কয়েকটা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ করার ইচ্ছা ছিলো। অনেকের সাথে অঙ্গীকারবদ্ধও ছিলাম। কিছু ব্যস্ততার জন্য তেমন সময় দিতে পারি না। আরও কিছু দিন হয়তো বিচ্ছিন্ন থাকবো।
একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত অন্যের কাছে কিছু চাওয়া। এক্ষেত্রে আমাদের কী বিশ্বাস রাখতে হবে। কতটুকু পর্যন্ত ইসলামের গন্ডির মধ্যে থাকবে। এ বিষয়টা নিয়ে একটু বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন।
আকিদার অস্পষ্টতার কারণে বিষয়টি অনেক সময় ভয়াবহ হয়ে ওঠে। সঠিক আকিদা না জানার কারণে নিজে যেমন ভুলের মধ্যে থাকে। সেই সাথে অন্যকেও আক্রমণের লক্ষ্য বানায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইমাম ইবনুল জাওযী রহ. তার বিখ্যাত কিতাব আল-ওফা বি-আহওয়ালিল মুস্তফা কিতাবে আবু বকর আল-মিনকারী থেকে একটা ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ইমাম ত্ববারানী, ইমাম আবুশ শায়খ ও ইমাম আব বকর মিনকারী মদিনায় অবস্থান করছিলেন। এক সময় তারা মারাত্মক ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েন। ইমাম আবু বকর মিনকারী বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা ক্ষুধার্ত। আমরা ক্ষুধার্ত। একথা বলে আমি উঠে যাচ্ছিলাম। আবুশ শায়খ আমাকে বললো, বসো। হয়তো রিজিকের ব্যবস্থা হবে না হয় এখানে ইন্তেকাল করবো।
আবু বকর মিনকারী বলেন, আমি ও আবুশ শায়খ সেখানে ঘুমিয়ে পড়লাম। ইমাম ত্ববারানী বসে বসে কিছু দেখছিলেন। ইতোমধ্যে দরজায় আলী রা. বংশের এক আলাভী উপস্থিত হলো। তার সাথে দুজন ছেলে ছিলো। তাদের দু’জনের হাতে অনেক বড় পাত্রে খাবার ছিলো। আমরা উঠে আহার করলাম। আমরা মনে করেছিলাম, খাবার শেষ হলে অবশিষ্ট খাবার সে নিয়ে যাবে। কিন্তু সে পুরো খাবার আমাদেরকে দিয়ে দিলো। খাবার শেষ হলে লোকটি বললো, তোমরা কি রাসূল স. এর কাছে অভিযোগ করেছিলে? আমি রাসূল স. কে স্বপ্নে দেখেছি। তিনি আমাকে তোমাদের জন্য কিছু খাবার আনার আদেশ করেছেন।
ঘটনাটি স্পষ্ট। তবে এর সনদ তাহকিক করার সুযোগ আমার হয়নি। আর এখানে সনদ মূল বিষয় নয়। কেউ এটাতে বিশ্বাস না করলেও কোন কিছু যায় আসে না। কিন্তু ইসলামের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কিতাবে যেহেতু ঘটনাটি এসেছে, মূল ঘটনার মানটি জানা জরুরি হয়ে পড়েছে। এই ঘটনা কি আসলে শিরক?
তিন মুহাদ্দিস রাসূল স. এর কাছে ক্ষুধার অভিযোগ করেছেন। এক কথায় বলতে গেলে, প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী এটি সুস্পষ্ট বড় শিরক। এধরণের কাজের জন্য তিন জন অথবা যিনি রাসূল স. এর কাছে অভিযোগ করেছেন বা যারা সমর্থন করেছেন, তারা মুশরিক হয়ে গেছেন।
ইবনুল জাওযী রহ. ঘটনাটি উল্লেখ করে শিরক প্রচার করেছেন। তিনি এটি সমর্থন করে থাকলে তিনিও মুশরিক হয়ে গেছেন।
মোট কথা, সাধারণ বিশ্বাস অনুযায়ী তারা বড় শিরক করে ইসলাম থেকে বের হয়ে গেছেন।
এজাতীয় বহু ঘটনা আমার নজরে এসেছে। অনেক বড় বড় মুহাদ্দিসদের থেকেও এসেছে। ঘটনাগুলোতে স্পষ্টভাবে তারা অন্যের কাছে এভাবে সাহায্য চেয়েছেন। মৃতের কাছে অভিযোগ করেছেন। এক্ষেত্রে আমি কী বিশ্বাস করবো?
১. এরা সকলেই মুশরিক? সকলেই তওবা না করে থাকলে মুশরিক হয়ে মারা গেছে?
২. যারা এগুলো লিখেছে, সংরক্ষণ করেছে, বর্ণনা করেছে, সমর্থন করেছে, তারা সকলেই মুশরিক? সকলেই বড় শিরক করে ইসলাম থেকে বের হয়ে গেছে?
প্রচলিত শিরকের ধারণা নিয়ে আমার পড়া-শোনার শুরুটা হয়েছে এখান থেকে। বিষয়টা আদৌ শিরক কি না? শিরক এর সাথে এর সম্পর্ক কতটুকু?
বিষয়টি পর্যালোচনা করে আমার কাছে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে, প্রচলিত শিরকের ধারণাটাই গলদ। যারা বিষয়টা নিয়ে কথা বলেন, তারা কয়েকটি ভুল করে থাকেন।
১. কিছু ভাসা ভাসা আলোচনাকে মূল মনে করেন।
২. শিরক কেন হয়, শিরক হওয়ার মূলনীতিগুলো আলোচনায় আসে না।
৩. নিজেরা কিছু মূলনীতি বানিয়েছে যেগুলোর তেমন শরয়ী ভিত্তি নেই।
উদাহরণ হিসেবে, এদের একটা মূলনীতি হলো, حي, حاضر.قادر
অর্থাৎ জীবিত, উপস্থিত ও সক্ষমের কাছে চাইলে শিরক হবে না। নতুবা শিরক হবে।
তাদের মতে আপনি যদি কোন অনুপস্থিত ব্যক্তির কাছে সাহায্য চান তাহলে শিরক হবে।
কোন মৃত বা জড় বস্তুর কাছে সাহায্য চান তাহলে শিরক হবে।
কোন অক্ষম বা অসমর্থ ব্যক্তির কাছে সাহায্য চাইলে শিরক হবে।
দেখতে মূলনীতিটা বেশ ভালো। কিন্তু এই মূলনীতি একেবারেই ভিত্তিহীন।
এগুলোর সাথে শিরকের কোন সম্পর্ক নেই। অথচ এটাকেই শিরক বলা না বলার মূলনীতি বানানো হয়েছে। বিষয়টা দুঃখজনক ও হাস্যকর।
মনে করেন, একটা লোক ধানমন্ডি লেকে পড়ে গেছে। সাতার জানে না। এখন সে জীবন বাঁচানোর জন্য কারও সাহায্য চাচ্ছে। এখন এই ব্যক্তি যদি এমন কারও কাছে সাহায্য চায়, যে নিজে সাঁতার জানে না, তাহলে সেটা শিরক হয়ে যাবে। কারণ এই ব্যক্তি জীবিত, উপস্থিত কিন্তু সে তাকে উদ্ধার করতে সক্ষম নয়। শিরকের উপরের মূলনীতি অনুয়ায়ী সাঁতার না জানার ব্যক্তির কাছে সাহায্য চাইলে শিরক হয়ে যাবে।
এখন কেউ হয়তো বলতে পারে, সক্ষম দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, সৃষ্টির কাছে এমন জিনিস চাওয়া যেটা কেবল আল্লাহ তায়ালাই করেন।
স্বাভাবিক কথা হলো, এটাও শিরক হওয়া বা না হওয়ার কোন কারণ নয়। একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই করেন এমন অনেক বিষয় আল্লাহ তায়ালা মাখলুককেও ক্ষমতা দিয়ে দিতে পারেন। সুতরাং এটা শিরক হওয়া না হওয়ার মূলনীতি হয় কী করে?
যেমন মৃতকে জীবিত করা এটা একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই পারেন। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা মু’জেযা হিসেবে হযরত ইসা আ. কে এই ক্ষমতা দিয়েছিলেন। এখন আপনার মূলনীতি অনুযায়ী যতো লোক ইসা আ. কে মৃতকে জীবিত করতে বলেছে, তারা সবাই মুশরিক হয়ে গেছে।
সুতরাং এটাও শিরক হওয়া বা না হওয়ার কোন মূলনীতি হতে পারে না।
জীবিত হওয়া বা না হওয়াকে শিরকের মূলনীতি বানানোটা আরও হাস্যকর। যেমন ধরেন, এখন টেকনোলজির যুগ। আমি যদি আইফোনকে বলি, হেই শ্রি, গুগলে সার্চ করে দাও। তাহলেই আমি মুশরিক হয়ে যাবো। আই ফোন তো একটা জড় পদার্থ। সুতরাং তার কাছে এটা চাইলে শিরক হয়ে যাবে।
আরও সাধারণভাবে চিন্তা করুন। আমি একবার এক বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমি যদি একটা কলাগাছকে গিয়ে বলি, আমাকে এক গ্লাস পানি দাও। তাহলে কী শিরক হবে?
তখন সে বললো, এটা তো পাগলামি হবে। শিরক হবে কেন?
কলাগাছকে এক গ্লাস পানি দিতে বললে, সেটা অর্থহীন হবে। তবে এটা শিরক হবে কি না?
উপরের মূলনীতি অনুযায়ী শিরক হয়ে যাবে। কারণ কলা গাছ সাধারণ অর্থে জীবিত নয়। আর জীবিত নয় এমন কিছুর কাছে চাওয়া শিরক। ব্যস হয়ে গেলো।
বাস্তব কথা হলো, শুধু কলা গাছ নয়, এক টুকরো পাথরের কাছে চাওয়াও শিরক হতে পারে। কিন্তু সেটা উপরের মূলনীতি অনুযায়ী নয়। শিরকের বাস্তবতার আলোকে। যেমন, হিন্দুরা একটা পাথরের মাথায় সিদুর লাগিয়ে সাহায্য চাইলে শিরক হয়ে যায়। এজন্য শিরক হওয়ার মূল কারণটা বোঝা খুব জরুরি।
উপরের মূলনীতি অনুযায়ী, কেউ যদি অনুপস্থিত কারও কাছে কিছু চায়, তাহলে সেটা শিরক হয়ে যায়। যেমন ধরুন, আপনার ভাই সৌদি থাকে। আপনি তার কাছে কিছু চাইলে শিরক হয়ে যাবে।
যে সময়ে বা যারা মূলনীতিটা বানিয়েছেন, হয়তো তাদের জানা ছিলো না যে, ভাইবার স্কাইপের যুগও আসবে। অনুপস্থিত কারও কাছে সাহায্য চাইলেও শিরক হয়ে যাবে না। আর এটা শিরক হওয়া বা না হওয়ার কোন মূলনীতিও হতে পারে না।
আরেকটা সিচুয়েশন চিন্তা করুন। আপনি আপনার দাদুর কাছ থেকে নিয়মিত টাকা পয়সা নেন। কাল দুপুরে আপনি দাদুর রুমে গিয়ে এক শ টাকা চাইলেন। দাদু বিছানায় শুয়ে আছে। দু’তিন বার ডাকার পরও সাড়া দিলেন না। আপনার মনে অজানা সন্দেহটা দেখা দিলো। বাবা মাকে ডাক দিয়ে বুঝলেন যে, আপনার দাদু বেশ আগেই ইন্তেকাল করেছেন।
এখন প্রশ্ন হলো, আপনি যে আপনার দাদুর ইন্তেকালের পরে তার কাছে একশ টাকা চাইলেন তার কী হবে? এটা কি শিরক হয়ে যাবে? যারা উপরের মূলনীতি দিয়েছেন। তাদের মতে কেউ মারা গেলে তার কিছু চাইলেই শিরক। সাথে সাথে আপনি ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবেন। এখন আপনার কী হবে?
এরা হয়তো বলবে, আপনি তো জানতেন যে, আপনার দাদু মারা গেছে। এজন্য ভুলে শিরক হয়ে গেছে। অসুবিধা নেই।
আচ্ছা ধরে নিলাম, আমি জানলাম দাদু মারা গেছে। এরপর যদি আমি তার কাছে গিয়ে এক শ টাকা চাই তাহলে শিরক হয়ে যাবে?
আপনার সামনে উপস্থিত কারও কাছে আপনি এক গ্লাস পানি চাইলেন। এইটা শিরক নয়। কিন্তু ওই ব্যক্তি আপনার সামনে থেকে উঠে অন্য কোথাও গেল, এখন সে আপনার কাছ থেকে গায়েব বা অনুপস্থিত, এই অবস্থায় আপনি তার কাছে পানি চাইলে শিরক হবে। এটা হল, সালাফিদের মূলনীতি। কিন্তু শিরক কি আসলেই এমন ভিত্তিহীন মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত?
অনেক আগের একটা লেখা দিয়ে শুরু করি। আগে লেখাটির উপর একটু চোখ বুলিয়ে নিন।১. প্রধানমন্ত্রীর দেহরক্ষী সারাদিন খুব বিনয়ের সাথে হাত বেধে প্রধানমন্ত্রীর সামনে দাড়িয়ে থাকলেও তাকে ইবাদত বলা হয় না। কিন্তু একই ব্যক্তি মসজিদে গিয়ে দাড়ালে ইবাদত বলা হচ্ছে।২.হযরত আদম আ.কে ফেরেশতারা সেজদা করলেও সেটা আদম আ. এর ইবাদত হয়নি কিন্তু কোন হিন্দু যদি মূর্তির সামনে সিজদা করে তাহলে সেটা ইবাদত হয়।৩. রমজানে মুসলমান সকাল থেকে সন্ধা পযর্ন্ত না খেয়ে থাকলে ইবাদত হয়, কিন্তু ডাক্তারের পরামর্শে না খেয়ে থাকলে ইবাদত হয় না।৫. কা’বাকে কেন্দ্র করে তওয়াফ করলে ইবাদত হয়, কিন্তু কোন একটা জিনিস খোজার জন্য কা’বাকে তওয়াফ করলে ইবাদত হয় না।৬. হিন্দু পাথরের সামনে মাথা ঝুকালে পাথর বা মূর্তি পূজক হচ্ছে, কিন্তু মুসলমান পাথরের সামনে দাড়িয়ে নামায পড়লে পাথর পূজারী হয় না।৭. প্রথম কাতারের মুসল্লী ইমাম সাহেবকে সামনে রেখে সিজদা করছে, দ্বিতীয় কাতারের মুসল্লী প্রথম কাতারের লোকদেরকে সামনে রেখে সিজদা করলেও কেউ মুশরিক হচ্ছে না, কিন্তু একটা মূর্তি বা পাথরের সামনে মাথা ঝুকালেই সে মুশরিক হয়ে যাচ্ছে।৮. সাফা-মারওয়ার মাঝখানে দৌড়া-দৌড়ি করলে ইবাদত হয়, কিন্তু এর মাঝখানে যদি কাউকে খোজার উদ্দেশ্য দৌড়ানো হয়, তাহলে ইবাদত হয় না।একই কাজ একই পদ্ধতিতে সংগঠিত হলেও ফলাফল ভিন্ন হচ্ছে। এর মূল কারণ কী?
মূল কারণ হলো, কোন একটা কাজ ইবাদত হওয়ার প্রথম শর্ত হলো অন্তরের নিয়ত। অন্তরের নিয়তের উপর নিভর্র করবে কাজটি ইবাদত না কি অন্য কিছু। রাসূল স. বলেছেন, সমস্ত কাজ নিয়তের উপর নিভর্রশীল।
একই কাজ একই পদ্ধতিতে ঘটছে। কিন্তু ফলাফল নির্ভর করছে নিয়তের উপর। শিরক বোঝার জন্য এই পয়েন্টটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।প্রথমত: শিরক বিষয়টা সম্পূর্ণ অন্তরের বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত। কাজের ক্ষেত্রে চিন্তা করলে তো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, সব সময় কাজই শিরকের মূল হতে পারছে না। কাজ কখনও কখনও শিরক বুঝতে সাহায্য করে, কিন্তু এটা আদৌ শিরক হওয়া বা না হওয়ার মূল নয়। আমরা একটা লোককে মসজিদে ঢুকতে দেখে তার সম্পর্কে চিন্তা করি, সে ইবাদত করতে যাচ্ছে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার জন্য ইবাদতটা তার নিয়তের উপর নির্ভর করছে। সে যদি জুতা চুরির নিয়তে যায়, তাহলে এখানে কাজ দেখে সিদ্ধান্ত দেয়াটা ভুল হবে।আপনি যদি একটা মূলনীতি এভাবে বানান যে, যারাই মসজিদে যাবে, তারাই ইবাদত করে, তাহলে এটা সব সময় সঠিক নাও হতে পারে। একজন লোক হাজারও নিয়তে মসজিদে যেতে পারে। কোনটা কী হবে, সেটা তার নিয়তের উপর নির্ভরশীল। শুধু মাত্র কাজের উপর ভিত্তি করে কখনও কোন মূলনীতি এখানে হতে পারে না।এবার আসি শিরকের বিষয়ে। শিরক আসলে কী?
সত্ত্বা বা গুণের ক্ষেত্রে কাউকে আল্লাহ তায়ালার সমকক্ষ বা তুলনীয় বিশ্বাস করা।
আল্লাহ তায়ালার সত্ত্বা বা গুণ == অন্য কারও সত্ব্বা বা গুণ।কারও অন্তরে যখন এই সমতা আসবে তখন এটা শিরক হবে। বিষয়টা আরেকটু বিস্তারিত বলি।আল্লাহ তায়ালার অনেক গুণবালী ও কাজ রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা দেখেন, শোনেন। ক্ষমা করেন, সাহায়্য করেন। আবার একই গুণ ও কাজ সীমাবন্ধ পরিসরে মানুষের মধ্যে আছে। যেমন আমি শুনি। আমি দেখি।এই কাজগুলো যেহেতু আল্লাহর গুণ বা কাজ, আমি যদি অন্য কারও মাঝে এটা বিশ্বাস করি, তাহলে সেটা কি শিরক হবে?
সহজ কথা হলো, এটা শিরক নয়। একই কাজ আল্লাহ তায়ালা করেন, মানুষও করে। একই গুণ আল্লাহর মাঝেও আছে, মানুষের মাঝেও আছে।
১.আল্লাহ তায়ালার ক্ষমতা আছে। মানুষেরও ক্ষমতা আছে।
২. আল্লাহ তায়ালা দেখেন। মানুষও দেখে।
৩. আল্লাহ তায়ালা শোনেন। মানুষও শোনে।
৪. বিপদে আল্লাহ তায়ালা সাহায্য করেন। মানুষও সাহায্য করে।একই কাজ বা গুণ আল্লাহর মাঝেও আছে আবার সৃষ্টির মাঝেও আছে। এখন শিরক কখন হবে?
যখন উভয়ের মধ্যে সমতায় বিশ্বাস করা হবে। যেমন,
শিরক: আল্লাহর ক্ষমতা == মানুষের ক্ষমতা।
শিরক: আল্লাহর দেখা == মানুষের দেখা।
শিরক: আল্লাহর সাহায্য == মানুষের সাহায্য।
অথবা উভয়ের মধ্যে তুলনা বা সাদৃশ্য দেয়া হবে।
যতক্ষণ না কোন গুণ বা কাজে এই সমতা বা তুলনা কারও অন্তরে আসবে ততক্ষণ এটা শিরক হবে না। তবে কখনও বাহ্যিক শিরক বা ছোট শিরক হতে পারে। সেটা ভিন্ন বিষয়। তবে বড় শিরক কেবল তখনই হবে যখন সত্ত্বা, গুণ বা কাজে আল্লাহ তায়ালা ও সৃষ্টির মাঝে সমতা বা তুলনা করা হবে।
আলোচনার মূল পয়েন্ট দু’টি:
১. শিরক সম্পূর্ণ অন্তরের বিষয়। কাজ কখনও কখনও অন্তরের বিশ্বাসের বহি:প্রকাশ বা প্রমাণ হতে পারে, তব সব ক্ষেত্রেই এটি প্রয়োজ্য বা মূলনীতি হবে না।
২. সত্ত্বা, গুণ ও কাজের ক্ষেত্রে কাউকে আল্লাহ তায়ালার সমকক্ষ বা তুলনীয় বিশ্বাস করা। এক্ষেত্রে যতক্ষণ না সমতা বা তুলনা করা হবে ততক্ষণ এটা শিরক হবে না।
শুরুতে কয়েকটা পরিভাষার সাথে পরিচিত হওয়া প্রয়োজন। আমরা আল্লাহ তায়ালাকে রব হিসেবে বিশ্বাস করি। আল্লাহ তায়ালার সত্ত্বা, গুণ ও কাজকে আমরা অনন্য বিশ্বাস করি। অনন্য অর্থ কী? একমাত্র আল্লাহর মাঝেই আছে। অন্য কারও মাঝে নয়। একমাত্র আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট। অন্য কারও মাঝে যেটা থাকতে পারে না। যিনি প্রভূ কেবল তার মধ্যেই থাকবে। এধরণের বিষয়কে আমরা খাসাইসুর রুবুবিয়্যা বা রবের অনন্য বৈশিষ্ট্য বলি।
কয়েকটা উদাহরণ দেয়া যাক। আমরা বিশ্বাস করি, যিনি প্রভূ, তাকে অবশ্যই ক্ষমতা সম্পন্ন হতে হবে। তার ক্ষমতা থাকবে। অক্ষম কেউ প্রভূ হতে পারে না। এখন প্রশ্ন হলো,
ক্ষমতা কি প্রভূর অনন্য বৈশিষ্ট্য?
