আক্বিদা

আধুনিক খারেজীদের উত্থানের গোড়ার কথা ( ১ম পর্ব)

ইজহারুল ইসলাম মঙ্গল, 03 ডিসে., 2024

গত শতাব্দীতে মুসলিম উম্মাহের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ ছিলো খিলাফতের পতন। এর মাধ্যমে উম্মাহ বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা  ও পালনের সক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হয়। মুসলমানদের এই সামগ্রিক পরাজয়ের ফল হিসেবে তাদের ঘাড়ে চেপে বসে পশ্চিমা ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলি। 

 

এখানে বলে নেয়া দরকার যে, পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলির প্রকাশ্য সহযোগিতায় নজদী-ওহাবীদের মাধ্যমে উসমানি খিলাফতকে দুর্বল করা হয়। খিলাফতের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক ষড়যন্ত্র, পুরো উসমানী সালতানাতকে মুশরিক আখ্যা দেয়া এবং যারা এদেরকে মুশরিক মনে করবে না বা তাদের সাহায্য করবে, তাদেরকেও মুশরিক আখ্যা দেয় এই তাকফিরী - নজদী গোষ্ঠী। নজদীদের হাত ধরে মুসলমানদের মাঝে আভ্যন্তরীণ কোন্দল মারাত্মক আকার ধারণ করে। নজদীরা তাদের এই তাকফিরী-খারেজী চিন্তা-চেতনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ধারাবাহিকভাবে মুসলমানদেরকে কাফের - মুশরিক আখ্যা দিয়ে তাদের রক্ত ও সম্পদকে হালাল করতে থাকে। এভাবে খারেজিয়াত চর্চার মাধ্যমে উম্মাহকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দেয়া এবং একে - অপরের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের পথকে সুগম করা হয় নজদীদের মাধ্যমে। 

 

খিলাফতে রাশেদার পতন ও সাহাবায়ে কেরামের সময় বড় বড় বিপর্যয়ের জন্য সেসময়ের খারেজী ফেতনা যেমন দায়ী ছিলো, একইভাবে বিগত শতাব্দীগুলোতে নজদী-খারেজীদেরকে পুনরুজ্জীবিত করে মুসলমানদেরকে পুরোপুরি পর্যুদস্ত করার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। যার অনেক কিছুই এখন সফলভাবে বাস্তবায়নও হয়েছে। 

 

সামগ্রিকভাবে মুসলমানদের এই পতনের সবচেয়ে খারাপ দিকটি হলো, বুদ্ধিবৃত্তিক ও আদর্শিকভাবে উম্মাহের সামনে পশ্চিমা দর্শনকে শ্রেষ্ঠ বানিয়ে সে অনুযায়ী দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করতে বাধ্য করা। সব দিক থেকে খ্রিষ্টধর্মের ব্যর্থতার কারণে পশ্চিমা বুদ্ধিজীবি সমাজ পুরোপুরি ধর্মবিরোধী একটি দর্শনের গোড়াপত্তন করেন। ধর্মবিদ্বেষী এই বুদ্ধিজীবী দার্শনিক শ্রেণী যখন সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন, তখন তারা রাষ্ট্র ও সমাজের মূল ধারা থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করে দেন। সব ধরণের পশ্চাৎপদতা, প্রগতি ও উন্নতির পথে তারা ধর্মকে অন্যতম মৌলিক কারণ হিসেবে তুলে ধরে। ধর্মের বিকল্প হিসেবে তারা পশ্চিমা দার্শনিকদের দর্শনকে মূল বানিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু করে। আধুনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজ বিজ্ঞান মূলত: এই পশ্চিমা দার্শনিকদের দর্শন ও চিন্তা-চেতনার উপর গড়ে ওঠেছে। যার মূল ভিত্তিই ছিলো, ধর্মকে রাষ্ট্রের মূল নিয়ন্ত্রণ থেকে সরিয়ে আধুনিক দর্শন ভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তোলা। 

 

সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় পশ্চিমা দর্শন ভিত্তিক যেই নিয়ম-নীতি তারা প্রতিষ্ঠা করবে,  আপনার ধর্ম-পালন যদি এগুলোর সাথে সাংঘর্ষিক না হয়, তাহলে আপনি আপনার ধর্ম পালন করতে পারবেন।কিন্তু কোথাও তাদের প্রতিষ্ঠিত দর্শনের সাথে ধর্মীয় চিন্তা-চেতনার সংঘর্ষ হলে আপনার ধর্ম-পালনকে সীমিত করতে হবে। প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় দর্শনের সাথে সাংঘর্ষিক ধর্মীয় বিধি - বিধান পালনে আপনার উপর নানা বিধি-নিষেধ আরোপ করা হবে। হামলা, মামলা, গ্রেফতারি সবই হতে পারে রাষ্ট্রীয় দর্শনকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে।

 

মোটকথা পশ্চিমাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিলো, ধর্ম থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন একটি সমাজ গড়ে তোলা। কিন্তু ধর্মকে সমাজ থেকে যেহেতু হুট করেই বিদায় করা সম্ভব হচ্ছে না, এজন্য যতদূর সম্ভব ধর্মকে রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে এর পরিধিকে সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর করে দেয়া। পশ্চিমা দেশগুলোতে তারা এর সফল বাস্তবায়নও করেছে। 

 

পশ্চিমারা যখন মুসলিম দেশগুলোর উপর নিজেদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করে, তারা পশ্চিমা খ্রিষ্ট - সমাজের সাথে করা তাদের আচরণ পুনরাবৃত্তি করতে চায়। মুসলমানদের রাষ্ট্র ও সমাজ থেকেও তারা একই পদ্ধতিতে ধর্মকে সংকুচীত করে পশ্চিমা দর্শন ভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। অধিকাংশ মুসলিম দেশগুলোতে তারা এই প্রচেষ্টায় সফলও হয়েছে। 

 

ধর্মকে রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া এবং পশ্চিমা দর্শন ভিত্তিক রাষ্ট্র পরিচালনা করা, তাদের দর্শনকে মূল বানিয়ে নিত্য-নতুন আইন তৈরি করে দেশ পরিচালনার এই প্রচেষ্টা ছিলো খোদ ইসলামের মূলমন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত। কারণ, ইসলামই পৃথিবীতে চূড়ান্ত সত্য। এর বিপরীতে কোন দর্শন, চিন্তা-চেতনা সত্য হওয়া অসম্ভব। পশ্চিমা বুদ্ধিজীবী ও দার্শনিকদের নাস্তিকতা, সংশয়বাদ, ভোগবাদ ইত্যাদির উপর প্রতিষ্ঠিত সমাজ বিজ্ঞান ও রাষ্ট্র বিজ্ঞান কখনও সত্যের সন্ধান দিতে পারে না। নিকষ কালো অন্ধকারে নিমজ্জিত, মিথ্যা, সংশয়বাদ ও নাস্তিকতার দোলাচলে দোদুল্যমান পশ্চিমা দর্শন কখনও চূড়ান্ত সত্য ইসলামের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে না। কিন্তু পশ্চিমা ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সেক্যুলারিজম ইত্যাদির অজুহাতে মুসলিম দেশগুলোর উপর তাদের  মিথ্যা দর্শনকে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। প্রয়োজনে একের পর এক মুসলিম দেশ ও জনপদগুলোতে আক্রমণ করে যাচ্ছে শুধু পশ্চিমা দর্শনকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য। 

 

প্রায় সব মুসলিম দেশগুলোকে পশ্চিমারা যখন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কুক্ষিগত করে নেয়, ধর্মকে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াস যখন অধিকাংশ মুসলিম দেশগুলোতে সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়, তখন মুসলমানদের পক্ষ থেকে নানা প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। কোথাও প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ আবার কোথাও বুদ্ধিবৃত্তিক সংঘর্ষ হতে থাকে। 

 

খিলাফত পতনের পর মুসলমানদের সামনে বুদ্ধিবৃত্তিক ও আদর্শিকভাবে সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ছিলো দু’টি। 

১। কমিউনিজম বা সমাজতন্ত্র। 

২। পশ্চিমা দর্শন ভিত্তিক সেক্যুলারিজম। 

 

নাস্তিকতা, সংশয়বাদ, সমাজ থেকে ধর্মকে উৎখাত, সমাজ ও মানুষের প্রগতি, উন্নতি ও অগ্রযাত্রার জন্য ধর্মকে বাঁধা মনে করার ক্ষেত্রে উভয় মতবাদের দর্শন এক ছিলো। তবে ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ ও ধর্মবিোরধী প্রচারণায় সেক্যুলারিজমের চেয়ে কমিউনিজমের অবস্থান ছিলো প্রকাশ্য ও মারমুখী। 

 

উপরের দার্শনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসনের মোকাবিলায় মুসলমানদের মাঝেও এক ধরণের জাগরণ ও প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিলো। এই প্রতিরোধের ক্ষেত্রে শাইখুল ইসলাম মুস্তফা সাবরী, আল্লামা জাহেদ আল-কাউসারী, শহীদ হাসান আল-বান্না,  মাওলানা মওদুদী, সাইয়্যেদ কুতুব সহ আরও কিছু উলামায়ে কেরাম এগিয়ে আসেন। মাওলানা মওদুদীর চিন্তা-চেতনায় কমিউনিজমের সমস্যাগুলো শক্তিশালীভাবে ওঠে আসলেও পশ্চিমা লিবারেল-সেক্যুলার দর্শনের বিপরীতে তার অবস্থান অতটা শক্ত ছিলো না। তবে রাষ্ট্রীয়ভাবে দ্বীন প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব প্রদানকে তিনি নতুন দার্শনিক ভিত্তি দেয়ার চেষ্টা করেন। 

 

দু:খজনক বিষয় হলো, ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করার পশ্চিমা ও কমিউনিস্ট প্রচেষ্টার মোকাবেলায় মাওলানা মওদুদীর এই নতুন দর্শন সঠিক ছিলো না। রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠার বিষয়টাকে তিনি গুরুত্ব দিতে গিয়ে খোদ ইসলামের মৌলিক পরিভাষাগুলোকে বিকৃত করে ফেলেন। ইসলামের একেবারে বুনিয়াদী চারটি পরিভাষা তথা রব, ইলাহ, দ্বীন, ইবাদত এই প্রত্যেকটি পরিভাষার উদ্দেশ্য ও মর্ম তিনি বিকৃত করেন। পুরো ইসলামকে তিনি বানিয়ে ফেলেন রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্ম প্রতিষ্ঠার নাম। রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে ইসলাম কখনও বিচ্ছিন্ন হতে পারে না, একথা সত্য। কিন্তু মাওলানা ইসলামের বুনিয়াদী বিষয়গুলোকে বিকৃত করে যেভাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠার অনুগামী বানিয়েছেন, এটি অবশ্যই তার বড় ধরণের ভুল ও বিচ্যূতি ছিলো। মাওলানা মওদুদী তার এই বিচ্যূতিকে আড়াল করার জন্য পুরো মুসলিম উম্মাহের হাজার বছরের ট্রেডিশনকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন। তার মতে হাজার বছরের মুসলিমরা ইসলামের এই বুনিয়াদী পরিভাষাগুলোর সঠিক মর্ম ও উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যূত হয়ে গেছে। মাওলানার এই দাবীটি ছিলো খুবই অবাস্তব ও অর্থহীন দাবী। মূলত: মাওলানার নতুন এই বিকৃত চিন্তার সাথে হাজার বছরের ইসলামের প্রকাশ্য বিরোধই মাওলানাকে এতো বড় একটা অবাস্তব দাবী করতে বাধ্য করে। 

 

মুসলিম বিশ্বের উপর কমিউনিস্ট ও পশ্চিমা লিবারেল-সেক্যুলার দেশগুলোর প্রভাব-প্রতিপত্তি যেহেতু একটি বাস্তব সমস্যা ছিলো, এর সমাধানের জন্য মুসলমানরা উন্মুখ ছিলো। নানা পথ ও পন্থা তারা খুঁজছিল। প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য তাদের প্রয়োজন ছিলো একটি শক্ত দার্শনিক বয়ানের। এসময় মাওলানা মওদুদীর হাকিমিয়ার এই নতুন দর্শন অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তারা এটাকে সমাধান মনে করে এর বাস্তবায়নের পথ খুঁজতে থাকেন। 

 

মাওলানা মওদুদীর এই নতুন দর্শনের মৌলিক সমস্যা ছিলো, এটি ইসলামের বিকৃত কিছু চিন্তা-ধারার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলো। তাছাড়া মাওলানা মওদুদীর সকল প্রচেষ্টার কেন্দ্রবিন্দু ছিলো ক্ষমতা অর্জন করে বাস্তবে আল্লাহর হাকিমিয়াহ প্রতিষ্ঠা। কমিউনিজম বা পশ্চিমা লিবারেল - সেক্যুলার দর্শনের বুদ্ধিবৃত্তিক ও দার্শনিক মোকাবিলা এখানে মুখ্য ছিলো না। তারা মনে করেছিলেন, ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে দার্শনিক সমস্যা ক্ষমতার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। এজন্য তারা তাদের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করেন ক্ষমতার পালাবদলে। এটাকেই মৌলিক সমাধান মনে করতে থাকেন। 

 

বুদ্ধিবৃত্তিক বা দার্শনিক আগ্রাসনকে মৌলিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত না করায়, পরবর্তীতে ক্ষমতা অর্জনের জন্য যারা কাজ করেছেন, এক সময় তারা নিজেরাই পশ্চিমা সেক্যুলার - লিবারেল চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েছেন। এরকম উদাহরণ অসংখ্য। সমস্যার মূল যেহেতু বুদ্ধিবৃত্তিক ও দার্শনিক, সেখানে সমস্ত মনযোগ ক্ষমতা-কেন্দ্রিক হওয়াটা ছিলো মাওলানা মওদুদীর চিন্তাধারার বড় ধরণের দুর্বলতা। ফলে এক সময় মাওলানা মওদুদীর অনুসারীদের বড় একটা অংশ সেক্যুলার বা সেক্যুলারদের প্রতি চিন্তাগতভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। 

 

মাওলানা মওদুদীর এই নতুন হাকিমিয়ার দর্শন দ্বারা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হোন মিশরের সাইয়্যেদ কুতুব। তিনি বড় মাপের সাহিত্যিক হওয়াই মাওলানা মওদুদীর এই দর্শনকে আরও সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে আরব বিশ্বের কাছে তুলে ধরেন তার ‘তাফসীর ফি জিলালিল কুরআন’, মায়ালিম ফিত ত্বরিক ইত্যাদি বইয়ের মাধ্যমে। 

 

মাওলানা মওদুদীর দর্শনের মূল কেন্দ্রবিন্দু যেহেতু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অর্জন বা রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা ছিলো এজন্য তারা প্রচলিত রাষ্ট্রযন্ত্র অপসারণকে তাদের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে দেখতে পান। ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র ও সমাজকে উৎখাত করে এর বদলে ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠা করা ছিলো তাদের দর্শনের মূল দাবী। সে হিসেবে প্রচলিত শাসন ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করা, প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতাকে উৎখাত করা ছিলো তাদের দর্শনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি না হলে তাওহীদুল হাকিমিয়াহ পরিপূর্ণ হলো না। আর তাওহীদুল হাকিমিয়াহ পরিপূর্ণ না হলে ঈমানই অপূর্ণ থেকে যাবে। আর এই ধরণের অপূর্ণ ঈমান আল্লাহর কাছে কীভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে?  

 

প্রশ্ন আসে, প্রচলিত শাসন ব্যবস্থাকে কীভাবে উৎখাত করা সম্ভব? প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতাকে কীভাবে চ্যালেঞ্জ করে ইসলামী ক্ষমতা ও শাসন ফিরিয়ে আনা যায়? প্রচলিত শাসন ব্যবস্থা অপসারণে প্রাথমিকভাবে তাদের সামনে ছিলো দু’টি পদ্ধতি। 

১। দাওয়াত 

২। জি-হা-দ

 

দাওয়াতকে ব্যাপক করার জন্য গড়ে ওঠে বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন। যেমন জামায়াত ইসলাম বা ইখওয়ানুল মুসলিমীন। দাওয়াতের পাশাপাশি তাদের মাঝে জি-হা-দ এর আলোচনাও পরোক্ষভাবে ছিলো। এর বাস্তবতা অনুধাবনের জন্য খুব বেশি দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। সোভিয়েত বিরোধী আফগান যুদ্ধের মূল লিডারশিপে কিন্তু এই জামায়াতে ইসলামীর নেতারাই মুখ্য ভূমিকা রেখেছিল। এমনকি সোভিয়েত পরবর্তী সরকার গঠনেও এদের ব্যাপক আধিপত্য ছিলো। সেই সময়ের জামায়াতের নেতারা স্বত:স্ফূর্তভাবে সোভিয়ত বিরোধী জি-হা-দ এ সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছিল। 

 

প্রাথমিক পর্যায়ে দাওয়াত ও জি-হা-দ মুখ্য থাকলেও একটা সময় তৃতীয় আরেকটি পদ্ধতিকেও তারা গ্রহণ করতে শুরু করেন। এর পেছনে কারণও ছিলো। প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতার মোকাবিলায় শুধু দাওয়াতী পদ্ধতিকে বেশ স্থূল ও ধীর মনে হওয়া স্বাভাবিক। আবার জি-হা-দ এর পদ্ধতিতে ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য প্রয়োজন সক্ষমতা। অস্ত্র, লোকবল, অর্থ-সম্পদ ও সুসংগঠিত একটি সশস্ত্র বাহিনী ছাড়া আধুনিক রাষ্ট্রযন্ত্রকে কাবু করা সহজ নয়। ফলে দাওয়াত ও জি-হাদের সাথে সাথে তারা প্রচলিত রাজনীতিতেও অংশগ্রহণ শুরু করেন। ক্ষমতার পালাবদল হওয়া যেহেতু এখানে একটি মৌলিক সমস্যা, এক্ষেত্রে প্রচলিত রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে ক্ষমতা অর্জন তাদের কাছে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান মনে হয়। তবে তারা চিন্তা করেন, প্রচলিত রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হলে তারা মূল রাষ্ট্রযন্ত্রকে পরিবর্তন করে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। 

 

এই প্রক্রিয়ায় জামায়াতে ইসলাম, ইখওয়ানুল মুসলিমীনসহ বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন আস্তে আস্তে প্রচলিত রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ইসলামী দলগুলোর এভাবে প্রচলিত রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভেতরে ভেতরে তাদের মাঝে বিভিন্ন বিরোধ গড়ে ওঠে। ডক্টর ইসরার আহমেদ এক সময় মাওলানা মওদুদীর প্রচন্ড ভক্ত থাকলেও প্রচলিত রাজনীতিতে অংশগ্রহণের প্রশ্নে তিনি জামায়াতে ইসলামী থেকে আলাদা হয়ে যান। 

 

প্রাথমিক পর্যায়ে প্রচলিত রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠার এই প্রচেষ্টা নিয়ে খুব বেশি আপত্তি না হলেও আস্তে আস্তে এটি নিয়ে সংশয় তৈরি হতে থাকে। এর মূল কারণ, প্রচলিত রাজনীতিও দাওয়াতের মতো একটি ধীর প্রক্রিয়া। এখানে অল্প সময়েই বড় ধরণের সফলতা আশা করা যায় না। আবার প্রচলিত রাজনীতিতে টিকে থাকার প্রয়োজনে ইসলামের বহু বিষয়ের সাথে কম্প্রোমাইজ করতে হয়। প্রচলিত রাজনীতি করে ক্ষমতা দখল করলেও সেই ক্ষমতা স্বাধীন ও নিরংকুশ থাকে না। রাজনীতিকে পেছন থেকে যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তাদের ইশারায় চলতে হয়। 

 

উপরের বিষয়গুলোর পাশাপাশি আ-ফগান যুদ্ধে সোভিয়তের বিরুদ্ধে মু-জা-হিদীনদের সফলতাও বিষয়টিকে আরও ত্বরান্বিত করে। সাইয়্যেদ কুতুব ও মালানা মওদুদীর দর্শনে বিশ্বাসী একদল মনে করে থাকেন, শুধু দাওয়াত বা প্রচলিত রাজনীতি কোন সমাধান নয়। আধুনিক ক্ষমতাধর রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে জি-হা-দই একমাত্র সমাধান। বিভিন্ন দেশে প্রচলিত রাজনীতিতে অংশ নেয়া ইসলামী দলগুলোর ব্যর্থতা, অন্য দিকে আ-ফ-গানের মাটিতে সোভিয়তের মতো একটি বড় পরাশক্তিকে পরাজিত করতে পারাটা তাদের চিন্তার পক্ষে খুবই শক্তিশালী দলিল হয়ে ওঠে। ফলে তারা সুনিশ্চিৎভাবে ধরে নেন যে, যারা দাওয়াত বা প্রচলিত রাজনীতির মাধ্যমে মুসলমানদের ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করছে, তারা ভুলের উপর রয়েছে। প্রচলিত দাওয়াত ও রাজনীতিতে যেহেতু  কাঙ্খিত সফলতা নেই, এজন্য জি-হা-দকেই একমাত্র সমাধান হিসেবে গ্রহণের দাওয়াত শুরু হয়। 

 

এই আলোচনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মাওলানা মওদুদীর দর্শনটি তার একান্ত নিজস্ব ছিলো না। এটি মূলত: ইবনে আব্দিল ওয়াহহাব নজদীর চিন্তাধারাকে বিষয়বস্তু পরিবর্তন করে উপস্থাপন করা হয়েছে। ইবনে আব্দিল ওয়াহহাবের দাওয়াতের মূল ছিলো, সেসময়ের মুসলমানদের মাঝে প্রচলিত কিছু তাসাউফের আমলকে শিরক বানিয়ে তার চিন্তাধারাকে তাওহীদ ও ঈমান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। আর মাওলানা মওদুদী সূফীদের আমলের পরিবর্তে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠাকে তার মূল লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছেন। তবে বক্তব্য উপস্থাপন, দাবী ও চিন্তা-ধারাগুলো প্রায় এক। ইবনে আব্দিল ওয়াহহাব যেখানে বলেছেন, নামাজ-রোজা করা, আল্লাহকে রব হিসেবে মানার পর যদি ওসীলা করা হয়, নবী-ওলীদের কাছে ইস্তিগাছা করা হয়, তাহলে তার এই নামাজ-রোজা আর আল্লাহকে রব হিসেবে মেনে নেয়ার কোন মূল্য নেই। কারণ সে আল্লাহকে রব মানলেও আল্লাহকে ইলাহ মানেনি। এজন্য সে মুসলমান নয়। মাওলানা মওদুদীর বক্তব্য হলো, নামাজ-রোজা সব কিছু করার পর, আল্লাহকে রব মনে করা, আল্লাহকে ইবনে আব্দিল ওয়াহহাবের শর্ত মতে ইলাহ মনে করার পরও যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা না করা হয় বা হাকিমিয়্যাহ এর তাওহীদ যদি না থাকে, তাহলে তার ঈমান পরিপূর্ণ নয়। যেখানে ইবনে আব্দিল ওয়াহহাব তাওহীদুল উলুহিয়্যার কথা বলেছেন, সেই বয়ানটাকেই মাওলানা মওদুদী তাওহীদুল হাকিমিয়াহ নাম দিয়ে তার দর্শনের ভিত্তি রেখেছেন। 

