প্রশ্ন: সিফাতে খাবারিয়্যার ক্ষেত্রে সালাফের মাজহাব কী ছিল?
উত্তর:
সালাফদের ঐকমত্যপূর্ণ মাজহাব ছিল তানজীহ। সকলেই আল্লাহ তায়ালাকে সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য থেকে মুক্ত বিশ্বাস করতেন। এ বিষয়ে কেউ দ্বিমত করতেন না। সুতরাং সালাফের সমস্ত বক্তব্য সামনে রাখলে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, সকলের ঐকমত্যপূর্ণ মাজহাব ছিল তানজীহ।
যেমন নুজুল বা অবতরণ। আল্লাহর নুজুল যে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন নয়, এব্যাপারে সকলেই একমত। একইভাবে আল্লাহর নুজুল উপর থেকে নীচে নামান নয়।
সালাফদের কেউ কেউ ইয়াদকে (হাত) সিফাত বলেছেন। কিন্তু তাদের সকলেই এ বিষয়ে একমত ছিলেন, ইয়াদ কোন অঙ্গ বা দেহের কোন অংশ নয়।
মোটকথা, তানজীহ (সৃষ্টির সাদৃশ্য থেকে আল্লাহ তায়ালাকে মুক্ত বিশ্বাস করা) হল সালাফের ঐকমত্যপূর্ণ মাজহাব।
প্রশ্ন: তানজীহের পর সালাফ কী করতেন?
উত্তর: এ বিষয়ে সালাফের মধ্যেই মতবিরোধ আছে। মোটামুটি তিনটি মত পাওয়া যায়।
১। ইসবাত মায়াত তানজীহ।
২। তাফয়ীজ মায়াত তানজীহ।
৩। তা’বীল মায়াত তানজীহ।
প্রশ্ন: এগুলোর ব্যাখ্যা কী?
উত্তর:
১। ইসবাত মায়াত তানজীহ হল, প্রথমে তারা শব্দের আক্ষরিক অর্থ থেকে আল্লাহকে মুক্ত ঘোষণা করতেন। এরপর তারা ঐ শব্দকে আল্লাহর সিফাত বলতেন। তবে শব্দের আক্ষরিক অর্থ বাদ দেয়ার পর ঐ শব্দের কী অর্থ হবে, তা আল্লাহ দিকে ন্যস্ত করতেন।
এক্ষেত্রে মূলত: তারা তা’বীল ও তাফয়ীজ করতেন। অর্থাৎ শব্দের আক্ষরিক অর্থ বাদ দেয়া হল তা’বীল। ঐ শব্দকে আল্লাহর সিফাত সাব্যস্ত করা হল ইসবাত।ঐ শব্দের আসল অর্থ ও উদ্দেশ্য কী হবে সেটা আল্লার দিকে ন্যস্ত করা হল তাফয়ীজ।
উদাহরণ: ইয়াদ।অর্থ হল, হাত। আরবী ‘ইয়াদ’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল, এটি দেহের অঙ্গ বা অংশ। সালাফদের সকলেই এই অর্থ পরিত্যাগ করেছেন। ইয়াদ ব্যবহার কতে অঙ্গ বা অংশ উদ্দেশ্য না নেয়া হল এক ধরণের তা’বীল।এরপর কেউ কেউ ইয়াদকে সিফাত বলেছেন। এটা হল ইসবাত (সিফাত সাব্যস্তকরণ)।
ইয়াদের বাহ্যিক অর্থ (অঙ্গ) পরিত্যাগ করার পর ইয়াদ দ্বারা আসলে কী উদ্দেশ্য সেটা আল্লাহ জানেন। এভাবে ইয়াদের আসল উদ্দেশ্য আল্লাহর উপর ছেড়ে দেয়াকে বলে তাফয়ীজ। একই সাথে তা’বীল, ইসবাত ও তাফয়ীজ পাওয়া গেল। এটা কিছু কিছু সালাফের মত ছিল।
২। তাফয়ীজ মায়াত তানজীহ হল, শব্দের আক্ষরিক অর্থ বাদ দেয়ার পর কী অর্থ হবে সেটা আল্লাহর উপর ন্যস্ত করা। এক্ষেত্রে আক্ষরিক অর্থ বাদ দেয়ার পর অন্য কোন অর্থ তারা নির্ধারণ করতেন না। আবার এটাও বলতেন না যে, এটা আল্লাহর সিফাত।
যেমন, আরবীতে ইয়াদ এর প্রায় পঁচিশটা অর্থ রয়েছে। ফাতহুল বারীতে ইবনে হাজার আসকালানী রহ: ইয়াদ এর পঁচিশটা অর্থ লিখেছেন। ইয়াদের আক্ষরিক অর্থ বাদ দেয়ার পর এই পঁচিশটার কোনটা উদ্দেশ্য অথবা অন্য কোন অর্থ উদ্দেশ্য কি না, সেটা তারা নির্ধারণ না করে আল্লাহর উপর ছেড়ে দিতেন। এক্ষেত্রে তা’বীল ও তাফয়ীজ পাওয়া যায়। শব্দের আক্ষরিক অর্থ পরিত্যাগের কারণে এটি তা’বীল। আবার সম্পূর্ণ বিষয়কে আল্লাহর উপর ন্যস্ত করার কারণে এটি তাফয়ীজ।
৩। তা’বীল মায়াত তানজীহ হল, শব্দের আক্ষরিক অর্থ পরিত্যাগ করার পর সম্ভাবনাময় কোন একটা অর্থ গ্রহণ করা। শুরুতেই তারা এর আক্ষরিক অর্থ পরিত্যাগ করেছেন। এটা হল তা’বীলে ইজমালী। এরপর তারা উক্ত শব্দের অন্যান্য ব্যবহার দেখতেন। এক্ষেত্রে আরবী ভাষার নিযম অনুযায়ী বক্তব্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ একটা অর্থ গ্রহণ করতেন। যেমন, ইয়াদ বা হাত। প্রথমে তারা আক্ষরিক অর্থ বাদ দিতেন। এরপর আরবী ভাষার নিয়ম অনুযায়ী বক্তব্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ একটা অর্থ নিতেন। যেমন, কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইহুদীদের সম্পর্কে বলেছেন; তারা বলে, আল্লার হাত বন্ধ (কৃপণ অর্থে)। এর প্রতিবাদে আল্লাহ তায়ালা বলেন, আল্লাহর উভয় হাত লম্বা। এখানে ইবনে কাসীর সহ অনেক মুফাসসির ‘আল্লারহ উভয় হাত প্রশস্ত’ কে রুপক অর্থে নিয়েছেন। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, আল্লাহ তায়ালা অধিক দানশীল।
ব্যবহার অনুযায়ী কখন ইয়াদ অর্থ শক্তি। কখনও নিয়ামত। কখনও ক্ষমতা। এধরণের প্রায় পচিশটা অর্থ ও এর ব্যবহার রয়েছে আরবী ভাষায়। স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী অর্থ গ্রহণ করা। এটাকে তা’বীলে তাফসিলি বলে।
প্রশ্ন: উপরের তিনটি মতই কি সালাফ থেকে প্রমাণিত?
উত্তর:
অবশ্যই। তবে তাদের কেউ কেউ একেকটা প্রাধান্য দিয়েছেন। সকলেই একটা বিষয়ের একমত হননি। তবে তিনটি বিষয়ই সালাফ থেকে প্রমাণিত।
প্রশ্ন: প্রসিদ্ধ মত কোনটি?
উত্তর:
তিনটি বিষয় সালাফদের থেকে প্রমাণিত হলেও প্রসিদ্ধ মত হল তাফয়ীজ মায়াত তানজীহ।
প্রশ্ন: কেউ কেউ বলে সালাফ তা’বীল করতেন না?
উত্তর:
এটা তাদের নামে মিথ্যাচার। সালাফ থেকে দু’ধরণের তা’বীলই প্রমাণিত।
১। তা’বীলে ইজমালী।
২। তা’বীলে তাফসালী।
প্রশ্ন: এগুলোর ব্যাখ্যা কী?
উত্তর:
শব্দের আক্ষরিক অর্থ পরিত্যাগ করা হল তা’বীলে ইজমালী (সামগ্রিক তা’বীল)। এটা সমস্ত সালাফ করেছেন।
শব্দের আক্ষরিক অর্থ বাদ দেয়ার পর সম্ভাবনাময় কোন একটা অর্থ গ্রহণ করা হল তা’বীলে তাফসালী। এটাও অসংখ্য সালাফ থেকে প্রমাণিত।
প্রশ্ন: বর্তমান সালাফীদের সাথে সালাফের বিরোধ কোথায়?
উত্তর:
১। সালাফ তানজীহ করতেন। কিন্তু বর্তমান সালাফীরা তানজীহ করে না। সালাফ আক্ষরিক অর্থ পরিত্যাগ করেছেন, কিন্তু সালাফীদের মূল হল, তারা আক্ষরিক অর্থে বিশ্বাস করে।
২। সকল সালাফ কাইফকে অস্বীকার করেছেন। কিন্তু সালাফীরা কাইফ সাব্যস্ত করে। তবে তারা বলে কাইফ অজ্ঞাত। কিন্তু সালাফ বলতেন, কোন কাইফ নেই। তারা বলে, কাইফ আছে কিন্তু অজ্ঞাত।
৩। অধিকাংশ সালাফ তাফয়ীজ মা’য়াত তানজীহ করতেন। কিন্তু সালাফীদের কাছে তাফয়ীজ হল নিকৃষ্ট বিদয়াত।
৪। সালাফ শব্দের আক্ষরি অর্থ পরিত্যাগ করার কারণে দেহবাদ ও সাদৃশ্যবাদ থেকে মুক্ত ছিলেন, কিন্তু বর্তমান সালাফীরা আক্ষরিক অর্থ গ্রহণ করার কারণে বিশ্বাসের দিক থেকে অধিকাংশ সালাফী দেহবাদী ও সাদৃশ্যবাদী।
প্রশ্ন: সালাফীদেরকে দেহবাদী বা সাদৃশ্যবাদী বললেন কেন?
উত্তর:
কারণ তারা আক্ষরিক অর্থে বিশ্বাস করে। আর আক্ষরিক অর্থে আল্লাহর জন্য হাত সাব্যস্ত করলে সেটা দেহবাদই হয়।
প্রশ্ন: তারা যে বলে, আল্লাহর হাত আল্লাহর হাতের মত?
উত্তর:
হাতের আক্ষরি অর্থ পরিত্যাগ না করে একথা বলে কোন লাভ নেই। হাতের আক্ষরিক অর্থ হল, এটা দেহের একটা অংশ বা অঙ্গ। যার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ আছে। আপনি যদি হাতের মূল অর্থ বাদ না দেন, আর বলেন, আল্লাহর হাত আল্লাহর মতই, তাহলেও সাদৃশ্যবাদ থাকে। আপনি আসলে মনে করছেন, আমাদের হাত ছোট-খাট। কিন্তু আল্লাহ অসীম হওয়ার কারণে তার হাত প্রকান্ড। এর দ্বারা আপনি শুধু হাতের ধরণের পার্থক্য করেছেন। মূল হাত আপনি আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করেছেন। আমরা বলি, হাত দ্বারা কখনও দেহের অংশ বা অঙ্গ উদ্দেশ্য নয়। মোটকথা হল, বাহ্যিক অর্থ সম্পূর্ণভাবে বাদ না দিতে পারলে আপনি সাদৃশ্যবাদ থেকে মুক্ত নন। আপনি যতই বলেন, আপনি আল্লাহর হাত তার শান অনুযায়ী। কারণ আল্লাহর শানই হল, তিনি একক। অঙ্গ বা অংশ থেকে মুক্ত।
প্রশ্ন: উপরের তিনটি মতের মধ্যে কোনটি উত্তম।
উত্তর:
তানজীহের বিষয়ে কোন মতবিরোধ নেই। এ বিষয়ে সকলেই একমত। সুতরাং তানজীহ অবশ্যই থাকতে হবে। এরপর আরবী ভাষার ব্যবহার অনুযায়ী যদি তা’বীল খুব স্পষ্ট হয়, তাহলে তা’বীল করাটাই উত্তম। আর যদি সম্ভাব্য অর্থ আরবী ভাষা সমর্থন না করে তাহলে সেক্ষেত্রে তাফয়ীজ করা হবে। তবে বিষয়টি যেহেতু ইজতিহাদী (গবেষণা নির্ভর), এজন্য তানজীহ করার পর যে কোন একটা মত গ্রহণের সুযোগ আছে। তবে যেসব বিষয় বাস্তবে কোন গুণ নয় বরং দেহের অংশ বা অঙ্গ বোঝায়, সেসব ক্ষেত্রে তা’বীল করাই উত্তম।
প্রশ্ন: সিফাতের ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানিফা রহ: এর মাজহাব কী ছিল?
উত্তর:
ইমাম আবু হানিফা রহ: কিছু ক্ষেত্রে ইসবাত মায়াত তানজীহ করেছেন। যেমন, ইয়াদকে সিফাত বলে তার আক্ষরিক অর্থ বাদ দিয়ে বলেছেন ‘ইয়াদ’ কোন অঙ্গ নয়। আবার কিছু ক্ষেত্রে তা’বীল মায়াত তানজীহ করেছেন। যেমন, আল্লাহর নৈকট্য ও দূরত্বের ক্ষেত্রে তিনি বলেছেন, আল্লাহর নৈকট্য স্থানগত নয়। আবার পাপী বান্দা আল্লাহর থেকে দূরে। এই দূরত্ব স্থানগত নয়। এখানে স্পষ্ট তা’বীল মায়াত তানজীহ করেছেন। ইমাম আবু হানিফা রহ: এর থেকে যদি ফিকহুল আকবার ও আবসাত প্রমাণিত হয়, তাহলে এটি তার মাজহাব হবে। নতুবা ইমাম আবু হানিফা রহ: এর আকিদা হিসেবে সেটাই মূল ধরা হবে, যা ইমাম ত্বহাবী রহ: আকিদাতুত ত্বাহীবিয়া তে লিখেছেন। কারণ তিনি শুরুতেই বলেছেন, এই আকিদাগুলো ইমাম আবু হানিফা রহ, ইমাম আবু ইউসুফ রহ: ও ইমাম মুহাম্মাদ রহ: এর আকিদা।
যেহেতু আল-ফিকহুল আকবার ও আবসাতের প্রামাণ্যতা নিয়ে প্রশ্নের সুযোগ রয়েছে, এজন্য এগুলোর উপর ভিত্তি করে ইমাম আবু হানিফা রহ: এর সুনিশ্চিত মাজহাব নির্ধারণ করাটা কঠিন। ইমাম ত্বহাবী রহ: যেহেতু স্পষ্ট করেছেন যে, আকিদাতুত ত্বহাবীর আকিদাগুলি ইমাম আবু হানিফা রহ: ও তার ছাত্রদ্বয়ের, এজন্য আকিদাতুত ত্বাহাবীকে মূল ধরাটাই অগ্রগণ্য।
প্রশ্ন: আপনি বলেছেন, যেসব বিষয় বাস্তবে কোন গুণ বোঝায় না, সেগুলোর ক্ষেত্রে তা’বীল করা উত্তম। যেমন, হাত, পা, চোখ, পায়ের পিন্ডলী। অথচ আমরা জানি, তা’বীল করলে সিফাত অস্বীকার করা হয়। তা’বীল করে কি আপনি সিফাত অস্বীকার করছেন না?
উত্তর:
এসব শব্দ থেকে সিফাত প্রমাণের বিষয়টা গবেষণা নির্ভর (ইজতেহাদী)। আর এ গবেষণা ভুল ও সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিষয়টা যে গবেষণা নির্ভর এটা বোঝার জন্য কয়েকটা উদাহরণ দেই।
উদাহরণ-১:
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, فأينما تولوا فثم وجه الله ( তোমরা যেদিকেই ফিরো, সেদিকে আল্লাহর চেহারা রয়েছে (আক্ষরিক অনুবাদ)। এই আয়াতে আল্লাহর চেহারা দ্বারা কী উদ্দেশ্য? আয়াত কি আল্লাহর চেহারা প্রমাণের জন্য এসেছে?
১। ইবনে তাইমিয়া রহ: এই আয়াতকে সিফাতের আয়াত মনে করতেন না। তিনি আল্লাহর চেহারা এর ব্যাখ্যা করেছেন কিবলা দ্বারা। এর স্বপক্ষে তিনি অনেক সালাফের বক্তব্যও এনেছেন। এ আয়াতটি তার নিকট সিফাতের আয়াত নয়। আল্লাহর চেহারা দ্বারা সিফাত উদ্দেশ্য নয়। এটি ছিল ইবনে তাইমিয়া রহ: এর ইজতিহাদ বা গবেষণা।
২| আবার ইবনে তাইমিয়া রহ: এর ছাত্র ইবনুল কাইয়্যিম রহ: আয়াতটিকে সিফাতের আয়াত মনে করতেন। তার মতে, আল্লাহর চেহারা দ্বারা বাস্তবেই আল্লাহর চেহারা উদ্দেশ্য। চেহারা আল্লাহর একটি সিফাত বা গুণ। এটি হল ইবনুল কাইয়্যিম রহ: এর ইজতিহাদ।
স্পষ্টত: উস্তাদ ও ছাত্রের ইজতিহাদে বিস্তর পার্থক্য লক্ষণীয়। একই আয়াত একজনের কাছে সিফাত, অন্যজনের কাছে সিফাত নয়। এটা মূলত: ইজতিহাদের পার্থক্যের কারণে হয়েছে।
উদাহরণ-২:
হাদীসে এসেছে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা সাত শ্রেণির মানুষকে তার ছায়ায় আশ্রয় দিবেন। হাদীসের শব্দে ছায়া আল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। আল্লাহর ছায়ায় সাত শ্রেণির মানুষকে জায়গা দিবেন।
১। হাদীছে যেহেতু আল্লাহর ছায়া বলা হয়েছে, এজন্য শায়খ ইবনে বাজ রহ: এর মতে ছায়া আল্লাহর একটি সিফাত। তিনি মনে করতেন, আল্লাহর ছায়া আছে। এটা ছিল তার ইজতিহাদ।
২। অপর দিকে সৌদি আরবের মান্যবর সালাফী আলেম শায়খ ইবনে উসাইমিন রহ: এর কঠোর বিরোধীতা করেছেন। তার মতে, ছায়া আল্লাহর সিফাত নয়। কিয়ামতের দিন মূলত: আরশের ছায়ায় সাত শ্রেণির মানুষকে জায়গা দেয়া হবে।
উদাহরণ-৩: সালাফীদের মৌলিক বিশ্বাস হল, আল্লাহর দু’টি হাত রয়েছে। এই দুই হাতের একটি কি ডান হাত এবং অপরটি কি বাম হাত? এ বিষয়ে শায়খদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে।
১। শায়খ ইবনে উসাইমিন রহ: ও শায়খ ইবনে বাজ রহ: এর মতে আল্লাহর বাম হাত আছে। তারা মুসলিম শরীফের একটি হাদীস থেকে এর প্রমাণ দিয়ে থাকেন। যেখানে বাম হাত আল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।
২। শায়খ নাসীরুদ্দীন আলবানী রহ: এর মতে আল্লাহর কোন বাম হাত নেই। এ বিষয়ে মুসলিম শরীফের হাদীসটি শায (বিচ্ছিন্ন বর্ণনা)। তিনি এ বর্ণনা গ্রহণ করেননি।
এ বিষয়ে আরও অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে। বিস্তারিত জানার জন্য ‘সালাফী আলেমদের আকিদাগত মতবিরোধ’ শিরোনামের নোটগুলি দেখতে পারেন।
মোটকথা, সিফাত প্রমাণের বিষয়টি সম্পূর্ণ ইজতিহাদী বা গবেষণা নির্ভর। এটা শরীয়তের অকাট্য বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত বিষয় না। কারও কাছে কোন একটা আয়াত বা হাদীস সিফাত এর প্রমাণ হলেও অন্যের কাছে সেটি সিফাতের দলিল নয়। যার কাছে বিষয়টি সিফাত, তিনি দাবী করছেন যে এটি আল্লাহর সিফাত। কিন্তু যার গবেষণায় এটি সিফাত নয়, তিনি বলছেন, আয়াত বা হাদীস সিফাত প্রমাণ করছে না।
বিষয়টি গবেষণা নির্ভর হওয়ার কারণে একজনের গবেষণার কারণে অন্যকে সিফাত অস্বীকারকারী বলার কোন সুযোগ নেই। কারণ অস্বীকারের প্রশ্ন পরে আসবে। তার কাছে তো বিষয়টি সিফাত হিসেবেই প্রমাণিত নয়। এক্ষেত্রে একজনের গবেষণাকে অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়া যেমন অন্যায়, একইভাবে যার কাছে বিষয়টি সিফাত হিসেবে প্রমাণিত নয়, তাকে সিফাত অস্বীকারকারী বলাটাও অন্যায়
আপনার প্রশ্নের উত্তর হল, যিনি তা’বীল করছেন, তিনি উক্ত আয়াত বা হাদীসকে সিফাতের আয়াত বা হাদীস মনে করছেন না। তার ইজতিহাদে এই আয়াত বা হাদীস আল্লাহর কোন গুণ প্রমাণের জন্য আসেনি। আপনার ইজতিহাদে হয়ত বিষয়টা কোন গুণ প্রমাণ করছে, কিন্তু যিনি তা’বীল করছেন তার কাছে এটি গুণ প্রমাণ করছে না। যেমন, শায়খ ইবনে বাজ রহ: ছায়াকে আল্লাহর গুণ মনে করলেও ইমনে উসাইমিন রহ: ছায়াকে আল্লাহর গুণ মনে করেননি। এক্ষেত্রে আপনি কাকে সিফাত অস্বীকারকারী বলবেন? আর ইবনে বাজ রহ: এর এই ইজতিহাদ কি সবার মেনে নেয়া জরুরি?
