করোনা ভাইরাস।বর্তমান বিশ্বে এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম।সাম্প্রতিক সময়ে সর্বোচ্চ উচ্চারিত ও গুগল সার্চে শীর্ষে থাকা শব্দ।যা অল্প সময়ের নোটিশে পুরো পৃথিবীকে বিবশ ও বিহ্বল করে দিয়েছে।স্থবির করে দিয়েছে চাঁদে যাওয়া,এভারেস্ট জয় করা,আকাশচুম্বী দালান তৈরি করা,চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিপ্লব সাধন করে জরা-বার্ধক্য এমনকি মৃত্যু রোধে গবেষণা শুরু করা অহংকারী মানুষের বিলাসবহুল জীবন ও তার সকল আয়োজন।
শাশ্বত বিধান 'মৃত্যু'র ভয় থমকে দিয়েছে তাদের জীবন ও জীবিকা।কর্মচঞ্চল পৃথিবী জুড়ে যেন নেমে এসেছে অপার্থিব ভীতিকর এক বিষন্ন সন্ধ্যা।নিথর নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে বিশাল বিশাল কর্মমুখর জনবহুল শহরগুলো।আল্লাহতে অবিশ্বাস করা মানুষগুলোও আজ নড়েচড়ে বসেছে।"আল্লাহর আযাব"-এ বিশ্বাস না করা মানুষগুলো আজেবাজে বকতে শুরু করেছে।কেউ কেউ তো বলতে শুরু করেছে,সে নাকি আল্লাহ-য় বিশ্বাস না করলেও "প্রকৃতির প্রতিশোধ"-এ বিশ্বাস করে!
জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির তথ্য বলছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বজুড়ে মৃতের সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়েছে।
এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পুরো বিশ্বে এখন এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ২৮ লাখ মানুষ।
(সূত্র:https://www.bbc.com/bengali/news-52429692)
(২৬ এপ্রিল ২০২০)
সংখ্যাগুলো প্রতিদিনই চক্রবৃদ্ধি হারে হু হু করে বাড়ছে।
স্পষ্টতই এই সংখ্যাগুলো অফিসিয়াল রেকর্ডেড।কিন্তু অফিসিয়াল রেকর্ডের বাইরে এই সংখ্যাটি যে আরো অনেক অনেক বেশি হবে,তা বলা বাহুল্য।বিশেষকরে আমাদের বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে।
করোনা পূর্ববর্তী ও করোনা পরবর্তী পৃথিবী একরকম হবে না এটা বোঝাই যাচ্ছে।অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি পারিবারিক,সামাজিক,রাষ্ট্রীয়,এমনকি কুটনৈতিক বিপর্যয়েরও পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে।
ট্রাম্প-কিমের উগ্র মনোভাব ও পাগলামির অবস্থাতো সবারই জানা।কিছুদিন আগে করোনা ইস্যু নিয়ে চিনের প্রতি ট্রাম্পের খোলামেলা অভিযোগের মাঝে উৎসাহী পর্যবেক্ষকরা করোনা উত্তর পৃথিবীতে ভিন্ন কিছুর আভাস পাচ্ছেন।
যাইহোক অন্য সকল সেক্টরের মত করোনা ধর্মীয় মহলেও নানা বিতর্ককে সামনে নিয়ে এসেছে।
এরমাঝে মৌলিকভাবে দুটি প্রশ্ন বার বার সামনে আসছে-
(১) ইসলাম কি ছোঁয়াছে রোগের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে?
(২) করোনার সংক্রমণকে ভয় করে এর প্রতিরোধের জন্য বিশেষ রকমের সতর্কতা অবলম্বন তকদীর-বিশ্বাস ও তাওয়াক্কুলের অন্তরায় কিনা?
এ দুটোর বাইরে প্রাসঙ্গিক ও শাখাগত আরো কিছু বিষয় রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হলো—
১. করোনা অমুসলিম জালেম রাষ্ট্রগুলোর জন্য এসেছে; মুসলমানদের এতে কিছু হবে না–এমন কথা কারো কারো মুখে শোনা যাচ্ছে।
২.করোনা ভাইরাস বা এর মতো সংক্রমণশীল রোগের মহামারীর পরিস্থিতিতে ইসলামের নির্দেশনা কি?
৩.করোনা পরিস্থিতিকে আমরা মুসলিমরা কিভাবে গ্রহণ করবো?
৪.মসজিদে জামাতের নামাজ ও জুমআ বন্ধ করা যাবে কি না?
#ইসলাম কি ছোঁয়াছে রোগের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে?
এপ্রসঙ্গটা আমি ফাতেহ24-এ প্রকাশিত সাবের ভাইয়ের
"মহামারী নিয়ন্ত্রণ : ধর্মীয় মহলে বিতর্ক" শীর্ষক নিবন্ধের একটি অংশ দ্বারা শুরু করছি।তিনি লিখেন,
"মৌলিকভাবে এটি আসলে স্বীকার করা, না করার বিষয় নয়। অভিজ্ঞতা বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে যদি দেখা যায় কোন জীবানু ছড়ায়, তাহলে তা ছড়ায়; এবং কোন জীবানুর ব্যাপারে যদি দেখা যায় তা ছড়ায় না, তাহলে তা ছড়ায় না। কোন রোগ ছড়ায় কি না–এরকম চিকিৎসা বিষয়ক সিদ্ধান্ত দেওয়া ইসলামের মূল কাজের অন্তর্ভুক্তও নয়। এটা সম্পূর্ণই বাস্তবতার যাচাই ও(চিকিৎসা শাস্ত্রীয়) পরিক্ষা-নীরিক্ষার উপর নির্ভর করে।
ইসলাম এখানে যে কাজটি করবে, তা হলো আপনার বিশ্বাসকে রক্ষা করবে এবং কোন অপবিশ্বাস থাকলে তা দূর করবে। সেই সাথে কর্মের ক্ষেত্রে কিছু মৌলিক নীতিমালা দিবে, যা আপনাকে মেনে চলতে হবে। অবশ্য, মৌলিক বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত না হলেও কুরআন ও হাদীসে নানান রোগের চিকিৎসা বিষয়ে বেশ কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যা অত্যন্ত বাস্তব ও কার্যকরী। আলোচ্য বিষয়টিতেও আমরা এরকমটি ঘটতে দেখি।"
(মহামারী পরিস্থিতিতে ইসলামের নির্দেশনা নিয়ে আমরা সামনে বিস্তারিত আলোচনা করবো।)
বিষয়টি সহজে বুঝার জন্যে আমরা প্রথমেই এ-সংক্রান্ত হাদিসগুলোতে একটু নজর বুলিয়ে নিই।
(১)
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ : قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : " لَا عَدْوَى وَلَا صَفَرَ وَلَا هَامَةَ ". فَقَالَ أَعْرَابِيٌّ : يَا رَسُولَ اللَّهِ، فَمَا بَالُ الْإِبِلِ تَكُونُ فِي الرَّمْلِ، كَأَنَّهَا الظِّبَاءُ، فَيُخَالِطُهَا الْبَعِيرُ الْأَجْرَبُ فَيُجْرِبُهَا ؟ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : " فَمَنْ أَعْدَى الْأَوَّلَ ؟ ".
আবু হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ রোগের মধ্যে কোন সংক্রমণ নেই, সফর মাসের মধ্যে অকল্যাণের কিছু নেই এবং পেঁচার মধ্যে কোন অশুভ আলামত নেই। তখন এক বেদুঈন বলল, ইয়া রাসুলাল্লাহ ! তাহলে যে উট পাল মরুভূমিতে থাকে, (এবং এমন সুস্থ-সবল হয়)যেন তা (চঞ্চল) হরিণ ছানা।এরপর সে উটের পালে একটি চর্মরোগওয়ালা উট মিশে সবগুলোকে চর্মরোগগ্রস্ত করে দেয়? রাসুলুল্লাহ সাঃ বললেন, তবে প্রথম উটটির মধ্যে কে রোগ সংক্রমিত করল?
(বুখারী:5817 ও 5770,মুসলিম:2220,আবুদাঊদ:3911,মুসনাদে আহমাদ:7620.)
(২)
وَعَنْ أَبِي سَلَمَةَ ، سَمِعَ أَبَا هُرَيْرَةَ بَعْدُ يَقُولُ : قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : " لَا يُورِدَنَّ مُمْرِضٌ عَلَى مُصِحٍّ ".
কোন অসুস্থ উটের মালিক যেন কিছুতেই তার উটকে আরেকজনের সুস্থ উটের সাথে না রাখে।
(বুখারী:5771,আবুদাঊদ:3911, ইবনে আব্দুল বার রহঃ(মৃঃ ৪৬৩ হিঃ) তাঁর মুয়াত্তা মালেকের ব্যাখ্যাগ্রন্থ
"التمهيد لما في الموطأ من المعاني و الأسانيد"-র মাঝেও অল্প কিছু শব্দগত ভিন্নতা সহকারে বর্ণনাটি এনে বলেন:
محفوظ لأبي هريرة عن النبي صلى الله على وسلم من وجوه كثيرة صحاح (খ:২৪,পৃ:১৮৮)
(এ অংশটি একটি সংশয় নিরসনের জন্যে উল্লেখ করা। যাদের মনে সংশয়টি দেখা দিবে তারা আশাকরি ইবনে আব্দুল বার রাহঃ-র এই মন্তব্য থেকে তাদের উত্তর পেয়ে যাবেন।আর যাদের মনে কোন সংশয় আসবেনা তারা এটা স্কিপ করে গেলেই ভালো হবে।)
(৩)
عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَخَذَ بِيَدِ مَجْذُومٍ فَأَدْخَلَهُ مَعَهُ فِي الْقَصْعَةِ، ثُمَّ قَالَ : " كُلْ بِاسْمِ اللَّهِ ثِقَةً بِاللَّهِ، وَتَوَكُّلًا عَلَيْهِ ". هَذَا حَدِيثٌ غَرِيبٌ
জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক কুষ্ঠ রোগীর হাত ধরে তাকে নিজের সাথে একই পাত্রে খাওয়াতে বসান। অতঃপর তিনি বলেনঃ আল্লাহ্ তা‘আলার নাম নিয়ে তাঁর উপর আস্থা রেখে ও তাঁর উপর ভরসা করে খাও।
(আবুদাঊদ:3925,তিরমিযি:1817,ইবনে মাজাহ:3542)
(৪)
عَنْ عَمْرِو بْنِ الشَّرِيدِ ، عَنْ أَبِيهِ ، قَالَ : كَانَ فِي وَفْدِ ثَقِيفٍ رَجُلٌ مَجْذُومٌ، فَأَرْسَلَ إِلَيْهِ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : " إِنَّا قَدْ بَايَعْنَاكَ، فَارْجِعْ ".
আমর ইবনে শারিদ তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন,(রাসুলুল্লাহ সাঃ এর কাছে বাইয়াতের উদ্দেশ্যে আসা) সাকিফ গোত্রের প্রতিনিধি দলের মাঝে একজন কুষ্ঠরোগী ছিলেন।রাসুলুল্লাহ সাঃ তার কাছে খবর পাঠালেন,তুমি ফিরে যাও আমি তোমার বাইয়াত নিয়ে নিয়েছি।
(মুসলিমঃ2231,নাসায়ীঃ4182,ইবনে মাজাহঃ3542,3544,মুসনাদে
আহমাদঃ19468,19474)
(৫)
حَدَّثَنَا سَعِيدُ بْنُ مِينَاءَ قال سَمِعْتُ أَبَا هُرَيْرَةَ يَقُوْلُ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم لاَ عَدْو‘ى وَلاَ طِيَرَةَ وَلاَ هَامَةَ وَلاَ صَفَرَ وَفِرَّ مِنَ الْمَجْذُومِ كَمَا تَفِرُّ مِنْ الأَسَدِ
সাঈদ ইবনে মি'না বলেন আমি আবু হুরাইরা রাঃ কে বলতে শুনেছি,রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ রোগের কোন সংক্রমন নেই, কুলক্ষণ বলে কিছু নেই, পেঁচা অশুভের লক্ষণ নয়, সফর মাসের কোন অশুভতা নেই। কুষ্ঠ রোগী থেকে এমনভাবে পলায়ন কর,যেভাবে তুমি বাঘ থেকে পলায়ন করে থাক।
(বুখারীঃ 5707)
আমরা দেখতে পাচ্ছি,হাদিসগুলো আপাতদৃষ্টিতে পরষ্পর বিরোধপূর্ণ।
একদিকে ১ম হাদিসটিতে এক সাহাবীর প্রশ্নের উত্তরে আল্লাহর রাসুল সাঃ বলছেন,(রোগ যদি শুধু সংক্রমণের মাধ্যমেই ছড়ায়) তবে প্রথম উটটিতে কে সংক্রমণ ঘটালো?
অপরদিকে ২য় হাদিসে তিনি নিজেই নির্দেশনা দিচ্ছেন,
কোন অসুস্থ উটের মালিক যেন কিছুতেই তার উটকে আরেকজনের সুস্থ উটের সাথে না রাখে!
তারপর ৪র্থ হাদিসে দেখতে পাই,তাঁর কাছে বায়আতের উদ্দেশ্যে আসা সাকিফ গোত্রের একজন কুষ্ঠরোগীকে পথিমধ্যে খবর পাঠাচ্ছেন,তুমি ফিরে যাও আমি তোমার বায়আত নিয়ে নিয়েছি।তেমনিভাবে ৫ম হাদিসের শেষের অংশে বলছেন,কুষ্ঠ রোগী থেকে এমনভাবে পলায়ন কর,যেভাবে তুমি বাঘ থেকে পলায়ন করে থাক।
অপরদিকে সেই ৫ম হাদিসেরই শুরুর দিকে তিনি বলছেন,রোগের কোন সংক্রমন নেই।সেইসঙ্গে ৩য় হাদিসে দেখতে পাই তিনি একজন কুষ্ঠরোগীর হাত ধরে তা নিজের সঙ্গে একই থালায় রেখে বলছেন,আল্লাহ্ তা‘আলার নাম নিয়ে তাঁর উপর আস্থা রেখে ও তাঁর উপর ভরসা করে খাও!
রাসুলুল্লাহর হাদিসগুলোতে পরস্পরে এতো বৈপরিত্য!
এতো দেখি রীতিমতো "Self defeating statement" হয়ে যাচ্ছে !
আসল ঘটনা হলো,সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব যার প্রতিটা আচরণ-উচ্চারন ওয়াহি কতৃক নির্দেশিত ও নিয়ন্ত্রিত, তাঁর কথায় কোন বৈপরিত্য নেই।আমরা নিজেরাই তাঁর কথার পূর্বাপর প্রসঙ্গ ও তৎকালীন প্রেক্ষাপটসহ সবকিছু বাদ দিয়ে জোর করে নিজের মতো বুঝতে গিয়ে সমস্যা বাধাই।এখানেও একই ব্যাপার ঘটেছে।ইনশা আল্লাহ আমাদের পরবর্তী আলোচনায় তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
#এইধরনের পরস্পর বিপরীত অর্থ প্রদানকারী হাদিস সমুহের ক্ষেত্রে সালাফগণ ক্ষেত্র বিশেষে তিন ধরনের পন্থা অবলম্বন করতেন।
১.একটিকে নাসিখ(রহিতকারী) ও অপরটিকে মানসুখ(রহিত) সাব্যস্তকরন।তবে এক্ষেত্রে একটিকে নাসেখ ও অপরটিকে মানসুখ বলার জন্যে পর্যাপ্ত দলিলের প্রয়োজন হয়।যেমনঃ সরাসরি আল্লাহর রাসুল থেকে কোন একটি রহিত হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে স্পষ্ট বিবৃতি পাওয়া যাওয়া কিংবা কোন সাহাবী কতৃক আল্লাহর রাসুলের সর্বশেষ আমল হিসেবে কোন একটিকে চিহ্নিত করন অথবা ইতিহাসের মাধ্যমে কোনো একটি আগে ও অপরটি পরের ঘটনা হিসেবে জানতে পারা ইত্যাদি।
২.সনদ ও মতন(হাদিসের মূল টেক্সট)গত বিভিন্ন দিক লক্ষ্য করে একটিকে আরেকটির উপর প্রাধান্যদান।
এর অনেক পদ্ধতি রয়েছে।তন্মধ্যে ৫০টি ইমাম হাযেমী রহঃ(মৃঃ৫৮৪ হিঃ) তার "الاعتبار في الناسخ والمنسوخ من الآثار"এর মাঝে তুলে ধরেছেন,এর সঙ্গে আরো ৬০টি যোগ করেছেন ইরাকী রহঃ(মৃঃ৮০৬হিঃ) তাঁর "التقييد و الإيضاح" কিতাবে।সর্বশেষ ইমাম শাওকানী রহঃ সবাইকে ছাড়িয়ে তার "إرشاد الفحول إلى تحقيق الحق من من علم الأصول" এর মাঝে প্রায় ১৬২ টি পদ্ধতি উল্লেখ করেন।যেগুলোকে আবার তিনি মৌলিকভাবে এগার ভাগ করেন।
(একথাগুলো এখানে বলার উদ্দেশ্য, একটা ভুল বুঝাবুঝির অপনোদন।আমরা অনেকেই মনে করি কোন হাদিস বুখারী বা মুসলিমে থাকলেই সেটাকে অন্যান্য হাদিসের উপর অগ্রাধিকার দিতে হবে।অথচ কোন হাদিস বুখারী-মুসলিমে থাকলে সেটাকে অগ্রাধিকার দেয়া উপরোক্ত ১৬২টি পদ্ধতির একটি পদ্ধতি।এপ্রসঙ্গে মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেবের শারহে নুখবার শরাহ "تنقيح الفكر"র মাঝে
"فكرة الاكتفاء بالصحيحين" শিরোনামে আরো অনেক যুক্তি সহকারে একটি সুন্দর ভারসাম্যপূর্ণ আলোচনা আছে।আগ্রহীরা দেখে নিতে পারেন।)
৩.বাহ্যত পরস্পর বিপরীত অর্থ প্রকাশক হাদিসের মাঝে সমন্বয় সাধন।এটারও অনেক পদ্ধতি,মাত্রা ও ক্ষেত্র রয়েছে।আহাদিসে মুখতালিফার উপর রচিত কিতাব সমুহ খেয়াল করে অধ্যয়ন করলেও এসবের অনেককিছু জানা যাবে।
উল্লেখ্য, অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম মনে করেন,উপর্যুক্ত তিন পদ্ধতির মাঝে তৃতীয়টি (অর্থাৎ সমন্বয় সাধন) সম্ভব হলে আর দ্বিতীয়টি (অর্থাৎ প্রাধান্যদান) প্রয়োজন হবেনা।
আরো উল্লেখ্য যে,উপরোক্ত তিন পদ্ধতির মাঝে কোনটি আগে অবলম্বন করতে হবে আর কোনটি পরে,এটা নিয়ে উলামায়ে কেরামগণের মাঝে কিছু মতানৈক্য রয়েছে।এবিষয়ে বিস্তারিত জানতে আল্লামা আব্দুল হাই লাখনোভী রহঃ (মৃত্যু-১৩০৪ হিঃ) লিখিত
"الأجوبة الفاضلة للأسئلة العشرة الكاملة" কিতাবটি শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহঃ(মৃত্যু-১৪১৭ হিঃ) এর
"التعليقات الحافلة على الأجوبة الفاضلة" সহ দেখা যেতে পারে।তবে প্রসঙ্গটি নিয়ে সংক্ষেপে সবচেয়ে ভারসাম্যপূর্ণ লেখা মনে হয়েছে "تنقيح الفكر" এ মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেবের আলোচনাটিকে।
এবার মূল প্রসঙ্গে ফেরা যাক।রোগের সংক্রমণ নিয়ে বাহ্যত পরস্পর বিপরীতার্থক যে হাদিসগুলো আমরা দেখে আসলাম,সেগুলোর মাঝে এই তিন পদ্ধতির কোনটি প্রযোজ্য হবে?
প্রথমটি হবেনা,কারণ একটাকে নাসেখ,আরেকটাকে মানসুখ বলার মতো পর্যাপ্ত দলিলের অনুপস্থিতি।
তবে আবু সালামা রাহঃ থেকে একটি বর্ণনা পাওয়া যায় যাতে তিনি বলেন যে, আবু হুরাইরা রাঃ আমাদেরকে দুটি হাদিস বর্ণনা করেন- একটি "রোগের কোন সংক্রমণ নেই" আর অপরটি "অসুস্থ উটকে কেউ যেন সুস্থ উটের কাছে না নিয়ে যায়"। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি প্রথম হাদিসটি বর্ণনা করা ছেড়ে দেন।.......
এরপর তিনি বলেন,আমি জানিনা আবু হুরাইরা রাঃ কি ভুলে গিয়েছেন না একটি অপরটিকে রহিত করে দিয়েছে।দেখুন "التمهيد" (খঃ২৪ পৃঃ১৯০)।
তবে এতটুকু বিষয় রহিত হওয়ার দাবি করার জন্যে যথেষ্ট নয়।যদিও আল্লামা مازري ও কাযী ইয়ায রহঃ কারো কারো থেকে নাসখের বিষয়টি নকল করেছেন।
কিন্তু পরবর্তী মুহাদ্দিসিনে কেরামগণ তা প্রত্যাখ্যান করেন।যেমন ইমাম নববী রহঃ তার মুসলিম শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ "المنهاج شرح صحيح مسلم بن الحجاج"- এ বলেন,
"قال جمهور العلماء: يجب الجمع بين هذين الحديثين، وهما صحيحان
অর্থাৎ অধিকাংশ উলামায়ে কেরামগণ বলেন, উভয় ধরনের হাদীসগুলোর মাঝে সমন্বয় সাধন করতে হবে যেহেতু দুইটিই সহীহ।
তাছাড়া ইবনে হাজার আসলাকানী রহঃও বলেছেন,
"وأما دعوى النسخ فمردودة؛ لأنَّ النسخ لا يُصار إليه بالاحتمال، ولا سيما مع إمكان الجمع".
অর্থাৎ রহিত হওয়ার দাবিটি অগ্রহণযোগ্য।কেননা শুধুমাত্র সম্ভাবনার দ্বারা রহিত সাব্যস্ত হয়না। বিশেষ করে যেখানে সমন্বয় সাধন করা সম্ভব।
(ফাতহুল বারী)
এবার তৃতীয় পদ্ধতিটির দিকে লক্ষ্য করা যাক।হ্যা এগুলোর মাঝে সমন্বয় সাধন সম্ভব।কিন্তু কিভাবে?
এটার উত্তর আমরা জানবো সালাফদের থেকে।
তার আগে বলে নেই,যেহেতু সমন্বয় সাধন সম্ভব তাই দ্বিতীয় পদ্ধতি(প্রাধান্যদান) অবলম্বনের আর প্রয়োজন হবেনা।যদিও কেউ কেউ সেই পন্থাও অবলম্বন করেছেন।
সালাফগণ যেভাবে এখানে সমন্বয় করেছেন-
(১)
"معالم السنن" প্রণেতা আল্লামা খাত্তাবী রহঃ(মৃঃ৩৮৮হিঃ) তাঁর বিখ্যাত কিতাব "أعلام الحديث"(৩/২১১৮)-এ বলেন,
قوله:لا عدوى، يريد أن شيئا لا يعدي من قبل ذاته و طبعه وما كان من ضرر و فساد فإنما هو بمشيئة الله تعالى و قضائه وقدره. اه
অর্থাৎ হাদিসের মাঝে যে,"রোগের কোন সংক্রমণ নেই" মর্মে বলা হয়েছে,তাতে রাসুলুল্লাহ সাঃ-র উদ্দেশ্য হলো,
কোন রোগেরই স্বত্ত্বাগত ও স্বভাবজাত সংক্রমণের ক্ষমতা নেই।তাতে যে ক্ষয়ক্ষতির বিষয় রয়েছে তা আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা ও ফায়সালার নিয়ন্ত্রণাধীন।
(২)
ইমাম আবু বকর বাকিল্লানী মালেকী রহঃ (মৃঃ৪০৩হিঃ) বলেন,
إثبات العدوى في الجذام ونحوه مخصوص من عموم نفي العدوى، قال: فيكون معنى قوله: " لا عدوى" أي: إلا من الجذام والبرص والجرب مثلا، قال: فكأنه قال: لا يعدي شيء شيئا إلا ما تقدم تبييني له أن فيه العدوى. وقد حكى ذلك ابن بطال أيضا.