 

এজন্য মূলগতভাবে মাওলানা মওদুদী ও সাইয়্যেদ কুতুবের দর্শনটি নজদী-তাইমী দর্শনের বিস্তৃত সংস্করণ। আগে এটি তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহ, আসমা ও সিফাত এবং উলুহিয়্যার মাঝে সীমিত থাকলেও মাওলানা মওদুদী ও সাইয়্যেদ কুতুবরা একে আরও বিস্তৃত করে তাওহীদুল হাকিমিয়্যাহ সংযুক্ত করেছেন। 

 

মৌলিকভাবে মাওলানা মওদুদী ও সাইয়্যেদ কুতুবের দর্শনের ভিত্তি নজদী-তাইমী দর্শন হওয়াই তাদের মাঝেও নজদী-তাইমী দর্শনের মূল সমস্যাগুলো বিদ্যমান ছিলো। নজদী-তাইমী দর্শনে তাওহীদের মর্ম বিকৃত করে মুসলমানদেরকে কাফের বানাবার রাস্তা তৈরি করে খারেজিয়াতের পথ উন্মুক্ত করা হয়, এই বিকৃতি ও খারেজিয়াত মাওলানা মওদুদীর দর্শনেও স্থান করে নেয়। সেই সাথে যুক্ত হয় মাওলানা মওদুদীর নিজস্ব কিছু বিকৃতি ও সংযোজন। সাইয়্যেদ কুতুবের দর্শন যখন আরব বিশ্বে চর্চা হতে থাকে, তখন মিশর ও অন্যান্য জায়গায় নজদী-তাইমী দর্শনটি সালাফী মানহাজের নাম ধরণ করে ব্যাপকভাবে চর্চিত হতে থাকে। মূল সালাফী চিন্তা-চেতনার সাথে মাওলানা মওদুদী ও সাইয়্যেদ কুতুবের হাকিমিয়ার দর্শন মিলে একটি নতুন ধারা গড়ে ওঠে। ইবনে আব্দিল ওয়াহহাবের তাকফিরী-খারেজী দর্শনের সাথে মাওলানী মওদুদী ও সাইয়্যেদ কুতুবের হাকিমিয়ার দর্শন মিলে গড়ে ওঠে আধুনিক সালাফী-জিহাদী মুভমেন্ট। যাদের মানহাজের মূল ভিত্তি ছিলো, তাকফীর, জি-হাদ ও হিজরত। 

 

সোভিয়ত বিরোধী আফগান জি-হাদের শেষের দিকে এই নতুন সালাফী-তাকফিরী ধারার লোকজন মিশরে নানা নির্যাতনের শিকার হয়ে আফগানিস্তানের পেশোয়ারে হিজরত করে। পেশোয়ারে অবস্থানরত মু-জাহিদীনদের মাঝেও আস্তে আস্তে তাদের তাকফিরী-খারেজী চিন্তা-চেতনা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এই তাকফিরী জামায়াতের অন্যতম সদস্য ছিলেন ডক্টর আই-মান জা-ওয়াহেরী ও ডক্টর সাইয়্যেদ ইমাম শরীফ ওরফে ডক্টর ফজল। 

 

পূর্ব থেকে নজদী-তাইমী হওয়াই সালাফীদের অনেকে খুব সহজেই এই তাকফিরী-খারেজী চিন্তাধারা গ্রহণ করা শুরু করে। পেশোয়ারে তাকফিরী গোষ্ঠীর দাওয়াতে যারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, তাদের অন্যতম ছিলেন ও-সামা বিন লা-দেন। পরবর্তীতে আই-মান জা-ওয়া-হেরীর সাথে মিলে আল-কায়দা গঠন করে গ্লোবাল জি-হাদ শুরু করে এই তাকফিরী গোষ্ঠী। পরের ইতিহাস সবারই প্রায় জানা। 

 

পশ্চিমাদের রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করণ প্রচেষ্টার মোকাবিলায় আমরা সক্রিয়ভাবে তিনটি ধারা দেখছি।

১। মাওলানা মওদুদী, সাইয়্যেদ কুতুব, ইবনে আব্দিল ওয়াহহাব ও ইবনে তাইমিয়ার চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত তাকফিরী-জিহাদী গোষ্ঠী। 

২। মাওলানা মওদুদী ও সাইয়্যেদ কুতুবুর মূল দর্শনে বিশ্বাসী হলেও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অর্জন প্রচলিত রাজনীতি করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী। এই দলে খোদ মাওলানা মওদুদীর জামায়াতে ইসলাম ও ইখওয়ানুল মুসলিমীন রয়েছে। 

 

৩। রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী তবে মাওলানা মওদুদী বা সাইয়্যেদ কুতুবের হাকিমিয়ার দর্শনে বিশ্বাসী নয়। এধরণের অনেক দল বিভিন্ন দেশে প্রচলিত রাজনীতি করে থাকে। 

 

প্রথম ও দ্বিতীয় দলের মৌলিক দর্শন এক হলেও কর্মপন্থার পার্থক্য এবং প্রথম দলে তাকফির ও খারেজিয়াতের প্রাধান্যের কারণে খুব অল্প দিনেই তারা একে-অপরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়। তাকফিরী-গোষ্ঠী মূল দর্শন যেহেতু তাকফির ও জি-হাদ, এজন্য তাদের এই দর্শনের সাথে যারা একমত নয়, তাদের উপর বিভিন্ন সময় তারা চড়াও হতে শুরু করে। এমনকি এক সময় এই তাকফিরী - গোষ্ঠী প্রচলিত রাজনীতি করে এমন দলগুলোকে তাকফির করে তাদেরকে হত্যাও শুরু করে। ইখওয়ানী ধারায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার ব্যর্থতা তুলে ধরে তাকফিরী গোষ্ঠীর অন্যতম নেতা আইমান জাও-য়াহেরী একটি কিতাবও লিখেন। তিনি এই কিতাবের নাম দিয়েছেন, আল-হাসাদুল মুর। বা তিক্ত ফল। জা-ওয়াহেরীর ভাষায় বিগত ষাট বছরে ইখওয়ানের ব্যর্থতার দাস্তান। নিচে কিতাবের ছবি দেয়া হলো,

 

 








 


 

প্রাথমিক পর্যায়ে প্রচলিত রাজনৈতিক প্রচেষ্টার ব্যর্থতা এবং জি-হা-দই একমাত্র সমাধান ইত্যকার দাওয়াতী বক্তব্যের মধ্যেই বিষয়গুলি সীমাবদ্ধ ছিলো। কিন্তু একটা সময়ে রাজনৈতিক ধারায় বিশ্বাসী ও জি-হাদী ধারার মাঝে বড় ধরণের টানা-পোড়েন শুরু হয়। এমনকি জি-হা-দী ধারা রাজনৈতিক ধারাকে প্রচলিত রাজনীতি বা গণতান্ত্রিক ধারায় অংশগ্রহণের কারণে মুরতাদ ও কাফের বলা শুরু করে। 

 

বিষয়টি সহজে বোঝার জন্য একটি ছোট্র উদাহরণ দেই। আল-জেরিয়াতে ফ্রান্স ও তাদের মদদপুষ্ট শাসন ব্যবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে ইসলামী শাসন ফিরিয়ে আনার জন্য বেশ কয়েকটি দল গড়ে ওঠে। এর মধ্যে কিছু কিছু দল ছিলো প্রচলিত রাজনৈতিক পদ্ধতিতে ভোট ও গণতন্ত্রে অংশগ্রহণ করে ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো, ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ক্ষমতায় গিয়ে গণতন্ত্রকে সরিয়ে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনবে। এই ধরণের দলের মধ্যে ইখওয়ানপন্থী দলও ছিলো। এছাড়া সবচেয়ে বড় দল ছিলো Islamic Salvation Front বা আল-জাবহাতুল ইসলামিয়া লিল-ইনকাদ। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তারা বিপুল জন-সমর্থনে জয়ী হলে তাদেরকে সরকার গঠনে ব্যর্থ করে দিয়ে গণগ্রেফতার করা হয়। এই দলের ব্যর্থতা থেকে গড়ে ওঠে Armed Islamic Group of Algeria বা সংক্ষেপে GIA. শুরুতেই এরা শপথ নেয় যে, তারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আর চেষ্টা করবে না। বরং জি-হা-দ ও অস্ত্রের মাধ্যমে শাসন প্রতিষ্ঠা করবে। পরবর্তীতে এই গ্রুপটি আলেজেরিয়ার সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী জি-হাদী গ্রুপ হয়ে ওঠে। কিছুকাল পরে কট্রর সালাফী আবু আব্দির রহমান আমীন যখন এই গ্রুপের নেতা হয়, তখন সে প্রতিপক্ষ বিভিন্ন দলকে মুরতাদ আখ্যা দিয়ে হত্যা শুরু করে। 

 

দু:খজনক বিষয় হলো, এই গ্রুপটি তখন মারাত্মক গণহত্যা শুরু করে। এই গণহত্যার পেছনে তাদের যুক্তি ছিলো, যাদেরকে তারা হত্যা করছে, তারা গণতান্ত্রিক  নির্বাচনে অংশ নিয়ে মুরতাদ হয়ে গিয়েছে। এ বিষয়ে আ-ল কা-য়েদায় সিনিয়র লিডার আবু মুসআব সূরী তার ‘শাহাদাতি আলাল জি-হাদি ফিল জাযাইর’ বইয়ে সেই ভয়ঙ্কর গণহত্যার কিছু চিত্র তুলে ধরেছেন। আবু মুসআব সূরীর মতে এই গণহত্যায় সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত গুপ্তচরদের সম্পৃক্ততা ছিলো। এমনকি তার সন্দেহ হলো, GIA এর লিডার আবু আব্দির আমীনের সাথে সরকারের হয়ত কোন বোঝা পড়া ছিলো। কিন্তু বিষয়টি যেমনই হোক, আল-জেরিয়ার সবচেয়ে বড় জি-হাদী গ্রুপের হাতে যেই বিভৎস গণহত্যা হয়েছিল, এর মূল কারণটি ছিলো খুব বেদনাদায়ক। বাচ্চা, শিশু, নারী, এমনকি জন্তু-জানোয়ারও এই গণহত্যা থেকে রেহাই পায়নি। আবু মুসআব সূরীর ভাষায় তারা আল-জেরিয়ানদের রক্তের নদী বইয়ে দিয়েছিল। এমনকি রমজানে মুসল্লীরা নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হওয়ার পথে মসজিদের সামনে তাদেরকে হত্যা করা হয়। হত্যার কারণ ছিলো, এরা বিগত নির্বাচনে অংগ্রহণ করে সবাই মুরতাদ হয়ে গিয়েছে। দু:খের বিষয় হলো, বিগত নির্বাচনে যেই অঞ্চলে Islamic Salvation Front সবচেয়ে বেশি ভোটে জিতেছিল, সেখানে সবচেয়ে বড় গণহত্যা চালান হয়। [ শাহাদাতি আলাল জিহাদি ফিল জাযাইর, আবু মুসআব সূরী, পৃ: ১৮]

 


 

 এখানে মূল পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য করুন। প্রাথমিক পর্যায়ে এরা সকলেই ইসলাম প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে একমত ছিলো। তাদের মাঝে মূল পার্থক্য ছিলো, পদ্ধতিগত। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যর্থ হওয়ার পর তারা অস্ত্র তুলে নিয়ে জি-হা-দ এর পদ্ধতি গ্রহণ করে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, জি-হা-দ এর এই পদ্ধতি গ্রহণের পর তারা গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশগ্রহণকেই সরাসরি মুরতাদ হওয়ার কারণ বানিয়ে রমজানে মসজিদের সামনে মুসল্লীদের গণহত্যা করে। আল-জেরিয়ার সেসময়ের সবচেয়ে বড় জি-হাদী গ্রুপ যদি সরকারের ইন্ধনে বা তাদের যোগ-সাজশে এগুলো করে থাকে, তাহলে বিষয়টি আমাদের জন্য আরও ভাবনার। জি-হা-দের নামে এরা কাফেরদের দ্বারা ব্যবহৃত হওয়া এবং তাদের সেই অনৈতিক জযবা ও বিকৃত চিন্তা-ধারার বলি হয়েছে সাধারণ মুসলমান। যাদের অপরাধ এতটুকু যে, তারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। আর একারণে সবাই মুরতাদ হয়ে গেছে। ইন্নালিল্লাহ। 

 

এই দলগুলোর মাঝে কতো দ্রুত চিন্তা-ধারার পরিবর্তন হয় এবং খুব অল্প সময়ে তারা কীভাবে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে তার আরেকটি উদাহরণ দেখা যাক। প্রাথমিক পর্যায়ে আল-জেরিয়ান এই জি-হাদী গ্রুপ বি-ন লা-দেন ও আ-ইমান জা-ওয়াহেরীর সাথে সম্পর্ক রাখত। আবু মুসআব সূরী বলেন, প্রথম দিকে GIA তাদের অনুসারীদের তরবিয়াত ও চিন্তা-ধারা পরিশুদ্ধির জন্য নির্ভরযোগ্য উপাদান ছিলো, আমার কিতাব ‘আত-তাজরিবাতুল জি-হা-দিয়্যাহ ফি সূরীয়া (সিরিয়ায় জিহা-দের অভিজ্ঞতা)’, আফ-গানিস্তানে আমার আরও কিছু লেকচার-সিরিজ। সেই সাথে সাইয়্যেদ কুতুবের বই পুস্তক এবং মিশরের জি-হাদী গ্রুপের রচনাও ছিলো। কিন্তু আবু আব্দির রহমান আমীন এসব কিতাবাদি এক জায়গা করে পুড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়। কারণ, এসব কিতাবে তার মতে বিভিন্ন ফিকির বা চিন্তা-চেতনা রয়েছে। এগুলোর কারণে অনেককে সে হত্যারও নির্দেশ দিত। আল-জেরিয়া ও অন্যান্য দেশের অনেক মু-জা-হিদদের সাথে সে এটি করেছে। কিছু দিন পরে এই আমীন ডক্টর জা-ওয়াহেরী ও সাইয়্যেদ কুতুবের চিন্তা-ধার খন্ডন করে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। আমীনের মতে আমাদের জি-হাদী জাগরণী চিন্তাধারা মূলত: বিদয়াত। এগুলো আমীনের ‘সালাফী’ চিন্তাধারা বিপরীত। 

[শাহাদাতি আলাল জি-হাদি ফিল জাযাইর, পৃ: ২২ ]




 



 

একই ধরণের চিন্তাধারা থেকে এদের উৎপত্তি হওয়া এবং একই সাথে কাজ করার পরও অল্প কিছু দিনের মধ্যেই এদের একদল আরেকদলকে মুরতাদ-কাফের বা বিদয়াতী বলে হত্যা শুরু করে। এটা মূলত: প্রাচীন খারেজীদেরই চরিত্র। উপরের উদাহরণ দু’টি থেকে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে এরা কীভাবে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেছে তার কিছু চিত্র আমাদের সামনে এসেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে এরা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনে অংগ্রহণ করে জয় লাভ করে। কাফেরদের ষড়ষন্ত্রে সরকার গঠনে ব্যর্থ হলে জি-হা-দী কার্যক্রম শুরু করে। প্রাথমিক পর্যায়ে জা-ওয়াহেরী, বিন-লাদেন, আবু মুসআব সূরী, সাইয়্যেদ কুতুবসহ অন্যান্যদের লেখনী ও চিন্তা-ধারাকে মূল বানিয়ে চললেও কিছু দিন পরে এদেরকেও বিদয়াতী বলে হত্যা শুরু করে। শুধু নির্বাচনে অংশগ্রহণের অভিযোগে সাধারণ মানুষকে রমজানে মসজিদের সামনে গণহত্যা করতে পিছপা হয়নি। বর্তমানে দা-য়েশ যে কাজটি করেছে, নব্বইয়ের দশকে একই কাজ করেছে GIA. 

 

আবু মুসআব সূরী বলেন, নব্বইয়ের দশক থেকে জি-হাদী ধারার সাথে অন্যান্য ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন যারা রাজনৈতিক পদ্ধতি বা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে গ্রহণ করেছিল, তাদের মধ্যে মারাত্মক বিরোধ শুরু হয়। এই বিরোধ আস্তে আস্তে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। 







 

 

সার কথা হলো, পশ্চিমা দর্শনের ধর্মকে রাস্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করার যেই আগ্রাসন শুরু হয়েছিল, এর মোকাবেলায় মাওলানা মওদুদী, সাইয়্যেদ কুতুব ও তাদের চিন্তা-ধারায় প্রভাবিত যেসব ইসলামী দল, আন্দোলন, তাকফিরী-জিহাদী গোষ্ঠী গড়ে ওঠেছিল, তারা নব্বইয়ের দশকে এসে মোটামুটি একে - অপরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়। ইসলাম প্রতিষ্ঠার পদ্ধতিগত মতবিরোধ তাদের একে-অপরকে তাকফীর ও হত্যা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। দু:খের বিষয় হলো, বিগত ত্রিশ বছরে এই বিরোধের মাত্রা বাড়লেও কোথাও কমার কোন লক্ষণ দেখা যায়নি। আর এভাবেই জি-হা-দ বনাম ইসলামী রাজনীতির কোন্দলে সাইয়্যেদ কুতুবদের দর্শন বিভিন্ন জায়গায় মুখ থুবড়ে পড়েছে। 


 

এবার চলুন, প্রচলিত ইসলামী রাজনীতি, গণতন্ত্র, ভোট ইত্যাদি সম্পর্কে নব্বইয়ের দশকের পরবর্তী আরও কিছু হাল-হাকীকত অনুসন্ধান করা যাক। 

 

বর্তমানের আইএস বা দায়েশের গোড়াপত্তন হয় আবু মুসআব আয-যারকাবীর হাত ধরে। ২০০৩ সালে এদের নাম ছিলো জামায়তুত তাওহীদি ওয়াল জি-হাদ। ২০০৪ সালের অক্টোবর মাসে আবু মুসআব জা-রকাবী বিন-লা-দেনের হাতে বাইয়াত দেয়। তখন এর নাম দেয়া হয় তানজিমু কা-য়েদাতিল জি-হাদ ফি বিলাদির রাফিদাইন। ১৫ ই ফেব্রুয়ারী ২০০৪ সালে আবু মুস-আব জা-রকাবী বিন - লাদেনের কাছে একটি চিঠি লিখেন। সেখানে তিনি ইরাক যুদ্ধে তার অবস্থান ও কর্মপদ্ধতি তুলে ধরেন। এই চিঠিতে তিনি মুতলাকভাবে ইরাকের শিয়া-রাফেজীদের হত্যার সিদ্ধান্তের কথাও লিখেন। এ বিষয়ে আমরা পরবর্তীতে অন্য কোথাও আলোচনা করব ইনশা আল্লাহ। আবু মুসআব জা-রকাবীর এই চিঠির বিষয়বস্তুর উপর সম্মতি প্রকাশ করে বিন - লা-দেন জার-কাবীর বাইয়াত গ্রহণে সম্মত হোন। এরপরই জারকাবীর জামায়াতুত তাওহীদ নাম পরিবর্তন করে আ-ল-কা-য়দা ইরাক নাম ধারণ করে। 




 

ডিসেম্বর ২০০৪ সালে বিন-লাদেন জার-কাবীর বাইয়াত গ্রহণ করে একটি চিঠি লিখেন। এই চিঠিতে বি-ন লা-দেন প্রচলিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন করা ও এতে অংশগ্রহণ সম্পর্কে তার মতামত তুলে ধরেছেন। 

 

বিন-লা-দেনের বক্তব্যের সারমর্ম হলো, বর্তমানে ইরাক, আ-ফগান, ফিলিস্তীনসহ মুসলিম বিশ্বের যেসব দেশের সংবিধানে ইসলামী বিরোধী বিধান রয়েছে, সেসব দেশের নির্বাচনে জেনে-বুঝে অংশগ্রহণ করলে ব্যক্তি মুরতাদ হয়ে যাবে। এধরণেরী নির্বাচনকে তিনি প্রকাশ্য ইরতিদাদ বা মুরতাদ হওয়ার কারণ মনে করেন। এমনকি যেসব ইসলামী দল বা জামায়াত মানুষকে এধরণের প্রকাশ্য মুরতাদ হওয়ার কাজে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে তিনি তাদেরকে দাজ্জাল আখ্যা দিয়েছেন। আর এধরণের নির্বাচনকে তিনি মুরতাদদের প্রোগ্রাম আখ্যা দিয়েছেন এবং এর মাধ্যমে গঠিত সংসদীয় ব্যবস্থাকে তিনি মাজলিসুর রিদ্দাহ বা মুরতাদ হওয়ার অধিবেশন নাম দিয়েছেন। 

একই বিধান পুরো মুসলিম বিশ্বের সকল দেশের জন্য প্রযোজ্য। তিনি বিষয়টি খুব স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। 

 

তার মতে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগের আবু জাহেলের নির্বাচন আর বর্তমান যুগের আবু জাহেল ও মুরতাদ সরকার যেমন, ইয়াদ আলাবী, মাহমুদ আব্বাস, হামিদ কারজায়ী, হোসনী মুবারক, ফাহাদ বিন আব্দুল আজিজের নির্বাচনের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। 

 

 


 


 

বিন-লা-দেনের মতে, কোন দেশের সংবিধান একটিও শরীয়ত বিরোধী বিষয় থাকলে সেই দেশের নির্বাচনে জেনে-বুঝে সন্তুষ্টচিত্তে অংশগ্রহণ করলে এ ব্যক্তি মুরতাদ হয়ে যাবে। 

 

একই কথা আবু মুস-আব জারকাবীও তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন।  তিনি লিখেছেন,
“যারা (ইরাকের মতো) নির্বাচনে প্রার্থী হয়, তারা নিজেদের খোদা ও ইলাহ হওয়ার দাবীদার। আর যারা তাদেরকে নির্বাচিত করে, তারা এদেরকে আল্লাহর সাথে প্রভূ ও শরীক হিসেবে গ্রহণ করেছে। এদের সকলের ব্যাপারে শরীয়তের বিধান হলো, এরা কাফের। এবং দ্বীন ইসলাম থেকে এরা বের হয়ে গেছে”



 

বিন-লা-দেন ও আবু মুসআব জা-রকাবীর বক্তব্য খুবই স্পষ্ট। এখানে বিশেষ ব্যাখ্যার কোন প্রয়োজন নেই। এখন প্রশ্ন হলো, সারা পৃথিবীর সব দেশের মুসলমানরা কম-বেশি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে থাকে। এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশ জানে যে, তাদের সংবিধানে শরীয়ত বিরোধী আইন রয়েছে। এরপরও তারা নির্বাচনে ভোট দেয়। উপরে বি-ন লা-দেন ও আবু মুসআব জা-রকাবীর বক্তব্য অনুযায়ী পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের অধিকাংশ মুসলমান মুরতাদ হয়ে গিয়েছে। আর এসব মুরতাদদের বিষয়ে নব্বইয়ের দশকে GIA আল-জেরিয়াতে যেই গণহত্যা চালিয়েছিল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে মুরতাদ হওয়ার অপরাধে, সেই গণহত্যা বিন-লা-দেন ও জারকাবীদের বক্তব্য অনুযায়ী কোন অপরাধ ছিলো না। যদিও তারা রমজানে নামাজ শেষে মসজিদের দরজার সামনে তাদেরকে হত্যা করেছে। 

 

আবু মুসআব জারকাবী ও বিন-লাদেনের এই তাকফিরী চিন্তা-ধারার এদেশীয় ধারক-বাহকদের অন্যতম সদস্য মাওলানা আলী হাসান ওসামার গতকালের নিচের বক্তব্যটিতেও একই ধরণের চিন্তা-ধারা ফুটে ওঠেছে। 

 

মাওলানা আলী হাসান ও-সামা লিখেছেন, 

ভোট নাকি সাক্ষ্য। আর ইনসাফের সাথে সাক্ষ্য দেওয়া ওয়াজিব। ইচ্ছাকৃত সাক্ষ্য গোপন করা হারাম। কিন্তু কথা হলো, এটা কিসের সাক্ষ্য? হাকিমিয়্যাহ (বিধান প্রণয়নের ক্ষমতা) গাইরুল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করার সাক্ষ্য? ভোটদাতারা কী করে? প্রথমে আল্লাহর সিফাত হাকিমিয়্যাহ নিজেদের জন্য সাব্যস্ত করে। এরপর এ ধরনের বহু সাব্যস্তকারী মিলে ব্যালট পেপার ফেলে কোনো একজনকে নিজেদের প্রতিনিধি বানায়, যার কাজ তাদের সকলের পক্ষ থেকে হাকিমিয়্যাহর অধিকার প্রয়োগ করা।

তো ভোট মানে সাক্ষ্য, কথা এতটুকু বললেই তো শেষ না। দারুল ইসলামে আমির নির্ধারণের ব্যাপারে আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ ও শুরা পরিষদের সাক্ষ্য আর ডেমোক্রেসিতে গাইরুল্লাহর জন্য হাকিমিয়্যাহ সাব্যস্তকারীদের সাক্ষ্য এক হয়ে গেল! বাহ, বাহ! উদ্ভট কিয়াসের অদ্ভুত দুনিয়া!

