ইতিহাস

আহমাদ রিদা খান ব্রেলভীর বিরুদ্ধে উলামায়ে দেওবন্দের অপপ্রচার (১ম পর্ব)

Ijharul Islam বৃহঃ, 19 ডিসে., 2024

ইতোপূর্বে আমি এক আলোচনায় দেখিয়েছিলাম যে বিপরীত মত তথা বেরেলভী পন্থী আলিমদের  সমালোচনা করতে গিয়ে কীভাবে দেওবন্দী আলিমদের মান্যবর আলিম ডক্টর খালিদ মাহমুদ বিভিন্ন রকম  ইলমী খিয়ানত করেছেন। ইসলামে বিভিন্ন মতামত থাকা, পক্ষ - বিপক্ষ থাকা দোষণীয় নয়। আল্লাহ তায়ালা এভাবেই সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু নিজের মত ও পক্ষকে শক্তিশালী করার জন্য বিপরীত মতের উপর জুলুম করা, খিয়ানত করা কিংবা মিথ্যাচার করা কোনভাবেই অনুমোদিত নয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা এ বিষয়ে স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, 

 

وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَىٰ أَلَّا تَعْدِلُوا ۚ اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَىٰ ۖ

কোন সম্প্রদায়ের শত্রুতার কারণে কখনও ন্যায়বিচার পরিত্যাগ করো না। সুবিচার কর এটাই খোদাভীতির অধিক নিকটবর্তী।

 

অর্থাৎ আমার দৃষ্টিতে প্রতিপক্ষ যেই হোক, যে স্তরেরই হোক তাকে ঘায়েল করার জন্য তার নামে মিথ্যাচার করা কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অপপ্রচার চালানোর কোন সুযোগ নেই। 

 

এজাতীয় ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় নেয়াতে উপকারের চেয়ে বরং ক্ষতি বেশি হয়। প্রতিপক্ষের সমালোচনায় যখন মিথ্যার আশ্রয় নেয়া হয়, তখন প্রতিপক্ষের কাছে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যে, এই সমালোচনা ইলমী - ইনসাফের সমালোচনা নয়। বরং এটা মিথ্যার উপর নির্ভর করে নিজেদের জিঘাংসা মেটানোর চেষ্টা মাত্র। এতে করে প্রতিপক্ষ তাদের মতের উপর আরও শক্তিশালী হয়ে যায়। এমনকি যাদের সামনে এজাতীয় মিথ্যার বাস্তবতা স্পষ্ট হয়ে যায়, তারাও নিজেদের পক্ষের কথার উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। মিথ্যাচার করে যেই উদ্দেশ্য হাসিল করতে চাওয়া হয়েছিল, দিন শেষে সেটি সব দিক থেকেই ব্যর্থ হয়। 

 

যে কোন আলিমের ভুল-ত্রুটি বা বিচ্যূতি হলে সেটা সঠিক পন্থায় খন্ডন হওয়া জ্বরুরি। এর মাধ্যমে সবারই উপকার হয়। সঠিক ইলমী পদ্ধতিতে যদি ব্রেলভীদের খন্ডন হয়, এটি অবশ্যই প্রশংসনীয় ও সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য কাজ। কিন্তু খন্ডনের নামে যদি মিথ্যাচার করা হয়, বিভিন্ন রকম মিথ্যা বিষয় চাপিয়ে দেয়া হয়, এগুলো তো কখনও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। 

 

আজকের আলোচনায় আমরা দেখব, দেওবন্দী উলামায়ে কেরামের পক্ষ থেকে কীভাবে নানা রকম অবাস্তব, মিথ্যা দাবী করে ব্রেলভীদের খন্ডন করা হয়েছে। এবং এগুলো দীর্ঘ সময় ধরে প্রচার হয়ে আসছে। দেওবন্দী ঘরানার পক্ষ থেকে এর সংশোধন বা এগুলোর প্রতিকার নিয়ে কোন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। এর চেয়ে অবাক করার বিষয় হলো, পরবর্তী প্রজন্ম এজাতীয় ভুলকে দলিল বানিয়ে সেগুলোকে প্রচারও করছে। কোন একটা ভুল বা মিথ্যা এভাবে গোষ্ঠীগতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়া অবশ্যই অন্যায়। বিশেষ করে উলামায়ে কেরামের জিম্মাদারি যেখানে ছিলো, সঠিক পন্থায় ইনসাফের সাথে খন্ডন করা, এর বিপরীতে মিথ্যার উপর নির্ভর করে অপপ্রচার চালিয়ে যাওয়া কখনও উলামায়ে কেরামের শান হতে পারে না। 

 

ব্যক্তিগতভাবে আমি ব্রেলভী মাসলাক বিশেষ করে আহমাদ রিদ্বা খানের বক্তব্য সঠিকভাবে তুলে এনে এর খন্ডনের পক্ষে। আমি নিজেও চাই, উলামায়ে দেওবন্দের পক্ষ থেকে সঠিক পন্থায় শক্ত ইলমী খন্ডন হোক। বিষয়গুলো এতো মজবুতভাবে খন্ডন হোক, যাতে এই খন্ডনের উপর অন্যরা হাত না দিতে পারে। 

 

সম্প্রতি মাওলানা মিজান হারুন উলামায়ে দেওবন্দের মাঝে প্রচলিত বিভিন্ন অবাস্তব  ধারণার উপর ভিত্তি করে ব্রেলভীদের সমালোচনার পুনরাবৃত্তি শুরু করেছেন। উনার অধিকাংশ লেখা এজাতীয় মিথ্যাচারমূলক অপপ্রচারের চর্বিত চর্বণ। যা পূর্ব থেকেই উলামায়ে দেওবন্দের মাঝে প্রচলিত আছে। এক্ষেত্রে অনেকে এই প্রশ্ন বা আপত্তি তুলেছেন যে, কওমীর সন্তান হয়েও কেন আহমাদ রিদ্বা খানের পক্ষে আমি লিখছি? এর সহজ উত্তর হলো, দুনিয়াতে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তির নামেও মিথ্যাচারের অনুমতি শরীয়াত দেয় না। এমনকি ফিরআউনের নামেও মিথ্যা কথা বলে তার বিরোধিতা করা অবৈধ। এক্ষেত্রে আমার সামনে যেহেতু এজাতীয় বিষয়ের বাস্তবতা স্পষ্ট, এজন্য নিজের দল বা পরিচয়ের বিপরীত হওয়া সত্ত্বেও ইসলাম ও ইলমের আমানত হিসেবে এই জাতীয় মিথ্যাচারের বাস্তবতা স্পষ্ট হওয়া আবশ্যক। ইলমী দালিলিক খন্ডন হলে আমি নিজেও এতে অংশগ্রহণ করব এবং সেটি প্রচারও করব। কিন্তু খন্ডনের নামে মিথ্যাচারকে সমর্থন করার কোন সুযোগ নেই। 

 

চলুন, মিজান হারুনের সাম্প্রতিক একটি পোস্ট নিয়ে আলোচনা শুরু যাক। মিজান হারুন মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া লিখিত কওমী মাদ্রাসার মেশকাত জামাতের (দাওরা হদীসের নিচের জামায়াত) এর নেসাবভুক্ত দেওবন্দ আন্দোলন ইতিহাস ঐতিহ্য অবদান নামক কিতাব একটি অংশ স্ক্রিনশট দিয়ে লিখেছেন,

 

“ মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া (র.) লিখিত 'দেওবন্দ আন্দোলন: ইতিহাস ঐতিহ্য অবদান'। এমন মূল্যবান বই আমাদের মাদরাসাগুলোর পাঠ্যতালিকায় থাকলেও গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া হয় না। আমাদের সময় দেখেছি, নামকাওয়াস্তে অতিরিক্ত বিষয় হিসেব পড়ানো হতো। ছেলেরা না বুঝেই কেবল পরীক্ষায় উতরানোর জন্য মুখস্থ করতো। অথচ এই বইয়ে নিজেদের ঐতিহ্য ও আত্মপরিচয়ের যে সবক রয়েছে, সেটা অধিকাংশ ছাত্রই অনুভব করতো না। ফলাফল সামনে।”

মিজান হারুনের পুরো পোস্টের স্ক্রিনশট দেখুন,

 


 

এখানে মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াইহয়া সাহেব লিখেছেন, 

 

সাইয়্যিদ আহমাদ বেরলভী রাহ: যখন হজ্ব থেকে ফিরে এসে তার জিহাদী তৎপরতা শুরু করলেন এবং দেশীয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্তিগুলোকে স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বপক্ষে একত্রিত করতে লাগলেন, তখন ধূর্ত ইংরেজরা সাইয়্যিদ আহমাদ রাহ: এবং তার সাথী-সঙ্গী শ্রদ্ধেয় উলামায়ে কেরামকে ওয়াহাবী মতালম্বী এবং এবং আব্দুল ওয়াহহাব নজদীর অনুসারী হিসেবে আখ্যায়িত করে। ফলে সাধারণ জনগণ তাদের ব্যাপারে বিভ্রান্তির শিকার হয়। ইংরেজদের ষড়যন্ত্রের বিষয়টি বুঝতে না পেরে একদল লোক তাদের ব্যাপারে ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করতে শুরু করে। কারণ হলো, (মুহাম্মাদ বিন) আব্দুল ওয়াহহাব নজদীর অনুসারীরা ইসলামের কতিপয় বিষয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ির কারণে এদেশীয় মুসলমানদের নিকট তারা আগে থেকেই সমালোচিত ছিলো। যখন প্রচার করা হলো এই সব আলিম উলামা ওয়াহাবী, তখন মানুষ তাদের প্রতি বিরুপভাবাপন্ন হয়ে ওঠল। আর একাজের জন্য তারা আহমাদ রেজা খান বেরলভী ও তার দলকে ক্রয় করে নেয়। বেরেলভী সম্প্রদায় মূলত: মুসলমানদের মধ্য থেকে বাছাই করা স্বার্থান্বেষী এবং তোষামোদী লোকের সমন্বয়ে গঠিত একটি ফেরকা, যার নেতা ছিল মৌ: আহমাদ রেজা খান বেরলভী। এরা নিজেকে একমাত্র রাসূল প্রেমিক বলে দাবী করত এবং স্বদেশী আলিমদের বিরুদ্ধে ছিলো অত্যন্ত তৎপর। উলামায়ে কেরাম যখন শিখ ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে রণক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তখন এরা তাদের মুকাবিলায় মেতে ওঠেছিল। এরাই ইংরেজদের প্ররোচণায় হক্বপন্থী উলামায়ে কেরামকে ওয়াহাবী বলে প্রচারণা চালাতে থাকে। মৌলভী আহমাদ রেজা খান তো হিন্দুস্তানকে ‘দারুল ইসলাম’ বলে ফতওয়াও দিয়েছিল।”


 

আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া সাহেব তার দেওবন্দ আন্দোলন বইয়ের ১৫২ পৃষ্ঠায় এই কথাগুলি লিখেছেন। পূর্ণ আলোচনার স্ক্রিনশট:

 


 

এখানে মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া সাহেব সংক্ষেপে আহমাদ রিদ্বা খান বেরেলভীর বিরুদ্ধে বললেও একই ধরণের সমালোচনা তিনি একই বইয়ের আরেক জায়গায় আরেকটু বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। একই বইয়ের ২৮২ পৃষ্ঠা থেকে বিদয়াতীদের ফেতনা প্রতিরোধে উলামায়ে দেওবন্দের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা শুরু করেছেন। ২৮৫ পৃষ্ঠায় তিনি একটি শিরোনাম দিয়েছেন, আহমদ রেজাখানের তৎপরতা নামে। সেখানে তিনি লিখেছেন,

 

“উলামায়ে হক্কানী যখন ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে আপোষহীন সংগ্রামে রত, তখন সাম্রাজ্যবাদীরা এই বিদয়াতী শ্রেণিকে তাদের স্বপক্ষে টেনে নেয়। তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে উলামায়ে হক্কানীর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতায় ধন্য এদেশীয় ব্যক্তিবর্গের মাঝে গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর পর বিদয়াতীদের বিশিষ্ট নেতা মাও: আহমদ রেজাখান ছিল অন্যতম। 

 

বহু বিদয়াতের উদ্ভাবনকারী এই লোকটি রায়বেরলীতে জন্মগ্রহণ করে। এদেশের গণ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়া ইংরেজ বিরোধী জিহাদী চেতনাকে অবদমিত করার জন্য ইংরেজরা যেসব ব্যক্তিবর্গকে জিহাদের বিধান রহিত বলে অপপ্রচার চালানোর জন্য ভাড়াটে হিসেবে নিয়োগ করেছিল, আহমদ রেজা খান ছিল তাদের অন্যতম। তবে সে গোলাম আহমদের মত জিহাদের বিধান রহিত করার জন্য নিজেকে নবী হিসেবে দাবী না করে অন্যপন্থা অবলম্বন করেছিল। প্রথম দিকে সে একজন আশেকে রাসূল এবং আধ্যাত্মিক রাহবার হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে এবং আশেকে রাসূল হিসাবে নিজেকে বৈশিষ্ট্য মন্ডিত করার জন্য মিলাদ ও কিয়ামের বিশেষ প্রথার প্রচলন করে। নবী প্রেমের কিছু কবিতা ও না’ত সে রচনা করে সাধারণ্যে প্রচার করতে থাকে। ইংরেজরা তাদের স্বার্থেই এ ভন্ড লোকটিকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা করতে থাকে। ফলে সেই নিমক হালালীর জন্য ইংরেজদের জন্য সহায়ক এমন কোন অপকর্ম নেই যা সে আঞ্জাম দেয়নি।”

 

এরপর তিনি ধারাবাহিকভাবে আহমাদ রেজাখানের দারুল হারব ও দারুল ইসলাম ফতোয়া নিয়ে সমালোচনা চালিয়ে যেতে থাকেন। ২৮৭ পৃষ্ঠায় তিনি ‘ওয়াহাবী অপবাদের নেপথ্য কাহিনী’ শিরোনামে আলোচনা শুরু করেন। এই আলোচনায় তিনি শুরুতে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব নজদীকে সংগ্রামী সংস্কারক হিসেবে উল্লেখ করে নজদীদের ইতিহাস সংক্ষেপে তুলে ধরেছেন। ওয়াহাবীদের ইতিহাস আলোচনা করার পর তিনি আবার আহমাদ রেজা খানের আলোচনায় ফিরে এসেছেন ২৮৯ পৃষ্ঠায়। এখানে তিনি লিখেছেন, 

 

“ ভারতে যখন হযরত সাইয়্যিদ আহমদ শহীদের নেতৃত্বে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন চূড়ান্ত রুপ ধারণ করে তখন এ আন্দোলনকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য ইংরেজরা যে সব চাল চালে তার মাঝে এ আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্টদের ওয়াহাবী বলে আখ্যায়িত করার চালটি অন্যতম। ১৮২২ সালে সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ হজ্জ থেকে ফিরে এসে প্রকাশ্যে জিহাদী তৎপরতা শুরু করলে ইংরেজরা তাদের প্রচার মাধ্যমগুলোতে তাকে ওয়াহাবী আন্দোলনের অন্যতম নেতা বলে অপপ্রচার চালাতে থাকে। যেহেতু এদেশের মানুষ আগে থেকেই ওয়াহাবীদের প্রতি বিরুপ ভাবাপন্ন ছিল সুতরাং তাদের এই প্রচারণায় যথেষ্ট সুফল ফলে। এমনকি ইংরেজ ঐতিহাসিক মি: হান্টারতো এই উভয় আন্দোলনকে এক ও অভিন্ন বলেই মন্তব্য করেছেন এবং প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন যে, হজ্জ করতে গিয়ে সাইয়্যিদ আহমদ রাহ: মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাবের শিষ্যত্ব বরণ করে স্বদেশে ফিরে আসেন এবং ভারতবর্ষে ওয়াহাবী আন্দোলনের সূচনা করেন। এর পেছনে যুক্তি হিসাবে তিনি দেখিয়েছেন যে, হজ্জে যাওয়ার আগে সে একজন পীর ছিল মাত্র, হজ্জ থেকে ফিরেই সে ওয়াহাবীদের অনুকরণে জিহাদী তৎপরতা শুরু করে। ওয়াহাবীরাও কবর ও মাযার পূজার বিরোধিতা করে সাইয়্যিদ আহমদও তাই করে ইত্যাদি ইত্যাদি। 

 

আর এই মুজাহিদদেরকে ওয়াহাবী বলে প্রচার করার জন্য ইংরেজরা আহমদ রেজা খানকে টাকার বিনিময়ে ক্রয় করে নেয়। সে তার দল বল নিয়ে আল্লাহর রাহে নিবেদিত স্বাধীনতা কামী মুজাহিদদেরকে ওয়াহাবী বলে সাধারণ মানুষের মাঝে জোড় প্রচারণা চালাতে থাকে, এবং এদেরকে কাফের ও রাসূল বিদ্বেষী বলে ফতওয়া দিয়ে বেড়াতে থাকে। সাধারণ মানুষের মাঝে যারা এ আন্দোলন সম্পর্কে পূর্ব থেকে ওয়াকিফহাল ছিলেন তারা তো ইংরেজদের এই ষড়যন্ত্র সহজেই ধরে ফেলতে পারলেন, কিন্তু যারা এ আন্দোলনের সাথে পূর্ব থেকে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না বা মুজাহিদদের তৎপরতা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল ছিলেন না তারাই এ প্রচারণা দ্বারা বিভ্রান্ত হলেন বেশী। সাধারণ মানুষ ইতিহাসের সূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণ জানেনা বিধায় তারা একথা তলিয়ে দেখেনি যে, মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব ১৭৮৭ সালে মারা গেলেন সুতরাং সাইয়্যিদ আহমদ রাহ: ১৮২২ সালে হজ্জ করতে গিয়ে তাঁর শিষ্যত্ব বরণ করবেন কী রুপে?

এই কিতাবের ২৮৭ পৃষ্ঠায় আহমদ রিদ্বা খান ও তার অনুসারীদের সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, 

 

“ কিন্তু আহমদ রেজা খান এই ফতওয়া নিয়ে ভারতবর্ষে এসে তা ব্যাপকভাবে প্রচার করে সংগ্রামী উলামায়ে কেরামের প্রভাব ক্ষুন্ন করত: স্বাধীনতা আন্দোলনকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করে। তার অনুসারীরা এতটাই বেড়ে যায় যে, তাদের কুসংস্কারের সমর্থক গোষ্ঠী ছাড়া অন্য সব  আলিম-উলামা ও তাদের অনুসারীদেরকে ঢালাওভাবে কাফের ও রাসূল বিদ্বেষী বলে অপপ্রচার করতে সামান্য কুন্ঠাবোধ করে না।  মিলাদ কিয়াম ইত্যাদির মাধ্যমে নবী প্রেমের সস্তা বুলি আওড়িয়ে  সাধারণ মানুষকে তারা বিভ্রান্ত করে চলেছে। এদলটি বর্তমানে বহু জঘন্য বিশ্বাসে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। এরা রাসূল গায়েব জানেন এবং আল্লাহ যেমন সর্বত্র বিরাজ করেন রাসূলও তেমনি সর্বত্র বিরাজ করেন বলে বিশ্বাস করে। তাছাড়া এরা রাসূলকে মানুষ বলে মনে করে না বরং নূরানী এক সত্ত্বা বলে বিশ্বাস করে, এবং সে নূর আল্লাহর খন্ডিত নূর বলে দাবী করে। এদের কেউ কেউ আল্লাহ ও রাসূলকে এক ও অভিন্ন সত্ত্বা বলেও বিশ্বাস করে।”




 





 


 




 

আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া সাহেবের এ বইটি ১৯৯৮ সাল থেকে প্রকাশিত হয়ে আসছে। এবং দীর্ঘ সময় ধরে এটি কওমী মাদ্রাসার মেশকাত জামায়াতের পাঠ্য-তালিকায় অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। এই বইয়ের ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন দেওবন্দী উলামায়ে কেরামের মান্যবর আলিম মাওলানা কাজী মু’তাজিম বিল্লাহ সাহেব। এছাড়া বেফাকের প্রয়াত মহাসচিব আব্দুল জব্বার সাহেবেরও একটি প্রশংসাবাণী রয়েছে। বিষয়বস্তুর দিক থেকে বইটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ হওয়াই মাওলানা মিজান হারুন এই বইয়ের উপর কওমীর বর্তমান প্রজন্মকে যত্নশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। বিশেষ করে আহমাদ রেজা খান ব্রেলভীর খন্ডনে এই বইয়ের আলোচনাকে তিনি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে এর একটি অংশের স্ক্রিনশটও দিয়েছেন। যা আমরা উপরে উল্লেখ করেছি। 

 