স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করলে দেখা যায়, সীমিত পর্যায়ে সৃষ্টির মধ্যেও ক্ষমতা আছে। তাহলে ক্ষমতা প্রভূর অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো কী করে?
এই বিষয়টা বোঝা খুব জরুরি। ক্ষমতা বা কুদরত অবশ্যই প্রভূর অনন্য বৈশিষ্ট্য। এটা শুধু প্রভূর মাঝেই আছে। অন্য কারও মাঝে নেই।
প্রভূর ক্ষমতা: স্বাধীন, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও অসীম।
সৃষ্টির ক্ষমতা: অন্যের দেয়া, অসম্পূর্ণ ও সসীম।
এবার চিন্তা করে দেখুন। প্রভূর ক্ষমতা আসলেই অনন্য বৈশিষ্ট্য। এই ক্ষমতা শুধু আল্লাহরই আছে। আর কারও নেই।
সহজেই আমরা বলতে পারি, আল্লাহরও ক্ষমতা আছে, মানুষেরও ক্ষমতা আছে। কিন্তু আল্লাহর ক্ষমতা অনন্য। কোন দিক থেকে মানুষের ক্ষমতার সাথে তুলনীয় হতে পারে না। কোন দিক থেকে যদি আপনি আল্লাহর ক্ষমতার সাথে অন্য কারও ক্ষমতা তুলনা করেন তাহলে আল্লাহর ক্ষমতা আর অনন্য রইলো না।
আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও মাঝে যদি স্বাধীন, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও অসীম ক্ষমতা বিশ্বাস করেন, তাহলে এটাই হলো শিরক।
শিরক নয়: সৃষ্টির ক্ষমতা আছে।
শিরক: সৃষ্টির স্বাধীন, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও অসীম ক্ষমতা আছে।মূল বিষয় হলো, আল্লাহর অনন্য বৈশিষ্ট্য বা কাজ অন্য কারও মাঝে আছে বা অন্য কারও সাথে তুলনীয়, এটা চিন্তা করাই হলো শিরক। শিরক অর্থ অংশীদার করা। আল্লাহর সাথে শিরক করার অর্থ আল্লাহর সাথে কাউকে অংশীদার করা। কী বিষয়ে অংশীদার করা হচ্ছে?
আল্লাহর অনন্য বৈশিষ্ট্যের মাঝে অংশীদার করা হচ্ছে। একটা গুণ শুধু আল্লাহরই আছে। আপনি যদি সেটা অন্য কারও মাঝে বিশ্বাস করেন, তাহলে এই গুণের ক্ষেত্রে তাকে আল্লাহর অংশীদার করা হলো। শিরক করা বা আল্লাহর অংশীদার সাব্যস্ত করার অর্থই হলো এটা।
এবার আসুন ক্ষমতার বিষয়টা আরেকটু পর্যালোচনা করি। আমি যদি কাউকে বলি, একটা ইট বা ছোট পাথর ছুড়ে ফেলো। সে এটা করে দিলো। আমি এতে কোন সমস্যা দেখছি না।
আবার কাউকে যদি বলি, হিমালয় পর্বতটা সরিয়ে ফেলো। সে কোনভাবে এটা করলো।
আমাদের কিছু কিছু অবুঝ ভাই বলবেন, এটা শিরক হয়েছে।যদি জিজ্ঞেস করি, কেন শিরক হলো? সত্য কথা হলো, এসমস্ত ভাইয়েরা এর কোন উত্তর দিতে পারে না।
যদি সহজ করে জিজ্ঞেস করি, শিরক করার অর্থ হলো আল্লাহর সাথে অংশীদার করা। এখন হিমালয় পর্বত সরিয়ে আল্লাহর সাথে কীসে অংশিদার করলো সে?
হিমালয় পর্বত সরানো কি আল্লাহর অনন্য বৈশিষ্ট্য? এটা যদি আল্লাহর অনন্য বৈশিষ্ট্য না হয়, তাহলে এখানে শিরক হবে কেন?
এই অবুঝ ভাইয়েরা আমতা আমতা করে বলেন, ছোট পাথর সরানোর ক্ষমতা তো মানুষের আছে। হিমালয় সরানোর ক্ষমতা তো মানুষের নেই। এজন্য এটা শিরক।
বিশ্বাস করুন, এটাই এদের বুঝের দৌড়। যদি জিজ্ঞেস করি, ছোট পাথর সরানোর ক্ষমতা মানুষের আছে মানে কি? এটা তার নিজস্ব, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বাধীন ক্ষমতা?
উত্তর হলো, না।হিমালয় পর্বত যদি কেউ সরায় তাহলে, এটাও কি তার নিজস্ব, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বাধীন ক্ষমতা?
উত্তর, না।এখন ছোট পাথর সরানোর ক্ষেত্রে আপনি যদি বিশ্বাস করেন যে, তার নিজস্ব, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বাধীন ক্ষমতা আছে, তাহলে এটাও শিরক। যদিও ছোট্র একটা পাথর সরানো খুব স্বাভাবিক বিষয়।
আবার যদি কারও ক্ষেত্রে এটা বিশ্বাস করেন যে, সে পুরো আমেরিকা মহাদেশ মুহূর্তেই এশিয়া মহাদেশে এনে ফেলতে পারে। কিন্তু এটা তার নিজস্ব, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বাধীন ক্ষমতা নয়। বরং আল্লাহর দেয়া। তাহলে এটা শিরক হবে না।এবার বাস্তব উদাহরণে আসি। হযরত জিবরাইল আ. কওমে লুতের পুরো এলাকা আকাশে উঠিয়ে নিয়ে উল্টে দিয়েছিলেন। আমাদের এসব ভাইদের চিন্তা অনুযায়ী তো এটা শিরক হওয়ার কথা। কারণ জিবরাইল আ. তো আল্লাহর একটা সৃষ্টি। জিবরাইল আ. এর মাঝে এই ক্ষমতা বিশ্বাস করলে শিরক হবে না, কিন্তু অন্য আরেকটা সৃষ্টির মাঝে বিশ্বাস করলে শিরক হবে কেন? আর এটার সাথে শিরকের কী সম্পর্ক? জমিনের একটা ভুখন্ড আসমানে নিয়ে উল্টিয়ে দেয়া কি আল্লাহর কোন অনন্য বৈশিষ্ট্য?
তাহলে এক্ষেত্রে আপনার মাথায় শিরকের চিন্তা কেন আসবে?উদাহরণ হিসেবে এদের কাউকে যদি জিজ্ঞেস করি, আব্দুল কাদের জিলানী রহ. মূহূর্তের মধ্যে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে পারতেন। এটা উদাহরণ হিসেবে ধরে নিন। আমি জানি না, এটা তার কারামত ছিলো কি না।
আমাদের এসব ভাইয়ের সামনে এটা বললেই বলবে, এটা তো শিরক। যদি জিজ্ঞেস করি, কেন শিরক? তখন আর উত্তর দিতে পারে না।মুহূর্তের মধ্যে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাওয়া কি আল্লাহর কোন অনন্য বৈশিষ্ট্য যা অন্য কারও মাঝে থাকবে না? আর আব্দুল কাদের জিলানী রহ. এর মধ্যে সেটা বিশ্বাসের কারণে আমি শিরক করে ফেলেছি? বিষয়টা কি আসলে এমন?এটাকে শিরক কেন বললেন? পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে মুহূর্তে আরেক প্রান্তে যাওয়াটাই যদি শিরক হয়, তাহলে এই ক্ষমতা তো ফেরেশতাদের আছে। জিনদের আছে। তো? ফেরেশতা আর জিনরা তাহলে শিরক করছে?
নিজেদের ভুল বুঝের কারণে শিরকের বিষয়টাকে এসমস্ত ভাইয়েরা সস্তা বানিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, তারা সারা জীবন তাউহীদ শিরকের নসীহত করলেও তারা গভীরভাবে তাওহিদ ও শিরক বোঝে না। এটা আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা।
আল্লাহ তায়ালার সত্ত্বা,গুণ ও কাজ অতুলনীয় ও অনন্য। এখানে তুলনা, সাদৃশ্য ও সমকক্ষ বলতে কিছু নেই।
আল্লাহর এই অনন্য সত্ত্বা, গুণ বা কাজের কোন কিছু যখন অন্যের জন্য সাব্যস্ত করা হবে বা তার সাথে সাদৃশ্য দেয়া হবে, তখন সেটি শিরক হবে। খাসাইসুস রুবুবিয়্যা বা একমাত্র আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য অন্যের জন্য সাব্যস্ত করাটা হলো শিরক।
যখন কোন একটা বিষয়কে আমরা শিরক বলবো, তখন এই বিষয়গুলো স্পষ্ট করা খুব জরুরি,
১. কী বিষয়ে আল্লাহর সাথে অংশীদার সাব্যস্ত করা হয়েছে? আল্লাহর কোন গুণ বা কাজের মধ্যে অংশীদার করা হয়েছে?
২. যে বিষয়কে শিরক বলা হচ্ছে, সেই গুণ বা কাজ কি শুধু আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট?
কেউ যদি আপনাকে বলে, ভাই, এটা শিরক।
আপনি সাথে সাথে তাকে জিজ্ঞেস করবেন, আল্লাহর কোন গুণ বা কাজের সাথে অন্যকে অংশীদার করা হয়েছে বলুন। আর সেই গুণ বা কাজটিকে আল্লাহর জন্য খাস বা নির্দিষ্ট কি না?
যেই শিরকের আলোচনা কররুক, তার কাছ থেকে এই দুই প্রশ্নের উত্তর নেয়া ছাড়া শিরকের আলোচনায় অগ্রসর হবেন না। কারও মুখে শিরক বলার দ্বারা কোন বিষয় শিরক হয়ে যাবে না। এজন্য সব সময় সঠিক বুঝকে গুরুত্ব দিতে হবে। যে এটাকে শিরক বলছে, সে আসলেই সঠিক বুঝেছে কি না, সেটা যাচাই করতে হবে।
যেসব বিষয়কে নিয়ে খুব বাড়াবাড়ি করা হয় এরকম একটা উদাহরণ দেই।
আপনি আপনার কাছে উপস্থিত কাউকে একটা চেয়ার এনে দিতে বললেন। সে আপনাকে চেয়ারটা এনে দিলো। ঘটনাটি খুব স্বাভাবিক। এখানে অন্য কোন চিন্তা করবে কি না।
কিন্তু আপনি ঢাকায় আছেন। খুলনায় আপনার বাড়ীতে আপনার পছন্দের একটা চেয়ার আছে। আপনি কাউকে বললেন যে, তুমি এখনই আমাকে চেয়ারটা এনে দাও।
ধরে নিন, সে সাথে সাথে চেয়ারটা আপনার সামনে এনে দিলো। ঘটনাটি অস্বাভাবিক।
প্রথম ঘটনায় কেউ আপত্তি করবে কি না। কিন্তু দ্বিতীয় ঘটনায় কিছু ভাই আপত্তি করবেন। তারা বলবেন, দ্বিতীয় ঘটনা শিরক।
যখনই এধরণের লোকেরা দ্বিতীয় ঘটনাকে শিরক বলবে, আপনি তাদেরকে উপরের প্রশ্ন দু’টি করুন।
১. খুলনা থেকে ঢাকায় মুহূর্তের মধ্যে চেয়ার আনাটা শিরক হবে কেন? এটাকে শিরক বলার অর্থ হলো আল্লাহর সাথে অংশীদার করা। এখন এই কাজটা করে আল্লাহর কোন বিষয়ের সাথে অংশীদার করা হয়েছে?
২. মুহূর্তের মধ্যে শত মাইল বা হাজার মাইল দূর থেকে কোন কিছু উপস্থিত করে দেয়া, এটা আল্লাহর অনন্য বৈশিষ্ট্য বা গুণ? এটা কি শুধু আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট্য? এটা কি খাসাইসুস রুবুবিয়া? আল্লাহর জন্য খাস কোন বিষয়?
সত্য কথা হলো, যেসব ভাই শিরক বলেন, তারা এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন না।
এবার আসুন আমরা ঘটনা দু’টো বিশ্লেষণ করি।
১ম ঘটনা: আপনার সামনে উপস্থিত কাউকে কাছের একটি চেয়ার এগিয়ে দিতে বলা
কোন কিছু এনে দেয়া বা উপস্থিত করা একটি ক্ষমতা। আপনার সামনে উপস্থিত কাউকে যখন বললেন, চেয়ারটা এনে দাও। আপনি তার ব্যাপারে চিন্তা করেছেন, চেয়ারটা উপস্থিত করার ক্ষমতা তার আছে। এখন এই ব্যক্তির চেয়ার উপস্থিত করার ক্ষমতা সম্পর্কে আপনার দু’টি বিশ্বাস থাকতে পারে।
শিরক: চেয়ার উপস্থিত করার এই ক্ষমতা তার নিজস্ব। এ ব্যাপারে সে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বাধীন।
শিরক নয়: লোকটির চেয়ার এগিয়ে দেয়ার ক্ষমতা আছে। তবে এই ক্ষমতা তার নিজস্ব নয়। এটি আল্লাহর দেয়া ক্ষমতা। এ ব্যাপারে সে স্বয়ংসম্পূর্ণও নয়। সে স্বাধীনও নয়। আল্লাহর হুকুম ও মর্জির উপর তার ক্ষমতা নির্ভরশীল।
আপনার কাছে উপস্থিত একটা লোকের জন্য সামনের চেয়ারটি এগিয়ে দেয়া খুব স্বাভাবিক হলেও আপনি যদি তার এই ক্ষমতাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বাধীন মনে করেন, তাহলে এটি শিরক হবে।
২ য় ঘটনা: মুহূর্তে খুলনা থেকে ঢাকায় চেয়ার এনে দেয়া
শিরক: লোকটির নিজস্ব, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বাধীন ক্ষমতা রয়েছে। যার মাধ্যমে সে খুলনা থেকে চেয়ারটি এনেছে।
শিরক নয়: লোকটির ক্ষমতা নিজস্ব নয়। সে এ ব্যাপারে স্বাধীন ও স্বয়ংসম্পূর্ণও নয়। তার এই ক্ষমতা আল্লাহর দেয়া। এটি আল্লাহর হুকুম ও ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল।
কোন ঘটনা স্বাভাবিক হলেও সেখানে শিরক হতে পারে। এমনকি তুচ্ছ ঘটনাতেও মানুষ শিরক করতে পারে। যেমন ধরেন ওষূধ খেলে ভালো হয়ে যান, এটা স্বাভাবিক ঘটনা। আপনার জীবনে নিত্যদিন ঘটছে। ওষুধ খেয়ে সুস্থ হওয়ার ক্ষেত্রে যদি আপনার বিশ্বাস থাকে, ওষুধ তার নিজস্ব, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বাধীন ক্ষমতায় আমাকে সুস্থ্য করেছে। তাহলে এটি নিশ্চিত শিরক। যদিও এটি স্বাভাবিক ঘটনা।
আবার খুবই অস্বাভাবিক ঘটনার ক্ষেত্রে যদি আপনার বিশ্বাস থাকে যে এটি আল্লাহর দেয়া ক্ষমতা ও তার ইচ্ছায় হয়েছে, তাহলে এটি শিরক হবে না। যেমন ধরুন মুমুর্ষু ক্যান্সারের রোগীকে কোন হুজুর শরয়ী ঝাড়ফুক করাতে সে সুস্থ্য হয়ে গেলো। এটা একটা অস্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু এখানে যদি আপনি বিশ্বাস রাখেন, উক্ত হুজুরের নিজস্ব ক্ষমতা নেয়। আল্লাহর মর্জি ও ক্ষমতায় হয়েছে, তাহলে এটি অস্বাভাবিক হলেও শিরক হবে না।
চেয়ার উপস্থিত করার ঘটনায় ফিরে আসি। হযরত সুলাইমান আ. এর এক উম্মত মুহূর্তে হাজার মাইল দূরের সিংহাসন চোখের পলকে উপস্থিত করেছিলেন। ঘটনাটি পবিত্র কুরআনেই আছে।
এটি একটি অস্বাভাবিক ঘটনা। এটা কি শিরক? অবুঝ ভাইদের মূলনীতি অনুযায়ী শিরক হওয়া উচিত। কিন্তু এটি শিরক নয়। সুলাইমান আ. যখন বলেছিলেন, তোমাদের মধ্যে কে আছো যে সিংহাসনটি উপস্থিত করবে, তখন তার অন্তরে আদৌ এটা ছিলো না যে, উপস্থিত জিন ও মানুষের নিজস্ব, স্পয়ংসম্পূর্ণ এই ক্ষমতা আছে।
তার উম্মত যখন সিংহাসনটি চোখের পলকে উপস্থিত করে দিলো, তখন তিনি এই চিন্তা করেননি যে, এটা তার নিজস্ব ক্ষমতা। হযরত সুলাইমান আ. বলেছেন,
هذا من فضل ربي
এটা আমার প্রভূর অনুগ্রহ। সূরা নামল।
ঘটনা স্বাভাবিক হোক আর অস্বাভাবিক, আমরা সবগুলোকেই আল্লাহর অনুগ্রহ মনে করি। আল্লাহর দেয়া ক্ষমতা ও ইচ্ছায় ঘটেছে সেটি বিশ্বাস করি। স্বাভাবিক ঘটনা নিজের ক্ষমতায় আর অস্বাভাবিক ঘটনা আল্লাহর ক্ষমতায় হয়েছে, এটি আমরা বিশ্বাস করি না। বরং এটিকে আমরা শিরক মনে করি। আমাদের আকিদা হলো,
সঠিক আকিদা: স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক উভয়টিই আল্লাহর দেয়া ক্ষমতায় হয়।
শিরকী আকিদা-১: স্বাভাবিক ঘটনা বা কাজ নিজের ক্ষমতায় হয়, অস্বাভাবিক ঘটনা আল্লাহর দেয়া ক্ষমতায় হয়।
শিরকী আকিদা -২. অস্বাভাবিক ঘটনা বা কাজ নিজের ক্ষমতায় হয়।
আপনি যদি বিশ্বাস করেন, কেউ তার নিজস্ব, স্বয়ংসম্পূর্ণ ক্ষমতায় এক গ্লাস পানি দিতে পারে, তাহলেও এটি শিরক হবে। কিন্তু আপনি যদি বিশ্বাস করেন, আল্লাহর দেয়া ক্ষমতায় কেউ মুহূর্তে আটলান্টিক মহা সাগর পানি শূন্য করে দিতে পারে, তাহলে সেটা আদৌ শিরক হবে না।
আল্লাহর সত্তা, গুণ ও কাজ সবকিছুই অনন্য ও অতুলনীয়। তার সাথে তুলনীয় কিছুই নেই। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে কিছু গুণ দিয়েছেন। বিভিন্ন কাজের ক্ষমতা দিয়েছেন। মানুষের এসব গুণাবলীর নাম আল্লাহর কোন গুণ বা কাজের নামের সাথে মিলতে পারে। যেমন: মানুষ দয়া করে, আল্লাহও দয়া করেন। মানুষ সাহায্য করে আবার আল্লাহ তায়ালাও সাহায্য করেন।
এখানে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, এটি শুধু শাব্দিক মিল। কিন্তু মৌলিক দিক থেকে দু’টির মধ্যে কোন ধরণের সাদৃশ্য ও তুলনাও চলবে না। শাব্দিক এই মিলের কারণে মৌলিক দিক থেকে উভয়টিকে এক মনে করা কিংবা তুলনা করাটাই শিরক।
মানুষকে আল্লাহ তায়ালা যেই ক্ষমতা দিয়েছেন এটি সসীম। আল্লাহর ইচ্ছা ও মর্জির উপর নির্ভরশীল। এটি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। আল্লাহ তায়ালা যে কোন মুহূর্তে তার চোখের দৃষ্টি কেড়ে নিতে পারেন। পায়ের চলার ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে পারেন। কথা বলার ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে বোবা করে দিতে পারেন। শ্রবণ ক্ষমতা দূর করে বধির বানাতে পারেন।
যে কোন ধরণের সৃষ্টিই হোক না কেন, প্রত্যেকের ক্ষমতা ও গুণাগুণ সীমিত ও আল্লাহর ইচ্ছার অধীন। এসব গুণ ও ক্ষমতা আল্লাহর দেয়া।
জিন ও ফেরেশতাদের অস্বাভাবিক ক্ষমতা আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে আমরা সেগুলো কল্পনাও করতে পারি না। হযরত ইস্রাফিল আ.কে যে ক্ষমতা দিয়েছেন একটু চিন্তা করে দেখুন। তার এক ফুৎকারে মহাপ্রলয় সংঘঠিত হয়ে যাবে। তাদের এই অকল্পনীয় ক্ষমতাও সসীম এবং আল্লাহর দেওয়া। এগুলো কখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। মোট কথা সৃষ্টির যতো ক্ষমতা, গুণাগুণ ও কাজ রয়েছে, এগুলো যতই অস্বাভাবিক হোক না কেন, সবই সসীম, আল্লাহর দেয়া এবং তার ইচ্ছা ও মর্জির উপর নির্ভরশীল।
সমস্ত সৃষ্টির সকল ক্ষমতা, গুণ ও কাজ যেহেতু সসীম এবং আল্লাহর দেওয়া, এজন্য সৃষ্টির কোন কিছুই কখনও আল্লাহর সাথে তুলনীয় হতে পারে না। যতো বেশিই ক্ষমতা হোক, যতো অকল্পনীয় কাজই হোক সৃষ্টির সব কিছুই সসীম ও আল্লাহর মুখাপেক্ষী।
কোন সৃষ্টিকে আল্লাহ তায়ালা অসীম, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বাধীন ক্ষমতা ও গুণ দিবেন না। এটি অসম্ভব। কারণ আল্লাহ তায়ালা যখন তাকে ক্ষমতা দিবেন তখন এটি স্বয়ংসম্পূর্ণ রইলো না। এটি তখন অন্যের কাছ থেকে নেওয়া হলো। এভাবে আল্লাহ তায়ালার সাথে তুলনীয় কোন গুণই কোন সৃষ্টির মধ্যে থাকতে পারে না।
কোন কোন ধর্মে দেখা যায়, এক ভগবান আরেক ভগবানকে বিশেষ ক্ষমতা দিচ্ছেন। যাকে ক্ষমতা দেয়া হলো, তিনি তো আদৌ ভগবান হওয়ার যোগ্য নয়। কারণ তিনি অন্যের কাছ থেকে ক্ষমতা নিচ্ছেন। তিনি অন্যের ক্ষমতার মুখাপেক্ষী। সুতরাং যে অন্যের ক্ষমতার মুখাপেক্ষী, সে ভগবান হয় কীভাবে?