অর্থাৎ কুষ্ঠ ও এর মত অন্যান্য রোগের ক্ষেত্রে সংক্রমণ সাব্যস্তকরনের বিষয়টিকে সংক্রমণ অস্বীকার করার সার্বজনীনতা থেকে আলাদা করা হয়েছে।(অর্থাৎ সাধারণভাবে সংক্রমনকে অস্বীকার করা হলেও কুষ্ঠ,
খোশপাচড়া ইত্যাদি এর ব্যতিক্রম।)
সে হিসেবে "রোগের কোন সংক্রমণ নেই" এর অর্থ হবে,
রোগের সংক্রমণ নেই,তবে কুষ্ঠ,খোশপাচড়া ইত্যাদির ব্যাপারটা ভিন্ন।এগুলোতে সংক্রমণ আছে।
ইবনে বাত্তাল রহঃও এমনটাই বর্ণনা করেছেন।
ফাতহুল বারী(খঃ১০পৃঃ১৬০)৫৭০৭ নং হাদিসের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
(৩)
ইমাম বায়হাক্বী রহঃ (মৃঃ৪৫৮ হিঃ)তার "السنن الصغير"-এ বলেন,
ﻭﺃﻣﺎ ﻗﻮﻟﻪ ﺻﻠﻰ اﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ: «ﻻ ﻋﺪﻭﻯ» ﻓﺈﻧﻪ ﺃﺭاﺩ ﻭاﻟﻠﻪ ﺃﻋﻠﻢ ﻋﻠﻰ اﻟﻮﺟﻪ اﻟﺬﻱ ﻛﺎﻧﻮا ﻳﻌﺘﻘﺪﻭﻥ ﻓﻲ اﻟﺠﺎﻫﻠﻴﺔ ﻣﻦ ﺇﺿﺎﻓﺔ اﻟﻌﻤﻞ ﺇﻟﻰ ﻏﻴﺮ اﻟﻠﻪ ﺗﻌﺎﻟﻰ، ﺛﻢ ﻗﺪ ﻳﺠﻌﻞ اﻟﻠﻪ ﺗﻌﺎﻟﻰ ﺑﺈﺭاﺩﺗﻪ ﻣﺨﺎﻟﻄﺔ اﻟﺼﺤﻴﺢ ﻣﻦ ﺑﻪ ﺷﻲء ﻣﻦ ﻫﺬﻩ اﻟﻌﻴﻮﺏ ﺳﺒﺒﺎ ﻳﺤﺪﺛﻮﻧﻪ ﺑﻪ، ﻭﻗﺪ ﻗﺎﻝ اﻟﻨﺒﻲ ﺻﻠﻰ اﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ: «ﻻ ﻳﺮﺩ ممرﺽ ﻋﻠﻰ ﻣﺼﺢ، ﻭﺑﺎﻟﻠﻪ اﻟﻌﺼﻤﺔ»
অর্থাৎ রাসুলুল্লাহর কথা-,"রোগের কোন সংক্রমণ নেই"
এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল,জাহেলি যুগে আরবরা যে অর্থে তা বিশ্বাস করত সে অর্থে সংক্রমণ নেই।তারা সংক্রমণের বিষয়টিকে গায়রুল্লাহর দিকে সম্বন্ধযুক্ত করত।
(অথচ সংক্রমণসহ সকল কাজ একমাত্র আল্লাহর হুকুমেই সংঘটিত হয়ে থাকে)
হ্যা কখনো আল্লাহ তায়ালা সুস্থ মানুষের জন্য এই ধরনের সংক্রমণ ব্যাধিগ্রস্ত মানুষের সংশ্রবকে তার মাঝেও রোগ সংক্রমিত হওয়ার মাধ্যম বা কারণ বানান।তাইতো রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন,অসুস্থ উটকে কেউ যেন সুস্থ উটের কাছে নিয়ে না যায়।
আসসুনানুস সগির লিল বায়হাকী(খঃ৩ পৃঃ৬৫) ২৫১৫ নং হাদিস সংশ্লিষ্ট আলোচনা দ্রষ্টব্য।
(৪)
মালেকী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ইমাম কাযী ইয়ায রহঃ(মৃঃ৫৪৪ হিঃ) বলেন,
والصحيح الذي عليه الأكثر ويتعين المصير إليه أن لا نسخ، بل يجب الجمع بين الحديثين وحمل الأمر باجتنابه والفرار منه على الاستحباب والاحتياط، والأكل معه على بيان الجواز
(এব্যাপারে)সঠিক সিদ্ধান্ত যা অধিকাংশ উলামায়ে কেরামগণ গ্রহণ করেছেন ও সবারই যা মেনে নিতে হবে তাহলো,নাসখের দাবী করা যাবেনা বরং উভয় হাদিসের মাঝে সমন্বয় সাধন করা জরুরি।এবং "কুষ্ঠরোগীর সংশ্রব থেকে বেঁচে থাকা" ও "তার কাছ থেকে পলায়ন করা"-র বিষয়টিকে "সাবধানতা ও মুস্তাহাব হওয়া"-র সাথে আর "তার সঙ্গে খাওয়া"র বিষয়টিকে
"জায়েজ হওয়া"-র সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে।
ফাতহুল বারী(খঃ১০পৃঃ১৬০)
(৫)
আল্লামা ফজলুল্লাহ তুরবিশতী হানাফী রহঃ (মৃঃ৬৬১হিঃ) বলেন,
ﻭﺃﺭﻯ اﻟﻘﻮﻝ اﻟﺜﺎﻧﻲ ﺃﻭﻟﻰ اﻟﺘﺄﻭﻳﻠﻴﻦ ﻟﻤﺎ ﻓﻴﻪ ﻣﻦ اﻟﺘﻮﻓﻴﻖ ﺑﻴﻦ اﻷﺣﺎﺩﻳﺚ اﻟﻮاﺭﺩﺓ ﻓﻴﻪ، ﺛﻢ ﻷﻥ اﻟﻘﻮﻝ اﻷﻭﻝ ﻳﻔﻀﻲ ﺇﻟﻰ ﺗﻌﻄﻞ اﻷﺻﻮﻝ اﻟﻄﺒﻴﺔ، ﻭﻟﻢ ﻳﺮﺩ اﻟﺸﺮﻉ ﺑﺘﻌﻄﻴﻠﻬﺎ، ﺑﻞ ﻭﺭﺩ ﺑﺈﺛﺒﺎﺗﻬﺎ
.............
ﻭﻻ ﺳﺒﻴﻞ ﺇﻟﻰ اﻟﺘﻮﻓﻴﻖ ﺑﻴﻦ ﻫﺬﻳﻦ اﻟﺤﺪﻳﺜﻴﻦ ﺇﻻ ﻣﻦ ﻫﺬا اﻟﻮﺟﻪ: ﺑﻴﻦ ﺑﺎﻷﻭﻝ اﻟﺘﻮﻗﻲ ﻣﻦ ﺃﺳﺒﺎﺏ اﻟﺘﻠﻒ، ﻭﺑﺎﻟﺜﺎﻧﻲ اﻟﺘﻮﻛﻞ ﻋﻠﻰ الله ﺟﻞ ﺟﻼﻟﻪ، ﻭﻻ ﺇﻟﻪ ﻏﻴﺮﻩ ﻓﻲ ﻣﺘﺎﺭﻛﺔ اﻷﺳﺒﺎﺏ ﻭﻫﻮ ﺣﺎﻟﻪ اﻩـ
অর্থাৎ আমি মনে করি,এখানকার দ্বিতীয় মতটিই সর্বোত্তম ব্যাখ্যা।যেহেতু এরদ্বারা এপ্রসঙ্গে বর্ণিত সবগুলো হাদিসের মাঝে সমন্বয় সম্ভব হয়।তাছাড়া প্রথম মতটি মানলে "চিকিৎসা শাস্ত্রীয়" মূলনীতিসমুহ অর্থহীন হয়ে যায়।অথচ শরীয়ত এগুলোকে বেকার করে দেয়ার কথা বলেনি বরং এগুলোকে সত্যায়ন করেছে।..........
উভয় হাদিসের মাঝে সমন্বয় কেবল এভাবে হতে পারে যে,প্রথম হাদিসের মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ সাঃ আমাদের জন্যে ক্ষতির 'মাধ্যম বা উপকরণ' সমুহ থেকে বেঁচে থাকার কথা বর্ণনা করেছেন আর দ্বিতীয় হাদিসের মাধ্যমে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলের বিবরণ দিয়েছেন।
"مرقاة المفاتيح" (খঃ৭পৃঃ২৮৯)।
(৬)
ইমাম নববী রহঃ(মৃঃ৬৭৬ হিঃ)তাঁর মুসলিম শরীফের ব্যাখাগ্রন্থ"المنهاج شرح صحيح مسلم بن الحجاج"
(খঃ১৪পৃঃ২১৩)-এ বলেন,
ﻗﺎﻝ ﺟﻤﻬﻮﺭ اﻟﻌﻠﻤﺎء ﻳﺠﺐ اﻟﺠﻤﻊ ﺑﻴﻦ ﻫﺬﻳﻦ اﻟﺤﺪﻳﺜﻴﻦ ﻭﻫﻤﺎ ﺻﺤﻴﺤﺎﻥ ﻗﺎﻟﻮا ﻭﻃﺮﻳﻖ اﻟﺠﻤﻊ ﺃﻥ ﺣﺪﻳﺚ ﻻﻋﺪﻭﻯ اﻟﻤﺮاﺩ ﺑﻪ ﻧﻔﻲ ﻣﺎ ﻛﺎﻧﺖ اﻟﺠﺎﻫﻠﻴﺔ ﺗﺰﻋﻤﻪ ﻭﺗﻌﺘﻘﺪﻩ ﺃﻥ المرض و العاهة ﺗﻌﺪﻯ ﺑﻄﺒﻌﻬﺎ ﻻﺑﻔﻌﻞ اﻟﻠﻪ ﺗﻌﺎﻟﻰ ﻭﺃﻣﺎ ﺣﺪﻳﺚ ﻻﻳﻮﺭﺩ ﻣﻤﺮﺽ ﻋﻠﻰ ﻣﺼﺢ ﻓﺄﺭﺷﺪ ﻓﻴﻪ ﺇﻟﻰ ﻣﺠﺎﻧﺒﺔ ﻣﺎ ﻳﺤﺼﻞ اﻟﻀﺮﺭ ﻋﻨﺪﻩ ﻓﻲ اﻟﻌﺎﺩﺓ ﺑﻔﻌﻞ اﻟﻠﻪ ﺗﻌﺎﻟﻰ ﻭﻗﺪﺭﻩ ﻓﻨﻔﻰ ﻓﻲ اﻟﺤﺪﻳﺚ اﻷﻭﻝ اﻟﻌﺪﻭﻯ ﺑﻄﺒﻌﻬﺎ ﻭﻟﻢ ﻳﻨﻒ ﺣﺼﻮﻝ اﻟﻀﺮﺭ ﻋﻨﺪ ﺫﻟﻚ ﺑﻘﺪﺭ اﻟﻠﻪ ﺗﻌﺎﻟﻰ ﻭﻓﻌﻠﻪ ﻭﺃﺭﺷﺪ ﻓﻲ اﻟﺜﺎﻧﻲ ﺇﻟﻰ اﻻﺣﺘﺮاﺯ ﻣﻤﺎ ﻳﺤﺼﻞ ﻋﻨﺪﻩ اﻟﻀﺮﺭ ﺑﻔﻌﻞ اﻟﻠﻪ ﻭﺇﺭاﺩﺗﻪ ﻭﻗﺪﺭﻩ ﻓﻬﺬا اﻟﺬﻱ ﺫﻛﺮﻧﺎﻩ ﻣﻦ ﺗﺼﺤﻴﺢ اﻟﺤﺪﻳﺜﻴﻦ ﻭاﻟﺠﻤﻊ ﺑﻴﻨﻬﻤﺎ ﻫﻮ اﻟﺼﻮاﺏ اﻟﺬﻱ ﻋﻠﻴﻪ ﺟﻤﻬﻮﺭ اﻟﻌﻠﻤﺎء ﻭﻳﺘﻌﻴﻦ
اﻟﻤﺼﻴﺮ ﺇﻟﻴﻪ
অর্থাৎ অধিকাংশ ওলামায়ে কেরামগণ বলেন, উভয় হাদীসের মাঝে সমন্বয় করা জরুরী,যেহেতু উভয় হাদীসই সহীহ।আর সমন্বয় করার পদ্ধতি হলো,"রোগের সংক্রমণ নেই" এই হাদীসের দ্বারা এই অর্থ নেয়া যে, এর দ্বারা জাহেলী যুগের মানুষের লালন করা ধারণা ও বিশ্বাসকে দূরকরা উদ্দেশ্য।
তারা বিশ্বাস করতো, রোগব্যাধি আল্লাহ পাকের সৃষ্টির মাধ্যমে নয়, বরং নিজস্ব ক্ষমতায় সংক্রমিত হয়। আর "অসুস্থ উটের মালিক যেন কিছুতেই তার উটকে সুস্থ উটের সাথে না রাখে" এই হাদীস দ্বারা এটি নির্দেশ করা উদ্দেশ্য যে, সুস্থ ও অসুস্থ পরস্পর সংস্পর্শে অবস্থানের দ্বারা কার্য-কারণ হিসেবে যে ক্ষতি পৌঁছে তাও আল্লাহ পাকের কুদরত ও তাঁরই কার্যের দ্বারা হয়।
প্রথম হাদীসে নিজ ক্ষমতায় রোগ ছড়িয়ে যাওয়াকে নফী করা উদ্দেশ্য, কিন্তু পরস্পর পরস্পরের সংস্পর্শের দ্বারা আল্লাহ পাকের কুদরত ও ফায়সালা হিসেবে ক্ষতি হওয়াকে অস্বীকার করা উদ্দেশ্য নয়। আর দ্বিতীয় হাদীস দ্বারা রোগির সংস্পর্শের মাধ্যমে আল্লাহ পাকের ইরাদা, কুদরত ও ফায়সালায় যে ক্ষতি পৌঁছার সম্ভাবনা, তা থেকে বেঁচে থাকার উপদেশ দেয়া হয়েছে।
(৭)
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী রহঃ তাঁর বুখারীর বিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ "عمدة القاري"(খঃ21পৃঃ২৪৭)-তে আরো কিছু ব্যাখ্যার সঙ্গে নিম্নোক্ত ব্যাখ্যাটিও তুলে ধরেন,
ﺃﻥ ﻫﺬﻩ اﻷﻣﺮاﺽ ﻻ ﺗﻌﺪﻱ ﺑﻄﺒﻌﻬﺎ، ﻭﻟﻜﻦ اﻟﻠﻪ ﺗﻌﺎﻟﻰ ﺟﻌﻞ ﻣﺨﺎﻟﻄﺔ اﻟﻤﺮﻳﺾ ﺑﻬﺎ ﻟﻠﺼﺤﻴﺢ ﺳﺒﺒﺎ ﻹﻋﺪاﺋﻪ ﻣﺮﺿﻪ، ﺛﻢ ﻗﺪ ﻳﺘﺨﻠﻒ ﺫﻟﻚ ﻋﻦ ﺳﺒﺒﻪ ﻛﻤﺎ ﻓﻲ ﺳﺎﺋﺮ اﻷﺳﺒﺎﺏ. ﻓﻔﻲ اﻟﺤﺪﻳﺚ اﻷﻭﻝ ﻧﻔﻲ ﻣﺎ ﻛﺎﻥ ﻳﻌﺘﻘﺪﻩ اﻟﺠﺎﻫﻠﻲ ﻣﻦ ﺃﻥ ﺫﻟﻚ ﻳﻌﺪﻱ ﺑﻄﺒﻌﻪ، ﻭﻟﻬﺬا ﻗﺎﻝ: ﻓﻣﻦ ﺃﻋﺪﻯ اﻷﻭﻝ؟ ﻭﻓﻲ ﻗﻮﻟﻪ: (ﻓﺮ ﻣﻦ اﻟﻤﺠﺬﻭﻡ) ﺃﻋﻠﻢ ﺃﻥ اﻟﻠﻪ ﺗﻌﺎﻟﻰ ﺟﻌﻞ ﺫﻟﻚ ﺳﺒﺒﺎ، ﻓﺤﺬﺭ ﻣﻦ اﻟﻀﺮﺭ اﻟﺬﻱ ﻳﻐﻠﺐ ﻭﺟﻮﺩﻩ ﻋﻨﺪ ﻭﺟﻮﺩﻩ ﺑﻔﻌﻞ اﻟﻠﻪ ﻋﺰ ﻭﺟﻞ
অর্থাৎ এসকল রোগ স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংক্রমিত হতে পারেনা।কিন্তু আল্লাহ তায়ালা সুস্থ ব্যাক্তির জন্যে অসুস্থ ব্যাক্তির সংশ্রবকে তার দিকে রোগ সংক্রমিত হওয়ার মাধ্যম বানিয়েছেন।তবে কখনো মাধ্যম বা উপকরণ পাওয়া যাওয়ার পরও রোগের সংক্রমণ হয়না যেমনটা অন্যান্য কার্য-কারণের ক্ষেত্রেও মাঝে মাঝে হয়ে থাকে।
সুতরাং প্রথম হাদিসে জাহেলি যুগের লোকদের রোগের "স্বয়ংক্রিয় সংক্রমণ"এর বিশ্বাসকে দূর করা হয়েছে।
তাইতো তিনি বলেছেন,"তাহলে প্রথম উটটিকে কে সংক্রমিত করলো?"
অপরদিকে "কুষ্ঠরোগি থেকে পলায়ন কর" বলে একথা জানিয়ে দিলেন যে,আল্লাহ তায়ালা এটাকে রোগ সংক্রমণের জন্যে মাধ্যম বানিয়েছেন।তাই আল্লাহর কুদরতে সংশ্রবের মাধ্যমে রোগ সংক্রমিত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থেকে ভয় দেখিয়েছেন।
(৮)
আল্লামা ক্বাসত্বাল্লানী রহঃ (মৃঃ ৯২৩হিঃ) তার বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ إرشاد الساري(খঃ৮ পৃঃ৩৭৪)তে নিম্নোক্ত ব্যাখ্যাটিও উল্লেখ ধরেন,
ﻭﺃﺟﻴﺐ: ﺑﺄﻥ اﻟﻤﺮاﺩ ﺑﻨﻔﻲ اﻟﻌﺪﻭﻯ ﺃﻥ ﺷﻴﺌﺎ ﻻ ﻳﻌﺪﻱ ﺑﻄﺒﻌﻪ ﻧﻔﺴﺎ ﻟﻤﺎ ﻛﺎﻧﺖ اﻟﺠﺎﻫﻠﻴﺔ ﺗﻌﺘﻘﺪﻩ ﻣﻦ ﺃﻥ اﻷﻣﺮاﺽ ﺗﻌﺪﻱ ﺑﻄﺒﻌﻬﺎ ﻣﻦ ﻏﻴﺮ ﺇﺿﺎﻓﺔ ﺇﻟﻰ اﻟﻠﻪ ﺗﻌﺎﻟﻰ ﻛﻤﺎ ﺳﺒﻖ، ﻓﺄﺑﻄﻞ -ﺻﻠﻰ اﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ- اﻋﺘﻘﺎﺩﻫﻢ ﺫﻟﻚ ﻭﺃﻛﻞ ﻣﻊ اﻟﻤﺠﺬﻭﻡ ﻟﻴﺒﻴﻦ ﻟﻬﻢ ﺃﻥ اﻟﻠﻪ ﺗﻌﺎﻟﻰ ﻫﻮ اﻟﺬﻱ ﻳﻤﺮﺽ ﻭﻳﺸﻔﻲ ﻭﻧﻬﺎﻫﻢ ﻋﻦ اﻟﺪﻧﻮ ﻣﻦ اﻟﻤﺠﺬﻭﻡ ﻟﻴﺒﻴﻦ ﺃﻥ ﻫﺬا ﻣﻦ اﻷﺳﺒﺎﺏ اﻟﺘﻲ ﺃﺟﺮﻯ اﻟﻠﻪ اﻟﻌﺎﺩﺓ ﺑﺄﻧﻬﺎ ﺗﻔﻀﻲ ﺇﻟﻰ ﻣﺴﺒﺒﺎﺗﻬﺎ ﻓﻔﻲ ﻧﻬﻴﻪ ﺇﺛﺒﺎﺕ اﻷﺳﺒﺎﺏ ﻭﻓﻲ ﻓﻌﻠﻪ ﺇﺷﺎﺭﺓ ﺇﻟﻰ ﺃﻧﻬﺎ ﻻ ﺗﺴﺘﻘﻞ ﺑﻞ اﻟﻠﻪ ﻫﻮ اﻟﺬﻱ ﺇﻥ ﺷﺎء ﺳﻠﺒﻬﺎ ﻗﻮاﻫﺎ ﻓﻼ ﺗﺆﺛﺮ ﺷﻴﺌﺎ ﺇﻥ ﺷﺎء ﺃﺑﻘﺎﻫﺎ ﻓﺄﺛﺮﺕ ﻭﻋﻠﻰ ﻫﺬا ﺟﺮﻯ ﺃﻛﺜﺮ اﻟﺸﺎﻓﻌﻴﺔ
অর্থাৎ(এসকল হাদিসে বাহ্যিক সংঘর্ষের)উত্তর এভাবে দেয়া হয় যে, সংক্রমণ অস্বীকার করা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো,কোন রোগই নিজ ক্ষমতায় সংক্রমিত হতে পারেনা।যেহেতু জাহেলি যুগে লোকেরা বিশ্বাস করতো,আল্লাহর হুকুম ছাড়া রোগ নিজে নিজে সংক্রমিত হতে পারে;তাই রাসুলুল্লাহ সাঃ তাদের সেই বিশ্বাস বাতিল করে দেন এবং কুষ্ঠরোগীর সাথে আহার করেন।যেন তাদের সামনে এবিষয়টি স্পষ্ট করতে পারেন যে, একমাত্র আল্লাহ তায়া’লাই রোগ দেন ও আরোগ্য দান করেন।আবার সাহাবায়ে কেরামকে কুষ্ঠরোগীর কাছে যেতে নিষেধ করেন এটা বয়ান করার জন্যে যে,ব্যাধিগ্রস্ত লোকের সংশ্রব ঐসকল 'কারণ'এর অন্তর্ভুক্ত যেগুলোর মাঝে আল্লাহ তায়ালা এই নিয়ম জারি করে দিয়েছেন যে,
এই 'কারণ'গুলি(যেমন-রোগির সংশ্রব) তার ফলাফল(যেমন-রোগের সংক্রমণ)এর দিকে পৌছে দিবে।সুতরাং 'সংক্রমণকে অস্বীকার' দ্বারা এর কারণ বা উপকরণকে প্রমাণ করেছেন।অপরদিকে নিজের কাজের মাধ্যমে একথার দিকে ইঙ্গিত করেছেন যে,এটা স্বয়ংক্রিয় নয়।আল্লাহ তায়ালা চাইলে এর শক্তি ছিনিয়ে নিতে পারেন ফলে তা আর ক্রিয়াশীল থাকবেনা।আবার চাইলে বাকি রাখতে পারেন যার ফলে তা প্রভাব বিস্তার করবে।
অধিকাংশ শাফেয়ী উলামায়ে কেরাম এই মতটিই গ্রহণ করেছেন।
(৯)
মোল্লা আলী কারী হানাফী রহঃ(মৃঃ ১০১৪হিঃ)তার মেশকাত শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ "مرقاة المفاتيح"-র
(খঃ৭ পৃঃ২৮৯৩) মাঝে 'রোগ সংক্রমণ' সংক্রান্ত বর্ণনার ক্ষেত্রে ইবনে হাজার আসলাকানী রহঃ-র মত উল্লেখ করে বলেন,
ﻭﻋﻠﻰ ﻛﻞ ﺗﻘﺪﻳﺮ، ﻓﻼ ﺩﻻﻟﺔ ﺃﺻﻼ ﻋﻠﻰ ﻧﻔﻲ اﻟﻌﺪﻭﻯ ﻣﺒﻴﻨﺎ
কোন অবস্থাতেই হাদীসগুলো সুস্পষ্টভাবে সংক্রমণ না হওয়াকে প্রমাণ করেনা।
এরপর তিনি আল্লামা তুরবিশতী রহঃ-র মত(যা আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি) তুলে ধরে বলেন,
ﻭﻫﻮ ﺟﻤﻊ ﺣﺴﻦ ﻓﻲ ﻏﺎﻳﺔ اﻟﺘﺤﻘﻴﻖ، ﻭاﻟﻠﻪ ﻭﻟﻲ اﻟﺘﻮﻓﻴﻖ
এটি খুবই সুন্দর সমন্বয় যা তাহকিকের উচ্চমার্গে
অবস্থিত।
(১০)
আল্লামা আব্দুর রওফ আলমুনাভী রহঃ(মৃঃ১০৩১) সুয়ুতী রহঃ-র الجامع الصغير এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ فيض القدير
(খঃ৬পৃ৪৩৪)-এ বলেন,
ﻗﺎﻝ اﻟﻘﺎﺿﻲ: ﻭاﻟﻤﺮاﺩ ﺑﻘﻮﻟﻪ ﻻ ﻋﺪﻭﻯ ﺇﻟﺦ ﺃﻥ ﻣﺼﺎﺣﺒﺔ اﻟﻤﻌﻠﻮﻝ ﻭﻣﺆاﻛﻠﺘﻪ ﻻ ﺗﻮﺟﺐ ﺣﺼﻮﻝ ﺗﻠﻚ اﻟﻌﻠﺔ ﻭﻻ ﺗﺆﺛﺮ ﻓﻴﻬﺎ ﻟﺘﺨﻠﻔﻪ ﻋﻦ ﺫﻟﻚ ﻃﺮﺩا ﻭﻋﻜﺴﺎ ﻟﻜﻨﻬﺎ ﺗﻜﻮﻥ ﻣﻦ اﻷﺳﺒﺎﺏ اﻟﻤﻘﺪﺭﺓ اﻟﺘﻲ ﺗﻌﻠﻘﺖ اﻟﻤﺸﻴﺌﺔ ﺑﺘﺮﺗﺐ اﻟﻌﻠﺔ ﻋﻠﻴﻬﺎ ﺑﺎﻟﻨﺴﺒﺔ ﺇﻟﻰ ﺑﻌﺾ اﻷﺑﺪاﻥ ﺇﺣﺪاﺙ اﻟﻠﻪ ﺗﻌﺎﻟﻰ ﻓﻌﻠﻰ اﻟﻌﺎﻗﻞ اﻟﺘﺤﺮﺯ ﻋﻨﻬﺎ ﻣﺎ ﺃﻣﻜﻦ ﺑﺘﺤﺮﺯﻩ
عن اﻷﻃﻌﻤﺔ اﻟﻀﺎﺭﺓ ﻭاﻷﺷﻴﺎء اﻟﻤﺨﻮﻓﺔ
অর্থাৎ কাযী ইয়ায রহঃ বলেন,"রোগের সংক্রমণ নেই" এটা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো,অসুস্থ ব্যাক্তির সাথে উঠা-বসা,খাওয়া-দাওয়া আবশ্যিক ভাবে সেই রোগের সংক্রমণ ঘটায়না।কেননা ফলাফল সবদিক থেকেই এগুলোর অনুগামী হয়না।তবে এগুলো(অসুস্থ ব্যাক্তির সাথে উঠা-বসা,খাওয়া-দাওয়া)আল্লাহ কতৃক নির্ধারিত ঐ সকল উপকরণের অন্তর্ভুক্ত যেগুলোর সাথে আল্লাহর ইচ্ছা যুক্ত হয়ে কোন কোন দেহে সংক্রমণ সৃষ্টি করে।
তাই বুদ্ধিমান ব্যাক্তির উচিত, ক্ষতিকর খাদ্য,বিপজ্জনক বস্তু ইত্যাদির ব্যাপারে সতর্ক থাকার মাধ্যমে যথাসম্ভব এগুলো থেকেও বেঁচে থাকা।
(১১)
শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহঃ(মৃঃ ১১৭৬হিঃ)
তার বিখ্যাত কিতাব "حجة الله البالغة"-য় বলেন,
و نفي العدوى: لا بمعنى نفي أصلها، ولكن العرب يظنونها سببا مستقلا وينسون التوكل رأسا.