আমরা উপরে আহমাদ রেজা খান ব্রেলভী সম্পর্কে এ বইয়ের আলোচনার কিছু কিছু অংশ উল্লেখ করেছি। এই আলোচনাগুলোর সত্য-মিথ্যা বা বাস্তবতা নিয়ে পর্যালোচনার পূর্বে একটি জ্বরুরি কথা বলে নেয়া প্রয়োজন। কোন একটা বিষয় স্পষ্টভাবে ভুল বা মিথ্যা প্রমাণিত হলে সেটার উত্তর হিসেবে অনেকে তা’বীলের পথ অবলম্বন করেন। আমাদের সম্মানিত উস্তায মুফতী নুরুল আমীন সাহেব দা: বা: ক্লাসে প্রায়-ই বলতেন, বা’বুত তা’বীলি মাফতুহুন। অর্থাৎ তা’বীলের রাস্তা খোলা রয়েছে। ভুল-ভাল তা’বীল করে যে কোন বাস্তবতাকে উল্টিয়ে দেয়া সম্ভব। এজন্য কোন একটা ভুল-ভ্রান্তি সুস্পষ্ট হওয়ার পর দেখা যায়, নিজেদের মাসলাক বা চিন্তাধারাকে বাঁচানোর জন্য নানা রকম অপব্যাখ্যার রাস্তা তৈরি করা হয়। আমরা এখানে যেই পর্যালোচনা উল্লেখ করব, এগুলোর উপর এজাতীয় অপব্যাখ্যা এক ধরণের দায়সারা জওয়াব দেয়ার চেষ্টা হতে পারে। কারণ পূর্বেও এধরণের অভিজ্ঞতা হয়েছে। এজন্য নানা অপব্যাখ্যা করে এগুলোর ভুল-ভাল জওয়াব দেয়ার চেষ্টার কথা মাথায় রেখেই নিচের পর্যালোচনাগুলো পড়তে হবে। 

 

সর্বপ্রথম বলে নেয়া প্রয়োজন যে, আহমদ রেজা খান ব্রেলভী বা তার সাথে সংশ্লিষ্ট যেসকল কথা মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া সাহেব লিখেছেন এর অধিকাংশই ঐতিহাসিক ও বাস্তবতার বিচারে মিথ্যা ও অপপ্রচার। প্রায় প্রত্যেকটা লাইন ধরে ধরে এর অসারতা তুলে ধরা সম্ভব। এটা করতে গেলে আলোচনা দীর্ঘ হয়ে যাবে। আমি এখানে মোটাদাগের কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করার চেষ্টা করব ইনশা আল্লাহ। অন্যান্য বিষয়ের পর্যালোচনা আমার অন্য কোন লেখাতে পরবর্তীতে আনার চেষ্টা থাকবে ইনশা আল্লাহ। 


 

উপরের আলোচনায় কিছু অবাস্তব ও মিথ্যা দাবী:

 

১। প্রথম দিকে সে একজন আশেকে রাসূল এবং আধ্যাত্মিক রাহবার হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে এবং আশেকে রাসূল হিসাবে নিজেকে বৈশিষ্ট্য মন্ডিত করার জন্য মিলাদ ও কিয়ামের বিশেষ প্রথার প্রচলন করে। নবী প্রেমের কিছু কবিতা ও না’ত সে রচনা করে সাধারণ্যে প্রচার করতে থাকে। (দেওবন্দ আন্দোলন-২৮৫ পৃষ্ঠা)

 

আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া সাহেবের এই বক্তব্যটি শুধু অবাস্তব বা মিথ্যাই নয় বরং এটি একটি চরম হাস্যকরও বটে। আহমদ রেজা খান বেরলভী নিজেকে আশেকে রাসূল হিসেবে বৈশিষ্ট্য মন্ডিত করার মিলাদ ও কিয়ামের বিশেষ প্রথার প্রচলন করেছেন, এরকম হাস্যকর দাবী একজন আলিম কীভাবে করতে পারেন? মিলাদ - কিয়ামের প্রথার প্রচলন  কি আহমাদ রেজা খান ব্রেলভীর হাত ধরে শুরু হয়েছে? প্রায় হাজার বছর আগের মিলাদ-কিয়ামের প্রথা আহমদ রেজা খানের হাত ধরে কীভাবে শুরু হতে পারে? নাকি যিনি এটি লিখেছেন তিনি জানেনই না যে মিলাদ - কিয়াম কীভাবে শুরু হয়েছে? এখানে এই বক্তব্যের তা’বীল উলামায়ে দেওবন্দের পক্ষ থেকে এরকম হতে পারে যে, মিলাদ - ক্বিয়ামের প্রথার প্রচলন দ্বারা আসলে হিন্দুস্তানের নতুন পদ্ধতির মিলাদ-কিয়াম উদ্দেশ্য। এই তা’বীলের উপর তখন প্রশ্ন আসবে,  আহমদ রেজা খান পূর্ব থেকে চলে আসা মিলাদ-ক্বিয়ামের পদ্ধতিতে কী কী পরিবর্তন এনেছেন যে, তিনি মিলাদ - কিয়ামের প্রথা চালু করেছেন নিজেকে আশেকে রাসূল প্রমাণের জন্য এই দাবী করা সঠিক হতে পারে? 

 

মোটকথা এরকম একটা নিরেট ভুল কথা কীভাবে এধরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ কিতাবে স্থান পেতে পারে সেটি আশ্চর্য্য হওয়ার মতো। 

 

২। মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া সাহেব আহমাদ রেজা খান বেরলভী ও তার অনুসারীদের বিশ্বাস সম্পর্কে লিখেছেন, 

“আল্লাহ যেমন সর্বত্র বিরাজ করেন রাসূলও তেমনি সর্বত্র বিরাজ করেন বলে বিশ্বাস করে।” 

 

এটিও আহমাদ রেজা খান বেরলভী ও তার অনুসারীদের উপর একটি চরম পর্যায়ের মিথ্যাচার। এর চেয়ে বড় ধরণের মিথ্যা দাবী আর হতে পারে না। এই কথা বলা যে, আল্লাহ যেমন সর্বত্র বিরাজ করেন রাসূলও তেমনি সর্বত্র বিরাজ করেন, এটি বেরলভীদের বিশ্বাস, এটি বাস্তবেই বেরলভীদের আকিদা সম্পর্কে না জেনে তাদের উপর মিথ্যাচার। 

 

ক: প্রথমত: আহমাদ রেজা খান বেরলভী বা তার অনুসারীরা আল্লাহ তায়ালাকে সর্বত্র বিরাজমানই বিশ্বাস করে না। বরং তারা আহলে সুন্নতের মৌলিক আকিদা অনুযায়ী আল্লাহ তায়ালাকে স্থান ও দিক থেকে মুক্ত বিশ্বাস করে। 

 

খ: নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর মতো সর্বত্র বিরাজমান এটাও তাদের আকিদা নয় বরং এটি তাদের আকিদা বিরোধী একটি বাতিল কথা। তারা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রুহানী হুজুর বা উপস্থিতির কথা বলেন সম্ভাবনা হিসেবে। অর্থাৎ আল্লাহর ইচ্ছা ও অনুমতিতে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রুহ মোবারক যে কোন জায়গায় উপস্থিত হতে পারেন। এই কথাটি আহমাদ রিদ্বা খানের নিজের বক্তব্য বা মতামত নয়। বরং এটি তিনি ইবনুল কাইয়্যিমের কিতাবুর রুহের আলোচনা থেকে নিয়েছেন। কিতাবুর রুহে রুহকে মূহুর্তে যে কোন জায়গায় উপস্থিত হওয়ার উদারহণ হিসেবে একে সূর্য্যের সাথে তুলনা করা হয়েছে। অর্থাৎ সূর্য্যের আলো যেমন সব-জায়গায় ছড়িয়ে থাকে রুহও তেমনি আল্লাহর সান্নিধ্যে থাকার পরও এটি বিভিন্ন জায়গায় একই সাথে থাকতে পারে। উদাহরণ হিসেবে ইবনুল কাইয়্যিম দলিল দিয়েছেন, হযরত মুসা আ: এর রুহ কবরে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়েছে আবার তার সাথেই আসমানে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাক্ষাৎ ও কথোপকথন হয়েছে। 

 

গ: যদি ধরেও নেয়া হয়, তারা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সব জায়গায় বিরাজমান বিশ্বাস করে, এরপরও তারা আল্লাহর মতো নবীজীকে সর্বত্র বিরাজমান বিশ্বাস করে এটা কীভাবে সাব্যস্ত হতে পারে? এই যে আল্লাহর সাথে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাদৃশ্য দেয়া হচ্ছে, এটা তাদের নামে কীভাবে চালান হলো? তারা কি এটা কোথাও বলেছে? বা আহমদ রেজা খান কি এধরণের কোন কথা লিখেছে?

 

আল্লাহ তায়ালাকে স্থান ও দিকে বিশ্বাসের আকিদার বিরুদ্ধে খোদ আহমাদ রেজা খান যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, এর বিপরীতে তার উপরই এমন মিথ্যাচার করা যে নবীজীকে নাউজুবিল্লাহ আল্লাহর মতো সর্বত্র বিরাজমান বিশ্বাস করে, এর চেয়ে মিথ্যা দুনিয়াতে আর কী হতে পারে?

 

চলুন আল্লাহর স্থান ও দিক থেকে মুক্ত হওয়ার বিষয়ে আহমাদ রিদ্বা খানের কিছু বক্তব্য দেখে নেয়া যাক। আহমদ রেজা খান বেরলভীর একটি বিখ্যাত কিতাবের নাম হলো, “কাওয়ারিউল কাহহার ফির রদ্দি আলা মুজাসসিমাতিল ফুজ্জার”। এই কিতাবটি তিনি লিখেছেন, এজাতীয় বাতিল আকিদা খন্ডনের জন্য। এই কিতাবে তিনি লিখেছেন, 

 

“ সাদৃশ্যবাদীরা আল্লাহর সিফাত অস্বীকারকারীদের বিপরীত। তারা এক্ষেত্রে ছাড়াছাড়িতে লিপ্ত হয়েছে। এদেরকে হাশাবিয়া বা মুজাসসিমাও (দেহবাদী) বলা হয়। এই খবীসরা প্রকাশ্যভাবে এই আকিদা গ্রহণ করেছে যে, আল্লাহর স্থান, দিক ও দেহ রয়েছে। আল্লাহর যেহেতু স্থান, দিক ও দেহ রয়েছে, এজন্য তার বসা-দাঁড়ান, ওঠা-নামা, চলন ও স্থির হওয়া সবই আছে।  এরা হলো সেই প্রত্যাখ্যাত দল যাদের সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, তাদের অন্তরে বক্রতা রয়েছে। তাদেরকে পথভ্রষ্ট ও ফেতনাকারী আখ্যা দেয়া হয়েছে। 

 

প্রিয় ভাই, জেনে রেখো যে, নাপাক ওয়াহাবীরা পূর্ববর্তী বিভিন্ন বাতিল ফেরকার পরিত্যক্ত ভ্রান্তিগুলোকে জমা করে সেগুলো নিজেদের জন্য গ্রহণ করেছে। তারা আস্তে আস্তে বিভিন্ন বাতিল ফেরকার ভ্রান্তির পথে হেঁটেছে। অন্যান্য ভ্রান্তির পাশাপাশি তাদের অভ্যাস অনুযায়ী দেহবাদ ও সাদৃশ্যবাদের ক্ষেত্রেও বাতিল মতাদর্শের অনুসারী হয়েছে। ওহাবীদের নেতা ইসমাইল দেহলভী তার সিরাতে মুস্তাকিম কিতাবে তার জাহেল পীরের জন্য আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ ও হাতে - হাত রেখে মোসাফাহার কথা যখন লিখেছে, তার পরবর্তী প্রজন্ম নিরেট দেহবাদী বাতিল আকিদা গ্রহণ করেছে। এই মাজহাবের বুনিয়াদ রেখেছে তাদের মতাদর্শের নেতা ইসমাইল দেহলভী তার ‘ইদাহুল হক্কিস সরীহ কিতাবে’। সেখানে সে বলেছে, আল্লাহ তায়ালাকে স্থান ও দিক থেকে মুক্ত বিশ্বাস করা বিদয়াত ও ভ্রষ্টতা। তার খন্ডনে আমি ‘আল-কাউকাবাতুশ শিহাবিয়্যাহ’ নামক কিতাব রচনা করেছি। আমি সেখানে শাহ আব্দুল আজীজের তুহফায়ে ইসনা আশারিয়্যাহ কিতাব থেকে উদ্ধৃতি এনে দেখিয়েছি যে, তিনি বলেছেন, আহলে সুন্নতের মতে আল্লাহর জন্য কোন স্থানের প্রয়োজন নেই, আল্লাহর জন্য স্থান, দিক, উপর-নিচ সাব্যস্ত হতে পারে না। 

 

বাহরুর রায়েক ও ফতোয়ায়ে হিন্দিয়াতে থেকে বক্তব্য এনে দেখিয়েছি যে, এধরণের বক্তব্যের কারণে কুফুরী হয়। কারণ এর মাধ্যমে আল্লাহর জন্য স্থান সাব্যস্ত করা হয়। আর আল্লাহর জন্য স্থান সাব্যস্ত করা কুফুরী। ফতোয়ায়ে কাজী খান থেকে উদ্ধৃত করেছি যে, কেউ যদি একথা বলে যে, আল্লাহ আসমানের উপর থেকে জানেন যে, আমার কাছে কিছুই নেই। এধরণের বক্তব্য কুফুরী হবে। কারণ, আল্লাহ তায়ালা স্থান থেকে মুক্ত। খোলাসাতুল ফতোয়া থেকে উদ্ধৃত করেছি যে, কেউ যদি বলে যে, তীর-ধনুক নিয়ে আসমানে যাও এবং আল্লাহর সাথে যুদ্ধ করো, তাহলে এটি কুফুরী হবে। কারণ সে আল্লাহর জন্য স্থান সাব্যস্ত করেছে। 

 

[কাওয়ারিউল কাহহার, পৃ: ১৩১-১৩৪ ]




 


 



 


 



 


 

মোটকথা, যেই আকিদা-বিশ্বাস খোদ আহমাদ রেজা খান বেরলভীর কাছে বাতিল ও কুফুরী, সেই আকিদা তার উরপ চাপিয়ে দিয়ে এই দাবী করা যে, আহমাদ রেজা খান নবীজী সাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ যেমন সর্বত্র বিরাজমান ওই রকম সর্বত্র বিরাজমান মনে করে, এর চেয়ে চরম পর্যায়ের মিথ্যাচার আর কী হতে পারে?

 

৪। তাছাড়া এরা রাসূলকে মানুষ বলে মনে করে না বরং নূরানী এক সত্ত্বা বলে বিশ্বাস করে, এবং সে নূর আল্লাহর খন্ডিত নূর বলে দাবী করে।

 

এটাও আহমদ রেজা খান বা তার প্রকৃত অনুসারীদের উপর মিথ্যাচার। এ বিষয়ে মাওলানা মিজান হারুন তো আরও এক ধাপ এগিয়ে আহমদ রেজা খান খ্রিষ্টান বা হিন্দুদের মতো অবতারের আকিদায় বিশ্বাস করে এধরণের একটি অপবাদমূলক লম্বা আলোচনা করেছে। এখানে কয়েকটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য,

 

ক: নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাশারিয়াত বা মানুষ হওয়াকে অস্বীকার করা কুফুরী। 

খ: নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহর খন্ডিত নূর মনে করাও কুফুরী। 

 

এ দু’টি বিষয় খোদ আহমদ রেজা খান তার কিতাবে স্পষ্টভাবে লিখে গিয়েছেন। আমরা পরের পর্বে মিজান হারুনের অবতার বিষয়ক অপবাদ ও মিথ্যাচারের আলোচনায় খোদ আহমদ রেজা খানের কিতাব থেকে তার বক্তব্য দেখাব ইনশা আল্লাহ। 

 

৫। এদেশের গণ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়া ইংরেজ বিরোধী জিহাদী চেতনাকে অবদমিত করার জন্য ইংরেজরা যেসব ব্যক্তিবর্গকে জিহাদের বিধান রহিত বলে অপপ্রচার চালানোর জন্য ভাড়াটে হিসেবে নিয়োগ করেছিল, আহমদ রেজা খান ছিল তাদের অন্যতম। তবে সে গোলাম আহমদের মত জিহাদের বিধান রহিত করার জন্য নিজেকে নবী হিসেবে দাবী না করে অন্যপন্থা অবলম্বন করেছিল।

 

এটাও আহমাদ রেজা খানের উপর মিথ্যাচার। জি-হা-দের বিধান রহিত এজাতীয় কথা আহমাদ রেজা খান কোথায় বলেছেন? আর ইংরেজরা যে আহমাদ রেজাকে টাকার বিনিময়ে ক্রয় করেছে বা ভাড়াটে হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে এই কথারই বা দলিল কী? নাকি কোন ধরণের প্রমাণ ছাড়া লাগামহীনভাবে যে কোন কথা বলে দেয়া যায়? 

 

৬। পুরো আলোচনার মধ্যে সবচেয়ে মজার একটি বিষয় হলো এ বইয়ের ২৮৯ পৃষ্ঠায় আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়াহ সাহেব লিখেছেন,

 

“ ভারতে যখন হযরত সাইয়্যিদ আহমদ শহীদের নেতৃত্বে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন চূড়ান্ত রুপ ধারণ করে তখন এ আন্দোলনকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য ইংরেজরা যে সব চাল চালে তার মাঝে এ আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্টদের ওয়াহাবী বলে আখ্যায়িত করার চালটি অন্যতম। ১৮২২ সালে সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ হজ্জ থেকে ফিরে এসে প্রকাশ্যে জিহাদী তৎপরতা শুরু করলে ইংরেজরা তাদের প্রচার মাধ্যমগুলোতে তাকে ওয়াহাবী আন্দোলনের অন্যতম নেতা বলে অপপ্রচার চালাতে থাকে। যেহেতু এদেশের মানুষ আগে থেকেই ওয়াহাবীদের প্রতি বিরুপ ভাবাপন্ন ছিল সুতরাং তাদের এই প্রচারণায় যথেষ্ট সুফল ফলে। এমনকি ইংরেজ ঐতিহাসিক মি: হান্টারতো এই উভয় আন্দোলনকে এক ও অভিন্ন বলেই মন্তব্য করেছেন এবং প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন যে, হজ্জ করতে গিয়ে সাইয়্যিদ আহমদ রাহ: মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাবের শিষ্যত্ব বরণ করে স্বদেশে ফিরে আসেন এবং ভারতবর্ষে ওয়াহাবী আন্দোলনের সূচনা করেন। এর পেছনে যুক্তি হিসাবে তিনি দেখিয়েছেন যে, হজ্জে যাওয়ার আগে সে একজন পীর ছিল মাত্র, হজ্জ থেকে ফিরেই সে ওয়াহাবীদের অনুকরণে জিহাদী তৎপরতা শুরু করে। ওয়াহাবীরাও কবর ও মাযার পূজার বিরোধিতা করে সাইয়্যিদ আহমদও তাই করে ইত্যাদি ইত্যাদি। 

 

আর এই মুজাহিদদেরকে ওয়াহাবী বলে প্রচার করার জন্য ইংরেজরা আহমদ রেজা খানকে টাকার বিনিময়ে ক্রয় করে নেয়। সে তার দল বল নিয়ে আল্লাহর রাহে নিবেদিত স্বাধীনতা কামী মুজাহিদদেরকে ওয়াহাবী বলে সাধারণ মানুষের মাঝে জোড় প্রচারণা চালাতে থাকে, এবং এদেরকে কাফের ও রাসূল বিদ্বেষী বলে ফতওয়া দিয়ে বেড়াতে থাকে। সাধারণ মানুষের মাঝে যারা এ আন্দোলন সম্পর্কে পূর্ব থেকে ওয়াকিফহাল ছিলেন তারা তো ইংরেজদের এই ষড়যন্ত্র সহজেই ধরে ফেলতে পারলেন, কিন্তু যারা এ আন্দোলনের সাথে পূর্ব থেকে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না বা মুজাহিদদের তৎপরতা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল ছিলেন না তারাই এ প্রচারণা দ্বারা বিভ্রান্ত হলেন বেশী। সাধারণ মানুষ ইতিহাসের সূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণ জানেনা বিধায় তারা একথা তলিয়ে দেখেনি যে, মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব ১৭৮৭ সালে মারা গেলেন সুতরাং সাইয়্যিদ আহমদ রাহ: ১৮২২ সালে হজ্জ করতে গিয়ে তাঁর শিষ্যত্ব বরণ করবেন কী রুপে?