এজন্য আমাদের অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস থাকবে, সৃষ্টির কোন ক্ষমতা, কাজ বা গুণ কখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বাধীন ও অসীম হতে পারে না। আর আল্লাহ তায়ালা কখনও কাউকে এধরণের ক্ষমতা বা গুণ দিবেন না।
জিন, ফেরেশতা, মানুষ, গাছপালা সব কিছুর সকল ক্ষমতা ও গুণ আল্লাহর দেওয়া। এরা সকলেই আল্লাহর সৃষ্টি ও আল্লাহর মুখাপেক্ষী। এগুলো নিজেরা স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বাধীন নয়। কখনও হতেও পারবে না। এজন্য কোন সৃষ্টিই ইবাদতের উপযুক্ত হতে পারে না। একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই ইবাদতের উপযুক্ত।
একথা যেহেতু নিশ্চিত যে, কোন সৃষ্টিই স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বাধীন ও অসীম ক্ষমতা ও গুণের অধিকারী হতে পারবে না, এজন্য কোন সৃষ্টির মাঝে এটির কল্পনা করাই হলো শিরক। গরুর মধ্যে এধরণের কোন কিছু কল্পনা করলে শিরক। গাছ, মানুষ ইত্যাদি যার মধ্যেই এটি বিশ্বাস করা হোক না কেন, এটি শিরক হবে।
সৃষ্টির কাজ যত বড়ই বিস্ময়কর হোক না কেন, সেটি কখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বাধীন হতে পারে না। একজন মুসলিম হিসেবে অবশ্যই এই বিশ্বাস রাখতে হবে।
আমাদের আলোচনার সারমর্ম হলো:
১. আল্লাহর গুণ ও কাজের সাথে মানুষের গুণ ও কাজের শাব্দিক মিল থাকলেও মৌলিক দিক থেকে কখনও একটি আরেকটির সাথে তুলনীয় হতে পারে না। মৌলিক দিক থেকে আল্লাহর গুণ বা কাজের সাথে তুলনা করলেই শিরক।
২. সৃষ্টির ক্ষমতা, গুণ ও কাজ কখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বাধীন ও অসীম হতে পারে না। সৃষ্টির মধ্যে এজাতীয় কিছু বিশ্বাস করলেই শিরক।
কোন পীরের মধ্যে যদি বিশ্বাস করেন, তার নিজস্ব বিশেষ ক্ষমতা আছে তাহলে সেটিও শিরক। কোন সৃষ্টিরই নিজস্ব কোন ক্ষমতা নেই। ওমুক বুজুর্গের মনে হয় নিজের বিশেষ কিছু আছে এজাতীয় চিন্তা চেতনাও শিরক। সৃষ্টির সকল ক্ষমতা আল্লাহর দেয়া এবং আল্লাহর ইচ্ছা ও মর্জির উপর নির্ভরশীল। কোন পীর আল্লাহর হুকুম ছাড়া চোখের পলকও ফেলার ক্ষমতা রাখে না। একজন মু’মিনের জন্য অবশ্যই এই বিশ্বাস রাখতে হবে।
৩. আল্লাহ তায়ালা কখনও কোন সৃষ্টিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বাধীন ও অসীম ক্ষমতা দিবেন না। কারণ অন্যের দেয়া ক্ষমতা কখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে না। এজন্য এটি একটি স্ববিরোধী অসম্ভব বিষয়। মোটকথা আল্লাহ তায়ালা কখনও নিজের গুণ অন্য কাউকে দিবেন না। কারণ আল্লাহর গুণ অন্যকে দেয়ার অর্থ হলো আরেক জনকে আল্লাহ বানানো। যেটা স্ববিরোধী ও বাস্তবে অসম্ভব। এজন্য হিন্দু বা অন্য যেসব ধর্মে একেক ভগবানকে একেক ধরণের ক্ষমতা দেয়ার যে ধারণা প্রচলিত আছে, এটি সম্পূর্ণ অবাস্তব। অন্যের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করলে সে কখনও ভগবান হওয়ার যোগ্য হতে পারে না। এজন্য বিদ্যা বুদ্ধির জন্য এক ভগবানকে, রিজিকের জন্য আরেক ভগবানকে মানা হলো চরম মূর্খতা। যিনি রিজিকের ভগবান তিনি নিজেই অসম্পুর্ণ ও অন্যের মুখাপেক্ষী। এরকম অসম্পুর্ণ ও মুখাপেক্ষী কীভাবে ভগবান হওয়ার যোগ্য হয়?
আমরা গত পর্বে আলোচনা করেছি, আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কোন কিছুর মাঝেই স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বাধীন ক্ষমতা বা অন্য কোন গুণ থাকতে পারে না। সমস্ত সৃষ্টিই আল্লাহর মুখাপেক্ষী। সমস্ত সৃষ্টির অস্তিত্বই আল্লাহর ইচ্ছা ও মর্জির অধীন।
সহজ কথা হলো, অন্যের মুখাপেক্ষী কেউ কখনও রব বা প্রভূ হতে পারেন না। যিনি নিজেই অন্যের উপর নির্ভরশীর তিনি কী করে প্রভূ হবেন? আর যে প্রভূ নয় তার সামনে মাথা নত করার প্রশ্নই ওঠে না। যে অন্যের মুখাপেক্ষী সে কখনও ইবাদত পাওয়ারও যোগ্য হতে পারে না। সমস্ত সৃষ্টি যেহেতু আল্রাহর মুখাপেক্ষী, আল্লাহর ইচ্ছা ও মর্জির অধীন, এজন্যই সৃষ্টির কোন কিছুই ইবাদত পাওয়ার যোগ্য না।
হিন্দুরা গাছের পূজা করছে। অথচ এই গাছ একটি নগন্য সৃষ্টি। হিন্দুরা গরুর পূজা করে। এটাও একটা নগন্য সৃষ্টি। মূর্তির পূজা করে। যা তাদের নিজস্ব বানানো। তাদের যেসব দেবতা বা ভগবান রয়েছে, এর কেউ-ই স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বাধীন নয়। নতুবা তারা বহু খোদায় বিশ্বাসী হতো না।
কোন সৃষ্টিই যে ইবাদত পাওয়ার যোগ্য না একথা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হওয়ার পরও মানুষ সৃষ্টির সামনে মাথা নত করে। সৃষ্টির পূজা করে। সৃষ্টির ইবাদত করে। একজন মুসলিম হিসেবে আমাদেরকে অবশ্যই বিশ্বাস রাখতে হবে, সমস্ত সৃষ্টি যেহেতু আল্লাহর অধীন ও তার মুখাপেক্ষী, এজন্য কোন সৃষ্টিই ইবাদত পাওয়ার উপযুক্ত নয়। একমাত্র ইবাদত পাওয়ার উপযুক্ত হলেন আল্লাহ তায়ালা।
আমাদের পরবর্তী আলোচনা বোঝার জন্য ইবাদত কাকে বলে সেটি আগে বুঝতে হবে।
ইবাদতের শাব্দিক অর্থ হলো, বিনয প্রকাশ করা, নত হওয়া।
শুধু বিনয় প্রকাশ করলেই তাকে ইবাদত বলা হয় না। ছেলে পিতা-মাতার সামনে বিনয় প্রকাশ করে, কিন্তু এটি ইবাদত নয়। সাহাবীগণ নবীজী স. এর সামনে বিনয়ী থাকতেন, এটাও তাদের ইবাদত ছিলো না। ছাত্র উস্তাদের সামনে বিনয়ী হয়, এটাও উস্তাদের ইবাদত নয়। এজন্য ইবাদতের পারিভাষিক অর্থ আমাদেরকে জানতে হবে।
ইবাদতের পারিভাষিক অর্থ হলো,
الخضوع باعتقاد شيء من خصائص الربوبية في المخضوع له .
কাউকে রব বা প্রভূ হওয়ার যোগ্য মনে করে তার সামনে নত হলে তাকে ইবাদত বলা হয়। অর্থাত কারও মধ্যে প্রভূ হওয়ার অনন্য বৈশিষ্ট্য আছে এই বিশ্বাস করে যদি তার জন্য বিনয় প্রকাশ করা হয় তাহলে তাকে ইবাদত বলে।
ইবাদত হওয়ার জন্য মৌলিক শর্ত হলো, যার ইবাদত করা হচ্ছে তাকে প্রভূ মনে করা বা তার মধ্যে প্রভূর কোন গুণ আছে এটা বিশ্বাস করা। অন্তরে যদি এই বিশ্বাস না থাকে তাহলে শুধু বাহ্যিক কাজকে ইবাদত বলা হবে না।
যেমন আপনি আপনার বাবার সামনে হাত বেধে দাড়িয়ে রইলেন। শুধু হাত বেধে দাড়ানোর কারণেই এটি ইবাদত হবে না। যতক্ষণ পয়র্ন্ত আপনার বাবাকে প্রভূ বা প্রভূর কোন গুণাগুণ বাবার মধ্যে আছে বিশ্বাস করবেন, ততক্ষণ এটি ইবাদত বলে গন্য হবে না।
আপনি বিপদে পড়ে কারও সাহায্য চাইলেন। কোন মানুষের কাছে শুধু সাহায্য চাইলেই সেটি ইবাদত হবে না। যার কাছে সাহায্য চাচ্ছেন তার ইবাদতের নিয়ত থাকতে হবে।
এ বিষয়ে ইমাম শাতবী রহ. খুবই চমৎকার একটি বিশ্লেষণ উল্লেখ করেছেন তার আল-মুয়াফাকাত কিতাবে। তিনি লিখেছেন,
المسألة الأولى : إن الأعمال بالنيات والمقاصد معتبرة في التصرفات من العبادات والعادات والأدلة على هذا المعنى لا تنحصر .
ويكفيك منها أن المقاصد تفرق بين ما هو عادة وما هو عبادة ، وفي العبادات بين ما هو واجب وغير واجب ، وفي العادات بين الواجب والمندوب والمباح والمكروه والمحرم والصحيح والفاسد وغير ذلك من الأحكام ، والعمل الواحد يقصد به أمر فيكون عبادة ، ويقصد به شيء آخر فلا يكون كذلك ، بل يقصد به شيء فيكون إيمانا ، ويقصد به شيء آخر فيكون كفرا كالسجود لله أو للصنم .
وأيضا فالعمل إذا تعلق به القصد تعلقت به الأحكام التكليفية ، وإذا عري عن القصد لم يتعلق به شيء منها كفعل النائم والغافل والمجنون .
অর্থ: সমস্ত কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল। ইবাদত ও স্বাভাবিক সকল কর্মকান্ডে মূল ধর্তব্য বিষয় হলো অন্তরের নিয়ত বা উদ্দেশ্য। সকল কাজে অন্তরের নিয়ত যে মূল ধর্তব্য বিষয়, এর অসংখ্য দলিল রয়েছে।
দলিল হিসেবে আপনার জন্য এতটুকু যথেষ্ট যে, ইবাদত ও আদত (অভ্যাসগত কাজ) সকল ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। ইবাদতের মধ্যে আবার ওয়াজিব ও গাইরে ওয়াজিবের মধ্যে নিয়তের পার্থক্য হয়ে থাকে। আদত বা অভ্যাসগত কাজের মধ্যেও ওয়াজিব, নফল, মুবাহ, মাকরুহ, হারাম, সহীহ, ভুল ইত্যাদি বিধানের ক্ষেত্রেও নিয়তের তারতম্য ধর্তব্য হয়।
একই কাজ এক ধরণের নিয়তের কারণে সেটি ইবাদত হয় আবার নিয়তের ভিন্নতার কারণে সেটি ইবাদত হয় না। একই কাজে এক ধরণের নিয়তের কারণে সেটি ইমান হয়, আবার নিয়তের ভিন্নতার কারণে সেটি কুফুরী হয়। যেমন, আল্লাহর জন্য সিজদা করলে ইমান হয়। কিন্তু একই সিজদা মূর্তির জন্য করলে কুফুরী হয়।
অতএব, আমল বা কাজের সাথে যখন নিয়ত যুক্ত হবে তখনই এর উপর শরয়ী বিধান প্রযোজ্য হবে। কোন কাজ যদি নিয়ত থেকে মুক্ত হয়, তাহলে এর সাথে শরয়ী বিধান যুক্ত হবে না। যেমন ঘুমন্ত ব্যক্তির কাজ। উদাসীন ও পাগলের কাজ। এগুলোর সাথে নিয়ত যুক্ত না হওয়ার কারণে এটি ধর্তব্য হবে না।
আল-মুয়াফাকাত, খ.৩,পৃ.৭-৯
মোটকথা নীচের তিনটি বিষয়ের যে কোন একটি যদি কোন কাজের মধ্যে যদি পাওয়া যায়, তাহলে সেটি ইবাদত ধরা হবে,
১. কারও মধ্যে প্রভূ হওয়ার অনন্য বৈশিষ্ট্য আছে বলে বিশ্বাস করা।
২. কাউকে ইলাহ বা ইবাদতের উপযুক্ত বলে বিশ্বাস করা ।
৩. যে কোন কাজের সাথে ইবাদতের নিয়ত যুক্ত থাকা।
সুতরাং যে কোন কাজের সময় যদি উক্ত তিনটি বিষয়ের কোন একটি পাওয়া যায়, তাহলে সেই কাজকে ইবাদত বলে গণ্য করা হবে। নতুবা এটি ইবাদত হবে না।
ফেরেশতাগণ হযরত আদম আ. কে সিজদা করেছিলো। কিন্তু আদম আ. এর ব্যাপারে উপরের তিনটি বিষয়ের কোনটি না থাকার কারণে এটি ইবাদত হয়নি। ফেরেশতারা আদম আ. এর মধ্যে আল্লাহর কোন গুণ আছে বলে বিশ্বাস করতো না বা আল্লাহর কোন গুণের সাথে আদম আ. এর কোন গুণ বা কাজকে তুলনা করেননি। ফেরেশতারা আদম আ.কে ইলাহ মনে করেননি। সিজদা করার সময় আদম আ. এর ইবাদতের নিয়তও তাদের ছিলো ন। এজন্য এটি সিজদা হওয়া সত্ত্বেও আদম আ. এর ইবাদত বলে গণ্য হবে না।
কিন্তু এটি আল্লাহর ইবাদত বলে গণ্য হবে। কারণ ফেরেশতাগণ আল্লাহর আদেশ মানার উদ্দেশ্যে সিজদা করেছেন। আর সিজদার সময় তারা আল্লাহ তায়ালাকে প্রভূ হিসেবে বিশ্বাস করতেন।
ইবাদত নয়: আদম আ. এর ইবাদতের নিয়ত না থাকার কারণে তাকে সিজদা করা সত্ত্বেও এই সিজদাকে ইবাদত ধরা হবে না।
একইভাবে ইউসুফ আ. এর ভাইয়েরা তাকে সিজদা করেছিলো। ইউসুফ আ. কে সিজদা করার সময় তাদের অন্তরে উপরে কোন একটি বিষয়ও ছিলো না, যার কারণে ইউসুফ আ.কে সিজদা করা সত্ত্বেও এটি ইবাদত ধরা হবে না।
সমস্ত সৃষ্টিই আল্লাহর ইবাদত করে থাকে। তারা অন্য কারও ইবাদত করে না। রাসূল স. এর জন্য গাছ ও পাথর সিজদা করতো। কিন্তু এটি তাদের ইবাদত নয়। কারণ গাছ ও পাথর রাসূল স. এর ইবাদতের উদ্দেশ্যে সিজদা করতো না।
সুতরাং ইবাদত হলো, কাজ বা আমল + ইবাদতের নিয়ত। ইবাদতের নিয়ত না থাকলে শুধু কাজকে ইবাদত বলা হবে না।
সঠিক বুঝ কেন জরুরি?
আমাকে একজন প্রশ্ন করেছেন,
শায়েখ,কেউ যদি কোন ভন্ড পীরকে সেজদা দেয় কিন্তু পীরকে সে আল্লাহ মনে করে না তাহলে শিরক হবে??
আমি উত্তরে লিখেছিলাম:
ইসলামে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কারও জন্য সিজদা করা সম্পূর্ণ হারাম। কেউ যদি পীরের কোন গুণ বা কাজকে আল্লাহ তায়ালার সমকক্ষ পর্যায়ে বিশ্বাস না করে তাহলে তার কাজটা হারাম হলেও শিরক হবে না।
আমাদের এক প্রিয় ভাই লিখেছেন,
/এটা শিরক হবে ।কারণ সিজদা কাকে করা যাবে বা যাবে না তা জায়েয নাজায়েয করবেন কেবল আল্লাহ ।বিনয় হোক ইবাদাত হোক সিজদা আল্লাহ কেবল তাঁর জন্যেই নির্দিষ্ট করেছেন ।তাই অন্য কাউকে বিনয় হোক বা ইবাদাত হোক সিজদা করা হারাম ।এক মাখলুক কে আরেক মাখলুকের কাছে মর্যাদাবান করতে আদম আং কে সিজদা তিনিই জায়েয করেছেন আর একই কারণে পিতামাতার জন্য জায়েয করলেও তিনিই করতেন যদিও এটি সেই উদ্দেশ্যেও কেবল তাঁরই যোগ্য ছিল ।তাই এটা তাঁর ইচ্ছা সুতরাং সেই উদাহরণ টানা যাবে না ।তাই কোন মুমিন যদি এই সিজদাতে কাউকে শরীক করে আল্লাহকে ছাড়া তবে তিনি আল্লাহকে (কেবল সিজদার যোগ্য বলে) বিশ্বাস করা সত্যেও শিরক করলেন ।এতে কোন সন্দেহ নেই ।/
প্রিয় ভাইয়ের কমেন্ট থেকে আমি যা বুঝেছি,
১. কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করা ছাড়া সম্মান বা অন্য কোন উদ্দেশ্যে সিজদা করলেও শিরক হবে।
২. আল্লাহ তায়ালা চাইলে অন্য কাউকে সম্মান বা বিনয়ের উদ্দেশ্যে সিজদা করার অনুমতি দিতে পারেন। যেমন আদম আ. কে সিজদার আদেশ করেছিলেন। মূল কাজটি শিরক হলেও আল্লাহর অনুমতির কারণে এটা জায়েজ হবে।
উপরের কমেন্ট থেকে আশা করি আমার বুঝটি ঠিক আছে। আসুন তার কথাগুলো একটু বিশ্লেষণ করি।
মৌলিকভাবে অন্য কাউকে সিজদা করা হলো শিরক। তবে আল্লাহ তায়ালা অনুমতি দিলে এটি জায়েজ।
আমি তো তার এই বুঝ দেখে প্রচন্ড অবাক হয়েছি। একটা কাজ মৌলিকভাবে শিরক কিন্তু কিন্তু আল্লাহ তায়ালা অনুমতি দিলে সেটা শিরক নয়। এর অর্থ দাড়ালো আল্লাহ তায়ালা শিরকের অনুমতি দেন।
আদম আ.কে সিজদা করা মূলত: শিরক ছিলো। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা অনুমতি বা আদেশ দেয়ার কারণে শিরকটা জায়েজ হয়েছে। আদম আ.কে সিজদার আদেশ করে আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদেরকে শিরক করার আদেশ করেছেন। কিন্তু ইবলিশ আল্লাহ তায়ালার সাথে শিরক করার এই আদেশ লংঘন করেছে।
এটা হলো উক্ত ভাইয়ের বক্তব্যের পরিণতি। ইসলামের আগে অন্যান্য ধর্মে সম্মানের সিজদা জায়েজ ছিলো। এর অর্থ আল্লাহ তায়ালা অন্য সবাইকে তার সাথে শিরক করার অনুমতি দিয়েছেন। শুধু আমাদেরকে তার সাথে শিরক করার অনুমতি দেননি।
আল্লাহ তায়ালা শিরক করার অনুমতি দেন, এটা কীভাবে সম্ভব? কোন জিনিসকে হালাল করা বা হারাম আল্লাহ তায়ালা তার ইচ্ছা অনুযায়ী করেন। তবে আল্লাহ তায়ালা তার সাথে শিরক করার অনুমতি দিবেন এটা আপনি চিন্তা করলেন কী করে?