মূলকথা হল, সিফাত প্রমাণের বিষয়টি গবেষণার উপর নির্ভর করছে। যার গবেষণায় বিষয়টি সিফাত নয় এবং তিনি এর তা’বীল করেছেন, তাকে আপনার গবেষণার কারণে সিফাত অস্বীকারকারী বলার সুযোগ নেই। এর দ্বারা আপনি আপনার গবেষণা সবাইকে মানতে বাধ্য করছেন। বাস্তবে অন্য সবাই আপনার গবেষণা মানতে বাধ্য নয়।
আহলে সুন্নতের অসংখ্য আলেমের ইজতিহাদ হল, হাত, পা, চোখ, পায়ের পিন্ডলী, দেহের পাশ এগুলো সিফাত নয়। যেসব আয়াত বা হাদীসে এগুলো আল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে, এগুলো আল্লাহর সিফাত প্রমাণের জন্য আসেনি। তাদের কাছে বিষয়গুলো সিফাত হিসেবেই প্রমাণিত নয়। এখন আপনার গবেষনায় বা অন্য কোন আলিমের গবেষণায় এগুলো সিফাত হতে পারে। আপনার গবেষণার কারণে যাদের কাছে এগুলো সিফাত হিসেবেই প্রমাণিত নয়, তারা সিফাত অস্বীকারকারী হবে কেন?
আপনি হয়ত দু’পক্ষের গবেষণার মধ্যে যে কোন একটা প্রাধান্য দিতে পারেন। সেটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু আপনার ইজতিহাদের কারণে অন্য পক্ষ সিফাত অস্বীকারকারী হবে না।
প্রশ্ন: আপনি বলেছেন, কিছু ক্ষেত্রে তা’বীল মায়াত তানজীহ প্রাধান্য পাবে। ইসবাত ও তাফয়ীজের উপর একে প্রাধান্য দেয়ার কারণ কী? অথচ সালাফ ইসবাত মায়াত তানজীহকে প্রাধান্য দিয়েছেন?
উত্তর:
যেহেতু বিষয়টা ইজতেহাদী, এজন্য এবিষয়ে যেকোন একটা মতকে প্রাধান্য দেয়ার সুযোগ আছে। আর তিনটি বিষয়ই যেহেতু সালাফ থেকে প্রমাণিত, এজন্য কোন একটাকে প্রাধান্য দিলেও সেটা সালাফেরই মত হিসেবে গণ্য হবে। কিছু কিছু সালাফ তাফয়ীজকে প্রাধান্য দিয়েছেন, এর অর্থ এই নয় যে, যেসব সালাফ তা’বীল করেছেন, তাদের মাজহাবটি ভুল। সালাফের কেউ কেউ হয়ত তা’বীলের বিরোধীতা করেছেন, কিন্তু অন্যান্য সালাফ থেকে তা’বীল প্রমাণিত। তাদের বিরোধীতার কারণে একথা বলার সুযোগ নেই যে, তা’বীল সালাফের মাজহাব নয়।
মোটকথা, তানজীহের পর ইসবাত, তাফয়ীজ, তা’বীল থেকে যে মতটিই গ্রহণ করা হবে, সেটা সালাফেরই মত হিসেবে গণ্য হবে। যেহেতু সবগুলিই সালাফ থেকে প্রমাণিত। আবার কোন একটি মতকে প্রাধান্য দিলে মূলত: সালাফের একটা মতকে আরেকটার উপর প্রাধান্য দেয়া হল।
কিছু ক্ষেত্রে তা’বীলকে তাফয়ীজের উপর প্রাধান্য দেয়ার কিছু মৌলিক কারণ উল্লেখ করছি।
১। অনেক আয়াত বা হাদীসে রুপক অর্থটাই মূল। রুপক অর্থ না নিলে আয়াত বা হাদীসের বক্তব্য বিকৃত হয়, সেক্ষেত্রে অবশ্য তা’বীল করতে হবে।
যেমন,
ক) সূরা কাসাসের ৮৮ নং আয়াত। আল্লাহর চেহারা ব্যতীত সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। এখানে সালাফ থেকে দু’টি তা’বীল বর্ণিত আছে।
#. আল্লাহর সত্ত্বা ব্যতীত সব কিছু ধ্বংস হবে। এখানে চেহারা দ্বারা সত্ত্বা উদ্দেশ্য।
#.আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কৃত নেক আমল।
দ্বিতীয় তা’বীলটি ইমামা বোখারী রহ: সহীহ বোখারীতে উল্লেখ করেছেন।
এ আয়াতে তা’বীল না করে বাহ্যিক অর্থ নিলে আয়াতের অর্থ বিকৃত হয়।
খ) পবিত্র কুরআনের সুরা দাহরে (আয়াত-৯) আল্লাহ তায়ালা বলেন,
إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللَّهِ
এই আয়াতের আক্ষরিক অর্থ হল, আমরা তোমাদেরকে আল্লাহর চেহারার জন্য আহার্য দান করি। মূল অর্থ হল, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে আমরা তোমাদেরকে আহার্য দান করি। এ আয়াতে ‘আল্লাহর চেহারা’ দ্বারা যদি তা’বীল না করে বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করা হয়, তাহলে আয়াতের অর্থ ও উদ্দেশ্য বিকৃত করা হয়। এধরণের তাহরীফে মা’নাবী (পরোক্ষ বিকৃতি) আবশ্যক হলে আয়াতের তা’বীল করা জরুরি।
গ) কেউ কেউ সূরা হুদের ৩৭ নং আয়াত দ্বারা আল্লাহর চোখ প্রমাণের চেষ্টা করেছে। আয়াতের বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করলে আল্লাহর বহু চোখ সাব্যস্ত করা হয়। আবার বাহ্যিক অর্থ গ্রহণের কারণে আয়াতের বক্তব্য বিকৃত হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَاصْنَعِ الْفُلْكَ بِأَعْيُنِنَا
আয়াতের বাহ্যিক অর্থ হল, হে নূহ, আমার চোখসমূহ দ্বারা নৌকা তৈরি করো।
আয়াত দ্বারা বহু চোখ সাব্যস্ত হয়। আবার সেই চোখসমূহ দ্বারা নৌকা তৈরির আদেশটিও অসম্ভব। আয়াতের মূল উদ্দেশ্য ও অর্থ এটি হতে পারে না। এজন্য এ আয়াতে তা’বীল না করলে তাহরীফ আবশ্যক হয়। তাফসীরে ইবনে কাসীরে এর অর্থ করা হয়েছে, আমার সম্মুখে বা তত্ত্বাবধানে নৌকা তৈরি করো।
২। যেসব ক্ষেত্রে বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করলে কুফুরী-শিরকী আবশ্যক হয়, সেসব ক্ষেত্রে তা’বীল করা জরুরি। যেমন,
ক। হাদীসে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, আমি বান্দার হাত হয়ে যায়। আমি বান্দার পা হয়ে যায়। এই হাদীসের বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করলে কুফুরী আবশ্যক হয়।
খ। কুরআনে এসেছে, আল্লাহ হলেন আসমান-জমিনের নূর বা আলো। এ আয়াতের বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করলে কুফুরী আবশ্যক হয়।
গ। হাদীসে এসেছে, তোমরা সময়কে গালি দিও না। কারণ আল্লাহ হলেন সময়। এই হাদীসের বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করলে কুফুরী হবে।
ঘ। কুরআনে এসেছে, কাফেররা আল্লাহকে ভুলে গেছে, আল্লাহ তায়ালাও তাদেরকে ভুলে গেছেন। এ আয়াত থেকে বাহ্যিক অর্থ নিয়ে একথা বলা কুফুরী হবে যে, আল্লাহ তায়ালা ভুলে যান।
ঙ। হাদীসে এসেছে, আমি ইয়ামান থেকে আল্লাহর শ্বাস-প্রশ্বাস পাচ্ছি। এই হাদীসের বাহ্যিক অর্থ নিলেও কুফুরী হবে।
এধরণের আরও অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে যেখানে তা’বীল না করলে কুফুরী-শিরকী আবশ্যক হয়। এসব ক্ষেত্রে তা’বীল করা জরুরি।
৩। কোন আয়াত বা হাদীসের বাহ্যিক অর্থ যদি আল্লাহর জন্য প্রযোজ্য না হয়, তাহলে এই বাহ্যিক অর্থ পরিত্যাগের বিষয়ে সমস্ত সালাফ একমত। যেমন, আল্লাহর ক্ষেত্রে নুজুল দ্বারা কখনও উপর থেকে নীচে নামা উদ্দেশ্য হবে না। শব্দের বাহ্যিক অর্থ পরিত্যাগ করাও তা’বীল। কারণ তা’বীল বলা হয়,
صرف اللفظ عن ظاهره
অর্থ: শব্দের বাহ্যিক অর্থ পরিত্যাগ করা।
সিফাতের ক্ষেত্রে এধরণের তা’বীলের কথা সমস্ত সালাফই বলেছেন। পরিভাষায় একে তা’বীলে ইজামালী বা সামগ্রিক তা’বীল বলে। সুতরাং কোন শব্দের বাহ্যিক অর্থ আল্লাহর জন্য প্রযোজ্য না হলে ঐ শব্দের বাহ্যিক অর্থ পরিত্যাগের বিষয়ে সমস্ত সালাফ একমত ছিলেন। তা’বীলে ইজমালী না করলে দেহবাদ ও সাদৃশ্যবাদ আবশ্যক হবে। উভয়টি মারাত্মক কুফুরী।
সালাফের মধ্যে যারা সিফাত সাব্যস্ত করেছেন অথবা যারা তাফয়ীজ করেছেন, তাদের সকলেই তা’বীলে ইজমালী করেছেন। তা’বীলে ইজমালী একটা ঐকমত্যপূর্ণ বিষয়।
৪। অনেক ক্ষেত্রে তা’বীলে ইজমালীর পাশাপাশি তা’বীলে তাফসীলি করাও উত্তম। তা’বীলে তাফসীলি হল, শব্দের বাহ্যিক অর্থ পরিত্যাগ করার পর সম্ভাব্য কোন রুপক অর্থ গ্রহণ করা। যেমন, আরবী ইয়াদ এর বাহ্যিক অর্থ হাত। কিন্তু আরবীসহ বিভিন্ন ভাষায় হাতের অনেক ব্যবহার আছে। কাউকে কৃপণ বোঝানোর জন্য আমরা বলি, তার হাত খাট। কোন নেতার ক্ষমতা বোঝানোর জন্য বলি, তার হাত অনেক লম্বা। আরবীতেও এধরণের অসংখ্য রুপকের ব্যবহার আছে। যেসব জায়গায় আনুসঙ্গিক বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, বক্তা রুপক অর্থ উদ্দেশ্য নিয়েছেন, সেক্ষেত্রে তা’বীলে তাফসীলি করতে হবে। যেমন, হাদীসে এসেছে,
إن قلوب بني آدم كلها بين إصبعين من أصابع الرحمن
অর্থ: বনী আদমের অন্তরসমুহ আল্লাহর দুই আঙ্গুলের মধ্যে।
এই হাদীস দ্বারা এটা কখনও উদ্দেশ্য নয় যে, প্রত্যেক মানুষের অন্তরে আল্লাহর দুই আঙ্গুল রয়েছে। বক্তব্য থেকে উদ্দেশ্য খুবই স্পষ্ট। মানুষের অন্তরের উপর আল্লাহর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি বর্ণনা করা উদ্দেশ্য। এখানে আল্লাহর আঙ্গুল সাব্যস্ত করা, প্রত্যেকের মানুষের অন্তরে আল্লাহর আঙ্গুল আছে, এটা বলা উদ্দেশ্য নয়। বক্তার বক্তব্য থেকে তা’বীলে তাফসীলি স্পষ্ট হওয়ার কারণে এখানে তা’বীল করাটা উত্তম।
৫। কিছু শব্দ বাস্তবে কোন সিফাত বা গুণ বোঝায় না। কিন্তু রুপক অর্থে কখনও গুণের অর্থে ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন, হাত, পা, চোখ। এগুলো পৃথিবীর কোন ভাষাতেই আক্ষরিক অর্থে গুণ বোঝায় না। এর আক্ষরিক অর্থ পরিত্যাগ করে একে গুণের অর্থে নেয়া সম্ভব। তবে এটি অপ্রচলিত তা’বীল হিসেবে গণ্য করা হবে। হাত শব্দ ব্যবহার করে যদি আমি ক্ষমতা, নেয়ামত ইত্যাদি রুপক অর্থ নেই, তাহলে সেটি প্রচলিত রুপক হিসেবে গণ্য হবে। কিন্তু আমি যদি হাতের বাহ্যিক অর্থ পরিত্যাগ করে বলি, হাত একটি গুণ, তাহলে এটা আরবী ভাষার প্রচলিত রুপকের মধ্যে থাকবে না। ইমাম আ’মাদী রহ: এর মতে হাত, পা এগুলোকে সিফাত বা গুণ বলা হল, অপ্রচলিত ও দূরবর্তী রুপক (তাজাউঝে বায়ীদ)। সালাফের মধ্যে যারা হাত, পা, চোখকে সিফাত বলেছেন, তারা মূলত: দূরবর্তী তা’বীল করেছেন। বাহ্যিকভাবে যদিও মনে হয়, তারা তা’বীল করছেন না বা তা’বীলের বিরোধীতা করছেন, কিন্তু বিষয়টিকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এটি তা’বীলে বায়ীদ বা দূরবর্তী তা’বীল।
১। তারা যখন শব্দের বাহ্যিক অর্থ পরিত্যাগ করছেন, তখন এটি তা’বীলে ইজমালী।
২। এরপর যখন ঐ শব্দকে সিফাত বা গুণ বলছেন, তখন এটি তা’বীলে বায়ীদ বা দূরবর্তী তা’বীল। কারণ শব্দটি আসলে কোন গুণ বোঝায় না। ইয়াদ নামে আরবীতে কোন গুণ নেই। কাদাম নামে কোন গুণ নেই। ইয়াদ বা কাদাম আরবী ভাষায় কোন গুণ না বোঝানো সত্ত্বেও একে গুণের অর্থে নেয়াটা ব্যাপক তা’বীল। যা প্রচলিত তা’বীল থেকেও দূরবর্তী।
সালাফের মধ্যে যারা হাত, পা, চোখকে সিফাত বলতেন, তারা মূলত: তা’বীলে বায়ীদ বা দূরবর্তী তা’বীল করেছেন। আর বাস্তবতা হল, দূরবর্তী বা অপ্রচলিত তা’বীলের চেয়ে প্রচলিত তা’বীল উত্তম। এজন্য ইয়াদকে সিফাত বলার চেয়ে ইয়াদকে ক্ষমতা বা অন্য কোন অর্থে তা’বীল করা উত্তম। ইমাম আ’মাদী রহ: এবিষয়ে আরও বিস্তারিত লিখেছেন তার ‘আবকারুল আফকার’ নামক কিতাবে।
৬। সালাফসহ আহলে সুন্নতের বহু আলিমের মতে এগুলো মুতাশাবিহাত এর অন্তর্ভূক্ত। এগুলো যদি মুতাশাবিহাত হয়, তাহলে এর দ্বারা সিফাত প্রমাণ করা কতটুকু সঠিক?