 

মজার বিষয় হলো, একই ধরণের বক্তব্য তিনি বইয়ের ১৫২ পৃষ্ঠাতেও এনেছেন। সেখানে তিনি সাইয়্যিদ আহমদ বেরলভীর হজ্ব থেকে ফিরে আসার পরে তাদের দলের মুজাহিদিনকে ওয়াহাবী বলার জন্য আহমাদ রেজা খানকে দায়ী করেছেন। আশ্চর্য্যের বিষয় হলো, উক্ত লেখাটি মাওলানা মিজান হারুন স্ক্রিনশট নিয়ে প্রচারও করেছেন। অথচ এই দুই জায়গায় একটি আজীব দাবী পেশ করা হয়েছে। লেখক যেভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন, এটিকে বাস্তব ধরে নিলে এটিকে পৃথিবীর সেরা কারামত বলতে হবে। আব্দুল কাদের জিলানীর নামে বিভিন্ন আজগুবী কারামত থাকলেও এই ধরণের কারামত বর্ণিত আছে কি না সন্দেহ। 

 

মূল বিষয় হলো, আহমদ রেজা খানের জন্মই হয়েছে ১৮৫৬ সালে। অথচ লেখক তার বইয়ের দু’জায়গায় সাইয়্যেদ আহমাদ বেরলভীদের হজ্ব থেকে ফিরে আসার পরে তাদেরকে ওয়াহাবী বলার ষড়যন্ত্রের জন্য দায় চাপাচ্ছেন আহমাদ রেজা খানের উপর। এবং লেখক নিজেও উল্লেখ করেছেন, সাইয়্যিদ আহমদ বেরলভীর হজ্ব থেকে ফিরে আসার ঘটনাটি ঘটেছে ১৮২২-২৩ সালে। অর্থাৎ লেখকের কথা আমলে নিলে আহমদ রেজা খান বেরলভী তার জন্মের প্রায় ৩৩ বছর আগে সাইয়্যিদ আহমদ বেরলভীর অনুসারী মুজাহিদ বাহিনীকে ওয়াহাবী অপবাদ দিয়েছে। কোন ব্যক্তি যে তার জন্মের ৩৩ বছর আগে এভাবে একটা ঘটনার জন্য দায়ী হতে পারে সেটা কীভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে? যদি বলি যে, এটি বাস্তবেই এমন হয়েছে, তাহলে এটা হবে পৃথিবীর সেরা একটি কারামত। এমন কারামত যা খোদ বেরলভীরাও কোন দিন হয়ত কল্পনা করেনি। আর যদি বলা হয় এটা বাস্তব না, তাহলে সাইয়্যিদ আহমাদ বেরলভীর হজ্ব থেকে ফেরত আসার পরে তাদেরকে ওয়াহাবী বলার জন্য আহমদ রেজা খান কীভাবে দায়ী হোন? যা তার জন্মের প্রায় ৩৩ বছর আগের ঘটনা? নতুবা লেখকের বক্তব্য আজীব কোন তা’বীল বের করতে হবে। আমি নিজেও একটা দু’টো তা’বীল লিখতে পারতাম, তবে এটি তা’বীল বের করতে সিদ্ধহস্তদের জন্য ছেড়ে দিলাম। তারা এই ঘটনার ব্যাখ্যা দিবে যে, জন্মের ৩৩ বছর আগের বিষয়ের জন্য একজন ব্যক্তি কীভাবে দায়ী হতে পারে? 

 

এভাবে মিথ্যার বাজার বসিয়ে বেরলভীদের খন্ডনের চেষ্টা হচ্ছে। অন্য দিকে মিজান হারুন সাহেব আফসোস করছেন, এজাতীয় মিথ্যার বেসাতির উপর অন্যরা কেন বিশ্বাস করছে না বা এই কিতাবকে আরও গুরুত্ব কেন দেয়া হচ্ছে না? আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া সাহেব যেভাবে লাইনে লাইনে অবাস্তব কথা লিখেছেন, এর বিস্তারিত খন্ডন করতে গেলে স্বতন্ত্র বই হয়ে যাবে। সংক্ষিপ্তভাবে মোটাদাগের কিছু বিষয় এখানে লিখেছি। পরবর্তী পর্বে ইনশা আল্লাহ নবীজীর নূর ও বাশার নিয়ে আহমদ রেজা খানের উপর মাওলানা মিজান হারুনের মিথ্যাচারের বাস্তবতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব ইনশা আল্লাহ। 

------ ------

লেখকের আরো ব্লগ

ইতিহাস

আহমাদ রিদা খান ব্রেলভীর বিরুদ্ধে মিজান হারুনের অপপ্রচার ও মিথ্যাচার (২য় পর্ব)

Ijharul Islam শনি, 21 ডিসে., 2024

এই পর্বে মাওলানা মিজান হারুনের একটি চরম মিথ্যাচারমূলক পোস্টের পর্যালোচনার উদ্দেশ্যে লিখছি। এটি যদিও হিন্দুস্তান - পাকিস্তানের দেওবন্দী আলিমরা বিষয়টি নিয়ে পুরোপুরি অপব্যাখ্যা করে না, তবে এদেশের অনেক আলিম বিষয়টি নিয়ে বেশ বিভ্রান্তি ছড়িয়ে থাকে। গত পর্বে আমরা দেখেছি, মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া সাহেব বিষয়টিকে আহমাদ রিদ্বা খান ব্রেলভীর আকিদার সম্পূর্ণ বিপরীত বক্তব্য তার বা তার দলের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। সেই সাথে মাওলানা মিজান হারুন তো আরও এক ধাপ এগিয়ে বিষয়টিকে হিন্দু-খ্রিষ্টানদের অবতারের আকিদার সাথে মিলিয়ে দিয়েছে। অথচ বিষয়টি আহমদ রিদ্বা খান বেরেলভীর উপর চরম মিথ্যাচার। এটি যে কতো বড় মিথ্যাচার সেটি পরবর্তী পর্যালোচনা দেখলেই আশা করি ইনশা আল্লাহ স্পষ্ট হবে।

শুরুতেই মাওলানা মিজান হারুনের বক্তব্যটি দেখে নেয়া যাক। তিনি লিখেছেন,

“ প্রসিদ্ধ মানুষদেরকে ঈশ্বরের অবতার কল্পনা করার ধারণা অনেক প্রাচীন। ভারতে রাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ প্রমুখ ব্যক্তিকে নানান ঈশ্বরের অবতার হিসেবে কল্পনা করেছে তারা। পরবর্তীতে এই আকীদা খ্রিস্টানরা গ্রহণ করে ঈসা (আ.) কে আল্লাহর 'অবতার' বানায়। ‌'মানুষ ঈসা' এর পরিবর্তে 'খোদার পুত্র', 'মানুষরূপী খোদা' হিসেবে গ্রহণ করে।

এই আকীদা যাতে মুসলমানদের মাঝে প্রবেশ না করে এজন্য কুরআন-সুন্নাহ প্রথম থেকেই এব্যাপারে সুস্পষ্ট থেকেছে। কুরআন শুরু থেকেই ফিরিশতাদেরকে নূরের স্বতন্ত্র সৃষ্টি, জিনদেরকে আগুনের স্বতন্ত্র সৃষ্টি আর নবী-রাসূলদেরকে সুস্পষ্ট শব্দে ‌'মানুষ', ‌'বাজার করেন‌‌‌', 'খাওয়া-দাওয়া করেন', ‌'অসুস্থ হন'- এমন প্রচুর শব্দে ব্যাখ্যা করেছে। বরং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর অবতীর্ণ প্রথম ওহীতে তাকে ‌'রক্তপিণ্ড থেকে সৃষ্ট মানুষ‌' আখ্যা দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় স্পষ্ট করতে বলা হয়েছে, ‌শোনো আমি তোমাদের মতোই মানুষ। পার্থক্য কেবল এটুকু যে আমার কাছে ওহী আসে। মুজিযা প্রকাশ পায়। এভাবে বলা হয়েছে, যাতে মুসলমানরা পূর্ববর্তী জাতিগুলোর মতো ভুল না করে।

কিন্তু দুর্বল ও ভ্রষ্ট চিন্তার কিছু মানুষেরা শেষপর্যন্ত ভ্রষ্টতাকেই গ্রহণ করলো। আলী (রা.) কে 'খোদার অবতার' কল্পনা করার মধ্য দিয়ে এই বিচ্যুতি শুরু হয়েছিল। ইহুদি ও খ্রিস্টানদের কাছ থেকে ধার করা হয়েছিল এই কুসংস্কার। সালাফের আলিমগণের কঠোর প্রতিবাদের মুখে সেটা প্রত্যাখ্যাত হয়। পরবর্তী সময়ে ইবনে মানসূর হাল্লাজসহ কিছু সূফী রাসূলুল্লাহ আদি ও অনন্ত নূরৈর তৈরি এমন আকীদা বানায়। কিন্তু সেটাও প্রত্যাখ্যাত হয়।

অতঃপর ইসলামের হাজার বছর পরে 'অবতার' কেন্দ্রিক এই বিভ্রান্তিকে নতুন করে উম্মাহর সামনে নিয়ে আসেন আহমদ রেজা খান। রাসূলুল্লাহ (সা.) কে সরাসরি ‌'আল্লাহর অবতার' না বললেও তাঁর বাশারিয়্যাত তথা মানুষ হওয়াকে (প্রকারান্তরে) অস্বীকার করেন। কুরআন ও সুন্নাহর বক্তব্যকে সুস্পষ্ট অপব্যাখ্যা করে মানুষ রাসূলকে ‌নূরের তৈরি এক এলিয়েন (অপরিচিত সৃষ্টি) বানিয়ে দেন। যা মূলত 'অবতার' কেন্দ্রিক কুসংস্কার থেকে উৎসারিত। নবী-রাসূলদেরকে আল্লাহ মানুষের মাঝ থেকে মানুষের জন্য নির্বাচিত করেন। ভিন্নগ্রহ থেকে ভিন্ন কেনো প্রাণীকে রাসূল করে পাঠানো হয়নি। নবী-রাসূলদের বাবা-মায়ের সৃষ্টিগত প্রকৃতি যেমন, নবী-রাসূলরাও তেমন। আব্দুল্লাহ ও আমিনার মাধ্যমে যিনি পৃথিবীতে এসেছেন, তিনি তাদের পুত্র; ঈশ্বরের অবতার নন। এমন হলে পিতা-ছাড়া জন্ম নেয়া ঈসাকে খোদারপুত্র বললে খ্রিস্টানরা ভ্রান্ত গণ্য হবে কেন?

ইসলাম কোনো রহস্য, ভাওতাবাজি, অস্পষ্টতা, অন্ধকার, কুসংস্কার, বাঁকানো-পেঁচানোকে প্রশ্রয় দেয় না। ইসলাম বাস্তববাদী জীবনব্যবস্থা। আকীদার যেখানেই রাখঢাক দেখবেন, কুটিলতা দেখবেন, অস্পষ্টতা ও রহস্যময়তা দেখবেন, পরিহার করবেন। বুঝবেন অন্য ধর্ম কিংবা দর্শনের বীজ রয়েছে এখানে।”

 

আহমাদ রিদ্বা খান বেরলভীর বিরুদ্ধে তার মূল অভিযোগ হলো,

“রাসূলুল্লাহ (সা.) কে সরাসরি ‌'আল্লাহর অবতার' না বললেও তাঁর বাশারিয়্যাত তথা মানুষ হওয়াকে (প্রকারান্তরে) অস্বীকার করেন। কুরআন ও সুন্নাহর বক্তব্যকে সুস্পষ্ট অপব্যাখ্যা করে মানুষ রাসূলকে ‌নূরের তৈরি এক এলিয়েন (অপরিচিত সৃষ্টি) বানিয়ে দেন। যা মূলত 'অবতার' কেন্দ্রিক কুসংস্কার থেকে উৎসারিত।”

 

 

 

 

 

এখানে আমহদ রিদ্বা খানের বিরুদ্ধে মিজান হারুনের মূল অভিযোগ ছিলো, আহমদ রিদ্বা খান নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাশারিয়্যাত তথা মানুষ হওয়াকে অস্বীকার করেন। প্রথম দিকে সরাসরি এভাবেই তিনি লিখেছিলেন। পরে ব্রাকেটে (প্রকারান্তরে) কথাটি যোগ করেছেন। শুরুতে আমি সরাসরি অস্বীকার করার বিষয়টি দেখি। পরবর্তীতে তিনি যে পোস্ট এডিট করেছেন, সেটিও তার পোস্টের হিস্টোরি থেকে স্পষ্ট। পোস্টের ভুল সংশোধন করে এডিট করাটা কোন অন্যায় নয়। কিন্তু সরাসরি আহমদ রিদ্বা খানের বিরুদ্ধে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাশারিয়াত অস্বীকার করার মতো বিষয়টির অভিযোগ করার আগে বিষয়টি উনার তাহকিক করা প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু উনার বর্ণনা ভঙ্গি এবং এডিট থেকে বোঝা যাচ্ছে পোস্টের আগে ও পরে তিনি বিষয়টি সঠিকভাবে যাচাই করেননি। এখানে মিজান হারুন যেভাবে তার প্রাথমিক বক্তব্য সংশোধন করেছেন, আমরা আশাবাদি তিনি আমাদের পর্যালোচনার বাকী বিষয়ের ভুল থেকেও সংশোধনের উদ্দোগ নিবেন। এডিট হিস্টোরির স্ক্রিনশট:

 

 

 

 

 

 

 

 


 

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মানুষ হওয়া বিষয়ে আহমাদ রিদ্বা খানের আকিদা কী ছিলো?

 

আরবীতে একটি বিখ্যাত প্রবাদ হলো, আল-ফদলু মা শাহিদাত বিহিল আ’দা। শত্রুর পক্ষ থেকে কোন প্রশংসা বা সাক্ষী পাওয়াটা অনেক বড় বিষয়। অর্থাৎ এই মাসআলায় বেরেলভীর সবচেয়ে প্রতিদ্বন্ধী হিসেবে পরিচিত দেওবন্দী উলামায়ে কেরাম যদি স্বাক্ষ্য দেন যে, এ বিষয়ে বেরেলভীর আকিদা কি তবে সেটি বেশ শক্তিশালী ও পাকাপোক্ত একটি স্বাক্ষ হিসেবে বিবেচিত হয়। 


 

দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে প্রকাশিত মুফতী আমীন পালনপুরীর লিখিত ‘মুহাদারায়ে ইলমিয়্যাহ বর মাউজুয়ে রেজাখানিয়্যাত’ বইটি বিশেষভাবে ব্রেলভীদের খন্ডনে লিখিত একটি কিতাব। এটি মূলত: দারুল উলুমের বিভিন্ন ফিরাকে বাতেলার খন্ডনে লিখিত সিরিজ কিতাবের একটি। এই কিতাবের ১২৫ পৃষ্ঠায় মুফতী আমিন পালনপুরী স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন, আহমদ রিদ্বা খান বা তার অনুসারীরা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বাশার বা মানুষ মনে করে। এবং কেউ যদি নবীজীর বাশারিয়্যাত তথা মানুষ হওয়াকে অস্বীকার করে তাহলে তারা তাকে কাফের বলে। 

 

মুফতী আমীন পালনপুরী আলোচনার মৌলিক অংশটির অনুবাদ নিচে দেয়া হলো,

 

“এই মাসআলায় সমস্ত আহলে সুন্নতের আক্বিদা-বিশ্বাস হলো, নবীজী সাল্লাল্লাহু যদিও মানব প্রজাতির অংশ হিসেবে মানুষ তবে তিনি গুণ ও পরিপূর্ণতার বিচারে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোন তুলনা বা দৃষ্টান্ত নেই। হযরত মাওলানা ইউসুফ লুধিয়ানবী তার ‘ইখতিলাফে উম্মত আউর সিরাতে মুস্তাকীম’ কিতাবে লিখেছেন, 

 

  • “নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে আমার আকিদা হল, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের সত্ত্বার দিক থেকে তিনি শুধু মানুষ নন বরং তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। তিনি শুধু ইনসান বা মানব নন, তিনি মহামানব। তিনি শুধু আদম আ: এর বংশের নন বরং তিনি আদম আলাইহিস সালাম ও তার সন্তানদের জন্য আপাদমস্তক গর্বের বিষয়। খোদ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,  কিয়ামতের দিন আমি আদম সন্তানের সরদার থাকব। (মেশকাত শরীফ, পৃ: ৫১১)। এজন্য নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মানুষ, মানব বা ইনসান হওয়াটা শুধু নবীজীর জন্য গর্বের বিষয় নয় বরং এটি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষ হওয়ার কারণে মানবজাতি ফেরেশতাদের ঈর্ষার বিষয় হয়েছে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের সত্ত্বার দিক থেকে যেমন মানুষ, একইভাবে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিদায়াতের গুণের দিক থেকে সমস্ত মানবজাতির আলোকবর্তিকা। এটি সেই নূর যার আলোয় মানবজাতি আল্লাহর রাস্তা পেতে পারে। এবং যার আলো চিরকাল স্বমহিমায় প্রজ্জ্বলিত থাকবে। এজন্য আমার আক্বিদা হলো, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একই সাথে নূর এবং বাশার (মানব)। এবং আমার নিকট নূর ও বাশারকে দু’ভাগে ভাগ করে একটা সাব্যস্ত করা এবং আরেকটা অস্বীকার করা ভুল” 

(ইখতিলাফে উম্মত আউর সিরাতে মুস্তাকীম, পৃ: ৩৭)


 

এবং রেজাখানি আলিমদের আক্বিদাও এটি যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাশার ও ইনসান। এবং যে ব্যক্তি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বাশার ও ইনসান মনে করবে না সে তাদের নিকট কাফের। মুফতী আহমাদ ইয়ারখান নইমী তার ‘শানে হাবীবুর রহমান’ বইয়ে লিখেছেন, 

  • “প্রত্যেক মুসলমানের আক্বিদা হলো, নবীগণ আল্লাহর বান্দা এবং তার প্রিয়ভাজন। তাদের আগমন ঘটেছে মানবজাতির মাঝে। তবে তাদেরকে হে মানুষ, হে ভাই, হে ইনসান বা এজাতীয় শব্দে ডাকা নিষেধ, যদি অপমানের নিয়তে এসব শব্দে ডাকে, তবে এই ব্যক্তি কাফের হয়ে যাবে” 

(শানে হাবীবুর রহমান, পৃ: ১০৩)

 

রেজাখানীদের শাইখুল ইসলাম সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ মাদানী নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফজীলতের উপর আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন, 

“ আমাদের উপর অপবাদ দেয়া হয় যে আমরা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মানব মনে করি না, আমরা নবীজীকে বাশার মনে করি না। আমি পুরো দাবীর সাথে ইতমিনান ও ইয়াকীনের সাথে বলছি যে, আকিদা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বাশার বা মানুষ মনে না করে, ইনসান মনে না করে সে কাফের। এর চেয়ে বেশি আর কী বলা যেতে পারে? প্রশ্ন তো এটা নয় যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষ কি না। প্রশ্ন তো তখন ওঠে যখন তোমরা বলো, তিনি আমাদের মতো মানুষ।”

(খুতুবাতে বিরিতানিয়া, পৃ: ১৪৩)

 

এসব আলোচনা থেকে জানা গেল যে, এই মাসআলায় কোন বিরোধ নেই। 

(মুহাদারাতে ইলমিয়া বর মাউদুয়ে রদ্দে রেজাখানিয়াত, পৃ: ১২৫, ১২৬)

(অনুবাদ শেষ হলো)।

 

এখানে মুফতী আমীন পালনপুরী খুব স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করলেন যে, ব্রেলভীরা আল্লাহর রাসূলের বাশারিয়াত বা মানুষ হওয়ার অস্বীকারকারীকে কাফের মনে করে। এবং আলোচনার শেষে তিনি এও বললেন যে, এই মাসআলায় দেওবন্দীদের সাথে বেরেলভীদের সাথে মৌলিক কোন বিরোধ নেই। তবে কুরআনের কিছু কিছু আয়াতের তাফসীরের ক্ষেত্রে কিছু বিরোধ আছে। তবে সেটি মৌলিক বিরোধ নয়। 


 





 

এবার চলুন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাশারিয়াত সম্পর্কে খোদ আহমাদ রিদ্বা খানের আকিদা-বিশ্বাস তার কিতাব থেকে জেনে নেই। 

 

১। মাওলানা ফজলে রাসূল বাদায়ূনীর বিখ্যাত কিতাব আল-মু’তাকাদুল মুনতাকাদ এ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য কোনটি আবশ্যকীয়, কোনটি নবীজীর জন্য অসম্ভব এবং কোনটি জায়েজ এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি বলেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য সেসব বিষয় হওয়া জায়েজ যেগুলো মানবীয় বৈশিষ্ট্যের সাথে সম্পর্কিত। যেমন, আল্লাহর পক্ষ থেকে বিভিন্ন পরীক্ষা, দু:খ-দুর্দশার, অসুস্থ্যতা ইত্যাদির সম্মুখীন হয়েছেন। একইভাবে বকরী চরান, ইয়াতীম হওয়া। সেই সাথে দুনিয়াবী যেসব কাজের সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন সেগুলোও মূলত: নবীজীর মর্যাদার বিষয়। যেমন, তার দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি, যুহদ, আহার, বস্ত্র, বাস-স্থান, কষ্ট-ক্লেশ সবই মানবীয় বৈশিষ্ট্য হিসেবে নবীজীর সম্মান ও মর্যাদার বিষয়। এগুলো নবীজীর নবী হওয়ার বিরোধী নয়। 

 

মাওলানা বাদায়ূনীর এ কিতাবের টীকা লিখেছেন, মাওলানা আহমাদ রিদ্বা খান বেরেলভী। 


 

সম্পূর্ণ বক্তব্যের স্ক্রিনশ নিচে দেয়া হলো,


 


 




 



 

একই কিতাবের ৯৫ পৃষ্ঠায় বিষয়গুলো আরও বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। মাওলানা বাদায়ূনী লিখেছেন,

“জেনে রাখা দরকার যে, আম্বিয়াগণ হলেন আল্লাহ ও বান্দার মাঝে মধ্যস্ততাকারী। এজন্য তাদেরকে ফেরেশতাদের রুহানিয়াত ও মানবীয় উভয় গুণের মধ্যবর্তী স্তর হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে। তারা আল্লাহর গুপ্ত রহস্যের অধিকারী, প্রকাশ্য নূরানিয়াতের আধার।  সুতরাং তারা দেহ ও প্রকাশ্য শরীরের বিবেচনায় মানুষ, তবে রুহ বা আধ্যাত্মিকতার বিবেচনায় ফেরেশতাদের সদৃশ। এজন্য নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 

“ আমি তোমাদের আকৃতিতে নই”

অর্থাৎ গুণাগুণ ও মূলের দিক থেকে আমি তোমাদের মত নই। এবং তিনি এও বলেছন, আমি আল্লাহর সান্নিধ্যে রাত কাটায়, তিনি আমাকে খাওয়ান, তিনি পান করান। 

সুতরাং তাদের বাহ্যিক অবয়ব, আকার-আকৃতি, দেহ মোবারক মানুষের গুণে গুণান্বিত। মানুষ হিসেবে দেহের উপর বিভিন্ন সময় অসুস্থতা ইত্যাদি দেখা দেয়, সেগুলোও তাদের দেহ মোবারকে হয়। তবে তাদের রুহানিজগৎ ফেরেশতাদের মতো সব ধরণের পঙ্কিলতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। মানবীয় দেহের রুহের উপর যেসব ত্রুটি ও পঙ্কিলতা দেখা দেয়, তাদের অভ্যন্তর এগুলো থেকে মুক্ত ও পবিত্র।”

(আল-মু’তাকাদুল মুনতাকাদ, পৃ: ৯৫)



 

একই ধরণের কথা আহমদ রিদ্বা খান বেরেলভী নূর ও বাশার সংক্রান্ত তার বিভিন্ন কিতাবে উল্লেখ করেছেন। আমি তার কিতাব থেকে কিছু উদ্ধৃতি উল্লেখ করছি। আহমদ রিদ্বা খান বেরেলভীর মাজমুয়ায়ে রাসাইলে নূর নামে নূর ও বাশার সংক্রান্ত সবগুলো পুস্তক সংকলন করে ছাপা হয়েছে। এই কিতাবের ৬৬ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, 

 

“ তিনি (নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মানুষ ছিলেন তবে উর্ধ্বজগৎ থেকে লক্ষ গুণ মর্যাদাশীল। তাঁর দেহ মোবারক মানবীয় ছিলো তবে তিনি ফেরেশতা ও রুহদের থেকে হাজারগুণ সূক্ষ্ম। এজন্য তিনি নিজেই বলেছেন, আমি তোমাদের মত নই (বোখারী)। অন্য বর্ণনায় আছে, আমি তোমাদের গঠন প্রকৃতির উপর নই। অন্য বর্ণনায় এসেছে, তোমাদের কে আমার মতো? 