 

 

 

এখানে মাওলানা আলী হাসান ওসামা যদিও সরাসরি জারকাবী বা বিন-লাদেনের মতো ভোটারদেরকে মুরতাদ বলেননি, কিন্তু দুইয়ে দুইয়ে চারের মতো ওনার বক্তব্য থেকে এটিই বের হয়। প্রচলিত ভোটকে তিনি গাইরুল্লাহর জন্য হাকিমিয়াহ সাব্যস্তের সাক্ষ্য  বলেছেন। যা প্রায় হুবহু আবু মুসআব জারকাবীও উপরে বলেছেন। পার্থক্য এতটুকু যে, জারকাবী ভোটের বিধান সরাসরি মুরতাদ হওয়া উল্লেখ করলেও মাওলানা আলী হাসান ওসামা বিষয়টি উল্লেখ করেননি। তবে তার বক্তব্য থেকে মুরতাদ হওয়ার হুকুম ছাড়া ভিন্ন কোন হুকুম বাহ্য দৃষ্টিতে বের হয় না। যৌক্তিকভাবে বললে তার বক্তব্যের ফলাফল দাঁড়ায় এভাবে,

১। প্রচলিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোট দেয়ার অর্থ হলো গাইরুল্লাহর জন্য হাকিমিয়ার সাক্ষ্য প্রদান।

২। আর গাইরুল্লাহর জন্য হাকিমিয়ার সাক্ষ্য প্রদান কুফুর ও ইরতিদাদ। 

৩। সুতরাং প্রচলিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোট দিলে সে কুফুরী ও ইরতিদাদের সম্মুখীন হবে। 

 

এই কথার বাইরে মাওলানার যদি ভিন্ন কোন ব্যাখ্যা থাকে, তাহলে সেটা সে উল্লেখ করতে পারে। তবে আমরা তার বক্তব্য থেকে যৌক্তিকভাবে এধরণের ফলাফলই পাচ্ছি। যা তার চিন্তা-চেতনার মূল গুরু বিন-লা-দেন ও জারকাবীদের সাথে মিলে যাচ্ছে। 

এই পর্যন্ত সব আলোচনাই ঠিক ছিলো। তবে এখানে সমস্যা তৈরি করেছে মিশরের মুরসী ও ইখওয়ানুল মুসলিমীনরা। মিশরের সংবিধানে শরীয়ত বিরোধী আইন থাকার পরও তারা নির্বাচন করেছে। আবার সেই নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিন-লা-দেনের ভাষায় মুরতাদ হওয়ার অধিবেশনও করেছে। এখন কথা হলো, বি-ন লা-দেন ও জারকাবীর উপরের বক্তব্য অনুযায়ী মুরসী ও মুরসীর সমস্ত সমর্থকদের মুরতাদ হওয়ার কথা। কিন্তু এখানেই প্যাঁচ লেগেছে। আর এই প্যাঁচকে কেন্দ্র করে পরবর্তীতে দা-য়েশ ও আল-কা-য়দার মধ্যে বিরোধের সূচনা হয়। এই প্যাঁচ নিয়ে আমরা পরের অংশে বিস্তারিত লিখব ইনশা আল্লাহ। এর মাধ্যমে এই তাকফিরী-খারেজীদের ডাবল স্ট্যান্ডার্ডও স্পষ্ট হবে ইনশা আল্লাহ।  


 

গণতন্ত্রকে কেন্দ্র করে কীভাবে দা-য়েশ ও আইমান জা-ও-য়াহেরী গ্রুপ নিজেদের মধ্যে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে, সে বিষয়ে আলাপের আগে বোকো হা-রা-ম নিয়ে কিছু আলাপ করা যাক। আন্তর্জাতিক বিষয়ে খবর রাখেন আর বোকো হা-রা-মের নাম শোনেননি, এমন লোক পাওয়া দু:স্কর। বোকো হা-রা-মের উৎপত্তির পেছনেও উল্লেখযোগ্য একটি কারণ ছিলো গণতন্ত্র। 

 

আমরা অনেকেই জানি, বোকো শব্দের অর্থ পশ্চিমা শিক্ষা বা পশ্চিমা চিন্তা-চেতনা। আর আরবী হারাম শব্দটির সাথেও সকলে পরিচিত। বোকো হা-রা-মের অর্থ হলো পশ্চিমা শিক্ষা হারাম। 

 

নাইজেরিয়ান এই জি-হা-দী গ্রুপের আসল নাম কিন্তু এটি নয়। এদের মূল নাম ‘জামায়াতু আহলিস সুন্নাহ লিদ-দাওয়াতি ওয়াল জি-হা-দ’। এটি মূলত: একটি সালাফী সংগঠন। এর মূল প্রতিষ্ঠাতা হলেন, আবু ইউসুসফ আল-বুরনাবী। আশির দশকে ইখওয়ানের সাথে কাজ করলেও পরবর্তীতে ইখওয়ান দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একটি গ্রুপ ‘ইব্রাহীম জাকজাকীর’ নেতৃত্বে শিয়া-পন্থী হয়ে যায়। অন্যরা দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ‘জামায়াতুত তাজদিদিল ইসলামী’ গঠন করে ।  আরেকদল সালাফী দাওয়াতের পক্ষে কাজ করা শুরু করে। মুহাম্মাদ ইউসুফ ইখওয়ান থেকে বের হয়ে এই জামায়াতের সাথে সালাফী দাওয়াতের পক্ষে শক্তভাবে কাজ করা শুরু করেন। বিশেষ করে বিভিন্ন সূফী ত্বরীকার বিরুদ্ধে নজদী-তাইমী দাওয়াতের প্রচার-প্রসারে আত্মনিয়োগ করেন।  ইখওয়ানের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি হওয়ার পর আবু ইউসুফ বারনাবী ‘জামায়াতু ইজালাতিল বিদয়াহ ও ইকামাতিস সুন্নাহ’ (বিদয়াত দূর করে সুন্নাহ প্রতিষ্ঠা) নামক দলে যোগদান করেন। 

নাইন ইলাভেনের পরে ‘সালাফী-জি-হা-দী’ আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হোন।

পরবর্তীতে এই দলের মাঝে বিরোধ হলে তিনি ২০০২ সালে জামায়াতু আহলিস সুন্নাহ লিদ-দাওয়াতি ওয়াল জি-হ-াদ’ প্রতিষ্ঠা করেন। এটিই মূলত: আন্তর্জাতিকভাবে বোকো হা-রাম নামে পরিচিত। 

 

আবু ইউসুফ বুরনাবী বেশ কয়েকটি সালাফী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। নিজে নিয়মিত দরস ও বয়ানের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন যার নাম ছিল, মারকাজু ইবনে তাইমিয়াহ। আবু ইউসুফ বুরনাবীর উল্লেখযোগ্য একটি রচনা হলো, ‘হাজি আকিদাতুনা ও মানহাজু দাওয়াতিনা’ ( এটি আমাদের আকিদা ও দাওয়াতের মানহাজ)। এই কিতাবে তিনি তার চিন্তা-ধারা তুলে ধরেছেন। নিচে কিতাবের ছবি দেয়া হলো,


 














 

এ কিতাবে তিনি ইবনে তাইমিয়া, ইবনে আব্দিল ওয়াহহাব নজদী, আল-কা-য়-দা লিডার আবু মুস-আব জা-রকাবী সহ অন্যান্য সালাফীদের চিন্তা-চেতনা অনুযায়ী তার দাওয়াতের বিষয়গুলো তুলে ধরেছে। 

 

চিন্তা-চেতনার দিক থেকে আবু ইউসুফ বুরনাবী অনেকটা আবু মুস-আব জার-কাবীর কাছাকাছি চিন্তা-চেতনা রাখত। গণতন্ত্রকে সরাসরি কুফুর ও শিরক মনে করা, শিয়া-রাফেদীদেরকে সরাসরি কাফের মনে করা সহ অনেক বিষয়ে আবু মুস-আব জা-রকাবীর মতে সাথে তার মিল রয়েছে। বিশেষ করে গণতন্ত্রের বিষয়ে তার বইয়ে আবু মুসআব জা-রকা-বীর একটি লম্বা আলোচনাও উদ্ধৃত করেছেন।  তিনি লিখেছেন,

 

 

অর্থাৎ “বর্তমান সময়ের ফেতনা সম্পর্কে সতর্ক থাকুন। বিশেষ করে বর্তমান সময়ের কুফুরী গণতন্ত্র সম্পর্কে। গণতন্ত্রের পন্থা এর অনুসারীদের নিকট একটি বিশেষ ধর্ম। 

 

আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি না, গণতন্ত্রের সাথে কাজ করি না, ক্ষমতা অর্জনে গণতন্ত্রকে ব্যবহার করি না। কেননা এটি কাফেরদের পন্থা। সুতরাং গণতন্ত্রকে অনুসরণ করা অথবা এর সাথে কাজ করা কিংবা এর গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করা কুফুরী। ফলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কোন মুসলমানের জন্য নিজে প্রার্থী হওয়া এবং অন্যকে নির্বাচিত করাও বৈধ হবে না”

[হাজিহি আকিদাতুনা ও দাওয়াতু মানহাজি না, পৃ: ৩৭]

 

এরপর তিনি সালাফী শায়খ ইবনে উসাইমিন ও ইবনে জিবরীনের বক্তব্য তুলে ধরেছেন। এরপর গণতন্ত্র বিষয়ে ৩৮-৪৩ পৃষ্ঠা পর্যন্ত আবু মুসআব-জা-রকা-বীর একটি লম্বা আলোচনা তুলে ধরেছেন। 

 

মুহাম্মাদ আবু ইউসুফ বুরনাবীর চিন্তা-চেতনা সম্পর্কে তার ছেলে আবু মুস-আব বুর-না-বী লিখেছেন,

অর্থাৎ “আমাদের জামায়াত বহুবার তাগুতী শাসন ও তার আইন-কানুন সম্পর্কে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছে যে, গণতন্ত্র একটি শিরকী ধর্ম। এটি তাওহীদের বিপরীত ও তাওহীদের আকিদা বিনষ্টকারী”। 

[খাজউল ওরাম, পৃ: ১৪]



আবু ইউসুফ বুরনাবীর মতে, বর্তমানের বিচার ও শাসন-ব্যবস্থা যেহেতু আল্লাহ প্রদত্ত নয়, বরং নিজেদের বানান এজন্য যারা তাদের এই বানান শাসন-ব্যবস্থা অনুসরণ করে এবং তাদের কাছে বিচার নিয়ে উপস্থিত হয়, তারা মুশরিক। 

 

 

গণতন্ত্রের পাশাপাশি তিনি শিয়া-রাফেদীদেরকেও সরাসরি তাকফীর করতেন। এছাড়া সূফীদেরকে ভ্রান্ত ও মুশরিক মনে করতেন। বিশেষ করে প্রচলিত সব সূফী ত্বরীকাকে তিনি ভ্রষ্ট মনে করতেন। তিজানী ত্বরীকার মূল আহমাদ ত্বিজানীকে বলেছেন, গৃহপালিত গাধা থেকেও বেশি পথভ্রষ্ট। তার কাছে সূফীদের পাশাপাশি কালামী ধারা তথা আশয়ারি-মাতুরিদিগণও বিদয়াতী ও পথভ্রষ্ট। হাজীহি আকিদাতুনা বইয়ে এগুলো বিস্তারিত রয়েছে।

 

বিষয়গুলি তার ছেলেও উল্লেখ করেছে।



 

এছাড়া আবু ইউসুফ বুরনাবীর মতে প্রচলিত তাগুতী শাসন ব্যবস্থার প্রশাসনিক কোন পদে চাকরী করলেও মুরতাদ হয়ে যাবে। যেমন, পুলিশ, মিলিটারী ইত্যাদি। এধরণের প্রশাসনিক পদে চাকরীর অর্থ হলো, তাগুতী শাসন ব্যবস্থার কুফুরীর সাথে একমত হওয়া ও সহযোগিতা করা। আর কুফুরের সহযোগিতা বা কুফুরের সাথে একমত হওয়াও কুফুরী। 

 

মোটকথা, অন্যান্য সালাফী - জি-হা-দী গ্রুপগুলোর মতই আবু ইউসুফ বুরনাবী তার চিন্তা-ধারা নজদী-তাইমী দর্শন ও তাকফিরী মানহাজের উপর গড়ে তোলে। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রশাসনের সাথে বড় ধরণের না হলেও ২০০৯ সালে কিছু সহিংসতা হয়। আবু ইউসুফ বুরনাবী সরাসরি নাইজেরিয়ান সরকারের বিরুদ্ধে জি-হা-দ ঘোষণা করে তার জামায়াতকে প্রস্তুত করেন। নিজে পতাকা হাতে তুলে দিয়ে মুরতাদ প্রশাসনের বিরুদ্ধে জি-হা-দ শুরু করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে তারা কিছু সফলতা পেলেও প্রশাসন বড় ধরণের আক্রমণ চালায় তাদের ইবনে তাইমিয়া মারকাজে। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর আবু ইউসুফ বুরনাবী গ্রেফতার হোন। তার কিছু অনুসারী সেখান থেকে পালিয়ে যায়। পরে আবু ইউসুফ বুরনাবীকে সরকার হত্যা করে। 

 

আবু ইউসুফ বুরনাবীর সবচেয়ে আস্থাভাজন ও তার স্থলাভিষিক্ত ছিলো আবু বকর শিকাও বা শিকাবী। তার জীবদ্দশাতেই আবু ইউসুফের অবর্তমানে শিকাবী দায়িত্ব পালন করত। বিভিন্ন দাওয়াতী প্রোগ্রামেও শিকাবী আবু ইউসুফের পাশাপাশি বয়ান - বক্তৃতা করত। 

 

আবু বকর শিকাবী খুবই দুনিয়া-বিরাগী, আবেদ, জাহেদ ছিলো। একটা জামা পড়ে বহু দিন কাটিয়ে দিত। কেউ অতিরিক্ত জামা-কাপড় হাদিয়া দিলে সেটি নিজে না ব্যবহার করে অন্যকে দান করে দিত। আবু বকর শিকাবীর এই জুহদ ও একনিষ্ঠতা দেখে তাকে কাছে টেনে নেন আবু ইউসুফ বুরনাবী। 



 

 

অর্থাৎ ইবাদত-বন্দেগী, তাকওয়া, খোদাভীতি, জুহদ, দনিয়া-ত্যাগ ইত্যাদিত ক্ষেত্রে আবু বকর শিকাবী অগ্রগামী ছিলো। মোটা কাপড় পরিধান করত। তার খাবার নির্ধারিত থাকার পরও ছাতু ইত্যাদি খেত। এছাড়াও আরও অনেকগুলি বিষয় প্রকাশিত হয়েছে যা তার দুনিয়া-ত্যাগের প্রমাণ বহন করে। যেমন, তার একটি মোটর-বাইক ছিলো। সেটি বেশ পুরাতন ও নষ্ট হয়ে গেলে কিছু সাথী তাকে আরেকটি নতুন মোটর সাইকেল কিনে দেয়ার প্রস্তাব দিলে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে। তারা কোনভাবেই তাকি রাজি করতে না পারায় পুরাতন নষ্ট মোটর-সাইকেরলের বিনিময়ে নতুনটি দেয়। তাকে দামী ও পাতলা কোন কাপড় হাদিয়া দিলে সে নিতো না। আবার নিলেও অন্যকে দান করে দিত। 

 

সেসময় তার বুজুর্গী এ পর্যায়ের ছিলো যে, একবার সে একজন খেজুর বিক্রেতার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তার কাছ থেকে খেজুর কিনতে চাইলে শিকাবীকে দেখে লোকটি খেজুর এমনিতে হাদিয়া দিতে চায়। তখন শিকাবী তার হাদিয়াও গ্রহণ করেনি আবার তার কাছ থেকে খেজুরও কিনেনি। কারণ, এখানে দ্বীন বিক্রি করে কিছু নেয়ার সম্ভাবনা ছিলো। 

[খাজউল ওরাম, পৃ: ৩৬ ]

 

আবু ইউসুফ বুরনাবীর জীবদ্দশাতেই যেহেতু আবু বকর শিকাবী তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে গিয়েছিল, এজন্য তার ইন্তেকালের পর শিকাবীর নেতৃত্বে আবার তারা সুসংগঠিত হতে থাকে। প্রাথমিক পর্যায়ে বোকো-হা-র-ামের অভিজ্ঞতা কম থাকায় তাদেরকে সহযোগিতা করার জন্য ‘আ-ল-কা-য়েদা’ এগিয়েম আসে। মরুভূমিতে বিভিন্ন ট্রেনিং ও অর্থনৈতিক সহযোগিতায় সরাসরি কা-য়-দা সম্পৃক্ত হয়। বোকো হা-রা-মের সাথে এ পর্যায়ে কা-য়-দার সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়টি আবু ইউসুফ বুরনাবীর ছেলে তার কিতাবে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন।

 

২০১১ - ২০১২ সাল থেকে আবু বকর শিকাবী তার কার্যক্রম শুরু করে।   নিজেকে ইমাম ও খলিফা হিসেবে আস্তে আস্তে প্রকাশ করতে থাকে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলো, প্রতিনিয়ত শিকাবীর তাকফিরী-খারেজী চিন্তা-চেতনা আর ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠছিলো। বো-কো-হারামের প্রতিষ্ঠাতা আবু ইউসুফ বুরনাবীর সময় পশ্চিমা শিক্ষা হারাম ও কুফুর বললেও সরাসরি শিক্ষার্থীদেরকে কাফের বলা হতো না। কিন্তু শিকাবী ঢালাওভাবে শিক্ষার্থীদেরকেও কাফের বলা শুরু করে। অমুসলিম দেশ বা অঞ্চলে বসবাসরত মুসলমানদেরকেও ঢালাওভাবে কাফের বলা শুরু করে। এমনকি যেসব অঞ্চলের মুসলমান শাসকদেরকে তারা মুরতাদ বলেছে, সেসব অঞ্চলের মুসলমানদেরকেও কাফের বলা শুরু করে। এভাবে একের পর এক তার তাকফিরী চিন্তা-চেতনা অন্য সব জি-হা-দী গ্রুপকে ছাড়িয়ে যায়। এদিকে  ২০১৪ সালে আবু বকর বা-গ-দাদী তার খিলাফত ঘোষণা দেয়। বাগ-দাদীর খেলাফত ঘোষণার পর আন্তর্জাতি বিভিন্ন সংগঠন বা-গদা-দীর হাতে বাইয়াত দিতে শুরু করে। 

 

আবু বকর শি-কা-বীর হিংস্রতা, বর্বরতা, ঢালাওভাবে তাকফীরে অতিষ্ঠ হয়ে তার অনুসারীদের একটা বড় অংশ তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এদের বিষয়ে অবগত হলে শিকাবী অনেককে বিভিন্ন হিলা-বাহানা করে হত্যা করে। এক পর্যায়ে নিজের দলের ভেতরে অসন্তোষ ও বিদ্রোহ দমন করার জন্য নাম-মাত্র দা-য়েশের হাতে বাইয়াত দেয়। দা-য়েশের হাতে বাইয়াত দিলেও শিকাবী তার মর্জি-মত চলত। তার নিজস্ব তাকফিরী-চিন্তা অনুযায়ী সাধারণ জনগণকে গণহত্যা করত। শিকাবীর অনেক কর্মকান্ডে দা-য়ে-শ প্রতিবাদ করলে সেগুলো সে কর্ণপাত করত না। ফলে এক পর্যায়ে দা-য়েশ তাকে অপসারিত করে আবু ইউসুফ বুরনাবীর ছেলেো আবু মুসআব বুরনাবীকে তার স্থানে পদ দেয়। শুরু হয় দা-য়েশের সাথে বোকো-হারামের সংঘর্ষ। আবু বকর শিকাবী পদ হারিয়ে দা-য়েশের উপরও নানা বিচ্যূতির অভিযোগ এনে তার বাইয়াত ভঙ্গ করে। 

 

২০১৬ সাল থেকে বো-কো-হা-রা-মের সাথে দা-য়েশ লাগাতার সংঘর্ষে লিপ্ত আছে। আবু ইউসুফ বুরনাবীর ছেলের গ্রুপ (দা-য়ে-শ) আবু বকর শিকাবীর গ্রুপের উপর অনেক অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করেছে। এমনকি ২০২১ সালে দুই গ্রুপের মাঝে তুমুল সংঘর্ষ হয়। অভিযোগ করা হয়, লড়াইয়ের এক পর্যায়ে শিকাবী সুই-সাইড বোম্ব ব্যবহার করে নিজেকে উড়িয়ে দেয়। 


 

জি-হা-দের নামে বোকো হা-রা-মের অপরাধের আসলে কোন কুল-কিনারা নেয়। এদের জুলুম, নির্যাতন, গণহত্যা, ডাকাতি ও লুটতরাজ এতো ভয়ঙ্কর ছিলো যে, খোদ দা-য়ে-শের মতো খারেজী সংগঠনও এদেরকে খা-রেজী বলতে বাধ্য হয়েছে। 

 