মুতাশাবিহ বিষয় কি কোন কিছু প্রমাণে দলিল হওয়ার যোগ্য? ইমাম শাতবী রহ: এর মতে মুতাশাবিহকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করে কোন কিছু প্রমাণ করা বিদয়াত। কারও কাছে যদি এ সংক্রান্ত আয়াত বা হাদীস মুতাশাবিহ হয়, তাহলে তার জন্য এগুলো দ্বারা সিফাত প্রমাণ করার সুযোগ থাকে না। এজন্য যেসব আয়াত বা হাদীসে হাত, পা, চোখ ইত্যাদির কথা আছে, এগুলোকে মুতাশাবিহ গণ্য করলে এর দ্বারা কোন সিফাত প্রমাণ করার সুযোগ নেই। সিফাত প্রমাণের জন্য মুহকাম আয়াত বা হাদীস প্রয়োজন। আর এগুলো যেহেতু মুহকাম নয়, এজন্য এগুলো দ্বারা সিফাত প্রমাণ করাটা দলিলের বিবেচনায় দুর্বল।
৭। হাত, পা, চোখ এগুলো মুলত: সিফাত হিসেবে আসেনি। ইজাফত হিসেবে এসেছে। যেমন, হাসানের বই। এখানে বই হাসানের দিকে সম্পৃক্ত হয়েছে ইজাফত হিসেবে। গুণ হিসেবে নয়। এই ইজাফাতকে সিফাত বা গুণ বলার জন্য পৃথক দলিল প্রয়োজন। আর এসব ইজাফাতকে সিফাত বলার ভাষাগত, যৌক্তিক বা শরয়ী কোন দলিল নেই। শরয়ী বা আকলী দলিল ছাড়া ইজাফাতকে সিফাত বলাটা যৌক্তিক হতে পারে না।
৮। আল্লাহর হাত, আল্লাহর চোখ, আল্লাহর রুহ সবগুলিই ইজাফাত। শব্দের ব্যবহারে সামান্যতম কোন পার্থক্য নেই। যারা হাত বা চোখকে সিফাত বলেন, তারা রুহকে আল্লাহর সিফাত বলেন না। যদিও বাংলাদেশী কিছু আহলে হাদীসদের আকিদার কিতাবে রুহ বা আত্মাকেও আল্লাহর সিফাত বলা হয়েছে। একই ধরণের ব্যবহার থাকা সত্ত্বেও পাত, পা, চোখকে সিফাত কেন বলা হবে এবং রুহ বা আত্মাকে আল্লাহর সিফাত কেন বলা হবে না? পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তিনি আদম আ: এর মাঝে তার রুহ ফুৎকারের মাধ্যমে প্রবেশ করিয়েছেন। এই আয়াত থেকে রুহকে আল্লাহর সিফাত বলা হবে না কেন? আর আল্লাহর সেই সিফাত আদম আ: এর মাঝে প্রবেশ করানো হয়েছে, এই বিশ্বাসকে কুফুরী বলা হবে কেন?
মূল বিষয় হল, কোন ইজাফাতকে সিফাত বলব এবং কোনটাকে বলবনা, এটা কে নির্ধারণ করবে? আর কোন কোন মূলনীতির আলোকে নির্ধারণ করা হবে? ছায়ার ইজাফাত আল্লাহর দিকে হওয়ার কারণে ইবনে বাজ রহ: ছায়াকে আল্লাহর সিফাত বললেন? তিনি কোন মূলনীতির আলোকে ছায়াকে সিফাত বললেন? আবার ইবনে উসাইমিন রহ: ছায়াকে সিফাত বলতে অস্বীকৃতি জানালেন। তিনি এই ইজাফাতকে সিফাত বলেন না কেন?
৯। সালাফের অনেকে তা’বীলে তাফসিলির বিরোধীতা করেছেন, তা’বীল সম্ভাবনাময় হওয়ার কারণে। সুনিশ্চিত না হওয়ার কারণে তারা তা’বীলের বিরোধীতা করেছেন। ইজাফাতের মাধ্যমে যদি সিফাত সাব্যস্ত করা হয়, তাহলে এক্ষেত্রেও বিষয়টি সম্ভাবনাময় থাকে। এটি অকাট্যভাবে প্রমাণ করে না যে, এটি আল্লাহর সিফাত। ইয়াদ আল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে একথা সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে না যে, আল্লাহর হাত রয়েছে। আরবী ভাষায় এধরণের বহু ব্যবহার রয়েছে। যেমন, কুরআনে ‘দিনের চেহারা’, ‘সত্যের পা’, ‘নম্রতার ডানা’, ‘কুরআনের দুই হাত’ ইত্যাদি বহু ব্যবহার রয়েছে। এগুলো প্রমাণ করে না যে, দিনের চেহারা রয়েছে। সত্যের পা রয়েছে। একইভাবে আল্লাহর দিকে হাত সম্পৃক্ত হলেই এটা প্রমাণ করে না যে, আল্লাহর হাত রয়েছে। কুরআনের দিকে দুই হাত সম্পৃক্ত করা হয়েছে। কেউ তো এটা বলে না যে, কুরআনের দুই হাত আছে? আল্লাহর ক্ষেত্রে হাতের ইজাফাত হলেই কেন বলা হবে যে, আল্লাহর হাত রয়েছে? সম্ভাবনার কারণে তা’বীল যদি বর্জনীয় হয়, তাহলে একই কারণে এসব আয়াত বা হাদীস থেকে সিফাত প্রমাণও বর্জনীয় হওয়া উচিত।
১০। যে কোন সিফাত আল্লাহর বিশেষ পরিচয় ও মহত্ব তুলে ধরে। আল্লাহ সর্বময় জ্ঞানী। এর দ্বারা আল্লাহর মহত্ব ও বড়ত্ব বোঝা যায়। কিন্তু হাত, পা, চোখ এগুলো কোন মহত্ব বা বড়ত্ব প্রকাশ করে না। এগুলোকে অনেক সময় আল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত করতেই মানুষ দ্বিধা করে। এছাড়া এজাতীয় যত আয়াত ও হাদীস আছে, সবগুলি মিলালেও পরিপূর্ণ কোন পরিচয় স্পষ্ট হয় না। বহু হাত, এক পা, বহু চোখ, দেহের এক পাশ, এক পায়ের পিন্ডলী এগুলো আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করলেও এটি একটি অসম্পূর্ণ পরিচয় তুলে ধরে। আল্লাহর সিফাতের মূলই ছিল আল্লাহর পরিচয় তুলে ধরা, এগুলোকে সিফাত বলার কারণে এর দ্বারা অস্পষ্টতা বেড়েছে। মূল বিষয় হল, এগুলো আল্লাহর কোন বিশেষ পরিচয় বা মহত্ব তুলে ধরে না। এগুলোকে সিফাত সাব্যস্ত করার মূল আবেদনটি এখানে অনুপস্থিত। অনেক ক্ষেত্রে এগুলো নুকস বা ত্রুটি হিসেবে গণ্য করা হয়। যেমন, হাত। মানুষের হাত তার একটি দুর্বলতাকে দুর করার জন্য এসেছে। কোন কিছু ধরার জন্য সে হাতের মুখাপেক্ষী। হাত মানুষের দুর্বলতার প্রতীক। এই অভিযোগটি তাদের জন্য প্রযোজ্য যারা আক্ষরিক অর্থে আল্লাহর জন্য হাত সাব্যস্ত করে।
পুরো আলোচনার উপসংহার হল, যেসব বিষয় বাস্তবে কোন গুণ বোঝায় না, বরং অঙ্গ বা দেহের অংশ বোঝায় এগুলোর ক্ষেত্রে তা’বীল করা উত্তম। তবে তা’বীলের শর্ত ঠিক রেখে তা’বীল করতে হবে। আরবী ভাষায় এর সমর্থন থাকতে হবে। আনুসঙ্গিক আলোচনার সাথে সংগতিপূর্ণ হতে হবে। এ বিষয়ে ইমাম ইজ ইবনে আব্দুস সালাম রহ: বলেন,
طريقة التاويل بشرطه اقربهما الي الحق
অর্থ: তা’বীল ও তাফয়ীজের মধ্যে শর্ত মেনে তা’বীলের পদ্ধতি সত্যের অধিক নিকটবর্তী।
(আল-বাহরুল মুহীত, খ-৩, পৃ-৪৪০)
প্রশ্ন: সিফাতে খাবারিয়্যার ক্ষেত্রে আশআরী-মাতুরিদি আকিদা আসলে কী?
উত্তর:
সালাফের আকিদাই মুলত: আশআরী-মাতুরিদি আকিদা। সালাফ থেকে প্রমাণিত প্রত্যেকটি মতই আশআরী-মাতুরিদিগণ গ্রহণ করেছেন। সালাফের সাথে আশআরী-মাতুরিদি আকিদার মৌলিক কোন বিরোধ নেই। সালাফের মৌলিক মাজহাব ছিল তানজীহ। আল্লাহ তায়ালাকে যে কোন ধরণের সাদৃশ্য থেকে মুক্ত বিশ্বাস করা। তানজীহের পর ইসবাত, তাফয়ীজ, তা’বীল সবগুলোকেই তারা সমর্থন করেন। তাদের মৌলিক আকিদার কিতাবগুলিতে বিস্তারিত রয়েছে।
প্রশ্ন: বর্তমান সালাফীরা আশআরী-মাতুরিদি আকিদার বিরোধীতা করে কেন?
উত্তর:
এর কয়েকটি কারণ আছে।
১। সালাফীরা তাদের আকিদার মূল বানিয়েছে শব্দের আক্ষরিক অর্থে বিশ্বাসের উপর। সালাফ, আশআরী-মাতুরিদি সকলেই শব্দের আক্ষরিক অর্থ বর্জনের উপর একমত। ইয়াদ বলে তারা হাতের আক্ষরিক অর্থ পরিত্যাগ করেছেন। তারা স্পষ্ট করেছেন, ইয়াদ কখনও দেহের কোন অঙ্গ নয়। সালাফীদের সাথে এই মৌলিক জায়গায় বিরোধের কারণে তারা আশআরী-মাতুরিদি আকিদার বিরোধীতা করে।
২। সালাফের অনুসরণে আশআরী-মাতুরিদিগণ বলেন, আল্লাহর জাত ও সিফাতের কোন কাইফ নেই। কিন্তু সালাফীরা বলে কাইফ আছে, কিন্তু কাইফ অজ্ঞাত।
৩। বহু আয়াত ও হাদীসে সালাফ থেকেই অসংখ্য তা’বীল বর্ণিত আছে। এসব তা’বীল আরবী ভাষাও সমর্থন করে। আশআরী-মাতুরিদিগণ এসব তা’বীলকে সমর্থন করেন। পক্ষান্তরে সালাফীরা এসব তা’বীল সালাফ থেকে বর্ণিত হলেও তারা এগুলো গ্রহণ বা সমর্থন করে না। এমনকি তাদের কেউ কেউ ইমাম তিরমিজি রহ: এর তা’বীলকে জাহমিয়াদের তা’বীল আখ্যা দিয়েছে। সালাফীদের স্বীকৃত আকিদার সমর্থনে কোন তা’বীল হলে, তারা শুধু এগুলো গ্রহণ করে। কিন্তু তাদের আকিদার বিরোধী হলে তা’বীলের বিপক্ষে যায়। আশআরী-মাতুরিদিগন গ্রহণযোগ্য তা’বীলগুলো গ্রহণ করে থাকেন। এক্ষেত্রে তারা সালাফীদের মত দ্বিমুখী আচরণ বা স্ববিরোধীতা করেন না।
প্রশ্ন: সালাফের ঐকমত্যপূর্ণ মাজহাব যে তানজীহ ছিল, এর দলিল কী?
উত্তর:
দু’ধরণের দলিল।
ক। সালাফের মাজহাব বিশ্লেষণ করে আহলে সুন্নতের বিখ্যাত আলিমগণ লিখেছেন যে, সালাফের মাজহাব ছিল তানজীহ। সিফাতের ক্ষেত্রে সালাফের মাজহাব সম্পর্কে তারা বলেন, সালাফের সকলেই বাহ্যিক অর্থ পরিত্যাগের ব্যাপারে একমত ছিলেন।
খ। স্বয়ং সালাফের বক্তব্য।
উভয় প্রকার বক্তব্য উল্লেখ করছি।
সালাফের মাজহাব সম্পর্কে আলিমগণের বক্তব্য
১। হাদীসে আল্লাহর নুজুলের কথা রয়েছে। নুজুল বা অবতরণ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ইমাম নববী রহ: বলেন,
هذا الحديث من أحاديث الصفات وفيه مذهبان مشهوران للعلماء سبق إيضاحهما في كتاب الإيمان، ومختصرهما أن أحدهما: وهو مذهب جمهور السلف وبعض المتكلمين، أنه يؤمن بأنها حق على ما يليق بالله تعالى وأن ظاهرها المتعارف في حقنا غير مراد ولا يتكلم في تأويلها مع اعتقاد تنزيه الله تعالى عن صفات المخلوق وعن الانتقال والحركات وسائر سمات الخلق، والثاني: مذهب أكثر المتكلمين وجماعات من السلف وهو محكي عن مالك والأوزاعي أنها تتأول على ما يليق بها بحسب مواطنها
شرح مسلم 6 / 36
অর্থ: হাদীসটি সিফাত সংক্রান্ত হাদীসসমূহের একটি। এ বিষয়ে আলিমগণের প্রসিদ্ধ দু’টি মাজহাব রয়েছে। কিতাবুল ইমানে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা আলোচনা করেছি। এখানে সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরছি। ১। প্রথম মতটি অধিকাংশ সালাফ ও কিছু কালামবিদের। তাদের মতে উক্ত সিফাতটি আল্লাহর শান অনুযায়ী আল্লাহর জন্য প্রযোজ্য। তবে সৃষ্টির জন্য প্রযোজ্য বাহ্যিক অর্থটি উদ্দেশ্য নয়। তাদের মতে উক্ত সিফাতের কোন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হবে না। সেই সাথে অবশ্যই তানজীহ থাকতে হবে। বিশ্বাস রাখতে হবে, আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টির গুণ থেকে মুক্ত। আল্লাহর নুজুল (অবতরণ) এক স্থান থেকে অন্যস্থানে গমন নয়। আল্লাহর নুজুল স্থান পরিবর্তন বা নড়াচড়া নয়। নুজুলের বিষয়ে এজাতীয় সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য থেকে মুক্ত বিশ্বাস করে সিফাত সাব্যস্ত করা হবে। (এটা মূলত: ইসবাত মায়াত তানজীহ)। ২। দ্বিতীয় মতটি অধিকাংশ কালামবিদ ও একদল সালাফের মাজহাব। এটি ইমাম মালিক ও ইমাম আওজায়ী রহ: থেকে বর্ণিত। তাদের মতে স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী তা’বীল করা হবে।
(শরহে মুসলিম ৬/৩৬)
২। শাইখুল ইসলাম ইমাম বদরুদ্দিন ইবনে জামায়া রহ (৬৩৯-৭৩৩) বলেন,
واتفق السلف وأهل التأويل على أن ما لا يليق من ذلك بجلال الرب تعالى غير مراد، كالقعود والاعتدال… فسكت السلف عنه – وأوله المتأولون
অর্থ: সালাফ ও তা’বীলকারীগণ সকলেই এবিষয়ে একমত যে, এসব শব্দের যে অর্থ আল্লাহর জন্য শোভনীয় নয়, সেগুলো উদ্দেশ্য নয়। যেমন, বসা বা সোজা হওয়া। সালাফ এসব বিষয়ে চুপ ছিলেন। তা’বীলকারীগণ এর তা’বীল করেছেন।
(ইজাহুদ দলিল, পৃ:১০৩, দারুস সালাম, কায়রো)
৩। ইমাম আবু আব্দিল্লাহ উব্বী রহ: বলেন,
ومذهب أهل الحق في جميع ذلك أن يصرف اللفظ عن ظاهره المحال، ثم بعد الصرف هل الأولى التأويل أو عدمه، بأن يؤمن باللفظ على ما يليق، ويكل علم حقيقة ذلك إلى الله سبحانه وتعالى… ثم الأظهر من قول أهل الحق التأويل
অর্থ: এসমস্ত আয়াত ও হাদীসের ক্ষেত্রে হক্বপন্থীদের মাজহাব হল, আল্লাহর জন্য অসম্ভব বাহ্যিক অর্থটি পরিত্যাগ করতে হবে। বাহ্যিক অর্থ পরিত্যাগ করার পর তা’বীল করা উত্তম নাকি না করা উত্তম? যেমন বাহ্যিক অর্থ পরিত্যাগের পর কেউ আল্লাহর শান অনুযায়ী উক্ত শব্দকে আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করল। এবং শব্দের প্রকৃত অর্থ আল্লাহর দিকে ন্যস্ত করল। (এটি মূলত: তাফয়ীজ)। আহলে হক্বের উভয় বক্তব্যের মধ্যে তা’বীল অধিক স্পষ্ট।
(শরহু সহীহ মুসলিম লিল উব্বী, ২/৩৮৫)
৪। ‘ইস্তিওয়া’ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ইমাম ইবনে কাসীর রহ: বলেন,
للناس في هذا المقام مقالات كثيرة، ليس هذا موضع بسطها، وإنما نسلك في هذا المقام مذهب السلف الصالح: مالك، والأوزاعي والثوري، والليث بن سعد، والشافعي، وأحمد وإسحاق وغيرهم من أئمة المسلمين قديما وحديثا وهي إمرارها كما جاءت، من غير تكييف، ولا تشبيه، ولا تعطيل، والظاهر المتبادر إلى أذهان المشبهين منفي عن الله
অর্থ: ‘ইস্তিওয়া’ বিষয়ে আলিমগণের বিস্তর আলোচনা-পর্যালোচনা রয়েছে। বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে আমরা সালাফে-সালেহীনের মাজহাব অনুসরণ করব। যেমন, ইমামা মালিক, আওজায়ী, সুফিয়ান সাউরী, লাইস ইবনে সা’য়াদ, শাফেয়ী, আহমাদ বিন হাম্বল, ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহ সহ পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের মাজহাব। তারা এসব শব্দকে যেভাবে আছে সেভাবে রাখতেন। কাইফ সাব্যস্ত করতেন না। সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য দিতেন না। সিফাতকে অস্বীকারও করতেন না। তাদের মতে, এসব শব্দের বাহ্যিক যে অর্থ সাদৃশ্যবাদীদের মাথায় আসে, এটি কখনও আল্লাহর জন্য প্রযোজ্য নয়।
(তাফসীরে ইবনে কাসীর, খ:২, ২৮০)
৫। মোল্লা আলী ক্বারী রহ: মেরকাতে নুজুলের উপর বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি ইমাম নববী রহ: উল্লেখিত বক্তব্য উল্লেখ করে লিখেছেন,
وبكلامه وبكلام الشيخ الرباني أبي إسحاق الشيرازي وإمام الحرمين والغزالي وغيرهم من أئمتنا وغيرهم يعلم أن المذهبين متفقان على صرف تلك الظواهر كالمجيء والصورة والشخص والرجل والقدم واليد والوجه والغضب والرحمة والاستواء على العرش والكون في السماء وغير ذلك عما يفهمه ظاهرها، لما يلزم عليه من محالات قطعية البطلان تستلزم أشياء يحكم بكفرها بالإجماع، فاضطر ذلك جميع الخلف والسلف إلى صرف اللفظ عن ظاهره.