তুমি কি আল্লামা খাফ্ফাজীর বক্তব্য দেখোনি যে, তিনি বলেছেন, নবীজীর বাশার বা মানুষ হওয়া তার প্রজ্বলিত ও উজ্জ্বল নূর হওয়ার বিপরীত নয়।”

 

এরপরে তিনি একটি বিখ্যাত কবিতা এনেছেন, 

 

“নিশ্চয় জেনে রেখো, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষ তবে তিনি অন্যান্য মানুষের মতো নন। যেমন, ইয়াকুত পাথর তবে সেটি অন্য পাথরের মতো নয়।”

 

আহমদ রিদ্বা খান বেরেলভীর আলোচনার স্ক্রিনশট নিচে দেয়া হলো,





 




 



 




 

এতো স্পষ্ট বক্তব্য থাকার পরও মাওলানা মিজান হারুন যেভাবে আহমদ রিদ্বা খানের উপর প্রকারান্তরে বাশারিয়াত অস্বীকার বা অবতারের আকিদা জীবিত করার চেষ্টা করেছেন এজাতীয় বক্তব্য চাপিয়ে দেয়া চরম মিথ্যাচার ও ইলমী খিয়ানত। যা কোন প্রকৃত আলিমের শান হতে পারে না। 


 

আহমদ রিদ্বা খান ব্রেলভী কি নবীজীকে আল্লাহর নূরের খন্ডিত অংশ মনে করত?

 

কুরআন ও হাদীসের বিভিন্ন জায়গায় রুহ, কালিমা, নূর ইত্যাদি শব্দ আল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। যেমন, আদম আ: এর মাঝে আল্লাহ তায়ালা আপন রুহ ফুঁকে দিয়েছেন। আবার ঈসা আ: কে আল্লাহর কালিমা ও রুহ বলা হয়েছে পবিত্র কুরআনে। একইভাবে আসমান ও জমিনের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, আল্লাহ হলেন আসমান ও জমিনের নূর। হাদীসে আছে, মুমিন ব্যক্তি আল্লাহর নূর দিয়ে দেখে।  একইভাবে উলামায়ে কেরামের অনেকে বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা নবীজীকে তার নূর থেকে সৃষ্টি করেছেন। উপরের কোন বক্তব্য থেকেই এই উদ্দেশ্য নেয়া সঠিক হবে না যে, আল্লাহর কোন অংশ আছে বা আল্লাহর কোন গুণ সৃষ্টির মাঝে অনুপ্রবেশ করেছে। সকল ক্ষেত্রে অকাট্যভাবে বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আল্লাহ তায়ালা অংশ, অঙ্গ ইত্যাদি থেকে মুক্ত। আবার তার কোন গুণ সৃষ্টির মাঝে অনুপ্রবেশ থেকেও মুক্ত। মোটকথা, আল্লাহ বা আল্লাহর কোন কিছু সৃষ্টির মাঝে অনুপ্রবেশ করেছে বা সৃষ্টির সাথে মিশে গিয়েছে এধরণের আকিদা রাখা কুফুর। উপরের আয়াত ও হাদীসের ক্ষেত্রে যেসব জিনিসকে আল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে, সব কিছুকেই মাখলুক ও সৃষ্ট মনে করতে হবে। কীভাবে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন বা এগুলোর প্রকৃত মর্ম ও উদ্দেশ্য কী সেটি আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন। তবে তিনি খালিক আর উপরের সব কিছু মাখলুক। 

 

উপরের বিষয়গুলি আহমাদ রিদ্বা খান খুব স্পষ্টভাবে তার কিতাবে উল্লেখ করেছেন। অথচ আমি গত পর্বে দেখিয়েছি, মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া সাহেব বেরলভীদের সম্পর্কে বলেছেন, তারা আল্লাহর রাসূলকে আল্লাহর খন্ডিত নূর মনে করে। অথচ এটি খোদ আহমদ রিদ্বা খানের কাছে কুফুরী। 

 

চলুন আহমদ রিদ্বা খানের বক্তব্য দেখে নেয়া যাক,

 

“ আল্লাহর নূর থেকে সৃষ্টি হয়েছেন এর অর্থ কখনও এটি নয় যে, নাউজুবিল্লাহ নবীজীর সৃষ্টির মৌল উপাদান হলেন আল্লাহ তায়ালা। যেমন, মাটি থেকে মানুষ সৃষ্টি হয়েছে বললে বোঝা যায়। নাউজুবিল্লাহ এটাও উদ্দেশ্য নয় যে, আল্লাহর সত্ত্বা বা সত্ত্বার খন্ডিত কিছু নবীজীর অংশ হয়ে গিয়েছেন। বরং আল্লাহ তায়ালা তো অংশ বিশিষ্ট হওয়া, কোন কিছুর সাথে মিলিত হওয়া বা কোন কিছুর মাঝে অনুপ্রবেশ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হোক কিংবা অন্য কোন কিছুকে আল্লাহর সত্ত্বার অংশ মনে করা কিংবা কোন সৃষ্টিকে হুবহু আল্লাহর সত্ত্বা বা সত্ত্বার অংশ মনে করা কুফুর”

(মাজমুয়ায়ে রাসাইল, পৃ: ১৮)












নূর ও বাশার বিষয়ে উলামায়ে দেওবন্দের অবস্থান কী ছিলো?

 

এদেশের দেওবন্দী উলামায়ে কেরামের মাঝে বিষয়টি প্রকট আকার ধারণ করেছে যে, তাদের অনেকে মূল দেওবন্দী উলামায়ে কেরামের অবস্থান না জেনেই নিজেদের মতো করে ধারণা করে বিভিন্ন বিষয়ের বিরোধিতা করে। অথচ দেওবন্দী উলামায়ে কেরামের কিতাবে এর ভিন্ন বাস্তবতা পাওয়া যায়। বিশেষ করে মাওলানা মিজান হারুনের মতো যারা উভয় ঘরানার কারও বক্তব্য সঠিকভাবে না জেনে একপাক্ষিক খন্ডনে নেমে পড়েছে, তাদের জানা উচিৎ ছিলো, নবীজীর নূর ও বাশার হওয়ার বিষয়ে উলামায়ে দেওবন্দের বড় কোন বিরোধ নেই। উলামায়ে দেওবন্দের কেউ কেউ নবীজীর নূরকে তার গুণ ও  হিদায়াতের নূর হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। তবে মৌলিকভাবে নবীজীর নূর হওয়াকে পুরোপুরি তারা অস্বীকার করেননি। 

 

মাওলানা উবাইদুল্লাহ আসআদি সাহেব দারুল উলুম দেওবন্দের আকিদা ও চিন্তা-চেতনার উপর বড় কলেবরের কিতাব লিখেছেন। ‘দারুল উলুম দেওবন্দ’ কিতাবে তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এই কিতাবের শুরুতে মুফতী তাকী উসমানী ও মাওলানা সাইদ আহমদ পালনপুরীর প্রশংবাণী ও অভিমত রয়েছে। এখানে তিনি একটি আলোচনার শিরোনাম দিয়েছেন, “নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াতের মৌলিকত্ব, নবীজীর প্রথম সৃষ্টি হওয়া এবং কিছু দৃষ্টিকোণ থেকে সৃষ্টির প্রথম হওয়া” সংক্রান্ত আলোচনা। এই আলোচনায় তিনি বলেছেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সৃষ্টির মূল হওয়ার বিষয়টি আল্লাহর নবীর সৃষ্টি সংক্রান্ত কিছু হাদীস থেকে বোঝা যায়। বিশেষ করে যেসব হাদীসে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নূরকে প্রথম সৃষ্টি করা হয়েছে এজাতীয় বক্তব্য রয়েছে। এজাতীয় কিছু কিছু হাদীস সনদের দিক থেকে দুর্বল বা জাল হলেও অর্থের দিক থেকে এর অর্থ ও উদ্দেশ্য সঠিক। 

 

এরপর মাওলানা উবাইদুল্লাহ আসআদী মাওলানা আশরাফ আলী থানবী ও মাওলানা আনোয়ার শাহ কাস্মিরীর বক্তব্যও এনেছেন। 

হযরত আবু হুরাইরা রা: থেকে একটি সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে, সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করেছেন, হে আল্লাহর রাসূল, কখন আপনার নবুওয়াত ওয়াজিব (দেয়া) হয়েছে? নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন আদম আলাইহিস সালাম দেহ ও আত্মার মধ্যবর্তী অবস্থায় ছিলেন। 

 

এই হাদীসের ব্যাখ্যায় মাওলানা আসআদী মাওলানা আশরাফ আলী থানবীর একটি দীর্ঘ বক্তব্য এনেছেন। মাওলানা থানবী বলেন, 

 

“ স্পষ্টত: তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেহ মোবারক তখন ছিলো না। সুতরাং নবুওয়াতের গুণটি তখন নবীজীর রুহ ও নূরে মুহাম্মাদিকে দেয়া হয়েছিল”।

 

এরপরে মাওলানা উবাইদুল্লাহ আসআদী নবীজীর নূর সংক্রান্ত  হাদীসে জাবের হিসেবে বিখ্যাত হাদীস দিয়েও দলিল দিয়েছেন। এই হাদীসের ব্যাখ্যা হিসেবে মাওলানা থানবীর নিচের বক্তব্যটি উল্লেখ করেছেন,

“হযরত জাবের রা: এর হাদীস থেকে স্পষ্ট যে নূরে মুহাম্মাদী হলো বাস্তবে প্রথম সৃষ্টি।” (নাশরুত তিব্ব, পৃ: ৬)

 

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নূর আল্লাহর নূর থেকে সৃষ্ট হওয়ার ব্যাখ্যায় মাওলানা আসআদী সেই সব বক্তব্যই উল্লেখ করেছেন যা আমরা উপরে মাওলানা আহমদ রিদ্বা খানের বক্তব্যে উল্লেখ করেছি। একই ধরণের বক্তব্য ও ব্যাখ্যা। আল্লাহর নূর থেকে সৃষ্ট হওয়ার ব্যাখ্যায় মাওলানা থানবীর একটি বক্তব্য তিনি উদ্ধৃত করেছেন,

“নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নূর আল্লাহর নূর থেকে সৃষ্ট হওয়ার অর্থ হলো, আল্লাহর নূরের ফয়েজ থেকে সৃষ্ট হয়েছে। এই অর্থে নয় যে, আল্লাহর নূর নবীজীর নূরের মৌল উপাদান” (নাশরুত তিব, পৃ:৫)

 

যারা হাদীসে জাবের জাল হওয়ার কথা বলেন, তাদের উত্তর তো মাওলানা উবাইদুল্লাহ আসআদী আলোচনার শুরুতেই দিয়েছেন যে, উলামায়ে দেওবন্দের কাছে এই হাদীসটি সনদের দিক থেকে দুর্বল বা জাল হলেও অর্থের দিক থেকে এর অর্থ সঠিক। 

 

মাওলানা উবাইদুল্লাহ আসআদীর সম্পূর্ণ আলোচনার স্ক্রিনশট নিচে দেয়া হলো,



 

 


 



 



 

 



 


 

একইভাবে মাওলানা রশীদ আহমাদ গাংগুহীকে ‘আমার নূর প্রথম সৃষ্টি করা হয়েছে’ সংক্রান্ত হযরত জাবের রা: এর হাদীস সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, 

“ হাদীসটি সিহাহ সিত্তাতে নেই। তবে শায়খ আব্দুল হক্ব মুহাদ্দিসে দেহলবী তার কিতাবে এটি উল্লেখ করে বলেছেন এর ভিত্তি আছে”। 

 

(ফতোয়া রশিদিয়্যাহ, পৃ: ১১০, ১১১)

 










 




 

মোটকথা, নূর ও বাশার হওয়ার বিষয়ে আহমদ রিদ্বা খানের বক্তব্য ও দলিলের সাথে উলামায়ে দেওবন্দের বক্তব্য ও দলিলের বড় কোন বিরোধ নেই। খোদ মুফতী আমীন পালনপুরী বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। উলামায়ে দেওবন্দের কেউ কেউ বেরেলভীদের সাথে বিরোধপূর্ণ মাসআলা হিসেবে নূর ও বাশারের কথা বললেও বাস্তব তাহকীকে এটি স্পষ্ট যে বেরেলভীরা নবীজীর বাশারিয়াতকে অস্বীকার করে না এবং এ বিষয়ে তাদের সাথে উলামায়ে দেওবন্দের বড় কোন বিরোধ নেই। এর বিপরীতে মাওলানা মিজান হারুন বিষয়টি কোন রুপ যাচাই - বাছাই না করে সম্পূর্ণ মনগড়া ও মিথ্যা অপবাদমূলক একটি পোস্ট করেছেন আহমদ রিদ্বা খানের বিরুদ্ধে। সেখানে বাশারিয়াত অস্বীকার থেকে শুরু করে এলিয়েন, অবতার ইত্যাদি টেনে এনেছেন। যা তার হিংসাত্মক অপবাদমূলক মানসিকতার বহি:প্রকাশ। এটি চরম জঘন্য মিথ্যাচারও।  বাস্তবতার সাথে মাওলানা মিজান হারুনের অপবাদের দূরতম সম্পর্কও নেই। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এধরণের অপবাদ, মিথ্যাচার ও ইলমী খিয়ানতমূলক কাজ থেকে হেফাজত করুন। 

------ ------

ইতিহাস

নামাজে গাউসিয়া নিয়ে আহমদ রিদা খান বেরলভীর বিরুদ্ধে মিজান হারুনের অপপ্রচার ও মিথ্যাচার (৩য় পর্ব)

Ijharul Islam শনি, 21 ডিসে., 2024

ব্রেলভীদের খন্ডন করতে গিয়ে মাওলানা মিজান হারুন আহমদ রেজা খান বেরলভীর উপর ‘সুস্পস্ট শিরক’ এর অভিযোগ এনেছেন। সুস্পষ্ট শিরক বলতে যদি তিনি শিরকে আকবর ( বড় শিরক), শিরকে জলী ( সুস্পষ্ট বা প্রকাশ্য শিরক) উদ্দেশ্য নিয়ে থাকেন, তাহলে এটি গুরুতর একটি অভিযোগ। এধরণের বড় শিরকের মাধ্যমে খোদ আহমদ রিদা খান মুসলমান ছিলেন নাকি মুশরিক সেই প্রশ্ন এসে পড়ে। সুস্পষ্ট শিরক দ্বারা মাওলানা মিজান হারুনের উদ্দেশ্য যদিও নজদীদের মতো বড় শিরকের অভিযোগ করে আহমদ রিদ্বা খানকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়া, তবে এখানে তার ব্যাখ্যার সুযোগ আমরা রাখছি। আশা করি, তিনি তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা প্রদান করবেন। আশ্বর্য্যের বিষয় হলো, তার এই আলোচনার পাঠকগণও তার আলোচনা থেকে ‘সুস্পষ্ট শিরক’  দ্বারা বড় শিরক উদ্দেশ্য নিয়েছেন। বেশ কয়েকজন কমেন্টও করেছেন আহমদ রিদ্বা খানকে বড় শিরকের অভিযোগ করে। মাওলানা মিজান হারুন সাহেব সেখানেও কোন প্রতিবাদ করে বলেননি যে, সুস্পষ্ট শিরক দ্বারা আমি বড় শিরক উদ্দেশ্য নেইনি, যা মানুষকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। এর অর্থ হলো, তার বক্তব্য ও তার পাঠকদের বক্তব্যও কাছাকাছি। অর্থাৎ সালাতে গাউসিয়ার মাধ্যমে আহমদ রিদ্বা খান বা তার অনুসারীরা বড় শিরক করেছেন। এটি তাদের অভিযোগের মূল বিষয়। 


 

এখানে বলে নেয়া প্রয়োজন যে, মিজান হারুন সাহেব আহমদ রিদ্বা খানের পক্ষ থেকে উলামায়ে দেওবন্দের উপর তাকফির হওয়ার কারণে বেশ কিছু আবেগঘণ পোস্ট দিয়েছেন। আবার এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, তিনি নিজেই সেই আহমদ রিদ্বা খানের উপর সুস্পষ্ট শিরকের অভিযোগ আনছেন। আপনার কাছে যিনি সুস্পষ্ট শিরককারী, সেই যদি আপনার পছন্দনীয় কাউকে কাফের বলে এতে আশ্চর্য্য হওয়ার কী আছে? হুকুমের দিক থেকে মাওলানা মিজান হারুনের পক্ষ থেকে দেয়া অভিযোগ অর্থাৎ শিরকের অভিযোগ বেশি গর্হিত কুফর থেকে। এক দিকে আহমদ রিদ্বা খানের পক্ষ থেকে তাকফির হলে সেটাকে খুব বড় করে উপস্থাপন করছেন আবার সেই তিনিই খোদ আহমদ রিদ্বা খানের উপর সুস্পষ্ট শিরকের অভিযোগ করছেন। কারও উপর শিরক বা কুফরের অভিযোগ যদি গুরুতর বিষয় হয়, তাহলে তিনি নিজেও সেই একই কাজ করেছেন, যেই কাজের জন্য তিনি অন্যকে অভিযোগ করছেন। বেরলভীরা যদি দেওবন্দীদেরকে তাকফির করে থাকে, তাহলে খোদ মিজান হারুন বেরলভীদের উপর সুস্পষ্ট শিরকের অভিযোগ এনে একই কাজ করেছেন। ফলাফলের দিক থেকে উভয়ের কাজ সমান। 

 

আমাদের আজকের পর্যালোচনায় আমরা দেখব, আহমদ রিদ্বা খানের উপর মিজান হারুন যে সুস্পষ্ট শিরকের অভিযোগ এনেছেন এর বাস্তবতা আসলে কী? আহমদ রিদ্বা খান কি এমন কিছু বলেছেন বা করেছেন যা তার সুস্পষ্ট শিরকের প্রমাণ হতে পারে? এখানে মিজান হারুন কি অন্যায়ভাবে আহমদ রিদ্বা খানের উপর শিরকের অভিযোগ এনেছেন? নাকি বাস্তবেই আহমদ রিদ্বা খান সুস্পস্ট শিরক করেছেন?