বোকো -হা-রা-মের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মাদ আবু ইইসুফের ছেলে আবু মুস-আব বা-র-নাবী শিকাবীর জুলুম-নির্যাত, ভয়ঙ্কর তাকফির ও গণহত্যার যে লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন তা ভাষায় প্রকাশের নয়। আমরা এখানে সামান্য কিছু নমুনা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করছি।

 

মনে রাখতে হবে, বর্ণনাগুলো লিখেছে বোকো হারামের একেবারে পরিবারের লোক, দীর্ঘ সময় যারা আবু বকর শিকাবীর সাথে কাজ করেছে এবং পুরো বিষয়গুলো স্বচক্ষে দেখেছে। তবে এরা যেহেতু এক পর্য়ায়ে বোকো -হারা-ম ত্যাগ করে দা-য়েশে অংশগ্রহণ করেছে, এজন্য অনেক চিন্তা-ভাবনাও খারেজী। তবে এদের চেয়েও খারেজিয়াতের দিক থেকে অধিক ভয়ঙ্কর দলের ব্যাপারে তাদের বক্তব্য সত্যিই অবাক করার মতো। জি-হা-দের নামে খারেজিয়াত কতো নিচে নামিয়ে দিতে পারে তার কিছু নমুনা পাওয়া যাবে এসব আলোচনায়। 

 

আবু মুস-আব বারনাবী সংক্ষেপে বোকো হা-রা-মের বিচ্যূতিগুলো এভাবে তুলে ধরেছেন,

 

অর্থাৎ ১। বোকো হা-র-াম খারেজীদের প্রায় সব ফেরকার সাথে একমত হয়ে কবিরা গোনাহের কারণে তাকফিরের মানহাজ অবলম্বন করেছে। তবে বিষয়টি তারা স্পষ্ট করে বলে না এবং সব কবিরা গোনাহের জন্যও তাকফির করে না। তবে তারা বিভিন্ন  কবিরা গোনাহের মাধ্যমে তাদের প্রতিপক্ষ বিভিন্ন দলের কুফুরীর দলিল দিয়ে থাকে। 

 

২। খারেজীদের মতো বোকো  হা-রাম তাদের সব ধরণের প্রতিপক্ষকে মুরতাদ ও কাফের আখ্যা দেয়। প্রতিপক্ষ সাধারণ মানুষ হোক কিংবা বিশেষ কোন গোষ্ঠী।  এ বিষয়ে বোকো হা-রামের প্রধান আবু বকর শিকাবীর স্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে। যেখানে সে কোন ধরণের বাছ-বিচার ছাড়া উম্মতের ছোট-বড় সব দলকে মুরতাদ বলেছে। সুতরাং দাউলাতুল ইসলাম আফ্রিকা (আফ্রিকান দা-য়েশ) কে তাকফির করাটা তার জন্য মামুলী বিষয়। 

 

৩। খারেজীদের আজারিকা ফেরকার সাথে একমত হয়ে সে বলেছে, যারা তার বিজিত অঞ্চলে হিজরত করবে না, তারা মুরতাদ ও কাফের। যদিও কেউ হিজরতের নিয়তে ভিন্ন জায়গায় অবস্থান করছে। 

 

৪। প্রাচীন খারেজী ফেরকা আজারিদাদের মতো তাদের দলে কেউ অংশগ্রহণ করতে চাইলে বিভিন্নভাবে তাকে পরীক্ষার পদ্ধতি চালু করে। যেমন, প্রতিপক্ষ কোন বন্দীকে সামনে দিয়ে তাকে হত্যা করতে বলা। অথবা প্রতিপক্ষের স্ত্রীদের সাথে বিবাহ দিয়ে পরীক্ষা করা। 

 

৫। প্রাচীন খারেজী ফেরকার আজারিদাদের একটি শাখা ফেরকা ছিলো মা’লুমিয়্যাহ। যারা বিশ্বাস করত, যে ব্যক্তি আল্লাহর সমস্ত নাম জানে না সে মূলত: আল্লাহ তায়ালাকে চিনে না। আর যে আল্লাহকে চিনে না সে কাফের। একইভাবে বোকো হা-রা-ম বলে, যে লা-ইলাহা এর সাতটি শর্ত ও ঈমান ভঙ্গের দশটি কারণ (ইবনে আব্দিল ওয়াহহাবের দেয়া) সম্পর্কে জানে না এবং উপস্থিত মুখস্থ বলতে পারে না সে দ্বীন ইসলাম থেকে বহির্ভূত মুরতাদ ও কাফের। 

 

৬। বর্তমান জামানার অন্যান্য খারেজীদের মতো তাদের মতে মানুষের মূল হলো, তারা কাফের। 

 

৭। বোকো হা-রাম তথা শিকাবীর দল মু’তাজিলাদের মতো চেইন তাকফির করে যার কোন শেষ নেই। অর্থাৎ তারা যাদেরকে কাফের বলে তাদেরকে কাফের না বললে এই ব্যক্তি কাফের। আবার এই ব্যক্তিকে যে কাফের বলবে না সেও কাফের। এভাবে তাকফির চলতেই থাকবে।

 

এগুলো ছিল বোকো হা-রা-মের খারেজী চিন্তা-চেতনার কিছু সংক্ষিপ্ত বিবরণ। বিস্তারিত বিবরণ আরও ভয়ঙ্কর ও লোমহর্ষক। একটা উদাহরণ দেয়া যাক। 

আবু বকর শিকাবীর মতে, মুরতাদ শাসকের অধীনে যারা বসবাস করছে তারাও মুরতাদ। কারণ, আল্লাহর আইন বাদ দিয়ে নিজেদের বানান আইনে যেসব মুসলিম শাসকরা বিচার করে থাকে, এসব সাধারণ জনগণ তাদের এই কাজের ব্যাপারে চুপ থাকে। অনেক সময় তারা এসব মুরতাদ শাসকের কাছে বিভিন্ন প্রয়োজনে বিচার নিয়ে যায়। এসব সাধারণ মানুষ যখন শাসকের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ করে না তখন এটি তাদের কুফুরী প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। সে হিসেবে গণতান্ত্রিক শাসকের অধীনে বসবাস করা সবাই কাফের ও মুরতাদ। 

 

প্রশ্ন হলো, আবু বকর শিকাবীর এই ধরণের মাসআলা দেয়ার প্রয়োজন হলো কেন? বিষয়টি বেশ লজ্জাজনক ও ভয়ঙ্কর। 

 

মূল ঘটনা:

 

দা-য়েশের অধীনে যেসব অঞ্চল ছিলো, তাদের কাছে দা-য়েশের পক্ষ থেকে নির্দেশনা ছিলো, মুরতাদ মহিলাকে হয় হত্যা করবে অথবা সে ইসলাম গ্রহণ করবে। 

 

এদিকে আবু বকর শিকাবী যেসব অঞ্চল বিজয় করত, সেসব অঞ্চলের মুসলমান মেয়েদেরকে মুরতাদ হিসেবে বন্দী করত। তাদেরকে যেহেতু মুরতাদ হিসেবে বন্দী করেছে, এজন্য দা-য়েশের নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের সামনে ইসলাম পেশ করলে তারা হয়ত ইসলাম গ্রহণ করবে অথবা তাদেরকে হত্যা করবে। এখন আবু বকর শিকাবী এসব মেয়েদের অনেকের সাথে গোপনে সহবাস করেছে। কারও কারও বাচ্চা পেটে এসে গেছে। বিষয়টি দা-য়ে-শ সহ অন্যদের কাছে প্রকাশ পেলে শিকাবী নতুন একটি উসূল বের করে। 

 

সে বলা শুরু করে, এসব মেয়েরা আসলে মুরতাদ নয়। বরং এরা জন্মগত কাফের। আর জন্মগত কাফের হওয়ার কারণে তাদেরকে বাদী হিসেবে সহবাস করা বৈধ। 

 

এখন প্রশ্ন দেখা দেয়, মুসলমানদের ঘরে জন্ম নেয়া এসব ছেলে-মেয়েরা কীভাবে জন্মগত কাফের হতে পারে?

 

তখন সে আরেকটি উসূল বের করে। তাদের অঞ্চলে উসমান বিন ফু’দে এর পর গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেসময় থেকে যারা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা মেনে নিয়ে তাদের অধীনে বসবাস করেছে, তারা সবাই মুরতাদ ও কাফের। আর মুরতাদ ও কাফেরের সন্তান হিসেবে বর্তমানের ছেলে-মেয়েরা জন্মগতভাবে কাফের। সুতরাং এরা যেহেতু জন্মগত কাফের, এজন্য এসব মেয়েদেরকে দাসী বানিয়ে তাদের সাথে সহবাস করা বৈধ। 

 

এ বিষয়ে বোকো -হা-রামের প্রতিষ্ঠাতা আবু ইউসুফের ছেলে পুরো বিষয়টি তার খাজউল ওরাম বইয়ের ৬৩-৬৪ পৃষ্ঠায় তুলে ধরেছেন। 

 

 

 

খাজউল ওরামের ৬৪ পৃষ্ঠায় এক দিনের ঘটনা তুলে ধরেছেন এভাবে,

“এক দিন আমরা জোহর অথবা আসরের নামাজ শেষ করলাম। তখন আবু বকর শিকাবী আমাদের দিকে মুখ করে বলল, আমার একটি প্রশ্ন আছে। আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে চাই। দেখি, তোমরা এই প্রশ্নের কী উত্তর দাও। উসমান বিন ফু’দে এর পরে আমরা যারা দারুল কুফুরে জন্ম গ্রহণ করেছি, তাদের হুকুম আসলে কী? 

তখন শিকাবীর শরীয়াহ বোর্ডের একজন যার নাম মালেম শারী সে বলল, আমাদের পিতা-মাতা গণতান্ত্রিক রাষ্টব্যবস্থা মেনে নিয়ে মুরতাদ হয়ে গিয়েছেলেন। আমরা আমাদের মুরতাদ পিতা-মাতার সন্তান। অতএব, আমরা একটি মুরতাদ ও কাফের প্রজন্মের সন্তান। সুতরাং আমরা জন্মগতভাবে কাফের। 

তখন শিকাবী বলল, এটিই সঠিক মত। উসমান বিন ফু’দে এর রাষ্ট্রের পতন হওয়ার পর আমাদের পিতা-মাতা সকলে মুরতাদ ও কাফের হয়ে গিয়েছে। আমরা তাদের কুফুরী অবস্থায় জন্ম নিয়েছি। সুতরাং আমাদের ক্ষেত্রে মূল হলো, আমরা জন্মগতভাবে কাফের।”

 

ইন্নালিল্লাহ। মুসলমান মেয়েদের সাথে জিনা-ব্যভিচার করার জন্য এরা আল্লাহর দ্বীন ও শরীয়তকে কীভাবে বিকৃত করে। নাউজুবিল্লাহ। এগুলো আবার হয়েছে জি-হা-দের নামে। দ্বীন প্রতিষ্ঠার নামে। আস্তাগফিরুল্লাহ। 

 

নাইজেরিয়াতে জি-হা-দের নামে আসলে কী চলছিল, তার কিছু চিত্র ওঠেছে বোকো হা-রা-মের প্রতিষ্ঠাতার ছেলের বর্ণনায়। তার বক্তব্যের সার - সংক্ষেপ নিচে তুলে ধরা হলো,

 

“আবু বকর শিকারী তার বাড়াবাড়ি ও বিচ্যূতিগুলো আস্তে আস্তে খুব ঠান্ডা মাথায় প্রকাশ করছিল। প্রথমত: সে বলে, সুস্পষ্ট কুফুরের ক্ষেত্রে অজ্ঞতার ওজর (উজর বিল জাহল) ধর্তব্য নয়। দারুল কুফুরে অবস্থানরত সকল মুসলমান কাফের। এভাবে তারা মুসলমানদের রক্ত ও সম্পদ হালাল করে নেয়। বোকো - হা-রামের দাওতী পদ্ধতিতেও মৌলিক পরিবর্তন এসে যায়। শিকাবী তার অনুসারীদের নিয়ে এক ধরণের এক-নায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করে। 

আ-ল-কা-য়-দার মরক্কো শাখার পক্ষ থেকে তাকে নসীহাত করে চিঠি পাঠান হয়। কিন্তু সে কোন ধরণের উপদেশ গ্রহণের পরিবর্তে বিচ্যূতি ও সীমালঙ্ঘনে আরও এক ধাপ এগিয়ে যায়। ফলে বোকো - হা-রামের অভ্যন্তরে কোন্দল ও বিরোধ শুরু হয়। জি-হা-দীরা কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। 

 

১। একদল শিকাবীকে অনুসরণ করে এবং তার পক্ষে দাঁড়িয়ে যায়। 

২। আরেকদল কঠোরভাবে তার বিরোধিতা শুরু করে এবং তার বিপক্ষে চলে যায়। 

৩। আরেকদল শিকাবীর বাড়াবাড়ি থেকে বাঁচতে গিয়ে আরেক বাড়াবাড়িতে লিপ্ত হয়। বাড়াবাড়ি থেকে বাঁচতে তারা ছাড়াছাড়ির পথ অবলম্বন  করে। একেবারে জি-হা-দ ছেড়ে দেয় এরা। 

 

তবে অধিকাংশ মু-জা-হিদীন কিংকর্তব্যেবিমূড় হয়ে পড়েন। কারণ, তারা বিষয়গুলোর পক্ষে শক্তিশালী দলিল পাচ্ছিলেন না। আবু বকর শিকাবীর কঠোর নির্দেশনা ছিলো, মুজা-হি-দীনদের দলনেতা ও অনুসারীরা যেন প্রতিপক্ষের কোন আলোচনা না শোনে। তার শুধু তাদের দলের পক্ষ থেকেই শুনত, অমুক মুনাফিক হয়ে গেছে। অমুক গণীমত আত্মসাৎ করেছে। অমুক ইমাম শিকাবীর বিরোধী হয়ে গেছে। এগুলো শুনে তারা হাসাহাসি করত। 

 

কিতাবাদি ও চিঠিপত্র যা প্রকাশ পেত, তার সবই ছিলো শিকাবীর পক্ষ থেকে। সেখানে সে নিজের মন-মর্জি মাফিক কুরআন হাদিসের দলিলের অপব্যবহার করে নিজের বিচ্যূতি ও বিদয়াতের পক্ষে সাফাই লিখত। 

 

আর যারা ন্যায় ইনসাফের সাথে সংশোধনের চেষ্টা করত, উভয় দলের মাঝে সমঝোতার চেষ্টা করত, তাদের ব্যাপারেও শিকাবীর পক্ষ থেকে কুৎসা রটান হতো। অনেককে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এমনকি অনেককে হত্যাও করেছে। এভাবে পুরো জামায়াত ভালো লোক থেকে শূন্য হয়ে অজ্ঞ ও জাহেলদের আখড়ায় পরিণত হয়। 

 

অধিকাংশ মু-জা-হিদীন শিকাবীর পক্ষে থাকার একটি বড় কারণ ছিলো, ময়দানের নেতৃস্থানীয় লিডাররা তখনও দলে ছিলো। তারা তখনও শিকাবী থেকে আলাদা হয়নি। যেমন, আবু সা’য়াদ বামাবী ও মুহাম্মাদ সালাফী। এসব নেতারা পক্ষে থাকায় শিকাবীর বিরোধী পক্ষ সেইভাবে শক্তিশালী হতে পারেনি। এসব নেতারা যত দিন তার সাথে ছিলো, ততো দিন তারাও শিকাবীকে কিছুটা বোকা বানিয়েছিল। যার কারণে শেষের দিকে শিকাবী নিজেও এদের খিয়ানতের অভিযোগ করেছিল। 

 

নেতৃস্থানীয় বেশ কয়েকজন নেতা নিহত হওয়ার পর শিকাবীর বিরোধীদের উপর আক্রমণ শুরু হয়। তাদেরকে তাড়িয়ে দেয়া, নিরস্ত্র করা সহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হতে থাকে। ফলে বিরোধীরা শিকাবী থেকে আলাদা হয়ে নতুন একটি দল গঠন করে। এর নাম দেয় ‘আন-সা-রুল মু-স-লিমীন ফি বিলাদিস সু-দান’। এই দলের নেতা হোন আবু মুহাম্মাদ বুশাবী। তার সাথে বোকো হা-রা-মের শরীয়াহ বোর্ডেরও অনেকে যুক্ত হয়। যেমন, শায়খ আবু উ-সা-মা আনসারী। তবে এই গ্রুপটি আবার অজ্ঞতার ওজরের বিষয়ে আবার ছাড়াছাড়িতে লিপ্ত হয়। তাদের মতে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদেরকে অজ্ঞতার ওজরের কারণে কাফের বলা হবে না (লেখক নিজে দা-য়ে-শ ও তাকফিরী হওয়াই শুধু নির্বাচনে অংশগ্রহণকে কুফুরী মনে করে)। সেই সাথে কিছু লোভী মানুষও এই দলে যুক্ত হয়। ফলে শুরু থেকেই দলটি দুর্বল ছিলো। 

 

এই দলটির বেশিরভাগ শরীয়াহ বিষয়ে অভিজ্ঞ ছিলো। একারণে তারা ইলমের দিক থেকে শিকাবীর দল থেকে বেশি ইলম রাখত। অন্য দিকে শিকাবী নেতৃত্ব ও সৈন্য পরিচালনায় দক্ষ ছিলো, ফলে এদের চেয়ে তার শক্তিমত্তা বেশি ছিলো। এক পর্যায়ে শিকাবী তার প্রতিপক্ষদেরকে ধরে হত্যা করার নির্দেশ দেয়। শিকাবীর আদেশে শায়খ আবু ওসামাকে হত্যা করা হয়। তিনি একাধারে আলিম ছিলেন। আবার বিরোধী জামায়াতের নেতাও ছিলেন। শিকাবীর বিরোধী দলের নেতা আবু মুহাম্মাদ বুশাবী বন্দী হওয়ার পর তিনি প্রধান হয়েছিলেন। পরে এই দলের অধিকাংশ নেতা মুরতাদ শাসকের হাতে বন্দী হয়। 

 

শিকাবীর বিরোধী দলের বড় বড় নেতারা বন্দী ও নিহত হওয়ার দলটি নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে। ছোট ছোট বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে জি-হা-দের প্রস্তুতির (ই’দাদ) নামে মানুষের কাছ থেকে টাকা নেয়া এদের মূল লক্ষ্যে পরিণত হয়। তারা ব্যাংক ডাকাতি করা শুরু করে। মানুষকে কিডন্যাপ করে মুক্তিপণ দাবী করতে থাকে। তারা কোথাও যদি পুলিশ ফাঁড়ি বা থানায় আক্রমণ করত, এদের মূল উদ্দেশ্য থাকত, প্রশাসনকে বিক্ষিপ্ত করে ব্যাংক ডাকাতি ও কিডন্যাপিংকে সহজ করা। পেট ও পকেট ভারী করাই ছিলো এদের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এদের অধিকাংশ ‘আ-ল-কা-য়-দার’ চিন্তা-চেতনায় প্রভাবিত ছিলো। লা হাওলা ওলা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ। এদের দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেসব নেতারা পরবর্তীতে খি-লা-ফতের (দা-য়েশ) সাথে যুক্ত হয়েছিল, তাদের অনেকে বিষয়টি আমাকে জানিয়েছে। 

 

অন্য দিকে শিকাবী গ্রুপ যখন পুরোপুরি আলিম - উলামা শূন্য হয়ে যায়, তখন Maiduguri (মাইদুগুরি) তে কিছু যুবক সীমালঙ্ঘন ও অজ্ঞতাপূর্ণ নতুন একটি মানহাজের সূচনা করে। এরা সাধারণ মানুষের উপর চরম জুলুম নির্যাতন  শুরু করে। এক পর্যায়ে এরা মাইদুগুরিতে ডাকাতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। 

 

আমার মনে আছে, মাইদাগুরি শহরের উত্তরে-পূর্ব দিকে রেল-স্টেশনের কাছাকাছি কিছু গ্রাম ছিলো। তারা এসব গ্রামের উপর নিজেদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। এই গ্রামগুলোকে তারা ফালুজা নাম দিয়েছিল। বাইরের কেউ এই গ্রামের আশে-পাশে যেত না। এমনকি শিকাবীর দলের লোক হলেও তাদের পরিচিত না হলে কেউ সেখানে যেতে সাহস করত না। নতুন কেউ যদি তাদের দলে ঢুকতে চাইত তাহলে তার কোন সুপারিশনামা না থাকলে তাকে গুপ্তচর হওয়ার কথা বলে হত্যা করে দিত। তারা দলিল দিত, এসব লোকের বাস্তবতা ও নিয়ত দেখার প্রয়োজন নেই। বরং তারা তাদের নিয়তের উপর কিয়ামতের দিন ওঠবে। তাদের এই ঘৃণ্য কাজের পক্ষে কা’বা শরীফের বিরুদ্ধে যুদ্ধকারী বাহিনীর মাটিতে ধ্বসে যাওয়ার হাদীস দিয়ে দলিল দিত। যেখানে হাদীসে তাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে, তারা তাদের নিয়তের উপর কিয়ামতের দিন ওঠবে। পুরো গ্রামটি যেন একটি প্রবাদে পরিণত হয়েছিল। সেখানে যে যেত আর কখনও ফিরত না। আর যে বের হতো কেমন যেন সে নতুন ভূমিষ্ঠ হলো। 

 

সাধারণ মানুষের সাথে এদের আচরণ ছিলো অবর্ণনীয়। তাদেরকে কাফের মুরতাদ বলা। তাদের সম্পদ লুন্ঠন করা ছিলো নিত্য-নৈমত্তিক ঘটনা। তাদের কেউ ক্ষুধার্ত হলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ছিনতাই করে খেত। পায়ে হেঁটে চলতে হলে সাধারণ মানুষের গাড়ী ছিনিয়ে নিত। কোন মেয়েকে বিবাহ করতে চাইলে তার পরিবার যদি অস্বীকৃতি জানাত, তখন অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে তাদেরকে জোরপূর্বক বিবাহ করত। 

 

এধরণের অকথ্য জুলুম-নির্যাতনের সম্মুখীন হয়ে সাধারণ মানুষ মু-জা-হিদীনদের প্রতি বিরুপ মনোভাব ও বিদ্বেষ পোষণ করতে শুরু করে। ফলে তারা প্রশাসনের সাথে এক জোট হয়ে মুজা-হিদীনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এমনকি ‘কাতু দা গুরা’ নামক সম্মিলিত আন্দোলনে তারা জি-হা-দীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এক পর্যায়ে তারা বিশেষ করে এই গ্রাম থেকে এবং মাইদুগুরি শহর থেকে মু-জা-হিদীনকে পুরোপুরি তাড়াতে সক্ষম হয়। তারা এভাবে সম্মিলিত নাগরিক শক্তি নামে দল বানিয়ে প্রশাসনের সাথে মিলে মুরতাদ হওয়ার পথ গ্রহণ করে।

 

[খাজউল ওরাম, পৃ: ৩৮-৪০] 

 


 



 

 