وإنما اختلفوا هل نصرفه عن ظاهره معتقدين اتصافه سبحانه بما يليق بجلاله وعظمته من غير أن نؤوله بشيء آخر، وهو مذهب أكثر أهل السلف وفيه تأويل إجمالي، أو مع تأويله بشيء آخر وهو مذهب أكثر أهل الخلف، وهو تأويل تفصيلي، ولم يريدوا بذلك مخـالفة السلف الصالح – معاذ الله أن يظن بهم ذلك – وإنما دعت الضرورة في أزمنتهم لذلك، لكثرة المجسمة والجهمية وغيرها من فرق الضلال، واستيلائهم على عقول العامة، فقصدوا بذلك ردعهم وبطلان قولهم، ومن ثم اعتذر كثير منهم وقالوا: لو كنا على ما كان عليه السلف الصالح من صفاء العقائد وعدم المبطلين في زمنهم لم نخض في تأويل شيء من ذلك
অর্থ: ইমাম নববী রহ:, ইমাম আবু ইসহাক সিরাজী রহ:, ইমামুল হারামাইন রহ, ইমাম গাজালী রহ: সহ আমাদের অন্যান্য ইমামগণের বক্তব্য হল, তা’বীল ও তাফয়ীজের উভয় মাজহাবের সকলে এসব আয়াত ও হাদীসের বাহ্যিক অর্থ পরিত্যাগের ব্যাপারে একমত। যেমন, আগমন, সুরত, শাখস (ব্যক্তি), পা, হাত, চেহারা, রাগ, রহমত, আরশের উপর ইস্তাওয়া, আসমানে থাকা। ইত্যাদি। এগুলোর বাহ্যিক অর্থ পরিত্যাগ করতে হবে। কেননা, আল্লাহর জন্য এগুলোর বাহ্যিক অর্থ সাব্যস্ত করাও অসম্ভব। এগুলোর বাহ্যিক অর্থ আল্লাহর জন্য সাব্যস্তকরণ অকাট্যভাবে বাতিল। এগুলোর বাহ্যিক অর্থে বিশ্বাস করলে সকলের ঐকমত্যে (ইজমা) কুফুরী হবে। এজন্য সালাফ ও পরবর্তীগণ বাধ্য হয়ে বাহ্যিক অর্থ পরিত্যাগ করেছেন।
মতবিরোধের বিষয় হল, বাহ্যিক অর্থ পরিত্যাগের পরে কি উক্ত বিষয়কে আল্লাহর শান অনুযায়ী আল্লাহর গুণ মনে করব; এবং কোন ধরণের তা’বীল থেকে বিরত থাকব নাকি অন্য কোন অর্থে তা’বীল করব? প্রথমটি অধিকাংশ সালাফের মাজহাব। সালাফের এই মাজহাবে বাহ্যিক অর্থ পরিত্যাগের কারণে তা’বীল ইজমালী (সামগ্রিক তা’বীল) পাওয়া যায়। দ্বিতীয় মতটি (বাহ্যিক অর্থ পরিত্যাগের পর অন্য অর্থে শব্দকে তা’বীল করা) পরবর্তী অধিকাংশ আলিমের মাজহাব। এটি মূলত: তা’বীলে তাফসীলি (সুস্পষ্ট তা’বীল)।
পরবর্তীগণ তাদের এই মাজহাবের দ্বারা নাউজুবিল্লাহ কখনও সালাফের বিরোধীতা করার ইচ্ছা করেননি। বরং যুগের চাহিদার কারণে তারা এটি করতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের সময়ে মুজাসসিমা (দেহবাদী), জাহমিয়া ও অন্যান্য ভ্রান্ত দলের অাধিক্যতার কারণে তারা এ মাজহাবটি ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেন। এসব ভ্রান্ত দল সাধারণ মানুষের বিবেকের উপর রাজত্ব করতে শুরু করে। এজন্য পরবর্তীগণ সুস্পষ্ট তা’বীলের দ্বারা তাদের ভ্রান্তি তুলে ধরেন। তাদের মতবাদ খণ্ডন করেন। পরবর্তী অনেক আলিম ওজর পেশ করে বলেছেন, সালাফের যুগের মতো আকিদার পরিশুদ্ধি এবং ভ্রান্ত দলগুলোর উপস্থিতি যদি না থাকত, তাহলে আমরা এগুলোর তা’বীল করতাম না।
(মেরকাত, খ:২, পৃ:১৩৬)
৬। জালালুদ্দিন সূয়ুতী রহ: বলেন,
من المتشابه آيات الصفات… وجمهور أهل السنة منهم السلف وأهل الحديث على الإيمان وتفويض معناها المراد منها إلى الله تعالى، ولا نفسرها مع تنزيهنا له – تعالى – عن حقيقتها
অর্থ: সিফাতের আয়াতগুলো মুতাশাবিহ এর অন্তর্ভূক্ত। সালাফ এবং মুহাদ্দিসগণসহ অধিকাংশ আহলে সুন্নতের মাজহাব হল, এসব শব্দের উপর ইমান রাখতে হবে। শব্দের উদ্দেশ্য ও অর্থকে আল্লাহর দিকে ন্যস্ত করতে হবে (তাফয়ীজ)। এগুলোর কোন বিশ্লেষণ করা হবে না। বিশ্বাস রাখতে হবে, শব্দের বাহ্যিক অর্থ থেকে আল্লাহ তায়ালা মুক্ত ও পবিত্র (তানজীহ)।
(আল-ইতকান ফি উলুমিল কুরআন, খ:২, পৃ:১০)
এখানে সুয়ূতী রহ: তাফয়ীজ মায়াত তানজীহ এর কথা বলেছেন।
তানজীহ সম্পর্কে স্বয়ং সালাফের বক্তব্য
কোন শব্দের বাহ্যিক অর্থ যদি ত্রুটি, অপূর্ণতা, সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য, সৃষ্টিগত সীমাবদ্ধতা অথবা আল্লাহর জন্য প্রযোজ্য নয়, এমন হয় তাহলে সালাফসহ সকলের মতে ঐ শব্দের বাহ্যিক অর্থটি পরিত্যাগ করতে হবে। আল্লাহর সমস্ত সিফাতের ক্ষেত্রে সৃষ্টির যাবতীয় সাদৃশ্য ও সীমাবদ্ধতা থেকে পবিত্রতা ঘোষণা করতে হবে। একে পরিভাষায় তানজীহ বলে। আমরা সবাই বিশ্বাস করি, ইলম বা জ্ঞান হল আল্লাহর একটি গুণ। এক্ষেত্রে তানজীহ হল, আল্লাহর ইলম বলতে কখনও অজানা জিনিসকে জানা বোঝান হবে না। আল্লাহ সর্বময় জ্ঞানী। তিনি অনাদী থেকে সব কিছু জানেন। আগে জানতেন না, নতুন করে জানার মাধ্যমে ইলম হয়েছে এমন নয়।
এভাবে আল্লাহর সমস্ত সিফাতের ক্ষেত্রে তানজীহ থাকতে হবে। দেহবাদী ও সাদৃশ্যবাদীরা ছাড়া আহলে সুন্নতের সকলেই তানজীহের ব্যাপারে একমত। আল্লাহর সিফাতের ক্ষেত্রে তানজীহ না থাকলে অধিকাংশ সময় কুফুরী শিরকীর সম্ভাবনা থেকে যায়।
আমরা এখানে তানজীহের ব্যাপারে সালাফের বক্তব্য উল্লেখ করব। সালাফের বক্তব্যগুলোকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। ১। ইসবাত মায়াত তানজীহ। ২। তাফয়ীজ মায়াত তানজীহ। সিফাত সাব্যস্তের সাথে সাথে যারা তানজীহ করেছেন তাদের বক্তব্যগুলো শুরুতে উল্লেখ করছি। আর যারা পুরো বিষয়টাকে তাফয়ীজ করেছেন, সেই সাথে তাফয়ীজ করেছেন, তাদের বক্তব্য পরবর্তীতে উল্লেখ করব ইনশা আল্লাহ।
১। ইমাম আবু হানিফা রহ (মৃত:১৫০ হি:)
ইমাম আবু হানিফা রহ: জান্নাতবাসীর জন্য আল্লাহর দর্শন সাব্যস্ত করেছেন। সেই সাথে তিনি স্পষ্ট ভাষায় তানজীহ করেছেন। সৃষ্টির কোন কিছুকে দেখার যাবতীয় সীমাবদ্ধতা থেকে আল্লাহর দর্শনকে মুক্ত বিশ্বাস করতে হবে। যেমন, সৃষ্টির কোন কিছুকে দেখার জন্য দর্শনীয় বস্তুটি কোন একটা দিকে থাকতে হয়। কিন্তু আল্লাহর দর্শনের ক্ষেত্রে কোন দিক সাব্যস্ত করা যাবে না। এজাতীয় সৃষ্টির যত বৈশিষ্ট্য বা সীমাবদ্ধতা সবগুলো থেকে আল্লাহ তায়ালা মুক্ত।
ইমাম আবু হানিফা রহ. আরও বলেন,
“ولقاء الله تعالى لأهل الجنة بلا كيف ولا تشبيه ولا جهةٍ حقٌّ”
অর্থ: কোন সাদৃশ্য, অবস্থা (কাইফ) ও দিক ব্যতীত জান্নাতবাসীর জন্য আল্লাহ তায়ালার দর্শন সত্য।
[কিতাবুল ওসিয়্যা, পৃ.৪, শরহে ফিকহুল আকবার, মোল্লা আলী কারী, পৃ.১৩৮]
ইমাম আবু হানিফা রহ: হাতকে আল্লাহর সিফাত বলেছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি হাতের বাহ্যিক অর্থ পরিত্যাগ করে তানজীহ করেছেন। তিনি বলেছেন, আল্লাহর হাত বলতে কোন অঙ্গ উদ্দেশ্য নয়। হাত বলে অঙ্গ উদ্দেশ্য নিলে সাদৃশ্যবাদ ও দেহবাদ হয়। এজন্য তিনি হাতের বাহ্যিক অর্থ পরিত্যাগ করেছেন।
ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেন,
يد الله فوق أيديهم ليست كأيدي خلقه و ليست بجارحة، و هو خالق الأيدي
অর্থ: আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর, তার হাত তার সৃষ্টির হাতের মত নয়; তা অঙ্গ নয়; তিনি হস্ত সমূহের স্রষ্টা।
[ইমাম আবু হানীফা, আল-ফিকহুল আবসাত, পৃঃ ৫৭]
ইমাম আবু হানিফা রহ. আল -ফিকহুল আকবারে বলেছেন, আল্লাহর হাত আল্লাহর একটি গুণ বা বিশেষণ। সুতরাং আল্লাহর হাত দ্বারা ইমাম আবু হানিফা রহ. আল্লাহর একটি বিশেষ গুণ উদ্দেশ্য নিয়েছেন। এটি আল্লাহর কোন অঙ্গ বা অংশ নয। আপনার ইলম আপনার গুণ, আপনার হাত আপনার কোন গুণ নয়। সুতরাং আল্লাহর হাতের ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানিফা রহ. হাতের প্রচলিত অর্থ উদ্দেশ্য নেননি বরং এটিকে আল্লাহর বিশেষ গুণ সাব্যস্ত করেছেন। হাতের বাহ্যিক অর্থ পরিত্যাগ করে তিনি স্পষ্ট তানজীহ করেছেন।
২। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহ (মৃত:২৪১ হি:)
ইমাম আহমাদ রহ: থেকে খুবই স্পষ্ট ভাষায় তানজীহ বর্ণিত হয়েছে। তিনি আল্লাহর জন্য ইয়াদ বা হাত সাব্যস্ত করেছেন। কিন্তু তিনি হাতের সমস্ত বাহ্যিক অর্থ পরিত্যাগ করে তানজীহ করেছে। তিনি বলেছেন, হাত কোন অঙ্গ নয়। এটি দেহ বা দেহ জাতীয় কিছু নয়। এটি নিছক আল্লাহর একটি গুণ বা বিশেষণ।
একইভাবে তিনি আল্লাহর ‘ওয়াজহ’ বা চেহারা সাব্যস্ত করেছেন। কিন্তু তিনি চেহারার সমস্ত বাহ্যিক অর্থ পরিত্যাগ করেন। চেহারা দ্বারা কোন আকার-আকৃতি, প্রতিচ্ছবি বা এজাতীয় কোন অর্থ নেয়া যাবে। ‘ওয়াজহ’ বা চেহারা তার নিকট একটি গুণ।
আল্লাহর ইস্তিওয়ার ক্ষেত্রেও তিনি স্পষ্ট তানজীহ করেছেন। ইস্তিওয়ার সমস্ত বাহ্যিক অর্থ ও উদ্দেশ্য তিনি পরিত্যাগ করেছেন। কোন কিছু স্পর্শ করে, কোন বস্তুর সাপেক্ষে অবস্থান করে তিনি ইস্তিওয়া করেননি। আর ইস্তিওয়ার কারণে আল্লাহর কোন গুণে পরিবর্তন হয়নি। নতুন কোন গুণ তিনি অর্জন করেননি। ইস্তিওয়ার কারণে তিনি সীমিত বা সীমাবদ্ধ হননি।
এভাবে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহ: সকল ক্ষেত্রে স্পষ্ট তানজীহ করেছেন।
ইমাম তামিমী রহ: বর্ণনা করেন,
وَكَانَ يَقُول إِن لله تَعَالَى يدان وهما صفة لَهُ فِي ذَاته ليستا بجارحتين وليستا بمركبتين وَلَا جسم وَلَا جنس من الْأَجْسَام وَلَا من جنس الْمَحْدُود والتركيب والأبعاض والجوارح وَلَا يُقَاس على ذَلِك لَا مرفق وَلَا عضد وَلَا فِيمَا يَقْتَضِي ذَلِك من إِطْلَاق قَوْلهم يَد إِلَّا مَا نطق الْقُرْآن بِهِ أَو صحت عَن رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم السّنة فِيهِ
অর্থ: তিনি বলতেন, মহান আল্লাহর দুটি হস্ত বিদ্যমান। এদুটি তার সত্ত্বার বিশেষণ। হস্তদ্বয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নয়, দেহের অংশ নয়, দেহ নয়, দেহ জাতীয় কিছু নয়, সীমা সংযোজন, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জাতীয় কিছুই নয়। এ বিষয়ে কিয়াস-যুক্তি অচল। এতে কনুই, বাহু ইত্যাদি কোনো কিছুর অস্তিত্ব কল্পনার সুযোগ নেই। কোরআন ও হাদীসে যতটুকু বলা হয়েছে তার অতিরিক্ত মানুষের ব্যাবহার থেকে কিছু সংযোজন করা যাবে না।
(ই’তিকাদুল ইমামিল মুনাব্বাল আহমাদ ইবনু হাম্বল, পৃ:২২)
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহ: আল্লাহর ‘ওয়াজহ’ বা চেহারার ক্ষেত্রেও একই কথা বলেছেন। এক্ষেত্রে চেহারা বা মুখমণ্ডলের সমস্ত বাহ্যিক অর্থ পরিত্যাগ করেছেন। এগুলোর বাহ্যি অর্থ তথা দেহের আকার-আকৃতি উদ্দেশ্য নিলে ইমাম আহমাদ রহ: এর নিকট সে বিদআতি। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহ: বলেন,
أَن لله عز وَجل وَجها لَا كالصور المصورة والأعيان المخططة بل وجهة وَصفه
মহান আল্লাহর একটি ‘ওয়াজহ’ বা মুখমণ্ডল আছে। তার মুখমণ্ডল প্রতিচ্ছবি বা আকৃতি নয় এবং আঁকানো বস্তুর মতও নয়। বরং মুখমণ্ডল তার একটি মহান বিশেষণ।
(ই’তিকাদুল ইমামিল মুনাব্বাল আহমাদ ইবনু হাম্বল, পৃ:১৭)
আরও স্পষ্ট ভাষায় ইমাম আহমাদ রহ: এর তানজীহ বর্ণিত হয়েছে এভাবে,
وَلَيْسَ معنى وَجه معنى جَسَد عِنْده وَلَا صُورَة وَلَا تخطيط وَمن قَالَ ذَلِك فقد ابتدع
তার(ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বলের) মতে মুখমণ্ডল অর্থ দেহ, ছবি বা আকৃতি নয়। যদি কেউ তা(মুখমণ্ডলকে দেহ বা আকৃতি) বলে তাহলে সে বিদআতি।
(ই’তিকাদুল ইমামিল মুনাব্বাল আহমাদ ইবনু হাম্বল, পৃ:১৭)
আল্লাহর ‘ইস্তিওয়া’ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ: তানজীহ করে বলেন,
و لا يجوز ان يقال استوي بمامسة ولا بملاقة تعالى الله عن ذلك علوا كبيرا ولم يلحقه تغير ولا تبدل ولا يلحقه الحدود قبل خلق العرش ولا بعد خلق العرش
অর্থ: একথা বলা বৈধ হবে না যে, তিনি কোন কিছু স্পর্শ করে বা কোন কিছুর সাপেক্ষে ইস্তিওয়া করেছেন। আল্লাহ তায়ালা এগুলো থেকে মহাপবিত্র। আরশ সৃষ্টির আগে বা পরে ইস্তিওয়ার কারণে আল্লাহর সত্ত্বাগত বা গুণগত কোন পরিবর্তন হয়নি। তিনি কোথাও সীমাবদ্ধ হননি।
৩। ইমাম ইসমাইলী (মৃত: ৩৭১ হি:) এর বক্তব্য:
وخلق ادم بيده، و يداه مبسوطتان ينفق كيف شاء بلا اعتقاد كيف يداه، اذ لم ينطق كتاب الله تعالى فيه بكيف. ولا يعتقد فيه الاعضاء و الجوارح و لا الطول ولا العرض ولا الغلظ و الدقة ونحو هذا مما يكون مثله في خلق، و انه ليس كمثله شيء
অর্থ: আল্লাহ তা’য়ালা তার ‘ইয়াদ’ দ্বারা আদম আদম আ: কে সৃষ্টি করেছেন। আল্লার উভয় হাত প্রশস্ত। তিনি যেভাবে ইচ্ছা দান করেন। আল্লাহর হাতের ব্যাপারে কোন কাইফিয়ত বিশ্বাস করা যাবে না। হাতের কাইফ বা ধরণ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে কিছু বলা হয়নি। তবে আল্লাহর হাতের ক্ষেত্রে কখনও এটা বিশ্বাস করা যাবে না যে, এটি কোন অঙ্গ। হাতের ক্ষেত্রে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, পুরুত্ব, গভীরতা মোটকথা দেহজাতীয় কোন কিছুই সাব্যস্ত করা যাবে না। আল্লাহর সিফাতের ক্ষেত্রে সৃষ্টির কোন বৈশিষ্ট্য সাব্যস্ত করা যাবে না। মহান আল্লাহর সাথে তুলনীয় কিছুই নেই।
(ই’তিকাদু আহলিল হাদীস, পৃ:৫১)
৪। ইমাম আবুল হাসান আশআরী রহ (মৃত ৩২৪ হি:)
ইমাম আবুল হাসান আশআরী রহ: আল্লাহর জন্য আগমন (মাজী) ও অবতরণ (নুজুল) সাব্যস্ত করেছেন। সেই সাথে তিনি তানজীহ করেছেন। আগমনের বাহ্যিক অর্থ পরিত্যাগ করেছেন। একইভাবে স্পষ্টভাষায় নুজুলের বাহ্যিক অর্থ পরিত্যাগ করেছেন। কেননা এসব শব্দের বাহ্যিক অর্থ সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য ও সীমাবদ্ধতা। আল্লাহ তায়ালা এধরণের সীমাবদ্ধতা বা সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য থেকে মুক্ত। যেমন, নুজুল এর বাহ্যিক অর্থ হল, উপর থেকে নীচে নামা। কিন্তু এই অাক্ষরিক অর্থটি সৃষ্টির জন্য প্রযোজ্য। আল্লাহর নুজুল দ্বারা কখনও উপর থেকে নীচে নামা বা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন বোঝাবে না। এটি সমস্ত সালাফের মাজহাব। তারা সকল ক্ষেত্রে সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ সমস্ত অর্থ পরিত্যাগ করে আল্লাহর জন্য সিফাত সাব্যস্ত করেছেন।