 

এই প্রশ্নের উত্তরের আগে চলুন মাওলানা মিজান হারুনের বক্তব্য দেখে নেয়া যাক। মাওলানা মিজান হারুন লিখেছেন,

 

ব্রেলভীদের নামাযে গাউসিয়্যাহ

ব্রেলভীদের একটি নামাযের নাম হলো 'নামাযে গাউসিয়্যাহ' বা 'গুপ্ত নামায' (صلاة الأسرار)। আব্দুল কাদের জীলানীর কাছে সাহায্যপ্রার্থনার জন্য এই নামায পড়া হয়। ‘নামাযে গাউসিয়্যাহ’ এর পদ্ধতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে আহমদ ব্রেলভী আব্দুল কাদের জীলানীর বক্তব্য উদ্ধৃত করেন এভাবে: قال سيدنا ومولانا الغوث الأعظم رضي الله تعالى عنه: من توسل بي في شدة فرجت عنه، ومن استغاث بي في حاجة قضيت له، ومن صلى بعد المغرب ركعتين، ثم يصلي ويسلم على النبي صلى الله تعالى عليه وسلم، ثم يخطو إلى جهة العراق احدى عشرة خطوة، يذكر فيها اسمي قضى الله تعالى حاجته অর্থাৎ ‘আমাদের সাইয়্যেদ ও মাওলানা, গাউসুল আজম রাযিয়াল্লঅহু আনহু বলেন, ‘যে ব্যক্তি সংকটের সময় আমার উসিলা গ্রহণ করে আমি তার সংকট দূর করে দিই। আর যে কোনো প্রয়োজনে আমার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে, আমি তার প্রয়োজন পূর্ণ করি দিই। আর মাগরিবের নামাজের পরে যে ব্যক্তি দুই রাকাআত নামাজ পড়বে। রাসূলুল্লাহর ওপর দরূদ পড়বে। অতঃপর ইরাকের দিকে এগারো কদম অগ্রসর হতে হতে মুখে আমার নাম যপবে। আল্লাহ তার প্রয়োজন পূর্ণ করে দিবেন’  [ফাতাওয়া: ৭/৬৩৮] এটাকেই বলা হয় নামাযে গাউসিয়্যাহ। [অবশ্য এই বক্তব্য জীলানী র. এর ওপর মিথ্যাচার। এটা আবিষ্কার করেছেন তার জীবনীকারক শাতনূফী]

ব্রেলভী বলেন, ‘এগুলো করার সময় ধ্যান করবে যেন সে বাগদাদে আছে। হযরতের কবর তার চোখের সামনে। তিনি কিবলামুখী হয়ে শুয়ে আছেন। বান্দা তার অনুগ্রহ চাওয়ার ইচ্ছা করবে। কিন্তু অপরাধবোধ ও লজ্জার কারণে চাইতে পারবে না। ফলে তখন পেরেশান থাকবে। যেন তার কাছে অনুমতি চাইবে। তার সাগরসম উদারতা ও তার ‘আমার প্রত্যাশী ভালো না হলেও আমি ভালো’- এই সুসংবাদের সুবাদে তার কাছে শাফায়াত প্রার্থনা করতে চাইবে। এই দ্বিধাদ্বন্দের মাঝেই যেন গউসে আজম তার দিকে চোখ তুলে তাকাবেন। তার দুরবস্থা ও লজ্জা দেখবেন। পাপী বান্দার প্রতি দয়াপরবশ হবেন এবং সুপারিশ করবেন। যেন তিনি বলবেন, ‘আমি তাকে সামনের কদমগুলো পূর্ণ করার অনুমতি দিচ্ছি’। তখন সে আমার নাম যপবে। আমার কাছে গুনাহের কারণে ভয় পাবে না। কারণ আমি তার জামিনদার। তার দুনিয়া ও আখিরাতের সবকিছুর অভিভাবক। বান্দা তখন উদ্দীপ্ত হবে। প্রচণ্ড ভাবাবেগে সামনে অগ্রসর হবে আর প্রতি কদমে বলতে থাকবে, ‘হে জ্বিন ও ইনসানের মুক্তিদাতা! হে দয়ালু পুণ্যাত্মা! আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করুন! হে প্রয়োজন পূর্ণকারী! আমার প্রয়োজন পূরণে সাহায্য করুন’ (ويذكر فيها اسمي ولا يخشى المعاصي عندي، فإني أنا ضمينه وكفيل مهماته في الدنيا والآخرة، فينشط العبد ويتقدم على أقدام الوجد قائلا على كل خطوة: يا غوث الثقلين، ويا كريم الطرفين، أغثني، وأمددني في قضاء حاجتي يا قاضي الحاجات)!!! [ফাতাওয়া: ৭/৬৪৬-৬৪৭]

ইন্নালিল্লাহ! জীলানী জ্বিন ও ইনসানের মুক্তিদাতা। প্রয়োজনপূর্ণকারী। তাহলে আল্লাহর জন্য তারা কী বাকি রেখেছে? আল্লাহ বলেছেন, ‌'তোমরা আমাকে ডাকো আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিবো‌' [মুমিন: ৬০] আর তারা শেখাচ্ছে আব্দুল কাদের জীলানীকে ডাকতে। এগুলো সুস্পষ্ট শিরক। অপব্যাখ্যাকারীদেরকে আল্লাহ হিদায়াত দিন।

 

বক্তব্যের স্ক্রিনশট:

 

 

 





 


 

মিজান হারুন সাহেব শুরুতে লিখেছেন, “আব্দুল কাদের জীলানীর কাছে সাহায্যপ্রার্থনার জন্য এই নামায পড়া হয়।” 

তার এই বক্তব্যের বাহ্যিক অর্থ নিলে একজন পাঠকের কাছে খুব নিকৃষ্ট একটি অর্থ বুঝে আসে। তিনি কেমন যেন বোঝাতে চান, আব্দুল কাদের জিলানীর কাছে সাহায্য চাওয়ার জন্য নামাজ পড়া হচ্ছে। যদিও আমাদের এই পর্যালোচনার পর খুবই সম্ভাবনা আছে, তিনি বলবেন, আমি উক্ত কথার বাহ্যিক অর্থ উদ্দেশ্য নেয়নি। যদিও তার পাঠকরা কিন্তু ঠিকই এই নিকৃষ্ট অর্থটি বুঝেছে। এবং স্বাভাবিকভাবে কেউ যদি তার লেখা পড়ে, বাহ্যিকভাবে এটিই বুঝে আসে যে, আব্দুল কাদের জিলানীর কাছে সাহায্য চাওয়ার জন্য নামাজ পড়া হচ্ছে। এজন্য মিজান হারুনের এক ভক্ত পাঠক আবু হাফসা লিখেছে, 

 

 

 

 

শিরক মিশ্রিত সালাত আবার কী জিনিস? হয়ত এখানে শিরক-মিশ্রিত সালাত বলতে আসলে মিজান হারুন সাহেবের উপরের বক্তব্য থেকে বোঝা নিকৃষ্ট অর্থটি উদ্দেশ্য। অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে সাহায্যের জন্য নামাজ পড়া হচ্ছে। আর আমরা সবাই জানি যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও জন্য যে কোন প্রকারের ইবাদত সুস্পষ্ট শিরক। সেই ইবাদত যদি নামাজ হয়, তাহলে সেটি শিরক হওয়ার ক্ষেত্রে কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়। মিজান হারুন সাহেব যেভাবে লিখেছেন, এতে এই ধরণের একটি নিকৃষ্ট শিরকের অভিযোগ ওঠে আহমদ রেজা খান বেরলভী ও তার অনুসারীদের উপর। যদিও মিজান হারুন সাহেব তার বক্তব্যকে বাহ্যিক অর্থে নিয়ে অপব্যাখ্যা করা হয়েছে এই দাবী করতে পারেন, এজন্য তার বক্তব্যের ব্যাখ্যার দায় তার উপর রেখেই আমরা পরবর্তী আলোচনায় যাব। আমরা চাই, তিনি নিজেই তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিক। তবে যারা তার বক্তব্য থেকে এধরণের শিরকী অর্থ বুঝে আহমদ রেজা খানের উপর অন্যায়ভাবে শিরকের অভিযোগ করেছে, তাদের ভুল ধারণা অপনোদন করা জ্বরুরি। 

 

শুরুতেই দু’টি মূলনীতি বুঝে নেয়া দরকার। 

 

১। ইসলামে ছোট-বড় যে কোন ধরণের ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্য সুনির্দিষ্ট। যে কোন ইবাদতই আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য করা শিরক। সেই ইবাদত ছোট হোক কিংবা বড় হোক। ইবাদতের নিয়তে যে কোন কাজ গাইরুল্লাহর জন্য করা শিরক।আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন নবী, রাসূল, গাউস, কুতুব কারও জন্য কোন প্রকার ইবাদত করার সুযোগ নেই। 

 

২। শরীয়াতে বিভিন্ন ইবাদত, আমল, ব্যক্তিকে আল্লাহর কাছে দু’য়া করার মাধ্যম বা ওসিলা হিসেবে গ্রহণ করা স্বীকৃত। খোদ কুরআনেই আল্লাহ তায়ালা ওসিলা গ্রহণের কথা বলেছেন। এজন্য নামাজ, রোজাসহ বিভিন্ন আমলকে আল্লাহর নিকট ওসিলা হিসেবে পেশ করার অনুমতি রয়েছে। এবং এধরণের ওসিলা গ্রহণের বিষয়ে পুরো উম্মতের ইজমা রয়েছে। নজদী-তাইমীরা ওসিলার কিছু প্রকারকে অস্বিকার করলেও মৌলিক ওসিলাকে তারাও স্বীকার করে। 

 

শরীয়াতের এমন কিছু আ’মলের নির্দেশনা রয়েছে যেগুলোর বাহ্যিক নাম দেখলে মনে হবে এটি গাইরুল্লাহর জন্য ইবাদত করা হচ্ছে। অথচ বাস্তবতা হলো, এগুলোর ক্ষেত্রে মূল ইবাদত আল্লাহর জন্যই করা হচ্ছে। তবে সেই ইবাদতকে সুনির্দিষ্ট প্রয়োজন পূরণের ওসিলা হিসেবে আল্লাহর কাছে পেশ করা হচ্ছে। যেমন, সালাতুল ইস্তিসকা। বা বৃষ্টির জন্য বিশেষ নামাজ। 

 

বৃষ্টির জন্য নামাজের অর্থ কী? যদি বাহ্যিক অর্থ নেন, তাহলে এটি খুব নিকৃষ্ট একটি অর্থ হবে। অর্থাৎ গাইরুল্লাহ তথা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়া হচ্ছে। আর আমরা জানি, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তি বা বস্তুর জন্য ইবাদত শিরক। তাহলে কি বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়া শিরক? কেউ আবার এক ধাপ এগিয়ে নাউজুবিল্লাহ একথা  বলতে পারে,  গ্রহ-নক্ষত্র বা মেঘের জন্য নামাজ পড়া হচ্ছে, যাতে বৃষ্টি হয়। 

 

এভাবে বক্তব্যের বাহ্যিক অর্থ নিলে শিরক সাব্যস্ত হয়। কিন্তু শরীয়াতে আসলে বিষয়টিকে এই নিকৃষ্ট অর্থ নেয়ার জন্য সাব্যস্ত করা হয়নি। বরং সালাতুল ইস্তিসকা বা বৃষ্টি প্রার্থনার নামাজ দ্বারা এমন নামাজ উদ্দেশ্য যা আল্লাহর জন্যই পড়া হয়েছে। নামাজ বা ইবাদত হয়েছে একমাত্র আল্লাহর জন্য। কিন্তু এখানে উক্ত নামাজকে বৃষ্টির প্রয়োজন পূরণের জন্য আল্লাহর কাছে ওসিলা হিসেবে পেশ করা হচ্ছে। 



 

একইভাবে সালাতুল হাজাহ বা প্রয়োজন পূরণের নামাজ। সালাতুল কুসুফ বা সূর্যগ্রহণের নামাজ। সূর্যগ্রহণের নামাজ দ্বারা কখনও এটি উদ্দেশ্য নয় যে, সূর্যগ্রহণের জন্য কিংবা সূর্য্যের জন্য ইবাদত করা হচ্ছে। বরং নামাজ পড়া হচ্ছে আল্লাহর ইবাদতের জন্য। এবং এই নামাজের ওসিলায় আল্লাহর কাছে সূর্য্যগ্রহণের মতো একটি বিপদের বিষয় থেকে হেফাজত চাওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাহ্যিক অর্থ নিলে এখান থেকে একটি নিকৃষ্ট অর্থ বের হয়। যা শিরক বোঝায়। একইভাবে সালাতুল খুসুফ বা চন্দ্রগ্রহণের নামাজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। 

 

ইস্তিখারা, হাজত, কুসুফ, খুসুফ, ইস্তিসকা এভাবে আল্লাহ ছাড়া গাইরুল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত করে যত নামাজের কথা শরীয়াতে আছে, সব ক্ষেত্রেই মূল ইবাদত আল্লাহর জন্য করা হচ্ছে। সেই ইবাদতকে আল্লাহর কাছে ওসিলা হিসেবে পেশ করা হচ্ছে। 

 

এখানে কেউ যদি বাহ্যিক শব্দের ব্যবহার থেকে গাইরুল্লাহর জন্য ইবাদত বা শিরক সাব্যস্ত করে, তাহলে তার  বক্তব্য খন্ডনের পূর্বে তার আক্বল-বুদ্ধির চিকিৎসা প্রয়োজন। 

 

এবার আসুন সালাতুল গাউসিয়া নিয়ে আলোচনা করা যাক। সালাতুল গাউসিয়া এর অর্থ কী? আব্দুল কাদের জিলানীর জন্য নামাজ পড়া কিংবা মাওলানা মিজান হারুনের ভাষায় আব্দুল কাদের জিলানীর কাছে সাহায্যের জন্য নামাজ পড়া? 

 

এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, আল্লাহ ছাড়া আব্দুল কাদের জিলানী বা অন্য কারও ইবাদতের জন্য নামাজ পড়া বড় শিরক। এধরণের কাজের মাধ্যমে ব্যক্তি ইসলাম থেকে বের হয়ে সরাসরি মুশরিক হয়ে যাবে। প্রশ্ন  হলো, সালাতুল গাউসিয়াতে কি আল্লাহর জন্য নামাজ পড়া হয় নাকি আব্দুল কাদের জিলানীর জন্য পড়া হয়?

 

মাওলানা মিজান হারুনের বাহ্যিক বক্তব্য থেকে বোঝা যায় (যদিও তিনি তার বক্তব্যের ভিন্ন ব্যাখ্যা দেয়ার সম্ভাবনা আছে) এটি আব্দুল কাদের জিলানীর জন্য পড়া হয়। নাউজুবিল্লাহ। মাওলানা লিখেছেন,

“ব্রেলভীদের একটি নামাযের নাম হলো 'নামাযে গাউসিয়্যাহ' বা 'গুপ্ত নামায' (صلاة الأسرار)। আব্দুল কাদের জীলানীর কাছে সাহায্যপ্রার্থনার জন্য এই নামায পড়া হয়।”

 

আমাদের অনুসন্ধানের বিষয় হলো, মাওলানা মিজান হারুনের উপরের বক্তব্যটি কতটুকু বাস্তব? আহমদ রিদ্বা খান বেরলভী বা তাদের অনুসারীরা কি এই নামাজকে আল্লাহর ইবাদত ছাড়া আব্দুল কাদের জিলানীর সাহায্য পাওয়ার জন্য পড়ে থাকে? 

 

চলুন, খোদ আহমদ রিদ্বা খানের বক্তব্য থেকেই এর জওয়াব নেয়ার চেষ্টা করি। আমি এখানে আহমদ রিদ্বা খানের বক্তব্যটি দীর্ঘ হলেও সম্পূর্ণ বক্তব্যের মূল অংশগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করব, যাতে পুরো বিষয়টা পাঠকের সামনে স্পষ্ট হয়।  

 

আহমদ রিদ্বা খান বেরলভী লিখেছেন, 

 

“সালাতুল আসরারের পদ্ধতি হলো, কোন ব্যক্তির যদি দ্বীনি বা দুনিয়াবী কোন প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে সে মাগরিবের নামাজের পরে মাগরিবের সুন্নতের সাথে দু’রাকাত নামাজ আদায় করবে।  সালাতুল আসরারের নিয়ত করে আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে (তাকাররুবান ইলাল্লাহ) এটি আদায় করবে এবং এই নামাজের সওয়াবের হাদিয়া গাউসে আজম আব্দুল কাদের জিলানীর রুহের জন্য পাঠাবে। যদি এর জন্য নতুন ওজু করে তাহলে ভালো। কারণ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক অন্ধ সাহাবির চোখের সুস্থ্যতার জন্য যেই সালাতুল হাজত পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন সেখানে নতুন ওজুর কথা বলেছিলেন। যদিও এখানে নতুন ওজু না করার সুযোগ আছে। যদি ওজু করে তাহলে ভালোভাবে করবে। কারণ, অন্ধ সাহাবিকে এমন নির্দেশ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিয়েছিলেন। আমার কাছে পছন্দনীয় হলো, সালাতুল আসরার পড়ার পূর্বে কিছু দান - সাদকা করবে। কারণ, এটি দু’য়া কবুলের জন্য দ্রুততর মাধ্যম। এবং বালা-মুসিবতের দরজা বন্ধের ওসিলা। আর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কোন কিছু জিজ্ঞাসা বা চাওয়ার পূর্বে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা সদকা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সুতরাং আল্লাহর কাছে কোন কিছু চাওয়ার পূর্বে সাদকা করা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। সেই সাথে সামগ্রিকভাবে সালাতুল আসরারে নবীজীর কাছে চাওয়ার বিষয়ও আছে। নবীজীর কাছে জিজ্ঞাসা বা চাওয়ার পূর্বে সাদকা করার আয়াতটির ওয়াজিব বিধান আল্লাহর রহমত হিসেবে রহিত হলেও এটি মুস্তাহাব হওয়ার বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। 

 

নামাজে সূরা ফাতিহার পরে যদি এগারবার সূরা ইখলাস পাঠ করে তাহলে এটি উত্তম। নামাজের সালাম শেষে আল্লাহর শান মোতাবেক তার হামদ ও সানা (গুণকীর্তন) করবে। এক্ষেত্রে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত শব্দে হামদ - সানা করা উত্তম। কারণ, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মতো অন্য কেউ আল্লাহর প্রসংশা করতে সক্ষম নয়। হামদের ভেতরে সুন্দর একটি হামদ হলো, 

الحمدلله حمدا كثيرا طيبا مباركا فيه ملء السموات وملء الارض وملء مابينهما وملء ماشئت من شئ بعد

 

অথবা এটি পড়বে,

 اللَّهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ حَمْدًا دَائِمًا مَعَ خُلُودِكَ ، وَلَكَ الْحَمْدُ حَمْدًا لا مُنْتَهَى لَهُ دُونَ مِشْيَتِكَ ، وَلَكَ الْحَمْدُ حَمْدًا لا يَزِيدُ قَائِلُهَا إِلا رِضَاكَ ، وَلَكَ الْحَمْدُ حَمْدًا مَلِيًّا عِنْدَ كُلِّ طَرْفَةِ عَيْنٍ وَتَنَفُّسِ نَفَسٍ


 

অথবা 

اللَّهُمَّ لَكَ الحَمْدُ كَمَا يَنْبَغِي لِجَلَالِ وَجْهِكَ وَعَظِيمِ سُلْطَانِكَ

 

اللهم لك الحمد شكرا ولك المن فضلا

 

অথবা, 

اللهم لك الحمد كالذي نقول وخيرا مما نقول

 

অথবা এজাতীয় যতো হাদিস বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর কোন একটি পড়বে। এক্ষেত্রে সবগুলো জমা করে পড়তে পারে অথবা এগুলোর কিছু কিছু পড়তে পারে। আমার পছন্দ হলো, হামদ - সানা শেষ করবে এর মাধ্যমে, কারণ এটি আল্লাহর সমস্ত প্রশংসা জমা করে এবং এটি প্রশংসার মধ্যে সবচেয়ে ব্যাপক পর্যায়ের। 

 

اللهم لا أحصي ثناء عليك أنت كما أثنيت على نفسك

 

যে উপরের কোনটি ভালোভাবে পারে না সে শুধু তিনবার আল-হামদুলিল্লাহ পড়বে। অথবা আল্লাহর প্রশংসার নিয়তে সূরা ফাতিহা অথবা আয়াতুল কুরসী পাঠ করবে। কারণ এগুলোর চেয়ে অধিক প্রশংসার কোন কিছু সে করতে পারবে না। 

 

এরপর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য ১১ বার দুরুদ ও সালামের হাদিয়া পেশ করবে। কারণ, আল্লাহর কাছে নবীজীর উপর দুরুদ পাঠ করা ছাড়া কোন দু’য়া কবুল হয় না। দুরুদের সাথে এখানে সালামও পেশ করবে। যাতে দুুরুদ ও সালাম উভয়টির ফজীলত হাসিল করতে পারে। আবার শুধু দুরুদ বা সালাম পেশ করার ক্ষেত্রে উলামাদের ইখতিলাফের বিষয় থেকে বাঁচার জন্য উভয়টি পাঠ করা উত্তম। কারণ, কিছু কিছু আলিম দুরুদ ও সালামের যে কোন একটা পড়াকে মাকরুহ বলেছেন।  

 