এটাই বুঝের সমস্যা। একটু বুঝের সমস্যার কারণে অভিশপ্ত ইবলিশের কাজ ভালো হয়ে গেলো। আল্লাহ তায়ালা সবাইকে শিরক করার আদেশ করেছেন। কিন্তু ইবলিশ শিরক করেনি। কোন লুকোচুরি ছাড়া বললে এটাই উপসংহার বের হয়। নাউযুবিল্লাহ।
শিরক একটি জঘন্য কাজ। আর পবিত্র কুরআনে রয়েছে, আল্লাহ তায়ালা কখনও জঘন্য ও গর্হিত কাজের আদেশ করেন না। إن الله لا يأمر بالفحشاء
এজন্য সঠিক বুঝ সব ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা গত পর্বে আলোচনা করেছি যে, যে কোন কাজের সাথে নীচের কোন একটি বিষয় সম্পৃক্ত হলে সেটি শিরক হবে।
১. কারও মধ্যে প্রভূ হওয়ার অনন্য বৈশিষ্ট্য আছে বলে বিশ্বাস করা।
২. কাউকে ইলাহ বা ইবাদতের উপযুক্ত বলে বিশ্বাস করা ।
৩. যে কোন কাজের সাথে ইবাদতের নিয়ত যুক্ত থাকা।
কারও সামনে মাথা নত করা একটি কাজ। এর সাথে যদি উপরের তিনটি বিষয়ের কোন একটি সম্পৃক্ত থাকে, তাহলে সেটি শিরক হবে। নতুবা শুধু মাথা নত করার কারণে শিরক হবে না। যে কোন কাজই হোক, শুধু কাজকেই মৌলিক শিরক হিসেবে বিবেচনা করা হবে না। এর সাথে উপরের তিনটি বিষয়ের কোন একটি যুক্ত হলেই কেবল শিরক হিসেবে গণ্য করা হবে।
কিছু কিছু আলেম সরাসরি কিছু কাজকেই কুফুরী বা শিরকী বলেছেন। যেমন কেউ মূর্তির সামনে সিজদা করছে। অথবা কুরআন শরীফ ছুড়ে ফেলছে। সূর্যকে সিজদা করছে।
তবে সকল ক্ষেত্রেই মূল হলো অন্তরের নিয়ত। কাজের দ্বারা অন্তরের নিয়ত কিছুটা বোঝা যেতে পারে, তবে কাজই মৌলিক ফয়সালার মানদন্ড হতে পারে না। এ বিষয়ে আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি।
আমরা আগের পর্বগুলোতে শিরকের বাস্তবতা নিয়ে আলোচনা করেছি। সমাজে কিছু ভাই শিকরের বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন না করে ঢালাওভাবে কিছু বিষয়কে শিরক বলে থাকে। যা একটি বড় ধরণের অন্যায়। যে কোন বিষয়ে শরিয়তের সীমা অতিক্রম করা অন্যায়। শিরকের প্রতি ঘৃণা থাকা অবশ্য কাম্য, কিন্তু অতি উৎসাহী হয়ে শিরক নয়, এমন বিষয়কে শিরক বলে প্রচার করা অন্যায়।
আজ সিজদার বিষয়ে আলোচনা করব।
সিজদা দু’প্রকার।
১. সিজদায়ে ইবাদত। ইবাদতের উদ্দেশ্যে সিজদা করা।
২. সিজদায়ে তা’জিমী। সম্মানের উদ্দেশ্যে সিজদা করা।
ইবাদতের নিয়তে কাউকে সিজদা করলে সেটা স্পষ্ট শিরক। এখানে আর কোন কিছু চিন্তার সুযোগ নেই। তা’জিম বা সম্মানের জন্য সিজদা করলে সেটা শিরক নয়। তবে ইসলামে হারাম।
এই মতটি শুধু আমাদের ঘরানার আলেমদের নয়, বরং এটি সালাফিদেরও মত। ইবনে তাইমিয়া, ইবনুল কাইয়িম, কাজি শাওকানি, শাইখ মুহাম্মাদ বিন ইব্রাহিম, শাইখ সালেহ আল-মুনাজ্জিদসহ প্রায় সকলে এই মতের অনুসারী।
শাইখ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ এই বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন।
ইংলিশঃ https://islamqa.info/en/229780
আরবি লিঙ্ক: https://islamqa.info/ar/229780
শাইখ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ এর দলিলগুলোর সারমর্মঃ
১। আল্লাহ তায়ালা ফেরেশাতেদেরকে আদম আঃ কে সিজদার আদেশ দিয়েছেন। মৌলিকভাবে শুধু সিজদা করায় যদি শিরক হত, তাহলে আল্লাহ তায়ালা এই আদেশ দিতেন না। কারণ আল্লাহ তায়ালা কখনও ঘৃণিত কাজের আদেশ করেন না। আর শিরক একটি ঘৃণিত কাজ।
২। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে ইউসুফ আঃ এর ঘটনা উল্লেখ করেছেন। হজরত ইয়াকুব আঃ ও তার ছেলেরা হজরত ইউসুফ আ কে সিজদা করেছিলেন। তাদের এই ঘটনা কুরআনে রয়েছে। মূল সিজদা যদি শিরক হত, কোন নবী কখনও এটি করতেন না।
৩। হজরত মুয়াজ বিন জাবাল রাঃ ইয়ামান থেকে ফিরে এসে রাছুল সঃ কে সিজদা করেন। মূল সিজদা যদি শিরক হত তাহলে রাছুল সঃ তাকে সেটি বলে দিতেন। কিন্তু রাছুল সঃ তাকে শুধু সিজদা হারাম হওয়ার কথা বলেছেন, শিরক হওয়ার কথা বলেননি। হজরত মুয়াজ বিন জাবাল রাঃ এর ঘটনাটি ইবন মাজাতে রয়েছে। হাদিসকে শাইখ নাসিরুদ্দিন আলবানি হাসান বলেছেন।
৪। কিছু কিছু হাদিস থেকে প্রমাণিত যে, বিভিন্ন প্রাণী রাছুল সঃ কে দেখে সিজদ্বা করত। মূল সিজদা যদি শিরক হত, তাহলে রাছুল এঁর ক্ষেত্রে এটি হত না।
৫। সিজদা একটা শরিয়তের বিধান ও হুকুম। যা বিভিন্ন শরিয়তে পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু তাউহিদ ও শিরক অপরিবর্তনশীল। এগুলো সব নবীর শরিয়তে একই রকম থাকবে।
৬। চার মাজহাবের সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমদের মতে ইবাদতের সিজদা ও তাজিমের সিজদার হুকুমের পার্থক্য রয়েছে। ইবাদতের সিজদা শিরক কিন্ত তাজিমের সিজদা হারাম। এরপর শাইখ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ বিভিন্ন আলেমের বক্তব্য উল্লেখ করেছেন। ইমাম ফখরুদ্দিন জাইলাই, ইমাম ইবনে নুজাইম আল-হানাফি, ইমাম নববি ও ইমাম শিহাবুদ্দিন রমালির বক্তব্য এনেছেন।
চার মাজহাবের গ্রহণযোগ্য মত হল, তাজিমের সিজদা হারাম শিরক নয়। এটাই দলিলের বিবেচনায় শক্তিশালী।
আমরা এখানে আরও কিছু আলেমের বক্তব্য দেখব যারা এ বিষয়ে মত দিয়েছেন।
১। ফতওয়া আল্মগিরির বক্তব্যঃ
مَنْ سَجَدَ لِلسُّلْطَانِ عَلَى وَجْهِ التَّحِيَّةِ أَوْ قَبَّلَ الْأَرْضَ بَيْنَ يَدَيْهِ لَا يَكْفُرُ , وَلَكِنْ يَأْثَمُ لِارْتِكَابِهِ الْكَبِيرَةَ , هُوَ الْمُخْتَارُ
অর্থঃ কেউ যদি বাদশাকে অভিবাদনের উদ্দেশ্যে সিজদা করে বা তার সামনে জমিনে চুমু দেয়, তাহলে সে কাফের হবে না। তবে তার কবিরা গোনাহ হবে। এটাই গ্রহণযোগ্য ফতওয়া । https://goo.gl/AYKTQf
২। ইমাম জাহাবি রহঃ তার মুজামুশ শুউখ কিতাবে লিখেছেন,
ألا ترى الصحابة من فرط حبهم للنبي –صلى الله عليه وسلم- قالوا: ألا نسجد لك؟ فقال: لا، فلو أذن لهم لسجدوا سجود إجلال وتوقير لا سجود عبادة كما سجد إخوة يوسف عليه السلام ليوسف، وكذلك القول في سجود المسلم لقبر النبي صلى الله عليه وسلم على سبيل التعظيم والتبجيل لا يكفر به أصلا بل يكون عاصيا.
অর্থঃ তুমি কি দেখ না, সাহাবায়ে কেরাম রাছুল সঃ এঁর প্রতি অতিরিক্ত মহব্বতের কারণে বলেছিলেন, হে রাছুল, আমরা কি আপনার সিজদা করব না ? রাছুল সঃ বলেন, না। আল্লাহর রাছুল যদি অনুমতি দিতেন, তাহলে তারা সম্মান ও ভক্তির উদ্দেশ্যে সিজদা করতেন, ইবাদতের উদ্দেশ্যে নয়। যেমন হজরত ইউসুফ আঃ এঁর ভাইয়েরা তাকে সিজদা করেছিল। একই হুকুম হবে, কোন মুসলমান যদি সম্মান ও ভক্তির উদ্দেশ্যে রাছুল স এঁর কবরে সিজদা করে, তাহলে সে কাফের হবে না, কিন্তু গুনাহগার হবে।
মুজামুশ শুউখ ১/৭৩।
৩। কাজি শাওকানি তার সাইলুল যারার কিতাবে লিখেছেন,
اعلم أن الحكم على الرجل المسلم بخروجه من دين الإسلام ودخوله في الكفر لا ينبغي لمسلم يؤمن بالله واليوم الآخر أن يقدم عليه إلا ببرهان أوضح من شمس النهار… وأما قوله : “ومنها السجود لغير الله” فلا بد من تقييده بأن يكون سجوده هذا قاصداً لربوبية من سجد له، فإنه بهذا السجود قد أشرك بالله عز وجل وأثبت معه إلهاً آخر، وأما إذا لم يقصد إلا مجرد التعظيم كما يقع كثيراً لمن دخل على ملوك الأعاجم أنه يقبل الأرض تعظيماً له، فليس هذا من الكفر في شيء، وقد علم كل من كان من الأعلام أن التكفير بالإلزام من أعظم مزالق الأقدام
অর্থঃ জেনে রেখ, দ্বীনের আলোর চেয়ে পরিষ্কার প্রমাণ ছাড়া কোন মুসলমানের উপর ইসলাম থেকে বের হয়ে কাফের হয়ে যাওয়ার হুকুম লাগানোর কারও অগ্রসর হওয়া উচিত নয়। আল্লাহ ও তার রাছুলের উপর ইমান রাখে এমন কেউ এধরণের কাজে অগ্রসর হতে পারে না… তিনি বলেছেন, ইমান ভঙ্গের একটি কারণ হল, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সিজদা করা। তার এই বক্তব্যকে অবশ্যই শর্তযুক্ত করতে হবে। যার জন্য সিজদা করছে, তাকে রব মনে করে সিজদা করলেই কেবল শিরক হবে। কারণ, রব মনে করে সিজদা করলে সে আল্লাহর সাথে শরিক করল এবং অন্য একজন ইলাহকে বিশ্বাস করল। ওই ব্যক্তি যদি শুধু সম্মানের উদ্দেশ্যে সিজদা তাহলে এটি কখনও শিরক হবে না। যেমন অনেক অনারব রাজা বাদশার সামনে গেলে জমিনে চুমু দিয়ে থাকে। এটি কুফরি নয়। সমস্ত বিজ্ঞ আলেম এ বিষয়ে সচেতন যে, কাউকে অন্যায়ভাবে তাকফির করা অনেক বড় পদস্খলন।
সাইলুল যারার – 4/ 578
৪। আল্লামা ইবনে নুজাইম রহঃ বলেন,
وَالسُّجُودُ لِلْجَبَابِرَةِ : كُفْرٌ ، إنْ أَرَادَ بِهِ الْعِبَادَةَ ؛ لَا إِنْ أَرَادَ بِهِ التَّحِيَّةَ ، عَلَى قَوْلِ الْأَكْثَرِ
অর্থঃ ইবাদতের নিয়তে কেউ বাদশাকে সিজদা করলে কুফরি হবে। সম্মান বা অভিবাদনের উদ্দেশ্যে সিজদা করলে কুফরি হবে না।
আল-বাহরুর রায়েক (5/134)
মোট কথা, এ বিষয়ে যারা বাড়া-বাড়ি করেছেন, তাদের মত সঠিক নয়। যেমন সালাফি শাইখ ইবনে উছাইমিন রহঃ লিখেছেন,
ومن ذهب إلى قبر فسجد لصاحب القبر فهو مشرك سجد لغير الله ، والسجود لا يكون إلا لله عز وجل
অর্থঃ কেউ যদি কোন কবরের কাছে গিয়ে কবরে শায়িত ব্যক্তির জন্য সিজদা করে, তাহলে সে মুশরিক হয়ে যাবে। কারণ সে আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য সিজদা করেছে। আর সিজদা হবে শুধু আল্লাহর জন্য।
মাজমুঊ ফাতওয়া ও রাছাইল- 24/224
শরিয়তের দলিল ও উছুলের আলোকে ইবনে উছাইমিন রহঃ এঁর বক্তব্য স্পষ্ট ভুল ও বাড়াবাড়ি। কবরে শায়িত ব্যক্তির জন্য শুধু ইবাদতের নিয়তে সিজদা করলে শিরক হবে। ইবাদতের নিয়ত ছারা সিজদা করলে হারাম হবে। শাইখ সালহ আল-মুনাজ্জিদের ফাতওয়া থেকে উপরে আমরা দলিল আলোচনা করেছি।
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এসব বিষয়ে বাড়াবাড়ি ও ছাড়া-ছাড়ি থেকে হেফাজত করুন। আমীন।
গত পর্বে সিজদার হুকুম ও এ বিষয়ে বাড়াবাড়ি নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা তাওয়াফ সম্পর্কে আলোচনা করব। কোন পীর, আলেম, পীরের কবর, পীরের বাড়িকে তাওয়াফ করার শরয়ী বিধান কী?
শরিয়তে তাওয়াফ শুধু কাবা ঘরের জন্য নির্দিষ্ট। কাবা ঘর ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তি, ঘর বা কবরকে তাওয়াফ করার কোন অনুমতি শরিয়তে নেই। এরপরেও কেউ যদি অন্য কারও কবর, ঘর বা ব্যক্তিকে তাওয়াফ করে তাহলে তার হুকুম হল-
১। যাকে তাওয়াফ করছে তার মধ্যে যদি আল্লাহর কোন গুণ (খাসাইসুর রুবুবিইয়া) আছে বলে বিশ্বাস করে অথবা ওই ব্যক্তির ইবাদতের নিয়ত থাকে, তাহলে এটি স্পষ্ট শিরক হবে। সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে। যেমন যাকে তাওয়াফ করছে তার ব্যাপারে যদি বিশ্বাস থাকে, তিনি নিজের ইচ্ছা ও ক্ষমতায় যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন, তার নিজের ক্ষমতায় তার যে কোন প্রয়োজন পূরণ করতে পারেন।
২। উপরের বিশ্বাসগুলো ছাড়া শুধু সম্মানের জন্য যদি কোন পীর বা পীরের কবরকে তাওাফ করে তাহলে সেটি হারাম ও বড় গোনাহের কাজ। তবে এটি শিরক হবে না।
এটি চার মাজহাব ও আহলে সুন্নতের সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমের অভিমত। সালাফি শাইখ ইবন বাজ, ইবনে উছাইমিন, ফাতওয়া আল-লাজনা আদ-দাইমার মুফতিগ্ণ ও শাইখ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ এমন মত দিয়েছেন।
১। মোল্লা আলি কারি রহঃ লিখেছেন,
“لا يطوف” أي لا يدور حول البقعة الشريفة , لأن الطواف من مختصات الكعبة المنيفة , فيحرم حول قبور الأنبياء والأولياء
অর্থঃ রাছুল সঃ এর রউজাকে ঘিরে তাওয়াফ করবে না। কেননা তাওয়াফ শুধু কাবা ঘরের জন্য-ই নির্দিষ্ট, নবী ও অলিদের কবরে তাওয়াফ করা হারাম হবে।
শরহুল মানাসিক।
২। ইমাম নববি রহঃ বলেন,
ولا يجوز أن يطاف بقبره صلى الله عليه وسلم، ويكره إلصاق الظهر والبطن بجدار القبر. قاله أبو عبد الله الحليمي وغيره، قالوا: ويكره مسحه باليد وتقبيله، بل الأدب أن يبعد منه كما كان يبعد منه لو حضره في حياته، هذا هو الصواب الذي قاله العلماء واطبقوا عليه، ولا يغتر بكثرة مخالفة كثيرين من العوام وفعلهم ذلك، فإن الاقتداء والعمل إنما يكون بالأحاديث الصحيحة وأقوال العلماء، ولا يلتفت إلى محدثات العوام وغيرهم وجهالاتهم
অর্থঃ রাছুল সঃ এর কবরে তাওয়াফ করা জায়েজ নয়। কবরের দেওয়ালে পেট বা পিঠ লাগান মাকরুহ। আবু আব্দিল্লাহ আল-হুলাইমি ও অন্যরা এই মত দিয়েছেন। তারা বলেছেন,রাছুল সঃ এর কবরে হাত দিয়ে কবর স্পর্শ করা, কিংবা কবরে চুমু দেওয়া মাকরুহ। বরং আদব হল, কবর থেকে একটু দূরে থাকবে। যেমন জীবিত অবস্থায় রাছুল সঃ কাছে গেলে একটু দূরে থাকত। এটাই সঠিক। উলামায়ে কেরাম এমনটি বলেছেন এবং এর উপর আমল করেছেন। অনেক সাধারণ মানুষের এর বিপরীত আমল দেখে ধোঁকা খাবে না। কেননা আমল ও অনুসরণ হবে সহিহ হাদিস ও আলেমদের বক্তব্যের উপর। সাধারণ মানুষের বিদআতী আমল ও অজ্ঞতার প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ করা হবে না।
আল-মাজমু-৮/২৫৮
৩। ইবনে হাজার হাইতামি রহঃ লিখেছেন,
الْكَبِيرَةُ الثَّالِثَةُ وَالرَّابِعَةُ وَالْخَامِسَةُ وَالسَّادِسَةُ وَالسَّابِعَةُ وَالثَّامِنَةُ وَالتِّسْعُونَ : اتِّخَاذُ الْقُبُورِ مَسَاجِدَ ، وَإِيقَادُ السُّرُجِ عَلَيْهَا ، وَاِتِّخَاذُهَا أَوْثَانًا ، وَالطَّوَافُ بِهَا ، وَاسْتِلَامُهَا ، وَالصَّلَاةُ إلَيْهَا
অর্থঃ ৯৩, ৯৪, ৯৫, ৯৬, ৯৭, ৯৮ নং কবিরা হল, যথাক্রমে কবরে সিজদা দেওয়া, কবরে বাতি জ্বালান, কবরকে পূজনীয় বানান, কবরে তাওয়াফ করা, কবরে চুমু দেওয়া, কবরের দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করা।
আজ-জাওয়াজির, ১/১২০।
৪। ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ুতি রহঃ বলেন,
ومن البدع أيضاً: أكل العوام التمر الصيحاني في الروضة الشريفة بين المنبر والقبر، وطوافهم بالقبر الشريف ، ولا يحل ذلك , وكذلك إلصاقهم بطونهم وظهورهم بجدار القبر، وتقبيلهم إياه بالصندوق الذي عند رأس النبي –صلى الله عليه وسلم- ومسحه باليد , وكل ذلك منهي عنه
অর্থঃ আরও কিছু বিদাত হল, রাছুল এর রওযায় কবর ও মেম্বারের মাঝখানে সাধারণ মানুষের সাইহানি খেজুর খাওয়ার যে রীতি আছে, এটি বিদ্আত। একইভাবে কবরে তাওয়াফ করা। এটি জায়েজ নয়। এছাড়া কবরের দেওয়ালে তাদের পীঠ ও পেট লাগান, রাছুল সঃ এর মাথার কাছে যে সিন্দুক রয়েছে, তাতে হাত দিয়ে চুমু দেওয়া। এসব কিছু নিষিদ্ধ।
আল-আমরু বিল ইত্তিবা, ওয়ান নাহঊ আনিল ইব্দিতা।
৫। ইমাম আবু শামা মাকদেসি লিখেছেন,
قال ابن الصلاح: ولا يجوز أن يطاف بالقبر، وحكى الإمام الحليمي عن بعض أهل العلم: أنه نهى عن إلصاق البطن والظهر بجدار القبر ومسحه باليد، وذكر أن ذلك من البدع
অর্থঃ ইমাম ইবনুস সালাহ বলেন, কবরে তাওয়াফ করা জায়েজ নয়। কিছু কিছু আলেম থেকে ইমাম হুলাইমি বর্ণনা করেছেন, কবরের দেওয়ালে পেট ও পীঠ লাগান এবং হাত দিয়ে স্পর্শ করতে নিষেধ করেছেন। তারা বলেছেন, এগুলো বিদআতের অন্তর্ভুক্ত।
আল-বাইস ফী ইঙ্কারিল বিদায়ী ওয়াল হাওয়াদিস – ২৮২-২৮৩।
মোট কথা, কবর তাওয়াফের ক্ষেত্রে ইবাদতের নিয়ত বা কবরে শায়িত ব্যক্তির মধ্যে রুবুবিয়াতের বিশ্বাস না থাকলে তাওয়াফ করা হারাম। এটা অধিকাংশ সালাফি আলেমেরও মত। সালাফি আলেমদের বক্তব্যগুলো নীচের লিঙ্ক এ পাবেন।
https://islamqa.info/ar/112867
আল্লাহ তায়ালা এসব বিষয়ে বাড়াবাড়ি করে অন্যায় তাকফির থেকে আমাদেরকে হেফাজত করুন। বাড়াবাড়ির নমুনা হিসেবে সালাফি শাইখ সালেহ আল-ফাওজানের বক্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে। শাইখকে জিজ্ঞেস করা হয়,
السجود عند الصنم والقبر، والذبح عند الصنم والقبر كذلك، هل يكفر صاحبه أم لابد أن يُنظر هل هو ذبح للصنم وسجد للصنم أو ذبح لله وسجد لله عند ذلك؟
هذه سفسطة وحذلقة لا تجوز، من ذبح عند القبر فهو مشرك، ومن سجد عند القبر فهو مشرك، ولا علينا من هل نوى ما نوى ، كل هذه سفسطة
অর্থঃ মূর্তি ও কবরের সামনে সিজদা করা, মূর্তি ও কবরের সামনে কোন কিছু জবাই করা, এসব ক্ষেত্রে কী ওই ব্যক্তিকে সরাসরি কাফের বলা হবে নাকি দেখা হবে যে, সে মূর্তির জন্য জবাই ও সিজদা করেছে, নাকি ওইখানে আল্লাহর জন্য জবাই করেছে?