واجمعوا على انه يجئ يوم القيامة و الملك صفا صفا لعرض الامم و حسابها و عقابها و ثوابها، فيغفر لمن يشاء من المذنبين ويعذب منهم يشاء، كما قال: و ليس مجيئه حركة ولا زوالا، وإنمايكون المجئ حركة و زوالا إذا كان الجائي جسما آو جوهرا، فاذا ثبت انه ليس بجسم ولا جوهر، لم يجب ان يكون مجيئه نقلة او حركة، الا تري انهم لا يريدون بقولهم: جائت زيدا الحمى، انها تنقلت اليه او تحركت من مكان كان فيه اذ لم تكن جسم و لا جوهرا، و انما مجيئها اليه وجودها به. وانه ينزل الى سماء الدنيا كمارو النبي صلي الله عليه وسلم ، وليس نزوله نقلة لأنه ليس بجسم و لا جوهر
অর্থ: তারা এ বিষয়ে ঐকমত্য করেছেন যে, আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন আগমন করবেন। ফেরেশতাগণ সারিবদ্ধভাবে থাকবে। মানুষকে হিসাবের জন্য আল্লাহর সামনে উপস্থিত করা হবে। হিসেব, ভালো-মন্দের বিচার ও শাস্তি হবে। পাপীদের যাকে ইচ্ছা তাকে আল্লাহ মাফ করবে। যাকে ইচ্ছা শাস্তি দিবেন। যেমনটি পবিত্র কুরআনে রয়েছে। আল্লাহর আগমন হরকত বা নড়াচড়া বোঝায় না। আল্লাহর আগমন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন নয়। আগমনকারী দেহবিশিষ্ট বা জাওহার (মৌল উপাদান) হলে তার আগমন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা স্থানান্তরের মাধ্যমে হয়। আল্লাহ তায়ালা যেহেতু দেহবিশিষ্ট বা মৌল উপাদান নন, এজন্য তার আগমন জায়গা পরিবর্তন বোঝায় না। আল্লাহর আগমন কোন হরকত বা গতি বোঝায় না।
যেমন, আমরা যখন বলি, جائت زيدا الحمى (যায়েদের জ্বর এসেছে)। জ্বর এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় এসেছে, এটা বোঝায় না। জ্বর যেহেতু দেহ বা মৌল উপাদান নয়, এজন্য জ্বরের আগমন বলতে কখনও জায়গা পরিবর্তন বোঝায় না। যায়েদের জ্বর এসেছে বলতে মূলত: যায়েদের শরীরে জ্বরের উপস্থিতি বোঝানো হয়েছে।
একইভাবে হাদীসে এসেছে, আল্লাহ তায়ালা প্রথম আসমানে নেমে আসেন। আল্লাহর নেমে আসার দ্বারা কখনও এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন বা উপর থেকে নীচে নামা উদ্দেশ্য নেয়া হবে না। কেননা আল্লাহ তায়ালা দেহ বা মৌল উপাদান নন।
(রিসালাতুন ইলা আহলিস সাগর, পৃ:২২৮)
৫। ইমাম আবু মানসুর মাতুরিদি রহ (মৃত: ৩৩৩ হি:)
ইমাম মাতুরিদি রহ: পরকালে আল্লাহর দর্শন সাব্যস্ত করেছেন। কিন্তু সেই সাথে সুস্পষ্ট ভাষায় তানজীহ করেছেন। আল্লাহর দর্শন সব ধরণের সৃষ্টির বৈশিস্ট্য বা সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হবে। সৃষ্টির কোন কিছুকে দেখার জন্য উভয়ের মধ্যে ন্যুনতম একটি দূরত্ব থাকতে হয়। আর খুব বেশি দূরের বস্তু মানুষ দেখতে পায় না। দর্শনীয় বস্তু আমাদের সামনের দিকে থাকতে হয়। একটি নির্দিষ্ট পরিমাপের আলোর প্রতিফলন থাকতে হয়। এধরণের বহু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কোন কিছু দেখার জন্য সৃষ্টির যত সীমাবদ্ধতা রয়েছে, আল্লাহর দর্শন এসব কিছু থেকে মুক্ত হবে। এটি মূলত: তানজীহ। আহলে সুন্নতের আলেমগণ সিফাত সাব্যস্ত করেন। সেই সাথে স্পষ্ট ভাষায় তানজীহ করে বলেন, আল্লাহ সৃষ্টির সীমাবদ্ধতা বা বৈশিষ্ট্য থেকে মুক্ত। এজাতীয় যত সীমাবদ্ধতা আমাদের কল্পনায় আসে, সব কিছু থেকে মহান আল্লাহ তায়ালাকে মুক্ত ও পবিত্র বিশ্বাস করাই হল, সালাফের ঐকমত্যপূর্ণ মাজহাব।
ইমাম আবু মানসুর মাতুরিদি রহ: তার ‘কিতাবুত তাউহীদ’-এ লিখেছেন,
فان قيل كيف يرى قيل بلا كيف؛ إذ الكيفية تكون لذي صورة، بل يري بلا وصف قيام وقعود، و اتكاء و تعلق، واتصال و انفصال، و مقابلة و مدابرة، و قصير و طويل، و نور و ظلمة، و ساكن و متحرك، ومماس و مباين، و خارج و داخل، ولا معنى يأخذه الوهم أو يقدره العقل، لتعاليه عن ذلك
كتاب التوحيد-٨٥
অর্থ: যদি প্রশ্ন করা হয়, পরকালে আল্লাহ তায়ালাকে কীভাবে দেখা যাবে? উত্তর দেয়া হবে, কোন কাইফ বা ধরণ ব্যতিরেকে। কেননা আকার-আকৃতি বিশিষ্ট বস্তুর দেখার ধরণ বা কাইফ থাকে। আল্লাহর দর্শন সব ধরণের সৃষ্টির সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হবে। যেমন, দাঁড়ান, বসা, হেলান দেয়া, মিলিত বা পৃথক থাকা, সামনে বা পেছনে থাকা, লম্বা বা খাট হওয়া, অন্ধকার বা আলোতে থাকা, স্থির বা গতিশীল হওয়া, স্পর্শে বা দূরত্বে থাকা, ভেতরে বা বাইরে থাকা এজাতীয় সব ধরণের সৃষ্টির সীমাবদ্ধতা থেকে আল্লাহ তায়ালা মুক্ত। (সৃষ্টিকে দেখতে হলে এসব সীমাবদ্ধতা থাকে, কিন্তু মহান স্রষ্টার ক্ষেত্রে এধরণের সীমাবদ্ধতার কল্পনাও করা যাবে না)। আমাদের ধারণা বা চিন্তাশক্তি কোন কিছু দেখার জন্য যা কিছু কল্পনা করে, সব কিছু থেকে আল্লাহ তায়ালা মুক্ত ও পবিত্র।
(কিতাবুত তাউহীদ-৮৫)
ইমামগণের বক্তব্যগুলো লক্ষ্য করুণ। সালাফের বক্তব্যের সাথে কারও কোন বিরোধ নেই। ইমাম আবুল হাসান আশআরী রহ ও ইমাম আবু মানসুর মাতুরিদি রহ: এর বক্তব্যের সাথে ইমাম আবু হানিফা রহ: বা ইমাম আহমাদ রহ: এর বক্তব্যের কি কোন বিরোধ চোখে পড়ে? এতোদিন আশআরী-মাতুরিদিগণকে বিদআতী প্রচার করছেন, তারা কি আদৌ সালাফের আকিদা সঠিকভাবে বুঝেছেন? আর বুঝে থাকলে সালাফের মত ও পথের উপর অটল আছেন? আমরা ইনশা আল্লাহ পরবর্তী আলোচনাগুলোতেও দেখব যে, আশআরী-মাতুরিদিগণ কীভাবে সালাফের মানহাজকে সংরক্ষণ করেছেন। সালাফের পদাঙ্ক অনুসরণে তারা বিন্দুমাত্রও ত্রুটি করেননি।
৬। ইমাম আলী রেজা ইবনে মুসা কাজিম রহ: (মৃত:২০৩ হি:)
ইমাম আবুশ শায়খ তার ‘আজমা’-তে সনদসহ বর্ণনাটি উল্লেখ করেছেন। মাহদি বিন সাবেক রহ: বলেন,
قدم قوم من وراء النهر علي علي بن موسى فقالوا: نسألك عن مسائل لا يعلمها الا عالم، فقال: سلوا عما شئتم. قالوا: اخبرنا عن معتمد رب العالمين عز ذكره اين كان و كيف كان إذ لا ارض ولا سماء ولا شيئ؟
فقال: معتمد رب العالمين عز ربنا وجل انه هو اين الأين و كيف الكيف و لا كيفية له وكان معتمده على قدرته. فقالوا: نشهد انك عالم اهل الارض.
فقال: الحمد لله الذي لا يحس و لا يمس و لا يجس، و لا تدركه الحواس الخمسة، و لا تصفه الأوهام و لا تبلغه العقول، لم ترى ربنا العيون فتخبر بجيوثيته أو أينونيته أو محدوديته أو كيفوفيته، هو العلي الأعلى حيث ما ينبغي يوحد
العظمة -١/٤.٥
অর্থ: মধ্য এশিয়া থেকে একদল লোক ইমাম আলী ইবনু মুসা কাজিম রহ (মৃত:২০৩ হি:) এর নিকট আগমন করল। তারা বলল, আমরা আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই। বিজ্ঞ আলিমই শুধু এর উত্তর দিতে পারবে।
তিনি বললেন, তোমরা প্রশ্ন করতে পারো।
তারা বলল, যখন কোন আসমান ছিল না, জমিন ছিল না, কোন কিছুই ছিল না, তখন আল্লাহ তায়ালা কোথায় ছিলেন? এ বিষয়ে সঠিক আকিদা-বিশ্বাস কী?
তিনি বলেন, আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস হল, তিনিই ‘কোথায়’ বলার মত জায়গাকে অস্তিত্ব দিয়েছেন। সব কিছুর ধরণ ও কাইফিয়তের স্রষ্টা তিনি। কোথায়-কেমন এগুলোর স্রষ্টা হলেন তিনি। তার কোন কাইফিয়ত (পরিবর্তনশীল অবস্থা, গুণ বা ধরণ) নেই। তিনিই সর্বশক্তিমান। (অর্থাৎ কোথায়-কেমন এগুলো থেকে আল্লাহ তায়ালা মুক্ত, এগুলোর স্রষ্টা তিনি।)
উত্তর শুনে তারা বলল, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি বিশ্বসেরা আলিম।
এরপর তিনি বললেন,
‘সমস্ত প্রশংসা সেই সত্ত্বার যাকে অনুভূতি শক্তি ধারণ করতে পারে না। যাকে স্পর্শ করা যায় না। পঞ্চ ইন্দ্রিয় যাকে বুঝতে পারে না। কল্পনাশক্তি যাকে কল্পনা করতে পারে না। বিবেক যাকে ধারণ করতে পারে না। কোন চোখ তাকে দেখেনি। তার গঠন, অবস্থান, সীমা বা অবস্থা মানুষ কীভাবে বলতে পারে? তিনি সব কিছু থেকে মহান। তাকে সীমাবদ্ধ করা কখনও শোভনীয় নয়।
(আল-আজমা, আবুশ শায়খ, খ:১, পৃ:৪০৫)
ইমাম আলী রেজা ইবনে মুসা কাজিম রহ: ১৪৮ হিজরীতে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। সালাফের যুগের বিখ্যাত ইমাম। সুবহানাল্লাহ। কতো স্বচ্ছ আকিদা-বিশ্বাস লালন করতেন!
তাফয়ীজ মায়াত তানজীহ সম্পর্কে সালাফের বক্তব্য
প্রথম যুগের সালাফগণ সিফাত বিষয়ে যথেষ্ট রক্ষণশীল ছিলেন। তারা এসব বিষয়ে আলোচনা পছন্দ করতেন না। চুপ থাকাকেই তারা শ্রেয় মনে করতেন। এগুলো সিফাত বলা, অর্থ করা বা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার বিরোধী ছিলেন। এমনকি সালাফের অনেকে এগুলোকে আরবী বা অন্য ভাষায় অর্থ করাও পছন্দ করতেন না। তারা এক্ষেত্রে পরিপূর্ণ তানজীহের উপর ছিলেন। শব্দের বাহ্যিক অর্থ বা উদ্দেশ্য বা উদ্দেশ্য আল্লাহর জন্য প্রযোজ্য হলে তারা এগুলোর অর্থ করা বা অনুবাদের বিরোধী হতেন না। বরং তারা এগুলোর প্রতি মানুষকে দাওয়াত দিতেন। কিন্তু বাস্তবতা হল, প্রাথমিক যুগের সালাফগণ মানুষকে এসব বিষয়ের দাওয়ার দেয়ার পরিবর্তে এগুলো থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতেন।
১। সুফিয়ান বিন উয়াইনা রহ (১০৭-১৯৮ হি:)
সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা রহ: এর মতে সিফাতের বিষয়গুলোর কোন ধরণের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হবে না। অর্থ নির্ধারণ, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, আরবীতে উদ্দেশ্য নির্ধারণ কিংবা অন্য কোন ভাষায় অনুবাদ এসব কিছুর বিরোধী ছিলেন তিনি। তার মতে সিফাতের আয়াত বা হাদীস পড়ে চুপ থাকতে হবে। চুপ থাকাই ছিল তার মূল মাজহাব।
مَا وَصَفَ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى بِهِ نَفْسَهُ فِي كِتَابِهِ فَقِرَاءَتُهُ تَفْسِيرُهُ ، لَيْسَ لأَحَدٍ أَنْ يُفَسِّرَهُ بِالْعَرَبِيَّةِ وَلا بِالْفَارِسِيَّةِ
অর্থ: আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে নিজের সম্পর্কে যা বলেছেন, সেগুলো পাঠ করাই হল এর তাফসীর। কারও জন্য এগুলোকে আরবীতে বা ফার্সীতে ব্যাখ্যা করা বৈধ নয়।
( আল-আসমা ওয়াস সিফাত, ইমাম বাইহাকী রহ, পৃ:৩১৪)
তিনি আরও বলেছেন,
كل ما وصف الله به نفسه في كتابه فتفسيره تلاوته والسكوت عليه
অর্থ: আল্লাহ তার কিতাবে নিজের সম্পর্কে যা কিছু বলেছেন, এগুলো তেলাওয়াত (পাঠ) হল এর তাফসীর। তেলাওয়াত করে চুপ থাকতে হবে।
(আল-ই’তিকাদ, ইমাম বাইহাকী রহ, পৃ: ১১৮)
এটা তো সবারই জানা কথা যে, শুধু তেলাওয়াত কখনও তাফসীর নয়। এরপরেও ইমাম ইবনে উয়াইনা রহ: শুধু তেলাওয়াতকে তাফসীর বলেছেন। এর দ্বারা মূলত: তিনি সিফাতের বিষয়ে আলোচনা থেকে বিরত থাকা, অর্থ ও উদ্দেশ্য বর্ণনা না করাসহ সব ধরণের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ থেকে বিরত থাকার কথা বলেছেন। বিষয়টাকে স্পষ্ট করার জন্য তিনি বলেছেন তেলাওয়াতের পর এ বিষয়ে কোন আলোচনা হবে না। বরং চুপ থাকতে হবে।
তারা মূলত: পুরো বিষয়টাকে আল্লাহর উপর ন্যস্ত করেছেন। কুরআন-হাদীসে যা রয়েছে, সেগুলোর সত্যতার উপর মৌলিক ইমান রাখতে হবে। কিন্তু যেসব বিষয় আল্লাহর জন্য প্রযোজ্য নয়, এজাতীয় আয়াত বা হাদীসের ক্ষেত্রে শুধু তেলাওয়াত করে যেতে হবে। উদ্দেশ্য বর্ণনা বা কোন ধরণের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হবে না।
এসব আয়াত বা হাদীসের বাহ্যিক অর্থ যদি তারা আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করতেন, তাহলে কখনও চুপ থাকতে বলতেন না। তারা বলে দিতেন, এগুলোর বাহ্যিক অর্থে বিশ্বাস করো। কিন্তু কাইফিয়ত অজ্ঞাত। কিন্তু তারা স্পষ্ট করে দিয়েছেন, এগুলো শুধু তেলাওয়াত করতে হবে। আরবীতে বা ফার্সীতে এর কোন অর্থ নির্ধারণ করা হবে না। বরং এসব আলোচনা থেকে বিরত থেকে সম্পূর্ণ চুপ থাকতে হবে। তারা যদি বাহ্যিক অর্থ নিতেন তাহলে যেমন চুপ থাকার কথা বলতেন না, একইভাবে এগুলোর অনুবাদ না করারও নির্দেশ দিতেন না।
২। ইমাম মুহাম্মাদ রহ (১৮৯ হি:)
ইমাম মুহাম্মাদ রহ: বলেন,
اتفق الفقهاء كلهم من المشرق إلى المغرب على الإيمان بالقرآن والأحاديث التي جاء بها الثقات عن رسول الله – صلى الله عليه وسلم – في صفة الرب عز وجل من غير تغيير، ولا وصف، ولا تشبيه، فمن فسر اليوم شيئاً من ذلك فقد خرج مما كان عليه النبي – صلى الله عليه وسلم -، وفارق الجماعة، فإنهم لم يصفوا ولم يفسروا، ولكن أفتوا بما في الكتاب والسنة ثم سكتوا
رواه اللالكائي (3/ 432)
অর্থ: পূর্ব থেকে পশ্চিমের সমস্ত ফকীহ ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে যা কিছু বলেছেন এবং রাসূল স: থেকে বিশ্বস্তসূত্রে আল্লাহর সিফাত সম্পর্কে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে, এগুলোর উপর ইমান রাখতে হবে। এগুলোতে পরিবর্তন-পরিবর্ধন, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও সাদৃ্শ্য ব্যতিরেকে। আজ কেউ যদি এসব সিফাতের ব্যাখ্যা করে, তাহলে সে রাসূল স: এর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হল। মুসলমানদের জামাত থেকে বিচ্ছিন্ন হল। কেননা, তারা এগুলো সম্পর্কে আলোচনা করেননি, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেননি। বরং তারা কুরআন-সুন্নাহে যা আছে এরপর ফতোয়া দিয়েছেন এবং চুপ থেকেছেন।