দুরুদ ও সালামের ক্ষেত্রে অধম (আহমদ রিদ্বা খান) এর পছন্দ হলো, এক্ষেত্রে আব্দুল কাদের জিলানী থেকে বর্ণিত দুরুদটি পড়বে। সেটি হলো, 

اللهم صل على سيدنا و مولانا محمد معدن الجود و الكرم و اله و سلم

অধম এই দুরুদকে এভাবে পড়ে থাকি,


 

اللهم صل على سيدنا و مولانا محمد معدن الجود و الكرم واله الكرام و ابنه الكريم و امته الكريمة يا اكرم الاكرمين و بارك و سلم

 

এরপর সে তার অন্তরকে মদিনার দিকে ধাবিত করবে এবং এগারবার বলবে, 

يا رسول الله يا نبي الله اعثني و امددني في قضاء حاجتي يا قاضي الحاجات

(অর্থ: হে আল্লাহর রাসূল, হে আল্লাহর নবী, আমার এই প্রয়োজন পূরণের ক্ষেত্রে আপনি আমাকে সাহায্য করুন, মদদ করুন। হে নবী, আপনি প্রয়োজনসমূহ পূর্ণকারী) 

 

এরপর স্বাভাবিকভাবে ইরাকের দিকে এগার কদম হাটবে। (এরপর আহমদ রিদ্বা খান বেরলভী হিন্দুস্তান থেকে ইরাকের দিক নিয়ে কিছু আলোচনা করেছেন। আমরা সেই আলোচনা এড়িয়ে গিয়েছি)। কারণ এটি স্বাভাবিক থাকা বাঞ্চনীয়। সাধারণ মানুষ যেভাবে করে সেভাবে নয়। অর্থাৎ তারা এক কদম বলতে কী উদ্দেশ্য সেটা বোঝে না। তারা প্রতি কদমে দুই চার আঙ্গুল অগ্রসর হয়। এটি আসলে কোন কদম নয়। এজন্য এখানে এক কদম হাটার কথা আছে। প্রয়োজন ছাড়া ভিন্ন কিছু করা এখানে ভুল। তবে যদি এমন জায়গায় থাকে যেখান হাটার সুযোগ নেই কিংবা বাহির কোন জায়গা নেই, তাহলে যতটুকু পারে ততটুকু করবে।  এর চেয়ে নিকৃষ্ট একটি বিষয় আমি দেখেছি সাধারণ মানুষের মাঝে, সেটি হলো, তারা নামাজ আদায় করে। এমনকি দ্বিতীয় রাকাতের ক্বিরাত শেষ করে নামাজের মধ্যেই ইরাকের দিকে এগার কদম অগ্রসর হয়। এরপর সেখান থেকে ফিরে এসে কেবলার দিকে ফিরে বাকী নামাজ আদায় করে। অথচ এই মিসকীন জানে না যে, এর দ্বারা তার নামাজই বাতিল হয়ে যায়। আর এটি আব্দুল কাদের জিলানী থেকে বর্ণিত পদ্ধতিরও বিরোধী। শরীয়াতে এভাবে কোন আমলকে বাতিল করা হারাম। আর নফল শুরু করলে সেটির কাজা করা ওয়াজিব। সে এটি জানেও না। এভাবে সে দ্বিগুন গুণাহের মধ্যে নিপতিত হয়। এধরণের লোকদেরকেই হাদীসে এসেছে, সঠিক ফিকহ না জেনে আমলকারী হলো সেই গাধার মতো যে আটা পিষতে পিষতে জীবন কাটিয়ে দেয়। এই লোকের চেয়ে তার যে শায়খ তাকে এই ধরণের আমলের কথা বলেছে সে বড় অপরাধী। লা হাউলা ওলা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আজিম। 

 

ইরাকের দিকে হাটার সময় আদব, ভয়, নম্রতা ও বিনয়ের সাথে অগ্রসর হবে। আমি পছন্দ করি সে যেন এই কল্পনা করে যে, সে কেমন যেন বাগদাদে উপস্থিত। আব্দুল কাদের জিলানীর কবর তার চোখের সামনে। তিনি কেবলামুখী হয়ে সেখানে শায়িত আছেন। অধম তার অনুগ্রহের আশাবাদী হয়ে তার দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করবে তবে অধিক গোনাহের কারণে যেন লজ্জার আড়স্টতা তাকে গ্রাস করেছে। সে হয়রান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। এরপর কেমন যেন সে তার কাছে অগ্রসর হওয়ার অনুমতি চাচ্ছে এবং তার সুপারিশের আবেদন করছে। কারণ, তার বদান্যতা ও অনুগ্রহ প্রশস্ত। কারণ তিনি সুসংবাদ দিয়েছেন, আমার মুরিদরা যদি ভালো না থাকে তাহলে আমি কীভাবে ভালো থাকব?। 

সে এভাবে কল্পনা করবে যে, তিনি তাকে দেখছেন এবং তার দীনতা ও লজ্জার বিষয়টি জানেন। তখন তার বদান্যতা ও অনুগ্রহের কারণে তিনি গোনহগার অধম বান্দার জন্য আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করবেন। কেমন যেন তিনি বলছেন, “এই অধম মিসকিনকে আমি ইরাকের দিকে অগ্রসর হওয়ার অনুমতি দিয়েছি, সে আমার নাম স্মরণ করে। আমার কাছে তার গোনাহের ভয় করে না। তার দুনিয়া ও আখিরাতের চিন্তা-পেরেশানির দায়িত্বশীল ও জিম্মাদার আমি।”  এভাবে বান্দা নিজেকে প্রস্তুত করে ওয়াজদ অবস্থায় প্রতিটা কদম অগ্রসর হয়ে বলবে, 

يا غوث الثقلين و يا كريم الطرفين اغثني و امددني في قضاء حاجتي يا قاضي الحاجات

 

(অর্থ: হে উভয় জাহানের সাহায্যকারী, হে পিতৃ-মাতৃকুল উভয় দিক থেকে সম্মানিত, আপনি আমাকে আমার এই প্রয়োজন পূরণে সাহায্য ও সহযোগিতা করুন। আপনি প্রয়োজনসমূহ পূর্ণকারী) 

 

এরপর সাইয়্যিদুল মুরসালিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওসিলায় এবং তার এই সম্মানিত সন্তান গাউসুল আজমের ওসিলায় আল্লাহর কাছে দু’য়া করবে। আর দু’য়ার শব্দসমূহের ক্ষেত্রে উলামায়ে কেরাম যেসব দু’য়ার আদব লিখেছেন সেগুলো রক্ষা করবে। বিশেষ করে হিসনে হাসীন সহ অন্যান্য দু’য়ার কিতাবে যা বর্ণিত হয়েছে। দুয়ার ফজীলত ও বিভিন্ন দু’য়া সংকলনের ক্ষেত্রে আমার সম্মানিত পিতা ইমামুল মুহাক্কিকীন মাওলানা নকী আলী খান একটি সুন্দর কিতাব লিখেছেন। এর নাম দিয়েছেন, আহসানুল বিয়া লি-আদাবিদ দু’য়া। আমি জাওয়াহিরুল বায়ান ফি আসরারিল আরকান কিতাবের হজ্বের অধ্যায়ে এর সার-সংক্ষেপ তুলে ধরেছি।  

 

আল্লাহর কাছে দু’য়ার ক্ষেত্রে ইয়া আরহামার রাহিমীন তিনবার বলে শুরু করবে। কারণ, যে এটি বলবে, এর জন্য নির্ধারিত একজন ফেরেশতা তাকে ডাক দিয়ে বলবে আরহামুর রহিমীন তোমার ডাকে সাড়া দিয়েছেন। এবং ইয়া বাদীয়াস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ, ইয়া জাল জালালি ওয়াল ইকরাম পড়বে। কারণ একটি বর্ণনা অনুযায়ী এটি ইসমে আজম। একইভাবে দু’য়ায়ে ইউনুস পাঠ করবে। তিনবার আমীন বলে দু’য়া শেষ করবে। কারণ এটি দু’য়া শেষ করার বাক্য এবং আল্লাহ তায়ালা বিশেষভাবে উম্মতে মুহাম্মাদীকে এটি দান করেছেন। সেই সাথে খাতামুন নাবিয়্যীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দুরুদ ও সালাম পেশ করবে এবং শেষে হামদ পাঠ করবে। যাতে করে তার দু’য়ার শুরু ও শেষ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দুরুদের মাধ্যমে হয়। কারণ দু’য়া হলো পাখির মতো। এই পাখির ডানা হলো দুরুদ। সুতরাং দুরুদের মাধ্যমে দু’য়ার ডানা পরিপূর্ণ হয়। আর যেহেতু নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দুরুদ পাঠ করা নি:সন্দেহে কবুল হয়, এজন্য কোন দু’য়ার উভয় প্রান্ত যদি কবুল হয়ে থাকে, তাহলে আল্লাহ তায়ালার অধিক দয়ার কারণে মাঝের দু’য়াগুলি কবুলের ব্যাপারেও আশা করা যায়। আর দু’য়া যেন বেজোড় হয়। কারণ, আল্লাহ তায়ালা বেজোড়, তিনি বেজোড় পছন্দ করেন। প্রত্যেক দু’য়ার পরে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দুরুদ পাঠ করবে। কারণ দু’য়া কবুলের জন্য নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দুরুদ পাঠের চেয়ে অধিক কার্যকরী কোন কিছু নেই। আর চেষ্টা করবে যেন চোখ দিয়ে অশ্রু বের হয়। কারণ এটি দু’য়া কবুলের আলামত। যদি কান্না না আসে, তাহলে কান্নার ভান করবে। কারণ, যে যাদের সাদৃশ্য গ্রহণ করবে সে তাদের অন্তর্ভূক্ত হবে। দু’য়া করার সময় আমার কাছে পছন্দনীয় হলো, ইরাকের দিকে মুখ করে থাকবে। কারণ এটি তার জন্য সুপারিশকারীদের দিক। তার জন্য তখন কেবলামুখী হওয়া জ্বরুরি নয়। দ্বিতীয় আব্বাসী খলিফা আবু জা’ফর মানসুর  মদিনার শ্রেষ্ঠ আলিম ইমাম মালিককে জিজ্ঞেস করেন, হে মালিক, আমি কি দু’য়ার সময় কেবলামুখী হয়ে দু’য়া করব নাকি নবীজীর দিকে মুখ করে দু’য়া করব? তখন ইমাম মালিক রহ: বলেন, আপনি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে মুখ ঘোরাবেন কেন? তিনি তো আল্লাহর কাছে কিয়ামতের দিন আপনার ও আপনার আদি পিতা আদম আলাইহিস সালামের ওসিলা।  বরং আপনি তার দিকে মুখ করে থাকুন, তাকে সুপারিশকারী বানান। আল্লাহ তায়ালা আপনার জন্য তার সুপারিশ কবুল করবেন। 

মোটকথা, যে ব্যক্তি অন্তরের দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে, আল্লাহর কাছে তাড়াহুড়া করা যেমন বলল যে, আমি দু’য়া করলাম, কবুল হলো না, এগুলো করা ব্যতিরেকে দু’য়া করবে, তাহলে আশা করা যায় আল্লাহ তায়ালা তার প্রয়োজন পূরণ করে দিবেন। তবে শর্ত হলো এক্ষেত্রে কোন গোনাহ কিংবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা যাবে না। 

(ফতোয়ায়ে রিদাভিয়্যা, খ: ৭, পৃ: ৬৩৯-৬৫২) 


 










 

 


 




 

 

 

 




 

 




 





 

আহমদ রিদ্বা খানের এই দীর্ঘ বক্তব্য উদ্ধৃত করার উদ্দেশ্য হলো, এই বক্তব্য থেকে যেভাবে মাওলানা মিজান হারুন ‘সুস্পষ্ট শিরক’ বের করার চেষ্টা করেছেন, সেটি আদৌ এখানে পাওয়া যায় কি না। আমরা শুরুতেই বলেছি, মাওলানা মিজান হারুন সালাতুল গাউসিয়াকে যেভাবে আব্দুল কাদের জিলানীর কাছে সাহায্যের জন্য নামাজ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন, আসলে বিষয়টি এমন নয়। মূল নামাজ পড়া হচ্ছে আল্লাহর ইবাদতের জন্য। যেটি আহমদ রিদ্বা খান খুব স্পষ্ট করে বলেছেন, নামাজটি তাকাররুবান ইলাল্লাহ বা আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের বা আল্লাহর ইবাদতের জন্য পড়বে। সুতরাং সালাতুল গাউসিয়াকে আব্দুল কাদের জিলানীর কাছে সাহায্য প্রার্থনার নামাজ হিসেবে উপস্থাপন সঠিক নয়। বরং এখানে ব্যক্তি তার প্রয়োজন পূরণের জন্য, নামাজ, দুয়া-দুরুদ, নবীজীর কাছে ইস্তিগাছা, আব্দুল কাদের জিলানীর কাছে ইস্তিগাছা সবই করছে ওসিলা হিসেবে। উপরের কোনটায় সরাসরি মৌলিক উদ্দেশ্য নয়। বরং সব কিছুই ওসিলা হিসেবে করা হচ্ছে। যা খোদ আহমদ রিদ্বা খান আলোচনার কয়েক জায়গায় স্পষ্ট করে লিখেছেনও। এবং সর্বশেষ তিনি বলেছেন, ব্যক্তির প্রয়োজন পূরণ করবেন আল্লাহ তায়ালা। এখানে আব্দুল কাদের জিলানীকেও সরাসরি প্রয়োজন পূরণকারী সাব্যস্ত করা হয়নি। বরং সকল আমল ও ওসিলার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা বান্দার প্রয়োজন পূরণ করবেন সেটি স্পষ্ট করে উল্লেখ করা আছে। 

 

মাওলানা মিজান হারুন যেই ফতোয়ায়ে রেজভিয়া থেকে তার বক্তব্যের উদ্ধৃতি এনেছে সেখানেই বিষয়গুলো স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। ইলমি আমানতের দাবী ছিলো, আহমদ রিদ্বা খানের এধরণের স্পষ্ট বক্তব্য উদ্ধৃত করা। যার মাধ্যমে শিরক সহ যে কোন ধরণের অপবাদের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এখানে মাওলানা মিজান হারুন সচেতনভাবে বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে এমন একটি বক্তব্য লিখেছেন, যাতে মানুষের ধারণা শিরকের দিকে যায়।  তিনি হয়ত দাবী করতে পারেন, কারও বক্তব্যের সব কিছু তো উদ্ধৃত করা জ্বরুরি নয়। কিন্তু এধরণের তা’বীল এখানে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, এই আলোচনার মৌলিক অংশ যার মাধ্যমে পুরো বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যেত, সেটি এড়িয়ে গিয়ে আব্দুল কাদের জিলানীর কাছে সাহায্য প্রার্থনার জন্য নামাজ পড়া হয়, এজাতীয় একটি বাহ্যিক শিরকী বক্তব্য দিয়ে পুরো বিষয়টাকে তিনি ধোয়াশাপূর্ণ করার চেষ্টা করেছেন। 

 

এধরণের আরেকটি ইলমী আমানতের পরিপন্থী  শুরুতে সালাতুল গাউসিয়ার পদ্ধতি করতে গিয়ে। তিনি লিখেছেন,

 

“ ‘নামাযে গাউসিয়্যাহ’ এর পদ্ধতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে আহমদ ব্রেলভী আব্দুল কাদের জীলানীর বক্তব্য উদ্ধৃত করেন এভাবে: قال سيدنا ومولانا الغوث الأعظم رضي الله تعالى عنه: من توسل بي في شدة فرجت عنه، ومن استغاث بي في حاجة قضيت له، ومن صلى بعد المغرب ركعتين، ثم يصلي ويسلم على النبي صلى الله تعالى عليه وسلم، ثم يخطو إلى جهة العراق احدى عشرة خطوة، يذكر فيها اسمي قضى الله تعالى حاجته অর্থাৎ ‘আমাদের সাইয়্যেদ ও মাওলানা, গাউসুল আজম রাযিয়াল্লঅহু আনহু বলেন, ‘যে ব্যক্তি সংকটের সময় আমার উসিলা গ্রহণ করে আমি তার সংকট দূর করে দিই। আর যে কোনো প্রয়োজনে আমার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে, আমি তার প্রয়োজন পূর্ণ করি দিই। আর মাগরিবের নামাজের পরে যে ব্যক্তি দুই রাকাআত নামাজ পড়বে। রাসূলুল্লাহর ওপর দরূদ পড়বে। অতঃপর ইরাকের দিকে এগারো কদম অগ্রসর হতে হতে মুখে আমার নাম যপবে। আল্লাহ তার প্রয়োজন পূর্ণ করে দিবেন’  [ফাতাওয়া: ৭/৬৩৮] এটাকেই বলা হয় নামাযে গাউসিয়্যাহ।” 

 

এই বক্তব্যেটি আহমদ রিদ্বা খানের সম্পূর্ণ বক্তব্য নয়। এখানে মাওলানা মিজান হারুন যদি আহমদ রিদ্বা খানের সম্পূর্ণ বক্তব্যটি তুলে ধরতেন, তাহলে আলোচনার শেষে তিনি যেভাবে আহমদ রিদ্বা খানের উপর ‘সুস্পষ্ট শিরকের’ অভিযোগ এনেছেন, সেই অভিযোগ আনার সুযোগ থাকত না। স্পষ্টত: এখানে মিজান হারুন সাহেব শিরক হওয়া বা না হওয়ার মূল বিষয়গুলোকে  আহমদ রিদ্বা খানের বক্তব্য থেকে উদ্ধৃত না করে তার উপর শিরকের অভিযোগ চাপিয়ে দিতে চেয়েছেন। যা কোন আমানতদার আলিমের জন্য শোভনীয় হতে পারে না। 

 

চলুন ফতোয়ায়ে রিদাভিয়্যা থেকে আহমদ রিদা খানের সম্পূর্ণ আলোচনাটি দেখা যাক। 

 

“ সালাতুল আসরার এর মূল বিভিন্ন সনদে খোদ আব্দুল কাদের জিলানী থেকে প্রমাণিত। যেমনটি উলামায়ে কেরাম উল্লেখ করেছেন। উলামায়ে কেরামের মধ্য থেকে ইমাম আবুল হাসান নুরুদ্দীন শাত্তানূফী তার ‘বাহজাতুল আসরার’ নামক কিতাবে, শাফেয়ী মাজহাবের আরেক বিখ্যাত ইমাম আব্দুল্লাহ বিন আসআদ ইয়াফেয়ী, হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী, উলামায়ে হিন্দের শাইখুল মাশাইখ মুহাক্কিক আব্দুল হক্ব মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ: আব্দুল কাদের জিলানী থেকে এটি বর্ণনা করেছেন। 

গাউসে আজম আব্দুল কাদের জিলানী বলেছেন, কোন মুসীবতে যে আমার ওসিলা দিবে তার মুসীবত দূর করা হবে। কোন প্রয়োজনে কেউ আমার কাছে সাহায্য চাইলে তার প্রয়োজন পূরণ করা হবে। যে ব্যক্তি মাগরিবের নামাজের পর দু’রাকাত নামাজ পড়বে, এরপর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দুরুদ ও সালাম পেশ করবে, এরপর ইরাকের দিকে এগার কদম অগ্রসর হওয়ার সময় আমার নাম স্মরণ করবে, আল্লাহ তায়ালা তার প্রয়োজন পূরণ করবেন।

 

আমি (আহমদ রিদ্বা খান) বলব, মুসীবত দূর করা হবে কিংবা আমি মুসীবত দূর করব, উভয় শব্দেই আরবীতে বক্তব্যটি পড়া যেতে পারে। শাহ আবুল মা’য়ালী তুহফায়ে কাদেরিয়াতে আমি প্রয়োজন পূরণ করব এই শব্দে উক্ত বক্তব্যের অর্থ করেছেন। তবে যেভাবেই বলা হোক, উভয়ের উদ্দেশ্য এক। প্রয়োজন পূরণ করা হবে যদি উদ্দেশ্য নেয়া হয়, তাহলে অর্থ ও উদ্দেশ্য হবে স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে প্রয়োজন পূরণ করার মালিক আল্লাহ তায়ালা। তিনি প্রয়োজন পূরণ করবেন। আর যদি আমি প্রয়োজন পূরণ করব এটি উদ্দেশ্য নেয়া হয়, তাহলে সেটি বাহ্যিক কারণ হিসেবে আল্লাহর প্রদত্ত ক্ষমতা ও অনুমতিতে সৃষ্টিকে মাধ্যম ধরা হবে। তবে উভয় ক্ষেত্রেই প্রয়োজন পূরণের মূল বিষয়টি আল্লাহর দিকে ন্যস্ত হবে যেভাবে খোদ আব্দুল কাদের জিলানী বিষয়টিকে আল্লাহর দিকে ন্যস্ত করেছেন এই বলে যে, আল্লাহ তায়ালা তার প্রয়োজন পূরণ করবেন। কারণ সব কিছুর চূড়ান্ত মালিক হলেন আল্লাহ তায়ালা”। 

 

আব্দুল কাদের জিলানীর বক্তব্যে প্রয়োজন পূরণের যে কথাটি রয়েছে সেই কথার ব্যাখ্যায় উপরে আহমদ রিদ্বা খান বেরলভী শিরক হওয়া বা না হওয়ার মানদন্ড সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। সেটিকে আরও স্পষ্ট করার জন্য টীকাতে আরও স্পষ্ট বক্তব্য উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, 