অর্থাৎ (হাদিসে) সংক্রমণকে অস্বীকার করা এই অর্থে নয় যে সংক্রমনের কোন অস্তিত্বই নেই।বরং আরবরা একে স্বয়ংসম্পূর্ণ সবব(কারন) মনে করতো এবং তাওয়াক্কুলের বিষয়টি পুরোপুরি ভুলে যেতো।(তাই তাদের ভুল ধারণাটি এখানে খন্ডন করা হয়।)
আল্লামা সাঈদ আহমদ পালনপুরী (দামাত
বারাকাতুহুম) এর টীকায় লিখেন,
সংক্রমণের অর্থ হলো রোগ রোগী থেকে সুস্থ ব্যক্তির শরীরে স্থানান্তরিত হওয়া।আর মূল সংক্রমণকে অস্বীকার না করার অর্থ হলো, কখনও কখনও রোগ রোগী থেকে সুস্থ ব্যক্তির শরীরে স্থানান্তরিত হয়। এ জন্যই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কুষ্ঠ রোগী থেকে এমনভাবে পালাও যেভাবে সিংহ থেকে পলায়ন করে থাকো। অর্থাৎ কিছু রোগের ক্ষেত্রে রোগীর সাথে মিশ্রিত হওয়া রোগের কারণ হয়। কাজেই এসব ক্ষেত্রে মানুষের উচিত ঐ ধরনের রোগীর সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকা।
(হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা, হজরত সাঈদ আহমদ পালনপুরী দামাত বারাকাতুহুম এর টীকাসহ, মূল আরবী কিতাব, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৫৮১)
(১২)
ইমামুল আসর কাশ্মীরী রহঃ(মৃঃ১৩৫২ হিঃ) তাঁর বুখারী শরীফের আমালী "فيض الباري" (খঃ৬পৃঃ51)-তে এপ্রসঙ্গে আশআরী ও মাতুরিদী রহঃ-র আকীদা নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনার পর বলেন,
إذا علمت هذا ﻓﺎﻋﻠﻢ ﺃﻧﻬﻢ ﺍﺧﺘﻠﻔﻮﺍ ﻓﻲ ﺷﺮﺡ ﺍﻟﺤﺪيث،ﻓﻘﻴﻞ:ﺍﻥ ﻧﻔﻲ ﺍﻟﻌﺪﻭﻱ ﻣﺤﻤﻮﻝ ﻋﻠﻲ ﺍﻟﻄﺒﻊ ، ﺃﻱ ﻻ ﻋﺪﻭﻱ ﺑﺎﻟﻄﺒﻊ ، ﺃﻣﺎ ﺑﺠﻌﻞ ﺍﻟﻠﻪ ﺗﻌﺎﻟﻲ ﻓﻬﻮ ﺛﺎﺑﺖ . ﻭ ﺫﻛﺮﻭﺍ ﻟﻪ ﺷﺮﻭﺣﺎ ﺁﺧﺮ ﺃﻳﻀﺎ . ﻭﺍﻻﺻﻮﺏ ﻣﺎ ﺫﻛﺮﻩ ﺍﺑﻦ ﺍﻟﻘﻴﻢ ﻓﻲ ﺯﺍﺩ ﺍﻟﻤﻌﺎﺩ:ﺍﻥ ﺍﻟﻌﺪﻭﻱ ﺍﻟﻤﻨﻔﻲ ﻫﻮ ﺍﺗﺒﺎﻉ ﺍﻷﻭﻫﺎﻡ ﻓﻘﻂ ، ﺑﺪﻭﻥ ﺗﺴﺒﻴﺐ ﻓﻲ البين
অর্থাৎ ইহা যখন জানলে, তখন এটাও বুঝে নাও যে, তারা এর উপর ভিত্তি করে হাদীসগুলোর ব্যাখ্যার মাঝেও ইখতিলাফ করেন। তাই বলা হয়, সংক্রমণকে নফী করা দ্বারা নিজ ক্ষমতায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংক্রমিত হওয়ার ধারণাকে নফী করা উদ্দেশ্য। অর্থাৎ নিজ ক্ষমতায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে রোগ একজনের কাছ থেকে অন্য জনের শরীরে যায় না।তবে আল্লাহ পাকের সৃষ্টি করার মাধ্যমে সংক্রমণ হওয়ার বিষয়টি প্রমানিত ও প্রতিষ্ঠিত। তারা এর আরও অনেক ব্যাখ্যা বর্ণনা করেছেন।তবে সবচেয়ে সঠিক ব্যাখ্যা সেটিই যা ইমাম ইবনুল কায়্যিম রহঃ(মৃঃ৭৫১হিঃ) 'যাদুল মাআদ' কিতাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, যে সংক্রমনকে হাদীসে অস্বীকার করা হয়েছে তা হচ্ছে জাহেলি যুগের লোকদের ধারণাপ্রসুত অপবিশ্বাস। উভয়ের মাঝে মাঝে রোগ ছড়ানোর সবব-মুসাব্বাব হওয়া বা কার্য-কারণকে অস্বীকার করা হয়নি।
(১৩)
শাইখ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহঃ(মৃঃ ১৪১৭হিঃ) মোল্লা আলী কারী রহঃ এর "المصنوع في معرفة الحديث الموضوع" এর উপর করা তাঁর তা'লিকে বলেন,
معنى الحديث عندي:' لا عدوى يعني لا يعد بعضكم بعضا، أي: ليمتنع صاحب المرض المعدي عن مخالطة الأصحاء خشية أن يعديهم بتقدير الله و لفظة "لا" هنا للنهي،كقوله تعالى: فلا رفث ولا فسوق ولا جدال في الحج
অর্থাৎ আমার নিকট হাদিসটির অর্থ এরকম—
এখানে "لا عدوى" এর মাঝে "لا" অব্যয়টি "نفي"(না-বাচক) অর্থে নয়।বরং তা "نهي"(নিষেধ সূচক) অর্থ প্রদান করছে। সে হিসেবে হাদিসটির অর্থ-"কোন সংক্রমণ নেই,কুলক্ষন বলতে কিছু নেই"- এমন হবেনা। বরং এর অর্থ হবে-
"لا يعد بعضكم بعضا، ولا تطيروا"(তোমরা একে অপরকে সংক্রমিত করোনা,কুলক্ষণ গ্রহণ করোনা)। যেমনটি আমরা"فلا رفث ولا فسوق و لا جدال في الحج"আয়াতটির
মাঝে করে থাকি।সাধারণভাবে শাব্দিক বিচারে
আয়াতটির অর্থ হয়-"হজ্বের মাঝে কোন অশ্লীলতা, পাপাচার,বিবাদ-বিসংবাদ নেই" কিন্তু আমরা এটার অর্থ করে থাকি-"হজ্বের মাঝে অশ্লীলতা, পাপাচার, বিবাদ-বিসংবাদ করোনা"।
মোটকথা,হাদিসটির অর্থ হবে এরকম- সংক্রমণ ব্যাধিগ্রস্ত ব্যাক্তি যেন সুস্থ লোকদের সাথে উঠাবসা করা থেকে বিরত থাকে।কেননা এতে 'আল্লাহর হুকুমে' সুস্থ লোকদের মাঝেও রোগ সংক্রমিত হওয়ার আশংকা রয়েছে।
তো আমরা দেখতে পাচ্ছি,উপরোক্ত ব্যাখ্যাগুলির কোনটিই সংক্রমণকে অস্বীকার করছেনা।বরং সেগুলো আল্লাহর হুকুমে সংক্রমণ হওয়ার বিষয়টিকেই ঘুরেফিরে প্রমাণ করছে।তবে এর ভিন্ন কোন ব্যাখ্যা নেই, এমন দাবী আমরা করছিনা।বরং ভিন্ন ব্যাখ্যাও রয়েছে।এমন ব্যাখ্যাও রয়েছে যা সংক্রমণকে পুরোপুরি অস্বীকার করে।যেমনটি মিনহাজ,ফাতহুল বারী,উমদাতুল কারী,ইরশাদুস সারী,মিরকাত,ফায়যুল কাদীর প্রভৃতি শুরুহুল হাদিসের কিতাবগুলোতে এসেছে।
কিন্তু পরবর্তী মুহাক্কিকিন উলামায়ে কেরাম তা গ্রহণ করেননি।বরং তারা সংক্রমণ প্রমাণ করে এমন ব্যাখ্যাগুলোকেই সঠিক বলেছেন।যেমনটা আমরা উপরোল্লিখিত মোল্লা আলী কারী হানাফী রহঃ(মৃঃ ১০১৪হিঃ),শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহঃ(মৃঃ ১১৭৬হিঃ),ইমামুল আসর কাশ্মীরী রহঃ(মৃঃ১৩৫২ হিঃ),শাইখ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহঃ(মৃঃ ১৪১৭হিঃ)প্রমুখ উলামায়ে কেরামের মন্তব্যগুলোতে দেখতে পাই।
#আমরা যদি বিষয়টির আরেকটু গভীরে যাই তো দেখতে পাই,যেসকল উলামায়ে কেরাম সংক্রমণ নেই বলে মত প্রকাশ করেছেন;তাদের এরকম মত দানের পেছনে ভুমিকা রেখেছে মূলত একটি ভুল ধারণা।আর তাহলো-
তাঁরা মনে করতেন,কোন বস্তুর মাধ্যম বা উপকরণ হওয়ার অর্থ হলো,স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজ ক্ষমতায় কাজ করা।"মাধ্যম বা উপকরণের" সাথে যে "কুদরত"ও জমা হতে পারে,এই বিষয়টি তাদের অজ্ঞাত ছিল।মোটকথা দর্শন ও বিজ্ঞানের বিষয়ে তাদের জানাশোনা অন্য সবার মতো ছিলোনা।তাইতো আমরা দেখতে পাই, এখানে এসে ইমামুল আসর কাশ্মীরী রহঃ(মৃঃ১৩৫২ হিঃ)হাদিস শাস্ত্রে হাফেজ ইবনে হাজার রহঃ(মৃঃ ৮৫২হিঃ) এর যোগ্যতার স্বীকৃতি দিয়ে দর্শন শাস্ত্রে তার দখল না থাকার দাবী করে 'সংক্রমণের মাসআলা'য় তাঁর অবস্থানের নকদ(শাস্ত্রীয় সমালোচনা) করছেন।তিনি বলেন,
ونقل جوابًا عن الشيخ أبي عمرو بن الصلاح وقد أجاب الحافظ عن تعارض الحديثين في نفي العدوى، والفرار من المجذوم، بالوجهين
قلت: والحق أحق أنْ يُتَّبع أنَّ الحافظ حافظٌ فنَّه، ولا ريب، أما إن السببية الطبعية، ماذا هي في الفلسفة؟ وماذا ارتباطها بالقدرة؟ وأنها هل يمكن اجتماعها مع القدرة أو لا؟ فتلك أمور لا يعرفها الحافظ، ولم أدر من تصنيف من تصانيفه أنه كانت له يد في الفلسفة، وهكذا لابن تيمية أيضًا.
فإنَّه، وإن كان متبحرًا فيها، لكن كلامَه أيضًا منتشرٌ، ليس كالحاذِق في الفن، وقال الصفدي فيه: إن علمَه أكبرُ من عقله. .
অর্থাৎ হাফেজ ( ইবনে হাজার) রহঃ সংক্রমণকে অস্বীকার এবং কুষ্ঠ রোগী থেকে পলায়ন - এই উভয় হাদীসের মাঝে বৈপরীত্যের জবাব দিতে দুই সুরতের বর্ণনা দিয়েছেন, আবার এর পক্ষে হযরত আবু আমর ইবনুস সালাহ রহঃ(মৃঃ ৭৪৩হিঃ) থেকে জবাবও নকল করেছেন। আমি বলব, যা হক তাই অনুসৃত হওয়ার বেশি উপযুক্ত। হাফেজ রহঃ তাঁর নিজের ফন বা শাস্ত্রের হাফেজ—এতে কোন সন্দেহ নেই।কিন্তু-
একটি বস্তু স্বভাবজাতভাবে কোন কাজের জন্যে কারণ বা মাধ্যম হওয়ার ব্যাপারে ফিলোসোফি বা দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি কি?
'কুদরত'এর সাথে 'কারন বা মাধ্যম'এর সম্পর্ক কি?
'কুদরত'এর সাথে কারন বা মাধ্যম'এর একত্র হওয়া সম্ভব কিনা?
দর্শনের সাথে সম্পর্কিত এই প্রশ্নগুলোর উত্তর হাফেজ রহঃ জানতেন না।আবার আমি তাঁর কিতাবসমুহের মাঝে এমন কিছু পাইনি যার দ্বারা দর্শন শাস্ত্রে তাঁর দখল প্রমানিত হয়।
এমনটি ইবনে তাইমিয়া রহঃ(মৃঃ ৭২৮হিঃ)এর ক্ষেত্রেও ঘটেছে।তিনি যদিও এক্ষেত্রে বিশাল পান্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন,কিন্তু তাঁর কথাও এখানে বিক্ষিপ্ত।শাস্ত্রে অভিজ্ঞ ব্যাক্তির মতো নয়।তাঁর ব্যাপারে সফাদী রহঃ(মৃঃ৭৬৪হিঃ) বলেছেন,
علمه أكبر من عقله
তাঁর জানার পরিধি তাঁর বোধশক্তির চেয়ে বিশাল।
( ফয়জুল বারী, ৬ষ্ঠ খন্ড, ৬৩ পৃষ্ঠা।)
##রোগ সংক্রমণের এই বিষয়টা একই সাথে আকীদা ও চিকিৎসা উভয় শাস্ত্রের সাথেই সম্পর্ক রাখে।আর আমরা জানি, আকীদা সংক্রান্ত বিষয়াবলী প্রমাণিত হয় কোরআন-হাদিস দ্বারা পক্ষান্তরে চিকিৎসা শাস্ত্রীয় বিষয় প্রমাণিত হয় অভিজ্ঞতা,বাস্তবতার যাচাই ও
(চিকিৎসা শাস্ত্রীয়)পরিক্ষা-নীরিক্ষার দ্বারা।
তো আমাদের আলোচ্য বিষয়ে আমরা কোত্থেকে সিদ্ধান্ত নিব?
এটাতো একই সঙ্গে আকীদা ও চিকিৎসা উভয় শাস্ত্রের সাথেই সম্পর্ক রাখে?
বিষয়টি সহজে বুঝার জন্যে দুটা উদাহরণ দেই।
১.কোন পুরুষ যদি তার প্রশ্রাবের রাস্তা দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় তেল,পানি বা ঔষধ প্রবেশ করায় তার রোজা ভাঙ্গবে কি ভাঙ্গবে না,এটা নিয়ে ইমামদের মত হলো—
ইমাম আবু হানিফা রহঃ ও ইমাম মুহাম্মদ রহঃ এর মতে ভাঙ্গবে না, কিন্তু ইমাম আবু ইউসুফ রহঃ এর মতে ভাঙ্গবে।তিনি মনে করেছিলেন, মুত্রথলি ও অন্ত্রের মাঝে কোন পথ আছে, তাই ওখানে পানি,তেল এসব চলে যাওয়ার আশঙ্কায় তিনি রোজা ভাঙ্গবে বলেছেন।কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলেন, কোন পথ নেই।
তো ফিকহে হানাফির প্রসিদ্ধ গ্রন্থ البحر الرائق-এ (খঃ২পৃঃ৩০১) আল্লামা ইবনে নুজাইম রহঃ বলেন,
ﻫﺬا ﻟﻴﺲ ﻣﻦ ﺑﺎﺏ اﻟﻔﻘﻪ؛ ﻷﻧﻪ ﻣﺘﻌﻠﻖ ﺑﺎﻟﻄﺐ
এটা ফিকহের বিষয় না।কেননা এটা চিকিৎসা শাস্ত্রের সাথে সম্পর্কীত।
২.মাথার কোন ক্ষতস্থান দিয়ে যদি কোন ঔষধ ব্রেইনের ভেতরে চলে যায় রোজা ভাঙ্গবে কিনা?
আগেকার জমানার ফকীহগন বলেছেন, রোজা ভেঙে যাবে। মুফতি দেলোয়ার হোসেন দামাত বারাকাতুহুম তাঁর 'ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা' নামক কিতাবে এই প্রসঙ্গে বলেন, বর্তমান ফতোয়া হলো, ভাঙ্গবে না। কারণ তখনকার ডাক্তারগন মনে করতেন, ব্রেইন ও পাকস্থলীর মাঝে ছিদ্রপথ আছে। কিন্তু আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে,কোন ছিদ্রপথ নেই। তাই রোজা ভাঙ্গবে না।
প্রিয় সহপাঠী ডাঃ মাসীহুল্লাহ ভাই খুব সুন্দর বলেছেন,
আসলে সঠিক উপকারী বিজ্ঞান শাখাগত অনেক মাসআলায় সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। আর কোন ফিকহী কায়দা পরিবর্তন করে না বটে তবে সঠিক তথ্য সরবরাহ করার মাধ্যমে কোন্ মাসআলায় কোন্ কায়দা প্রযোজ্য হবে অনেক সময় তার নির্দেশনা দেয়।
এখন আমাদের আলোচ্য প্রসঙ্গে আসা যাক।
"রোগের সংক্রমণ" এটার সম্পর্ক কতটুকু আকীদার সাথে?
আর কতটুকু চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাথে?
যখন আমরা দেখতে পাচ্ছি,সংক্রমণ অস্বীকার করার মতো অকাট্য তো দূরের কথা স্পষ্ট কোন দলিলও নেই।আবার মুহাক্কিক উলামায়ে কেরামের এক জামাত এটাকে প্রমাণ করছেন।সেই সাথে যারা এটাকে অস্বীকার করেন তাদের ভুলটি কোথায়, তাও দেখিয়ে দিচ্ছেন।
অপরদিকে আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রের অনুজীব বিজ্ঞানীরা একেবারে অকাট্যভাবে রোগের সংক্রমণকে প্রমাণ করছেন;তখন নিশ্চিতভাবে বলাই যায়,
"ইসলাম রোগের সংক্রমণকে অস্বীকার করেনা।"
الله أعلم و علمه أتم و أحكم
#দ্বিতীয় টপিক
করোনার সংক্রমণকে ভয় করে এর প্রতিরোধের জন্য বিশেষ রকমের সতর্কতা অবলম্বন তকদীর-বিশ্বাস ও তাওয়াক্কুলের অন্তরায় কিনা?
