হলে, উপরোক্ত বিষয়গুলো থাকা আবশ্যক। 

প্রাসঙ্গিকভাবে বলে নেয়া আবশ্যক যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি মহাবিশ্ব থেকে বহির্গত হওয়া আবশ্যক। কেননা সৃষ্টির কারণ যদি মহাবিশ্বের ভিতরগত কিংবা মহাবিশ্বেরই কোন অংশ হয়, তখন এর অর্থ হয় যে, মহাবিশ্ব নিজেই নিজের স্রষ্টা। আর এটি অসম্ভব। মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ যেহেতু বহির্গত, আপনি সহজেই অনুমান করতে পারবেন যে, আপনি মহাবিশ্বের বহির্গত বিষয়ের মধ্যে অবস্থান, আকার-আকৃতি ও বর্ণগত পার্থক্য করতে পারবেন না। কেননা এ বিষয়গুলো কেবল মহাবিশ্বের অভ্যন্তরে বিশেষ অর্থ প্রদান করে, এর বাইরে নয়। কেননা উপর্যুক্ত বিষয় তথা দূরত্ব, আকার-আকৃতি বা বর্ণ প্রত্যেকটি সৃষ্ট। মহাবিশ্বের বাইরে সৃষ্ট কোন বস্তু নেই। মহাবিশ্বের বাইরে উপর্যুক্ত বিষয়ের অনুপস্থিতির কারণে সৃষ্টির পিছে ক্রিয়াশীল দু’টি কারণের মধ্যে পার্থক্য করাও সম্ভব নয়। এজন্য সৃষ্টির পিছে দু’টি বা অসংখ্য কারণের কথা বলাটাও ভিত্তিহীন, অযৌক্তি ও ধারণাপ্রসূত একটি বক্তব্য মাত্র। 

৪. অনন্যতা

মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি ইউনিক বা অনন্য হওয়া আবশ্যক। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “তাঁর কোন সমকক্ষ নেই”। মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি যদি অনন্য না হয়, তবে এর অর্থ হবে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ ও মহাবিশ্বের মাঝে একটি সিমিলারিটি বা সাদৃশ্য রয়েছে। কেননা এর দ্বারা এটি প্রমাণিত হয় যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি এর মাঝে রয়েছে। যার অর্থ এই দাঁড়াল যে, মহাবিশ্ব নিজেই নিজের স্রষ্টা। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি মহাবিশ্বের সাদৃশ্যপূর্ণ হতে পারবে না কেন? এর উত্তরটি খুবই সহজ। আমরা জানি মহাবিশ্ব অসংখ্য বস্তুর সমষ্টি। সুতরাং মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি অবশ্যই ইম্যাটেরিয়াল বা বস্তুজগতের ঊর্ধ্বে হতে হবে। নতুবা মহাবিশ্ব নিজেই নিজের স্রষ্টা হওয়া আবশ্যক হবে। সুতরাং বস্তু সৃষ্টির কারণটিও যদি বস্তুর মতো হয়, তবে বস্তু নিজেই নিজের স্রষ্টা হওয়া আবশ্যক, যা অসম্ভব। সুতরাং উপসংহারে আপনাকে অবশ্যই বলতে হবে যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি অবশ্যই ইম্যাটেরিয়াল ও ইউনিক হতে হবে। আমাদের এ বক্তব্যটি স্রষ্টার এককত্বের প্রমাণ হয় কিভাবে? আমরা বলব, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ যদি একাধিক হয়, তবে তার কোনটিই ইউনিক বা অনন্য হবে না। ফলে স্রষ্টা একজন হওয়াটাই নির্দিষ্ট।

৫. ঐশীবাণী

স্রষ্টার এককত্ব প্রমাণের সবচেয়ে সহজ উপায় হল, আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ঐশীবাণীর শরণাপন্ন হওয়া। এক্ষেত্রে যুক্তি হল, কোন বাণীর ব্যাপারে যদি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয় যে, এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত এবং এটি মানব রচিত নয়, তখন এ গ্রন্থের বক্তব্যের ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকে না। সুতরাং আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ঐশী গ্রন্থে আল্লাহ তায়ালা নিজের সম্পর্কে যে তথ্য প্রদান করবেন সেটি নিশ্চিতভাবে সত্য বলে বিবেচিত হবে। 

কেউ যদি আল্লাহ সম্পর্কে অজ্ঞ হয় তবে সে কিভাবে আল্লাহ সম্পর্কে বা তার প্রেরিত কিতাব সম্পর্কে ধারণা অর্জন করবে?