“ বাস্তবে হাকিকী-বাতেনীভাবে প্রয়োজন পূরণের দ্বারা উদ্দেশ্য হলো স্বয়ংস্পূর্ণভাবে কারও দান কিংবা কারও নির্ধারণ ব্যতীত স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে প্রয়োজন পূরণ করা উদ্দেশ্য। এটি শুধুমাত্র আল্লাহর গুণের সাথেই নির্দিষ্ট।”

 

তিনি আরও লিখেছেন,

“ বাহ্যিকভাবে কারও প্রদত্ত ক্ষমতায় প্রয়োজন পূরণের দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, যেটি আল্লাহর দেয়া গুণের মাধ্যমে অর্জিত হয়। এটি কখনও স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে কারও থাকে না। শুধু প্রয়োজন পূরণ নয় বরং মাখলুকের সমস্ত গুণই এরকম আল্লাহর দেয়া। যেমন, ইলম, কুদরত, বদান্যতা, সাহায্য - সহযোগিতা, এমনকি সৃষ্টির নিজের অস্তিত্ত্বও আল্লাহ প্রদত্ত” 

(ফতোয়ায়ে রিদাভিয়্যা, খ: ৭, পৃ: ৬৩৭-৬৩৯)

 

 

 

 

 

 

 

 


 

এখানে আহমদ রিদ্বা খান বেরলভী কয়েকটি বিষয় খুব স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন, 

 

১। আব্দুল কাদের জিলানী বা অন্য কাউকে যখন প্রয়োজন পূরণকারী বলা হবে কিংবা তাদের দিকে কোন প্রয়োজন পূরণের বিষয় সম্পৃক্ত হবে, এর দ্বারা মূল উদ্দেশ্য হবে মূলত: আল্লাহ তায়ালাই স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে প্রয়োজন পূরণ করেন। সৃষ্টি তথা ব্যক্তি বা বস্তু এখানে মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। মূল বিষয় আল্লাহর দিকেই ন্যাস্ত হবে।

২। মাখলুকের কোন কিছুই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। বরং প্রয়োজন পূরণ থেকে শুরু করে তার ইলম, ক্ষমতা, বদান্যতা এমনকি তার নিজেরও অস্তিত্বও আল্লাহর দেয়া। এখানে মাখলুকের স্বয়ংসম্পূর্ণ ও নিজস্ব বলে কিছু নেই। 

 

৩। আব্দুল কাদের জিলানীর নাম নেয়ার কথা বললেও মূল প্রয়োজন পূরণ করবেন আল্লাহ তায়ালা। যা খোদ আব্দুল কাদের জিলানী নিজে বলেছেন এবং এটাকেই আহমদ রিদ্বা খান তার মূল সিদ্ধান্ত হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আমরা উপরে দেখিয়েছি, এই পদ্ধতির বিস্তারিত বিবরণের ক্ষেত্রেও আহমদ রিদ্বা খান চূড়ান্ত প্রয়োজন পূরণকারী হিসেবে আল্লাহ তায়ালাকেই সাব্যস্ত করেছেন এবং আল্লাহর কাছে দু’য়া করার বিভিন্ন পদ্ধতি ও নিয়ম শিখিয়েছেন। এবং এও শর্ত করে দিয়েছেন যে, আদব ও ইহতিরামের সাথে, তাড়াহুড়ো না করে, গোনাহ ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন না করে এভাবে দু’য়া করলে সেটি কবুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এখানে যাদের ওসিলা করা হচ্ছে কিংবা যাদেরকে সুপারিশকারী মনে করা হচ্ছে, তাদের কাউকেই সুপারিশের ক্ষেত্রেও স্বাধীন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ  মনে করা হচ্ছে না যে, আল্লাহ তায়ালা চান অথবা না চান, নাউজুবিল্লাহ আব্দুল কাদের জিলানীর কাছে চাইলেই সেটা পূরণ হবে। এধরণের শিরকী সুপারিশ বা ওসিলাও এখানে পাওয়া যাচ্ছে না। বরং নামাজ, দু’য়া, ইস্তিগাছা, দুরুদ ও সালাম সব কিছুর পরে প্রয়োজন পূরণের বিষয়টি আল্লাহর উপর ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। তিনি বান্দার দু’য়া কবুলও করতে পারেন। নাও করতে পারেন। তবে সঠিক পদ্ধতিতে করলে আদব ও ইহতিরামের সাথে করলে দু’য়া কবুলের সম্ভাবনা থাকে। 

 

৪। আহমদ রিদ্বা খান যেসব বিখ্যাত ইমামদের উদ্ধৃতিতে এটি তার কিতাবে এনেছেন সেটি গোপন করে পুরো বিষয়ের দোষটি শুধু আহমদ রিদ্বা খানের উপর চাপিয়ে তাকে `সুস্পষ্ট শিরকের` অভিযোগে অভিযুক্ত করা আরেকটি বড় ধরণের ইলমী খিয়ানত। উপরের পদ্ধতি ও আমল যদি শিরক হয়, তাহলে পূর্বের যেসব আলিমরা বিষয়টির উপর আমল করেছেন কিংবা আমলের জন্য তাদের কিতাবে এনেছেন, তাদেরকেও সুস্পষ্ট শিরকের অভিযোগ দিতে হবে। এখানে শুধু আহমদ রিদ্বা খানের উপর কেন তার মাসলাকবাজির আশ্রয় নিয়ে অন্তরের সুপ্ত জিঘাংসা চরিতার্থ করা হবে? মিজান হারুনের উচিৎ ছিলো, মোল্লা আলী ক্বারীর উপর সুস্পষ্ট শিরকের অভিযোগ দেয়া। শায়খ আব্দুল হক্ব মুহাদ্দিসে দেহলভীর উপর শিরকের অভিযোগ দেয়া। ইমাম আব্দুল্লাহ বিন আসআদ ইয়াফেয়ীর উপর শিরকের অভিযোগ দেয়া।  কিন্তু আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, তিনি শিরকের অভিযোগের তীর শুধু আহমদ রিদ্বা খানের দিকে ছুঁড়েছেন। অথচ মূল বিষয় যদি শিরক হয়ে থাকে, তাহলে উপরের সবার দিকেই এই অভিযোগ আরোপ করার প্রয়োজন ছিলো। 

 

মাওলানা মিজান হারুন কীসের ভিত্তিতে আহমদ রিদ্বা খানের উপরের আলোচনাগুলিকে শিরক বানিয়ে দিলেন, তার কোন সুনির্দিষ্ট ভিত্তি আলোচনা করেননি। আব্দুল কাদের জিলানীকে উভয় জাহানের প্রয়োজন পূরণকারী কিংবা মুক্তিদাতা ইত্যাদি শব্দের বাহ্যিক অর্থ নিয়ে এটিকে আল্লাহর বিপরীতে দাঁড় করিয়ে সুস্পষ্ট শিরকের অভিযোগ এনেছেন। অথচ খোদ আব্দুল কাদের জিলানী এবং আহমদ রিদ্বা খানের উভয়ে তাদের বক্তব্যে স্পষ্ট করেছেন, তাদের প্রয়োজন পূরণ কিংবা বিপদাপদ দূর করার বিষয়টি মৌলিকভাবে আল্লাহর দিকেই ন্যাস্ত। মূলত: আল্লাহ তায়ালাই প্রয়োজন পূরণ কিংবা বিপদাপদ দূর করেন। এজন্য এখানে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কাউকে স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে প্রয়োজন পূরণকারী বিশ্বাস করা হচ্ছে না কিংবা কারও জন্য আল্লাহর ইচ্ছা, অনুমতি কিংবা আল্লাহর দেয়া ক্ষমতার বাইরে কোন কিছুই সাব্যস্ত করা হচ্ছে না, তাহলে কীসের ভিত্তিতে বিষয়টি শিরক হলো? 

 

এখানে মাওলানা মিজান হারুনের আরেকটি বড় ইলমী দুর্বলতা হলো, শিরকের মূলনীতি ও ভিত্তি আলোচনা না করে সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির উপর বড় শিরকের অভিযোগ তোলা। বিশেষ করে কারও ব্যাপারে শিরকের অভিযোগ সঠিক হওয়ার জন্য সবার আগে প্রয়োজন ছিলো, তার শিরক হওয়া বা না হওয়ার মূলনীতি ঠিক করে দেয়া। কিন্তু তিনি সেটি না করে জোরপূর্বক ব্যক্তির উপর শিরক চাপিয়ে দিতে চেয়েছেন। তিনি আশা করেছেন, পাঠক তার বক্তব্যের ফাঁক-ফোকর অনুধাবন না করেই তার শিরকের অভিযোগ মেনে নিবে। অথচ বাস্তবতা হলো কিছু মূর্খ মানুষকে এভাবে বিভ্রান্ত করা সম্ভব হলেও বাস্তবে এভাবে কাউকে জোর করে বড় শিরকের অভিযোগ করে পার পাওয়া যাবে না। বরং তাকে এই মারাত্মক অভিযোগের দায় নিতে হবে। এবং শিরক হওয়া বা না হওয়ার দলিল ভিত্তিক আলোচনা করে মূলনীতি ঠিক করে তবেই শিরকের অভিযোগ দিতে হবে। 

 

নতুবা আমরা তো নজদী-তাইমীদেরকে কথায় কথায় মানুষকে শিরকের অভিযোগ দিতে দেখি। তাহাজ্জুদ না পড়ে ঘুমিয়ে থাকা, স্ত্রীর ভালোবাসায় শরীয়াত বিরোধী কাজ করা, বাকীটা আল্লাহর হাতে বলা, এজাতীয় শত শত বিষয়কে শিরক বানিয়ে রেখেছে তারা। এমনকি এক সময় আমরা তাদের কাছ থেকে শুনেছি, মাওলানা বলা শিরক। কারণ, কুরআনে আল্লাহ তায়ালা নিজের ক্ষেত্রে মাওলানা শব্দ ব্যবহার করেছেন। সুতরাং আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও জন্য মাওলানা বলা শিরক। মাজহাব মানা শিরক। এভাবে তাদের শিরকের ফিরিস্তির তো কোন কুল-কিনারা নেই। 

 

মজার বিষয় হলো, এই আলোচনায় আহমদ রিদ্বা খান প্রয়োজন পূরণের ক্ষেত্রে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কাজিউল হাজাত বলেছেন। একইভাবে আব্দুল কাদের জিলানীকেও কাজিউল হাজত বা প্রয়োজনপূরণকারী বলেছেন। মিজান হারুন সাহেব, এই দু’টি শব্দ নিয়েও শিরক হওয়ার দিকে ইঙ্গিত দিয়েছেন। অথচ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যেই অর্থে কাজিউল হাজত বলা হয়েছে সেই অর্থে আব্দুল কাদের জিলানীকে কখনও কাজিউল হাজাত বলা হয়নি এটা নিশ্চিৎ। আবার মাখলুক হিসেবে নবীজী বা আব্দুল কাদের জিলানীকে যেই অর্থে কাজিউল হাজাত বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালাকে কখনও সেই একই অর্থে বলা হয় না। কিন্তু এখানে মিজান হারুন সাহেবরা আল্লাহ তায়ালাকে মাওলানা বলা আর হুজুরকে মাওলানা বলার বাহ্যিক শব্দকে এক করে শিরক বলার মতো করে তিনটি ব্যবহারকে এক বানিয়ে এর উপর জোর করে শিরকের হুকুম চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। 

 

শুধু শব্দের ব্যবহার যদি শিরক হওয়া বা না হওয়ার নির্ধারক হয়, তাহলে নাউজুবিল্লাহ পবিত্র কুরআনের নিচের সবগুলো ব্যবহারকে শিরক বলতে হবে। 

 

১। দেখুন, পবিত্র কুরআনে আল্লাহর গুণ হিসেবে রহীম শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। বিসমিল্লাহ এর মধ্যেই রহীম গুণটি আল্লাহর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। সূরা ফাতিহার আর-রহমানির রহীম, এখানে রহীম শব্দটি আল্লাহর জন্য গুণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

আবার পবিত্র কুরআনে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেও রহীম বলা হয়েছে। যেমন সূরা তাওবার ১২৮ নং আয়াত,

لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِّنْ أَنفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُم بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ (128)

এখানে আসলে শুধু রহীম নয়, রউফুন আল্লাহর গুণবাচক নাম। সেটিও নবীজীর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। আজীজ আল্লাহর নাম। সেটিও নবীজীর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।

আল্লাহর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে এমন তিনটি গুণবাচক শব্দ এখানে নবীজীর জন্যও হুবহু একই শব্দে ব্যবহার করা হয়েছে।

তাহলে কী কুরআন আমাদেরকে নাউজুবিল্লাহ শিরক শিক্ষা দিচ্ছে?

২। পবিত্র কুরআনে আল্লাহর গুণ হিসেবে সামী (শ্রোতা), বাসীর (দ্রষ্টা) শব্দ দু'টি ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ একই গুণ মানুষের জন্যও ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন সূরা দাহরে রয়েছে,

هَلْ أَتَى عَلَى الإنْسَانِ حِينٌ مِنَ الدَّهْرِ لَمْ يَكُنْ شَيْئًا مَذْكُورًا ۝ إِنَّا خَلَقْنَا الإنْسَانَ مِنْ نُطْفَةٍ أَمْشَاجٍ نَبْتَلِيهِ فَجَعَلْنَاهُ سَمِيعًا بَصِيرًا ۝

অর্থ: মানুষের উপর এমন কিছু সময় অতিবাহিত হয়েছে যখন সে উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না। আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মিশ্র শুক্রবিন্দু থেকে, এভাবে যে, তাকে পরীক্ষা করব অতঃপর তাকে করে দিয়েছি শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন।

এখানে আল্লাহর জন্য ব্যবহার হওয়া 'সামী', 'বাসীর' গুণবাচক শব্দ দু'টি হুবহু বান্দা বা মানুষের জন্যও ব্যবহার করা হয়েছে। তাহলে কি নাউজুবিল্লাহ কুরআনে আল্লাহ ও বান্দার গুণের মাঝে শিরক করা হয়েছে?

৩। আল্লাহর আরেকটি গুণবাচক নাম হলো 'আলীম'। অথচ এটি হুবহু একই শব্দে পবিত্র কুরআনে বান্দার জন্যও ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন، সূরা যারিয়াতে হযরত ইব্রামী আ: এর স্ত্রীকে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে একজন আলীম ছেলের।

فَأَوْجَسَ مِنْهُمْ خِيفَةً ۖ قَالُوا لَا تَخَفْ ۖ وَبَشَّرُوهُ بِغُلَامٍ عَلِيمٍ

অর্থ: অতঃপর তাদের সম্পর্কে সে মনে মনে ভীত হলঃ তারা বললঃ ভীত হবেন না। তারা তাঁকে একট জ্ঞানীগুণী পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিল।

এখানে কি তাহলে আল্লাহর গুণবাচক নাম আলীম বান্দার জন্য ব্যবহার করে শিরক হয়েছে নাউজুবিল্লাহ?

কুরআনের অন্য জায়গায় আছে,

وفوق كل ذي علم عليم

এরকম হালীম আল্লাহর গুণবাচক নাম। আবার ইসমাইল আলাইহি ওয়াসাল্লামকেও হালীম বলা হয়েছে। যেমন,

فَبَشَّرْنَاهُ بِغُلَامٍ حَلِيمٍ

এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে, যেখানে আল্লাহর গুণবাচক নামগুলো হুবহু বান্দার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে কী শিরক হয়েছে? যদি শিরক না হয়ে থাকে, তাহলে কেন শিরক নয়? আপনি যে বললেন, আল্লাহর গুণ অন্যের জন্য সাব্যস্ত করা শিরক, তাহলে এসব ক্ষেত্রে শিরক নয় কেন? আর গুণের ক্ষেত্রে শিরক হওয়া বা না হওয়ার পার্থক্যই বা কীভাবে করা হবে?

অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। কারণ, তারা শিরক বিষয়ে অনেক শোরগোল করলেও শিরকের বাস্তবতা বোঝার ক্ষেত্রে অন্য সবার থেকে পিছিয়ে।

 

গুণের ক্ষেত্রে শিরকের বিষয়টি নিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়ে যাওয়ার পর যদি কর্মের ক্ষেত্রে শিরক নিয়ে আলোচনা তুলি, তাহলে এখানেও কুল-কিনারা করতে পারেন না। কিন্তু মৌলিক বিষয়গুলো বলতে না পারলেও শিরক নিয়ে তাদের শোরগোল কিন্তু থেমে নেই।

যদি জিজ্ঞেস করি, আপনি যে বলেছেন, গুণ, কর্ম ও ইবাদতে আল্লাহর শরীক করা। গুণের বিষয় তো সুরাহা করতে পারলেন না। তো এবার কর্মের বিষয়ে বলেন। কর্মে আল্লাহর সাথে শরীক করার অর্থ কী?

বলে, আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট কাজ বান্দার জন্য সাব্যস্ত করা হলো কর্মের শিরক।

জিজ্ঞেস করি, এরকম দু'একটি শিরকের উদাহরণ দিন।

বলে, সন্তান দেয়া, সৃষ্টি করা, জীবন - মৃত্যু দেয়া ইত্যাদি।

আমি বললাম, উপরের সবগুলো বিষয়ই পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া মাখলুকের জন্য সাব্যস্ত করা হয়েছে। কিছু উদারহণ দিলেই স্পষ্ট হবে। আল্লাহ তায়ালার কর্ম অন্যের জন্য সাব্যস্ত করে কি তাহলে কুরআনে নাউজুবিল্লাহ আমাদেরকে শিরক শেখান হয়েছে?

আপনাদের উদারহণ দেয়া কর্মগুলো আল্লাহ ছাড়া অন্যের ক্ষেত্রে ব্যবহারের কিছু নমুনা

১। হযরত মারইয়াম আলাইহাস সালাম এর ঘটনা পবিত্র কুরআনের সূরা মারইয়ামে এসেছে।

فَاتَّخَذَتْ مِن دُونِهِمْ حِجَابًا فَأَرْسَلْنَا إِلَيْهَا رُوحَنَا فَتَمَثَّلَ لَهَا بَشَرًا سَوِيًّا

অতঃপর তাদের থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্যে সে পর্দা করলো। অতঃপর আমি তার কাছে আমার রূহ প্রেরণ করলাম, সে তার নিকট পুর্ণ মানবাকৃতিতে আত্নপ্রকাশ করল।

قَالَتْ إِنِّي أَعُوذُ بِالرَّحْمَـٰنِ مِنكَ إِن كُنتَ تَقِيًّا

মারইয়াম বললঃ আমি তোমা থেকে দয়াময়ের আশ্রয় প্রার্থনা করি যদি তুমি আল্লাহভীরু হও।

قَالَ إِنَّمَا أَنَا رَسُولُ رَبِّكِ لِأَهَبَ لَكِ غُلَامًا زَكِيًّا

সে বললঃ আমি তো শুধু তোমার পালনকর্তা প্রেরিত, যাতে তোমাকে এক পবিত্র পুত্র দান করে যাব।

এখানে সন্তান দেয়ার ক্ষেত্রে জিবরীল আলাইহিস সালাম নিজের দিকে সন্তান দেয়ার কর্মকে সম্পৃক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, আমি আপনাকে পবিত্র সন্তান দিব। সন্তান দেয়ার কর্মকে সরাসরি নিজের দিকে সম্পৃক্ত করেছেন।

আল্লাহর কর্ম জিবরাইল আলাইহিস সালাম নিজের দিকে সম্পৃক্ত করে কি কর্মের মাঝে শিরক করেছেন? যদি বলেন, হ্যাঁ। তাহলে কুরআন নাউজুবিল্লাহ শিরক শিক্ষা দিয়েছে। আর যদি না বলেন, তাহলে কর্মের মধ্যে শিরক হচ্ছে কি না সেটা কীভাবে পার্থক্য করা হবে? কোন কর্মটা শিরক আর কোনটা শিরক নয় সেটা কীভাবে বোঝা যাবে?