সহজে বোধগম্য হওয়ার জন্যে আমরা এই প্রসঙ্গটিকে কয়েক ভাগে ভাগ করবো-
(ক)তাকদীর ও তাওয়াক্কুলের পরিচয়।
(খ)দুটি পরিভাষার সঙ্গে পরিচয়।
(গ)তাওয়াক্কুলের হাকিকত ও এর পরিধি।
(ঘ)কিছু সংশয় নিরসন।
(ক)তাকদীর ও তাওয়াক্কুলের পরিচয়।
তাকদীর মানে কী?একজন মুসলিম হিসেবে আমাকে বিশ্বাস করতে হবে যে, ছোট-বড় সকল বিষয় ও ঘটনা আল্লাহ তাআলা কর্তৃক নির্ধারিত। যা হয়েছে, তা হওয়ার ছিল; যা হয়নি, তা হওয়ার ছিল না। যা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত আছে, তা হবে; এবং যা নির্ধারিত নয়, তা কখনোই হবে না।
তাওয়াক্কুলের অর্থ হলো,সবকিছু পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর সোপর্দ করে দেয়া।তাঁর উপরেই ভরসা করা,আস্থা রাখা।
যার ফলে বান্দা মাখলুকের কাছে কি আছে সেদিকে না তাকিয়ে আল্লাহর কাছে কি আছে সেদিকে তাকাবে।সুখে-দুঃখে, সুস্থতায়-অসুস্থতায়, চলনে-বলনে,শয়নে-জাগরনে,ভেতরে-বাহিরে সর্বাবস্থায় তাঁর কাছেই আশ্রয় নিবে।শরীয়ত অনুমোদিত মাধ্যম-উপকরন গ্রহণ করবে,কিন্তু আস্থা-ভরসা থাকবে এসব মাধ্যম-উপকরনের সংঘটক আল্লাহর উপর।এবং বিশ্বাস করবে,এগুলোর কার্যকারিতা আল্লাহর হাতে,তিনি না চাইলে এগুলো কোনো কাজেই আসবেনা।যেমন আগুনের স্বভাবজাত প্রবনতা পোড়ানো হলেও ইবরাহীম আঃকে পোড়াতে পারেনি,পানির স্বভাবজাত প্রবনতা ডোবানো হলেও মূসা আঃকে তা ডোবাতে পারেনি।
(খ)দুটি পরিভাষার সঙ্গে পরিচয়।
১.আ'দাতুল্লাহ বা আল্লাহ তায়ালার ইউনিভার্সাল ল’।
একে আবার সুন্নাতুল্লাহও বলা হয়।অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা নানা জিনিসের মধ্যে নানা গুণাগুণ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। এগুলো তাঁর নির্দেশমতই একটা নিয়ম মেনে কাজ করে যায়।যেমন আগুনের জন্যে পুড়িয়ে ফেলা,পানির জন্য ভিজিয়ে দেয়া বা ডুবিয়ে দেয়া ইত্যাদি।
এখন আমরা যেহেতু এগুলোকে ব্যবহার করি, তাই আমাদেরকে এসবের গুনাগুন ও প্রবণতাগুলোর ব্যাপারে যথাসম্ভব শুদ্ধ অভিজ্ঞতা লাভ করতে হয়। এর মাধ্যমে নির্ণিত হয় এগুলোর ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার সুন্নত বা নিয়মটি কী।
২.কুদরাতুল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা অনেক সময় নানা উদ্দেশ্যে বিশেষ রকমের শক্তি প্রদর্শন করেন। নবীগণের জীবনে(মুজিজা হিসেবে) আল্লাহ তাআলা এই শক্তিকে প্রকাশ প্রকাশ করেছেন অধিক হারে। অনেক ওলীর ক্ষেত্রেও কারামাত হিসেবে তা প্রকাশিত হয়ে থাকে।
(গ)তাওয়াক্কুলের হাকিকত ও এর পরিধি।
বিন বায রহঃ এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন,
তাওয়াক্কুল হচ্ছে দুটি বস্তুর সমন্বিত রূপ।
এক,আল্লাহর উপর ভরসা করা।এবং বিশ্বাস রাখা,তিনিই সকল কার্যকারনের সংঘটক।তিনি যা লিখে রেখেছেন তা কার্যকর হবেই।
দুই,(শরীয়ত অনুমোদিত)মাধ্যম-উপকরন গ্রহণ।এগুলো ছেড়ে দেয়ার নাম তাওয়াক্কুল না,বরং তাওয়াক্কুল, আল্লাহর উপর ভরসা ও মাধ্যম-উপকরন গ্রহণ উভয়টিকেই অন্তর্ভুক্ত করে।
এরপর তিনি সুন্দর একটা উদাহরণ দেন,
কেউ যদি বলে আমি বিয়ে করবোনা।আল্লাহ আমাকে বিয়ে ছাড়াই সন্তান দিবেন;তবে অবশ্যই তাকে মানসিক রোগী হিসেবে গণ্য করা হবে।এমনিভাবে কেউ যদি কামাই-উপার্জন ছেড়ে ঘরে বা মসজিদে বসে থেকে সাদাকার অপেক্ষা করতে থাকে এটা শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈধও হবেনা তাওয়াক্কুলও হবেনা।বরং তার জন্যে হালাল রিযিক অন্বেষণ করা ওয়াজিব।
তাই আমরা আমাদের সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করে বাকিটা আল্লাহর উপর ছেড়ে দিব।আমার জন্যে যা কল্যাণকর হবে তিনি তাঁর ইলমে আযলীর মাধ্যমে সেটারই ফায়সালা করবেন।
# উসতাযে মুহতারাম মুফতী কেফায়াতুল্লাহ সাহেব (হাফিজাহুল্লাহ) একবার ক্লাসে দারুণ একটা কথা বলেছিলেন।হুবহু শব্দ মনে নেই, তবে মূল কথাটা এরকম-
আসলে আমরা যত আসবাবই গ্রহণ করি,একটা পর্যায়ে গিয়ে আমাদের বাকীটা আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়ে তাঁর উপরেই ভরসা করতে হয়।কৃষক ক্ষেতে মই দেয়,তাতে বীজ রোপন করে,সেচ দেয়,আগাছা পরিষ্কার করে,পাহারা দেয়। কিন্তু একসময় গিয়ে তার সব ছেড়ে আল্লাহর উপরেই ভরসা করতে হয়।এছাড়া তার সাধ্যে আর কিছু করারও থাকেনা।
আমরা নিজেদের দিকেই তাকাই।বেঁচে থাকার প্রয়োজনে আমাদের খাবার খেতে হয়।তাই আমরা উপার্জন করি।খাবার ক্রয় করি।এরপর আবার তা খাবার উপযোগী করার জন্যে রান্নাও করি।এরপর কি করি?
খাবার জন্যে মুখে নেই।চিবিয়ে গিলেও ফেলি।কিন্তু এরপর?
এপর্যন্ত পুরো ব্যাপারটার উপরেই আমার নিয়ন্ত্রণ ছিল।
কিন্তু খাবার খেয়ে ফেললেই কি শেষ?
এর পরের ধাপ?
খাবারটি জারক রসে গলিয়ে এর গুরুতর হজম প্রক্রিয়া, তারপর এর দরকারী অংশ রেখে বাকিটা আলাদা করে ঠিক জায়গামত পৌঁছানো, এরপর তা শরীরের বাইরে বের করা,এই সবটা প্রক্রিয়াই আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এটার জন্যেও শেষ পর্যন্ত আল্লাহর উপরেই ভরসা করতে হয়।
মোটকথা তিনি বোঝাতে চেয়েছেন,আমি আসবাব গ্রহণ করলাম মানেই একেবারে সব করে ফেললাম আল্লাহ কিছুই করেননি,এমনটা ভাবার সুযোগ নেই।
## দুনিয়া দারুল আসবাব।আল্লাহ একে এভাবেই সৃষ্টি করেছেন।আমাদেরও এটাকে সেভাবেই ব্যবহার করতে হবে।আমরা চাইলেও এই আসবাবের সার্কেল থেকে বের হতে পারবোনা।বিষয়টা সহজ করার জন্যে একটা উদাহরণ দেয়া যাক-
(উদাহরণটি সহজে বোধগম্য হওয়ার জন্যে নাম পুরুষ ব্যবহার করা হলো)
ধরুন আপনি কোন রকমের আসবাব ছাড়াই আল্লাহর উপর ভরসা করে রইলেন।কামাই করাও ছেড়ে
দিলেন।
এবার মনে করুন আপনার তাওয়াক্কুলের জোরে আল্লাহ তাঁর কোন বান্দার মনে ঢেলে দিলেন আর সে আপনাকে এক লাখ টাকা হাদিয়া দিয়ে গেলো।এবার?
এই টাকা দিয়ে আপনার পেট ভরবে?
তৃষ্ণা নিবারন হবে?
আচ্ছা ঠিকাছে ধরে নিলাম কেউ আপনাকে খাবার কিনে দিলো বা সরাসরি খাবার হাদিয়া নিয়ে এলো?
এরপর?
রান্না?
আচ্ছা ধরে নিলাম রান্না করা খাবারই দিয়ে গেলো?
এরপর?
এটাকে খাবার জন্যে মুখে দিতে হবেনা?
আচ্ছা কেউ একজন মুখেও তুলে দিলো?
এরপর চাবানো,জিহ্বা দিয়ে ঠেলে ভেতরে দেওয়া,গিলা?
এগুলোতো অন্যকেউ করে দিতে পারবেনা।
আবার দাত,জিহ্বা এগুলোওতো আসবাব?
আচ্ছা ধরে নিলাম খাবার দৈবক্রমে আপনার পেটে চলে গেলো?
কিন্তু এতেইকি শেষ?
এর হজম প্রক্রিয়া থেকে নিয়ে বাইরে বের হওয়া?
বাইরে বের করার জন্যেওতো আপনাকে শৌচাগারে যেতে হবে।আবার আসবাব।
###এবার দেখা যাক,রাসুলুল্লাহ সাঃ আসবাব গ্রহণের ব্যাপারে কি বলেছেন। আর নিজে কি করেছেন।
সুনানে তিরমিজিতে আনাস ইবনে মালেক রাঃ থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে।তিনি বলেন,
قَال رَجُلٌ : يَا رَسُولَ اللَّهِ،أَعْقِلُهَا
وَأَتَوَكَّلُ، أَوْ أُطْلِقُهَا وَأَتَوَكَّلُ ؟ قَالَ : " اعْقِلْهَا وَتَوَكَّلْ
একলোক রাসুলুল্লাহ সাঃকে জিজ্ঞেস করলো,ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি কি আমার উটটিকে বেধে এরপর আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করবো?নাকি তা ছেড়ে রেখে তাওয়াক্কুল করবো? তিনি ইরশাদ করলেন,তুমি সেটাকে বেঁধে তারপর তাওয়াক্কুল কর।
সুনানে তিরমিজি(হাদিস নংঃ২৫১৭)
এখানে আমাদের চিন্তা করা উচিত,উটটা বেধে রেখে দিলেই কি কাজ শেষ? উট বেধে রাখলেইকি এর নিরাপত্তা গ্যারান্টেড হয়ে যায়?উটটা বাধলাম মানে সবই আমি করে ফেললাম? আল্লাহ কিছুই করেননি?
عن يعمر العذري والد أبي خزامة: سألتُ رسولَ اللهِ ﷺ فقلتُ يا رسولَ اللهِ أرأيتَ رُقىً نسترْقيها ودواءً نتداوى به وتقاةً نتقِيها هل تردُّ من قدرِ اللهِ شيئًا قال هي منْ قدرِ اللهِ
الترمذي (٢٧٩ هـ)، سنن الترمذي ٢٠٦٥ • حسن صحيح
সুনানে তিরমিজিতে(২০৬৫) বর্ণিত আরেকটি হাদিস।
আবু খুযামা রাঃ-র পিতা ইয়া'মুর রাঃ বলেন,
আমি আল্লাহর রাসুলকে জিজ্ঞেস করলাম,ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমরা যে বিভিন্ন রকমের ঝাড়ঁফুক করি,ঔষধ ব্যাবহার করি সেই সাথে বিভিন্ন বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করি,এগুলো কি আল্লাহর নির্ধারণ করা ভাগ্যকে প্রতিরোধ করতে পারে?
তিনি বললেন,তোমার এই সকল কার্যকলাপও আল্লাহর তাকদিরেরই অংশ।
অর্থাৎ আমাদের আসবাব গ্রহণের বিষয়টাকে এভাবে দেখাই ভুল যে,এটা আল্লাহর তাকদিরকে পরিবর্তন বা প্রতিরোধ করবে।বরং আমাদের আসবাব গ্রহণের ব্যাপারটাও আল্লাহর বিশাল পরিকল্পনা "তাকদির"এরই একটি অংশ।
عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : " لَوْ أَنَّكُمْ كُنْتُمْ تَوَكَّلُونَ عَلَى اللَّهِ حَقَّ تَوَكُّلِهِ لَرُزِقْتُمْ كَمَا يُرْزَقُ الطَّيْرُ، تَغْدُو خِمَاصًا وَتَرُوحُ بِطَانًا
উমার রাঃ থেকে বর্ণিত আরেকটি প্রসিদ্ধ হাদিস যা আমরা আমাদের বয়ানে,তা'লিমে প্রায়ই শুনে থাকি।
রাসুলুল্লাহ সাঃ ইরশাদ করেন,যদি তোমরা আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করতে তবে অবশ্যই তোমাদেরকে এমনভাবে রিযিক দেয়া হত যেভাবে পাখিকে রিযিক দেয়া হয়।
সে সকালে খালি পেটে বের হয়ে সন্ধায় ভরপেটে ফিরে আসে।
সুনানে তিরমিজি(২৩৪৪),ইবনে মাজাহ(৪১৬৪),মুসনাদে আহমাদ(৩৭০),ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারককৃত 'কিতাবুয যুহদ' তাওয়াক্কুল ও তা'আইয়ুনের অধ্যায়,(পৃঃ১৯৬-১৯৭)।
বায়হাকী রহঃ(মৃঃ৪৫৮হিঃ) তার শুআবুল ঈমানে এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন,এই হাদিস কিছুতেই কামাই-রোজগার ছেড়ে ঘরে বসে থাকাকে প্রমাণ করেনা।
বরং তা রিযিক অন্বেষনকেই প্রমাণ করছে।কেননা পাখি ভোর বেলাতেই নীড় ছেড়ে বের হয়ে যায়।রিযিক তালাশ করে।তাই এখানে নবীজির উদ্দেশ্য হলো,(আল্লাহু আ'লাম) যদি তারা তাদের আচরণে,
চলাফেরায় আল্লাহর উপরেই ভরসা রাখতো এবং বিশ্বাস করতো,সকল কল্যাণ একমাত্র তাঁরই হাতে এবং তাঁরই পক্ষ হতে; তবে অবশ্যই তারাও সকাল বেলা খালি পেটে বের হয়ে সন্ধায় ভরপেটে ফিরে আসতো।কিন্তু তারাতো ভরসা করে তাদের নিজেদের শক্তির উপর সেইসাথে ধোকাবাজি করে,মিথ্যা বলে। এসবইতো তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী।
দলিলুল ফালেহিন(খঃ১ পৃঃ২৭২)।
বুখারী শরীফে বর্ণিত এই হাদিসটি এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক-
عَنِ ابْنِ عَبّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عنْهما، قالَ: كانَ أهْلُ اليَمَنِ يَحُجُّونَ ولا يَتَزَوَّدُونَ، ويقولونَ: نَحْنُ المُتَوَكِّلُونَ، فَإِذا قَدِمُوا مَكَّةَ سَأَلُوا النّاسَ، فأنْزَلَ اللَّهُ تَعالى: {وَتَزَوَّدُوا فإنَّ خَيْرَ الزّادِ التَّقْوى} [البقرة: ١٩٧].
ইবনে আব্বাস রাঃ বলেন,ইয়ামানের লোকেরা হজ্ব করতে আসার সময় রসদ নিয়ে আসতোনা। আর বলতো,আমরা আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করি।কিন্তু যখন তারা মক্কায় আসতো তখন মানুষের কাছে হাত পাততো।তাই আল্লাহ তায়ালা আয়াত নাযিল করলেন।
{وَتَزَوَّدُوا فإنَّ خَيْرَ الزّادِ التَّقْوى} [البقرة: ١٩٧].
তোমরা পাথেয় সাথে নাও।নিশ্চয়ই সর্বোত্তম পাথেয় হলো 'তাকওয়া'।
বুখারী (হাঃ নংং ১৫২৩)
মোল্লা আলী কারী রহঃ এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন,
আয়াতে 'তাকওয়া' বা বেঁচে থাকার অর্থ হলো,
মানুষের কাছে হাত পাতা ও তাদের সম্পদ লুন্ঠন করা থেকে বেঁচে থাকা।
বাগাভী রহঃ বলেন, তাদের এহেন কর্মকান্ড অনেক সময় তাদেরকে আত্মসাৎ ও লুন্ঠন পর্যন্ত নিয়ে যেতো।
তিনি আরো যোগ করেন,তারা আরো বলতো,আমরা আল্লাহর ঘরের উদ্দেশ্যে হজ্ব করবো আর তিনি আমাদেরকে খাওয়াবেননা?!
مرقاة المفاتيح(৫/১৭৫)
এবার রাসুলুল্লাহ সাঃ ও সালাফের জীবনের দিকে তাকানো যাক।আমরা দেখতে পাই-
তিনি শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করেছেন।সাবধানতা অবলম্বন করেছেন।সাহাবায়ে কেরামগণকে দিয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করিয়েছেন।সৈন্য প্রস্তুত করেছেন।সুরক্ষার জন্যে বর্ম পরিধান করেছেন।মাথায় শিরস্ত্রান লাগিয়েছেন।ঢাল ব্যবহার করেছেন।যুদ্ধ কৌশল হিসেবে গিরিপথের মুখে তীরন্দাজদের বসিয়েছেন।শহর সুরক্ষার জন্যে মদিনার চারপাশে পরিখা খনন করেছেন।সাহাবাদেরকে হাবশায় আবিসিনিয়ায় হিজরত করতে বলেছেন।নবুওয়তের শুরু যামানায় বিভিন্ন গোত্রে গিয়ে বলতেন,
من يعصمني حتى أبلغ رسالة ربي
কে আমাকে নিরাপত্তা দিবে আমি আমার রবের রিসালাত পৌছাবো?
(দেখুন (الفروق للقرافي)(4/22)
তাঁর সাহাবাদেরকে মদিনায় হিজরতে পাঠিয়েছেন,নিজে হিজরত করেছেন।বাহন প্রস্তুত করেছেন।পথ দেখানোর জন্যে গাইড নিয়োগ দিয়েছেন।শত্রু থেকে বাঁচতে জাবালে ছাওরের গুহায় আত্মগোপন করেছেন।জিহাদ অথবা ওমরার সফরে বের হলে রসদ সঙ্গে নিয়েছেন।শেষজীবনে যখন আল্লাহ সামর্থ্য দান করেন তখন স্ত্রীদের প্রত্যেককে আগামী একবছরের খোরাকী দিয়ে দিয়েছেন।আসমান থেকে সরাসরি নাযিল হওয়ার অপেক্ষা করেননি।বরং তিনি বিশ্বাস করতেন,যা তিনি কামাই করেছেন সেগুলোও নিজের যোগ্যতায় নয় বরং আসমানের দানেই পেয়েছেন।
অথচ তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব,
তাওয়াক্কুলকারীদের সর্দার।
আসলে আমাদের সমস্যা হলো,আমরা সবসময় সবকিছুর ক্রেডিট নিজের জন্যে নিতে পছন্দ করি।চাকরি-ব্যবসা করে টাকা উপার্জন করেই মনে করি সব বুঝি আমিই করলাম।অথচ যিনি চাকরি-ব্যবসার সব উপকরণ আমার জন্যে সহজলভ্য করে দিলেন দিনশেষে সেই তাকেই বেমালুম ভুলে যাই!!
وكان الانسان كفورا
সত্যিই আমরা বড় অকৃতজ্ঞ।
আমরা শুধু তখনই মহান আল্লাহকে ক্রেডিট দিতে রাজি যখন তিনি আমাদের কাছে সরাসরি আসমান থেকে খাবার নাযিল করবেন!
সহীহ বুখারীর আরেকটি বর্ণনা দেখুন,
ﻋﻦ اﻟﻤﻘﺪاﻡ ﺑﻦ ﻣﻌﺪﻱ ﻛﺮﺏ - ﺭﺿﻲ اﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ: ﻗﺎﻝ: ﻗﺎﻝ ﺭﺳﻮﻝ اﻟﻠﻪ - ﺻﻠﻰ اﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ - " «ﻣﺎ ﺃﻛﻞ ﺃﺣﺪ ﻃﻌﺎﻣﺎ ﻗﻂ ﺧﻴﺮا ﻣﻦ ﺃﻥ ﻳﺄﻛﻞ ﻣﻦ ﻋﻤﻞ ﻳﺪﻳﻪ، ﻭﺇﻥ ﻧﺒﻲ اﻟﻠﻪ ﺩاﻭﺩ - ﻋﻠﻴﻪ اﻟﺴﻼﻡ - ﻛﺎﻥ ﻳﺄﻛﻞ ﻣﻦ ﻋﻤﻞ ﻳﺪﻳﻪ»
"নিজ হাতের উপার্জনের চাইতে উত্তম খাবার কেউ কখনো খায়নি।আল্লাহর নবী দাঊদ আঃও নিজ হাতে কামাই করে খেতেন।" বুখারী(২০৭২)
দাঊদ আঃ একজন রাসুল হওয়া সত্ত্বেও নিজ হাতে কামাই করেন।এটাকে তাওয়াক্কুলের খেলাফ মনে করেননি।
আসলে ইসলামকে আমরা যদি সালাফদের থেকে বুঝার চেষ্টা করতাম;তাহলেই কোন সমস্যা ছিলোনা।কিন্তু আমরা নিজেরাই নিজেদের মতো করে বোঝার চেষ্টা করে সমস্যা বাধাই।ভারসাম্য হারিয়ে ফেলি।প্রান্তিকতার শিকার হই।
বায়হাকী রহঃ-র শুয়াবুল ঈমান ও মুজামে তাবারানীর আরেকটি বর্ণনা দেখুন,
عن عبدالله بن مسعود: طلبُ كسبِ الحلالِ فريضةٌ بعدَ الفريضةِ
البيهقي (٤٥٨ هـ)، السنن الكبرى للبيهقي ٦/١٢٨ • تفرد به عباد بن كثير الرملي ضعيف • أخرجه ابن حبان في«المجروحين» (٢/٩٨)، والطبراني (١٠/٩٠) (٩٩٩٣) باختلاف
يسير، والبيهقي (١٢٠٣٠) واللفظ له
وقال الملا علي القاري(١٠١٤هج)رحمه الله في المرقاة:ﻭﻛﺬا ﺭﻭاﻩ اﻟﻄﺒﺮاﻧﻲ، ﻭﺭﻭﻯ اﻟﺪﻳﻠﻤﻲ ﻓﻲ ﻣﺴﻨﺪ اﻟﻔﺮﺩﻭﺱ، ﻋﻦ ﺃﻧﺲ ﻣﺮﻓﻮﻋﺎ:ﻃﻠﺐ اﻟﺤﻼﻝ ﻭاﺟﺐ ﻋﻠﻰ ﻛﻞ مسلم
"হালাল কামাই করা অন্যান্য ফরজের পর আরেকটি ফরজ।"
মুসনাদে আহমাদ ও মুজামে তাবারানীতে বর্ণিত মিকদাম রাঃ এর আরেকটি বর্ণনা দেখুন,
عن المقدام بن معدي كرب: كانت لمِقْدامِ بنِ مَعْدي كَرِبَ جاريةٌ تَبيعُ اللَّبَنَ، ويَقبِضُ المِقْدامُ الثَّمَنَ، فقيل له: سُبحانَ اللهِ! أَتَبيعُ اللَّبَنَ وتَقبِضُ الثَّمَنَ؟ فقال: نعَمْ، وما بأْسٌ بذلك؛ سمِعتُ رسولَ اللهِ ﷺ يقولُ: لَيأتيَنَّ على الناسِ زَمانٌ لا يَنفَعُ فيه إلّا الدِّينارُ والدِّرهَمُ.