উত্তরঃ এটা তো মূর্খতা ও প্রগলভতা । এটা ঠিক নয়। যে কবরের কাছে কোন প্রাণী জবাই করল সে মুশরিক। যে কবরের কাছে সিজদা করল, সে মুশরিক। সে কি নিয়তে করেছে এটা আমাদের দেখার দরকার নেই। এগুলো সব জাহালত।
শরহু কাইদাতিন জালিলা, দরস-১৪।
এটা হল, তাকফিরের ক্ষেত্রে শাইখ ফাওজানের মারাত্মক বাড়াবাড়ি। এটা অন্যায়। তাকফিরের ক্ষেত্রে আহলে সুন্নত সর্বদা খুবই সতর্ক ছিলেন। এভাবে তাকফিরি চিন্তা -চেতনা জমহুর আহলে সুন্নতের নীতি ও আদর্শের খেলাফ। কারও ব্যাপারে তাকফিরের আগে অবশ্য-ই তার নিয়ত ও বিশ্বাস জেনে নিশ্চিত হয়ে তাকফির করতে হবে। এভাবে নিয়ত ও অবস্থা যাচায় না করে কাউকে তাকফিরের অনুমতি শরিয়ত দেয় না।
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে বাড়াবাড়ি ও ছাড়া-ছাড়ি থেকে হেফাজত করুন। আমিন।
------ ------
খতীব বাগদাদী রহ. তার ‘আল-জামে লি-আখলাকির রাবি ও আদাবিস সামে’ কিতাবে ইমাম আবু ইউসুফ রহ. থেকে একটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন।
الْعِلْمُ شَيْءٌ لا يُعْطِيكَ بَعْضَهُ حَتَّى تُعْطِيَهُ كُلَّكَ
অর্থ: ইলম এমন একটি জিনিস, সে তোমাকে তার কিছু অংশও দিবে না যতক্ষণ না তুমি নিজেকে পূর্ণভাবে তার কাছে সমর্পণ না করবে।
অন্যান্য সৃষ্টি থেকে মানুষের শ্রেষ্ঠত্যের একটি বিশেষ দিক হলো ইলম অর্জনের ক্ষমতা। এটি মানুষের জন্য আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
ইলমের জন্য যে…
ইবনে তাইমিয়া রহ. এর জীবনী আলোচনা করেছেন তার বিশিষ্ট ছাত্র ইবনুল কাইয়্যিম রহ। তার পৃথক জীবনী লিখেছেন ইবনে তাইমিয়া রহ. এর বিশিষ্ট দুই ছাত্র। একজন হলেন, হাফেজ আবু হাফস উমর ইবনে আলি আল-বাযযার (মৃত:৭৪৯ হি:) তিনি আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া লিখেছেন। ইবনে তাইমিয়া রহ. আরেক ছাত্র ইবনে আব্দুল হাদী রহ. (মৃত: ৭৪৪ হি:) আরেকটি জীবনী লিখেছেন। তার লিখিত জীবনীর নাম আল-উকুদুল দুররিয়া মিন মানাকিবি শাইখিল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া।
আমি এখানে ইবনে তাইমিয়া রহ. এর বিশিষ্ট ছাত্রদের বর্ণনায় তার কিছু উল্লেখযোগ্য কারামত উল্লেখ করছি।
কারামত-১:
লওহে মাহফুজ দেখে বিজয়ের সংবাদ:
গায়েবসম্পর্কেইবনেতাইমিয়ারহ. এরকারামত:
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) “মাদারিজুস সালিকিন শরহু মানাযিলিস সাঈরিন” নামক কিতাবে আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) এর কারামতের কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) লিখেছেন-
أخبر الناس والأمراء سنة اثنتين وسبعمائة لما تحرك التتار وقصدوا الشام : أن الدائرة والهزيمة عليهم وأن الظفر والنصر للمسلمين وأقسم على ذلك أكثر من سبعين يمينا فيقال له : قل إن شاء الله فيقول : إن شاء الله تحقيقا لا تعليقا وسمعته يقول ذلك قال : فلما أكثروا علي قلت : لا تكثروا كتب الله تعالى في اللوح المحفوظ : أنهم مهزومون في هذه الكرة وأن النصر لجيوش الإسلام
“তাতারীরা যখন মুসলিম উম্মাহের বিভিন্ন অঞ্চলে সেনা অভিযান পরিচালনা করে এবং শামে আক্রমণের উদ্যোাগ গ্রহণ করে তখন ৭০২ হিঃ সনে শায়েখ (রহঃ) সাধারণ মানুষ এবং আমীর-উমারাদেরকে সংবাদ দিলেন যে, “তাতারীরা পরাজিত হবে এবং মুসলমানরা বিজয় ও সাহায্য লাভ করবে।”। তিনি তাঁর কথার উপর সত্তরটিরও বেশি কসম খেয়েছেন। তাঁকে বলা হল, আপনি ইনশাআল্লাহ বলুন! অতঃপর তিনি বলেন, নিশ্চিতভাবে ইনশাআল্লাহ বলছি, সম্ভাবনা হিসেবে নয়। আমি তাঁকে বলতে শুনেছি, যখন তারা আমার উপর পীড়াপীড়ি করল, আমি তাদেরকে বললাম, তোমরা পীড়াপীড়ি কর না, আল্লাহ তায়ালা লউহে মাহফুজে লিখে রেখেছেন যে, তারা পরাজিত হবে এবং মুসলমানরা বিজয়ী হবে।
[মাদারিজুস সালিকিন, খ–২, পৃষ্ঠা-৪৮৯]
আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) আরও অনেক কারামতের কথা উল্লেখ করেছেন, ইবনে আব্দুল হাদী মুকাদ্দেসী (রহঃ) এবং আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ)। বিস্তারিত জানার জন্য আগ্রহী পাঠক, মাদারিজুস সালিকীন ও আ’লামুল আলিয়্যা গ্রন্থদ্বয় দেখতে পারেন।
¬
কারামত-২: ইবনে তাইমিয়া রহ. এর ভবিষ্যৎবাণী:
আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) এর বিশেষ ছাত্র আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) লিখেছেন-
وأخبرني غير مرة بأمور باطنة تختص بي مما عزمت عليه ولم ينطق به لساني وأخبرني ببعض حوادث كبار تجري في المستقبل ولم يعين أوقاتها وقد رأيت بعضها وأنا أنتظر بقيتها وما شاهده كبار أصحابه من ذلك أضعاف أضعاف ما شاهدته والله أعلم
“তিনি আমাকে অনেকবার অনেক বাতেনি বিষয়ের সংবাদ দিয়েছেন। তিনি শুধু আমাকে এগুলো বলেছেন এবং এ বিষয় সম্পর্কে আমি কাউকে কিছু বলি নি। তিনি আমাকে ভবিষ্যতের অনেক ঘটনার সংবাদ দিয়েছেন কিন্তু তিনি সময় নির্দিষ্ট করে দেননি। তাঁর ভবিষ্যৎ বাণীর কিছু কিছু আমি ঘটতে দেখেছি এবং অবশিষ্টগুলো সংঘটিত হওয়ার অপেক্ষায় আছি। তাঁর বড় বড় সাগরেদগণ আমি যা দেখেছি, তার চেয়ে বহু বহু গুণ বেশি দেখেছেন”
[মাদারিজুস সালিকিন, খ–২, পৃষ্ঠা-৪৯০]
কারামত-৩: অন্তরের বিষয় সম্পর্কে অবগত হওয়া:
ইবনে তাইমিয়া রহ. এর ছাত্র আবু হাফস উমর আল-বাযযার বলেন,
“أنه جرى بيني وبين بعض الفضلاء منازعة في عدة مسائل وطال كلامنا فيها وجعلنا نقطع الكلام في كل مسألة بأن نرجع إلى الشيخ وما يرجحه من القول فيها
ثم أن الشيخ رضي الله عنه حضر فلما هممنا بسؤاله عن ذلك سبقنا هو وشرع يذكر لنا مسألة مسألة كما كنا فيه وجعل يذكر غالب ما أوردناه في كل مسأله ويذكر أقوال العلماء ثم يرجح منها ما يرجحه الدليل حتى أتى على آخر ما أردنا أن نسأله عنه وبين لنا ما قصدنا أن نستعلمه منه فبقيت أنا وصاحبي ومن حضرنا أولا مبهوتين متعجبين مما كاشفنا به وأظهره الله عليه مما كان في خواطرنا.”
অর্থাৎ আমার সাথে একজন সম্মানিত আলেমের কয়েকটি মাসআলা নিয়ে বিতর্ক হলো। এ বিষয়ে আমাদের আলোচনা অনেক দীঘর্ হলো। প্রত্যেক মাসআলায় আমরা এভাবে কথা শেষ করলাম যে, মাসআলার সমাধান ইবনে তাইমিয়া রহ. এর কাছ থেকে জেনে নিবো।
এরপর শায়খ রহ. আমাদের নিকট উপস্থিত হলেন। আমরা যখন মাসআলাগুলো সম্পর্কে শায়খকে জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছা করলাম তিনি আমাদের জিজ্ঞাসার পূর্বেই আলোচনা শুরু করলেন। তিনি আমাদের আলোচনা অনুযায়ী একের পর এক মাসআলার সমাধান বলতেছিলেন। প্রত্যেক মাসআলায় আমাদের কাঙ্খিত উত্তর প্রদান করছিলেন। এভাবে তিনি প্রত্যেকটি মাসআলায় উলামায়ে কেরামের বক্তব্য এবং দলিল অনুযায়ী প্রাধান্য পাওয়া মাসআলাটি উল্লেখ করছিলেন। অবশেষে তিনি আমাদের আলোচিত সর্বশেষ মাসআলাটির সমাধান প্রদান করলেন। আমাদের অন্তরের বিষয়গুলো আল্লাহ তায়ালা এভাবে সুস্পষ্ট করে প্রকাশ করায় উপস্থিত লোকজন, আমার সঙ্গী ও আমি আশ্চর্যন্বিত ও বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৩, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
নিচের স্ক্রিনশট দেখুন,
এছাড়া আবু হাফস আল-বাযযার অন্তরের বিষয়ে ইবনে তাইমিয়া রহ. এর অবগত হওয়া সম্পর্কে আরও বলেন,
و كنت في خلال الأيام التي صحبته فيها إذا بحث مسألة يحضر لي إيراد فما يستتم خاطري به حتي يشرع فيرده و يذكر الجواب من عدة وجوه
অর্থাৎ আমি যখন যেসময়ে তার সংস্পর্শে ছিলাম, তখন আমার মনে কোন বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ার সঙ্গে তিনি এর জওয়াব দিতে শুরু করতেন এবং কয়েকভাবে এর উত্তর প্রদান করতেন।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৩, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
কারামত-৪: অন্যের সাহায্য
“وحدثني الشيخ الصالح المقريء أحمد بن الحريمي أنه سافر إلى دمشق قال فاتفق أنى لما قدمتها لم يكن معي شئ من النفقة البتة وأنا لا اعرف أحدا من أهلها فجعلت أمشي في زقاق منها كالحائر فإذا بشيخ قد أقبل نحوي مسرعا فسلم وهش في وجهي ووضع في يدي صرة فيها دراهم صالحة وقال لي انفق هذه الآن وخلي خاطرك مما أنت فيه فإن الله لا يضيعك ثم رد على أثره كأنه ما جاء إلا من أجلي فدعوت له وفرحت بذلك، وقلت لبعض من رأيته من الناس من هذا الشيخ؟ فقال وكأنك لا تعرفه هذا ابن تيمية
আমার নিকট শায়খ সালেহ আল –মুকরী বর্ণনা করেন, তিনি দামেশকের উদ্দেশে সফর করেন। তিনি বলেন, ঘটনাক্রমে ঐ সফরে আমার সঙ্গে কোন চলার মতো কোন খাবার বা অর্থ ছিলো না। আমি ওখানকার কাউকে চিনতাম না। এ অবস্থায় আমি উদভ্রান্তের মতো দামেশকের অলি-গলিতে ঘুরছিলাম। হঠাৎ একজন শায়খ আমার দিকে দ্রুত গতিতে হেঁটে এলেন। তিনি হাস্যোজ্জল মুখে সালাম দিলেন। তিনি আমার হাতে একটা থলি দিলেন যাতে কিছু খাটি দিরহাম ছিলো। এরপর বললেন, “ এগুলো ব্যবহার করো। তোমার অন্তরে যেই পেরেশানী আছে এগুলো ঝেড়ে ফেলো। আল্লাহ তায়ালা তোমাকে ধ্বংস করবেন না।” একথা বলে তিনি একই পথে ফিরে গেলেন। তিনি যেন শুধু আমার কাছেই এসেছিলেন। আমি তার জন্য দুয়া করলাম এবং এতে আনন্দি হলাম। আমি অন্যান্য মানুষকে জিজ্ঞেস করলাম, এই শায়খ কে? তারা বললো, তুমি মনে হয় শায়খকে চেনো না, তিনি হলেন ইবনে তাইমিয়া।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৪, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
কারামত-৫:
وحدثني الشيخ العالم المقريء تقي الدين عبد الله ابن الشيخ الصالح المقريء احمد بن سعيد قال سافرت إلى مصر حين كان الشيخ مقيما بها فاتفق أني قدمتها ليلا وأنا مثقل مريض فأنزلت في بعض الأمكنة فلم ألبث أن سمعت من ينادي باسمي وكنيتي فأجبته وأنا ضعيف فدخل إلي جماعة من أصحاب الشيخ ممن كنت قد اجتمعت ببعضهم في دمشق فقلت كيف عرفتم بقدومي وأنا قدمت هذه الساعة فذكروا أن الشيخ أخبرنا بأنك قدمت وأنت مريض وأمرنا أن نسرع بنقلك وما رأينا أحدا جاء ولا أخبرنا بشيء، فعلمت أن ذلك من كرامات الشيخ رضي الله عنه.”
শায়খ সালেহ আল-মুকরী এর ছেলে শায়খ তাকিউদ্দীন আব্দুল্লাহ আল-মুকরী আমাকে বলেছেন, শায়খ ইবনে তাইমিয়া রহ. যখন মিশরে ছিলেন তখন আমি মিশরে সফর করি। আমি রাতে মিশরে গিয়ে উপস্থিত হলাম। তখন আমার কাছে ভারী বোঝা ছিল আর আমি অসুস্থ ছিলাম। আমি এক জায়গায় গিয়ে বাহন থেকে নামলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে শুনতে পেলাম এক ব্যক্তি আমার নাম ও উপনাম ধরে ডাকছে। আমি দুর্বল শরীরে তার ডাকে সাড়া দিলাম। তখন শায়খ ইবনে তাইমিয়ার একদল ছাত্র আমার নিকট এলো। তাদের সাথে আমি পূর্বে দামেশকে সাক্ষাৎ করেছিলাম। আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা আমার আগমন সম্পর্কে কীভাবে জানলে; অথচ আমি মাত্র এলাম? তারা বলল, শায়খ ইবনে তাইমিয়া তাদেরকে বলেছে যে, আপনি এসেছেন এবং আপনার শরীর অসুস্থ। আমাদেরকে দ্রুত আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন। আমরা কাউকে আসতেও দেখিনি এবং আপনার সম্পর্কে কেউ পূর্বে সংবাদও দেয়নি। আমি তখন বুঝলাম এটি শায়খের কারামত।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৪, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
কারামত-৬:
“وحدثني أيضا قال مرضت بدمشق إذ كنت فيها مرضة شديدة منعتني حتى من الجلوس فلم اشعر إلا والشيخ عند رأسي وأنا مثقل مشتد بالحمى والمرض فدعا لي وقال جاءت العافية، فما هو إلا أن فارقني وجاءت العافية وشفيت من وقتي”
শায়খ সালেহ আল-মুকরী এর ছেলে শায়খ তাকিউদ্দীন আব্দুল্লাহ আল-মুকরী আরও বলেন, আমি দামেশকে কঠিন রোগে আক্রান্ত হলাম। এমনকি আমি বসতেও পারতাম না। হঠাৎ আমার মাথার নিকট শায়খকে দেখতে পেলাম।তখন আমি মারাত্মক জ্বর ও রোগে আক্রান্ত ছিলাম।তিনি আমার জন্য দুয়া করলেন এবং বললেন, সুস্থতা চলে এসেছে।তিনি আমার কাছ থেকে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি সুস্থ হয়ে গেলাম।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৫, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
কারামত-৭:
“وحدثني أيضا قال أخبرني الشيخ ابن عماد الدين المقرئ المطرز قال قدمت على الشيخ ومعي حينئذ نفقة فسلمت عليه فرد علي ورحب بي وأدناني ولم يسألني هل معك نفقة أم لا، فلما كان بعد أيام ونفدت نفقتي أردت أن اخرج من مجلسه بعد أن صليت مع الناس وراءه فمنعني وأجلسني دونهم فلما خلا المجلس دفع إلي جملة دراهم وقال أنت الآن بغير نفقة فارتفق بهذه فعجبت من ذلك وعلمت أن الله كشفه على حالي أولا لما كان معي نفقة وآخرا لما نفدت واحتجت إلى نفقة.”