এর দু’টি পদ্ধতি রয়েছে-

১. ইন্টারন্যাল

২. এক্সটারন্যাল

আভ্যন্তরীণভাবে আল্লাহ তায়ালার পরিচয় পাওয়ার অর্থ হল, আপনি আত্মপরীক্ষা বা আত্মদর্শনের মাধ্যমে আল্লাহ সম্পর্কে অবগত হওয়ার চেষ্টা করবেন। অর্থাৎ নিজের আভ্যন্তরীণ শক্তি ব্যবহার করে আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা। আজব ব্যাপার হল, আল্লাহ সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন মানুষের নিজস্ব শক্তির দ্বারা সম্ভব নয়।

এর কিছু মৌলিক কারণ হল,

১. মানুষ সৃষ্টিগতভাবে বৈচিত্রময়। ব্যক্তি বৈচিত্রের এধারাটি মূলতঃ মানুষের মানসিক ভিন্নতারই বহিপ্রকাশ। সাইকোলজিক্যাল ভিন্নতার প্রধান কারণ হল, ডি.এন.এ এর ভিন্নতা, বাস্তব অভিজ্ঞতা, সামাজিক পূর্বসূত্র, বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানার্জনের ক্ষমতা, লিঙ্গের বৈষম্য ইত্যাদি নিয়ামক দ্বারা প্রভাবিত। আত্মদর্শনের মাধ্যমে স্রষ্টা সম্পর্কে ধারণা পেতে এবিষয়গুলো আপনাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে। সুতরাং আপনার আত্মপরীক্ষার মাধ্যমে যে ফলাফল পাওয়া যাবে সেটি অন্যদের থেকে ভিন্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। আপনি নিজেও এই বাস্তবতা উপলব্ধি করবেন যে, উপর্যুক্ত বিষয়ের উপস্থিতিতে আপনি একাকী যদি স্রষ্টা সম্পর্কে ধারণা পেতে চান তবে তা সত্য থেকে অনেক বিচ্যুত হতে পারে। এটি একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ বছর আগে পৃথিবীতে প্রায় ৩৭০০ হাজার দেবতার ধারণা মানুষের মনে জেঁকে বসেছিল।

২. দ্বিতীয় কারণ হল, বাস্তবতার বিবেচনায় মানুষ খুবই সীমাবদ্ধ। এজন্য মানুষ যদি নিজের পক্ষ থেকে স্রষ্টা সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করতে চায়, তবে তা অধিকাংশ সময় ভ্রান্তির কারণ হয়। দার্শনিকগণ ¯্রষ্টার অস্তিত্বের ব্যাপারে কিছু যুক্তিসঙ্গত দার্শনিক তত্ত্ব উপস্থাপন করে থাকেন। তবে তারা স্বতঃসিদ্ধ ও বাস্তব কোন তথ্য দিতে অক্ষম। প্রকৃতপক্ষে যদি আপনি স্রষ্টা সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা অর্জন করতে চান, তবে তা হবে ইঁদুরের পক্ষে হাতির শক্তিমত্তা সম্পর্কে ধারণা অর্জনের মতো হাস্যকর। এজন্য শুধু যুক্তি বা ধারণার উপর ভিত্তি করে স্রষ্টা সম্পর্কে কিছু বলা তার সম্পর্কে মিথ্যাচারের নামান্তর। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, “তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে যা জান না, তা বলো কেন?” সুতরাং আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে আমরা যদি জ্ঞান অর্জন করতে চাই তবে তা অবশ্যই এক্সটারন্যাল বা বহির্গত কোন মাধ্যমে হতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা ঐশীবাণীর মাধ্যমে আমাদেরকে যা জানিয়েছেন, সেটিই হবে বিশুদ্ধ জ্ঞান।

আর পবিত্র কুরআন থেকে আমরা একথা সুনিশ্চিতভাবে জানি যে, আল্লাহ তায়ালা হলেন এক ও অদ্বিতীয়। তার সমকক্ষ কেউ নেই। সুতরাং তার এককত্বের ব্যাপারে আর কোন সন্দেহ থাকে না।

------ ------