شعيب الأرنؤوط (١٤٣٨ هـ)، تخريج المسند ١٧٢٠١ • إسناده ضعيف • أخرجه أحمد (١٧٢٠١) واللفظ له، ونعيم بن حماد في «الفتن» (٧١٨) باختلاف يسير، والطبراني (٢٠/٢٧٩) (٦٦٠) بنحوه
তিনি বলেন,তাঁর একটি বাদী ছিলো যে দুধ বিক্রয় করতো।আর তার মূল্য তিনি(মিকদাম রাঃ) গ্রহণ করতেন।এটা দেখে একলোক বললো,সুবহানাল্লাহ! আপনি দুধ বিক্রয় করছেন আবার এর মূল্য গ্রহণ করছেন?!!
তিনি বললেন,হ্যা।এতে তো কোন সমস্যা নেই।আমি আল্লাহর রাসুল সাঃ কে বলতে শুনেছি,অবশ্যই মানুষের উপর এমন এক যামানা আসবে যখন দিনার দেরহাম ছাড়া আর কিছুই মানুষের কোন উপকারে আসবেনা!
এই হাদিসের ব্যাখ্যায় মোল্লা আলী কারী হানাফী রহঃ(মৃঃ১০১৪হিঃ) তাঁর মেশকাত শরীফের প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাগ্রন্থ مرقاة المفاتيح(৫/১৯০)-এ বলেন,
ﺃﻱ ﺑﺎﻟﻤﺎﻝ اﻟﻤﻌﺒﺮ ﺑﻬﻤﺎ ﻋﻨﻪ، ﻓﺈﻧﻬﻤﺎ اﻷﺻﻞ ﻭاﻟﻤﺮاﺩ ﻛﺴﺒﻬﻤﺎ ﻭﺟﻤﻌﻬﻤﺎ ﻣﻦ ﺃﻱ ﺟﻬﺔ ﻛﺎﻧﺖ، ﻓﺈﻥ ﺃﻫﻞ ﺫﻟﻚ اﻟﺰﻣﺎﻥ ﻟﻤﺎ ﻏﻠﺐ ﻋﻠﻴﻬﻢ اﻟﻨﻘﺺ ﺻﺎﺭﻭا ﻻ ﻳﻌﺘﺪﻭﻥ ﺑﺄﺭﺑﺎﺏ اﻟﻜﻤﺎﻝ، ﻭﻳﺨﺪﻣﻮﻥ ﺃﺻﺤﺎﺏ اﻷﻣﻮاﻝ، ﻭﺃﻣﺎ ﺃﻫﻞ اﻟﻠﻪ ﻓﺄﻋﺮﺿﻮا ﻋﻨﻬﻢ ﺑﺎﻟﻜﻠﻴﺔ، ﻭﻗﺎﻝ اﻟﻄﻴﺒﻲ - ﺭﺣﻤﻪ اﻟﻠﻪ -: ﻣﻌﻨﺎﻩ ﻻ ﻳﻨﻔﻊ اﻟﻨﺎﺱ ﺇﻻ اﻟﻜﺴﺐ، ﺇﺫ ﻟﻮ ﺗﺮﻛﻮﻩ ﻟﻮﻗﻌﻮا ﻓﻲ اﻟﺤﺮاﻡ، ﻛﻤﺎ ﺭﻭﻱ ﻋﻦ ﺑﻌﻀﻬﻢ ﻭﻗﻴﻞ ﻟﻪ: ﺇﻥ اﻟﺘﻜﺴﺐ ﻳﺪﻧﻴﻚ ﻣﻦ اﻟﺪﻧﻴﺎ ﻗﺎﻝ: ﻟﻴﺲ ﺃﺩﻧﺎﻧﻲ ﻣﻦ اﻟﺪﻧﻴﺎ، ﻟﻘﺪ ﺻﺎﻧﻨﻲ ﻋﻨﻬﺎ، ﻭﻛﺎﻥ اﻟﺴﻠﻒ ﻳﻘﻮﻟﻮﻥ: اﺗﺠﺮﻭا ﻭاﻛﺴﺒﻮا ﻓﺈﻧﻜﻢ ﻓﻲ ﺯﻣﺎﻥ ﺇﺫا اﺣﺘﺎﺝ ﺃﺣﺪﻛﻢ ﻛﺎﻥ ﺃﻭﻝ ﻣﺎ ﻳﺄﻛﻞ ﺩﻳﻨﻪ، ﻭﺭﻭﻱ ﻋﻦ ﺳﻔﻴﺎﻥ ﻭﻛﺎﻧﺖ ﻟﻪ ﺑﻀﺎﻋﺔ ﻳﻘﻠﺒﻬﺎ ﻭﻳﻘﻮﻝ: ﻟﻮﻻ ﻫﺬﻩ ﻟﺘﻤﻨﺪﻝ ﺑﻲ ﺑﻨﻮ اﻟﻌﺒﺎﺱ: ﺃﻱ: ﻟﺠﻌﻠﻮﻧﻲ ﻛﺎﻟﻤﻨﺪﻳﻞ ﻳﻤﺴﺤﻮﻥ ﺑﻲ ﺃﻭﺳﺎﺧﻬﻢ (ﺭﻭاﻩ ﺃﺣﻤﺪ) .
অর্থাৎ এখানে দিনার দেরহামের দ্বারা উদ্দেশ্য মাল।
হাদিসের উদ্দেশ্য হলো, যেকোন(বৈধ)পন্থায় সম্পদ উপার্জন করা।কেননা মানুষের মাঝে যখন (ঈমান আমলের) কমতি প্রাধান্য বিস্তার করে ফেলবে তখন তারা কামেল লোকদেরকে পাত্তাই দিবেনা।প্রাচুর্য-সম্পদের মালিকদের খেদমতে লেগে গিয়ে আল্লাহওয়ালাদের থেকে পুরোপুরি বিমুখ হয়ে যাবে।
আল্লামা শরফুদ্দীন তীবি রহঃ(মৃঃ ৭৪৩হিঃ)বলেন,
এর অর্থ হলো,কামাই-রোজগার ছাড়া আর কিছুই মানুষের উপকারে আসবেনা।কেননা তারা যদি উপার্জন ছেড়ে দেয়,তবে হারামে লিপ্ত হয়ে পড়বে।
যেমন সালাফের কোন একজন থেকে বর্ণিত,তাকে জিজ্ঞেস করা হলো,সম্পদ উপার্জনতো আপনাকে দুনিয়ার কাছাকাছি করে দিচ্ছে?
উত্তরে তিনি বললেন, এটা আমাকে দুনিয়ার কাছাকাছি করে দিচ্ছেনা বরং দুনিয়া থেকে আমাকে হেফাজত করছে।
সালাফগণ বলতেন,তোমরা ব্যাবসা কর।মাল উপার্জন কর।কেননা তোমরা এমন যামানায় আছো যে,তোমাদের কেউ যদি দারিদ্র্যতায় পতিত হয় তবে সর্বপ্রথম যে বস্তুটি সে বিক্রি করে দিবে সেটা হল তার দ্বীন।
সুফিয়ান সাওরী রাহঃ(মৃঃ ১৬১হিঃ) থেকে বর্ণিত,একবার তাঁর কিছু সম্পদের উপর তিনি হাত বোলাচ্ছিলেন তখন বললেন, "যদি এগুলো না থাকতো,বনি আব্বাসের লোকেরা আমাকে তাদের হাত মোছার রুমাল বানিয়ে ফেলতো!
আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক রহঃ(মৃঃ ১৮১হিঃ)উম্মাহর শ্রেষ্ঠ আলেম,মুজাহিদ,যাহেদদের অন্যতম একজন ব্যাক্তিত্ব।এবং সম্ভবত একমাত্র মুহাদ্দিস যার ব্যাপারে কারো কোন জরাহ(অভিযোগ) নেই।তাঁর একটি ঘটনা যা বায়হাকী রহঃ তার নিজ সনদে ফুযাইল ইবনে ইয়ায রহঃ (মৃঃ ১৮৭হিঃ)থেকে বর্ণনা করেছেন।
روى البيهقي بسنده إلى الفضيل بن عياض أنه قال لابن المبارك: أنت تأمرنا بالزهد والتقلل والبلغة ونراك تأتي بالبضائع من بلاد خراسان إلى البلد الحرام؟ كيف ذا وأنت تأمرنا بخلاف ذا؟ فقال ابن المبارك: يا أبا علي، أنا أفعل ذا لأصون بها وجهي وأكرم بها عرضي، واستعين بها على طاعة ربي، لا أرى لله حقاً إلا سارعت إليه حتى أقوم به، فقال له الفضيل: يا ابن المبارك ما أحسن ذا إن تم ذا
তিনি(ফুযাইল ইবনে ইয়ায রহঃ) বলেন,তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক রহঃকে জিজ্ঞেস করলেন,আপনি আমাদেরকে দুনিয়া বিমুখতা,কৃচ্ছতা,অল্পেতুষ্টির আদেশ করেন অথচ আমরা আপনাকে দেখছি,সুদূর খোরাসান থেকে মক্কায় ব্যবসায়ী পণ্য আমদানি করছেন?এটা কেমন কথা হল?
আপনি নিজে একরকম করছেন আর আমাদেরকে ভিন্ন রকম আদেশ করছেন?
ইবনে মোবারক রহঃ তখন বললেন, হে আবু আলী!(ফুযাইল ইবনে ইয়াযের উপনাম) আমি এমনটা করছি আমার চেহারাকে(সওয়ালের অসম্মানী) থেকে হেফাজত করার জন্যে।যেন এর মাধ্যমে আমি আমার মর্যাদা রক্ষা করতে পারি ও সেই সাথে আমার রবের আনুগত্যে এর সাহায্য নিতে পারি।আমি যেখানেই আমার উপর আল্লাহর কোন হক দেখতে পেয়েছি,সেখানেই দ্রুত তা আদায় করতে সচেষ্ট হয়েছি।
ফুযাইল রহঃ বলেন,ইহা কতইনা সুন্দর যদি তা পরিপূর্ণ হয়।
শুআবুল ঈমান(খঃ২ পৃঃ৯৫)।
মোটকথা আমরা দেখতে পেলাম,আসবাব অবলম্বন কিছুতেই তাওয়াক্কুল কিংবা তাকদিরে বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক তো নয়ই উল্টো তা শরীয়তেরই নির্দেশনা।
ইমাম আবুল কাসেম কুশাইরী রহঃ(মৃঃ৪৬৫ হিঃ) বলেন,
اعلم أن التوكل محله القلب، وأما الحركة بالظاهر فلا تنافي التوكل بالقلب بعدما تحقق العبد أن الثقة من قبل الله تعالى، فإن تعسر شيء فبتقديره وإن تيسر فبتيسيره
জেনেরাখো,তাওয়াক্কুলের জায়গা হলো অন্তর।তবে বাহ্যিক চেষ্টা-হরকত তার অন্তরায় নয়,যখন বান্দা এই বিষয়টা নিশ্চিত করবে যে,তার আস্থা আল্লাহ তায়ালার উপর।কোন কিছু কঠিন হলে তা আল্লাহরই তাকদিরের মাধ্যমে।আবার কোন কিছু সহজ হলে তাও আল্লাহরই হুকুমে।
المنهاج شرح صحيح مسلم بن الحجاج (খঃ৩ পৃঃ ৯১)
আল্লামা ইবনে রজব হাম্বলী রহঃ(মৃঃ ৭৯৫হিঃ)
তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ جامع العلوم والحكم
(পৃঃ৪০৯)-এ বলেন,
فالسعي في الأسباب بالجوارح طاعة، والتوكل عليه إيمان به
বাহ্যিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মাধ্যমে আসবাবের মাঝে নিজের (সাধ্যানুযায়ী) চেষ্টা করা ইবাদাত,আর আল্লাহর উপর ভরসা রাখা হলো ঈমান।
সবশেষে ইমাম সুফয়ান ইবনে উয়াইনা রহঃ-র দুটি বক্তব্য দিয়ে এই প্রসঙ্গটির এখানেই ইতি টানছি।তিনি বলেন,
'দুনিয়াতে চলার জন্য যে বিষয়গুলো দরকার সেগুলো সংগ্রহ করাকে দুনিয়ার প্রতি ভালবাসা বলে না।
'যুহদ হলো, আল্লাহর নিআমত লাভ করলে শুকরিয়া আদায় করা। বিপদে আক্রান্ত হলে সবর করা।'
[ হিলয়াতুল আউলিয়া : ৭/২৭৩ ]
(ঘ)সংশয় নিরসন
কারো কারো মনে হতে পারে,আমার ঈমান যথেষ্ট মজবুত।করোনা আমার কিছুই করতে পারবেনা।তাই আমার কোন সাবধানতা অবলম্বন বা চিকিৎসা গ্রহণের প্রয়োজন নেই। তাছাড়া হাদিসেতো এর ফজিলতও এসেছে।যেমন-
হাদীসে এসেছে, উম্মতের বিশাল একদল মানুষের ব্যাপারে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন, যারা কুলক্ষণ তালাশ করতো না, রুকইয়া করত না এবং ‘কাই’ এর চিকিৎসা করত না; বরং আল্লাহ তাআলার উপর তাওয়াক্কুল করত। (অথচ, কাই এর চিকিৎসা ইসলামে গ্রহণযোগ্য ও সমর্থিত একটা ব্যবস্থা।) তখন উক্কাশা নামে এক সাহাবি এই দলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কামনা প্রকাশ করলে নবীজি তাঁর জন্য দোয়া করলেন। এরপর আরেক সাহাবি দাঁড়ালে তিনি বললেন, উক্কাশা তোমার আগে চলে গেছে।
সহিহ ইবনে হিব্বান(হাঃ নং ৭২৪৪)
আমরা এখানে কয়েকটি বিষয় আরজ করবো-
১.কোন কোন মানুষ আল্লাহ তাআলার উপর তাওয়াক্কুল (ভরসা ও নির্ভরতা) ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে এতো নিকটবর্তি ও উচ্চমার্গে পৌঁছে যান, ফলে, আসবাব বা উপকরণ গ্রহণ করাটাকে তিনি তার ঈমানের পূর্ণতার পক্ষে দোষণীয় মনে করতে থাকেন। সেই অবস্থান থেকে তারা সব রকমের চিকিৎসাকে বর্জন করে আল্লাহ তাআলার উপর ভরসা করেন। এঁরা হলেন অত্যন্ত বিশেষ পারসন। অনেক সময় দেখা যায় ই্উনিভার্সাল ল’ তাদের উপর কাজ করে না। এটা হলো তাঁদের জন্যে আল্লাহ তাআলার বিশেষ কেয়ার।
এখানে যে পরিভাষাটি কাজ করে একে আরবিতে বলা হয় কুদরাতুল্লাহ।যার ব্যাখ্যা আমরা পূর্বে করে এসেছি। অনেক ওলীর ক্ষেত্রেও কারামাত হিসেবে তা প্রকাশিত হয়ে থাকে। সেই অবস্থান থেকে কেউ যদি চিকিৎসা গ্রহণ না করেন, তাহলে তিনি সম্মানিত। এর পুরস্কারও তিনি পাবেন।যেমনটি আমরা উপরোক্ত হাদিসটিতে দেখতে পেলাম।
কিন্তু এখানে এবিষয়টি মাথায় রাখতে হবে—
এই অবস্থানটি মানুষ আত্মিক পুতঃপবিত্রতা, আমল ও দোয়ার মাধ্যমে লাভ করে। যে কেউ হুট করে ঘোষণা দিয়ে সে অবস্থানে যেতে পারে না। এই অবস্থানটি গ্রহণ করার নয়; সাধনার মাধ্যমে অর্জন করার। কেউ সে পর্যায়ে গেলে তাকে নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ঘোষণা করতে হবে না। তার স্বাভাবিক জীবনধারাতেই তা আপসে গড়ে উঠবে।
২.এই বিশেষ অবস্থা শুধুমাত্র করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে নয়, সকল রোগের ব্যাপারেই তার জীবনে তা পরিলক্ষিত হবে।
এখন আমি যদি সাধারণ রোগ-শোকের চিকিৎসা নেই, পার্থিব সকল উপায় ও উপকরণ গ্রহণ করে চলি, কিন্তু করোনার ব্যাপারে গিয়ে হঠাৎ করে তাওয়াক্কুলের ঘোষণা দিয়ে বসলাম, এটা হটকারিতা এবং নিজেকে স্বেচ্ছায় বিপদে নিপতিত করা। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কোন ঈমানদারের জন্যে সমীচীন নয় নিজেকে লাঞ্ছিত করা। সাহাবাগণ প্রশ্ন করলেন, তা কীভাবে? তিনি বললেন : নিজেকে এমন দুর্যোগের মুখোমুখি করা, যা সামলানোর ক্ষমতা তার নেই।
আমি যদি অন্য সকল রোগের চিকিৎসা নেই, তাহলে করোনার চিকিৎসা নিতে আপত্তি থাকবে কেন?
এখন, প্রতিটি রোগেরই নিজস্ব চিকিৎসাব্যবস্থা রয়েছে। যে রোগের চিকিৎসাপদ্ধতি যেমন, আমাকেও সে অনুযায়ীই চিকিৎসা নিতে হবে। সুতরাং, করোনার চিকিৎসা যদি হয় সতর্কতা অবলম্বন, তবে সেটাই আমাকে নিতে হবে। এখানে আপত্তি থাকাটা বোধগম্য নয়৷
তবে এটাও ভুলে গেলে চলবেনা যে, একটা হলো যৌক্তিক স্বাভাবিক সতর্কতা, আরেকটা হলো ‘অতি সতর্কতা’। পথে চললে একসিডেন্ট হতে পারে, এ জন্য দেখেশুনে ধীরে ড্রাইভ করা হলো স্বাভাবিক সতর্কতা; কিন্তু পথে বের না হয়ে ভয়ে ঘরে বসে থাকা হলো ‘অতি সতর্কতা’। অতি সতর্কতা অবশ্যই তাওয়াক্কুলের খেলাফ এবং আপনার তকদীর-বিশ্বাস নড়বড়ে হওয়ার ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু স্বাভাবিক সতর্কতা অবশ্যই কাম্য। রোগ বাড়ার আশংকা থাকলে অজু করা মাফ হয়ে তার পরিবর্তে তায়াম্মুমের বিধান দেওয়া হয়েছে এ কারণেই। করোনার ক্ষেত্রে যেহেতু চাক্ষুষ দেখা যাচ্ছে এটি অসতর্ক মেলামেশার কারণে ছড়িয়ে পড়ছে, সে ক্ষেত্রে একে তাওয়াক্কুল ও তকদীরের খেলাফ বলে মনে করা ও প্রচার করা স্পষ্টতই ইসলামের অপব্যাখ্যা। অল্প কিছু মানুষ ইসলামের সঠিক ভাষ্যটি না বুঝেই জনমানসে এসব ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
৩.আমার তাওয়াক্কুল আমার নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। নিজের তাকওয়া ও তাওয়াক্কুল আরেকজনের উপর চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। সুতরাং, আমি যদি করোনাকে কেয়ার না করতে চাই, না করতে পারি। কিন্তু সাধারণ আচরণবিধি আমাকে মেনে চলতে হবে। আর না হয়, আমি অন্যের মধ্যে এটিকে ছড়িয়ে দেওয়ার বাহকে পরিণত হবো। আমার তাকওয়ার কারণে আমার কিছু না-ও হতে পারে, কিন্তু আমার পাশের জনের তো সে উচ্চামার্গীয় তাওয়াক্কুল নেই, তার কী হবে?
সে যদি আমার কারণে আক্রান্ত হয় এর দায় কিন্তু আমার উপরেই আসবে।ফিকহ-ফতুয়ার ভাষায় বললে,আমার জন্যে এটা কিছুতেই জায়েজ হবেনা।
৪.আমার অবস্থানটি একটি বিশেষ অবস্থান। সাধারণ ও সকলের জন্য আবশ্য-পালনীয় কিছু নয়। সুতরাং এই অবস্থানটিকেই ইসলামের একমাত্র দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে প্রচার করতে থাকা ভুল সিদ্ধান্ত। ব্যাপকভাবে মানুষের জন্য অনুসরণীয় হলো সাধারণ ইউনিভার্সাল ল’। ইসলামকে সে অনুযায়ীই উপস্থাপন করতে হবে। সে বিশেষ অবস্থানের সর্বোচ্চ চূড়ায় অবস্থান করা সত্ত্বেও নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারণভাবে আমাদেরকে সুন্নাতুল্লাহ অনুযায়ী চলার নির্দেশনা দিয়ে গেছেন।নিজেও চলে দেখিয়ে গিয়েছেন।যেমনটা আমরা পেছনে বিভিন্ন বর্ণনায় দেখে এসেছি।
#প্রাসঙ্গিক ও শাখাগত আরো কিছু বিষয়
১. করোনা কি শুধু অমুসলিম জালেম রাষ্ট্রগুলোর জন্য এসেছে? মুসলমানদের এতে কিছু হবে না?
এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা মুহতারাম আলী হাসান উসামা (হাফিযাহুল্লাহু)-র "কোভিড-১৯ : প্রেক্ষিত ইসলাম" শীর্ষক একটি নিবন্ধের অংশবিশেষ উল্লেখ করবো।
"করোনাভাইরাস কী?
আকাশসমূহ ও পৃথিবীতে আল্লাহ তাআলার রয়েছে অসংখ্য অগণিত বাহিনী।[১] তন্মধ্যে একটি বাহিনীর নাম হলো করোনাভাইরাস। এই করোনাভাইরাস যখন জালিম কাফিরদেরকে আক্রান্ত করে, তখন তা হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি আজাব। কিন্তু আজাব যেহেতু ব্যাপকভাবে আসলে কিছু মুমিন বান্দাকেও তা আক্রান্ত করে, তাই আল্লাহ অনুগ্রহস্বরূপ একই জিনিসকে মুমিনদের জন্য রহমত বানিয়ে দেন।[৩] করোনাভাইরাসে মৃত্যুবরণকারী সকলে কিয়ামতের দিন এক অবস্থায় উঠবে না। সেদিন মুমিনদের হাশর হবে ইমানদারদের কাফেলায় আর কাফির ও মুনাফিকদের হাশর হবে তাগুতের কাফেলায়।[২]
যে অঞ্চলে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে যাবে, সেখানে যারা তাকদিরের ওপর বিশ্বাস রেখে সওয়াব লাভের প্রত্যাশায় ধৈর্যের সঙ্গে অবস্থান করবে, তাদের জন্য রয়েছে শহিদের মর্যাদা।[৩]
তথ্যসূত্র :
[১] সুরা ফাতহ : ৭
وَلِلَّهِ جُنُودُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ۚ
আর আল্লাহ তাআলার অধিকারেই রয়েছে আকাশসমূহ ও পৃথিবীর সকল বাহিনী।
সুরা আহযাব : ৯
فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ رِيحًا وَجُنُودًا لَّمْ تَرَوْهَا ۚ
তখন তাদের ওপর আমি প্রেরণ করলাম ঝঞ্ছাবায়ু ও এমন সব বাহিনী, যা তোমরা দেখতে পাওনি।
[২] সহিহ বুখারি : ২১১৮
عَنْ نَافِعِ بْنِ جُبَيْرِ بْنِ مُطْعِمٍ ، قَالَ : حَدَّثَتْنِي عَائِشَةُ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ” يَغْزُو جَيْشٌ الْكَعْبَةَ، فَإِذَا كَانُوا بِبَيْدَاءَ مِنَ الْأَرْضِ يُخْسَفُ بِأَوَّلِهِمْ وَآخِرِهِمْ “. قَالَتْ : قُلْتُ : يَا رَسُولَ اللَّهِ، كَيْفَ يُخْسَفُ بِأَوَّلِهِمْ وَآخِرِهِمْ وَفِيهِمْ أَسْوَاقُهُمْ، وَمَنْ لَيْسَ مِنْهُمْ ؟ قَالَ : ” يُخْسَفُ بِأَوَّلِهِمْ وَآخِرِهِمْ، ثُمَّ يُبْعَثُونَ عَلَى نِيَّاتِهِمْ “.