(শরহু উসুলি ই’তিকাদি আহলিস সুন্নাহ, ইমাম লালকায়ী, খ:৩, পৃ:৪৩২)
এসব শব্দের বাহ্যিক অর্থই যদি উদ্দেশ্য হত, তাহলে চুপ থাকার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল কেন? আর কেউ এগুলোর অর্থ করলে, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করলে তিনি তাকে আহলে সুন্নতের জামাত থেকে বের করে দিলেন কেন? এতো কঠিন বক্তব্য দেয়ার কারণ কী? কেউ যদি বলে, হাত দ্বারা বাহ্যিক অর্থ উদ্দেশ্য, তাহলে তো সে হাতের ব্যাখ্যা করল। হাতের বাহ্যিক অর্থ নির্দিষ্ট করার কথা তো কুরআন-সুন্নাহে নেই। সে এটি নিজের থেকে সংযোজন করেছে। ইমাম মুহাম্মাদ রহ: এধরণের অর্থ নির্ধারণ, উদ্দেশ্য বর্ণনা বা ব্যাখ্যাকে রাসূল স: এর আদর্শের বিপরীত বলেছেন। বরং তার মতে এসব ক্ষেত্রে চুপ থাকাই হল সালাফের মানহাজ।
৩। ইমাম আবু উবাইদ কাসিম ইবনে সাল্লাম রহ ( মৃত:২২৪ হি)
ইমাম আবু উবাইদ কাসিম ইবনে সাল্লাম রহ: বলেন,
إذا سئلنا عن تفسيرها : قلنا : ما أدركنا أحدا يفسر منها شيئا ونحن لا نفسر منها شيئا نصدق بها ونسكت
অর্থ: আমাদেরকে যখন এসব হাদীসের ব্যাখ্যা জিজ্ঞেস করা হয়, আমরা এগুলোর ব্যাখ্যা করি না। আমরা এমন কাউকে পাইনি যারা এগুলোর ব্যাখ্যা করেছেন। একারণে আমরাও ব্যাখ্যা করি না। এসব হাদীসকে সত্য মনে করি এবং চুপ থাকি।
(শরহু উসুলি ই’তিকাদি আহলিস সুন্নাহ, খ:৩, পৃ:৫২৬)
ইমাম আবু উবাইদ কাসিম ইবনে সাল্লাম রহ: এর সিফাত সংক্রান্ত হাদীস বর্ণনা করতেন। তবে তিনি এগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতেন না। তিনি বলেন, আমি এমন কাউকে পাইনি যে এগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে। প্রাথমিক যুগের সালাফদের রীতি এমন ছিল। তারা এগুলোর আলোচনা পছন্দ করতেন না। এগুলোর বাহ্যিক অর্থ সাব্যস্ত করলে অর্থ ও উদ্দেশ্য স্পষ্ট হওয়ার কারণে এটি তাফসীর বা ব্যাখ্যা হিসেবে গণ্য হবে। ইমাম আবু উবাইদসহ অন্যান্য বহু সালাফ এর বিরোধী ছিলেন।
ইমাম খাত্তাবী রহ: বলেছেন,
كان ابو عبيد القاسم بن سلام وهو احد انهياء اهل العلم يقول: نحن نروي هذه الاحاديث ولا نريغ لها المعاني
অর্থ: ইমাম আবু উবায়েদ কাসিম ইবন সাল্লাম প্রথিতযশা আলিম ছিলেন। তিনি বলতেন, আমরা এসব হাদীস বর্ণনা করি, কিন্তু এগুলোর অর্থ খুঁজি না।
(আকাবিলুস সিকাত, পৃ:১৭৭)
এখানে তিনি স্পষ্ট বললেন, আমরা এগুলোর অর্থ তালাশ করি না। তার মত বহু সালাফের মানহাজ ছিল এটি।
৪। ইমাম ইবনে সুরাইজ রহ (২৪৯-৩০৬ হি:)
ইমাম ইবনে সুরাইজ রহ: বলেন,
ان السوال عن معانيها بدعة و الجواب كفر و زندقة
অর্থ: এসবের অর্থ জিজ্ঞেস করা বিদয়াত। আর এর উত্তর হল, কুফুরী ও ধর্মদ্রোহিতা।
(আল-উলু, ইমাম জাহাবী রহ, পৃ:২০৭)
ইমাম ইবনে সুরাইজ রহ: এসবের অর্থ করা বা অনুবাদ করার বিরোধী ছিলেন। তারা যদি এগুলোর বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করতেন তাহলে কখনও এসম্পর্কে প্রশ্ন করাকে বিদয়াত বলতেন। আর এর উত্তর প্রদানকে কুফুরী ও ধর্মদ্রোহিতা বলতেন না। এজাতীয় প্রশ্নের উত্তরকে কুফুরী বলার কারণ হল, এসব আয়াত বা হাদীসের বাহ্যিক অর্থ আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা কুফুরী। নুজুল দ্বারা উপর থেকে নীচে নামা উদ্দেশ্য, হাত দ্বারা অঙ্গ উদ্দেশ্য নিলে কুফুরী হবে। ইতোপূর্বে আমরা এবিষয়ে মোল্লা আলী ক্বারী রহ: এর বক্তব্য উল্লেখ করেছি। এসব আয়াত বা হাদীসের বাহ্যিক অর্থ আল্লাহর জন্য প্রযোজ্য নয়। এগুলো আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করলে কুফুরী হবে। এজন্য ইমাম ইবনে সুরাইজ রহ: এ সংক্রান্ত উত্তরকে কুফুরী ও ধর্মদ্রোহিতা আখ্যা দিয়েছেন। ইবনে সুরাইজ রহ: এসব শব্দকে অন্য ভাষায় অনুবাদেরও বিরোধী ছিলেন।
৫। ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু মাইন রহ: (২৩৩ হি:)
ইবনে কুদামা রহ: নুজুল বিষয়ে ইয়াহইয়া ইবনে মাইন রহ: এর বক্তব্য উল্লেখ করেছেন। ইয়াহইয়া ইবনে মাইন রহ: বলেন,
صدق به و لا تصفه و قال: اقروه و لا تحدوه
অর্থ: এসব হাদীসের সত্যতার উপর ইমান রাখো। এগুলো ব্যাখ্যা করো না। এরপর তিনি বলেন, হাদীসের সত্যতাকে স্বীকার করো। সৃষ্টিগত কোন সীমাবদ্ধতা সাব্যস্ত করো না।
(জাম্মুল তা’বীল, পৃ:২১)
ইমামগণের বক্তব্যগুলো খুবই স্পষ্ট। কেউ-ই এগুলোর বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করছেন না। কেউ কেউ বাহ্যিক অর্থ না নেয়ার ব্যাপারে এত কঠোর ছিলেন যে, অন্য ভাষায় অনুবাদ করতেও নিষেধ করেছেন। অধিকাংশ ইমামই এসব আয়াত ও হাদীসের উপর মৌলিক ইমান রেখে চুপ থাকতে বলেছেন। আল্লাহ ও তার রাসূল যা বলেছেন, যে উদ্দেশ্যে তা সবই সত্য। এতটুকু হল মৌলিক ইমান। এরপর এ বিষয়ে আর কোন আলোচনা পছন্দ করতেন না। বরং সুস্পষ্টভাবে চুপ থাকতে বলতেন। তারা কোন ধরণের আলোচনাই পছন্দ করতেন না। প্রাথমিক যুগের সালাফগণের মূল মানহাজ ছিল এটি। সময় যত গড়াতে থাকে, এগুলো নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা বাড়তে থাকেন। কেউ এগুলোকে সিফাত বলা শুরু করেন। কেউ তা’বীল করেন। কেউ আরও আগ্রসর হয়ে এগুলোর বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করে দেহবাদী ও সাদৃশ্যবাদী হয়। এভাবে আস্তে আস্তে সালাফের মূল মানহাজ (চুপ থাকা) থেকে সরে আসতে থাকে। প্রাথমিক যুগের সালাফগণ চুপ থাকতে বললেও পরবর্তী সালাফদের যুগেই আলোচনা-পর্যালোচনা হতে থাকে। ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চলতে থাকে। যুগের পরিবর্তনে সালাফদের মানহাজেও ব্যাপক পরিবর্তন আসে। একারণে সিফাত বিষয়ে সালাফের মানহাজের মধ্যেই ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। তবে তাদের সকলেই তানজীহের বিষয়ে একমত ছিলেন। সালাফ ও খালাফ (পরবর্তী) সবার ঐকমত্যের কারণে সিফাতের ক্ষেত্রে তানজীহকে আমরা মূল মনে করি। তানজীহের পর ‘ইসবাত’, ‘তাফয়ীজ’, ‘তা’বীল’ যেকোন একটা গ্রহণ করতে পারে। সবগুলোই সালাফ থেকে প্রমাণিত।
প্রশ্ন: আপনি বলেছেন, তানজীহের পর ‘ইসবাত’, ‘তাফয়ীজ’, ‘তা’বীল’ থেকে যেকোন একটি মত গ্রহণ করা যাবে। এগুলোর পরস্পরের মধ্যে কি কোন বিরোধ আছে?
উত্তর: সবগুলোর মধ্যে মৌলিক মিল হল সবক্ষেত্রেই বাহ্যিক অর্থ পরিত্যাগ করা হচ্ছে। যাকে আমরা তানজীহ বলছি। তানজীহের পর ‘ইসবাত’, ‘তাফয়ীজ’, ‘তা’বীল’ থেকে যেকোন একটি মত গ্রহণ করা যাবে। কারণ সবগুলোই সালাফ থেকে প্রমাণিত। মতগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিরোধ রয়েছে। তাফয়ীজ ও তা’বীলের মাঝে মৌলিক কোন বিরোধ নেই। কিন্তু ইসবাতের সাথে তাফয়ীজ-তা’বীলের বিরোধ রয়েছে।
ইসবাতের ক্ষেত্রে বাহ্যিক অর্থ পরিত্যাগ করার পর শব্দটিকে আল্লাহর সিফাত বা গুণ সাব্যস্ত করা হয়। কিন্তু তা’বীল বা তাফয়ীজের ক্ষেত্রে বাহ্যিক অর্থ পরিত্যাগের পর গুণ সাব্যস্ত করা হয় না। তাফয়ীজের ক্ষেত্রে অর্থ ও উদ্দেশ্য আল্লাহর উপর ছেড়ে দেয়া। মূল কুরআনের আয়াত বা হাদীসের উপর মৌলিক বিশ্বাস রেখে সম্পূর্ণ বিষয়টিকে আল্লাহর উপর ছেড়ে দেয়া হয়। আর তা’বীলের ক্ষেত্রে বাহ্যিক অর্থ পরিত্যাগ করে সম্ভাব্য অন্য কোন অর্থ গ্রহণ করা হয়।
যেমন, আল্লাহর নুজুল (অবতরণ)। সকলেই নুজুলের মূল অর্থ তথা উপর থেকে নীচে নামাকে পরিত্যাগ করেছেন। এরপর যারা ‘ইসবাত’ করেছেন, তারা বলেন, নুজুল আল্লাহর একটি সিফাত। তবে নুজুল দ্বারা কী উদ্দেশ্য সেটা আল্লাহ তায়ালা ভাল জানেন। তবে আল্লাহর নুজুল কখনও স্থান পরিবর্তন নয়।
ইসবাতের ভেতরে তিনটি বিষয় থাকে।
১। তা’বীলে ইজমালী বা তানজীহ। বাহ্যিক অর্থ পরিত্যাগ করাটা হল তা’বীলে ইজমালী বা তানজীহ। ইসবাতের ক্ষেত্রে শুরুতেই বাহ্যিক অর্থ পরিত্যাগ করা হয়।
২। শব্দটিকে আল্লাহর গুণ সাব্যস্ত করা হয়।
৩। শব্দের বাহ্যিক অর্থ পরিত্যাগ করার পর উক্ত শব্দ দ্বারা কী উদ্দেশ্য, সেটা আল্লাহর দিকে ন্যস্ত করা হয়। এটা তাফয়ীজ।
আর যারা তাফয়ীজ করেন, বাহ্যিক অর্থ পরিত্যাগ করার পর পুরো বিষয়টাকে আল্লাহর কাছে ন্যস্ত করেন। তারা বলেন এগুলোর অর্থ ও উদ্দেশ্য আল্লাহ ভাল জানেন। তবে আমরা এগুলোর উপর মৌলিক ইমান রাখি। আল্লাহ ও তার রাসূল যা বলেছেন, যে উদ্দেশ্যে বলেছেন, তা সবই সত্য। এ বিষয়ে তারা এরচেয়ে বেশি অগ্রসর হোন না। বরং চুপ থাকাকেই শ্রেয় মনে করেন। যেমন নুজুলের ক্ষেত্রে তারা বলেন, হাদীসটি রাসূল স: থেকে বিশুদ্ধসূত্রে বর্ণিত। আমরা এর উপর মৌলিক ইমান রাখি। নুজুল দ্বারা কী উদ্দেশ্য সেটি আল্লাহ তায়ালা ভাল জানেন। তবে আল্লাহর নুজুল কখনও স্থান পরিবর্তন নয়। উপর থেকে নীচে নামা নয়।
আর যারা তা’বীল করেন, তারা বাহ্যিক অর্থ পরিত্যাগ করার পর আরবী ভাষার রীতি ও বক্তব্যের সাথে সংগতিপূর্ণ সম্ভাব্য একটি অর্থ গ্রহণ করে থাকেন। যেমন, নুজুলের ক্ষেত্রে তারা কয়েকটি অর্থ করে থাকেন।
১। নুজুল দ্বারা ঐ সময় আল্লাহর বিশেষ রহমতের অবতরণ উদ্দেশ্য।
২। আল্লাহর পক্ষ থেকে নিযুক্ত ফেরেশতার উদ্দেশ্য। এর স্বপক্ষে তারা নাসায়ী শরীফের একটি হাদীসও পেশ করেন।
তিনটি মত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তা’বীল ও তাফয়ীজের ক্ষেত্রে শব্দটিকে আল্লাহর সিফাত বা গুণ সাব্যস্ত করা হচ্ছে না। কিন্তু ইসবাতের ক্ষেত্রে শব্দটিকে আল্লাহর সিফাত বলা হচ্ছে। মত তিনটির মধ্যে পরস্পর বিরোধ থাকলেও সম্পূর্ণ বিষয়টি ইজতেহাদী (গবেষণা নির্ভর)। সালাফ থেকে তিনটি মতই প্রমাণিত। এজন্য আমরা তানজীহের পর যে কোন একটি মত গ্রহণকে বৈধ মনে করি। এক্ষেত্রে কারও গবেষণা অন্যের উপর চাপিয়ে দেই না। যারা সিফাত সাব্যস্ত তাদের মত যেমন সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, একইভাবে যারা তা’বীল বা তাফয়ীজ করেছেন, তাদের মতও সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এক্ষেত্রে কোন একটা গ্রহণ করে অন্যদেরকে বিদয়াতী বা আহলে সুন্নত বহির্ভূত বলার সুযোগ নেই।
সালাফ থেকে যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে কঠোরতা দেখা যায়, কিন্তু সেসব কঠোরতাকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করা হবে না। যেমন ইবনে সুরাইজ রহ: সিফাত সংক্রান্ত উত্তর বা উত্তর প্রদানকে কুফুরী ও জিন্দিকি বলেছে। তার এই বক্তব্যকে দলিল বানিয়ে সিফাত সংক্রান্ত যে কোন উত্তরকে সরাসরি কুফুরী বলা ঠিক হবে না। তবে যদি কারও উত্তরে কুফুরী থাকে, সেটা ভিন্ন বিষয়। একইভাবে কিছু কিছু সালাফ তা’বীলের নিন্দা করেছেন। তা’বীল যেহেতু অন্যান্য সালাফ থেকে প্রমাণিত এজন্য তা’বীলের এসব নিন্দাকে মৌলিক দলিল হিসেবে গ্রহণ করা হবে না। যেমন, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ: সূরা কাসাসের ৮৮ নং আয়াত (আল্লাহর চেহারা ব্যতীত সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে) এর আলোচনায় বলেছেন, কেউ যদি এ আয়াতে চেহারা দ্বারা আল্লাহর সত্ত্বা উদ্দেশ্য নেয়, তাহলে মুলহিদ হয়ে যাবে। কেউ ‘ওয়াজহ’ এর অন্য কোন অর্থ নেয়, তাহলে সে কাফের হয়ে যাবে। অথচ এই আয়াতে সালাফ থেকেই ভিন্ন অর্থ বর্ণিত হয়েছে। ইমাম বোখারী রহ: আল্লাহর রাজত্ব অর্থ নিয়েছেন। একইভাবে ইবনে তাইমিয়া রহ, ইবনুল কাইয়্যিম রহ, ইমাম বাগাবী রহ, ইবনে কাসীর রহ সহ অনেকে ‘ওয়াজহ’ এর বিভিন্ন অর্থ করেছেন। ইমাম আহমাদ রহ: এর কথা গ্রহণ করলে এসব ইমামগণকে নাউযুবিল্লাহ কাফের বলতে হবে। এধরণের বহু উদাহরণ দেয়া যাবে। যেখানে হয়ত কোন সালাফ একটা বিষয়ে কঠোরতা করেছেন, কিন্তু বিষয়টি দলিলের বিবেচনায় দুর্বল অথবা অন্যান্য সালাফ থেকে বিপরীত বিষয়টিও প্রমাণিত, তাহলে উক্ত সালাফের কঠোরতাকে গ্রহণ করা হবে না।
অনেক সালাফ অনেক তা’বীলকে জাহমিয়া বা কাদেরিয়াদের মত বলে দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে উক্ত তা’বীলটি অন্যান্য সালাফ থেকে প্রমাণিত বা দলিলের বিবেচনায় শক্তিশালী, এক্ষেত্রে তাদের কঠোরতাকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করা হবে না। উক্ত তা’বীল করার কারণে অন্য সালাফকে জাহমিয়া বা কাদেরিয়া আখ্যা দেয়া যাবে না।
এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, তানজীহের পর সম্পূর্ণ বিষয়টা ইজতেহাদী বা গবেষণা নির্ভর। আর সালাফের ইজতিহাদে ভিন্নতা থাকাটাই স্বাভাবিক। একজনের ইজতিহাদকে মূল বানিয়ে অন্যকে কাফের, বিদয়াতী, সিফাত অস্বীকারকারী, জাহমিয়া বা এজাতীয় কিছু আখ্যা দেয়া যাবে না। এক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করলে সালাফের উপর জুলুম করা হবে। অন্যায় অপবাদ দেয়া হবে। যা মারাত্মক গর্হিত কাজ।
প্রশ্ন: আপনারা তো আকিদার ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানিফা রহ: কে মানেন না, আশআরী-মাতুরিদিকে মানেন। এর কারণ কী?
উত্তর:
আকিদার কী কী বিষয়ে ইমাম আবু হানিফা রহ: এর বিরোধীতা করেছি?
প্রশ্ন: ইমাম আবু হানিফা রহ: বলেছেন, যে আল্লাহর তায়ালাকে আরশে বিশ্বাস করে না, সে কাফের। আপনারা তো বলেন, আল্লাহ স্থান ও দিক থেকে মুক্ত, তাহলে ইমাম আবু হানিফা রহ: এর বক্তব্য অনুযায়ী আপনারা কাফের হয়ে যাচ্ছেন?