এদের জুলুম - নির্যাতনের উপাখ্যান আসলে এখানে শেষ নয়। এদের বাস্তবতার খুব সামান্য একটা অংশই কেব বইয়ের পাতায় ওঠে এসেছে। অন্যায়ভাবে মানুষের রক্ত, সম্পদ ও সম্ভ্রম নষ্ট করা ছিলো এদের জন্য সাধারণ ঘটনা। সন্দেহ বশত: যাকে তাকে হত্যা করে ফেলত। সাধারণ মানুষের তাদের রক্ত, সম্পদ, ইজ্জত-সম্মান ও সম্ভ্রমের কোন নিরাপত্তা ছিলো না। এক পর্যায়ে বোকো হা-রা-মের সদস্যার ডাকাতে পরিণত হয়। যখন  ইচ্ছা মানুষের সম্পদ লুণ্ঠন করে গণীমত বলে চালিয়ে দিত। যাকে ইচ্ছা বন্দী করে নিয়ে আসত। 

 

যেসব আলিম - উলামা তাদেরকে উপদেশ দিতে গিয়েছে বা তাদের এসব ঘৃণ্য কাজের প্রতিবাদ করেছে, তাদেরকে তারা হত্যা করত। যেমন, শায়খ আব্দুল মালিক আনসারী কাদুনাবীকে তারা হত্যা করেছে। শায়খ আবুল আব্বাস বিনকায়ানীকেও হত্যা করেছে। এভাবেই তাদের লোমহর্ষক জুলুম - নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চলছিল। 




 


 

নজদী-তাইমী তাকফিরী মানহাজের উপর বোকো-হা-রামের চিন্তা-চেতনা প্রতিষ্ঠিত হওয়াই শুরু থেকেই তারা বেশ উগ্র ছিলো। আবু বকর শিকাবীর নেতৃত্বে আস্তে আস্তে এদের উগ্রতা ও হিংস্রতা বাড়তেই থাকে। মজার ব্যাপার হলো, এদের এই তাকফিরী চিন্তা-চেতনার কারণে শুরু থেকেই নাইজেরিয়ান উলামায়ে কেরাম তাদেরকে খারেজী বলে আসছিল। কিন্তু তারা এসব আলিমদেরকে উলামায়ে সু, সূফী বা বিদয়াতী আখ্যা দিয়ে তাদের কথায় কর্ণপাত করত না। তারা যে অন্যায়ভাবে মুসলমানদেরকে মুরতাদ আখ্যা দিয়ে খারেজীদের পথ অবলম্বন করেছে, এ বিষয়টি শুরু থেকেই অস্বীকার করে আসছে। আশ্চর্য্যের বিষয় হলো, এসব খারেজী ফেরকার কেউ-ই নিজেদের অন্যায় তাকফির ও খারেজিয়াতের বিষয়টি স্বীকার করে না। বার বার কসম খেয়ে দাবী করে যে, আমরা কখনও খারেজী নই। অন্যায়ভাবে আমরা কাউকে তাকফির করি না। আমরা কেবল তাদেরকেই কাফের বলি, যাদের মুরতাদ হওয়াটা অকাট্য ও প্রমাণিত। যারা বলে, আমরা অন্যায়ভাবে মানুষকে মুরতাদ ও কাফের বলি, তারা আমাদের নামে মিথ্যা বলে। এরা উলামায়ে সু ও দরবারী আলিম ইত্যাদি। 


 

আমরা প্রাচীন খারেজীদের প্রায় ২০ টি ফেরকা নিয়ে আলোচনা করেছি ভিডিওতে। সেখানে স্পষ্ট হয়েছে যে, উগ্রতা ও সহিংসতার দিক থেকে সবগুলো খারেজী দল একই স্তরের ছিলো না। মূলনীতিতে খারেজী হওয়ার পরও এসব দলের মাঝে অনেক বড় বড় পার্থক্যও ছিলো। এমনকি একেকটা খারেজী দল অন্য দলকে খারেজী ও মুশরিক আখ্যা দিত। আশ্চর্য্যের বিষয় হলো, বর্তমানের চিত্রও ঐতিহাসিক বাস্তবতার অনুরুপ। জি-হা-দী গ্রুপের একদল আরেকদলকে তাকফিরী - খারেজী বলছে। অথচ সেই দল নিজেও তাকফিরী - খারেজী। 

 

নিচের বিষয়টি লক্ষ্য করুন,

 

১। তাকফিরী-খারেজী উসূল ও নীতিমালার কারণে আমরা নজদী-সালাফী তথা ইবনে আব্দিল ওয়াহহাব ও তার অনুসারীদেরকে খারেজী মনে করি। কিন্তু নজদী-ওহাবীরা কসম কেটে সব-সময় দাবী করে আমরা কখনও অন্যায়ভাবে কাউকে তাকফির করি না। যারা বলে, আমরা অন্যায়ভাবে তাকফির করি, তারা আমাদের নামে অপবাদ দেয়। এরা উল্টো তাদের তাকফিরী নীতিমালার সাথে একমত না হওয়ার কারণে আহলে সুন্নতকে মুরজিয়া বলে অভিযোগ করে। 

 

২। বর্তমানে ইবনে আব্দিল ওয়াহহাবের অনুসারী সালাফীদের একটি বড় অংশ বিভিন্ন সালাফী-জিহাদী গ্রুপ যেমন আ-ল -কা-য়দ-া তাদের অঙ্গ-সংগঠনগুলোকে খারেজী মনে করে। কিন্তু কা-য়-দা বরাবরই অস্বীকার করে যে, আমরা অন্যায়ভাবে কাউকে তাকফির করি না। যারা এটা বলে, তারা আমাদের নামে অপবাদ দেয়। কা-য়-দার মতে কিছু দরবারী ভ্রষ্ট মুরজিয়া আলিম তাদের নামে এগুলো অপবাদ দেয়। বাস্তবে আসলে তাদের নীতিমালায় কোন সমস্যা নেই। 

 

৩। আল-কা-য়দা ও তার অঙ্গ-সংগঠনগুলো আবার বর্তমানের দা-য়েশকে খারেজী বলে থাকে। কিন্তু দা-য়েশ কখনও স্বীকার করে না যে, তারা অন্যায়ভাবে তাকফির করে। তারা সব-সময় কসম দিয়ে দাবী করে যে, আমরা কখনও অন্যায়ভাবে কাউকে তাকফির করি না। যারা আমাদেরকে অন্যায়ভাবে তাকফিরের অভিযোগে খারেজী বলে, তারা মূলত: আমাদের নামে অপবাদ দেয়। দা-য়েশের অনেকে মুবাহালারও চ্যালেঞ্জ দিয়েছে। দা-য়েশের মতে আল-কা-য়দার মতো মুরজিয়া ও ভ্রষ্ট দলই কেবল তাদের নামে খারেজী হওয়ার মিথ্যা অভিযোগ করে। 

 

৪। দা-য়ে-শ আবার বো-কো হা-রা-মকে খারেজী বলে থাকে। কিন্তু বো-কো হা-রা-ম বরাবরই অন্যায়ভাবে তাকফির ও খারেজী হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে উল্টো দা-য়েশের উপর অভিযোগ করে যে, তারা ভ্রষ্ট ও মুরজিয়া। যেখানে পুরো বিশ্ব দা-য়ে-শের সহিংসতা ও হিংস্রতায় স্তব্ধ, সেখানে খোদ দা-য়েশই বো-কো হা-রাম তথা আবু বকর শিকাবী ও তার অনুসারীদের হিংস্রতায় স্তব্ধ। 

 

আহলে সুন্নতের মতে, ইবনে আব্দিল ওয়াহহাব ও তার অনুসারী সালাফীরা তাকফিরী-খারেজী। একইভাবে কা-য়-দা, দা-য়ে-শ, বো-কো হা-রাম প্রত্যেকটি দলই তাকফিরী-খারেজী। যদিও একে - অপরকে খারেজী বলার ক্ষেত্রে এসব দল নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে। আর বাইরের কেউ অভিযোগ করলে দু’চারটি কসম খেয়ে অস্বীকার করে যে আমরা তাকফির করি না। যারা আমাদেরকে তাকফিরী বলে, তারা মূলত: আমাদের নামে অপবাদ দেয়।   


 

এখানে এসব দলের চিন্তা-চেতনা বোঝার জন্য আবু বকর শিকাবীর একটি ভিডিও ক্লিপ শেয়া করছি। সেখানে সে শুরুর দিকে দাবী করে, তার মানহাজ মূলত: ইবনে তাইমিয়া ও ইবনে আব্দিল ওয়াহহাবের মানহাজ। সে পুরোপুরি আহলে সুন্নতের আকিদার উপর। ভিডিওর ৫ মিনিট থেকে সে বলে, আমাদের বিরুদ্ধে অনেক অপবাদ দেয়া হয়। আমাদের দাওয়াতের প্রতিপক্ষ অনেকেই আমাদেরকে নানা অপবাদে অভিযুক্ত করে। এমনকি অনেকে আমাদের নামে প্রচার করে, আমরা নাকি সব জনগণকে তাকফির করি। শুধু আমাদের অনুসারী ছাড়া আমরা নাকি সবাইকে কাফের বলি। এসব বলে তারা আমাদের থেকে মানুষকে বিমুখ করতে চায়। ইনশা আল্লাহ আল্লাহ তায়ালা আমাদের মাঝে কিয়ামতে ফয়সালা করবেন। 

 

এখানে শিকাবী খুব স্বাভাবিকভাবে তাকফিরের বিষয়টিকে অপবাদ বলে প্রতিপক্ষের প্রপাগান্ডা হিসেবে চালিয়ে দিলো। এখানে সে খুব শক্তভাবে দাবী করে যে, আমরা কোন মুসলিমকে কোন গোনাহের কারণে তাকফির করি না। যতক্ষণ না তারা এটাকে হালাল করে নেয়। শিকাবীর এসব কথা শুনলে মনে হবে এরা আসলেই তাকফির করে না, সব তাদের নামে অপবাদ ও প্রপাগান্ডা। কিন্তু বাস্তবতা আসলে ভিন্ন। 

 

পুরো ১৫ মিনিটের ভিডিও ক্লিপের লিংক:

https://www.facebook.com/100008333593217/videos/1994935620794205


 

এই ভিডিওর শেষের দিকে সে বলেছে, 

“আমরা জামায়াতু আহলিস সুন্নাহ লিদ-দাওয়াতি ওয়াল জি-হা-দ, মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকি। মানুষকে কুরআনের দিকে ডাকি। আমরা মানুষকে সহীহ হাদীসের দিকে ডাকি। সুতরাং যে কেউ গণতন্ত্রকে অনুসরণ করবে সে কাফের। এবং যে আল্লাহর আইন ছাড়া নিজেদের আইনে বিচার করবে সেও কাফের। যে পশ্চিমা শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়বে সেও কাফের। এটিই আমার আকিদা”

 

ভিডিও ক্লিপ এর লিংক:

https://www.facebook.com/100024171302922/videos/946819316133770

 

এই হলো এদের বাস্তবতা। বক্তব্যের শুরুর দিকে খুব শক্তভাবে দাবী করবে, প্রয়োজনে দু’চারটি কসম খাবে যে, আমরা অন্যায়ভাবে তাকফির করি না। অথচ একই ভিডিওর শেষে এগুলোর বিপরীতে আমভাবে তাকফির করেছে। এভাবে জি-হা-দের নামে হত্যা, লুন্ঠন, ধর্ষণ সবই চলছে। এমনকি তাদের প্রতিপক্ষ অন্যান্য জি-হা-দী দলকেও এরা জি-হা-দের নামে তাকফির করে। সুযোগ পেলেই একে অপরকে কাফের ও খারেজী আখ্যা দিয়ে বছরের পর বছর যুদ্ধ করতে থাকে। গণতন্ত্রের বিরোধিতা, দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে এসব আন্দোলন শুরু হলেও এগুলোর শেষ হয় গণহত্যা, লুন্ঠন ও ধর্ষণের মধ্য দিয়ে। কারণ, এদের চিন্তা-চেতনার মূল ভিত্তিই হলো নজদী-তাইমী তাকফিরী চিন্তা। যার প্রভাবে এরা সুযোগ পেলেই খারেজী হয়ে ওঠতে বাধ্য এদের খারেজী উসূলের কারণে।  পরের পর্বে আমরা ইনশা আল্লাহ জা-ও-য়াহেরী দা-য়ে-শের মধ্যকার বিরোধ নিয়ে আলাপ করব ইনশা আল্লাহ। এ পর্বে যদিও তাদের নিয়ে কথা বলার ইচ্ছা ছিলো, কিন্তু বো-কো হা-রামের বিষয়টি আলোচনায় আসায় আর হলো না। ইনশা আল্লাহ পরের পর্বে তাদের নিয়ে কথা হবে। 













 

------ ------

লেখকের আরো ব্লগ

আক্বিদা

ইলমের সফর অব্যাহত থাকুক

ইজহারুল ইসলাম মঙ্গল, 03 ডিসে., 2024

খতীব বাগদাদী রহ. তার ‘আল-জামে লি-আখলাকির রাবি ও আদাবিস সামে’ কিতাবে ইমাম আবু ইউসুফ রহ. থেকে একটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন।
الْعِلْمُ شَيْءٌ لا يُعْطِيكَ بَعْضَهُ حَتَّى تُعْطِيَهُ كُلَّكَ
অর্থ: ইলম এমন একটি জিনিস, সে তোমাকে তার কিছু অংশও দিবে না যতক্ষণ না তুমি নিজেকে পূর্ণভাবে তার কাছে সমর্পণ না করবে।

অন্যান্য সৃষ্টি থেকে মানুষের শ্রেষ্ঠত্যের একটি বিশেষ দিক হলো ইলম অর্জনের ক্ষমতা। এটি মানুষের জন্য আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।

ইলমের জন্য যে…

বাকি অংশ পড়তে সাবস্ক্রাইব করুন
আক্বিদা

ইবনে তাইমিয়া রহ. এর কারামত

ইজহারুল ইসলাম মঙ্গল, 03 ডিসে., 2024

ইবনে তাইমিয়া রহ. এর জীবনী আলোচনা করেছেন তার বিশিষ্ট ছাত্র ইবনুল কাইয়্যিম রহ। তার পৃথক জীবনী লিখেছেন ইবনে তাইমিয়া রহ. এর বিশিষ্ট দুই ছাত্র। একজন হলেন, হাফেজ আবু হাফস উমর ইবনে আলি আল-বাযযার (মৃত:৭৪৯ হি:) তিনি আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া লিখেছেন। ইবনে তাইমিয়া রহ. আরেক ছাত্র ইবনে আব্দুল হাদী রহ. (মৃত: ৭৪৪ হি:) আরেকটি জীবনী লিখেছেন। তার লিখিত জীবনীর নাম আল-উকুদুল দুররিয়া মিন মানাকিবি শাইখিল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া।

আমি এখানে ইবনে তাইমিয়া রহ. এর বিশিষ্ট ছাত্রদের বর্ণনায় তার কিছু উল্লেখযোগ্য কারামত উল্লেখ করছি।

কারামত-১:

লওহে মাহফুজ দেখে বিজয়ের সংবাদ:

গায়েবসম্পর্কেইবনেতাইমিয়ারহএরকারামত:

আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) “মাদারিজুস সালিকিন শরহু মানাযিলিস সাঈরিন” নামক কিতাবে আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) এর কারামতের কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) লিখেছেন-

أخبر الناس والأمراء سنة اثنتين وسبعمائة لما تحرك التتار وقصدوا الشام : أن الدائرة والهزيمة عليهم وأن الظفر والنصر للمسلمين وأقسم على ذلك أكثر من سبعين يمينا فيقال له : قل إن شاء الله فيقول : إن شاء الله تحقيقا لا تعليقا  وسمعته يقول ذلك قال : فلما أكثروا علي قلت : لا تكثروا كتب الله تعالى في اللوح المحفوظ : أنهم مهزومون في هذه الكرة وأن النصر لجيوش الإسلام

“তাতারীরা যখন মুসলিম উম্মাহের বিভিন্ন অঞ্চলে সেনা অভিযান পরিচালনা করে এবং শামে আক্রমণের উদ্যোাগ গ্রহণ করে তখন ৭০২ হিঃ সনে শায়েখ (রহঃ) সাধারণ মানুষ এবং আমীর-উমারাদেরকে সংবাদ দিলেন যে, “তাতারীরা পরাজিত হবে এবং মুসলমানরা বিজয় ও সাহায্য লাভ করবে।”। তিনি তাঁর কথার উপর সত্তরটিরও বেশি কসম খেয়েছেন। তাঁকে বলা হল, আপনি ইনশাআল্লাহ বলুন! অতঃপর তিনি বলেন, নিশ্চিতভাবে ইনশাআল্লাহ বলছি, সম্ভাবনা হিসেবে নয়। আমি তাঁকে বলতে শুনেছি, যখন তারা আমার উপর পীড়াপীড়ি করল, আমি তাদেরকে বললাম, তোমরা পীড়াপীড়ি কর না, আল্লাহ তায়ালা লউহে মাহফুজে লিখে রেখেছেন যে, তারা পরাজিত হবে এবং মুসলমানরা বিজয়ী হবে।

[মাদারিজুস সালিকিন, খ–২, পৃষ্ঠা-৪৮৯]

আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) আরও অনেক কারামতের কথা উল্লেখ করেছেন, ইবনে আব্দুল হাদী মুকাদ্দেসী (রহঃ) এবং আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ)। বিস্তারিত জানার জন্য আগ্রহী পাঠক, মাদারিজুস সালিকীন ও আ’লামুল আলিয়্যা গ্রন্থদ্বয় দেখতে পারেন।

¬

কারামত-২: ইবনে তাইমিয়া রহ. এর ভবিষ্যৎবাণী:

আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) এর বিশেষ ছাত্র আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) লিখেছেন-

وأخبرني غير مرة بأمور باطنة تختص بي مما عزمت عليه ولم ينطق به لساني وأخبرني ببعض حوادث كبار تجري في المستقبل ولم يعين أوقاتها وقد رأيت بعضها وأنا أنتظر بقيتها وما شاهده كبار أصحابه من ذلك أضعاف أضعاف ما شاهدته والله أعلم

“তিনি আমাকে অনেকবার অনেক বাতেনি বিষয়ের সংবাদ দিয়েছেন। তিনি শুধু আমাকে এগুলো বলেছেন এবং এ বিষয় সম্পর্কে আমি কাউকে কিছু বলি নি। তিনি আমাকে ভবিষ্যতের অনেক ঘটনার সংবাদ দিয়েছেন কিন্তু তিনি সময় নির্দিষ্ট করে দেননি। তাঁর ভবিষ্যৎ বাণীর কিছু কিছু আমি ঘটতে দেখেছি এবং অবশিষ্টগুলো সংঘটিত হওয়ার অপেক্ষায় আছি। তাঁর বড় বড় সাগরেদগণ আমি যা দেখেছি, তার চেয়ে বহু বহু গুণ বেশি দেখেছেন”

[মাদারিজুস সালিকিন, খ–২, পৃষ্ঠা-৪৯০]

কারামত-৩: অন্তরের বিষয় সম্পর্কে অবগত হওয়া:

ইবনে তাইমিয়া রহ. এর ছাত্র আবু হাফস উমর আল-বাযযার বলেন,

أنه جرى بيني وبين بعض الفضلاء منازعة في عدة مسائل وطال كلامنا فيها وجعلنا نقطع الكلام في كل مسألة بأن نرجع إلى الشيخ وما يرجحه من القول فيها

ثم أن الشيخ رضي الله عنه حضر فلما هممنا بسؤاله عن ذلك سبقنا هو وشرع يذكر لنا مسألة مسألة كما كنا فيه وجعل يذكر غالب ما أوردناه في كل مسأله ويذكر أقوال العلماء ثم يرجح منها ما يرجحه الدليل حتى أتى على آخر ما أردنا أن نسأله عنه وبين لنا ما قصدنا أن نستعلمه منه فبقيت أنا وصاحبي ومن حضرنا أولا مبهوتين متعجبين مما كاشفنا به وأظهره الله عليه مما كان في خواطرنا.”

অর্থাৎ আমার সাথে একজন সম্মানিত আলেমের কয়েকটি মাসআলা নিয়ে বিতর্ক হলো। এ বিষয়ে আমাদের আলোচনা অনেক দীঘর্ হলো। প্রত্যেক মাসআলায় আমরা এভাবে কথা শেষ করলাম যে, মাসআলার সমাধান ইবনে তাইমিয়া রহ. এর কাছ থেকে জেনে নিবো।

এরপর শায়খ রহ. আমাদের নিকট উপস্থিত হলেন। আমরা যখন মাসআলাগুলো সম্পর্কে শায়খকে জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছা করলাম তিনি আমাদের জিজ্ঞাসার পূর্বেই আলোচনা শুরু করলেন। তিনি আমাদের আলোচনা অনুযায়ী একের পর এক মাসআলার সমাধান বলতেছিলেন। প্রত্যেক মাসআলায় আমাদের কাঙ্খিত উত্তর প্রদান করছিলেন। এভাবে তিনি প্রত্যেকটি মাসআলায় উলামায়ে কেরামের বক্তব্য এবং দলিল অনুযায়ী প্রাধান্য পাওয়া মাসআলাটি উল্লেখ করছিলেন। অবশেষে তিনি আমাদের আলোচিত সর্বশেষ মাসআলাটির সমাধান প্রদান করলেন। আমাদের অন্তরের বিষয়গুলো আল্লাহ তায়ালা এভাবে সুস্পষ্ট করে প্রকাশ করায় উপস্থিত লোকজন, আমার সঙ্গী ও আমি আশ্চর্যন্বিত ও বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৩, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

নিচের স্ক্রিনশট দেখুন,

এছাড়া আবু হাফস আল-বাযযার অন্তরের বিষয়ে ইবনে তাইমিয়া রহ. এর অবগত হওয়া সম্পর্কে আরও বলেন,

و كنت في خلال الأيام التي صحبته فيها إذا بحث مسألة يحضر لي إيراد فما يستتم خاطري به حتي يشرع فيرده و يذكر الجواب من عدة وجوه

অর্থাৎ আমি যখন যেসময়ে তার সংস্পর্শে ছিলাম, তখন আমার মনে কোন বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ার সঙ্গে তিনি এর জওয়াব দিতে শুরু করতেন এবং কয়েকভাবে এর উত্তর প্রদান করতেন।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৩, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কারামত-৪: অন্যের সাহায্য

“وحدثني الشيخ الصالح المقريء أحمد بن الحريمي أنه سافر إلى دمشق قال فاتفق أنى لما قدمتها لم يكن معي شئ من النفقة البتة وأنا لا اعرف أحدا من أهلها فجعلت أمشي في زقاق منها كالحائر فإذا بشيخ قد أقبل نحوي مسرعا فسلم وهش في وجهي ووضع في يدي صرة فيها دراهم صالحة وقال لي انفق هذه الآن وخلي خاطرك مما أنت فيه فإن الله لا يضيعك ثم رد على أثره كأنه ما جاء إلا من أجلي فدعوت له وفرحت بذلك، وقلت لبعض من رأيته من الناس من هذا الشيخ؟ فقال وكأنك لا تعرفه هذا ابن تيمية

আমার নিকট শায়খ সালেহ আল –মুকরী বর্ণনা করেন, তিনি  দামেশকের উদ্দেশে সফর করেন। তিনি বলেন, ঘটনাক্রমে ঐ সফরে আমার সঙ্গে কোন চলার মতো কোন খাবার বা অর্থ ছিলো না। আমি ওখানকার কাউকে চিনতাম না। এ অবস্থায় আমি উদভ্রান্তের মতো  দামেশকের অলি-গলিতে ঘুরছিলাম। হঠাৎ একজন শায়খ আমার দিকে দ্রুত গতিতে হেঁটে এলেন। তিনি হাস্যোজ্জল মুখে সালাম দিলেন। তিনি আমার হাতে একটা থলি দিলেন যাতে কিছু খাটি দিরহাম ছিলো। এরপর বললেন, “ এগুলো ব্যবহার করো। তোমার অন্তরে যেই পেরেশানী আছে এগুলো ঝেড়ে ফেলো।  আল্লাহ তায়ালা তোমাকে ধ্বংস করবেন না।” একথা বলে তিনি একই পথে ফিরে গেলেন। তিনি যেন শুধু আমার কাছেই এসেছিলেন। আমি তার জন্য দুয়া করলাম এবং এতে আনন্দি হলাম। আমি অন্যান্য মানুষকে জিজ্ঞেস করলাম, এই শায়খ কে? তারা বললো, তুমি মনে হয় শায়খকে চেনো না, তিনি হলেন ইবনে তাইমিয়া।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৪, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কারামত-৫:

وحدثني الشيخ العالم المقريء تقي الدين عبد الله ابن الشيخ الصالح المقريء احمد بن سعيد قال سافرت إلى مصر حين كان الشيخ مقيما بها فاتفق أني قدمتها ليلا وأنا مثقل مريض فأنزلت في بعض الأمكنة فلم ألبث أن سمعت من ينادي باسمي وكنيتي فأجبته وأنا ضعيف فدخل إلي جماعة من أصحاب الشيخ ممن كنت قد اجتمعت ببعضهم في دمشق فقلت كيف عرفتم بقدومي وأنا قدمت هذه الساعة فذكروا أن الشيخ أخبرنا بأنك قدمت وأنت مريض وأمرنا أن نسرع بنقلك وما رأينا أحدا جاء ولا أخبرنا بشيء، فعلمت أن ذلك من كرامات الشيخ رضي الله عنه.”