২। আপনি উপরে সৃষ্টির কথা বলেছেন। অথচ সৃষ্টি করার কথা আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্যেও পবিত্র কুরআনে ব্যবহার করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় আপনার উদাহরণ দেয়া অনেকগুলো কর্মের ক্ষেত্রে ঈসা আলাইহিস সালাম বলেছেন, আমি এগুলো আল্লাহর অনুমতিতে করি। যেমন, সূরা আল-ইমরানের ৪৯ নং আয়াতে রয়েছে,

وَرَسُولًا إِلَىٰ بَنِي إِسْرَائِيلَ أَنِّي قَدْ جِئْتُكُم بِآيَةٍ مِّن رَّبِّكُمْ ۖ أَنِّي أَخْلُقُ لَكُم مِّنَ الطِّينِ كَهَيْئَةِ الطَّيْرِ فَأَنفُخُ فِيهِ فَيَكُونُ طَيْرًا بِإِذْنِ اللَّهِ ۖ وَأُبْرِئُ الْأَكْمَهَ وَالْأَبْرَصَ وَأُحْيِي الْمَوْتَىٰ بِإِذْنِ اللَّهِ ۖ وَأُنَبِّئُكُم بِمَا تَأْكُلُونَ وَمَا تَدَّخِرُونَ فِي بُيُوتِكُمْ ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَةً لَّكُمْ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ

আর বণী ইসরাঈলদের জন্যে রসূল হিসেবে তাকে মনোনীত করবেন। তিনি বললেন নিশ্চয়ই আমি তোমাদের নিকট তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে এসেছি নিদর্শনসমূহ নিয়ে। আমি তোমাদের জন্য মাটির দ্বারা পাখীর আকৃতি তৈরী করে দেই। তারপর তাতে যখন ফুৎকার প্রদান করি, তখন তা উড়ন্ত পাখীতে পরিণত হয়ে যায় আল্লাহর হুকুমে। আর আমি সুস্থ করে তুলি জন্মান্ধকে এবং শ্বেত কুষ্ঠ রোগীকে। আর আমি জীবিত করে দেই মৃতকে আল্লাহর হুকুমে। আর আমি তোমাদেরকে বলে দেই যা তোমরা খেয়ে আস এবং যা তোমরা ঘরে রেখে আস। এতে প্রকৃষ্ট নিদর্শন রয়েছে, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও।

এখানে ঈসা আলাইহিস সালাম বলেছেন, আমি তোমাদের জন্য মাটি দিয়ে পাখির আকৃতি সৃষ্টি করে সেখানে ফুৎকার দেই। আর সেটি আল্লাহর অনুমতিতে পাখি হয়ে যায়। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, তিনি এখানে খালক বা সৃষ্টি শব্দ ব্যবহার করেছেন। একইভাবে মৃতকে জীবিত করার কথাও বলেছেন। একইভাবে তিনি গায়েবের বিষয়ও বলতে পারেন। যেমন, তোমরা কী খাও, আর ঘরে কী সঞ্চয় করো, সেগুলোও আমি আল্লাহর অনুমতিতে বলে দিতে পারি।

এখন মৌলিকভাবে এসব কর্ম আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট হয়, তাহলে ঈসা আলাইহিস সালাম বা অন্য কারও দ্বারা সেগুলো সংগঠিত হওয়া শিরক। আপনি হযত বলবেন, এগুলো তো তিনি আল্লাহর অনুমতিতে করেছেন। তখন প্রশ্ন থাকে, আল্লাহ তায়ালা কি ঈসা আলাইহিস সালাম বা অন্য কাউকে শিরক করার অনুমতি কখনও দিবেন? মৌলিকভাবে বিষয়গুলো যদি শিরকই হয়, তাহলে আল্লাহ তায়ালা কী শিরক করার অনুমতি দেন? আর যদি মৌলিকভাবে কর্মগুলো যদি শিরক না হয়, তাহলে আপনি উপরে এগুলোকে কর্মের শিরক কেন বললেন? আর কর্মের ক্ষেত্রে শিরক হচ্ছে কি না সেটা বোঝার মানদন্ডই বা কি?

৩। উপরে ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর অনুমতিতে মৃতকে জীবিত করার কথা বলেছেন। এর উল্টোও কুরআনে আছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,

اللَّهُ يَتَوَفَّى الْأَنفُسَ حِينَ مَوْتِهَا وَالَّتِي لَمْ تَمُتْ فِي مَنَامِهَا ۖ فَيُمْسِكُ الَّتِي قَضَىٰ عَلَيْهَا الْمَوْتَ وَيُرْسِلُ الْأُخْرَىٰ إِلَىٰ أَجَلٍ مُّسَمًّى ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ

আল্লাহ মানুষের প্রাণ হরণ করেন তার মৃত্যুর সময়, আর যে মরে না, তার নিদ্রাকালে। অতঃপর যার মৃত্যু অবধারিত করেন, তার প্রাণ ছাড়েন না এবং অন্যান্যদের ছেড়ে দেন এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।

এই আয়াতসহ কুরআনের বহু আয়াতে জান-কবজ ও মৃত্যুকে আল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।

আবার একই কাজ (জান-কবজ) বা মৃত্যুকে আল্লাহ ছাড়া অন্য মাখলুকের দিকেও সম্পৃক্ত করা হয়েছে।

قُلْ يَتَوَفَّاكُم مَّلَكُ الْمَوْتِ الَّذِي وُكِّلَ بِكُمْ ثُمَّ إِلَىٰ رَبِّكُمْ تُرْجَعُونَ

বলুন, তোমাদের প্রাণ হরণের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতা তোমাদের প্রাণ হরণ করবে। অতঃপর তোমরা তোমাদের পালনকর্তার কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে।

সূরা সাজদাহ, আয়াত-১১।

এখানে জান-কবজের কাজকে ফেরেশতাদের দিকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এখন আল্লাহর কর্মকে ফেরেশতাদের দিকে সম্পৃক্ত করাতে কি কর্মের শিরক হয়েছে? যদি না হয়ে থাকে তাহলে কর্মের শিরক জিনিসটা কী? আপনার উপরের বক্তব্য অনুযায়ী এগুলো কর্মের শিরক হওয়ার কথা?

আপনি হয়ত বলবেন, ঈসা আলাইহিস সালাম বা ফেরেশতাদের কর্মগুলো রুপক। এখন প্রশ্ন আসবে, রুপক অর্থেও কি আল্লাহর সাথে শিরক করার অনুমতি আছে? এখানে রুপক বলতে কী উদ্দেশ্য? আপনার বক্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে, এমন কিছু কর্ম রয়েছে যেগুলো আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। সেগুলো আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও থেকে প্রকাশিত হলে আপনি এটাকে কর্মের শিরক মনে করছেন। অথচ আমরা দেখছি, এই কাজগুলো পবিত্র কুরআনেই বিভিন্ন জায়গায় আল্লাহ ছাড়া অন্য থেকে প্রকাশিত হওয়ার কথা আছে। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, নাউজুবিল্লাহ পবিত্র কুরআন আমাদেরকে কর্মের শিরক শিক্ষা দিয়েছে। আর যদি বিষয়টি এমন না হয়, তাহলে কর্মের শিরকের বাস্তবতা তাহলে কী? কীভাবে পার্থক্য করা হবে যে, কোন কর্মটা আল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত করলে তাওহীদ, আর কোনটা আল্লাহ ছাড়া সৃষ্টির দিকে সম্পৃক্ত করলে শিরক?

উভয়ের মাঝে পার্থক্যের মানদন্ডটা আসলে কী?

 

শিরকের মানদন্ড আলোচনার পূর্বে সালাতুল গাউসিয়া  বা এজাতীয় কাছাকাছি আমল কারা করেছেন, তাদের বিষয়ে কিছু আলোচনা প্রয়োজন। এখানে মোল্লা আলী ক্বারী সহ অন্যদের কিছু আলোচনা তাদের কিতাব থেকে উদ্ধৃত করার চেষ্টা করব। 

 

১। হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলিম মোল্লা আলী ক্বারী শায়খ আব্দুল কাদের জিলানীর জীবনীর উপর পৃথক একটি পুস্তক রচনা করেছেন। এর নাম দিয়েছেন, নুজহাতুল খাতিরিল ফাতির ফি তারজামাতি সাইয়্যিদিশ শরীফ আব্দিল ক্বাদির। এই কিতাবের ৬১ পৃষ্ঠায় তিনি সনদসহ সালাতুল গাউসিয়ার বিষয়টি আব্দুল কাদের জিলানী থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, 

“ শায়খ আবুল হাসান আলী আল-খাব্বাজ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি শায়খ আবুল কাসেম উমর আল-বাজ্জাজকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, আমি সাইয়্যিদি মহিউদ্দীন আব্দুল কাদেরকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি কোন বিপদাপদে আমার মাধ্যমে সাহায্য চাইবে তার বিপদ দূর করা হবে, কোন মুসীবতে কেউ আমার নামে ডাকলে তার মুসীবতের সমাধান করা হবে। যে আমার ওসিলা করে কোন প্রয়োজনে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবে তার প্রয়োজন পূরণ করা হবে। যে ব্যক্তি দু’রাকাত নামাজ আদায় করবে, প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহার পর এগারবার সূরা ইখলাস পাঠ করবে, নামাজ শেষে নবীজীর উপর এগার বার দুরুদ-সালাম পেশ করবে এবং আল্লাহর রাসূলের কথা স্মরণ করবে, অত:পর ইরাকের দিকে এগার কদম অগ্রসর হবে এবং আমার নাম স্মরণ করে তার প্রয়োজনের কথা স্মরণ করবে, আল্লাহর অনুমতিতে তার প্রয়োজন পূরণ করা হবে।”

 

এই বর্ণনা উল্লেখ করে মোল্লা আলী ক্বারী লিখেছেন, এই আমলটি বহুবার পরীক্ষিত হয়েছে এবং বাস্তবে ব্যক্তির প্রয়োজন পূরণ হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা শায়খ আব্দুল কাদিরের উপর সন্তুষ্ট হোন (নুজহাতুল খাতিরিল ফাতির, পৃ: ৬১)

 

এখানে মোল্লা আলী ক্বারী শুধু বর্ণনা উল্লেখ করেই ক্ষ্যান্ত হোননি, বরং এই আমলটি যে বহুবার আমল করে পরীক্ষিত বাস্তব একটি আমল সেটিও উল্লেখ করেছেন। সুতরাং মোল্লা আলী কারীর কাছে আমলটি শুধু বিশ্বাসের স্তরে থাকেনি, এটি বাস্তবে আমল করার মাধ্যমেও প্রমাণিত। এখন উপরের আমলের উপর যদি শিরকের হুকুম দিতে হয়, তাহলে কিতাবে উল্লেখ এবং আমলটিকে বার বার পরীক্ষার মাধ্যমে সঠিক প্রমাণের দাবীর কারণে মোল্লা আলী কারীর উপরও শিরকের অভিযোগ আসবে। 





 









 


 

২। আব্দুল হক্ব মুহাদ্দিসে দেহলভী

 

শায়খ আব্দুল হক্ব মুহাদ্দিসে দেহলভীও তার আখবারুল আখইয়ার এবং যুবদাতুল আসার কিতাবে উপর্যুক্ত পদ্ধতি উল্লেখ করেছেন। 


 


 



 

৩। শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী

উপরে আমরা দেখেছি, মাওলানা মিজান হারুন আব্দুল কাদির জিলানীকে গাউসুস সাকালাইন  বা জ্বিন ও ইনসানের মুক্তিদাতা বলার কারণে শক্ত সমালোচনা করে লিখেছেন, 

 

“ইন্নালিল্লাহ! জীলানী জ্বিন ও ইনসানের মুক্তিদাতা। প্রয়োজনপূর্ণকারী। তাহলে আল্লাহর জন্য তারা কী বাকি রেখেছে? আল্লাহ বলেছেন, ‌'তোমরা আমাকে ডাকো আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিবো‌' [মুমিন: ৬০] আর তারা শেখাচ্ছে আব্দুল কাদের জীলানীকে ডাকতে। এগুলো সুস্পষ্ট শিরক। অপব্যাখ্যাকারীদেরকে আল্লাহ হিদায়াত দিন।”

 

অথচ আমরা যদি শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভীর কিতাব দেখি, সেখানে তিনিও স্পষ্ট ভাষায় আব্দুল কাদের জ্বিলানীকে গাউসুস সাকালাইন বলেছেন। শায়খ উবাইদুল্লাহ আহরারকে ‘গাউসে আ’জম’ বলেছেন। এখন ওলী-বুজুর্গদের কাউকে গাউসুস সাকালাইন বলার দ্বারা যদি তাদেরকে আল্লাহর বিপরীতে দাঁড় করিয়ে সুস্পস্ট শিরকের অভিযোগ দেয়া যায় তাহলে শাহ ওয়ালিউল্লাহর উপর কেন একই অভিযোগ আরোপ করা হবে না, যেই অভিযোগ আহমদ রিদ্বা খানের উপর আরোপ করা হচ্ছে? 

 

 

 

 


 


 


 

শিরকের অভিযোগের উপর আহমদ রিদ্বা খানের কৈফিয়ত:


 

এধরণের বিষয়ের উপর শিরকের অভিযোগ অনেক আগে থেকেই চলমান আছে। বিশেষ করে ইবনে আব্দিল ওয়াহহাব নজদীর খারেজী আন্দোলনের পর থেকে এর প্রচার-প্রসার বেশি হচ্ছে। এধরণের শিরকের অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে আহমদ রিদ্বা খান বেরলভী তার “হায়াতুল মাওয়াত ফি বায়ানি সিমাইল আমওয়াত” কিতাবে লিখেছেন, 

 

“শাহ ওয়ালিউল্লাহ তার কিতাব আল-ইন্তিবাহ তে লিখেছেন, আমাকে আমার শায়খ আবু তাহের কুর্দি এই সিলসিলার খিরকা পরিয়েছেন। তিনি আমাকে ‘জাওয়াহিরে খামসা’ - তে যত আমল আছে সেগুলোর ইজাজত দিয়েছেন। 

 

পরবর্তীতে লিখেছেন,

“ আমি হজ্বের সফরে যখন লাহোর পৌঁছলাম, সেখানে শায়েখ মুহাম্মাদ সাইদ লাহোরীর হস্ত চুম্বনের সুযোগ হয়। তিনি আমাকে ‘সাইফী’ দু’য়ার ইজাজত দিয়েছেন। বরং তিনি জাওয়াহিরে খামসার সমস্ত আমলের ইজাজত দিয়েছেন।”

 

এই শাইখ আবু তাহের কুরদী মাদানী মূলত: শাহ ওয়ালিউল্লাহর হাদীস ও তাসাউফের সিলসিলায় রয়েছেন। মদিনায় দীর্ঘ সময় তার খেদমতে থেকে তার কাছ থেকে হাদীসের সনদ হাসিল করেছেন। এই সনদই পরবর্তীতে শাহ আব্দুল আজিজের মাধ্যমে শাহ ইসহাক পেয়েছেন। 

দু’য়ায়ে সাইফীর অনুমতি যেই শায়েখ সাইদ লাহোরীর কাছ থেকে নিয়েছেন তার সম্পর্কে শাহ ওয়ালিল্লাহ লিখেছেন, 

“ শায়েখ সাইদ ত্বরিকতের বরেণ্য শায়খদের মধ্যে বিশ্বস্ত একজন শায়েখ”। 

 

এই ইন্তিবাহ কিতাবেই জাওয়াহিরে খামসা ও সাইফী দু’য়ার সনদ উল্লেখ করা হয়েছে। এই সনদে শায়েখ আবু তাহের কুর্দির পিতা শায়েখ ইব্রাহীম কুর্দি, তার উস্তায শায়েখ আহমদ কাশশাশী, তার উস্তায শায়েখ আহমদ শাননাবী রয়েছেন। আরেক সনদে শাহ ওয়ালিউল্লাহর দাদা উস্তায় আহমদ নাখলী রয়েছেন।  মোটকথা এই চারজন শাহ ওয়ালিউল্লাহর অধিকাংশ হাদীসের সনদেও রয়েছে। তার মুসালসাল হাদীসের সনদগুলো বিশ্লেষণ করলে এমনটাই প্রতিয়মান হয়। 

অন্য দিকে শাইখ সাইদ লাহোরীর পীর ছিলেন শাইখ আশরাফ লাহোরী, তার শায়েখ ও পীর ছিলেন মাওলানা আব্দুল মালেক, তার শায়েখ ও পীর ছিলেন শায়েখ বাইজীদে সানী (দ্বিতীয় বায়জীদ), এবং শায়েখ আহমদ শান্নাবীর পীর ছিলেন সাইয়্যেদ সিবগাতুল্লাহ বুরুজী। তাদের পীর ছিলেন মাওলানা ওজীহুদ্দীন আলাভী। এই সমস্ত মাশায়েখ ও উলামা সাইফী দু’য়া সহ জাওয়াহিরে খামসার বিভিন্ন আমলের ইজাজত তাদের উস্তায থেকে হাসিল করেছেন এবং তারা তাদের ছাত্রদেরকে ইজাজত দিয়েছেন। শাহ মুহাম্মাদ গাউস গোলিয়ারী তো এই সিলসিলার সর্বশেষ ব্যক্তি। তিনি নিজেই জাহওয়াহিরে খামসার লেখক। আল্লাহ তায়ালা সবার উপর রহম করুন।

 

লক্ষ্য করুন, এই জাওয়াহিরে খামসাতে সাইফী দু’য়ার পদ্ধতি এভাবে লেখা হয়েছে,

“সাতবার, তিনবার অথবা একবার নাদে আলী পড়বে। নাদে আলী হলো,

 

ناد عليا مظهر العجائب 

تجده عونا لك في النوائب

كل هم و غم سينجلي 

بولايتك يا علي يا علي

 

অর্থ: আশ্চর্য্য বিষয় প্রকাশের আধার আলীকে ডাকো। তোমার বিপদাপদে তাকে সাহায্যকারী হিসেবে পাবে। প্রত্যেক চিন্তা ও পেরেশানী অচিরেই দূর হবে। আপনার বিলায়াতের মাধ্যমে হে আলী, হে আলী। 

 

আলী রাজিয়াল্লাহু কে মুশকিল কুশা বা বিদাপদে সাহায্যকারী বিশ্বাস করা, মুসীবতে উদ্ধারকারী বিশ্বাস করা, চিন্তা - পেরেশানীর সময় ইয়া আলী ইয়া আলী বলে আহ্বান করা সরাসরি শিরক হয়, তাহলে তোমাদের নিকট উপরের সমস্ত আলিম ও মাশায়েখ কাফের ও মুশরিক হওয়ার কথা। সবচেয়ে বড় মুশরিক ও কট্রর কাফের হওয়ার কথা নাউজুবিল্লাহ শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ। তিনি তো এসব মুশরিকদেরকে ওলী মনে করতেন, নিজের শায়েখ, উস্তায, পীর ও হাদীস ও তাসাউফের সনদ মনে করেন তাদেরকে। নবীজীর হাদীসের সনদ নিয়েছেন তাদের কাছ থেকে। লম্বা সময় তাদের খেদমতে আত্মনিয়োগ করেছেন। তাদের শায়খ, সিকাহ, আমানতদার হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাদের সাক্ষাৎকে হস্ত চুম্মনের সৌভাগ্য বলে উল্লেখ করেছেন।  

 

এই যে মুহাদ্দিস হওয়া, তাদের সব হাদীসের সনদ এমনভাবে ধ্বংস হলো যে এর মধ্যে এতোজন মুশরিক রয়েছে। শাহ ওয়ালীউল্লাহর পরে শাহ আব্দুল আজিজও একইভাবে পূর্ববর্তীদের প্রতি তার মহব্বত, সুধারণা, তাদের আক্বিদা ও চিন্তা-চেতনার সাথে একাত্মতা ছিলো। শাহ সাহেবের হাতে বাইয়াত, তার ছাত্রত্ব এবং তার হাদীসের সব সনদেও তোমাদের এই বড় মুশরিক ও বড় কাফির রয়েছেন। তাহলে কীসের মুহাদ্দিস হওয়া, কীসের রাজত্ব, মূল ঈমান ঠিক আছে কি না সেটা নিয়েই প্রশ্ন। ইন্নালিল্লাহি ওইন্না ইলাইহি রাজিউন। 

 

তাছাড়া পরবর্তীতে মৌলভী ইসহাক ও শাহ ইসমাইলের আর কী বিশেষত্ব বাকী রইল? তাদের সব কিছুই তো এই শিরকের জলাভূমিতে নিমজ্জিত। তাদের বংশ মুশরিকদের, তারা মুশরিকদের সন্তান, তাদের উস্তায মুশরিক, পীর মুশরিক। চোখ খুললেই তারা মুশরিক দেখতে পাবে। বুঝ হয়েছে মুশরিকদের মাঝে। মুশরিকদের কলে-পিঠে, মুশরিকদের লালন-পালনে, তাদের খোর-পোষে তারা বড় হয়েছে।  তাদের আমল - আখলাক মুশরিকদের কাছ থেকে এসেছে, তাদের বেড়ে ওঠা মুশরিকদের মাঝে, মুশরিকদের কাছ থেকে শিখেছে, মুশরিকদের কাছে পড়েছে, দাদা মুশরিক, নানা মুশরিক, সারা জীবন এই মুশরিকদেরকেই মেনে এসেছে। নাউজুবিল্লাহ। লা হাওলা ওলা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ। 

 

প্রিয় মুসলিম, দেখুন,  ইয়া আলী ইত্যাদি নিদা করাকে শিরক বলার কতো বড় শাস্তি তাদের ভাগ্যে জুটেছে। তারা যদি অন্যায়ভাবে মুসলমানদেরকে মুশরিক বলার কাজে লিপ্ত না হতো তাহলে তাদের এরকম আগে-পরে সবার মুশরিক হওয়ার মুসীবতে পড়তে হতো না। এই মুসীবতে পড়ার চেয়ে তাদের জন্য উত্তম তো ছিলো তারা সঠিক পথে ফিরে আসত। প্রকৃত মুসলমানদেরকে মুশরিক বানান ছেড়ে দিন নতুবা নিজেদের লোকদের ঈমান আছে কি না সেই ফিকির করুন। 



 

 



 

------ ------