আয়িশা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, (পরবর্তী যামানায়) একদল সৈন্য কা‘বা (ধ্বংসের উদ্দেশ্যে) অভিযান চালাবে। যখন তারা বায়দা নামক স্থানে পৌঁছাবে তখন তাদের আগের-পিছের সকলকে জমিনে ধ্বসিয়ে দেয়া হবে। আয়িশা রা. বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, তাদের অগ্রবাহিনী ও পশ্চাৎবাহিনী সকলকে কীভাবে ধ্বসিয়ে দেয়া হবে, অথচ তাদের মধ্যে বাজারের (পণ্য-সামগ্রী বহনকারী) লোকও থাকবে এবং এমন লোকও থাকবে যারা তাদের দলভুক্ত নয়, তিনি বললেন, তাদের আগের-পিছের সকলকে ধ্বসিয়ে দেয়া হবে। তারপরে (কিয়ামতের দিবসে) তাদেরকে তাদের নিয়াত অনুযায়ী ওঠানো হবে।
[৩] সহিহ বুখারি : ৬৬১৯
عَنْ يَحْيَى بْنِ يَعْمَرَ ، أَنَّ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا أَخْبَرَتْهُ، أَنَّهَا سَأَلَتْ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنِ الطَّاعُونِ، فَقَالَ : ” كَانَ عَذَابًا يَبْعَثُهُ اللَّهُ عَلَى مَنْ يَشَاءُ، فَجَعَلَهُ اللَّهُ رَحْمَةً لِلْمُؤْمِنِينَ، مَا مِنْ عَبْدٍ يَكُونُ فِي بَلَدٍ يَكُونُ فِيهِ وَيَمْكُثُ فِيهِ لَا يَخْرُجُ مِنَ الْبَلَدِ، صَابِرًا مُحْتَسِبًا، يَعْلَمُ أَنَّهُ لَا يُصِيبُهُ إِلَّا مَا كَتَبَ اللَّهُ لَهُ، إِلَّا كَانَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِ شَهِيدٍ “.
আয়িশা রা. হতে বর্ণিত। তিনি একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্লেগ রোগ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন, এটা একটা আজাব। আল্লাহ যার ওপর ইচ্ছে, তা পাঠান। আল্লাহ এটা মুমিনদের জন্য (মুনাফিকদের জন্য নয়) রহমত করে দিয়েছেন। প্লেগে আক্রান্ত শহরে কোনো বান্দা যদি ধৈর্য ধরে সওয়াব লাভের প্রত্যাশা নিয়ে অবস্থান করে, সেখান থেকে বের না হয় এবং সে এই ইলম রাখে যে, আল্লাহ তার জন্য যা লিখেছেন, তা ছাড়া অন্য কিছুই তাকে আক্রান্ত করবে না, তবে সে ব্যক্তি শহিদের সমান সাওয়াব পাবে।
[লিঙ্ক:https://alihasanosama.com/covid-19-prekkhit/]
২.করোনা ভাইরাস বা এর মতো সংক্রমণশীল রোগের মহামারীর পরিস্থিতিতে ইসলামের নির্দেশনা কি?
এই প্রশ্নের উত্তরটা আমরা সরাসরি বোখারী শরীফের একটি হাদীস থেকেই জেনে নেই-
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ خَرَجَ إِلَى الشَّأْمِ حَتّٰى إِذَا كَانَ بِسَرْغَ لَقِيَه“ أُمَرَاءُ الأَجْنَادِ أَبُو عُبَيْدَةَ بْنُ الْجَرَّاحِ وَأَصْحَابُه“ فَأَخْبَرُوه“ أَنَّ الْوَبَاءَ قَدْ وَقَعَ بِأَرْضِ الشَّأْمِ.
قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ فَقَالَ عُمَرُ ادْعُ لِي الْمُهَاجِرِينَ الأَوَّلِينَ فَدَعَاهُمْ فَاسْتَشَارَهُمْ وَأَخْبَرَهُمْ أَنَّ الْوَبَاءَ قَدْ وَقَعَ بِالشَّأْمِ فَاخْتَلَفُوا فَقَالَ بَعْضُهُمْ قَدْ خَرَجْتَ لأَمْرٍ وَلاَ نَر‘ى أَنْ تَرْجِعَ عَنْه“ وَقَالَ بَعْضُهُمْ مَعَكَ بَقِيَّةُ النَّاسِ وَأَصْحَابُ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَلاَ نَر‘ى أَنْ تُقْدِمَهُمْ عَلٰى هٰذَا الْوَبَاءِ فَقَالَ ارْتَفِعُوا عَنِّي ثُمَّ قَالَ ادْعُوا لِي الأَنْصَارَ فَدَعَوْتُهُمْ فَاسْتَشَارَهُمْ فَسَلَكُوا سَبِيلَ الْمُهَاجِرِينَ وَاخْتَلَفُوا كَاخْتِلاَفِهِمْ فَقَالَ ارْتَفِعُوا عَنِّي ثُمَّ قَالَ ادْعُ لِي مَنْ كَانَ هَاهُنَا مِنْ مَشْيَخَةِ قُرَيْشٍ مِنْ مُهَاجِرَةِ الْفَتْحِ فَدَعَوْتُهُمْ فَلَمْ يَخْتَلِفْ مِنْهُمْ عَلَيْهِ رَجُلاَنِ فَقَالُوا نَر‘ى أَنْ تَرْجِعَ بِالنَّاسِ وَلاَ تُقْدِمَهُمْ عَلٰى هٰذَا الْوَبَاءِ فَنَادى عُمَرُ فِي النَّاسِ إِنِّي مُصَبِّحٌ عَلٰى ظَهْرٍ فَأَصْبِحُوا عَلَيْهِ.
قَالَ أَبُو عُبَيْدَةَ بْنُ الْجَرَّاحِ أَفِرَارًا مِنْ قَدَرِ اللهِ فَقَالَ عُمَرُ لَوْ غَيْرُكَ قَالَهَا يَا أَبَا عُبَيْدَةَ نَعَمْ نَفِرُّ مِنْ قَدَرِ اللهِ إِلٰى قَدَرِ اللهِ أَرَأَيْتَ لَوْ كَانَ لَكَ إِبِلٌ هَبَطَتْ وَادِيًا لَه“ عُدْوَتَانِ إِحْدَاهُمَا خَصِبَةٌ وَالأُخْر‘ى جَدْبَةٌ أَلَيْسَ إِنْ رَعَيْتَ الْخَصْبَةَ رَعَيْتَهَا بِقَدَرِ اللهِ وَإِنْ رَعَيْتَ الْجَدْبَةَ رَعَيْتَهَا بِقَدَرِ اللهِ قَالَ فَجَاءَ عَبْدُ الرَّحْمٰنِ بْنُ عَوْفٍ وَكَانَ مُتَغَيِّبًا فِي بَعْضِ حَاجَتِه„ فَقَالَ إِنَّ عِنْدِي فِي هٰذَا عِلْمًا سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُوْلُ إِذَا سَمِعْتُمْ بِه بِأَرْضٍ فَلاَ تَقْدَمُوا عَلَيْهِ وَإِذَا وَقَعَ بِأَرْضٍ وَأَنْتُمْ بِهَا فَلاَ تَخْرُجُوا فِرَارًا مِنْه“ قَالَ فَحَمِدَ اللهَ عُمَرُ ثُمَّ انْصَرَفَ.
‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ:
‘উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) সিরিয়ার দিকে রওনা করেছিলেন। শেষে তিনি যখন সারগ এলাকায় গেলেন, তখন তাঁর সঙ্গে সৈন্য বাহিনীর প্রধানগণ তথা আবূ ‘উবাইদাহ ইবনু জাররাহ ও তাঁর সঙ্গীগণ সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা তাঁকে জানালেন যে, সিরিয়া এলাকায় প্লেগের বিস্তার ঘটেছে। ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেন, তখন ‘উমার (রাঃ) বললেন, আমার নিকট প্রবীণ মুহাজিরদের ডেকে আন। তখন তিনি তাঁদের ডেকে আনলেন। ‘উমার (রাঃ) তাঁদের সিরিয়ার প্লেগের বিস্তার ঘটার কথা জানিয়ে তাঁদের কাছে পরামর্শ চাইলেন। তখন তাঁদের মধ্যে মতভেদের সৃষ্টি হল। কেউ বললেন, আপনি একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে বের হয়েছেন; কাজেই তা থেকে প্রত্যাবর্তন করা আমরা পছন্দ করি না। আবার কেউ কেউ বললেন, বাকী লোক আপনার সঙ্গে রয়েছেন এবং রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর সাহাবীগণও। কাজেই আমরা সঠিক মনে করি না যে, আপনি তাদের এই প্লেগের মধ্যে ঠেলে দিবেন। ‘উমার (রাঃ) বললেনঃ তোমরা আমার নিকট থেকে চলে যাও। এরপর তিনি বললেনঃ আমার নিকট আনসারদের ডেকে আন। আমি তাদের ডেকে আনলাম। তিনি তাদের কাছে পরামর্শ চাইলে তাঁরাও মুহাজিরদের পথ অবলম্বন করলেন এবং তাঁদের মতই মতপার্থক্য করলেন। ‘উমার (রাঃ) বললেনঃ তোমরা উঠে যাও। এরপর আমাকে বললেনঃ এখানে যে সকল বয়োজ্যেষ্ঠ কুরাইশী আছেন, যাঁরা মাক্কাহ জয়ের বছর হিজরাত করেছিলেন, তাদের ডেকে আন। আমি তাদের ডেকে আনলাম, তখন তারা পরস্পরে মতভেদ করলেন না। তাঁরা বললেনঃ আপনার লোকজনকে নিয়ে প্রত্যাবর্তন করা এবং তাঁদের প্লেগের মধ্যে ঠেলে না দেয়াই আমরা ভাল মনে করি। তখন ‘উমার (রাঃ) লোকজনের মধ্যে ঘোষণা দিলেন যে, আমি ভোরে সাওয়ারীর পিঠে আরোহণ করব (ফিরে যাওয়ার জন্য)। অতএব তোমরাও সকালে সওয়ারীর পিঠে আরোহণ করবে। আবূ ‘উবাইদাহ (রাঃ) বললেনঃ আপনি কি আল্লাহর নির্ধারিত তাকদীর থেকে পলায়ন করছেন? ‘উমার (রাঃ) বললেনঃ হে আবূ ‘উবাইদাহ! যদি তুমি ব্যতীত অন্য কেউ কথাটি বলত! হাঁ, আমরা আল্লাহর, এক তাকদীর থেকে আল্লাহর আরেকটি তাকদীরের দিকে ফিরে যাচ্ছি। তুমি বলতো, তোমার কিছু উটকে যদি তুমি এমন কোন উপত্যকায় নিয়ে যাও যেখানে আছে দু’টি মাঠ। তন্মধ্যে একটি হল সবুজ শ্যামল, আর অন্যটি হল শুষ্ক ও ধূসর। এবার বল ব্যাপারটি কি এমন নয় যে, যদি তুমি সবুজ মাঠে চরাও তাহলে তা আল্লাহর তাকদীর অনুযায়ীই চরিয়েছ। আর যদি শুষ্ক মাঠে চরাও, তাহলে তাও আল্লাহর তাকদীর অনুযায়ীই চরিয়েছ। বর্ণনাকারী বলেন, এমন সময় ‘আবদুর রহমান ইবনু ‘আওফ (রাঃ) আসলেন। তিনি এতক্ষণ যাবৎ তাঁর কোন প্রয়োজনের কারণে অনুপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেনঃ এ ব্যাপারে আমার নিকট একটি তথ্য আছে, আমি রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) –কে বলতে শুনেছিঃ তোমরা যখন কোন এলাকায় (প্লেগের) বিস্তারের কথা শোন, তখন সেখানে প্রবেশ করো না। আর যদি কোন এলাকায় এর প্রাদুর্ভাব নেমে আসে, আর তোমরা সেখানে থাক, তাহলে সেখান থেকে বেরিয়ে যেয়ো না। বর্ণনাকারী বলেনঃ এরপর ‘উমার (রাঃ) আল্লাহর প্রশংসা করলেন, তারপর প্রত্যাবর্তন করলেন।
বোখারী (হাঃনং ৫৭২৯)
এই করোনাকালে হাদিসটা খুবই প্রাসঙ্গিক।বিশেষ করে উম্মতের দ্বিতীয় সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ যার ব্যাপারে নবীজি সাঃ বলে গিয়েছেন,আমার পরে যদি কোন নবী আসতো তবে সে হতো উমর।
যার বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার নজীর পুরো উম্মতের ইতিহাসে বিরল।আবু উবাইদা রাঃকে দেয়া সেই মানুষটির উপমাটাতে খুবই চমৎকৃত হয়েছি।উপমাও এতো সুন্দর,উপযোগি,যথার্থ,ভারসাম্যপূর্ণ হতে পারে!
বর্তমান বিশ্ব যদি এই একটা হাদিসের উপরেও আমল করতো তবে হয়তো এই বিভীষিকাময় অবস্থা আজ আমাদের দেখতে হতোনা।লকডাউন,হোম কোয়ারেন্টাইন,আইসোলেশন এইসব নুতন পরিভাষাগুলোর কিছুই দরকার হতোনা।
উমার রাঃ এর আরেকটা হাদিস দেখুন,
عن ابن أبي مُلَيكة: "أنَّ عمر - رضي الله عنه - مر بامرأة مجذومة - وهي تطوف بالبيت - فقال لها: يا أمَة الله، لا تُؤْذِي الناس، لو جلَسْتِ في بيتك لكان خيرًا لك، فجلسَتْ في بيتها، فمرَّ بها رجل بعدَما مات عُمَر، فقال لها: إنَّ الذي نهاك قد مات فاخْرجي، فقالت: والله، ما كنتُ لأطيعه حيًّا، وأعصيه ميتًا
ইবনে আবি মুলাইকা বর্ণনা করেন,একবার উমার রাঃ এক কুষ্ঠরোগগ্রস্তা মহিলার পাশদিয়ে যাচ্ছিলেন যে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করছিলো।তখন তিনি মহিলাটিকে বললেন,হে আল্লাহর বান্দী! মানুষকে কষ্ট দিওনা।তুমি যদি ঘরে থাক সেটাই তোমার জন্যে ভালো হবে।
ফলে সেই মহিলা ঘরে থাকা শুরু করলো।
এরপর উমার রাঃ এর ইন্তেকালের পরে একলোক তার পাশদিয়ে যাওয়ার সময় তাকে বললো,তোমাকে যে বাইরে বের হতে নিষেধ করেছিলো সেতো মারা গিয়েছে।এখন তুমি বাইরে বের হও।মহিলা উত্তর দিলেন,জীবিত অবস্থায় তাঁর আনুগত্য করবো আর মারা গেলেই তাঁর নাফরমানী করবো,আমি এমন নই।
সুবহানাল্লাহ !
আমি এখানে কিসের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করবো?
উমারের দূরদর্শিতা?
নাকি জনগণের প্রতি কল্যাণকামীতা?
নাকি মৃত্যুর পরেও খলিফার প্রতি একজন সাধারণ নারী নাগরিকের আনুগত্য?
কি বলবো এটাকে?
শুধুই আনুগত্য? নাকি শ্রদ্ধা ভালোবাসার সম্মিলন?
যেখানে আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যাতে লাঠিয়াল বাহিনী দিয়েও রাষ্ট্রপরিচালকেরা জনগণের আনুগত্য আদায় করতে ব্যর্থ।
তাই আধুনিক বিশ্ব শেষ পর্যন্ত এসে চৌদ্দশ বছরের পুরাতন ইসলামের পায়েই মাথা ঠুকলো।ইসলামের দোহাই দিয়ে জনগণকে সচেতন করতে হচ্ছে।ইসলামের নবীর বাণী রাস্তায় বিলবোর্ডে ঝুলিয়ে রাখতে হচ্ছে।
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=544509519544670&id=349804782348479
ধর্মকে রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে ঝেটিয়ে বিদেয় করা আমাদের এই সেকুলার রাষ্ট্র বাংলাদেশও তাদের আইন আর লাঠিয়াল বাহিনী প্রয়োগ করে জনগণকে মানাতে ব্যর্থ হয়ে শেষে রাস্তায় বিলবোর্ড ঝুলায়-
"এইডস থেকে বাঁচতে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলুন" !!!
৪.মসজিদে জামাতের নামাজ ও জুমআ বন্ধ করা যাবে কি না?
আসলে আমার জন্যে এ বিষয়ে কথা বলার মানে অনাধিকারচর্চা।ফিকহুন নাওয়াযিলের এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলবেন দেশের বিজ্ঞ প্রাজ্ঞ মুফতিয়ানে কেরাম।অনেকেই এটা নিয়ে লেখালেখি করেছেন।বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে নানা বিতর্ক হয়েছে।যেমন-
মসজিদ বন্ধ করে দেয়া হবে নাকি খোলা রাখা হবে?খোলা রাখা হলে- জামাতে মুসল্লিদের অবাধে অংশগ্রহণের সুযোগ রাখা হবে? নাকি অংশগ্রহণ সীমিত করা হবে? সীমিত করা হলে এর প্রক্রিয়াটি কেমন হবে? সংখ্যা নির্ধারন করা যাবে কিনা? সংখ্যা নির্ধারন করলে 'ইযনে আম'-এর শর্ত পাওয়া যাবে কিনা?
কিন্তু কারো কারো প্রশ্ন দেখে রীতিমতো হতাশ হচ্ছি।যেমন—
বাজার,ব্যাংক খোলা থাকতে পারলে মসজিদ খোলা রাখতে সমস্যা কোথায়?
এটা নিয়ে ছোট্ট একটা কথা বলি।আমি মনে করি,প্রথমত এখানে আমাদের যেটা করা দরকার সেটা হলো, সমস্যাটাকে চিহ্নিত করা।তা চিহ্নিত হয়ে গেলে এরপর সে অনুযায়ী সমাধান গ্রহণের চেষ্টা করা।সমস্যা থাকার পরেও,তারা কেন তাদের ওখানে সমস্যার সমাধান করছেনা,তাই আমরাও আমাদের এখানে সমাধান করবোনা-এমন কথা বলা বোকামী।
শুধু বোকামী না বরং রীতিমতো আত্মঘাতী।আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার তাওফিক দান করুন।অন্যথায় আর সবাই ভুলে গেলেও ইতিহাস ঠিকই সযত্নে সংরক্ষণ করে রাখবে আমাদের এই জাতিগত ব্যার্থতার কথা।আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম জানবে,নিজেদেরকে জাতির রাহবার দাবিকরা তাদের পূর্বসুরীরা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যার্থ হয়েছিলো।
যাইহোক এটা নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে অনেক লেখা পড়েছি,তবে সাবের ভাইয়ের কথাগুলো খুবই ভালো লেগেছে।মজার ব্যাপার হচ্ছে,এই লেখাটি শুরু করেছিলাম তাঁর লেখা দিয়ে শেষও করছি তাঁর লেখা দিয়ে।তিনি লিখেন-
মসজিদে জামাত বন্ধ করা যাবে কি না?