শায়খ সালেহ আল-মুকরী এর ছেলে শায়খ তাকিউদ্দীন আব্দুল্লাহ আল-মুকরী আমাকে বলেছেন, শায়খ ইবনে তাইমিয়া রহ. যখন মিশরে ছিলেন তখন আমি মিশরে সফর করি। আমি রাতে মিশরে গিয়ে উপস্থিত হলাম। তখন আমার কাছে ভারী বোঝা ছিল আর আমি অসুস্থ ছিলাম। আমি এক জায়গায় গিয়ে বাহন থেকে নামলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে শুনতে পেলাম এক ব্যক্তি আমার নাম ও উপনাম ধরে ডাকছে। আমি দুর্বল শরীরে তার ডাকে সাড়া দিলাম। তখন শায়খ ইবনে তাইমিয়ার একদল ছাত্র আমার নিকট এলো। তাদের সাথে আমি পূর্বে দামেশকে সাক্ষাৎ করেছিলাম। আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা আমার আগমন সম্পর্কে কীভাবে জানলে; অথচ আমি মাত্র এলাম? তারা বলল, শায়খ ইবনে তাইমিয়া তাদেরকে বলেছে যে, আপনি এসেছেন এবং আপনার শরীর অসুস্থ। আমাদেরকে দ্রুত আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন। আমরা কাউকে আসতেও দেখিনি এবং আপনার সম্পর্কে কেউ পূর্বে সংবাদও দেয়নি। আমি তখন বুঝলাম এটি শায়খের কারামত।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৪, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কারামত-৬:                                  

“وحدثني أيضا قال مرضت بدمشق إذ كنت فيها مرضة شديدة منعتني حتى من الجلوس فلم اشعر إلا والشيخ عند رأسي وأنا مثقل مشتد بالحمى والمرض فدعا لي وقال جاءت العافية، فما هو إلا أن فارقني وجاءت العافية وشفيت من وقتي”

শায়খ সালেহ আল-মুকরী এর ছেলে শায়খ তাকিউদ্দীন আব্দুল্লাহ আল-মুকরী আরও বলেন, আমি দামেশকে কঠিন রোগে আক্রান্ত হলাম। এমনকি আমি বসতেও পারতাম না। হঠাৎ আমার মাথার নিকট শায়খকে দেখতে পেলাম।তখন আমি মারাত্মক জ্বর ও রোগে আক্রান্ত ছিলাম।তিনি আমার জন্য দুয়া করলেন এবং বললেন, সুস্থতা চলে এসেছে।তিনি আমার কাছ থেকে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি সুস্থ হয়ে গেলাম।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৫, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কারামত-৭:

“وحدثني أيضا قال أخبرني الشيخ ابن عماد الدين المقرئ المطرز قال قدمت على الشيخ ومعي حينئذ نفقة فسلمت عليه فرد علي ورحب بي وأدناني ولم يسألني هل معك نفقة أم لا، فلما كان بعد أيام ونفدت نفقتي أردت أن اخرج من مجلسه بعد أن صليت مع الناس وراءه فمنعني وأجلسني دونهم فلما خلا المجلس دفع إلي جملة دراهم وقال أنت الآن بغير نفقة فارتفق بهذه فعجبت من ذلك وعلمت أن الله كشفه على حالي أولا لما كان معي نفقة وآخرا لما نفدت واحتجت إلى نفقة.”

আমার নিকট তিনি আরও বর্ণনা করেছেন, আমার নিকট শায়খ ইবনে ইমাদুদ্দিন আল-মুকরী আল-মুতাররায বর্ণনা করেন, তিনি বলেন আমি একবার শায়খের নিকট আগমন করলাম। তখন আমার কাছে খরচের টাকা-পয়সা ছিলো। আমি তাকে সালাম দিলাম, তিনি উত্তর দিলেন এবং আমাকে স্বাগত জানালেন। আমাকে তিনি তার নিকটে বসালেন। এবার তিনি আমার জীবিকা নির্বাহের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন না। কিছুদিন পর আমার খরচের উপকরণ শেষ হয়ে গেল। তখন আমি তার পিছে নামায আদায় করে তার মজলিশ থেকে বের হতে উদ্যত হলাম। তিনি আমাকে বাধা দিয়ে বসতে বললেন। এরপর যখন মজলিশ শেষ হলো, তখন তিনি আমাকে কিছু দিরহাম দিয়ে বললেন, এখন তোমার কোন খরচের টাকা-পয়সা নেই। এগুলো ব্যবহার করতে থাকে। এ ঘটনায় আমি বিস্মিত হলাম। বুঝলাম যে আল্লাহ তায়ালা আমার পূর্বের ও বর্তমান অবস্থা শায়খের নিকট প্রকাশ করে দিয়েছেন।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৬, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কারামত-৮: মৃত সম্পর্কে সংবাদ:

“وحدثني من لا أتهمه أن الشيخ رضي الله عنه حين نزل المغل بالشام لأخذ دمشق وغيرها رجف أهلها وخافوا خوفا شديدا، وجاء إليه جماعة منهم وسألوه الدعاء للمسلمين فتوجه إلى الله ثم قال أبشروا فإن الله يأتيكم بالنصر في اليوم الفلاني بعد ثالثة حتى ترون الرؤوس معبأة بعضها فوق بعض.قال الذي حدثني فوالذي نفسي بيده أو كما حلف ما مضى إلا ثلاث مثل قوله حتى رأينا رؤوسهم كما قال الشيخ على ظاهر دمشق معبأة بعضها فوق بعض.”

আমার নিকট বিশ্বস্ত এক ব্যক্তি বর্ণনা করেছেন, যখন মোগলরা দামেশক ও অন্যান্য অন্চল দখলের জন্য শামে আক্রমণ করলো, দামেশকের অধিবাসীরা খুবই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। এসময় একদল মুসলমান শায়খ ইবনে তাইমিয়া রহ. এর নিকট আগমন করলেন এবং তাকে মুসলমানদের জন্য দুয়া করার অনুরোধ করলেন। তিনি আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করলেন। এরপর বললেন, তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ করো, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা  তিন দিন পর তোমাদেরকে সাহায্য করবেন, এমনকি তোমরা দেখবে যে একটার উপর আরেকটা মাথা স্তুপ হয়ে থাকবে। ঘটনার বর্ণনাকারী বলেন, আল্লাহর শপথ, তৃতীয় দিন দামেশকের প্রবেশ মুখে শত্রুদের মাথাগুলো একটার উপর আরেকটা স্তুপ হয়েছিলো যেমন শায়খ বলেছিলেন।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৬, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কারামত-৯:

“وحدثني الشيخ الصالح الورع عثمان بن احمد بن عيسى النساج أن الشيخ رضي الله عنه كان يعود المرضى بالبيمارستان بدمشق في كل أسبوع فجاء على عادته فعادهم فوصل إلى شاب منهم فدعا له فشفي سريعا وجاء إلى الشيخ يقصد السلام عليه فلما رآه هش له وأدناه ثم دفع إليه نفقة وقال قد شفاك الله فعاهد الله أن تعجل الرجوع إلى بلدك أيجوز أن تترك زوجتك وبناتك أربعا ضيعة وتقيم هاهنا؟ فقبل يده وقال يا سيدي أنا تائب إلى الله على يدك وقال الفتى وعجبت مما كاشفني به وكنت قد تركتهم بلا نفقة ولم يكن قد عرف بحالي أحد من أهل دمشق.”

শায়খ উসমান ইবনে আহমাদ ইবনে ইসা আন-নাসসাজ আমার নিকট বর্ণনা করেছেন, শায়খ ইবনে তাইমিয়া রহ. দামেশকের বিমারিস্তান নামক জায়গায় প্রত্যেক সপ্তাহে রোগীদের দেখতে আসতেন। অভ্যাস অনুযায়ী তিনি রোগী দেখতে এলেন। তাদের মধ্যে এক যুবককে তিনি দেখলেন এবং তার জন্য দুয়া করলেন। সে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠল। যুবকটি শায়খকে সালাম দেয়ার জন্য এলো। তাকে দেখে শায়খ হাসিমুখে নিকটে বসালেন। তার কাছে কিছু খরচের টাকা-পয়সা দিলেন এবং বলেন, আল্লাহ তায়ালা তোমাকে সুস্থ করেছেন। সুতরাং তুমি আল্লাহর কাছে ওয়াদা করো যে তুমি দ্রুত পরিবারের কাছে ফিরে যাবে। তোমার জন্য কখনও বৈধ হবে যে তোমার স্ত্রী ও চার কন্যাকে ধ্বংসের মুখে রেখে এখানে অবস্থান করবে? যুবকটি বলল, আমি তার হাতে চুমু দিলাম এবং বললাম, শায়খ, আমি আল্লাহর নিকট আপনার হাতে তওবা করছি।

আমি তার কাশফ দেখে বিস্মিত হলাম। বাস্তবেই আমি আমার পরিবারকে সহায়-সম্বলহীন রেখে এসেছিলাম।দামেশকের কেউ আামার পরিবার সম্পর্কে অবগত ছিলো না।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৬, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

এই কারামতগুলো লিখে আবু হাফস আল-বাযযার রহ. লিখেছেন,

و كرامات الشيخ رضي الله عنه  كثيرة جدا لا يليق بهذا المختصر أكثر من ذكر هذا القدر منها . ومن أظهر كراماته أنه ما سمع بأحد عاداه أو غض عنه إلا و أبتلي بعدة بلايا غالبها في دينه وهذا ظاهر مشهور لا يحتاج فيه إلي شرح صفته

শায়খ রহ. অনেক কারামত রয়েছে। এই সংক্ষিপ্ত বইয়ে সেগুলো উল্লেখ করা সঙ্গত নয়। তার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ করামত হলো যে কেউ শায়খের বিরোধীতা করেছে বা তার সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক রয়েছে, সে বিভিন্ন ধরনের বালা-মুসীবতে নিপতিত হয়েছে। বেশিরভাগ মুসীবত দীন সম্পর্কীয়। বিষয়গুলো স্পষ্ট ও প্রকাশিত। এগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা অনাবশ্যক।

[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৮, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]

কাশফ ও ইলহাম সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া রহ. এর অনেক কারামত রয়েছে। এ বিষয়ে তার অনেক বক্তব্যও আছে। এগুলোর কিছু কিছু ইবনে তাইমিয়া রহ. এর দৃষ্টিতে তাসাউফ বইয়ে উল্লেখ করেছি। দু:খজনক বিষয় হলো, আমাদের আজকের আলোচনার মূল বিষয় এখনও শুরু করা হয়নি। আজ এখানেই ইতি টানছি। পরবর্তী আলোচনায় গায়েব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করা হবে। 

------ ------

আক্বিদা

আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাকার ইবনে আবিল ইয রহ: হানাফী না কি হাশাবী?

ইজহারুল ইসলাম মঙ্গল, 03 ডিসে., 2024

[বর্তমানে  ইবনে আবিল ইযের  আকিদাতুত ত্বহাবীর  ব্যাখ্যাগ্রন্থটি ব্যাপকভাবে প্রচারের চেষ্টা করা হচ্ছে। যেমন, সালাফী আলেম আব্দুল্লাহ শাহেদ মাদানী এর বাংলা অনুবাদ করে অনলাইনে প্রচার করছেন। সুতরাং এই কিতাবের বাস্তবতা ও এর লেখক সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাগুলো সুস্পষ্ট করা আবশ্যক। আকিদাতুত ত্বহাবীর উপর দরসের নিয়ত ব্যক্ত করেছিলাম কিছু দিন আগে। উক্ত দরসের প্রয়োজনে আজকের আলোচনাটি লেখা। যারা উক্ত দরস দেখবেন, আশা করি বিষয়টি তাদের উপকারে আসবে।  ]

সৌদি আরবের কল্যাণে কাররামিয়াদের ভ্রান্ত দেহবাদী আকিদাগুলো সালাফী মতবাদের মোড়কে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। পেট্র-ডলারের সহায়তায় তারা এক্ষেত্রে অনেকটা অগ্রসর। সালাফীদের ভ্রান্ত আকিদা সম্পর্কে বেশ কিছু প্রবন্ধ লেখার সুযোগ হয়েছে আল-হামদুলিল্লাহ। আমাদের আইডিয়ার ওয়েবসাইটে লেখাগুলো পাবেন। সালাফী মতবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে থাকে। এর মধ্যে একটি বিশেষ কৌশল হল, বিভিন্ন ইমামের আকিদার কিতাব ব্যাখ্যার নামে নিজেদের ভ্রান্ত আকিদা ছড়িয়ে দেয়া। উদাহরণ হিসেবে ইমাম ত্বহাবীর আকিদাতুত ত্বহাবীর কথা বলা যায়। একটু খোজ নিলে দেখবেন, প্রায় প্রত্যেক সালাফী শায়খই আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখেছেন, কেউ অডিও বা ভিডিও লেকচার দিয়েছেন। অন্তত বিশ-পজিশজন বা এর চেয়ে বেশি সালাফী শায়খের ব্যাখ্যা পাবেন। একটি মৌলিক প্রশ্ন হল,  এসব সালাফী আলেমরা কি ইমাম ত্বহাবীর আকিদা পোষণ করেন? ধ্রুব সত্য হল, ইমাম ত্বহাবীর আকিদার সাথে এদের আকিদার দূরতম কোন সম্পর্ক নেই। ইমাম ত্বহাবী রহ. এর আকিদার ও এদের আকিদার মাঝে আসমান-জমিনের ফারাক। আরেকটি প্রশ্ন মনে উকি দেয়, এরা যেহেতু ইমাম ত্বাহাবীর আকিদা পোষণ করে না, তাহলে এর ব্যাখ্যা করে কেন? সহজ উত্তর হল, ইমাম ত্বহাবীর আকিদা প্রচারের ছদ্মাবরণে নিজেদের ভ্রান্ত আকিদা প্রচার। এদের যে কোন একটা ব্যাখ্য পড়লেই এই বাস্তবতা উপলব্ধি করবেন। 

সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে ইমাম ত্বহাবী রহ. এর আকিদাকে বিকৃত করার লক্ষ্যে লিখিত একটি বেনামী ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৩৪৯ হিজরীতে।  বে-নামী ব্যাখ্যা এজন্য বললাম, উক্ত ব্যাখ্যার উপর লেখকের নাম ছিল না। আর প্রশাকগণ নিশ্চিত ছিলেন না যে, ব্যাখ্যাগ্রন্থটি মূলত: কার। পরবর্তীতে তারা তত্ব-তালাশ করে উদ্ধার করেন, এটি ইবনে আবিল ইয আল-হানাফীর লেখা। বর্তমানে এটি ইবনে আবিল ইযের ব্যাখ্যা হিসেবে প্রচার করা হয়। আমাদের আলোচ্য বিষয় শিরোনাম থেকে কিছুটা স্পষ্ট। তবে দু’টি বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করার চেষ্টা করব। ১. ইবনে আবিল ইযের নামে প্রচারিত আকিদা কি আসলেই ইবনে আবিল ইযের লেখা?২. ইবনে আবিল ইযকে হানাফী হিসেবে প্রচার করা হয়। তিনি কি হানাফী ছিলেন না কি দেহবাদী আকিদায় বিশ্বাসী হাশাবী ছিলেন?

প্রচলিত আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যা কি ইবনে আবিল ইযের?

বিষয়টি বোঝার জন্য ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রকাশের ইতিহাসের দিকে ফিরে যেতে হবে। আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যাগ্রন্থটি ১৩৪৯ হিজরীতে মক্কায় সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়।

এই প্রকাশনায় কিতাবের উপর লেখকের কোন নাম ছিল না। বরং প্রকাশকরা লেখেন,

 راجعنا ما في أيدينا من كتب التراجم والفنون، فلم نجد ما يمكننا معه الجزم بنسبته لشخص بعينه، وإنا نثبت هنا أسماء شارحي هذه العقيدة الذين عدهم صاحب كشف الظنون وهم سبعة ……. ومنهم صدر الدين علي بن محمد بن أبي العز الأذرعي الدمشقي الحنفي المتوفى سنة 746هـ وهو الذي يترجح الظن أنه الشارح” আমাদের কাছে বিদ্যমান বিভিন্ন জীবনীগ্রন্থ ও রিজালের কিতাবে আমরা অনুসন্ধান চালিয়েছি। আমরা এমন কোন তথ্য পাইনি, যার আলোকে সুনিশ্চিতভাবে ব্যাখ্যাগ্রন্থটিকে সুনির্দিষ্ট কোন লেখকের দিকে সম্পৃক্ত করা সম্ভব। কাশফুজ জুনুন এর লেখকের বক্তব্য অনুযায়ী আমরা এখানে আকিদাত্ব ত্বহাবীর সমস্ত ব্যাখ্যাকারের নাম উল্লেখ করছি। তারা হলেন সাতজন…….। এদের মাঝে একজন ব্যাখ্যাকার হলেন, সদরুদ্দিন আলী ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবিল ইয হানাফী (মৃত:৭৪৬ হি:)। আমাদের বিশেষ ধারণা হল, সাতজন ব্যাখ্যাকারের মাঝে তিনি হলেন আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাকার। “

এখানে প্রবল ধারণা হিসেবে সদরুদ্দিন আলী ইবনে মুহাম্মাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যার মৃত্যু তারিখ হল, ৭৪৬ হিজরী। আর বর্তমানে প্রচারিত ব্যাখ্যাকার হলেন, আলী ইবনে আলী ইবনে আবিল ইয। যার মৃত্যু তারিখ হল, ৭৯২ হিজরী। এখানে প্রবল ধারণা হিসেবে যার কথা বলা হয়েছে, তিনি হলেন বর্তমানে প্রচারিত লেখকের পিতা। ছেলে আর পিতা কখনও এক হতে পারে না। উভয়ের মৃত্যু তারিখ থেকেও বিষয়টি স্পষ্ট। মোটকথা, ব্যাখ্যাগ্রন্থটি কার সেটা সুনিশ্চিতভাবে বলার মত কোন তথ্য তখনকার উলামায়ে কেরাম পাননি। পরবর্তীতে সৌদি আরবের শায়খগণ বিখ্যাত আলেম আহমাদ শাকেরকে এটি তাহকীক করার অনুরোধ করেন। শায়খ আহমাদ শাকের পরবর্তীতে এটি তাহকীক করে প্রকাশ করেন।

তিনি এর ভূমিকায় লেখেন, ” এ কিতাবের যে মাখতুতা বা হস্তলিপি আমি পেয়েছি, সেখানে মূল লেখকের নেই। সুতরাং কিতাবের লেখক আসলে কে সেটা জানা সম্ভব হয়নি। ” 

শায়খ আহমাদ শাকের তার ভূমিকায় কয়েকবার বলেছেন যে, তিনি এই কিতাবের নির্ভরযোগ্য কোন মাখতুতা বা হস্তলিপি পাননি।

তিনি তার সাধ্য অনুযায়ী এটি তাহকীক করার চেষ্টা করেছেন। শায়খ আহমাদ শাকের আশা ব্যক্ত করেছেন, তিনি যদি নির্ভরযোগ্য কোন হস্তলিপি পান, তাহলে পরবর্তীতে এটি সংশোধনের চেষ্টা করবেন।

শায়খ আহমাদ শাকের বলেন,

 ولكني لا أزال أرى هذه الطبعة مؤقتة أيضا، حتى يوفقنا الله إلى أصل محفوظ للشرح صحيح، يكون عمدة في التصحيح فنعيد طبعه

“আমি এখনও মনে করি, এই সংস্করণ অস্থায়ী। আল্লাহ তায়ালা যদি নির্ভরযোগ্য বিশুদ্ধ কোন হস্তলিপি মিলিয়ে দেন, তাহলে এটি সংশোধন করে নতুনভাবে প্রকাশ করার করব। শায়খ আহমাদ শাকের আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. [মৃত: ১২০৫ হি:] এর একটি বক্তব্য পান ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিনে। সেখানে মোর্তজা যাবিদি রহ. ব্যাখ্যাকারের নাম লিখেছেন, আলী ইবনে আলী ইবনে মুহাম্মাদ আল-গাজ্জী আল-হানাফী। মোর্তজা যাবিদি রহ. এর উদ্ধৃতিতে লেখকের সঠিক পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি।

শায়খ আহমাদ শাকের বলেন, মোর্তজা যাবিদি রহ. লেখকের নামের নিসবতে ভুল করেছেন। তিনি লিখেছেন, আলী ইবনে আলী আল-গাজ্জী, বাস্তবে হওয়ার কথা ছিল, আলী ইবনে আলী ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী। মোটকথা, শায়খ আহমাদ শাকেরের সামনে মোর্তজা যাবিদি রহ. এর উদ্ধৃতি ছিল, বেশ কয়েকটি মাখতুতা ছিল এরপরেও ব্যাখ্যাকার সম্পর্কে সুনিশ্চিতভাবে বলেননিন যে, অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে, উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের লেখক ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী। শায়খ আহমাদ শাকের মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্যের আলোকে তার ধারণা অনুযায়ী কিতাবে লেখকের নাম লিখেছেন, আলী ইবনে আলী ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী। পরবর্তীতে মাকতাবাতুল ইসলামী থেকে শায়খ আলবানীর তাহকীকে ব্যাখ্যাগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। সেখানে কিছু মাখতুতা বা হস্তলিপি এর চিত্র দেয়া হয়েছে। এসকল হস্তলিপিতে স্পষ্টভাবে লেখকের নাম লেখা হয়েছে, আলী ইবনে মুহাম্মাদ। যার মৃত্যু তারিখ, ৭৪৬ হি:। সুতরাং মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্য অনুযায়ী, লেখকের নাম হওয়ার কথা ছিল, আলী ইবনে আলী আল-গাজ্জী। মাকতাবাতুল ইসলামী এর মাখতুতা অনুযায়ী, লেখকের নাম আলী ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবিল ইয। সুতরাং একথা সুনিশ্চিতভাবে বলার অবকাশ নেই যে, উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের প্রকৃত লেখক কে। এরপরেও শায়খ আলবানী ও যুহাইর আশ-শাবীশ দাবী করেন, সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হল, উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের লেখক ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী।