উত্তর:
এর কয়েকটা উত্তর আছে।
১। সালাফীদের অনেক বরেণ্য আলিমের নিকট আল-ফিকহুল আকবার ও আবসাত কোনটিই ইমাম আবু হানিফা রহ: থেকে প্রমাণিত নয়। সৌদি আরবের উম্মুল কুরা ইইনিভার্সিটি আক্বিদা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. আব্দুল আজিজ বিন আহমাদ আল-হুমাইদী এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এছাড়া ড. সালিহ আল-মুনাজ্জিদও মনে করেন, কিতাব দু’টি ইমাম আবু হানিফা রহ: থেকে প্রমাণিত নয়।
সুতরাং যেখানে সালাফী আলিমগণের নিকট মূল কিতাবটিই ইমাম আবু হানিফা রহ: এর থেকে প্রমাণিত নয়, তাহলে এই অপ্রমাণিত কিতাবের বক্তব্যকে দলিল হিসেবে গ্রহণ কতটুকু যুক্তিসঙ্গত হতে পারে? মৌলিকভাবে বক্তব্যের প্রামাণ্যতা নিয়ে যেখানে প্রশ্ন রয়েছে, সেটাকে আকিদার দলিল বানানো কতটুকু যৌক্তিক?
এছাড়া সালাফী ঘরাণার অনেক আলিম আবু মূতী বালখী রহ:কে দুর্বল বা আরও কঠোর সমালোচনা করে থাকেন। সুতরাং তার থেকে বর্ণিত বক্তব্যটি তাদের নিকট দলিলযোগ্য হতে পারে না। এখানে এধরণের দ্বিমুখী আচরণের কারণ আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। একদিকে মূল রাবীর কঠোর সমালোচনা করা হচ্ছে, অন্যদিকে তার বর্ণিত বক্তব্যকেই দলিল বানানো হচ্ছে। এটা তো যৌক্তিক বা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
২। ইমাম আবু হানিফা রহ: এর উক্ত বক্তব্যটি ভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম আবু হানিফা রহ: বলেন,
من قال لا أعرف الله أفي السماء هو أم في الأرض فقد كفر، لأن هذا القول يوهم أن للحق مكانا ومن توهم أن للحق مكانا فهو مشبه
অর্থ: যে ব্যক্তি বলল, আমি জানিনা আল্লাহ তায়ালা আসমানে রয়েছেন নাকি জমিনে রয়েছেন, তাহলে এ ব্যক্তি কুফুরী করল। কেননা তার এই বক্তব্য দ্বারা বোঝা যায় যে, আল্লাহ তায়ালা কোন স্থানে রয়েছন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য স্থান বা জায়গা সাব্যস্ত করল সে সাদৃশ্যবাদী।
উক্ত বক্তব্যটি ইমাম আবু হানিফা রহ: থেকে আহলে সুন্নতের বহু আলিম উল্লেখ করেছেন।
১। ইমাম আহমাদ রেফায়ী (৫১২-৫৭৮ হি:) রহ: তার “আল-বুরহানুল মুয়ায়্যাদ’ কিতাবে।
২। ইমাম ইজ্ব ইবনে আব্দুস সালাম (মৃত: ৬৬০ হি:) রহ: তার ‘হাল্লুর রুমুজ (পৃ:৪৪)’ কিতাবে।
৩। ইমাম ত্বকিউদ্দীন হাসানী রহ: তার ‘দাফউ শুবাহি মান শাব্বাহা ও তামাররাদা’ নামক কিতাবে।
৪। শায়খ আলওয়ান ইবনে আতিয়্যা আল-হুসাইনী আল-হামাবী (মৃত: ৯৩৬ হি:) তার ‘বয়ানুল মায়ানী’ কিতাবে।
৫। শায়খ সামসুদ্দিন রমালী (মৃত: ১০০৪ হি:) তার ‘ফতোয়া’-তে উল্লেখ করেছেন।
৬। মালেকী মাজহাবের বিখ্যাত আলিম ইমাম নাফরাবী (১১২৬ হি:) তার ‘আল-ফাওয়াকিহুদ দানী’-তে উল্লেখ করেছেন।
৭। শায়খ সুলাইমান আল-হালাবী তার ‘নুখবাতুল লায়ালীতে’ উল্লেখ করেছেন।
এ বিষয়ে মোল্লা আলী ক্বারী রহ: বলেন,
ثم قال: ومنه ما روي عن أبي مطيع البلخي أنه سأل أبا حنيفة رحمه الله عمن قال: لا أعرف ربي في السماء هو أم في الأرض، فقال: قد كفر لأن الله تعالى يقول :{الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى } وعرشه فوق سبع سمواته، قلت: فإن قال إنه على العرش ولا أدري العرش في السماء أم في الأرض، قال: هو كافر لأنه أنكر كونه في السماء فمن أنكر أنه في السماء فقد كفر لأن الله تعالى في أعلى عليين وهو يدعى من أعلى لا من أسفل” اهـ.
والجواب أنه ذكر الشيخ الإمام ابن عبد السلام في كتاب “حل الرموز” أنه قال الإمام أبو حنيفة رحمه الله: “من قال لا أعرف الله تعالى في السماء هو أم في الأرض كفر، لأن هذا القول يوهم أن للحق مكانا ومن توهم أن للحق مكانا فهو مشبه”اهـ ولا شك أن ابن عبد السلام من أجل العلماء وأوثقهم فيجب الاعتماد على نقله لا على ما نقله الشارح، مع أن أبا مطيع رجل وضاع عند أهل الحديث كما صرح به غير واحد
অর্থ: আবু মুতী বালখী রহ: থেকে বর্ণিত আছে, তিনি ইমাম আবু হানিফা রহ: কে জিজ্ঞাসা করেছেন, কেউ যদি বলে, আমি জানি না, আল্লাহ তায়ালা জমিনে আছেন না কি আসমানে তাহলে সে কাফের হয়ে যাবে। কেননা, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, আল্লাহ আরশে ইস্তিওয়া করেছেন। আর আল্লাহর আরশ সাত আসমানের উপরে।
কেউ যদি বলে, আল্লাহ আরশে আছেন। কিন্তু আমি এটি জানি না যে, আরশ আসমানে নাকি জমিনে? তিনি বলেন, এ ব্যক্তিও কাফের। কেননা সে আল্লাহর আসমানে থাকাকে অস্বীকার করেছে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর আসমানে থাকাকে অস্বীকার করল সে কাফির। কেননা আল্লাহ তায়ালা সব কিছুর উর্ধ্বে। আর আল্লাহ তায়ালাকে উপরের দিকের সাপেক্ষে ডাকা হবে, নীচের দিকের নয়।”
উক্ত বর্ণনার উত্তর হল, ইমাম ইজ্ব ইবনে আব্দুস সালাম (মৃত:৬৬০) রহ: তার ‘হল্লুর রুমুজ’ কিতাবে ইমাম আবু হানিফা রহ: এর উক্ত বক্তব্য উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, “ইমাম আবু হানিফা রহ: বলেন, যে ব্যক্তি বলল, আমি জানিনা আল্লাহ তায়ালা আসমানে রয়েছেন নাকি জমিনে রয়েছেন, তাহলে এ ব্যক্তি কুফুরী করল। কেননা তার এই বক্তব্য দ্বারা বোঝা যায় যে, আল্লাহ তায়ালা কোন স্থানে রয়েছন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য স্থান বা জায়গা সাব্যস্ত করল সে সাদৃশ্যবাদী।”
(মোল্লা আলী ক্বারী রহ: বলেন) এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, ইমাম ইজ্ব ইবনে আব্দুস সালাম রহ: অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও বিশ্বস্ত আলিম। সুতরাং আকীদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যার ইবনু আবিল ইজ যা উদ্ধৃত করেছেন তার উপর নির্ভর না করে ইমাম ইজ্ব ইবনে আব্দুস সালামের উদ্ধৃতির উপর নির্ভর করা উচিৎ। এছাড়া আবু মুতী বালখী একজন জাল বর্ণনাকারী। অনেক মুহাদ্দিস তার সম্পর্কে এটি বলেছেন।
(শরহু ফিকহীল আকবার, মোল্লা আলী কারী রহ, পৃ:১৭২)
মোল্লা আলী ক্বারী রহ: সহ অন্যান্য ইমামগণ ইমাম আবু হানিফা রহ: এর দ্বিতীয় বক্তব্যটি সমর্থন করেছেন।
৩। ইমাম আবু হানিফা রহ: এর বক্তব্যকে সঠিক ধরা হয়, তাহলে দেখা যাবে তিনি নিজেই নিজেকে কাফির বলছেন। নাউযুবিল্লাহ। আল্লাহর অবস্থান সম্পর্কে তার অন্যান্য বক্তব্য দেখুন।
ইমাম আবু হানিফা রহ. এর আল-ফিকহুল আবসাতে রয়েছে,
:”قلتُ: أرأيتَ لو قيل أين الله تعالى؟ فقال ـ أي أبو حنيفة ـ : يقال له كان الله تعالى ولا مكان قبل أن يخلق الخلق، وكان الله تعالى ولم يكن أين ولا خَلْق ولا شىء، وهو خالق كل شىء”
অর্থ: যদি আপনাকে প্রশ্ন করা হয় আল্লাহ তায়ালা কোথায়? ইমাম আবু হানিফা রহ. এর উত্তরে বলেন, তাকে বলা হবে, সৃষ্টির অস্তিত্বের পূর্বে, যখন কোন স্থানই ছিলো না, তখনও আল্লাহ তায়ালা ছিলেন। আল্লাহ তায়লা তখনও ছিলেন যখন কোন সৃষ্টি ছিলো না, এমনকি ‘কোথায়’ বলার মতো স্থানও ছিলো না। সৃষ্টির একটি পরমাণুও যখন ছিলো না তখনও আল্লাহ তায়ালা ছিলেন। তিনিই সব কিছুর সৃষ্টা” [ আল-ফিকহুল আবসাত, পৃ.৫৭, আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারীর তাহকীক]
এখানে সরাসরি ইমাম আবু হানিফা রহ: কে ‘আল্লাহ কোথায়’ এ প্রশ্ন করা হয়েছে। তিনি স্পষ্টভাবে আল্লাহ তায়ালাকে স্থান থেকে মুক্ত বলেছেন। তার মতে স্থান-কাল সৃষ্টির আগে যেমন আল্লাহ তায়ালা ছিলেন, এখনও আছেন। তিনি এখানে বলেননি, আল্লাহ আরশে কিংবা আসমানে। ইমাম আবু হানিফা রহ: এ বক্তব্যের সাথে উপরের বক্তব্য সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। উপরের বক্তব্য মূল ধরলে বলতে হবে, ইমাম আবু হানিফা রহ: নিজেই নিজেকে কাফের বলেছেন। নাউযুবিল্লাহ।
ইমাম আবু হানিফা রহ. আরও বলেন,
“ولقاء الله تعالى لأهل الجنة بلا كيف ولا تشبيه ولا جهةٍ حقٌّ”
অর্থ: জান্নাতবাসীর জন্য কোন সাদৃশ্য, অবস্থা ও দিক ব্যতীত আল্লাহ তায়ালার দর্শন সত্য।
[কিতাবুল ওসিয়্যা, পৃ.৪, শরহে ফিকহুল আকবার, মোল্লা আলী কারী, পৃ.১৩৮]
এখানে তিনি আল্লাহ তায়ালাকে দিক থেকে মুক্ত বলেছেন।
ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেন,
ونقر بأن الله سبحانه وتعالى على العرش استوى من غير أن يكون له حاجة إليه واستقرار عليه، وهو حافظ العرش وغير العرش من غير احتياج، فلو كان محتاجا لما قدر على إيجاد العالم وتدبيره كالمخلوقين، ولو كان محتاجا إلى الجلوس والقرار فقبل خلق العرش أين كان الله، تعالى الله عن ذلك علوا كبيرا” اهـ.
আমরা স্বীকার করি যে, আল্লাহ তায়ালা আরশের উপর ইস্তিওয়া করেছেন। আরশের প্রতি কোনরূপ প্রয়োজন ও আরশের উপর স্থিতিগ্রহণ ব্যতীত। তিনি আরশ ও অন্যান্য মাখলুকের প্রতি বিন্দুমাত্র মুখাপেক্ষী নন। তিনি যদি আরশ ও অন্যান্য মাখলুকের মুখাপেক্ষী হতেন, তাহলে মহাবিশ্ব সৃষ্টি ও লালন-পালন করতে পারতেন না। যেমন কোন মাখলুক অন্যের মুখাপেক্ষী হওয়ার কারণে কোন কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। তিনি যদি আরশের উপর বসা ও এর উপর স্থির হওয়ার মুখাপেক্ষী হতেন, তাহলে আরশ সৃষ্টির পূর্বে তিনি কোথায় ছিলেন? মহান আল্লাহ এধরণের ধ্যান-ধারণা থেকে মহাপবিত্র।
[আল-ওসিয়্যা, পৃ.২, তাহকীক, আল্লামা যাহিদ আল-কাউসারী রহ.]
‘আরশ সৃষ্টির পূর্বে কোথায় ছিলেন’ এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সালাফের বহু ইমাম এ প্রশ্নটি করেছেন। যারা আল্লাহর জন্য স্থান, দিক সাব্যস্ত করে, যারা মনে করে আল্লাহ আরশে রয়েছেন, তাদের মতবাদ খন্ডনের জন্য সালাফ প্রশ্নটি করেছেন। আরশ তো এক সময় ছিল না। আরশ সৃষ্টির আগে তিনি কোথায় ছিলেন? আরশ সৃষ্টির আগে যদি তিনি থাকেন, তাহলে আরশ সৃষ্টির পরে আরশে অবস্থানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল কেন?
‘আরশ সৃষ্টির পূর্বে কোথায় ছিলেন’ এ প্রশ্নের দ্বারা ইমাম আবু হানিফা রহ: আল্লাহর আরশে অবস্থানকে স্পষ্টভাবে খন্ডন করেছেন।
আপনার কাছে জিজ্ঞাসা, আবু মতী বালখী রহ: এর উপরের বর্ণনা গ্রহণ করলে তো স্বয়ং ইমাম আবু হানিফা রহ: কাফির হয়ে যান। তাকে সরাসরি ‘আল্লাহ কোথায়’ এ প্রশ্ন করা হয়েছে। তিনি বলেছেন সব কিছু সৃষ্টির আগে যেমন স্থান থেকে আল্লাহ মুক্ত ছিলেন, একইভাবে আছেন। তিনি এখানে বলেননি, আল্লাহ আরশে কিংবা আল্লাহ আসমানে।
যে বর্ণনাটি স্বয়ং ইমাম আবু হানিফা রহ: এর অন্যান্য বক্তব্যের বিপরীত, যার বিপরীতে আরেকটি বর্ণনা আহলে সুন্নতের বিখ্যাত ইমামগণ গ্রহণ করেছেন, যেই বর্ণনার প্রামাণ্যতা ইমামগণ প্রশ্ন তুলেছেন, সেটিকে কীভাবে আকিদার দলিল হিসেবে গ্রহণ করেন? আর একে দলিল বানিয়ে হানাফীদেরকে ইমাম আবু হানিফা রহ: এর আকিদা বিরোধী বলেন কীভাবে?
৪। ইমাম আবু হানিফা রহ: এর বক্তব্যটি আবু মুতী বালখী রহ: এর সূত্রে বর্ণিত আল-ফিকহুল আকবারে রয়েছে। আল-ফিকহুল আকবারের মূল বক্তব্যে কুফুরীর কারণ স্পষ্ট করা হয়নি। ইমাম আবুল লাইস সমরকন্দী রহ: আল-ফিকহুল আকবারের ব্যাখ্যায় কুফুরীর কারণ হিসেবে বলেছন, উক্ত বক্তব্য দ্বারা মূলত: আল্লাহর জন্য স্থান সাব্যস্ত করা হয়। আর আল্লাহর জন্য স্থান সাব্যস্ত করা হল কুফুরী। তাহলে দেখা যাচ্ছে, সালাফীদের বর্ণিত রেওয়াতে কুফুরীর যে কারণ বলা হয়েছে, সেটি মূল ফিকহুল আকবারে অনুপস্থিত।
সালাফী ভাইয়েরা যে বর্ণনাটি প্রচার করে থাকেন এটি মূলত: আবু ইসমাইল আল-হারাবী তার আল-ফারুক কিতাবে উল্লেখ করেছেন। আল-ফারুক কিতাবটি এখন মাফকুদ। আমার জানা মতে কোথাও এর হ্স্তলিপি পাওয়া যায় না। মূল কিতাবের বক্তব্য ও সনদ বিশ্লেষণ এখানে জরুরি। কিতাবটি মাফকুদ হওয়ার কারণে যা সম্ভব নয়।
আরেকটু উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, কুফুরীর কারণ হিসেবে বর্ণিত শব্দগুলির মাঝেও বেশ ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। ইমাম জাহাবী রহ: এর বর্ণিত শব্দ ও ইবনুল কাইয়্যিম রহ: এর শব্দের মধ্যে বেশ পার্থক্য দেখা যায়। এসব পার্থক্যের কারণেও মূল বর্ণনাটির মাঝে পরিবর্তন-পরিবর্ধনের সম্ভবনা দেখা দেয়।
মোটকথা, বর্ণনাটির প্রামাণ্যতা নিয়ে প্রশ্নের সুযোগ রয়েছে। একইভাবে কুফুরীর কারণটিও মৌলিকভাবে প্রমাণিত ও গ্রহণযোগ্য নয়। এর বিপরীতে স্বয়ং ইমাম আবু হানিফা রহ: এর নিজস্ব বক্তব্য যেমন রয়েছে, একইভাবে হানাফীদের বরেণ্য আলিমগণও আল্লাহর জন্য স্থান সাব্যস্ত করাকে মূল কুফুরীর কারণ মনে করেন। আরশে বিশ্বাস না করাকে তারা কুফুরী বলেন না।
এসকল কারণে উক্ত বক্তব্য দ্বারা একথা বলার সুযোগ নেই যে, হানাফীরা আকিদার ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানিফা রহ: কে অনুসরণ করে না। এটি মূলত: আহলে সুন্নতের মূল-ধারার হানাফীদের সম্পর্কে একটি মারাত্মক মিথ্যাচার। কিছু ভাইয়ের এধরণের অপপ্রচারের সাথে বাস্তবতার কোন মিল নেই। এটি বাস্তবতা বিবর্জিত একটি প্রপাগান্ডা ছাড়া আর কিছুই নয়। আল্লাহ তায়ালা সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন।
প্রশ্ন: বর্তমান সালাফীগণ কি সালাফের মানহাজের প্রতিনিধিত্ব করছেন?