"মৌলিকভাবে এটি নিয়ে কথা বলবেন বিজ্ঞ আলেম ও মুফতিগণ। বলেছেনও বটে। আমি সাধারণ মানুষ হিসেবে কয়েকটি দিক সামনে আনতে পারি। আমরা দেখি ইসলামে অক্ষম অবস্থাকে মোকাবেলা করার জন্য মৌলিক কিছু নীতিমালা আছে। সেই নীতিমালার আলোকে পরিস্থিতি বিবেচনায় সিদ্ধান্ত প্রস্তুত হবে। এর মধ্যে অন্যতম একটি মূলনীতি হলো, কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, তিনি বান্দাকে তার সাধ্যের বাইরে কিছু করতে নির্দেশ দেন না। ফলে, যেখানেই সাধ্যের প্রশ্ন আসবে, সেখানেই সুযোগ ও ছাড় তৈরী হবে। সুতরাং, যদি এমন পরিস্থিতি আসে যে, মসজিদগুলোতে জামাত চললে মহামারীকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না, তাহলে মসজিদে জামাত বন্ধ করতে শরীয়ত নিজেই আমাদেরকে নির্দেশ দিবে। এ ক্ষেত্রে কারো কোন দ্বিমত নেই।
কিন্তু এখানে মূল পয়েন্ট হলো : এরকম পরিস্থিতি ঠিক কখন তৈরী হলো এটা বুঝা যাবে কী করে? এখানে দুটো জিনিস লাগবে, এক হলো পরিস্থিতি চেক করার জন্য ধর্মীয় ইনস্টিটিউট এবং দ্বিতীয় বিষয় হলো যথাযথ কর্তৃপক্ষ থেকে পর্যাপ্ত অথেনটিক ডাটা সরবরাহ করা। অর্থাৎ, ধর্মীয় ইনস্টিটিউট ও রাষ্ট্র যৌথভাবে এখানে কাজ করতে হবে। দুঃখজনক হলো আমাদের দেশে এ দুয়ের কোনটিই যথাযথভাবে উপস্থিত নেই। ফলে, এখানে যে একটা বিশৃঙ্খলা হবে, তা পূর্ব অনুমিত।
এখানে আপনি নানা পক্ষকে নানা এঙ্গেল থেকে দোষারোপ করতে থাকতে পারেন, এবং আপনার মুখ যদি খারাপ থাকে, তাহলে গালিগালাজও করতে পারেন। কিন্তু আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, এই ইস্যুতে এটা কোন সমাধান না। একটা ধর্মীয় ইনস্টিটিউট গড়ে না উঠার পেছনে এবং অথেনটিক ডাটা সরবরাহ নিশ্চিত না হওয়ার পেছনে আপনারও দায় আছে। ফলে, আমাদের দায়িত্ব হলো এই দূরবস্থাটি কাটিয়ে উঠার জন্য কাজ করে যাওয়া।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন যে সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেছে, এটি নিয়ে মন্তব্য করার সাহস আমার নাই। অনেক বড় বড় আলেমগণ একে প্রস্তুত করেছেন। এটি নিশ্চয়ই ফিকহি দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক হবে। আমি শুধু একটি কথা সম্মুখে আনতে চাই—আমাদের বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ খুব সুবিধার জিনিস না। প্রচুর অসতর্কতা আছে, বুঝের কমতি আছে, এবং দীনি ক্ষেত্রে নিজের অসম্পূর্ণ বুঝমত ভুল আবেগে চালিত হবার প্রবণতা আছে। ফলে, এমন বৃহৎ বিষয়ে একাডেমিক শর্তটর্ত রক্ষা করে মাসআলা মেনে চলা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
এজন্য পাবলিককে ডিল করার সময় এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এই জায়গাটার জন্য ফিকহে একটা কথা আছে—সাদ্দান লিযযারায়ে’। অর্থাৎ, একটি বিষয় মৌলিকভাবে সঠিক হলেও সাধারণ মানুষ একে খুব দ্রুতই বিকৃত করে ফেলবে, এই ভয়ে ঘোষণার মধ্যে সূক্ষ্ম ভাগ ও বিশ্লেষণে না গিয়ে বিধানটিকে শর্টকাট করে ফেলা। বাংলাদেশের মানুষ যখন দেখবে মসজিদে যেতে নিষেধ করা হচ্ছে না, তখন তারা আর বিস্তারিত বিশ্লেষণে যাবে না। এ জন্য আপনি খেয়াল করলে দেখবেন ফাউন্ডেশনের এই ফতোয়া বাংলাদেশের মসজিদগুলোতে খুব একটা প্রভাব ফেলছে না।
বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের কাছে আমার একটা নিবেদন থাকবে, মসজিদগুলো অবশ্যই খোলা থাকবে। কমিটি বা এলাকার মুরুব্বিগণ একেবারে আশপাশের বাড়িগুলো থেকে দশজন সুস্থ যুবককে ঠিক করে দিবেন। ইমাম মুয়াজ্জিন ও এই দশজন যুবক মিলে জামাত অনুষ্ঠিত হবে। উলামায়ে কেরাম এই সিদ্ধান্ত দিবেন এবং সরকার এই মর্মে আইন জারি করবে। পাকিস্তানে মুফতি তাকি উসমানি সাহেব বলেছেন, সরকার যদি মুসল্লির সংখ্যার উপর নির্দেশনা জারি করে, তাহলে অন্যান্য নামাজিদেরকে মা’যূর বা অক্ষম হিসেবে গণ্য করা হবে।
করোনার ইস্যুতে একটি বিষয় খুব ভালোভাবে পরিস্কার হয়েছে, বাংলাদেশের সরকার, মিডিয়া ও বামপন্থীগণ ইসলামকে যতই ইগনোর করার চেষ্টা করুক, কিন্তু ইসলাম ও উলামায়ে কেরামের নির্দেশনা ছাড়া সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। কারণ, এই দেশে তৃণমূলে ইসলামই একমাত্র শক্তিশালী প্রভাবক । ফলে, ইসলামকে এড়িয়ে এখানে কেউ কিছুই করতে পারবে না। এর বিপরীতে উলামায়ে কেরাম যদি সুসংহতভাবে এই জায়গায়টায় কাজ করতে পারেন, তাহলে এই দেশে অসাধারণ একটি পরিবর্তন সম্ভব। রাষ্ট্র এই জায়গাটা বুঝুক এবং সমস্ত সেক্টরে শরীয়াহ প্রতিনিধি নিশ্চিত করুক – এই কামনা থাকলো।"
মোবারক হোসাইন
৩০-০৪-২০২০
রাত ১:৩২
------ ------
হাদীস গ্রহণ-বর্জনের ক্ষেত্রে ইমামগণের প্রত্যেকেরই নিজস্ব কিছু মূলনীতি ছিলো।যেগুলো তারা অনুসরণ করে চলতেন।মূলত এসব মূলনীতির উপর ভিত্তি করেই নির্ণীত হয়,কোন ইমামের কোন কিতাবের হাদীসের মান কোন পর্যায়ের।যেমন- ইমাম বোখারী রাহঃ-র সহীহ বোখারীতে অনুসৃত মূলনীতিসমুহ, ইমাম মুসলিম,আবু দাঊদ,তিরমিযী রহঃ-র মূলনীতি(যেগুলো তাঁরা তাদের সহীহ ও সুনান সংকলনের ক্ষেত্রে ফলো করেছেন)এর চাইতে কঠিন ছিলো।যার ফলে তাঁরা নিজেদের কিতাবে এমন অনেক হাদীস এনেছেন, যা ইমাম বোখারী রহঃকতৃক ফলোকরা মূলনীতিগুলোর বিচারে অনুত্তীর্ণ।
উল্লেখ্য, ইমাম বোখারী রহঃ তাঁর সহীহ বুখারী সংকলনের ক্ষেত্রে যেরূপ কঠিন শর্ত আরোপ করেছেন, তাঁর অন্যকোন রচনায় তেমনটা করেননি।যার ফলে তাঁর অন্যান্য রচনাবলীর অনেক বর্ণনাই সহীহ বুখারীর মানে উত্তীর্ণ নয়।
এই জায়গাটিতে এসে অনেক গায়রে মুকাল্লিদ ভাইয়েরা খেয়ানতের আশ্রয় নেন।ড. আসাদুল্লাহ আল-গালিব, মুজাফফর বিন মুহসিন সাহেবরাও তাদের রচনাবলীর অনেক জায়গায় রিওয়ায়াত উল্লেখ করে ব্র্যাকেটে "বোখারী" লিখে সাধারণ পাঠকদের এই ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছেন যে, এটা সহীহ বোখারীতে আছে।অথচ ইমাম বুখারী রহঃ এটা তাঁর কোন "জুয"এ উল্লেখ করেছেন।আমরা জানি, এক্ষেত্রে মুহাদ্দেসিনে কেরামগণ
رواه البخاري في جزء رفع اليدين কিংবা في جزء القراءة خلف الإمام ইত্যাদি বলে খোলাসা করে দেন।
আরো উল্লেখ্য, ইমাম বোখারীর এসব মূলনীতির প্রত্যেকটিই অন্যদের চাইতে উচ্চাঙ্গের,এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই।বরং ব্যাপারটি আপেক্ষিক।তাই দেখা যায় ইমাম নাসায়ী রহঃকতৃক ফলোকরা কিছু মূলনীতি ইমাম বোখারী মুসলিম রহঃ-র চাইতে এগিয়ে।যেমন-
ইমাম নাসায়ী রহঃ তাঁর সুনানে বেদ'আতী রাবীর বর্ণনা একেবারেই গ্রহণ করেননি।অপরদিকে বোখারী-মুসলিমে কিছু শর্তসাপেক্ষে তাদের থেকেও হাদিস গ্রহণকরা হয়েছে।তাই এইদিক থেকে অবশ্যই ইমাম নাসায়ী তাঁদের চেয়ে এগিয়ে থাকবেন।
যাইহোক আমরা সবাই একথা জানি যে,ইমাম বোখারী রহঃ-র অনুসৃত মূলনীতি খুবই কঠিন।অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ এর ধারে কাছেও নেই।তাঁর সহীহ কিতাবটি কোরআনের পর দুনিয়ার সবচে' বিশুদ্ধ কিতাব।ব্লা...ব্লা...
কিন্তু যে বিষয়টি আমরা অনেকেই জানিনা তাহলো,
হাদীস গ্রহণের ক্ষেত্রে ইমাম আ'যম আবু হানীফা রহঃ-র মূলনীতি ইমাম বোখারী-মুসলিমের চাইতেও অনেক বেশী কঠিন ও সাবধানতাপূর্ণ।
তাইতো আলী ইবনুল জা'দ রহঃ বলেন,
.أبو حنيفة إذا جاء بالحديث،جاء به مثل الدر
আবু হানীফা রহঃ যখন কোন হাদীস সামনে নিয়ে আসেন,তা হয় মোতির মতো।
(জামিউ মাসানিদিল ইমাম আল-আ'যম-২/৩০৮)।
চলুন কিছু নমুনা দেখে নেয়া যাক-
১.বর্ণনাকারী নিজ শায়খ থেকে হাদীস শোনার পর হতে আপন ছাত্রদেরকে শেখানো পর্যন্ত পুরোটা সময় সেই হাদীসটি নিজের মস্তিষ্কে ধারণ করতে হবে।মাঝখানে কিছু সময়ের জন্যেও ভুলে যাওয়া চলবেনা।
২.রাবী যদি নিজের নোটখাতা দেখে হাদীস বর্ণনা করতে চায় তবে সেক্ষেত্রে অবশ্যই তার এই বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে যে,এটি সে তার শায়খ থেকে শুনেছে।অর্থাৎ শুধু নিজের লেখার মতো লেখা দেখেই তা থেকে বর্ণনা করতে পারবেনা।
৩.খবরে ওয়াহেদ সামনে আসলে তা কিতাবুল্লাহরعمومات (ব্যাপক ও সার্বজনীন আহকাম) ও ظواهر(দ্ব্যর্থহীন ও সুস্পষ্ট আহকাম)এর সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে।যদি দেখা যায়,এগুলো হাদীসটিকে সাপোর্ট করছে তবে তা গ্রহণ করা হবে।অন্যথায় হাদীসটিকে মা'লুল সাব্যস্ত করা হবে।
৪.এমনিভাবে হাদীসটি সাহাবা ও তাবেয়ীগণের
"আমালে মুতাওয়ারাস"(প্রজন্ম পরম্পরায় ধারাবাহিকভাবে চলে আসা আমল)এর বিপরীত না হতে হবে।
৫." উমুমুল বালওয়া" (অর্থাৎ এমন বিষয় যা,সবারই বারবার প্রবল প্রয়োজন হয়) এর ক্ষেত্রে শুধুমাত্র
খবরে ওয়াহেদ পাওয়া যাওয়া যথেষ্ট নয়।বরং এর জন্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোকদের থেকে বর্ণনা পাওয়া যেতে হবে।
৬.শরীয়তের "হুদুদ" ও "কিসাস"এর মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলোতে যে বর্ণনাটি সর্বাধিক সাবধানতাপূর্ণ ও মানুষের জন্যে অধিক সহজ, তা গ্রহণ করা।
৭.বর্ণনাটি খবরে ওয়াহেদ হলে তা কোন (ক্বাওলী বা ফে'লী) মাশহুর সুন্নাহের বিপরীত হতে পারবেনা।
৮.হাদীসের বর্ণনাকারী তাঁর বর্ণনার বিপরীত আমল না করা।কেননা এটা হাদীসটি তাঁর নিকট মানসুখ হওয়াকে প্রমাণ করে।যেমন-আবু হুরাইরা রাঃ কতৃক বর্ণিত কোন পাত্রে কুকুর মুখ দিলে তা সাতবার ধৌত করার হাদীসের উপর ইমাম আবু হানীফা রহঃ আমল করেননি।কেননা আবু হুরাইরা রাঃ-র ফাতওয়া এর বিপরীত ছিল।তিনি তিনবার ধৌত করার ফাতওয়া দিতেন।
তাঁর মত একজন সাহাবী নিজের বর্ণিত হাদীসের বিপরীত আমল করবেন,এটা অসম্ভব যদি না তাঁর কাছে এর চাইতেও শক্তিশালী কোন দলিল থাকে।
৯.যে হাদীসের সপক্ষে সালাফের আসার বেশী পাওয়া যায় তাকে অন্যান্য বর্ণনার উপর প্রাধান্য দেয়া।
১০.হাদীসটির বিপরীতে এমন কোন বর্ণনা পাওয়া না যাওয়া, যা সিহহত ও আমলের বিচারে তার চেয়ে শক্তিশালী বা একই মানের।
এক্ষেত্রে তিনি তারজিহ বা একটিকে অপরটির উপর প্রাধান্য দিতেন।এর অনেক পদ্ধতি রয়েছে।তন্মধ্যে কিছু ইমাম হাযেমী রহঃ(মৃঃ৫৮৪ হিঃ) তার "الاعتبار في الناسخ والمنسوخ من الآثار"এর মাঝে তুলে ধরেছেন,এর সঙ্গে আরো কিছু যোগ করেছেন ইরাকী রহঃ(মৃঃ৮০৬হিঃ),সেগুলোর সঙ্গে আবার আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতী রহঃ(মৃঃ৯১১হিঃ) তার تدريب الراوي-তে আরো কিছু যোগ করেছেন।সর্বশেষ ইমাম শাওকানী রহঃ সবাইকে ছাড়িয়ে তার "إرشاد الفحول إلى تحقيق الحق من من علم الأصول" এর মাঝে প্রায় ১৬২ টি পদ্ধতি উল্লেখ করেন।
(একথাগুলো এখানে বলার উদ্দেশ্য, একটা ভুল বুঝাবুঝির অপনোদন।আমরা অনেকেই মনে করি কোন হাদিস বুখারী বা মুসলিমে থাকলেই সেটাকে অন্যান্য হাদিসের উপর অগ্রাধিকার দিতে হবে।অথচ কোন হাদিস বুখারী-মুসলিমে থাকলে সেটাকে অগ্রাধিকার দেয়া উপরোক্ত ১৬২টি পদ্ধতির একটি পদ্ধতি মাত্র।এপ্রসঙ্গে মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেবের শারহে নুখবার শরাহ "تنقيح الفكر"র মাঝে
"فكرة الاكتفاء بالصحيحين"
শিরোনামে আরো অনেক যুক্তি সহকারে একটি সুন্দর ভারসাম্যপূর্ণ আলোচনা আছে।আগ্রহীরা দেখে নিতে পারেন।)
১১.হাদীসটির ব্যাপারে সালাফ থেকে প্রামাণ্য ত্বা'ন(অভিযোগ) পাওয়া না যাওয়া।
১২.হাদীসটি নুসুসে শারইয়্যাহ থেকে থেকে উৎসারিত কোন মূলনীতির বিপরীত না হওয়া।এক্ষেত্রে তিনি হাদীসটি বাদ দিয়ে সে মূলনীতির উপরই আমল করেন।এসকল মূলনীতি যেহেতু কোরআন সুন্নাহ থেকেই উৎসারিত, তাই তিনি এই হাদীসটিকে "শায"(বিচ্ছিন্ন) হিসেবে গণ্য করেন।আর আমরা সবাই জানি,শায না হওয়া হাদীস সহীহ হওয়ার পূর্বশর্ত।
ইমাম তহাবী রহঃকৃত "শারহু মা'আনিল আসার" অধ্যয়ন করলে এর অনেক নমুনা পাওয়া যাবে।
১৩.সিকাহ রাবীদের মুরসাল বর্ণনা গ্রহণ করা; যখন তার চাইতে শক্তিশালী কোন দলিল পাওয়া না যায়।
যাহেদ কাউসারী রহঃ(মৃঃ ১৩৭১হিঃ) তাঁর "তানিবুল খতিব"-এ বলেন,
"মুরসাল হাদিসের মাধ্যমে দলিল উপস্থাপন "সুন্নাতে মুতাওয়ারিসা"(প্রজন্ম পরম্পরায় চলে আসা সুন্নাহ)।
খায়রুল কুরুনের লোকেরাও এর উপর চলেছেন।
এমনকি ইবনে জারির তাবারী রহঃ(মৃঃ ৩১০হিঃ) বলেন,
"নির্বিচারে মুরসাল হাদীস প্রত্যাখ্যান করা বিদআত, যা দ্বিতীয় শতাব্দীর শুরুতে প্রকাশ পেয়েছে।"
যেমনটা আবুল ওয়ালিদ বাজী রহঃ(মৃঃ ৪৭৪হিঃ) তাঁর 'ইহকামুল ফুসুল ফি আহকামিল উসুল'-এ, ইবনু আব্দিল বার রহঃ(মৃঃ ৪৬৩হিঃ) তাঁর 'তামহিদ'-এ,ইবনে রজব হানবালী রহঃ(মৃঃ ৭৯৫হিঃ)তাঁর 'শারহু ইলালিত তিরমিযি'-তে উল্লেখ করেছেন।
বরং আপনি ইমাম বোখারী রহঃকে পর্যন্ত দেখবেন তাঁর 'জুযউল ক্বিরাআত খালফাল ইমাম' ও অন্যান্য রচনার ন্যায় সহীহ বোখারীতেও মুরসাল হাদীস দ্বারা দলিল পেশ করছেন।ইমাম মুসলিম রহঃ তো তাঁর সহীহ মুসলিমেই অনেক মুরসাল হাদীস নিয়ে এসেছেন।
এপ্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা আপনি আল্লামা শাব্বির আহমাদ উসমানী রহঃ(মৃঃ ১৩৬৯হিঃ) এর 'ফাতহুল মুলহিম'(১/৩৬) ও সুয়ুতী রহঃ(মৃঃ৯১১হিঃ)এর "তাদরিবুর রাবী" (পৃঃ১৩৫-১৩৬)তে পাবেন।
এরপর তিনি(কাউসারী রহঃ) বলেন,যে ব্যাক্তি শুধুমাত্র মুরসাল হওয়ার কারণে হাদীসকে জয়িফ সাব্যস্ত করে সে যেন সুন্নাহের বিশাল অংশকেই ছুড়ে ফেলে দেয়।'
তিনি আরো বলেন,যে ব্যাক্তি ইমাম আবু হানীফা রহঃএর ব্যাপারে এরকম ধারণা করে যে, তিনি হাদিস কম জানতেন বা হাদীসের প্রচুর বিরোধিতা করতেন কিংবা বেশীরভাগ যয়ীফ হাদীস গ্রহণ করতেন;সে মূলত হাদীস গ্রহণের ক্ষেত্রে ইমামগনের মূলনীতিগুলোই জানেনা।এবং মুজতাহিদ ইমামগণের 'ইলম' তার ত্রুটিপূর্ণ ব্যাক্তিগত মানদণ্ড দিয়ে পরিমাপ করতে চায়!"
------ ------
আমাদের অনেক ভাই মনে করেন,সব ইখতিলাফ শুধু ফুকাহাদের মাঝেই, মুহাদ্দিসগণের মাঝে কোন ইখতিলাফ নেই।উপরন্তু তারা এই ইখতিলাফকে খুবই নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করে থাকেন।অনেকের কথায় এমন ভাবও ফুটে উঠে যে,এই ফিকহী ইখতিলাফই উম্মাহর বিভক্তির কারণ!
ড. বিলাল ফিলিপস তার বই 'Evolution of the madh-habs' যা সিয়ান পাবলিকেশন্স থেকে 'মাযহাবঃ অতিত,বর্তমান ও ভবিষ্যৎ' নামে অনূদিত হয়েছে,তাতে মাযহাব মানা ও না মানা উভয় সিদ্ধান্তকে প্রান্তিক বলে দাবি করে মাযহাব মানা লোকদের সম্পর্কে বলেন,
'এই উভয় সিদ্ধান্তই অনাকাঙ্ক্ষিত।দ্বিতীয় মতের অনুসারীগণ এই মাযহাবকেন্দ্রিক মতপার্থক্যকে এক ধরণের স্থায়ী রূপ দান করেছেন।এসব দৃষ্টিভঙ্গি অতিতেও মুসলমানদের বিভক্ত করেছে এবং বর্তমানেও করে চলছে।' {পৃ:২০}
এখানে 'বিভক্তি' বলে লেখক ঠিক কোন ধরণের বিভক্তি বুঝিয়েছেন তা লেখকই জানেন।অন্যথায় পুরো ইসলামের ইতিহাসে স্রেফ মাযহাবকে কেন্দ্র করে উম্মাহর মাঝে ফাটল কিংবা অনৈক্য দেখা দিয়েছে,এরকম নজির কেউ দেখাতে পারবেনা।হ্যা নিতান্ত বিচ্ছিন্নভাবে ব্যাক্তি বিশেষের বাড়াবাড়ি বা ছাড়াছাড়ির কারণে কোন কোন ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন দেখা গিয়েছে,নয়তো يَكونُ في أمَّتي رجلٌ يُقالُ لَهُ : ابنُ إدريسَ أضرُّ على أمَّتي مِن إبليسَ ورجلٌ يُقالُ لَهُ أبو حَنيفةَ هوَ سراجُ أمَّتي -এধরণের জাল বর্ণনা তৈরি হয়েছে কিভাবে?
কিন্তু মেজরিটি মু'তাদিল লোকেদের থাকায় এরা বিশেষ পাত্তা পায়নি।ফলে সময়ের সাথে সাথে এরাও হারিয়ে গেছে।
এই লেখায় আমরা দেখানোর চেষ্টা করবো,ইখতিলাফ শুধু ফুকাহাদের মাঝে ছিলোনা,বরং মুহাদ্দিসগণের মাঝেও অনেক মতানৈক্য ছিলো।কোন রাবীকে একজন মুহাদ্দিস নিজের ইজতিহাদ অনুযায়ী ছিকাহ বলেছেন তো আরেকজন বলেছেন যয়িফ।তাইতো আমরা দেখতে পাই জাবের আল-জু'ফীর ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা রহঃ বলছেন,ما رأيت أكذب من جابر الجعفي কিন্তু শুবা রহঃ তার থেকে রেওয়ায়েত নিচ্ছেন।মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাকের ব্যাপারে একদিকে ইমাম মালেক বলছেন,
دجال من الدجاجلة، نحن أخرجناه من المدينة
অপরদিকে শুবা রহঃ "أمير المؤمنين في الحديث" বলছেন। ইমাম বুখারী সহীহ বুখারীতে তার বক্তব্য নিয়ে আসছেন!
কোন হাদিসকে এক মুহাদ্দিস নিজের ইজতিহাদ অনুযায়ী তাসহীহ করেছেন তো অন্যরা তাযয়িফ করেছেন।এর অসংখ্য নজির তো আমাদের সবার সামনেই আছে।
এবার চলুন মুহাদ্দিসগণের মাঝে থাকা কিছু মৌলিক ইখতিলাফের নমুনা দেখে নেয়া যাক—
আমরা জানি, কোন হাদিস সহীহ হতে হলে তাতে পাঁচটি শর্তের উপস্থিতি জরুরি-
১. اتصال السند বা অবিচ্ছিন্ন সূত্র।
২. عدالة الراوي বা বর্ণনাকারীর বিশ্বস্ততা।
৩. ضبط الراي বা বর্ণনাকারীর স্মৃতিশক্তি।
৪. السلامة من الشذوذ বা সনদ ও মতন বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্ত হওয়া।
৫. السلامة من العلة القادحة বা সুক্ষ্ম ত্রুটি থেকে মুক্ত হওয়া।
এখন আমরা এই সবগুলো শর্তের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণের কিছু ইখতিলাফের নমুনা তুলে ধরবো—
• ইত্তিসাল বা অবিচ্ছিন্ন সূত্রের শর্তটি প্রমাণিত হওয়ার
ক্ষেত্রে খোদ ইমাম বোখারী ও মুসলিমের মাঝেই বিশাল মতানৈক্য রয়েছে।যা 'مسئلة اللقاء' হিসেবে প্রসিদ্ধ।এমনকি এই মতানৈক্যের জের ধরে ইমাম মুসলিম তার সহিহ মুসলিমের মুকাদ্দিমায় ইমাম বুখারী ও এই মতের প্রবক্তা অন্যান্য মুহাদ্দিসগণকে 'بعض منتحلي الحديث' বলেছেন।কওমী মাদ্রাসায় দাওরা পড়া ছাত্র মানেই জানেন কত কঠিন শব্দপ্রয়োগ এটি।
তো ইমাম বুখারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ হাদিসের সনদে উল্লেখিত শায়খ ও ছাত্রের মাঝে একবার হলেও সাক্ষাৎ প্রমাণিত থাকার শর্ত আরোপ করেন।অপরদিকে ইমাম মুসলিম ও আরো কিছু লোকেরা শুধুমাত্র সাক্ষাতের সম্ভাবনাকেই যথেষ্ট মনে করেন।এমনকি মুসলিম রহঃ তাঁর এই মতের ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের ইজমা থাকার কথাও দাবি করেছেন।
চিন্তাশীল মানুষ মাত্রই অনুভব করতে পারছেন,এই একটি মূলনীতিগত ইখতিলাফের কারনে কি পরিমাণ শাখাগত মাসআলায় মতানৈক্য তৈরি হবে।ইমাম মুসলিম ও তাঁর মতের প্রবক্তাগণ এই মূলনীতির উপর ভিত্তি করে যে সকল হাদিসকে সহিহ বলবেন ও তা থেকে মাসআলা আহরণ করবেন; এসবকিছু ইমাম বুখারী ও তাঁর অনুসারীদের নিকট দূর্বল।এগুলো থেকে আহরণ করা মাসআলাও অগ্রহণযোগ্য।
ইত্তিসালের মাসআলায় ইখতিলাফের আরো বড় ক্ষেত্র হচ্ছে,হাদিসে মুরসাল যা কোন তাবেয়ী সাহাবীর মধ্যস্থতা ছাড়া সরাসরি রাসুলুল্লাহ ﷺ থেকে বর্ণনা করেন।
→অধিকাংশ মুহাদ্দিসিনে কেরামগণের নিকট হাদিসে মুরসাল জয়িফ।
→অধিকাংশ ফুকাহায়ে কেরাম (যাদের মাঝে ইমাম আবু হানীফা,ইমাম মালেক ও আহমাদ রহঃ ও এক মতানুযায়ী আছেন)এর মতে তা সহিহ ও দলিলযোগ্য।
→ইমাম শাফেয়ী রহঃ এর নিকট শর্ত সাপেক্ষে তা দলিলযোগ্য হতে পারে।
এখন ইমাম শাফেয়ী রহঃ কতৃক আরোপিত শর্ত পাওয়া যায়নি,এমন হাদিস দ্বারা অন্যান্য ফকিহগণ যদি কোন মাসআলা ইস্তিম্বাত করেন; তবে স্পষ্টতই ইমাম শাফেয়ী ও মুহাদ্দিসিনে কেরাম তার বিপরিতে অবস্থান নিবেন।
• রাবীর বিশ্বস্ততার জায়গাতেও ইখতিলাফের বিশাল ক্ষেত্র রয়েছে।কোন্ ধরণের বিশ্বস্ততা এখানে গ্রহণযোগ্য এটা নিয়েও মতানৈক্য রয়েছে।
→রাবী এমন মুসলিম হওয়াই কি যথেষ্ট যার ব্যাপারে কোন জরাহ প্রমাণিত নেই?