আমার নিকট তিনি আরও বর্ণনা করেছেন, আমার নিকট শায়খ ইবনে ইমাদুদ্দিন আল-মুকরী আল-মুতাররায বর্ণনা করেন, তিনি বলেন আমি একবার শায়খের নিকট আগমন করলাম। তখন আমার কাছে খরচের টাকা-পয়সা ছিলো। আমি তাকে সালাম দিলাম, তিনি উত্তর দিলেন এবং আমাকে স্বাগত জানালেন। আমাকে তিনি তার নিকটে বসালেন। এবার তিনি আমার জীবিকা নির্বাহের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন না। কিছুদিন পর আমার খরচের উপকরণ শেষ হয়ে গেল। তখন আমি তার পিছে নামায আদায় করে তার মজলিশ থেকে বের হতে উদ্যত হলাম। তিনি আমাকে বাধা দিয়ে বসতে বললেন। এরপর যখন মজলিশ শেষ হলো, তখন তিনি আমাকে কিছু দিরহাম দিয়ে বললেন, এখন তোমার কোন খরচের টাকা-পয়সা নেই। এগুলো ব্যবহার করতে থাকে। এ ঘটনায় আমি বিস্মিত হলাম। বুঝলাম যে আল্লাহ তায়ালা আমার পূর্বের ও বর্তমান অবস্থা শায়খের নিকট প্রকাশ করে দিয়েছেন।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৬, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
কারামত-৮: মৃত সম্পর্কে সংবাদ:
“وحدثني من لا أتهمه أن الشيخ رضي الله عنه حين نزل المغل بالشام لأخذ دمشق وغيرها رجف أهلها وخافوا خوفا شديدا، وجاء إليه جماعة منهم وسألوه الدعاء للمسلمين فتوجه إلى الله ثم قال أبشروا فإن الله يأتيكم بالنصر في اليوم الفلاني بعد ثالثة حتى ترون الرؤوس معبأة بعضها فوق بعض.قال الذي حدثني فوالذي نفسي بيده أو كما حلف ما مضى إلا ثلاث مثل قوله حتى رأينا رؤوسهم كما قال الشيخ على ظاهر دمشق معبأة بعضها فوق بعض.”
আমার নিকট বিশ্বস্ত এক ব্যক্তি বর্ণনা করেছেন, যখন মোগলরা দামেশক ও অন্যান্য অন্চল দখলের জন্য শামে আক্রমণ করলো, দামেশকের অধিবাসীরা খুবই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। এসময় একদল মুসলমান শায়খ ইবনে তাইমিয়া রহ. এর নিকট আগমন করলেন এবং তাকে মুসলমানদের জন্য দুয়া করার অনুরোধ করলেন। তিনি আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করলেন। এরপর বললেন, তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ করো, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তিন দিন পর তোমাদেরকে সাহায্য করবেন, এমনকি তোমরা দেখবে যে একটার উপর আরেকটা মাথা স্তুপ হয়ে থাকবে। ঘটনার বর্ণনাকারী বলেন, আল্লাহর শপথ, তৃতীয় দিন দামেশকের প্রবেশ মুখে শত্রুদের মাথাগুলো একটার উপর আরেকটা স্তুপ হয়েছিলো যেমন শায়খ বলেছিলেন।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৬, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
কারামত-৯:
“وحدثني الشيخ الصالح الورع عثمان بن احمد بن عيسى النساج أن الشيخ رضي الله عنه كان يعود المرضى بالبيمارستان بدمشق في كل أسبوع فجاء على عادته فعادهم فوصل إلى شاب منهم فدعا له فشفي سريعا وجاء إلى الشيخ يقصد السلام عليه فلما رآه هش له وأدناه ثم دفع إليه نفقة وقال قد شفاك الله فعاهد الله أن تعجل الرجوع إلى بلدك أيجوز أن تترك زوجتك وبناتك أربعا ضيعة وتقيم هاهنا؟ فقبل يده وقال يا سيدي أنا تائب إلى الله على يدك وقال الفتى وعجبت مما كاشفني به وكنت قد تركتهم بلا نفقة ولم يكن قد عرف بحالي أحد من أهل دمشق.”
শায়খ উসমান ইবনে আহমাদ ইবনে ইসা আন-নাসসাজ আমার নিকট বর্ণনা করেছেন, শায়খ ইবনে তাইমিয়া রহ. দামেশকের বিমারিস্তান নামক জায়গায় প্রত্যেক সপ্তাহে রোগীদের দেখতে আসতেন। অভ্যাস অনুযায়ী তিনি রোগী দেখতে এলেন। তাদের মধ্যে এক যুবককে তিনি দেখলেন এবং তার জন্য দুয়া করলেন। সে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠল। যুবকটি শায়খকে সালাম দেয়ার জন্য এলো। তাকে দেখে শায়খ হাসিমুখে নিকটে বসালেন। তার কাছে কিছু খরচের টাকা-পয়সা দিলেন এবং বলেন, আল্লাহ তায়ালা তোমাকে সুস্থ করেছেন। সুতরাং তুমি আল্লাহর কাছে ওয়াদা করো যে তুমি দ্রুত পরিবারের কাছে ফিরে যাবে। তোমার জন্য কখনও বৈধ হবে যে তোমার স্ত্রী ও চার কন্যাকে ধ্বংসের মুখে রেখে এখানে অবস্থান করবে? যুবকটি বলল, আমি তার হাতে চুমু দিলাম এবং বললাম, শায়খ, আমি আল্লাহর নিকট আপনার হাতে তওবা করছি।
আমি তার কাশফ দেখে বিস্মিত হলাম। বাস্তবেই আমি আমার পরিবারকে সহায়-সম্বলহীন রেখে এসেছিলাম।দামেশকের কেউ আামার পরিবার সম্পর্কে অবগত ছিলো না।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৬, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
এই কারামতগুলো লিখে আবু হাফস আল-বাযযার রহ. লিখেছেন,
و كرامات الشيخ رضي الله عنه كثيرة جدا لا يليق بهذا المختصر أكثر من ذكر هذا القدر منها . ومن أظهر كراماته أنه ما سمع بأحد عاداه أو غض عنه إلا و أبتلي بعدة بلايا غالبها في دينه وهذا ظاهر مشهور لا يحتاج فيه إلي شرح صفته
শায়খ রহ. অনেক কারামত রয়েছে। এই সংক্ষিপ্ত বইয়ে সেগুলো উল্লেখ করা সঙ্গত নয়। তার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ করামত হলো যে কেউ শায়খের বিরোধীতা করেছে বা তার সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক রয়েছে, সে বিভিন্ন ধরনের বালা-মুসীবতে নিপতিত হয়েছে। বেশিরভাগ মুসীবত দীন সম্পর্কীয়। বিষয়গুলো স্পষ্ট ও প্রকাশিত। এগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা অনাবশ্যক।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৮, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
কাশফ ও ইলহাম সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া রহ. এর অনেক কারামত রয়েছে। এ বিষয়ে তার অনেক বক্তব্যও আছে। এগুলোর কিছু কিছু ইবনে তাইমিয়া রহ. এর দৃষ্টিতে তাসাউফ বইয়ে উল্লেখ করেছি। দু:খজনক বিষয় হলো, আমাদের আজকের আলোচনার মূল বিষয় এখনও শুরু করা হয়নি। আজ এখানেই ইতি টানছি। পরবর্তী আলোচনায় গায়েব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করা হবে।
------ ------
[বর্তমানে ইবনে আবিল ইযের আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাগ্রন্থটি ব্যাপকভাবে প্রচারের চেষ্টা করা হচ্ছে। যেমন, সালাফী আলেম আব্দুল্লাহ শাহেদ মাদানী এর বাংলা অনুবাদ করে অনলাইনে প্রচার করছেন। সুতরাং এই কিতাবের বাস্তবতা ও এর লেখক সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাগুলো সুস্পষ্ট করা আবশ্যক। আকিদাতুত ত্বহাবীর উপর দরসের নিয়ত ব্যক্ত করেছিলাম কিছু দিন আগে। উক্ত দরসের প্রয়োজনে আজকের আলোচনাটি লেখা। যারা উক্ত দরস দেখবেন, আশা করি বিষয়টি তাদের উপকারে আসবে। ]
সৌদি আরবের কল্যাণে কাররামিয়াদের ভ্রান্ত দেহবাদী আকিদাগুলো সালাফী মতবাদের মোড়কে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। পেট্র-ডলারের সহায়তায় তারা এক্ষেত্রে অনেকটা অগ্রসর। সালাফীদের ভ্রান্ত আকিদা সম্পর্কে বেশ কিছু প্রবন্ধ লেখার সুযোগ হয়েছে আল-হামদুলিল্লাহ। আমাদের আইডিয়ার ওয়েবসাইটে লেখাগুলো পাবেন। সালাফী মতবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে থাকে। এর মধ্যে একটি বিশেষ কৌশল হল, বিভিন্ন ইমামের আকিদার কিতাব ব্যাখ্যার নামে নিজেদের ভ্রান্ত আকিদা ছড়িয়ে দেয়া। উদাহরণ হিসেবে ইমাম ত্বহাবীর আকিদাতুত ত্বহাবীর কথা বলা যায়। একটু খোজ নিলে দেখবেন, প্রায় প্রত্যেক সালাফী শায়খই আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখেছেন, কেউ অডিও বা ভিডিও লেকচার দিয়েছেন। অন্তত বিশ-পজিশজন বা এর চেয়ে বেশি সালাফী শায়খের ব্যাখ্যা পাবেন। একটি মৌলিক প্রশ্ন হল, এসব সালাফী আলেমরা কি ইমাম ত্বহাবীর আকিদা পোষণ করেন? ধ্রুব সত্য হল, ইমাম ত্বহাবীর আকিদার সাথে এদের আকিদার দূরতম কোন সম্পর্ক নেই। ইমাম ত্বহাবী রহ. এর আকিদার ও এদের আকিদার মাঝে আসমান-জমিনের ফারাক। আরেকটি প্রশ্ন মনে উকি দেয়, এরা যেহেতু ইমাম ত্বাহাবীর আকিদা পোষণ করে না, তাহলে এর ব্যাখ্যা করে কেন? সহজ উত্তর হল, ইমাম ত্বহাবীর আকিদা প্রচারের ছদ্মাবরণে নিজেদের ভ্রান্ত আকিদা প্রচার। এদের যে কোন একটা ব্যাখ্য পড়লেই এই বাস্তবতা উপলব্ধি করবেন।
সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে ইমাম ত্বহাবী রহ. এর আকিদাকে বিকৃত করার লক্ষ্যে লিখিত একটি বেনামী ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৩৪৯ হিজরীতে। বে-নামী ব্যাখ্যা এজন্য বললাম, উক্ত ব্যাখ্যার উপর লেখকের নাম ছিল না। আর প্রশাকগণ নিশ্চিত ছিলেন না যে, ব্যাখ্যাগ্রন্থটি মূলত: কার। পরবর্তীতে তারা তত্ব-তালাশ করে উদ্ধার করেন, এটি ইবনে আবিল ইয আল-হানাফীর লেখা। বর্তমানে এটি ইবনে আবিল ইযের ব্যাখ্যা হিসেবে প্রচার করা হয়। আমাদের আলোচ্য বিষয় শিরোনাম থেকে কিছুটা স্পষ্ট। তবে দু’টি বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করার চেষ্টা করব। ১. ইবনে আবিল ইযের নামে প্রচারিত আকিদা কি আসলেই ইবনে আবিল ইযের লেখা?২. ইবনে আবিল ইযকে হানাফী হিসেবে প্রচার করা হয়। তিনি কি হানাফী ছিলেন না কি দেহবাদী আকিদায় বিশ্বাসী হাশাবী ছিলেন?
প্রচলিত আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যা কি ইবনে আবিল ইযের?
বিষয়টি বোঝার জন্য ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রকাশের ইতিহাসের দিকে ফিরে যেতে হবে। আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যাগ্রন্থটি ১৩৪৯ হিজরীতে মক্কায় সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়।
এই প্রকাশনায় কিতাবের উপর লেখকের কোন নাম ছিল না। বরং প্রকাশকরা লেখেন,
راجعنا ما في أيدينا من كتب التراجم والفنون، فلم نجد ما يمكننا معه الجزم بنسبته لشخص بعينه، وإنا نثبت هنا أسماء شارحي هذه العقيدة الذين عدهم صاحب كشف الظنون وهم سبعة ……. ومنهم صدر الدين علي بن محمد بن أبي العز الأذرعي الدمشقي الحنفي المتوفى سنة 746هـ وهو الذي يترجح الظن أنه الشارح” আমাদের কাছে বিদ্যমান বিভিন্ন জীবনীগ্রন্থ ও রিজালের কিতাবে আমরা অনুসন্ধান চালিয়েছি। আমরা এমন কোন তথ্য পাইনি, যার আলোকে সুনিশ্চিতভাবে ব্যাখ্যাগ্রন্থটিকে সুনির্দিষ্ট কোন লেখকের দিকে সম্পৃক্ত করা সম্ভব। কাশফুজ জুনুন এর লেখকের বক্তব্য অনুযায়ী আমরা এখানে আকিদাত্ব ত্বহাবীর সমস্ত ব্যাখ্যাকারের নাম উল্লেখ করছি। তারা হলেন সাতজন…….। এদের মাঝে একজন ব্যাখ্যাকার হলেন, সদরুদ্দিন আলী ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবিল ইয হানাফী (মৃত:৭৪৬ হি:)। আমাদের বিশেষ ধারণা হল, সাতজন ব্যাখ্যাকারের মাঝে তিনি হলেন আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাকার। “
এখানে প্রবল ধারণা হিসেবে সদরুদ্দিন আলী ইবনে মুহাম্মাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যার মৃত্যু তারিখ হল, ৭৪৬ হিজরী। আর বর্তমানে প্রচারিত ব্যাখ্যাকার হলেন, আলী ইবনে আলী ইবনে আবিল ইয। যার মৃত্যু তারিখ হল, ৭৯২ হিজরী। এখানে প্রবল ধারণা হিসেবে যার কথা বলা হয়েছে, তিনি হলেন বর্তমানে প্রচারিত লেখকের পিতা। ছেলে আর পিতা কখনও এক হতে পারে না। উভয়ের মৃত্যু তারিখ থেকেও বিষয়টি স্পষ্ট। মোটকথা, ব্যাখ্যাগ্রন্থটি কার সেটা সুনিশ্চিতভাবে বলার মত কোন তথ্য তখনকার উলামায়ে কেরাম পাননি। পরবর্তীতে সৌদি আরবের শায়খগণ বিখ্যাত আলেম আহমাদ শাকেরকে এটি তাহকীক করার অনুরোধ করেন। শায়খ আহমাদ শাকের পরবর্তীতে এটি তাহকীক করে প্রকাশ করেন।
তিনি এর ভূমিকায় লেখেন, ” এ কিতাবের যে মাখতুতা বা হস্তলিপি আমি পেয়েছি, সেখানে মূল লেখকের নেই। সুতরাং কিতাবের লেখক আসলে কে সেটা জানা সম্ভব হয়নি। ”
শায়খ আহমাদ শাকের তার ভূমিকায় কয়েকবার বলেছেন যে, তিনি এই কিতাবের নির্ভরযোগ্য কোন মাখতুতা বা হস্তলিপি পাননি।
তিনি তার সাধ্য অনুযায়ী এটি তাহকীক করার চেষ্টা করেছেন। শায়খ আহমাদ শাকের আশা ব্যক্ত করেছেন, তিনি যদি নির্ভরযোগ্য কোন হস্তলিপি পান, তাহলে পরবর্তীতে এটি সংশোধনের চেষ্টা করবেন।
শায়খ আহমাদ শাকের বলেন,
ولكني لا أزال أرى هذه الطبعة مؤقتة أيضا، حتى يوفقنا الله إلى أصل محفوظ للشرح صحيح، يكون عمدة في التصحيح فنعيد طبعه
“আমি এখনও মনে করি, এই সংস্করণ অস্থায়ী। আল্লাহ তায়ালা যদি নির্ভরযোগ্য বিশুদ্ধ কোন হস্তলিপি মিলিয়ে দেন, তাহলে এটি সংশোধন করে নতুনভাবে প্রকাশ করার করব। শায়খ আহমাদ শাকের আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. [মৃত: ১২০৫ হি:] এর একটি বক্তব্য পান ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিনে। সেখানে মোর্তজা যাবিদি রহ. ব্যাখ্যাকারের নাম লিখেছেন, আলী ইবনে আলী ইবনে মুহাম্মাদ আল-গাজ্জী আল-হানাফী। মোর্তজা যাবিদি রহ. এর উদ্ধৃতিতে লেখকের সঠিক পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি।
শায়খ আহমাদ শাকের বলেন, মোর্তজা যাবিদি রহ. লেখকের নামের নিসবতে ভুল করেছেন। তিনি লিখেছেন, আলী ইবনে আলী আল-গাজ্জী, বাস্তবে হওয়ার কথা ছিল, আলী ইবনে আলী ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী। মোটকথা, শায়খ আহমাদ শাকেরের সামনে মোর্তজা যাবিদি রহ. এর উদ্ধৃতি ছিল, বেশ কয়েকটি মাখতুতা ছিল এরপরেও ব্যাখ্যাকার সম্পর্কে সুনিশ্চিতভাবে বলেননিন যে, অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে, উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের লেখক ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী। শায়খ আহমাদ শাকের মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্যের আলোকে তার ধারণা অনুযায়ী কিতাবে লেখকের নাম লিখেছেন, আলী ইবনে আলী ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী। পরবর্তীতে মাকতাবাতুল ইসলামী থেকে শায়খ আলবানীর তাহকীকে ব্যাখ্যাগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। সেখানে কিছু মাখতুতা বা হস্তলিপি এর চিত্র দেয়া হয়েছে। এসকল হস্তলিপিতে স্পষ্টভাবে লেখকের নাম লেখা হয়েছে, আলী ইবনে মুহাম্মাদ। যার মৃত্যু তারিখ, ৭৪৬ হি:। সুতরাং মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্য অনুযায়ী, লেখকের নাম হওয়ার কথা ছিল, আলী ইবনে আলী আল-গাজ্জী। মাকতাবাতুল ইসলামী এর মাখতুতা অনুযায়ী, লেখকের নাম আলী ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবিল ইয। সুতরাং একথা সুনিশ্চিতভাবে বলার অবকাশ নেই যে, উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের প্রকৃত লেখক কে। এরপরেও শায়খ আলবানী ও যুহাইর আশ-শাবীশ দাবী করেন, সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হল, উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের লেখক ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী।
শায়খ যুহাইর আশ-শাবীস নবম সংস্করণের ভূমিকায় ( পৃ.৯) লিখেছেন,
وأما نسختنا فقد كان اسم مؤلفها مثبتا على الورقة الأولى منها، إلا أن بعض الأيدي قد لعبت فيه بالمحو والكتابة أكثر من مرة، وأخيرا أثبت عليه ما أثبته الشيخ أحمد شاكرঅর্থ: আমাদের মূল হস্তলিপিতে লেখকের নাম প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা ছিল। তবে অজ্ঞাত কেউ উক্ত নাম কয়েকবার ঘষা-মাজা করে নতুনভাবে লিখেছে। অবশেষে আমি শায়খ আহমাদ শাকেরের তথ্য অনুযায়ী লেখকের নাম উল্লেখ করেছি।মোটকথা, এই ব্যাখ্যাগ্রন্থের মূল হস্তলিপিতে লেখকের নাম উল্লেখ নেই। পরবর্তীতে বিভিন্ন ঘষা-মাজার মাধ্যমে অজ্ঞাত কেউ হস্তলিপিতে লেখকের নাম সংযুক্ত করেছে। ঘষা-মাজা করে নাম সংযুক্ত করার পরও বর্তমানে প্রচলিত লেখকের নাম উক্ত হস্তলিপিতে নেই। বরং প্রচলিত লেখকের পিতার নাম ও তার মৃত্যু তারিখ দেয়া রয়েছে।
চূড়ান্ত কথা:
ইবনে আবিল ইয এধরণের ব্যাখ্যাগ্রন্থ লেখাটা অসম্ভব নয়। প্রবল ধারণা মতে হয়ত তিনি এটি লিখেছেন। কিন্তু ইবনে ইয এর লেখক হওয়ার ব্যাপারে অকাট্য কোন প্রমাণ কারও কাছে নেই, যার আলোকে নি:সন্দেহে বলা যাবে, এটি ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী লিখেছেন। ইবনে আবিল ইয আল-হানাফীর জীবনী থেকে একটা ধারণা সৃষ্টি হয়, হয়ত তিনি এটি লিখেছেন। আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. এর উদ্ধৃতি থেকে হয়ত ধারণাটি আরেকটু মজবুত হয়। কিন্তু এটা সুনিশ্চিত বা অকাট্য কোন প্রমাণ বলার সুযোগ নেই। উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের লেখক ইবনে আবিল ইয হলেও আমাদের কোন আপত্তি নেই। না হলেও এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই। কিতাবটি ছেলে লিখেছে না কি তার পিতা লিখেছে সেটাও মৌলিক কোন বিষয় নয়।
আমাদের নিকট মূল বিবেচ্য বিষয় হল, ইবনে আবিল ইযকে হানাফী হিসেবে প্রচার করা হয়। সেই সাথে এটাও বোঝানো হয় যে, তিনি হানাফীদের আকিদার প্রতিনিধত্ব করেন। অন্যান্য হানাফীগণ তার বিরোধীতা করে মূলত: হানাফীদের মৌলিক আকিদার বিরোধিতা করে থাকে।
আমাদের সামনে মৌলিক কয়েকটি প্রশ্ন দেখা দিয়েছে,
১. ইবনে আবিল ইয বাস্তবেই কি হানাফী ছিলেন?