শায়খ যুহাইর আশ-শাবীস নবম সংস্করণের ভূমিকায় ( পৃ.৯) লিখেছেন, 

وأما نسختنا فقد كان اسم مؤلفها مثبتا على الورقة الأولى منها، إلا أن بعض الأيدي قد لعبت فيه بالمحو والكتابة أكثر من مرة، وأخيرا أثبت عليه ما أثبته الشيخ أحمد شاكرঅর্থ: আমাদের মূল হস্তলিপিতে লেখকের নাম প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা ছিল। তবে অজ্ঞাত কেউ উক্ত নাম কয়েকবার ঘষা-মাজা করে নতুনভাবে লিখেছে। অবশেষে আমি শায়খ আহমাদ শাকেরের তথ্য অনুযায়ী লেখকের নাম উল্লেখ করেছি।মোটকথা, এই ব্যাখ্যাগ্রন্থের মূল হস্তলিপিতে লেখকের নাম উল্লেখ নেই। পরবর্তীতে বিভিন্ন ঘষা-মাজার মাধ্যমে অজ্ঞাত কেউ হস্তলিপিতে লেখকের নাম সংযুক্ত করেছে। ঘষা-মাজা করে নাম সংযুক্ত করার পরও বর্তমানে প্রচলিত লেখকের নাম উক্ত হস্তলিপিতে নেই। বরং প্রচলিত লেখকের পিতার নাম ও তার মৃত্যু তারিখ দেয়া রয়েছে।

 চূড়ান্ত কথা:

ইবনে আবিল ইয এধরণের ব্যাখ্যাগ্রন্থ লেখাটা অসম্ভব নয়। প্রবল ধারণা মতে হয়ত তিনি এটি লিখেছেন। কিন্তু ইবনে ইয এর লেখক হওয়ার ব্যাপারে অকাট্য কোন প্রমাণ কারও কাছে নেই, যার আলোকে নি:সন্দেহে বলা যাবে, এটি ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী লিখেছেন। ইবনে আবিল ইয আল-হানাফীর জীবনী থেকে একটা ধারণা সৃষ্টি হয়, হয়ত তিনি এটি লিখেছেন। আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. এর উদ্ধৃতি থেকে হয়ত ধারণাটি আরেকটু মজবুত হয়। কিন্তু এটা সুনিশ্চিত বা অকাট্য কোন প্রমাণ বলার সুযোগ নেই। উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের লেখক ইবনে আবিল ইয হলেও আমাদের কোন আপত্তি নেই। না হলেও এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই। কিতাবটি ছেলে লিখেছে না কি তার পিতা লিখেছে সেটাও মৌলিক কোন বিষয় নয়।

 আমাদের নিকট মূল বিবেচ্য বিষয় হল, ইবনে আবিল ইযকে হানাফী হিসেবে প্রচার করা হয়। সেই সাথে এটাও বোঝানো হয় যে, তিনি হানাফীদের আকিদার প্রতিনিধত্ব করেন। অন্যান্য হানাফীগণ তার বিরোধীতা করে মূলত: হানাফীদের মৌলিক আকিদার বিরোধিতা করে থাকে।

আমাদের সামনে মৌলিক কয়েকটি প্রশ্ন দেখা দিয়েছে,

১. ইবনে আবিল ইয বাস্তবেই কি হানাফী ছিলেন?

২. তিনি আদৌ কি হানাফী মাজহাবের সুপ্রতিষ্ঠিত আকিদার অনুসারী ছিলেন?৩. তার লেখা ব্যাখ্যাগ্রন্থ ইমাম ত্বহাবী বা হানাফী মাজহাবের মৌলিক আকিদার প্রতিনিধিত্ব করে কি?৪. ইবনে আবিল ইযের আকিদা হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমদের নিকট নির্ভরযোগ্য কি?

৫. ইবনে আবিল ইযকে হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণ নির্ভরযোগ্য আলেম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন কি?

৬. হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণ ইবনে আবিল ইযের আকিদার সাথে সহমত পোষণ করেন না কি তার প্রবল বিরোধীতা করেন?

৭. হানাফী মাজহাবের উলামায়ে কেরামের জীবনীর উপর বিভিন্ন গ্রন্থ লেখা হয়েছে। এসকল কিতাবে হানাফী আলেম হিসেবে তার জীবনী বা নির্ভরযোগ্য আলেম হিসেবে কোথাও  তস্বীকৃতি দেয়া হয়েছে কি?আমরা ইনশাআল্লাহ প্রত্যেকটি বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করব। 

ইবনে আবিল ইযের মাজহাব:

শরহে আকিদাতু ত্বহাবীর তাহকীক করেছেন, শায়খ শুয়াইব আরনাউত ও শায়খ আব্দুল্লাহ তুরকী। তারা উক্ত তাহকীকে ইবনে আবিল ইযের জীবনী আলোচনা করেছেন। তার জীবনী আলোচনা করতে গিয়ে তারা লিখেছেন, ইবনে আবিল ইযকে হানাফী মাজহাবের দিকে সম্পৃক্ত করা হয়। তবে বাস্তবে তিনি নিজের গর্দানকে তাকলীদের (মাজহাব অনুসরণ) বন্ধন থেকে মুক্ত করেন।  শায়খ শুয়াইব আরনাউত ও শায়খ আব্দুল্লাহ তুরকীর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ইবনে আবিল ইয একজন গাইরে মুকাল্লিদ, লা-মাজহাবী বা যাহেরী ছিল। 

ইবনে আবিল ইয পারিবারিকভাবে হানাফী ছিল। যেমন শায়খ আলবানী পারিবারিকভাবে হানাফী ছিল। কিন্তু কেউ হানাফী পরিবারে জন্মগ্রহণ করলে, কিংবা হানাফী মাদ্রাসায় পড়লে বা পড়ালে সে হানাফী হয়ে যায় না। আমাদের দেশের অধিকাংশ লা-মাজহাবী হানাফী পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও তারা গাইরে মুকাল্লিদ। একইভাবে বর্তমানে আহলে হাদীসদের অধিকাংশ শায়খ হানাফী মাজহাবের মাদ্রাসায় পড়া-লেখা করেছে, কিন্তু তারা হানাফী নয়। সুতরাং কারও হানাফী হওয়াটা তার পরিবার, পিতা-মাতা বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করে না। ইবনে আবিল ইয জন্মগতভাবে হানাফী হলেও বাস্তবে সে হানাফী নয়। বরং  ইবনে আবিল ইয একজন গাইরে মুকাল্লিদ বা লা-মাজহাবী।সুতরাং তাকে হানাফী হিসেবে প্রচার করে তাকে হানাফী মাজহাব বা আকিদার প্রতিনিধি হিসেবে প্রকাশ করা একটি মারাত্মক ভুল। 

যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেই যে, ইবনে আবিল ইয হানাফী ফিকহের অনুসারী ছিল, কারণ সে হানাফী মাজহাবের মাদ্রাসায় শিক্ষতা করেছে, তাহলে এটি কখনও বলা সম্ভব নয় যে, সে আকিদার দিক থেকেও হানাফী ছিলা। মু’তাজিলা সম্প্রদায়ের অনেকেই হানাফী মাজহাবের অনুসারী ছিল, কিন্তু তাদের কাউকে হানাফী বলা হয় না। একইভাবে কাররামিয়াদের অনেকেই হানাফী মাজহাব অনুসরণ করত। কিন্তু তাদেরকেও হানাফী বলা হয় না। ফিকহের দিক থেকে কেউ হানাফী ফিকহ অনুসরণ করলেই তাকে হানাফী হিসেবে পরিচয় দেয়া হয় না। কারণ হানাফী হিসেবে কারও পরিচিতি এটা প্রমাণ করে যে, সে আকিদা ও ফিকহ উভয় ক্ষেত্রে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অন্তর্ভূক্ত। কেউ যদি ফিকহের ক্ষেত্রে হানাফী মাজহাব অনুসরণ করে, কিন্তু আকিদার ক্ষেত্রে আহলে সু্ন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত আকিদা পোষণ করে তাকে হানাফী বলা হয় না। বরং আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত আকিদার দিকে তাকে সম্পৃক্ত করা হয়। কাররামিয়া মতবাদের অনুসারী কারও নামের শেষে হানাফী লাগিয়ে দিয়ে আকিদা ও ফিকহে তাকে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অন্তর্ভূক্ত করার অপচেষ্টা কেউ করলে সেটি অবশ্যই বাস্তবতা বিরোধী। সুতরাং ফিকহ ও আকিদা উভয় ক্ষেত্রে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত ইবনে আবিল ইযকে কীভাবে হানাফী হিসেবে পরিচয় দেয়া হয়? তার বাহ্যিক অবস্থা বিবেচনা করে হানাফী লিখলেও তাকে যদি কেউ হানাফী ফিকহ বা আকিদার প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন করে, তাহলে অবশ্যই আমরা বলব, প্রকৃতপক্ষে ইবনে আবিল ইয ফিকহ ও আকিদা কোন ক্ষেত্রেই হানাফী ছিল না। বরং সে কাররামিয়াদের অনুসারী হাশাবী বা দেহবাদী আকিদায় বিশ্বাসী ছিল। ইবনে আবিল ইযের যেসকল কিতাব তার দিকে সম্পৃক্ত করা হয়, তার প্রত্যেকটি সে হানাফী মাজহাবের বিরুদ্ধে লিখেছে। হানাফী মাজহাবের পক্ষে তার বিশেষ কোন খেদমত নেই।

ইবনে আবিল ইযের গাইরে মুকাল্লিদ হওয়ার আরেকটি প্রমাণ হল, তার একটি কিতাব বর্তমানের আহলে লা-মাজহাবীরা প্রচার করে থাকে। আহলে হাদীস আলেম আতাউল্লাহ হানীফ ইবনে আবিল ইযের “আল-ইত্তেবা” কিতাবটি তাহকীক করে প্রকাশ করেছে। পরবর্তীতে আবু সুহাইব আসিম ইবনে আব্দুল্লাহ  আল-কারইউতী এটি তাহকীক করেছে। আবু সুহাইব এই কিতাবের ভূমিকায় হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেম আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. ও আল্লামা যফর আহমাদ উসমানী রহ. এর বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছে এবং এসমস্ত বিখ্যাত আলেমদের বিরুদ্ধে ইবনে আবিল ইযের বক্তব্য উপস্থাপন করেছে। যেখানে ইবনে আবিল ইয সুনিদিষ্ট একটি মাজহাবের অনুসারীকে শিয়াদের সাথে তুলনা করেছে। নাউযুবিল্লাহ। ইবনে আবিল ইযের অবস্থা থেকে বাংলা ভাষার প্রসিদ্ধ একটি প্রবাদবাক্য মনে পড়ে গেল।  “মার চেয়ে মাসির দরদ বেশি” ।ইবনে আবিল ইযের প্রতি সালাফী ও আহলে হাদীসদের অতিশয় আগ্রহ এটিই প্রমাণ করে।  বর্তমানের সালাফীরা হানাফী মাজহাবের উলামায়ে কেরামকে তাদের আকিদার বিরোধী হওয়ার কারণে কাফের, বিদযাতী, জাহমী, মুয়াত্তিলা ইত্যাদি আখ্যায়িত করে। এ বিষয়ে অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে।  হানাফী মাজহাবের অধিকাংশ আলেম যাদের কাছে কাফের ও বিদয়াতী, তারাই ইবনে আবিল ইযের আকিদা প্রচার করছে। আবার উপমহাদেশের লা-মাজহাবীরা মাজহাবের অনুসারীদেরকে মুশরিক বলে বিশ্বাস করে, অথচ তারাই আবার ইবনে আবিল ইযের কিতাব প্রকাশ ও প্রচার করছে। ইবনে আবিল ইয আসলেই যদি হানাফী হত, তাহলে হানাফীদেরকে যারা কাফের-মুশরিক আখ্যা দিচ্ছে, তারা কেন তার কিতাব নিয়ে এত মাতামাতি করে?

ইবনে আবিল ইয সম্পর্কে হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণের বক্তব্য:

মোল্লা আলী কারী রহ. এর বক্তব্য:

মোল্লা আলী কারী রহ. শরহে ফিকহুল আকবারে আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যাকার সম্পর্কে লিখেছেন, 

 والحاصل ان الشارح يقول بعلو المكان مع نفي التشبيه وتبع فيه طائفة من أهل البدعة

মোটকথা, আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যাকার  তাশবীহমুক্ত অবস্থায় আল্লাহ তায়ালা স্থানগতভাবে উপরের দিকে রয়েছেন বলে বিশ্বাস করে। এক্ষেত্রে সে একদল বিদয়াতীর অনুসরণ করেছে। তিনি আরও বলেন,

 و من الغريب أنه إستدل على مذهبه الباطل برفع الأيدي في الدعاء إلى السماء

 অর্থ: আশ্চর্যের বিষয় হল, সে তার ভ্রান্ত মতবাদ প্রমাণ করতে গিয়ে দুয়ার সময় হাত উপরের দিকে উঠানোর দলিল দিয়েছে। (শরহুল ফিকহিল আকবার, পৃ.১৭২. আল-ইলিময়া)মোল্লা আলী কারী রহ. এর বক্তব্য থেকে দু’টি বিষয় স্পষ্ট। তিনি ইবনে আবিল ইযকে বিদয়াতীদের অনুসারী বলেছেন। এবং তার মতবাদকে বাতিল বা ভ্রান্ত মতবাদ আখ্যায়িত করেছেন। 

আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্য:

আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিনে ইবনে আবিল ইয সম্পর্কে লিখেছেন,

“ولما تأملته حق التأمل؛ وجدته كلامًا مخالفًا لأصول مذهب إمامه!! وهو في الحقيقة كالرد على أئمة السنة، كأنه تكلم بلسان المخالفين، وجازف وتجاوز عن الحدود، حتى شبه قول أهل السنة بقول النصارى! فليتنبه لذلك”.

অর্থ: আমি  তার (ইবনে আবিল ইযের) বক্তব্য সম্পর্কে পরিপূর্ণ চিন্তা-ভাবনা করে দেখেছি, তার বক্তব্য তার ইমামের মাজহাবের মৌলিক নীতিমালার সম্পূর্ণ বিরোধী। বরং প্রকৃতপক্ষে তার বক্তব্য যেন আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের ইমামগণের বক্তব্য খন্ডনে লিখিত।  তার বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয়, সে যেন আহলে সুন্নতের ইমামগণের সাথে প্রতিপক্ষ হিসেবে কথা বলেছে। সে মারাত্মক বিকৃতির শিকার হয়েছে এবং সীমা অতিক্রম করেছে। এমনকি সে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের ইমামগণের বক্তব্যকে খ্রিষ্টানদের বক্তব্যের সাথে তুলনা করেছে। সুতরাং এ বিষয় সতর্ক থেক। [ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিন, খ.২, পৃ.১৪৬]

আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্য থেকে যেসকল বিষয় স্পষ্ট:

১. ইবনে আবিল ইয হানাফী মাজহাবের মৌলিক নীতিমালা অনুসরণ করত না।

২. তার লেখনী মূলত: হানাফী মাজহাব ও আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের বক্তব্য খন্ডনের উদ্দেশ্যে লিখিত।৩. হানাফী মাজহাব ও আহলে সুন্নতের উলামায়ে কেরামের সাথে যেন সে প্রতিপক্ষ হিসেবে কথা বলেছে।

৪.সে মারাত্মক প্রগলভতার  শিকার হয়ে সীমা অতিক্রম করেছে। 

৫. আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের উলামায়ে কেরামের বক্তব্যকে খ্রিষ্টানদের বক্তব্যের সাথে তুলনা করেছে।

 ৬. আল্লামা যাবিদি রহ. তার এসব বক্তব্যের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেছেন। 

আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. এর বক্তব্য:

হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত ইমাম আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাকার সম্পর্কে বলেন,

وطبع شرح لمجهول ينسب إلى المذهب الحنفي زورا ينادي صنع يده بأنه جاهل بهذا الفن وأنه حشوي مختل العيار

“আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যা হিসেবে একজন অজ্ঞাত ব্যক্তির একটি ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। যাকে বানোয়াটী করে হানাফী মাজহাবের দিকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এ লোকের লেখনী দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করে যে  সে আকিদা সম্পর্কে অজ্ঞ। সে একজন হাশাবী বা দেহবাদী এবং মারাত্মক বিচ্যুতির শিকার। “[আল-হাবী ফি সিরাতিল ইমামিত ত্বহাবী, পৃ. ৩৮]আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. এর বক্তব্য থেকে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট। প্রথমত: ইবনে আবিল ইযকে হানাফী মাজহাবের দিকে সম্পৃক্ত করা একটি বানোয়াট বা মিথ্যা। বাস্তবে সে হানাফী ছিল না। দ্বিতীয়ত: ইবনে আবিল ইয আকিদা বিষয়ে জাহেল বা অজ্ঞ ছিল এবং সে একজন মুজাসসিমা বা দেহবাদী আকিদার অনুসারী হাশাবী ছিল। আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. এর বক্তব্য অনুযায়ী আমরা ইবনে আবিল ইযকে হানাফী না বলে দেহবাদী আকিদার অনুসারী হাশাবী বলতে পারি। 

ইবনে আবিল ইযের সম-সাময়িক আলেমগণের বিরোধীতা:ইবনে আবিল ইযের ভ্রান্ত কিছু বক্তব্য প্রকাশিত হওয়ার তখনকার বিখ্যাত আলেমগণ তার প্রতিবাদ করেন। বিশেষভাবে অন্যান্য তিন মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণের সাথে হানাফী মাজহাবের আলেমগণও তার প্রতিবাদ করেন।

আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহ. তার ‘ইম্বাউল গুমর বি আবনায়িল উমর’ কিতাবে লিখেছেন,

وأن العلماء بالديار المصرية خصوصا أهل مذهبة من الحنفية أنكرواذلك عليه

অর্থ: মিশরের আলেমগণ বিশেষভাবে তার মাজহাব তথা হানাফী মাজহাবের উলামায়ে কেরাম তার বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন। [ইমবাউল গুমর, খ.২, পৃ.৯৬]

যেসব উলামায়ে কেরাম ইবনে আবিল ইযের বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন, এদের মাঝে বিখ্যাত কিছু আলেমের নাম উল্লেখ করেছেন ইবনে হাজার আসকালানী রহ.। যেমন, যাইনুদ্দীন ইবনে রজব রহ, তকীউদ্দীন ইবনে মুফলিহ রহ. শরফুদ্দীন ইবনে গাজ্জী রহ. ।

বর্তমানে সালাফীরা ইবনে আবিল ইযের আরেকটি কিতাব প্রকাশ করেছে। কিতাবের নাম হল, আত-তাম্বীহ আলা মুশকিলাতিল হিদায়াহ। সালাফী আলেমরা ইবনে আবিল ইযের রচনা হিসেবে এটি প্রকাশ করেছে। যদিও কিতাবটি ইবনে আবিল ইযের নাকি তার দাদার এটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সালাফীদের বক্তব্য অনুযায়ী কিতাবটি যদি ইবনে আবিল ইযের হয়, তাহলে তার সম্পর্কে হানাফী মাজহাবের আরও কিছু উলামায়ে কেরামের বক্তব্য শুনুন। 

ইমাম সাখাবী রহ. তার আজ-জাওউল লামে কিতাবে লিখেছেন, হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত ইমাম কাসেম ইবনে কুতলুবুগা ইবনে হেদায়া কিতাবের উপর ইবনুল ইযের অভিযোগ খন্ডন করে কিতাব লিখেছেন। “صنّف “أجوبةً عن اعتراضات ابن العزّ على الهداية”[আজ-জাওউল লামে, খ.৬, পৃ.১৮৭]

সালাফীরা ইবনে আবিল ইযের উক্ত কিতাবকে হেদায়ার ব্যাখ্যা হিসেবে প্রচারের চেষ্টা করলেও এটি মূলত: হেদায়া কিতাবের উপর তার অভিযোগ সংকলন। একারণে আল্লামা কাসেম ইবনে কুতলুবুগা তার অভিযোগ খন্ডন করেছেন। একইভাবে আল-বাহরুর রায়েকে রয়েছে ফাতহুল কাদীরে আল্লামা ইবনুল হুমাম ইবনুল ইযের বক্তব্য খন্ডন করেছেন।

 وَقَدْ أَطَالَ فِي فَتْحِ الْقَدِيرِ فِي بَيَانِهِ إطَالَةً حَسَنَةً وَتَعَرَّضَ لِلرَّدِّ عَلَى ابْنِ الْعِزِّ، وَلَسْنَا بِصَدَدِ ذَلِكَ

[আল-বাহরুর রায়েক, বাবুল ইয়ামীন ফিল আকলি ওয়াশ শুরব]

সালাফীদের বক্তব্য অনুযায়ী আত-তাম্বীহ আলা শরহিল হেদায়া কিতাবটি যদি আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাকার ইবনে আবিল ইযের হয়, তাহলে তার বক্তব্য আল্লামা হাসকাফী ও আল্লামা ইবনে আবিদীন খন্ডন করেছেন। তার বক্তব্যকে গরীব (আশ্চর্যজনক) আখ্যা দিয়েছেন। বিস্তারিত,

 “قال (ابن العز!): فحينئذ ينقض الوضوء، وهو فرع غريب وتخريج ظاهر.قال المصنف: ولظهوره عوّلنا عليه.قلت: قال شيخنا الرملي حفظه الله تعالى: كيف يعول عليه وهو مع غرابته لا يشهد له رواية ولا دراية، أما الاولى فظاهر إذا لم يرو عن أحد ممن يعتمد عليه، وأما الثانية فلعدم تسليم المقدمة الاولى ويشهد لبطلانها مسألة الجدي إذا غذي بلبن الخنزير فقد عللوا حل أكله بصيرورته مستهلكا لا يبقى له أثر، فكذلك نقول في عرق مدمن الخمر، ويكفينا في ضعفه غرابته”.[রদ্দুল মুহতার, খ.৬, পৃ.১৪৬-১৪৭]