→নাকি এর পাশাপাশি বাহ্যিক ন্যায়পরায়ণতাও লাগবে?
→শুধু বাহ্যিক ন্যায়পরায়ণতাই চলবে? নাকি এর সাথে সাথে আভ্যন্তরীণ ন্যায়পরায়ণতাও থাকতে হবে?
→এরপর শুধু একজন ইমাম কতৃক রাবীর ন্যায়পরায়ণতার সাক্ষি দেয়াই যথেষ্ট? দুজন লাগবে?
→এগুলোর পাশাপাশি কোন্ কোন্ বিষয় রাবীর বিশ্বস্ততাকে নষ্ট করে দেয়?কোনগুলো দেয়না?
এখানেও মতান্তরের বিশাল ক্ষেত্র রয়েছে।কত রাবীকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে শুধুমাত্র 'ইরাকী' হওয়ার কারনে জরাহ করা হয়েছে! কত রাবীর 'আদালাত'(বিশ্বস্ততা) বিলোপ করা হয়েছে 'আহলুর রায়' হওয়ার অপরাধে(?) কত রাবীকে 'খালকে কুরআন'এর মাসআলায় মুখ খোলার কারণে যিন্দিক কিংবা বিদআতি বলে দেয়া হয়েছে! খোদ ইমাম বুখারী যার শিকার হয়েছিলেন নিজ উস্তায যুহলীর পক্ষ থেকে।
তাই শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা হাফিযাহুল্লাহ বলেন,জরাহ তা'দিলের 'ইতিহাস' ও এর 'আভ্যন্তরীণ বিষয়াদি' জানা এবং এর 'ফিকহ' অর্জন ছাড়া এগুলো থেকে বাঁচা সম্ভব নয়।
• রাবীর স্মৃতিশক্তি প্রমাণের জায়গাতেও যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে।ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর মতে রাবী তার শায়খ থেকে হাদিস গ্রহণের পর থেকে নিজের ছাত্রদের শেখানোর আগপর্যন্ত পুরো সময় ধরে হাদিসটিকে তার মস্তিষ্কে সংরক্ষণ করতে হবে।কিছু সময়ের জন্যেও ভুলে যাওয়া চলবেনা।এমনকি ব্যাক্তিগত নোট খাতা দেখেও যদি হাদিস বর্ণনা করতে যায়, তবু্ও যতক্ষণ না পর্যন্ত এব্যাপারে নিশ্চিত হবে যে, এটা তার নিজের লেখা ততক্ষণ সেটা বর্ণনা করতে পারবেনা।অর্থাৎ শুধু নিজের খাতায় নিজের লেখার মতো লেখা দেখেই বর্ণনা করতে পারবেনা, যদি না নিজে সেটা লেখার কথা মনে থাকে।
• 'সনদ ও মতন বিচ্ছিন্নতা ও সুক্ষ্ম ত্রুটি থেকে মুক্ত হওয়া' এখানে যে আরো বিশাল মতপার্থক্যের সুযোগ রয়েছে ইলালের কিতাবগুলোই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
এখানে রয়েছে মুহাদ্দিসের 'যাওক' বা শাস্ত্রীয় রুচির প্রভাব।এমনকি অনেক বিষয় এমন রয়েছে যেগুলো কোন মুহাদ্দিস স্রেফ নিজে অনুভব করতে পারেন কিন্তু কথায় ব্যাক্ত করার মতো ভাষা পাননা।বলা যেতে পারে অনেকটা জহুরীর মতো।অনেক সময় জহুরীকে স্বর্ণের মতো দেখতে কোন ধাতু দেয়ার পর সে এটাকে দেখেই ভেজাল ধরে ফেলতে পারে কিন্তু তার কাছে যদি এর প্রমাণ চাওয়া হয় সে কোন প্রমাণ দেখাতে পারবেনা।অথচ তার মন্তব্য পুরোপুরি নির্ভুল।
তাইতো আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতী (৯১১হিঃ) বলেন,
ربما تقصر عبارة المعلل عن إقامة الحجة على دعواه، كالصيرفي في نقد الدينار والدرهم
তারীবুর রাবী (পৃঃ১৬১-১৬২)
মাওলানা আব্দুল মালেক (হাফিযাহুল্লাহ)র এই কথাটা এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক—
بل قرائن خصوص المقام وشواهد الحال وشهادة الوجدان قد تحكم على القواعد فتجعلها أكثرية أو أدنى من ذلك، وأصحاب البصيرة النافذة من أئمة الحديث والمجتهدين ليسوا بمتقيدين تقيدا حرفيا بالقواعد التي صاغ عباراتها المحدثون المتأخرون في كتب المصطلح، بل جل تلك القواعد مما استبط بالنظر في صنيع الأئمة وأحكامهم على الرواة
المدخل إلى علوم الحديث الشريف (পৃঃ ১৬৭)
(সুবহানাল্লাহ! স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো কথা।)
উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা সুস্পষ্ট যে,মুহাদ্দিসিনে কেরামগণের মাঝেও যথেষ্ট পরিমাণে ইখতিলাফ ছিলো,এবং ক্ষেত্রবিশেষে এগুলোকে কেন্দ্র করে তাঁরা একজন আরেকজনের ব্যাপারে কঠিন কঠিন শব্দও প্রয়োগ করেছিলেন।কিন্তু ফিকহ যেহেতু হাদিসের প্রায়োগিক দিকের সাথে সম্পর্কিত তাই এখানকার ইখতিলাফটা বড় করে চোখে পড়েছে।অপরদিকে হাদিসের ইখতিলাফ স্রেফ তাত্ত্বিকতায় সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে।
------ ------
ঘটনা-১
ছোটভাই মেরিন একাডেমি থেকে গ্র্যাজুয়েশান কমপ্লিট করে তাবলীগে গিয়ে নতুন নতুন ইসলাম প্র্যাকটিস করা শুরু করেছে।মাঝে মাঝে আমাকে এটা সেটা জিজ্ঞেস করে।ক্যাডেট হিসেবে প্রথমবারের মতো জাহাজে উঠার পর সেদিন নেটওয়ার্ক খারাপ থাকায় এসএমএস করে জানতে চাইলো সেখানে কসর করবে নাকি পুরো চার রাকাতই পড়তে হবে?
উত্তর নিয়ে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে গেলাম।একবার মনে হচ্ছে,কসর করতে হবে;আরেকবার মনে হচ্ছে,জাহাজের মাসআলা কিছুটা ভিন্নও তো হতে পারে।
জীবনে প্রথমবার নেটওয়ার্ক খারাপ থাকার কারণে মনে খুশি অনুভব করলাম।যাক ছোটভাইয়ের সামনে "জানিনা" বলতে হয়নি।
ঘটনা-২
কয়েকমাস আগে নাহবেমীর জামাতের দুজন ছাত্র এলো পড়া বুঝে নিতে।নাহবেমীরের শেষে যুক্তকরা "জুমাল" নামক ছোট রিসালাটি নিয়ে।দুজনই ভালো ছাত্র। মেধার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ তায়ালা পরিশ্রম করার মানসিকতাও দিয়েছেন।তবে ইতিপূর্বে তাদের মেধা ও শ্রমের পুরোটা ব্যয়িত হতো শুধু মূখস্ত করার পেছনে।কিন্তু মূখস্ত করার পাশাপাশি বোঝটাও যে সমান গুরুত্ব রাখে বরং ক্ষেত্রবিশেষে এটা আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে,এটা আমিই তাদেরকে বুঝিয়ে ছিলাম।ফলে তারাও কোথাও কিছু না বোঝলেই নির্দ্বিধায় আমার কাছে চলে আসত।তো এবার পুরোটা বুঝিয়ে দিয়ে শেষে একজায়গায় গিয়ে আটকে গেলাম।"জুমলায়ে মাকত্বুয়া" এর সংজ্ঞাটি কিছুতেই বুঝতে পারছিলামনা। বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করে শেষে "বুঝতে পারছিনা" বলেছিলাম। কিন্তু এটা বলতে ভেতরে অল্পকিছু দ্বিধাও কাজ করেছিলো।(পরিমানে খুব কম হলেও)কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লেগেছিলো। যা মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে কিছুক্ষণ সময় লেগেছিলো।
প্রশ্ন হচ্ছে,এমনটা কেনো হবে?
কেনো আমি যা জানিনা,তা বলতে লজ্জা পাবো?
"জানিনা" বলতে হয়নি বলে নেটওয়ার্ক খারাপ থাকায় মনে মনে খুশি হবো?
নিজেকে সবজান্তা হিসেবে দেখাতে কেনো পছন্দ করবো?
খোদ আল্লাহর রাসূল (সাঃ) থেকে শুরু করে সাহাবী,তাবেয়ী,তাবে' তাবেয়ীরা যদি প্রশ্নের উত্তর জানা না থাকলে জানিনা বলতে পারেন,তবে আমি কোথাকার কোন মহাজ্ঞানী হয়ে গেলাম যে, "জানিনা" বলতে ইগোতে লাগে ?
# আব্দুর রহমান ইবনে মাহদী রহঃ (মৃঃ১৯৮ হিঃ) বলেন,
আমরা ইমাম মালেক রহঃ এর মজলিসে বসা ছিলাম। একলোক এসে বললো—
হে আবু আব্দুর রহমান! (ইমাম মালেকের উপনাম)
আমি দীর্ঘ ছয়মাসের দূরত্ব থেকে সফর করে এসেছি। আমার শহরের লোকেরা কয়েকটি বিষয় জানতে আপনার কাছে পাঠিয়েছে।
ইমাম মালেক বললেন,ঠিকাছে তুমি প্রশ্ন কর।
সে একটি মাসআলা জানতে চাইলে ইমাম মালেক নির্দ্বিধায় বললেন—"لا أحسنها" আমি এর উত্তর ভালোভাবে জানিনা।
বর্ণনাকারী বলেন,এটা শুনে লোকটি হতভম্ব হয়ে গেলো। যেনো সে এমন একজনকে প্রশ্ন করে ছিলো যে সব কিছু জানে!
সম্বিৎ ফিরে পেয়ে সে বললো,এখন আমি আমার শহরের লোকদের কি উত্তর দিবো?
ইমাম মালেক বললেন, তুমি গিয়ে তাদের বলবে—
قال مالك: لا أحسن
মালেক বলেছেন, "আমি এর উত্তর ভালোভাবে জানিনা।"
## ইমাম মালেক রহঃএর প্রসিদ্ধ ছাত্র ইবনে ওয়াহাব রহঃ বলেন,আমি ইমাম মালেককে এতো বেশি "লা আদরী" বলতে শুনেছি যে,এগুলো জমা করলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ভরে যেতো!
এগুলো তারা কোত্থেকে শিখলেন?
আসলে তাদের বড়রাও এমনই ছিলেন।
# ইবনে ওয়াহাব রহঃ বলেন,আমি ইমাম মালেককে বলতে শুনেছি,একবার আব্দুল্লাহ ইবনে নাফে আইয়ুব আসসাখতিয়ানী রহঃ কে কোন বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি উত্তর না দিয়ে চুপ থাকেন।
—আপনি হয়তো আমার প্রশ্নটি বুঝতে পারেননি।
—কেনো বুঝবোনা অবশ্যই বুঝেছি।
—তাহলে উত্তর দেননি কেনো?
—আমি এর উত্তর জানিনা।
## ইমাম মালেক রহঃ আরো বলেন, আমি মুহাম্মাদ ইবনে আজলান রহঃ কে বলতে শুনেছি—
কোন আলেম যখন "লা আদরী" বলা ভুলে যায়,তার কথাবার্তায় ভুল ত্রুটি হতে শুরু করে।
ইবনে আব্বাস রাঃ থেকেও এমন বর্ণনা পাওয়া যায়।
ইমাম মালেক রহঃ আরো বলেন,
যে ব্যাক্তি কোন মাসআলার উত্তর দিতে চায়,তার উচিত উত্তর দেয়ার আগে নিজেকে জান্নাত এবং জাহান্নামের সামনে কল্পনা করা,আখেরাতে কিভাবে সে মুক্তি পাবে তা আগেই চিন্তা নেয়া।
একবার তাঁকে একটি মাসআলা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, "লা আদরী"।তখন তাঁকে বলা হলো,এটাতো খুবই হালকা ও সহজ একটি মাসআলা।
কথাটি শুনে তিনি খুবই রেগে উঠলেন।সেইসাথে বললেন,
" ইলমের কোন জিনিসই হালকা নয়।তুমি কি এই আয়াত শুনোনি? إِنَّا سَنُلْقِي عَلَيْكَ قَوْلا ثَقِيلا
শীঘ্রই আমি তোমার উপর অত্যন্ত ভারী বাণী নাযিল করবো।
# তাইতো ইবনে উমার রাঃ বলেন, ইলম হচ্ছে তিনটি জিনিস—কুরআন,সুন্নাহ ও "লা আদরী"।
## ইমাম আবু দাউদ রহঃ বলেন,
قول الرجل فيما لا يعلم: لا أعلم، نصف العلم
নিজের নাজানা বিষয়ে "লা আদরী" বলা ইলমের অর্ধেক।
### ইমাম ইবনে আব্দুল বার রহঃ(৪৬৩ হিঃ) রচিত "জামিউ বায়ানিল ইলম"এ তিনি এক আলেমের কথা নকল করেন—
ليس معي من العلم إلا أني أعلم أني لست أعلم
আমার কাছে কোনও ইলম নেই।তবে এটুকু জানি যে,"আমি জানিনা"।
একবার সাঈদ ইবনে জুবাইর রহঃকে কোন বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমি জানিনা।এরপর বললেন,ঐ ব্যাক্তি ধ্বংস হোক,যে না জেনেও বলে আমি জানি।
আবু বকর রাঃ এর পৌত্র কাসিম বিন মুহাম্মাদকে এক ব্যাক্তি প্রশ্ন করলে তিনি বলেন,আমি বিষয়টি ভালোভাবে জানিনা।লোকটি পূনরায় বললো,আমি আপনার কাছেই বিষয়টিকে সোপর্দ করে দিলাম।আমি আপনাকে ছাড়া আর কাউকে চিনিনা।
তিনি উত্তর দিলেন—
لا تنظر إلى طول لحيتي، وكثرة الناس حولي، والله لا أحسنه
আমার লম্বা দাড়ি আর চারপাশে এতো মানুষজন দেখে লাভ নেই।আল্লাহর কসম আমি জানিনা।
শেষে আরো বললেন—
والله لئن يقطع لساني أحب إليَّ من أن أتكلم بما لا أعلم
আল্লাহর কসম! আমার জিহ্বা কেটে দেয়া হবে,এটা আমার কাছে বেশী পছন্দনীয়;আমি যে বিষয়ে জানিনা সে বিষয়ে কথা বলার চাইতে।
একবার ইবনে উমার রাঃ এর পৌত্র কাসিম বিন উবাইদুল্লাহ রহঃকে এমন একটি বিষয়ে প্রশ্ন করা হলো যা তাঁর জানা ছিলনা।তো উত্তর না দেয়ায় ইয়াহয়া ইবনে সায়ীদ তাকে বললেন—
এটাতো খুবই মন্দ ও মারাত্মক বিষয় যে, আপনাকে কোন বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে আর সে বিষয়ের ইলম আপনার কাছে থাকবেনা! অথচ আপনি উমার ও ইবনে উমারের মতো মহান ব্যাক্তিত্বদ্বয়ের পুত্র!!
তিনি উত্তর দিলেন—
কিন্তু আল্লাহর নিকট এবং তাঁর পক্ষ হতে দ্বীনের 'বুঝ'প্রাপ্ত লোকদের নিকটে এর চাইতেও মারাত্মক বিষয় হলো,আমি ইলম ছাড়া উত্তর দিবো কিংবা অবিশ্বস্ত ব্যাক্তি হতে বর্ণনা করবো।
আহা কি ছিলো তাদের অবস্থা?
আর এখন আমরা কোথায় এসে হাজির হয়েছি।?জানি বা নাজানি কেউ প্রশ্ন করলেই নিজের ইলম ঝাড়তে শুরু করি,এমনকি আমাকে প্রশ্ন না করা হলেও নিজ থেকে যেচে গিয়ে জ্ঞান দিয়ে আসি।
অথচ সাহাবায়ে কেরামগণের চেষ্টা ছিলো—
প্রসিদ্ধ তাবেয়ী আব্দুর রহমান ইবনে আবি লায়লা বলেন,আমি একশত বিশজন আনসারী সাহাবীকে পেয়েছি।যাদের একজনকে কোন মাসআলা জিজ্ঞেস করা হলে নিজে উত্তর না দিয়ে আরেকজনের কাছে পাঠিয়ে দিতেন।শেষে দেখা যেতো,প্রশ্নটি ঘুরে আবার প্রথমজনের কাছেই ফিরে এসেছে।তাঁরা প্রত্যেকেই চাইতেন তাঁর পরিবর্তে অপর মুসলিম ভাই এর উত্তর দিক।
হাসান আল আসাদী রহঃ বলেন, তোমরা এমন এমন মাসআলায়ও নিজে ফাতওয়া দিয়ে বসো,যেগুলির কোন একটা উমার রাঃ এর সামনে আসলে তা সমাধানের জন্যে তিনি সকল বদরী সাহাবীদেরকে একত্রিত করতেন!
উকবা ইবনে মুসলিম বলেন,
আমি ইবনে উমার রাঃ এর সংস্রবে ৩৪ মাস থেকেছি।অনেক সময়ই তাঁকে প্রশ্ন করা হলে বলতেন,"লা আদরী"।এরপর আমার দিকে ফিরে বলতেন,
تدري ما يريد هؤلاء؟ يريدون أن يجعلوا ظهورنا جسراً لهم إلى جهنم
"তুমি কি জান এসকল লোকেরা কি চায়? এরা চায়,আমাদের পিঠকে পুল বানিয়ে তারা জাহান্নামে যাবে!
আশআস রহঃ বলেন,
ইবনে সীরীন রহঃকে যখন ফিকহের কোন হালাল-হারামের বিষয়ে প্রশ্ন করা হত,তাঁর চেহারার রং পাল্টে যেত।তাঁর অবস্থা এমন হয়ে যেত যে,তাকে দেখলে মনেই হতনা,ইনি কিছুক্ষণ আগেও স্বাভাবিক ছিলেন।
ইবনে সারহ রহঃ(মৃঃ ২৫০হিঃ) খুবই সুন্দর বলেছেন—
قد صار "لا أدري" عند أهل زماننا هذا عيبا
আমাদের এই যুগে "লা আদরী" বলাটা দোষে পরিণত হয়েছে!
কথাটা তিনি বলেছিলেন দ্বিতীয় শতাব্দীতে।আর আমরা আছি পঞ্চদশ শতাব্দীতে।
আসলে আমাদের এই যুগে প্রশ্নকারী ও উত্তরদাতা উভয়ের মাঝেই সমস্যা রয়েছে।
উত্তরদাতারা মনে করে,জানিনা বললেই আমার মান সম্মান শ্যাষ!প্রেস্টিজ পাংচার!
তাই কোন ভাবেই জানিনা বলা চলবেনা।প্রয়োজনে উল্টাপাল্টা বলে হলেও মান বাঁচাতে হবে।
অপরদিকে প্রশ্নকারীদের অবস্থা হলো, কেউ যদি একবার ভুলেও জানিনা বলে ফেলে তবেই সেরেছে।সারা এলাকা বলে বেড়াবে,অমুক হুজুরকে একটা প্রশ্ন করেছিলাম উত্তর দিতে পারেনি।এইলোক কিচ্ছু জানেনা।এতদিন তবে কি ঘোড়ার ঘাস কাটলো?
তবে অনেক সচেতন মানুষও রয়েছেন।যারা এই ধরনের বিষয়গুলোকে স্বাভাবিক ভাবেই গ্রহণ করেন।
কিন্তু এভাবে আর কতদিন?
এই বাজে পরিবেশটা আমাদের পাল্টানো দরকার।
ইবনে উমার রাঃ হতে বর্ণিত,একবার একলোক রাসুলুল্লাহ সাঃ এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,ইয়া রাসুলাল্লাহ! দুনিয়াতে সর্বোত্তম স্থান কোনটি?
তিনি বললেন,"লা আদরী"।লোকটি আবার জিজ্ঞেস করলো,ইয়া রাসুলাল্লাহ! দুনিয়াতে সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্থান কোনটি? তিনি আবার বললেন, "লা আদরী"।
এরপর জিবরাঈল আঃ আসলেন। রাসূলুল্লাহ সাঃ তাঁকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে তিনিও বলেন, "লা আদরী"।
পরিশেষে জিবরাঈল আঃ আল্লাহ তায়ালার কাছে জিজ্ঞেস করে জেনে আসেন যে,দুনিয়াতে সর্বোত্তম স্থান মাসজিদ,আর সবচে' নিকৃষ্ট স্থান বাজার।
আমাদের ভাবা উচিত,যেখানে "أوتيت علم الأولين و الآخرين" এর দাবী করা মহান মানুষটি পর্যন্ত "জানিনা" বলতে লজ্জাবোধ করেননি,সেখানে আমি কোন আল্লামা,ফাহহামা,শায়খুল ইসলাম হয়ে গেলাম যে,না-জানা বিষয়ে জানিনা বলতে লজ্জা পাই?
পরিশেষে আলী রাঃ এর একটা কথা দিয়ে শেষ করি।তিনি বলেন,
يا بردها على الكبد! أن تقول لما لا تعلم الله أعلم
এটা কতইনা অন্তর প্রশান্তকারী যে,তুমি যা জাননা তাতে বলবে,আল্লাহ ভালো জানেন।
হাদিসের কিতাবগুলোতে তাই অহরহ আমরা দেখতে পাই সাহাবায়ে কেরামগণ বলছেন—
الله و رسوله أعلم
আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভালো জানেন।
(পুনশ্চঃ অনেক ঘাটাঘাটি করেও "জুমলায়ে মাকতুয়া"র সংজ্ঞাটি আমি এখনো বুঝতে পারিনি।এই নামে কোন জুমলার অস্তিত্বও এই জুমাল নামক রিসালা ছাড়া অন্য কোথাও পাইনি।কেউ সাহায্য করলে অধম তার দোয়ায় অবশ্যই তাঁকে স্মরণ রাখবে।)
তথ্যসূত্র
الكامل لابن عدي
جامع بيان العلم وفضله
عيون الأخبار
مقدمة صحيح مسلم
تاريخ دمشق
حلية الأولياء
------ ------
© COPYRIGHT 2021 - Hasbi Academy - We Love Our Students