২. তিনি আদৌ কি হানাফী মাজহাবের সুপ্রতিষ্ঠিত আকিদার অনুসারী ছিলেন?৩. তার লেখা ব্যাখ্যাগ্রন্থ ইমাম ত্বহাবী বা হানাফী মাজহাবের মৌলিক আকিদার প্রতিনিধিত্ব করে কি?৪. ইবনে আবিল ইযের আকিদা হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমদের নিকট নির্ভরযোগ্য কি?
৫. ইবনে আবিল ইযকে হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণ নির্ভরযোগ্য আলেম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন কি?
৬. হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণ ইবনে আবিল ইযের আকিদার সাথে সহমত পোষণ করেন না কি তার প্রবল বিরোধীতা করেন?
৭. হানাফী মাজহাবের উলামায়ে কেরামের জীবনীর উপর বিভিন্ন গ্রন্থ লেখা হয়েছে। এসকল কিতাবে হানাফী আলেম হিসেবে তার জীবনী বা নির্ভরযোগ্য আলেম হিসেবে কোথাও তস্বীকৃতি দেয়া হয়েছে কি?আমরা ইনশাআল্লাহ প্রত্যেকটি বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করব।
ইবনে আবিল ইযের মাজহাব:
শরহে আকিদাতু ত্বহাবীর তাহকীক করেছেন, শায়খ শুয়াইব আরনাউত ও শায়খ আব্দুল্লাহ তুরকী। তারা উক্ত তাহকীকে ইবনে আবিল ইযের জীবনী আলোচনা করেছেন। তার জীবনী আলোচনা করতে গিয়ে তারা লিখেছেন, ইবনে আবিল ইযকে হানাফী মাজহাবের দিকে সম্পৃক্ত করা হয়। তবে বাস্তবে তিনি নিজের গর্দানকে তাকলীদের (মাজহাব অনুসরণ) বন্ধন থেকে মুক্ত করেন। শায়খ শুয়াইব আরনাউত ও শায়খ আব্দুল্লাহ তুরকীর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ইবনে আবিল ইয একজন গাইরে মুকাল্লিদ, লা-মাজহাবী বা যাহেরী ছিল।
ইবনে আবিল ইয পারিবারিকভাবে হানাফী ছিল। যেমন শায়খ আলবানী পারিবারিকভাবে হানাফী ছিল। কিন্তু কেউ হানাফী পরিবারে জন্মগ্রহণ করলে, কিংবা হানাফী মাদ্রাসায় পড়লে বা পড়ালে সে হানাফী হয়ে যায় না। আমাদের দেশের অধিকাংশ লা-মাজহাবী হানাফী পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও তারা গাইরে মুকাল্লিদ। একইভাবে বর্তমানে আহলে হাদীসদের অধিকাংশ শায়খ হানাফী মাজহাবের মাদ্রাসায় পড়া-লেখা করেছে, কিন্তু তারা হানাফী নয়। সুতরাং কারও হানাফী হওয়াটা তার পরিবার, পিতা-মাতা বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করে না। ইবনে আবিল ইয জন্মগতভাবে হানাফী হলেও বাস্তবে সে হানাফী নয়। বরং ইবনে আবিল ইয একজন গাইরে মুকাল্লিদ বা লা-মাজহাবী।সুতরাং তাকে হানাফী হিসেবে প্রচার করে তাকে হানাফী মাজহাব বা আকিদার প্রতিনিধি হিসেবে প্রকাশ করা একটি মারাত্মক ভুল।
যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেই যে, ইবনে আবিল ইয হানাফী ফিকহের অনুসারী ছিল, কারণ সে হানাফী মাজহাবের মাদ্রাসায় শিক্ষতা করেছে, তাহলে এটি কখনও বলা সম্ভব নয় যে, সে আকিদার দিক থেকেও হানাফী ছিলা। মু’তাজিলা সম্প্রদায়ের অনেকেই হানাফী মাজহাবের অনুসারী ছিল, কিন্তু তাদের কাউকে হানাফী বলা হয় না। একইভাবে কাররামিয়াদের অনেকেই হানাফী মাজহাব অনুসরণ করত। কিন্তু তাদেরকেও হানাফী বলা হয় না। ফিকহের দিক থেকে কেউ হানাফী ফিকহ অনুসরণ করলেই তাকে হানাফী হিসেবে পরিচয় দেয়া হয় না। কারণ হানাফী হিসেবে কারও পরিচিতি এটা প্রমাণ করে যে, সে আকিদা ও ফিকহ উভয় ক্ষেত্রে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অন্তর্ভূক্ত। কেউ যদি ফিকহের ক্ষেত্রে হানাফী মাজহাব অনুসরণ করে, কিন্তু আকিদার ক্ষেত্রে আহলে সু্ন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত আকিদা পোষণ করে তাকে হানাফী বলা হয় না। বরং আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত আকিদার দিকে তাকে সম্পৃক্ত করা হয়। কাররামিয়া মতবাদের অনুসারী কারও নামের শেষে হানাফী লাগিয়ে দিয়ে আকিদা ও ফিকহে তাকে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অন্তর্ভূক্ত করার অপচেষ্টা কেউ করলে সেটি অবশ্যই বাস্তবতা বিরোধী। সুতরাং ফিকহ ও আকিদা উভয় ক্ষেত্রে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত ইবনে আবিল ইযকে কীভাবে হানাফী হিসেবে পরিচয় দেয়া হয়? তার বাহ্যিক অবস্থা বিবেচনা করে হানাফী লিখলেও তাকে যদি কেউ হানাফী ফিকহ বা আকিদার প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন করে, তাহলে অবশ্যই আমরা বলব, প্রকৃতপক্ষে ইবনে আবিল ইয ফিকহ ও আকিদা কোন ক্ষেত্রেই হানাফী ছিল না। বরং সে কাররামিয়াদের অনুসারী হাশাবী বা দেহবাদী আকিদায় বিশ্বাসী ছিল। ইবনে আবিল ইযের যেসকল কিতাব তার দিকে সম্পৃক্ত করা হয়, তার প্রত্যেকটি সে হানাফী মাজহাবের বিরুদ্ধে লিখেছে। হানাফী মাজহাবের পক্ষে তার বিশেষ কোন খেদমত নেই।
ইবনে আবিল ইযের গাইরে মুকাল্লিদ হওয়ার আরেকটি প্রমাণ হল, তার একটি কিতাব বর্তমানের আহলে লা-মাজহাবীরা প্রচার করে থাকে। আহলে হাদীস আলেম আতাউল্লাহ হানীফ ইবনে আবিল ইযের “আল-ইত্তেবা” কিতাবটি তাহকীক করে প্রকাশ করেছে। পরবর্তীতে আবু সুহাইব আসিম ইবনে আব্দুল্লাহ আল-কারইউতী এটি তাহকীক করেছে। আবু সুহাইব এই কিতাবের ভূমিকায় হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেম আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. ও আল্লামা যফর আহমাদ উসমানী রহ. এর বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছে এবং এসমস্ত বিখ্যাত আলেমদের বিরুদ্ধে ইবনে আবিল ইযের বক্তব্য উপস্থাপন করেছে। যেখানে ইবনে আবিল ইয সুনিদিষ্ট একটি মাজহাবের অনুসারীকে শিয়াদের সাথে তুলনা করেছে। নাউযুবিল্লাহ। ইবনে আবিল ইযের অবস্থা থেকে বাংলা ভাষার প্রসিদ্ধ একটি প্রবাদবাক্য মনে পড়ে গেল। “মার চেয়ে মাসির দরদ বেশি” ।ইবনে আবিল ইযের প্রতি সালাফী ও আহলে হাদীসদের অতিশয় আগ্রহ এটিই প্রমাণ করে। বর্তমানের সালাফীরা হানাফী মাজহাবের উলামায়ে কেরামকে তাদের আকিদার বিরোধী হওয়ার কারণে কাফের, বিদযাতী, জাহমী, মুয়াত্তিলা ইত্যাদি আখ্যায়িত করে। এ বিষয়ে অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। হানাফী মাজহাবের অধিকাংশ আলেম যাদের কাছে কাফের ও বিদয়াতী, তারাই ইবনে আবিল ইযের আকিদা প্রচার করছে। আবার উপমহাদেশের লা-মাজহাবীরা মাজহাবের অনুসারীদেরকে মুশরিক বলে বিশ্বাস করে, অথচ তারাই আবার ইবনে আবিল ইযের কিতাব প্রকাশ ও প্রচার করছে। ইবনে আবিল ইয আসলেই যদি হানাফী হত, তাহলে হানাফীদেরকে যারা কাফের-মুশরিক আখ্যা দিচ্ছে, তারা কেন তার কিতাব নিয়ে এত মাতামাতি করে?
ইবনে আবিল ইয সম্পর্কে হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণের বক্তব্য:
মোল্লা আলী কারী রহ. এর বক্তব্য:
মোল্লা আলী কারী রহ. শরহে ফিকহুল আকবারে আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যাকার সম্পর্কে লিখেছেন,
والحاصل ان الشارح يقول بعلو المكان مع نفي التشبيه وتبع فيه طائفة من أهل البدعة
মোটকথা, আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যাকার তাশবীহমুক্ত অবস্থায় আল্লাহ তায়ালা স্থানগতভাবে উপরের দিকে রয়েছেন বলে বিশ্বাস করে। এক্ষেত্রে সে একদল বিদয়াতীর অনুসরণ করেছে। তিনি আরও বলেন,
و من الغريب أنه إستدل على مذهبه الباطل برفع الأيدي في الدعاء إلى السماء
অর্থ: আশ্চর্যের বিষয় হল, সে তার ভ্রান্ত মতবাদ প্রমাণ করতে গিয়ে দুয়ার সময় হাত উপরের দিকে উঠানোর দলিল দিয়েছে। (শরহুল ফিকহিল আকবার, পৃ.১৭২. আল-ইলিময়া)মোল্লা আলী কারী রহ. এর বক্তব্য থেকে দু’টি বিষয় স্পষ্ট। তিনি ইবনে আবিল ইযকে বিদয়াতীদের অনুসারী বলেছেন। এবং তার মতবাদকে বাতিল বা ভ্রান্ত মতবাদ আখ্যায়িত করেছেন।
আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্য:
আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিনে ইবনে আবিল ইয সম্পর্কে লিখেছেন,
“ولما تأملته حق التأمل؛ وجدته كلامًا مخالفًا لأصول مذهب إمامه!! وهو في الحقيقة كالرد على أئمة السنة، كأنه تكلم بلسان المخالفين، وجازف وتجاوز عن الحدود، حتى شبه قول أهل السنة بقول النصارى! فليتنبه لذلك”.
অর্থ: আমি তার (ইবনে আবিল ইযের) বক্তব্য সম্পর্কে পরিপূর্ণ চিন্তা-ভাবনা করে দেখেছি, তার বক্তব্য তার ইমামের মাজহাবের মৌলিক নীতিমালার সম্পূর্ণ বিরোধী। বরং প্রকৃতপক্ষে তার বক্তব্য যেন আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের ইমামগণের বক্তব্য খন্ডনে লিখিত। তার বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয়, সে যেন আহলে সুন্নতের ইমামগণের সাথে প্রতিপক্ষ হিসেবে কথা বলেছে। সে মারাত্মক বিকৃতির শিকার হয়েছে এবং সীমা অতিক্রম করেছে। এমনকি সে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের ইমামগণের বক্তব্যকে খ্রিষ্টানদের বক্তব্যের সাথে তুলনা করেছে। সুতরাং এ বিষয় সতর্ক থেক। [ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিন, খ.২, পৃ.১৪৬]
আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্য থেকে যেসকল বিষয় স্পষ্ট:
১. ইবনে আবিল ইয হানাফী মাজহাবের মৌলিক নীতিমালা অনুসরণ করত না।
২. তার লেখনী মূলত: হানাফী মাজহাব ও আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের বক্তব্য খন্ডনের উদ্দেশ্যে লিখিত।৩. হানাফী মাজহাব ও আহলে সুন্নতের উলামায়ে কেরামের সাথে যেন সে প্রতিপক্ষ হিসেবে কথা বলেছে।
৪.সে মারাত্মক প্রগলভতার শিকার হয়ে সীমা অতিক্রম করেছে।
৫. আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের উলামায়ে কেরামের বক্তব্যকে খ্রিষ্টানদের বক্তব্যের সাথে তুলনা করেছে।
৬. আল্লামা যাবিদি রহ. তার এসব বক্তব্যের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেছেন।
আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. এর বক্তব্য:
হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত ইমাম আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাকার সম্পর্কে বলেন,
وطبع شرح لمجهول ينسب إلى المذهب الحنفي زورا ينادي صنع يده بأنه جاهل بهذا الفن وأنه حشوي مختل العيار
“আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যা হিসেবে একজন অজ্ঞাত ব্যক্তির একটি ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। যাকে বানোয়াটী করে হানাফী মাজহাবের দিকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এ লোকের লেখনী দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করে যে সে আকিদা সম্পর্কে অজ্ঞ। সে একজন হাশাবী বা দেহবাদী এবং মারাত্মক বিচ্যুতির শিকার। “[আল-হাবী ফি সিরাতিল ইমামিত ত্বহাবী, পৃ. ৩৮]আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. এর বক্তব্য থেকে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট। প্রথমত: ইবনে আবিল ইযকে হানাফী মাজহাবের দিকে সম্পৃক্ত করা একটি বানোয়াট বা মিথ্যা। বাস্তবে সে হানাফী ছিল না। দ্বিতীয়ত: ইবনে আবিল ইয আকিদা বিষয়ে জাহেল বা অজ্ঞ ছিল এবং সে একজন মুজাসসিমা বা দেহবাদী আকিদার অনুসারী হাশাবী ছিল। আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. এর বক্তব্য অনুযায়ী আমরা ইবনে আবিল ইযকে হানাফী না বলে দেহবাদী আকিদার অনুসারী হাশাবী বলতে পারি।
ইবনে আবিল ইযের সম-সাময়িক আলেমগণের বিরোধীতা:ইবনে আবিল ইযের ভ্রান্ত কিছু বক্তব্য প্রকাশিত হওয়ার তখনকার বিখ্যাত আলেমগণ তার প্রতিবাদ করেন। বিশেষভাবে অন্যান্য তিন মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণের সাথে হানাফী মাজহাবের আলেমগণও তার প্রতিবাদ করেন।
আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহ. তার ‘ইম্বাউল গুমর বি আবনায়িল উমর’ কিতাবে লিখেছেন,
وأن العلماء بالديار المصرية خصوصا أهل مذهبة من الحنفية أنكرواذلك عليه
অর্থ: মিশরের আলেমগণ বিশেষভাবে তার মাজহাব তথা হানাফী মাজহাবের উলামায়ে কেরাম তার বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন। [ইমবাউল গুমর, খ.২, পৃ.৯৬]
যেসব উলামায়ে কেরাম ইবনে আবিল ইযের বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন, এদের মাঝে বিখ্যাত কিছু আলেমের নাম উল্লেখ করেছেন ইবনে হাজার আসকালানী রহ.। যেমন, যাইনুদ্দীন ইবনে রজব রহ, তকীউদ্দীন ইবনে মুফলিহ রহ. শরফুদ্দীন ইবনে গাজ্জী রহ. ।
বর্তমানে সালাফীরা ইবনে আবিল ইযের আরেকটি কিতাব প্রকাশ করেছে। কিতাবের নাম হল, আত-তাম্বীহ আলা মুশকিলাতিল হিদায়াহ। সালাফী আলেমরা ইবনে আবিল ইযের রচনা হিসেবে এটি প্রকাশ করেছে। যদিও কিতাবটি ইবনে আবিল ইযের নাকি তার দাদার এটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সালাফীদের বক্তব্য অনুযায়ী কিতাবটি যদি ইবনে আবিল ইযের হয়, তাহলে তার সম্পর্কে হানাফী মাজহাবের আরও কিছু উলামায়ে কেরামের বক্তব্য শুনুন।
ইমাম সাখাবী রহ. তার আজ-জাওউল লামে কিতাবে লিখেছেন, হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত ইমাম কাসেম ইবনে কুতলুবুগা ইবনে হেদায়া কিতাবের উপর ইবনুল ইযের অভিযোগ খন্ডন করে কিতাব লিখেছেন। “صنّف “أجوبةً عن اعتراضات ابن العزّ على الهداية”[আজ-জাওউল লামে, খ.৬, পৃ.১৮৭]
সালাফীরা ইবনে আবিল ইযের উক্ত কিতাবকে হেদায়ার ব্যাখ্যা হিসেবে প্রচারের চেষ্টা করলেও এটি মূলত: হেদায়া কিতাবের উপর তার অভিযোগ সংকলন। একারণে আল্লামা কাসেম ইবনে কুতলুবুগা তার অভিযোগ খন্ডন করেছেন। একইভাবে আল-বাহরুর রায়েকে রয়েছে ফাতহুল কাদীরে আল্লামা ইবনুল হুমাম ইবনুল ইযের বক্তব্য খন্ডন করেছেন।
وَقَدْ أَطَالَ فِي فَتْحِ الْقَدِيرِ فِي بَيَانِهِ إطَالَةً حَسَنَةً وَتَعَرَّضَ لِلرَّدِّ عَلَى ابْنِ الْعِزِّ، وَلَسْنَا بِصَدَدِ ذَلِكَ
[আল-বাহরুর রায়েক, বাবুল ইয়ামীন ফিল আকলি ওয়াশ শুরব]
সালাফীদের বক্তব্য অনুযায়ী আত-তাম্বীহ আলা শরহিল হেদায়া কিতাবটি যদি আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাকার ইবনে আবিল ইযের হয়, তাহলে তার বক্তব্য আল্লামা হাসকাফী ও আল্লামা ইবনে আবিদীন খন্ডন করেছেন। তার বক্তব্যকে গরীব (আশ্চর্যজনক) আখ্যা দিয়েছেন। বিস্তারিত,
“قال (ابن العز!): فحينئذ ينقض الوضوء، وهو فرع غريب وتخريج ظاهر.قال المصنف: ولظهوره عوّلنا عليه.قلت: قال شيخنا الرملي حفظه الله تعالى: كيف يعول عليه وهو مع غرابته لا يشهد له رواية ولا دراية، أما الاولى فظاهر إذا لم يرو عن أحد ممن يعتمد عليه، وأما الثانية فلعدم تسليم المقدمة الاولى ويشهد لبطلانها مسألة الجدي إذا غذي بلبن الخنزير فقد عللوا حل أكله بصيرورته مستهلكا لا يبقى له أثر، فكذلك نقول في عرق مدمن الخمر، ويكفينا في ضعفه غرابته”.[রদ্দুল মুহতার, খ.৬, পৃ.১৪৬-১৪৭]
আকিদার ক্ষেত্রে ইবনে আবিল ইযের বিচ্যুতি সুস্পষ্ট। অধিকাংশ বিষয়ে সে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত আকিদা পোষণ করে। এবং কাররামিয়া ও মুজাসসিমাদের ভ্রান্ত বক্তব্য প্রচার করেছে। আকিদাতুত ত্বহাবীর সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা ভিডিও আকারে প্রকাশের নিয়ত রয়েছে। আমাদের আলোচনায় ইবনে আবিল ইযের ভ্রান্ত মতবাদগুলি বিস্তারিত উল্লেখ করা হবে ইনশাআল্লাহ। এখানে সংক্ষেপে দু’একটি বিষয় উল্লেখ করা মুনাসিব মনে করছি। এসকল বিষয়ের কয়েকটি কুফুরী পর্যায়ের। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করেন।
১. কিছু সৃষ্টি কাদীম বা অবিনশ্বর। অনাদী থেকেই বিদ্যমান। এটি তাসালসুলুল হাওয়াদিস নামে পরিচিত। [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.১২৯, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]
২. আল্লাহ তায়ালার হদ বা সীমা রয়েছে। [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.২১৯, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]
৩. আল্লাহর সত্তার মাঝে নশ্বর বিষয় সৃষ্টি হয়। [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.১৭৭, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]
৪. আল্লাহর বক্তব্যের অক্ষর ও শব্দ রয়েছে। [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.১৬৯, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]
৫. আল্লাহ তায়ালা স্থানগতভাবে উপরের দিকে রয়েছেন। অর্থাৎ আল্লাহর দিক রয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে দেহবাদী আকিদার ভ্রান্তি থেকে হেফাজত করুন। আমীন।
------ ------
ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের মাঝে সর্বপ্রধান বিষয় হল, আল্লাহর তাওহীদ তথা একত্বের উপর ঈমান আনয়ন করা। এই বিশ্বাস করা যে, সৃষ্টা হিসেবে তিনি একক, গুণাবলীর বিবেচনায় তিনি একক এবং উপাসনার যোগ্য একমাত্র তিনিই। পবিত্র কুরআন ও রাসূল (সঃ) এর সমস্ত হাদীস তাওহীদ তথা আল্লাহর এককত্বের উপর ভিত্তি করেই আবর্তিত। কোন বিষয়ে আল্লাহর সমকক্ষ বা অংশীদার নেই, এটিই এ বিশ্বাসের মূলমন্ত্র। পবিত্র কুরআনের ১১২ নং সূরায় এ বিষয়টি সুষ্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষিত হয়েছে। সে প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর অস্তিত্ব অনুভব করে এবং আল্লাহর এককত্বের স্বাক্ষর প্রদান করে।
আমরা এখানে আল্লাহর এককত্বের উপর পাঁচটি যুক্তি উপস্থাপন করব।
কুরআন স্পষ্টভাষায় জিজ্ঞাসা করেছে, এই মহাবিশ্ব কি এমনিতেই সৃষ্টি হয়েছে? এর উত্তর খুবই সহজ ও স্পষ্ট। কেননা ভৌত পদার্থবিদ্যা এবং সকল দর্শন এবিষয়ে একমত যে, যে বস্তু অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এসেছে, তার অস্তিত্বের পিছে একটি কজ বা কারণ রয়েছে। আর মহাবিশ্ব যেহেতু অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এসেছে এজন্য এর পিছে একটি কারণ বা কজ রয়েছে। মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পিছে একটি সামগ্রিক কজ বা কারণ থাকাটাই যুক্তিযুক্ত। অসীম সংখ্যক কারণ থাকাটা অসম্ভব। কেননা বাস্তবে কখনও অসীম কোন কিছু থেকে আমরা কোন ফলাফল লাভ করি না।
উদাহরণ হিসেবে নীচের দু’টি বিষয় লক্ষ্য করুণ-
১. কোন কক্ষে যদি অসীম সংখ্যক মানুষ থাকে এবং সেখান থেকে যদি আমি দু’জনকে বাদ দেই, তাহলে কতজন থাকবে? আপনি উত্তর দিবেন, অসীম বিয়োগ দুই। অর্থাৎ অসীম থেকে দু’জনকে বাদ দিলে যা থাকে। এর দ্বারা বাস্তবে কোন অর্থ বোঝায় কি? অসীম থেকে যদি দুজনকে বাদ দেয়া হলেও কক্ষে অসীম সংখ্যক মানুষই থেকে যাবে। বাস্তবে এটি বিশেষ কোন অর্থ প্রদান করে না। আপনাকে যদি কক্ষের অসীম সংখ্যক লোক গণনা করতে বলা হয়, আপনার পক্ষে তা গণনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু লোকসংখ্যা যদি অসীম থেকে সামান্য কমিয়ে গণনা করতে বলা হয়, তবুও আপনার পক্ষে তা গণনা করা সম্ভব নয়। এর অর্থ হল, বাস্তব জীবনে অসীম সংখ্যা থেকে বিশেষ অর্থ বোঝা সম্ভব নয়।
২. মনে করুন, আমি একজন সৈনিক। আমি একটা শত্রুকে গুলি করতে চাই। আমার গুলি করার জন্য আমার পেছনের সৈনিকের অনুমতি নেয়া প্রয়োজন। আমার পিছের সৈনিকের জন্য আবার তার পেছনের সৈনিকের অনুমতি প্রয়োজন। এভাবে এ ধারা যদি চলতে থাকে এবং আমার গুলি করার জন্য অসীম সংখ্যক সৈনিকের অনুমতির প্রয়োজন হয়, তবে আমি কি আদৌ শত্রুকে গুলি করতে পারব? উত্তর খুবই সহজ ও স্বাভাবিক। একইভাবে আমি মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পিছে যদি অসীম সংখ্যক কারণ ধরে নেই, তবে আদৌ মহাবিশ্বের অস্তিত্ব সম্ভব হত না। এবং কখনও এটি অস্তিত্বে আসত না। সুতরাং মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পিছে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বাধীন ও একক কারণ থাকাটাই যুক্তিসঙ্গত।
আপনি এ যুক্তি দেখাতে পারেন যে, উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্য তথা স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বাধীন একাধিক কারণ একই সাথে ক্রিয়াশীল হলে সমস্যা কোথায়?