আকিদার ক্ষেত্রে ইবনে আবিল ইযের বিচ্যুতি সুস্পষ্ট। অধিকাংশ বিষয়ে সে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত আকিদা পোষণ করে। এবং কাররামিয়া ও মুজাসসিমাদের ভ্রান্ত বক্তব্য প্রচার করেছে। আকিদাতুত ত্বহাবীর সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা ভিডিও আকারে প্রকাশের নিয়ত রয়েছে। আমাদের আলোচনায় ইবনে আবিল ইযের ভ্রান্ত মতবাদগুলি বিস্তারিত উল্লেখ করা হবে ইনশাআল্লাহ। এখানে সংক্ষেপে দু’একটি বিষয় উল্লেখ করা মুনাসিব মনে করছি। এসকল বিষয়ের কয়েকটি কুফুরী পর্যায়ের। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করেন। 

১. কিছু সৃষ্টি কাদীম বা অবিনশ্বর। অনাদী থেকেই বিদ্যমান। এটি তাসালসুলুল হাওয়াদিস নামে পরিচিত। [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.১২৯, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]

২. আল্লাহ তায়ালার হদ বা সীমা রয়েছে।  [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.২১৯, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]

৩. আল্লাহর সত্তার মাঝে নশ্বর বিষয় সৃষ্টি হয়।  [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.১৭৭, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]

৪. আল্লাহর বক্তব্যের অক্ষর ও শব্দ রয়েছে।  [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.১৬৯, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]

৫. আল্লাহ তায়ালা স্থানগতভাবে উপরের দিকে রয়েছেন। অর্থাৎ আল্লাহর দিক রয়েছে। 

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে দেহবাদী আকিদার ভ্রান্তি থেকে হেফাজত করুন। আমীন।

------ ------

আক্বিদা

আল্লাহ তায়ালার এককত্বের প্রমাণ

ইজহারুল ইসলাম মঙ্গল, 03 ডিসে., 2024

ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের মাঝে সর্বপ্রধান বিষয় হল, আল্লাহর তাওহীদ তথা একত্বের উপর ঈমান আনয়ন করা। এই বিশ্বাস করা যে, সৃষ্টা হিসেবে তিনি একক, গুণাবলীর বিবেচনায় তিনি একক এবং উপাসনার যোগ্য একমাত্র তিনিই। পবিত্র কুরআন ও রাসূল (সঃ) এর সমস্ত হাদীস তাওহীদ তথা আল্লাহর এককত্বের উপর ভিত্তি করেই আবর্তিত। কোন বিষয়ে আল্লাহর সমকক্ষ বা অংশীদার নেই, এটিই এ বিশ্বাসের মূলমন্ত্র। পবিত্র কুরআনের ১১২ নং সূরায় এ বিষয়টি সুষ্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষিত হয়েছে। সে প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর অস্তিত্ব অনুভব করে এবং আল্লাহর এককত্বের স্বাক্ষর প্রদান করে।

আমরা এখানে আল্লাহর এককত্বের উপর পাঁচটি যুক্তি উপস্থাপন করব।

অকহ্যাম রেজর এর তত্ত্ব

কুরআন স্পষ্টভাষায় জিজ্ঞাসা করেছে, এই মহাবিশ্ব কি এমনিতেই সৃষ্টি হয়েছে? এর উত্তর খুবই সহজ ও স্পষ্ট। কেননা ভৌত পদার্থবিদ্যা এবং সকল দর্শন এবিষয়ে একমত যে, যে বস্তু অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এসেছে, তার অস্তিত্বের পিছে একটি কজ বা কারণ রয়েছে। আর মহাবিশ্ব যেহেতু অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এসেছে এজন্য এর পিছে একটি কারণ বা কজ রয়েছে। মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পিছে একটি সামগ্রিক কজ বা কারণ থাকাটাই যুক্তিযুক্ত। অসীম সংখ্যক কারণ থাকাটা অসম্ভব। কেননা বাস্তবে কখনও অসীম কোন কিছু থেকে আমরা কোন ফলাফল লাভ করি না।

উদাহরণ হিসেবে নীচের দু’টি বিষয় লক্ষ্য করুণ-

১. কোন কক্ষে যদি অসীম সংখ্যক মানুষ থাকে এবং সেখান থেকে যদি আমি দু’জনকে বাদ দেই, তাহলে কতজন থাকবে? আপনি উত্তর দিবেন, অসীম বিয়োগ দুই। অর্থাৎ অসীম থেকে দু’জনকে বাদ দিলে যা থাকে। এর দ্বারা বাস্তবে কোন অর্থ বোঝায় কি? অসীম থেকে যদি দুজনকে বাদ দেয়া হলেও কক্ষে অসীম সংখ্যক মানুষই থেকে যাবে। বাস্তবে এটি বিশেষ কোন অর্থ প্রদান করে না। আপনাকে যদি কক্ষের অসীম সংখ্যক লোক গণনা করতে বলা হয়, আপনার পক্ষে তা গণনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু লোকসংখ্যা যদি অসীম থেকে সামান্য কমিয়ে গণনা করতে বলা হয়, তবুও আপনার পক্ষে তা গণনা করা সম্ভব নয়। এর অর্থ হল, বাস্তব জীবনে অসীম সংখ্যা থেকে বিশেষ অর্থ বোঝা সম্ভব নয়। 

২. মনে করুন, আমি একজন সৈনিক। আমি একটা শত্রুকে গুলি করতে চাই। আমার গুলি করার জন্য আমার পেছনের সৈনিকের অনুমতি নেয়া প্রয়োজন। আমার পিছের সৈনিকের জন্য আবার তার পেছনের সৈনিকের অনুমতি প্রয়োজন। এভাবে এ ধারা যদি চলতে থাকে এবং আমার গুলি করার জন্য অসীম সংখ্যক সৈনিকের অনুমতির প্রয়োজন হয়, তবে আমি কি আদৌ শত্রুকে গুলি করতে পারব? উত্তর খুবই সহজ ও স্বাভাবিক। একইভাবে আমি মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পিছে যদি অসীম সংখ্যক কারণ ধরে নেই, তবে আদৌ মহাবিশ্বের অস্তিত্ব সম্ভব হত না। এবং কখনও এটি অস্তিত্বে আসত না। সুতরাং মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পিছে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বাধীন ও একক কারণ থাকাটাই যুক্তিসঙ্গত।

আপনি এ যুক্তি দেখাতে পারেন যে, উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্য তথা স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বাধীন একাধিক কারণ একই সাথে ক্রিয়াশীল হলে সমস্যা কোথায়? 

আমি বলব, আপনার এ যুক্তিটা খুবই দুর্বল প্রকৃতির। চতুর্দশ শতাব্দীর দার্শনিক অকহ্যাম রেজর এর তত্ত্বের মাধ্যমে আপনার এ যুক্তির অসারতা প্রমাণিত হয়। অকহ্যাম রেজরের নীতি হল, প্রয়োজন ছাড়া বহু সংখ্যার ব্যবহার অনুচিৎ। আরেকটু সহজ করে বললে এভাবে বলা যায়,  সবচেয়ে সরল ও সর্বাধিক অর্থবহ ব্যাখ্যা হল, সর্বোত্তম ব্যাখ্যা।

অতএব, কোন প্রমাণ ছাড়া কিংবা প্রয়োজন ছাড়া আমরা এটা বলতে পারি না যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির পিছে অনেকগুলো কারণ ক্রিয়াশীল। সুতরাং এক্ষেত্রে আমাদেরকে সবচেয়ে অর্থবহ ও সরল কারণ তথা মহাবিশ্ব সৃষ্টির একক কারণকেই গ্রহণ করতে হবে। কেননা এক্ষেত্রে আমাদেরকে কাছে কোন প্রমাণ নেই যে আমরা বলতে পারি, মহাবিশ্বের সৃষ্টি মূলতঃ দুটি, তিনটি, কিংবা কয়েক হাজার কারণের কম্বিনেশন বা সমন্বয়। একাধিক কারণ গ্রহণের দ্বারা একটি স্বাধীন, স্বয়ংসম্পূর্ণ কারণে অতিরিক্ত কোন মাত্রা যোগ হয় না।

যেমন, যখন বলা হল, মহাবিশ্ব একটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কারণের দ্বারা সৃষ্ট, এ কথা দ্বারা যে অর্থ স্পষ্ট হয়েছে, যদি বলা হয়, মহাবিশ্ব দু’টি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কারণের দ্বারা সৃষ্ট, এ কথার দ্বারা অতিরিক্ত কোন অর্থ প্রকাশ পায় না। কেননা আমি যখন বলছি, কারণটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী তখন অন্য কোন সর্বময় ক্ষমতার প্রয়োজন নেই। কারণটি যদি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী না হত, তবে সাহায্যকারী হিসেবে অন্য কোন কারণের প্রয়োজন পড়ত। এক্ষেত্রে কোন কারণই তখন স্বাধীন বা স্বয়ংসম্পূর্ণ কারণ থাকবে না।

সুতরাং মহাবিশ্ব সৃষ্টির পিছে আমাদের মূলতঃ একটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কারণের প্রয়োজন ছিল এবং এটুকুই যথেষ্ট কেননা কারণটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।

২. যৌক্তিক প্রমাণ

যুক্তির দাবি হল, মহাবিশ্ব সৃষ্টি যদি অনেক প্রভূ থাকত, তবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে মহাবিশ্ব ধ্বংস হয়েছে। এবং আমরা মহাবিশ্বে যে সুষম শৃঙ্খলা ও নিয়মতান্ত্রিকতার সর্বোচ্চ সমাবেশ লক্ষ্য করে থাকি, অনেক প্রভূ থাকলে তা পরিলক্ষিত হত না।

আপনি যুক্তি দেখাতে পারেন, আপনার গাড়িটি তৈরি করে অনেক মানুষ। যেমন, কেউ গাড়ীর বডি তৈরি করে, কেউ ইঞ্জিন আবার কেউ চাকা। কিন্তু পূর্ণ গাড়িটি তৈরি হলে সেটি একটি সুন্দর ও সুষম গাড়ি হয়ে থাকে। অতএব, একটি সৃষ্ট বস্তুর অনেক স্রষ্টা থাকলেও সেটি ভারসাম্যপূর্ণ হতে পারে। 

আপনার এ প্রশ্নের উত্তর হল, মহাবিশ্ব সৃষ্টির পিছে আমরা যে কারণটি উল্লেখ করেছি সেটি হল, এমন একজন প্রভূ যিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং ইচ্ছার ক্ষেত্রে এককভাবে স্বাধীন। কেননা প্রভূ তো তিনিই হবেন, যার অসীম প্রয়োগিক ইচ্ছা রয়েছে। যদি অনেক প্রভূ থাকত, তবে প্রত্যেকের ইচ্ছা প্রয়োগের প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হত, আর এটিই মহাবিশ্বে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণ হতো।

আপনি যুক্তি দেখাতে পারেন, এ সম্ভাবনা রয়েছে যে, অনেকগুলো প্রভূ একটি বিষয়ে একমত পোষণ করতে পারে। অথবা এক একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে তাদের পৃথক পৃথক ক্ষমতা থাকবে। এক্ষেত্রে আমরা বলব, এ ধরণের প্রভূর ইচ্ছা অসীম ও স্বাধীন নয়। ফলে এরা প্রভূ হওয়ার যোগ্য নয়। সার কথা হল, যদি দু’জন স্রষ্টা থাকে, এবং তারা কোন বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে, যেমন একজন ক নামক ব্যক্তিকে স্থির রাখতে চাচ্ছে, আরেকজন তাকে গতিশীল করতে চাচ্ছে। অথবা একজন প্রভূ খ কে জীবন্ত প্রাণি বানাতে চাচ্ছে, আরেকজন চাচ্ছে যে, এটি জড়পদার্থ হিসেবে অবস্থান করবে।

যুক্তির আলোকে যদি বিশ্লেষণ করা হয়, তবে এখানে তিনটি অবস্থার কোন একটি ঘটতে বাধ্য-

১. উভয় প্রভূর ইচ্ছা বহাল রাখা হবে এবং তা বাস্তবায়ন করা হবে।

২. শুধু তাদের একজনের ইচ্ছা বহাল রাখা হবে।

৩. তাদের কারও ইচ্ছায় বাস্তবায়ন করা হবে না।প্রথমটি সম্ভব নয়।

কেননা এক্ষেত্রে দু’টি বিপরীত বিষয় একই সাথে অস্তিত্ব লাভ করা আবশ্যক হবে। যা অসম্ভব। অর্থাৎ একই সাথে একটি বস্তু জীবিত ও মৃত হতে পারে না। তৃতীয় বক্তব্যও বাতিল হয়ে যাবে। কেননা এর দ্বারা এটা আবশ্যক হয় যে, একটি বস্তু গতিশীলও না, আবার স্থিরও না। একইভাবে একটি বস্তু জীবিতও না, আবার মৃত না। আর এটি অসম্ভব। সাথে সাথে তাদের কারও ইচ্ছায় যদি বাস্তবায়ন করা না হয়, তখন তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, তাদের কেউ-ই নিজ ইচ্ছা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম নয়। ফলে প্রত্যেকেই প্রভূ হওয়ার যোগ্যতা হারাবে।

দ্বিতীয় বক্তব্য অনুযায়ী, যদি দু’জনের মধ্য থেকে একজনের ইচ্ছা বাস্তবায়ন করা হয়, এবং অপরজনের ইচ্ছা পরিত্যাগ করা হয়, তবে তিনিই হবেন একক প্রভূ। যার ইচ্ছা পরিত্যাগ করা হয়েছে, সে প্রভূ হওয়ার যোগ্য থাকবে না। উপর্যুক্ত বক্তব্য দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, এই ভারসাম্যপূর্ণ মহাবিশ্বের একজন মাত্র প্রভূ থাকা সম্ভব, যিনি অসীম ইচ্ছার অধিকারী এবং একক ক্ষমতার অধিকারী।

৩. ধারণাগত বৈচিত্র

আমরা কিভাবে দু’টি জিনিসকে পরস্পর থেকে পৃথক করে থাকি? দু’জন ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে আমরা তাদের মধ্যে পার্থক্য করি কীভাবে। এর উত্তর হল, আমরা এটা করে থাকি, কনসেপ্চুয়াল ডিফারেনসিয়েশন বা ধারণাগত বৈচিত্রের মাধ্যমে। এই ধারণাগুলো হল, স্থান, পারম্পরিক দূরত্ব, গঠন ও আকার-আকৃতিগত তারতম্য।

আমরা যে কোন দু’টি বস্তুর মাঝে পার্থক্য করতে পারি, তাদের পারস্পরিক দূরত্ব, বর্ণ ও আকার-আকৃতিগত বৈচিত্রের মাধ্যমে। দু’টি বিষয়ের মধ্যে যখন উপরোক্ত বিষয়গুলো না পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে কি আপনি উক্ত বস্তু দু’টির মাঝে কোন পার্থক্য করতে সক্ষম হবেন? আপনি পারবেন না। এবিষয়টি শুধু দু’য়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং অসংখ্য বস্তুর ক্ষেত্রে পার্থক্য নির্ণয় করতে হলে, উপরোক্ত বিষয়গুলো থাকা আবশ্যক। 

প্রাসঙ্গিকভাবে বলে নেয়া আবশ্যক যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি মহাবিশ্ব থেকে বহির্গত হওয়া আবশ্যক। কেননা সৃষ্টির কারণ যদি মহাবিশ্বের ভিতরগত কিংবা মহাবিশ্বেরই কোন অংশ হয়, তখন এর অর্থ হয় যে, মহাবিশ্ব নিজেই নিজের স্রষ্টা। আর এটি অসম্ভব। মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ যেহেতু বহির্গত, আপনি সহজেই অনুমান করতে পারবেন যে, আপনি মহাবিশ্বের বহির্গত বিষয়ের মধ্যে অবস্থান, আকার-আকৃতি ও বর্ণগত পার্থক্য করতে পারবেন না। কেননা এ বিষয়গুলো কেবল মহাবিশ্বের অভ্যন্তরে বিশেষ অর্থ প্রদান করে, এর বাইরে নয়। কেননা উপর্যুক্ত বিষয় তথা দূরত্ব, আকার-আকৃতি বা বর্ণ প্রত্যেকটি সৃষ্ট। মহাবিশ্বের বাইরে সৃষ্ট কোন বস্তু নেই। মহাবিশ্বের বাইরে উপর্যুক্ত বিষয়ের অনুপস্থিতির কারণে সৃষ্টির পিছে ক্রিয়াশীল দু’টি কারণের মধ্যে পার্থক্য করাও সম্ভব নয়। এজন্য সৃষ্টির পিছে দু’টি বা অসংখ্য কারণের কথা বলাটাও ভিত্তিহীন, অযৌক্তি ও ধারণাপ্রসূত একটি বক্তব্য মাত্র। 

৪. অনন্যতা

মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি ইউনিক বা অনন্য হওয়া আবশ্যক। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “তাঁর কোন সমকক্ষ নেই”। মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি যদি অনন্য না হয়, তবে এর অর্থ হবে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ ও মহাবিশ্বের মাঝে একটি সিমিলারিটি বা সাদৃশ্য রয়েছে। কেননা এর দ্বারা এটি প্রমাণিত হয় যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি এর মাঝে রয়েছে। যার অর্থ এই দাঁড়াল যে, মহাবিশ্ব নিজেই নিজের স্রষ্টা। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি মহাবিশ্বের সাদৃশ্যপূর্ণ হতে পারবে না কেন? এর উত্তরটি খুবই সহজ। আমরা জানি মহাবিশ্ব অসংখ্য বস্তুর সমষ্টি। সুতরাং মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি অবশ্যই ইম্যাটেরিয়াল বা বস্তুজগতের ঊর্ধ্বে হতে হবে। নতুবা মহাবিশ্ব নিজেই নিজের স্রষ্টা হওয়া আবশ্যক হবে। সুতরাং বস্তু সৃষ্টির কারণটিও যদি বস্তুর মতো হয়, তবে বস্তু নিজেই নিজের স্রষ্টা হওয়া আবশ্যক, যা অসম্ভব। সুতরাং উপসংহারে আপনাকে অবশ্যই বলতে হবে যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি অবশ্যই ইম্যাটেরিয়াল ও ইউনিক হতে হবে। আমাদের এ বক্তব্যটি স্রষ্টার এককত্বের প্রমাণ হয় কিভাবে? আমরা বলব, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ যদি একাধিক হয়, তবে তার কোনটিই ইউনিক বা অনন্য হবে না। ফলে স্রষ্টা একজন হওয়াটাই নির্দিষ্ট।

৫. ঐশীবাণী

স্রষ্টার এককত্ব প্রমাণের সবচেয়ে সহজ উপায় হল, আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ঐশীবাণীর শরণাপন্ন হওয়া। এক্ষেত্রে যুক্তি হল, কোন বাণীর ব্যাপারে যদি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয় যে, এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত এবং এটি মানব রচিত নয়, তখন এ গ্রন্থের বক্তব্যের ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকে না। সুতরাং আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ঐশী গ্রন্থে আল্লাহ তায়ালা নিজের সম্পর্কে যে তথ্য প্রদান করবেন সেটি নিশ্চিতভাবে সত্য বলে বিবেচিত হবে। 

কেউ যদি আল্লাহ সম্পর্কে অজ্ঞ হয় তবে সে কিভাবে আল্লাহ সম্পর্কে বা তার প্রেরিত কিতাব সম্পর্কে ধারণা অর্জন করবে?

এর দু’টি পদ্ধতি রয়েছে-

১. ইন্টারন্যাল

২. এক্সটারন্যাল

আভ্যন্তরীণভাবে আল্লাহ তায়ালার পরিচয় পাওয়ার অর্থ হল, আপনি আত্মপরীক্ষা বা আত্মদর্শনের মাধ্যমে আল্লাহ সম্পর্কে অবগত হওয়ার চেষ্টা করবেন। অর্থাৎ নিজের আভ্যন্তরীণ শক্তি ব্যবহার করে আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা। আজব ব্যাপার হল, আল্লাহ সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন মানুষের নিজস্ব শক্তির দ্বারা সম্ভব নয়।

এর কিছু মৌলিক কারণ হল,

১. মানুষ সৃষ্টিগতভাবে বৈচিত্রময়। ব্যক্তি বৈচিত্রের এধারাটি মূলতঃ মানুষের মানসিক ভিন্নতারই বহিপ্রকাশ। সাইকোলজিক্যাল ভিন্নতার প্রধান কারণ হল, ডি.এন.এ এর ভিন্নতা, বাস্তব অভিজ্ঞতা, সামাজিক পূর্বসূত্র, বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানার্জনের ক্ষমতা, লিঙ্গের বৈষম্য ইত্যাদি নিয়ামক দ্বারা প্রভাবিত। আত্মদর্শনের মাধ্যমে স্রষ্টা সম্পর্কে ধারণা পেতে এবিষয়গুলো আপনাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে। সুতরাং আপনার আত্মপরীক্ষার মাধ্যমে যে ফলাফল পাওয়া যাবে সেটি অন্যদের থেকে ভিন্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। আপনি নিজেও এই বাস্তবতা উপলব্ধি করবেন যে, উপর্যুক্ত বিষয়ের উপস্থিতিতে আপনি একাকী যদি স্রষ্টা সম্পর্কে ধারণা পেতে চান তবে তা সত্য থেকে অনেক বিচ্যুত হতে পারে। এটি একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ বছর আগে পৃথিবীতে প্রায় ৩৭০০ হাজার দেবতার ধারণা মানুষের মনে জেঁকে বসেছিল।

২. দ্বিতীয় কারণ হল, বাস্তবতার বিবেচনায় মানুষ খুবই সীমাবদ্ধ। এজন্য মানুষ যদি নিজের পক্ষ থেকে স্রষ্টা সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করতে চায়, তবে তা অধিকাংশ সময় ভ্রান্তির কারণ হয়। দার্শনিকগণ ¯্রষ্টার অস্তিত্বের ব্যাপারে কিছু যুক্তিসঙ্গত দার্শনিক তত্ত্ব উপস্থাপন করে থাকেন। তবে তারা স্বতঃসিদ্ধ ও বাস্তব কোন তথ্য দিতে অক্ষম। প্রকৃতপক্ষে যদি আপনি স্রষ্টা সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা অর্জন করতে চান, তবে তা হবে ইঁদুরের পক্ষে হাতির শক্তিমত্তা সম্পর্কে ধারণা অর্জনের মতো হাস্যকর। এজন্য শুধু যুক্তি বা ধারণার উপর ভিত্তি করে স্রষ্টা সম্পর্কে কিছু বলা তার সম্পর্কে মিথ্যাচারের নামান্তর। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, “তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে যা জান না, তা বলো কেন?” সুতরাং আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে আমরা যদি জ্ঞান অর্জন করতে চাই তবে তা অবশ্যই এক্সটারন্যাল বা বহির্গত কোন মাধ্যমে হতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা ঐশীবাণীর মাধ্যমে আমাদেরকে যা জানিয়েছেন, সেটিই হবে বিশুদ্ধ জ্ঞান।

আর পবিত্র কুরআন থেকে আমরা একথা সুনিশ্চিতভাবে জানি যে, আল্লাহ তায়ালা হলেন এক ও অদ্বিতীয়। তার সমকক্ষ কেউ নেই। সুতরাং তার এককত্বের ব্যাপারে আর কোন সন্দেহ থাকে না।

------ ------