আমি বলব, আপনার এ যুক্তিটা খুবই দুর্বল প্রকৃতির। চতুর্দশ শতাব্দীর দার্শনিক অকহ্যাম রেজর এর তত্ত্বের মাধ্যমে আপনার এ যুক্তির অসারতা প্রমাণিত হয়। অকহ্যাম রেজরের নীতি হল, প্রয়োজন ছাড়া বহু সংখ্যার ব্যবহার অনুচিৎ। আরেকটু সহজ করে বললে এভাবে বলা যায়, সবচেয়ে সরল ও সর্বাধিক অর্থবহ ব্যাখ্যা হল, সর্বোত্তম ব্যাখ্যা।
অতএব, কোন প্রমাণ ছাড়া কিংবা প্রয়োজন ছাড়া আমরা এটা বলতে পারি না যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির পিছে অনেকগুলো কারণ ক্রিয়াশীল। সুতরাং এক্ষেত্রে আমাদেরকে সবচেয়ে অর্থবহ ও সরল কারণ তথা মহাবিশ্ব সৃষ্টির একক কারণকেই গ্রহণ করতে হবে। কেননা এক্ষেত্রে আমাদেরকে কাছে কোন প্রমাণ নেই যে আমরা বলতে পারি, মহাবিশ্বের সৃষ্টি মূলতঃ দুটি, তিনটি, কিংবা কয়েক হাজার কারণের কম্বিনেশন বা সমন্বয়। একাধিক কারণ গ্রহণের দ্বারা একটি স্বাধীন, স্বয়ংসম্পূর্ণ কারণে অতিরিক্ত কোন মাত্রা যোগ হয় না।
যেমন, যখন বলা হল, মহাবিশ্ব একটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কারণের দ্বারা সৃষ্ট, এ কথা দ্বারা যে অর্থ স্পষ্ট হয়েছে, যদি বলা হয়, মহাবিশ্ব দু’টি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কারণের দ্বারা সৃষ্ট, এ কথার দ্বারা অতিরিক্ত কোন অর্থ প্রকাশ পায় না। কেননা আমি যখন বলছি, কারণটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী তখন অন্য কোন সর্বময় ক্ষমতার প্রয়োজন নেই। কারণটি যদি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী না হত, তবে সাহায্যকারী হিসেবে অন্য কোন কারণের প্রয়োজন পড়ত। এক্ষেত্রে কোন কারণই তখন স্বাধীন বা স্বয়ংসম্পূর্ণ কারণ থাকবে না।
সুতরাং মহাবিশ্ব সৃষ্টির পিছে আমাদের মূলতঃ একটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কারণের প্রয়োজন ছিল এবং এটুকুই যথেষ্ট কেননা কারণটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।
যুক্তির দাবি হল, মহাবিশ্ব সৃষ্টি যদি অনেক প্রভূ থাকত, তবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে মহাবিশ্ব ধ্বংস হয়েছে। এবং আমরা মহাবিশ্বে যে সুষম শৃঙ্খলা ও নিয়মতান্ত্রিকতার সর্বোচ্চ সমাবেশ লক্ষ্য করে থাকি, অনেক প্রভূ থাকলে তা পরিলক্ষিত হত না।
আপনি যুক্তি দেখাতে পারেন, আপনার গাড়িটি তৈরি করে অনেক মানুষ। যেমন, কেউ গাড়ীর বডি তৈরি করে, কেউ ইঞ্জিন আবার কেউ চাকা। কিন্তু পূর্ণ গাড়িটি তৈরি হলে সেটি একটি সুন্দর ও সুষম গাড়ি হয়ে থাকে। অতএব, একটি সৃষ্ট বস্তুর অনেক স্রষ্টা থাকলেও সেটি ভারসাম্যপূর্ণ হতে পারে।
আপনার এ প্রশ্নের উত্তর হল, মহাবিশ্ব সৃষ্টির পিছে আমরা যে কারণটি উল্লেখ করেছি সেটি হল, এমন একজন প্রভূ যিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং ইচ্ছার ক্ষেত্রে এককভাবে স্বাধীন। কেননা প্রভূ তো তিনিই হবেন, যার অসীম প্রয়োগিক ইচ্ছা রয়েছে। যদি অনেক প্রভূ থাকত, তবে প্রত্যেকের ইচ্ছা প্রয়োগের প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হত, আর এটিই মহাবিশ্বে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণ হতো।
আপনি যুক্তি দেখাতে পারেন, এ সম্ভাবনা রয়েছে যে, অনেকগুলো প্রভূ একটি বিষয়ে একমত পোষণ করতে পারে। অথবা এক একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে তাদের পৃথক পৃথক ক্ষমতা থাকবে। এক্ষেত্রে আমরা বলব, এ ধরণের প্রভূর ইচ্ছা অসীম ও স্বাধীন নয়। ফলে এরা প্রভূ হওয়ার যোগ্য নয়। সার কথা হল, যদি দু’জন স্রষ্টা থাকে, এবং তারা কোন বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে, যেমন একজন ক নামক ব্যক্তিকে স্থির রাখতে চাচ্ছে, আরেকজন তাকে গতিশীল করতে চাচ্ছে। অথবা একজন প্রভূ খ কে জীবন্ত প্রাণি বানাতে চাচ্ছে, আরেকজন চাচ্ছে যে, এটি জড়পদার্থ হিসেবে অবস্থান করবে।
যুক্তির আলোকে যদি বিশ্লেষণ করা হয়, তবে এখানে তিনটি অবস্থার কোন একটি ঘটতে বাধ্য-
১. উভয় প্রভূর ইচ্ছা বহাল রাখা হবে এবং তা বাস্তবায়ন করা হবে।
২. শুধু তাদের একজনের ইচ্ছা বহাল রাখা হবে।
৩. তাদের কারও ইচ্ছায় বাস্তবায়ন করা হবে না।প্রথমটি সম্ভব নয়।
কেননা এক্ষেত্রে দু’টি বিপরীত বিষয় একই সাথে অস্তিত্ব লাভ করা আবশ্যক হবে। যা অসম্ভব। অর্থাৎ একই সাথে একটি বস্তু জীবিত ও মৃত হতে পারে না। তৃতীয় বক্তব্যও বাতিল হয়ে যাবে। কেননা এর দ্বারা এটা আবশ্যক হয় যে, একটি বস্তু গতিশীলও না, আবার স্থিরও না। একইভাবে একটি বস্তু জীবিতও না, আবার মৃত না। আর এটি অসম্ভব। সাথে সাথে তাদের কারও ইচ্ছায় যদি বাস্তবায়ন করা না হয়, তখন তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, তাদের কেউ-ই নিজ ইচ্ছা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম নয়। ফলে প্রত্যেকেই প্রভূ হওয়ার যোগ্যতা হারাবে।
দ্বিতীয় বক্তব্য অনুযায়ী, যদি দু’জনের মধ্য থেকে একজনের ইচ্ছা বাস্তবায়ন করা হয়, এবং অপরজনের ইচ্ছা পরিত্যাগ করা হয়, তবে তিনিই হবেন একক প্রভূ। যার ইচ্ছা পরিত্যাগ করা হয়েছে, সে প্রভূ হওয়ার যোগ্য থাকবে না। উপর্যুক্ত বক্তব্য দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, এই ভারসাম্যপূর্ণ মহাবিশ্বের একজন মাত্র প্রভূ থাকা সম্ভব, যিনি অসীম ইচ্ছার অধিকারী এবং একক ক্ষমতার অধিকারী।
আমরা কিভাবে দু’টি জিনিসকে পরস্পর থেকে পৃথক করে থাকি? দু’জন ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে আমরা তাদের মধ্যে পার্থক্য করি কীভাবে। এর উত্তর হল, আমরা এটা করে থাকি, কনসেপ্চুয়াল ডিফারেনসিয়েশন বা ধারণাগত বৈচিত্রের মাধ্যমে। এই ধারণাগুলো হল, স্থান, পারম্পরিক দূরত্ব, গঠন ও আকার-আকৃতিগত তারতম্য।
আমরা যে কোন দু’টি বস্তুর মাঝে পার্থক্য করতে পারি, তাদের পারস্পরিক দূরত্ব, বর্ণ ও আকার-আকৃতিগত বৈচিত্রের মাধ্যমে। দু’টি বিষয়ের মধ্যে যখন উপরোক্ত বিষয়গুলো না পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে কি আপনি উক্ত বস্তু দু’টির মাঝে কোন পার্থক্য করতে সক্ষম হবেন? আপনি পারবেন না। এবিষয়টি শুধু দু’য়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং অসংখ্য বস্তুর ক্ষেত্রে পার্থক্য নির্ণয় করতে হলে, উপরোক্ত বিষয়গুলো থাকা আবশ্যক।
প্রাসঙ্গিকভাবে বলে নেয়া আবশ্যক যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি মহাবিশ্ব থেকে বহির্গত হওয়া আবশ্যক। কেননা সৃষ্টির কারণ যদি মহাবিশ্বের ভিতরগত কিংবা মহাবিশ্বেরই কোন অংশ হয়, তখন এর অর্থ হয় যে, মহাবিশ্ব নিজেই নিজের স্রষ্টা। আর এটি অসম্ভব। মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ যেহেতু বহির্গত, আপনি সহজেই অনুমান করতে পারবেন যে, আপনি মহাবিশ্বের বহির্গত বিষয়ের মধ্যে অবস্থান, আকার-আকৃতি ও বর্ণগত পার্থক্য করতে পারবেন না। কেননা এ বিষয়গুলো কেবল মহাবিশ্বের অভ্যন্তরে বিশেষ অর্থ প্রদান করে, এর বাইরে নয়। কেননা উপর্যুক্ত বিষয় তথা দূরত্ব, আকার-আকৃতি বা বর্ণ প্রত্যেকটি সৃষ্ট। মহাবিশ্বের বাইরে সৃষ্ট কোন বস্তু নেই। মহাবিশ্বের বাইরে উপর্যুক্ত বিষয়ের অনুপস্থিতির কারণে সৃষ্টির পিছে ক্রিয়াশীল দু’টি কারণের মধ্যে পার্থক্য করাও সম্ভব নয়। এজন্য সৃষ্টির পিছে দু’টি বা অসংখ্য কারণের কথা বলাটাও ভিত্তিহীন, অযৌক্তি ও ধারণাপ্রসূত একটি বক্তব্য মাত্র।
মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি ইউনিক বা অনন্য হওয়া আবশ্যক। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “তাঁর কোন সমকক্ষ নেই”। মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি যদি অনন্য না হয়, তবে এর অর্থ হবে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ ও মহাবিশ্বের মাঝে একটি সিমিলারিটি বা সাদৃশ্য রয়েছে। কেননা এর দ্বারা এটি প্রমাণিত হয় যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি এর মাঝে রয়েছে। যার অর্থ এই দাঁড়াল যে, মহাবিশ্ব নিজেই নিজের স্রষ্টা। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি মহাবিশ্বের সাদৃশ্যপূর্ণ হতে পারবে না কেন? এর উত্তরটি খুবই সহজ। আমরা জানি মহাবিশ্ব অসংখ্য বস্তুর সমষ্টি। সুতরাং মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি অবশ্যই ইম্যাটেরিয়াল বা বস্তুজগতের ঊর্ধ্বে হতে হবে। নতুবা মহাবিশ্ব নিজেই নিজের স্রষ্টা হওয়া আবশ্যক হবে। সুতরাং বস্তু সৃষ্টির কারণটিও যদি বস্তুর মতো হয়, তবে বস্তু নিজেই নিজের স্রষ্টা হওয়া আবশ্যক, যা অসম্ভব। সুতরাং উপসংহারে আপনাকে অবশ্যই বলতে হবে যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি অবশ্যই ইম্যাটেরিয়াল ও ইউনিক হতে হবে। আমাদের এ বক্তব্যটি স্রষ্টার এককত্বের প্রমাণ হয় কিভাবে? আমরা বলব, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ যদি একাধিক হয়, তবে তার কোনটিই ইউনিক বা অনন্য হবে না। ফলে স্রষ্টা একজন হওয়াটাই নির্দিষ্ট।
স্রষ্টার এককত্ব প্রমাণের সবচেয়ে সহজ উপায় হল, আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ঐশীবাণীর শরণাপন্ন হওয়া। এক্ষেত্রে যুক্তি হল, কোন বাণীর ব্যাপারে যদি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয় যে, এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত এবং এটি মানব রচিত নয়, তখন এ গ্রন্থের বক্তব্যের ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকে না। সুতরাং আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ঐশী গ্রন্থে আল্লাহ তায়ালা নিজের সম্পর্কে যে তথ্য প্রদান করবেন সেটি নিশ্চিতভাবে সত্য বলে বিবেচিত হবে।
কেউ যদি আল্লাহ সম্পর্কে অজ্ঞ হয় তবে সে কিভাবে আল্লাহ সম্পর্কে বা তার প্রেরিত কিতাব সম্পর্কে ধারণা অর্জন করবে?
এর দু’টি পদ্ধতি রয়েছে-
১. ইন্টারন্যাল
২. এক্সটারন্যাল
আভ্যন্তরীণভাবে আল্লাহ তায়ালার পরিচয় পাওয়ার অর্থ হল, আপনি আত্মপরীক্ষা বা আত্মদর্শনের মাধ্যমে আল্লাহ সম্পর্কে অবগত হওয়ার চেষ্টা করবেন। অর্থাৎ নিজের আভ্যন্তরীণ শক্তি ব্যবহার করে আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা। আজব ব্যাপার হল, আল্লাহ সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন মানুষের নিজস্ব শক্তির দ্বারা সম্ভব নয়।
এর কিছু মৌলিক কারণ হল,
১. মানুষ সৃষ্টিগতভাবে বৈচিত্রময়। ব্যক্তি বৈচিত্রের এধারাটি মূলতঃ মানুষের মানসিক ভিন্নতারই বহিপ্রকাশ। সাইকোলজিক্যাল ভিন্নতার প্রধান কারণ হল, ডি.এন.এ এর ভিন্নতা, বাস্তব অভিজ্ঞতা, সামাজিক পূর্বসূত্র, বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানার্জনের ক্ষমতা, লিঙ্গের বৈষম্য ইত্যাদি নিয়ামক দ্বারা প্রভাবিত। আত্মদর্শনের মাধ্যমে স্রষ্টা সম্পর্কে ধারণা পেতে এবিষয়গুলো আপনাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে। সুতরাং আপনার আত্মপরীক্ষার মাধ্যমে যে ফলাফল পাওয়া যাবে সেটি অন্যদের থেকে ভিন্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। আপনি নিজেও এই বাস্তবতা উপলব্ধি করবেন যে, উপর্যুক্ত বিষয়ের উপস্থিতিতে আপনি একাকী যদি স্রষ্টা সম্পর্কে ধারণা পেতে চান তবে তা সত্য থেকে অনেক বিচ্যুত হতে পারে। এটি একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ বছর আগে পৃথিবীতে প্রায় ৩৭০০ হাজার দেবতার ধারণা মানুষের মনে জেঁকে বসেছিল।
২. দ্বিতীয় কারণ হল, বাস্তবতার বিবেচনায় মানুষ খুবই সীমাবদ্ধ। এজন্য মানুষ যদি নিজের পক্ষ থেকে স্রষ্টা সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করতে চায়, তবে তা অধিকাংশ সময় ভ্রান্তির কারণ হয়। দার্শনিকগণ ¯্রষ্টার অস্তিত্বের ব্যাপারে কিছু যুক্তিসঙ্গত দার্শনিক তত্ত্ব উপস্থাপন করে থাকেন। তবে তারা স্বতঃসিদ্ধ ও বাস্তব কোন তথ্য দিতে অক্ষম। প্রকৃতপক্ষে যদি আপনি স্রষ্টা সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা অর্জন করতে চান, তবে তা হবে ইঁদুরের পক্ষে হাতির শক্তিমত্তা সম্পর্কে ধারণা অর্জনের মতো হাস্যকর। এজন্য শুধু যুক্তি বা ধারণার উপর ভিত্তি করে স্রষ্টা সম্পর্কে কিছু বলা তার সম্পর্কে মিথ্যাচারের নামান্তর। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, “তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে যা জান না, তা বলো কেন?” সুতরাং আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে আমরা যদি জ্ঞান অর্জন করতে চাই তবে তা অবশ্যই এক্সটারন্যাল বা বহির্গত কোন মাধ্যমে হতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা ঐশীবাণীর মাধ্যমে আমাদেরকে যা জানিয়েছেন, সেটিই হবে বিশুদ্ধ জ্ঞান।
আর পবিত্র কুরআন থেকে আমরা একথা সুনিশ্চিতভাবে জানি যে, আল্লাহ তায়ালা হলেন এক ও অদ্বিতীয়। তার সমকক্ষ কেউ নেই। সুতরাং তার এককত্বের ব্যাপারে আর কোন সন্দেহ থাকে না।
------ ------
© COPYRIGHT 2021 - Hasbi Academy - We Love Our Students