উত্তর:
এর মৌলিক উত্তর হল, না। তারা প্রকৃত অর্থে সিফাতের ক্ষেত্রে সালাফে-সালেহীর প্রতিনিধিত্ব করছেন না। শায়খ আয়্যাশ কুবাইসীর নীচের বক্তব্যটি সামনে রাখলে বর্তমান সালাফীদের প্রান্তিকতার বিষয়গুলি স্পষ্ট হবে বলে আশা রাখি।
আল্লাহর নাম ও গুণাবলী বিষয়ে অসাধারণ একটি কিতাব হলো ড. আয়্যাশ আল-কুবাইসী এর লেখা আস-সিফাতুল খাবারিয়্যা। এ কিতাবে তিনি সিফাতের বিষয়ে অত্যন্ত জ্ঞান গর্ভ আলোচনা করেছেন। যারা সিফাত বিষয়ে অধ্যয়ন করতে চান, তাদের প্রত্যেকের কিতাবটি পড়া উচিৎ। এ কিতাবে শায়খ আয়্যাশ কুবাইসী সিফাতের বিষয়ে সালাফের অবস্থান নিয়ে আলোচনা করেছেন। আলোচনার উপসংহারে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা লিখেছেন। আমি তার উপসংহারের মোটামুটি অনুবাদ সাধারণ পাঠকের জন্য তুলে ধরছি।
“সিফাতের বিষয়ে সালাফের অবস্থান সম্পর্কে উপযুক্ত স্পষ্ট পর্যালোচনা থেকে আমরা দৃঢ়ভাবে বলতে পারি যে, সিফাতের বিষয়ে সালাফে সালেহীনের সুস্পষ্ট কোন একক মাজহাব ছিলো না।কিছু ধারণা ও আলামতের উপর নিভর্র করে সিফাতের বিষয়ে সালাফদের অবস্থানের ব্যাখ্যা করা হয়। এই ধারণা ও আলমাত গুলো অকাট্য নয়। ফলে সালাফদের অবস্থানের বিষয়ে যেসব ব্যাখ্যা করা হয়, অনুমান নির্ভর হওয়ার কারণে সেই ব্যাখ্যাগুলো মেনে নেয়া আমাদের জন্য আবশ্যক নয়। এজন্য বিষয়টি নিয়ে পরবর্তী আলেমগন মতবিরোধ করেছেন। পরবর্তীদের মধ্যে বিভিন্ন মাজহাব ও মতবাদ দেখা দিয়েছে। সিফাতের বিষয়ে সালাফের যদি একটিমাত্র সুস্পষ্ট মাজহাব থাকতো, তাহলে কোন মুসলিমের জন্য সেটার বিরোধীতা করা জায়েজ হতো না। এটা তো অকল্পনীয় যে, সালাফের একটি মাত্র সুস্পষ্ট মাজহাব থাকবে, আর মুসলিম উম্মাহর বিশাল একটা অংশের পক্ষে তাদের বিরোধীতা করা জায়েজ হয়ে যাবে।
আকিদা এমনকি ফিকহী বিষয়ে সালাফের একটিমাত্র মাজহাব ছিলো, এ ধরণের দাবী মূলত: বাস্তবতা বিবর্জিত ও ভয়ংকর। বাস্তবে এধরণের দাবী মুসলিম উম্মাহের মাঝে বিভেদের রাস্তা প্রশস্ত করেছে। বিভেদটি মুসলমানদের মধ্যে এমন ভয়ংকর দূরত্ব তৈরি করেছে যে এর উপশম কঠিন। এজন্য একজন আরেকজনকে পথভ্রষ্ট, বিদয়াতী এমনকি কাফের বলার বাজার গরম হয়েছে। লা হাওলা ওলা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।
ধরুন, সিফাতের বিষয়ে সালাফে যতো কথা বলেছেন, আমরা সবগুলো একত্র করলাম। তাদের সমস্ত বক্তব্য একত্র করে কি আমরা একটা সুস্পষ্ট একক মাজহাব ও সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারবো? একটি একক মাজহাবে উপনীত হওয়া যে সম্ভব নয়, এটি প্রমাণের জন্য সালাফদের মতবিরোধের যে উদাহরণগুলো আমি আলোচনা করেছি, সেগুলোই যথেষ্ট।আর যারা সালাফের যুগে অবস্থান করতেন, তাদের সামনে তো সমস্ত সালাফের বক্তব্য সংকলিত অবস্থায় ছিলো না। কারণ তখন তারা এগুলো সংকলন, বিন্যাস ও লিপিবদ্ধের বিষয়ে এতটা গুরুত্ব দিতেন না। সেসময়ে তারা এগুলোর প্রতি মানুষকে আহ্বানও করতেন না, আবার তাদের বক্তব্যের ব্যাখ্যাও দিতেন না। সালাফের অবস্থানের বিষয়ে আমার কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মত হলো, সিফাতের এসব বিষয় শরীয়তের অবধারিত কোন কিছুর অন্তর্ভূক্ত নয়। তাই যদি হতো, তাহলে কি সমস্ত সাহাবী এটা জানতেন যে, আল্লাহর দু’টি হাত, আঙ্গুল, পা, পায়ের পিন্ডলী, চেহারা এবং আল্লাহর চোখ আছে? সাহাবীদের প্রত্যেকেই কি জানতেন যে আল্লাহ উপহাস করেন, ষড়যন্ত্র করেন, আল্লাহ তায়ালা হাসেন, উপর ওঠেন, নীচে নামেন? সাহাবীদের প্রত্যেকে কি এগুলো মুখস্থ রাখতেন, এগুলোকে দ্বীনের মৌলিক আকিদা ও দ্বীনের মৌলিক অংশ মনে করতেন? তারা কি অন্যদেরকে এগুলো বিশ্বাসের প্রতি দাওয়াত দিতেন? তারা কি এগুলো দিয়ে মানুষকে পরীক্ষা করতে যে, তারা প্রকৃত মুসলমান কি না? তারা কি তাদের ছেলে সন্তানদেরকে এগুলো গুরুত্ব সহকারে শিক্ষা দিতেন? তারা যদি এগুলো করে থাকেন, তাহলে এ বিষয়ে তো আমাদের কাছে তাদের একটা বর্ণনাও এলো না? তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, একজন দু’জন সাহাবী করেছেন। (যদিও একজন দু’জন থেকেও বিষয়টি বর্ণিত নয়), তাদের সকলে কি এটি করেছেন? আপনার জন্য কি আদৌ এটা জায়েজ হবে যে, আপনি ইসলামের মৌলিক কিছু আকিদা একেবারে বেমালুম ভুলে থাকবেন? এসমস্ত প্রশ্ন দিয়ে বিরামহীন সেমস্ত মস্তিষ্কে আঘাত করা উচিৎ যারা উম্মাহের দেহ খন্ড-বিখন্ড করার জন্য সিফাতের বিষয়গুলোকে কাচি হিসেবে ব্যবহার করছে। আল্লাহই একমাত্র সাহায্যকারী।
— আস-সিফাতুল খাবারিয়্যা, ড. আয়্যাশ আল-কুবাইসী, পৃ.৭৮
------ ------
খতীব বাগদাদী রহ. তার ‘আল-জামে লি-আখলাকির রাবি ও আদাবিস সামে’ কিতাবে ইমাম আবু ইউসুফ রহ. থেকে একটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন।
الْعِلْمُ شَيْءٌ لا يُعْطِيكَ بَعْضَهُ حَتَّى تُعْطِيَهُ كُلَّكَ
অর্থ: ইলম এমন একটি জিনিস, সে তোমাকে তার কিছু অংশও দিবে না যতক্ষণ না তুমি নিজেকে পূর্ণভাবে তার কাছে সমর্পণ না করবে।
অন্যান্য সৃষ্টি থেকে মানুষের শ্রেষ্ঠত্যের একটি বিশেষ দিক হলো ইলম অর্জনের ক্ষমতা। এটি মানুষের জন্য আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
ইলমের জন্য যে…
ইবনে তাইমিয়া রহ. এর জীবনী আলোচনা করেছেন তার বিশিষ্ট ছাত্র ইবনুল কাইয়্যিম রহ। তার পৃথক জীবনী লিখেছেন ইবনে তাইমিয়া রহ. এর বিশিষ্ট দুই ছাত্র। একজন হলেন, হাফেজ আবু হাফস উমর ইবনে আলি আল-বাযযার (মৃত:৭৪৯ হি:) তিনি আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া লিখেছেন। ইবনে তাইমিয়া রহ. আরেক ছাত্র ইবনে আব্দুল হাদী রহ. (মৃত: ৭৪৪ হি:) আরেকটি জীবনী লিখেছেন। তার লিখিত জীবনীর নাম আল-উকুদুল দুররিয়া মিন মানাকিবি শাইখিল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া।
আমি এখানে ইবনে তাইমিয়া রহ. এর বিশিষ্ট ছাত্রদের বর্ণনায় তার কিছু উল্লেখযোগ্য কারামত উল্লেখ করছি।
কারামত-১:
লওহে মাহফুজ দেখে বিজয়ের সংবাদ:
গায়েবসম্পর্কেইবনেতাইমিয়ারহ. এরকারামত:
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) “মাদারিজুস সালিকিন শরহু মানাযিলিস সাঈরিন” নামক কিতাবে আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) এর কারামতের কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) লিখেছেন-
أخبر الناس والأمراء سنة اثنتين وسبعمائة لما تحرك التتار وقصدوا الشام : أن الدائرة والهزيمة عليهم وأن الظفر والنصر للمسلمين وأقسم على ذلك أكثر من سبعين يمينا فيقال له : قل إن شاء الله فيقول : إن شاء الله تحقيقا لا تعليقا وسمعته يقول ذلك قال : فلما أكثروا علي قلت : لا تكثروا كتب الله تعالى في اللوح المحفوظ : أنهم مهزومون في هذه الكرة وأن النصر لجيوش الإسلام
“তাতারীরা যখন মুসলিম উম্মাহের বিভিন্ন অঞ্চলে সেনা অভিযান পরিচালনা করে এবং শামে আক্রমণের উদ্যোাগ গ্রহণ করে তখন ৭০২ হিঃ সনে শায়েখ (রহঃ) সাধারণ মানুষ এবং আমীর-উমারাদেরকে সংবাদ দিলেন যে, “তাতারীরা পরাজিত হবে এবং মুসলমানরা বিজয় ও সাহায্য লাভ করবে।”। তিনি তাঁর কথার উপর সত্তরটিরও বেশি কসম খেয়েছেন। তাঁকে বলা হল, আপনি ইনশাআল্লাহ বলুন! অতঃপর তিনি বলেন, নিশ্চিতভাবে ইনশাআল্লাহ বলছি, সম্ভাবনা হিসেবে নয়। আমি তাঁকে বলতে শুনেছি, যখন তারা আমার উপর পীড়াপীড়ি করল, আমি তাদেরকে বললাম, তোমরা পীড়াপীড়ি কর না, আল্লাহ তায়ালা লউহে মাহফুজে লিখে রেখেছেন যে, তারা পরাজিত হবে এবং মুসলমানরা বিজয়ী হবে।
[মাদারিজুস সালিকিন, খ–২, পৃষ্ঠা-৪৮৯]
আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) আরও অনেক কারামতের কথা উল্লেখ করেছেন, ইবনে আব্দুল হাদী মুকাদ্দেসী (রহঃ) এবং আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ)। বিস্তারিত জানার জন্য আগ্রহী পাঠক, মাদারিজুস সালিকীন ও আ’লামুল আলিয়্যা গ্রন্থদ্বয় দেখতে পারেন।
¬
কারামত-২: ইবনে তাইমিয়া রহ. এর ভবিষ্যৎবাণী:
আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) এর বিশেষ ছাত্র আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) লিখেছেন-
وأخبرني غير مرة بأمور باطنة تختص بي مما عزمت عليه ولم ينطق به لساني وأخبرني ببعض حوادث كبار تجري في المستقبل ولم يعين أوقاتها وقد رأيت بعضها وأنا أنتظر بقيتها وما شاهده كبار أصحابه من ذلك أضعاف أضعاف ما شاهدته والله أعلم
“তিনি আমাকে অনেকবার অনেক বাতেনি বিষয়ের সংবাদ দিয়েছেন। তিনি শুধু আমাকে এগুলো বলেছেন এবং এ বিষয় সম্পর্কে আমি কাউকে কিছু বলি নি। তিনি আমাকে ভবিষ্যতের অনেক ঘটনার সংবাদ দিয়েছেন কিন্তু তিনি সময় নির্দিষ্ট করে দেননি। তাঁর ভবিষ্যৎ বাণীর কিছু কিছু আমি ঘটতে দেখেছি এবং অবশিষ্টগুলো সংঘটিত হওয়ার অপেক্ষায় আছি। তাঁর বড় বড় সাগরেদগণ আমি যা দেখেছি, তার চেয়ে বহু বহু গুণ বেশি দেখেছেন”
[মাদারিজুস সালিকিন, খ–২, পৃষ্ঠা-৪৯০]
কারামত-৩: অন্তরের বিষয় সম্পর্কে অবগত হওয়া:
ইবনে তাইমিয়া রহ. এর ছাত্র আবু হাফস উমর আল-বাযযার বলেন,
“أنه جرى بيني وبين بعض الفضلاء منازعة في عدة مسائل وطال كلامنا فيها وجعلنا نقطع الكلام في كل مسألة بأن نرجع إلى الشيخ وما يرجحه من القول فيها
ثم أن الشيخ رضي الله عنه حضر فلما هممنا بسؤاله عن ذلك سبقنا هو وشرع يذكر لنا مسألة مسألة كما كنا فيه وجعل يذكر غالب ما أوردناه في كل مسأله ويذكر أقوال العلماء ثم يرجح منها ما يرجحه الدليل حتى أتى على آخر ما أردنا أن نسأله عنه وبين لنا ما قصدنا أن نستعلمه منه فبقيت أنا وصاحبي ومن حضرنا أولا مبهوتين متعجبين مما كاشفنا به وأظهره الله عليه مما كان في خواطرنا.”
অর্থাৎ আমার সাথে একজন সম্মানিত আলেমের কয়েকটি মাসআলা নিয়ে বিতর্ক হলো। এ বিষয়ে আমাদের আলোচনা অনেক দীঘর্ হলো। প্রত্যেক মাসআলায় আমরা এভাবে কথা শেষ করলাম যে, মাসআলার সমাধান ইবনে তাইমিয়া রহ. এর কাছ থেকে জেনে নিবো।
এরপর শায়খ রহ. আমাদের নিকট উপস্থিত হলেন। আমরা যখন মাসআলাগুলো সম্পর্কে শায়খকে জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছা করলাম তিনি আমাদের জিজ্ঞাসার পূর্বেই আলোচনা শুরু করলেন। তিনি আমাদের আলোচনা অনুযায়ী একের পর এক মাসআলার সমাধান বলতেছিলেন। প্রত্যেক মাসআলায় আমাদের কাঙ্খিত উত্তর প্রদান করছিলেন। এভাবে তিনি প্রত্যেকটি মাসআলায় উলামায়ে কেরামের বক্তব্য এবং দলিল অনুযায়ী প্রাধান্য পাওয়া মাসআলাটি উল্লেখ করছিলেন। অবশেষে তিনি আমাদের আলোচিত সর্বশেষ মাসআলাটির সমাধান প্রদান করলেন। আমাদের অন্তরের বিষয়গুলো আল্লাহ তায়ালা এভাবে সুস্পষ্ট করে প্রকাশ করায় উপস্থিত লোকজন, আমার সঙ্গী ও আমি আশ্চর্যন্বিত ও বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৩, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
নিচের স্ক্রিনশট দেখুন,
এছাড়া আবু হাফস আল-বাযযার অন্তরের বিষয়ে ইবনে তাইমিয়া রহ. এর অবগত হওয়া সম্পর্কে আরও বলেন,
و كنت في خلال الأيام التي صحبته فيها إذا بحث مسألة يحضر لي إيراد فما يستتم خاطري به حتي يشرع فيرده و يذكر الجواب من عدة وجوه
অর্থাৎ আমি যখন যেসময়ে তার সংস্পর্শে ছিলাম, তখন আমার মনে কোন বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ার সঙ্গে তিনি এর জওয়াব দিতে শুরু করতেন এবং কয়েকভাবে এর উত্তর প্রদান করতেন।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৩, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
কারামত-৪: অন্যের সাহায্য
“وحدثني الشيخ الصالح المقريء أحمد بن الحريمي أنه سافر إلى دمشق قال فاتفق أنى لما قدمتها لم يكن معي شئ من النفقة البتة وأنا لا اعرف أحدا من أهلها فجعلت أمشي في زقاق منها كالحائر فإذا بشيخ قد أقبل نحوي مسرعا فسلم وهش في وجهي ووضع في يدي صرة فيها دراهم صالحة وقال لي انفق هذه الآن وخلي خاطرك مما أنت فيه فإن الله لا يضيعك ثم رد على أثره كأنه ما جاء إلا من أجلي فدعوت له وفرحت بذلك، وقلت لبعض من رأيته من الناس من هذا الشيخ؟ فقال وكأنك لا تعرفه هذا ابن تيمية
আমার নিকট শায়খ সালেহ আল –মুকরী বর্ণনা করেন, তিনি দামেশকের উদ্দেশে সফর করেন। তিনি বলেন, ঘটনাক্রমে ঐ সফরে আমার সঙ্গে কোন চলার মতো কোন খাবার বা অর্থ ছিলো না। আমি ওখানকার কাউকে চিনতাম না। এ অবস্থায় আমি উদভ্রান্তের মতো দামেশকের অলি-গলিতে ঘুরছিলাম। হঠাৎ একজন শায়খ আমার দিকে দ্রুত গতিতে হেঁটে এলেন। তিনি হাস্যোজ্জল মুখে সালাম দিলেন। তিনি আমার হাতে একটা থলি দিলেন যাতে কিছু খাটি দিরহাম ছিলো। এরপর বললেন, “ এগুলো ব্যবহার করো। তোমার অন্তরে যেই পেরেশানী আছে এগুলো ঝেড়ে ফেলো। আল্লাহ তায়ালা তোমাকে ধ্বংস করবেন না।” একথা বলে তিনি একই পথে ফিরে গেলেন। তিনি যেন শুধু আমার কাছেই এসেছিলেন। আমি তার জন্য দুয়া করলাম এবং এতে আনন্দি হলাম। আমি অন্যান্য মানুষকে জিজ্ঞেস করলাম, এই শায়খ কে? তারা বললো, তুমি মনে হয় শায়খকে চেনো না, তিনি হলেন ইবনে তাইমিয়া।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৪, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
কারামত-৫:
وحدثني الشيخ العالم المقريء تقي الدين عبد الله ابن الشيخ الصالح المقريء احمد بن سعيد قال سافرت إلى مصر حين كان الشيخ مقيما بها فاتفق أني قدمتها ليلا وأنا مثقل مريض فأنزلت في بعض الأمكنة فلم ألبث أن سمعت من ينادي باسمي وكنيتي فأجبته وأنا ضعيف فدخل إلي جماعة من أصحاب الشيخ ممن كنت قد اجتمعت ببعضهم في دمشق فقلت كيف عرفتم بقدومي وأنا قدمت هذه الساعة فذكروا أن الشيخ أخبرنا بأنك قدمت وأنت مريض وأمرنا أن نسرع بنقلك وما رأينا أحدا جاء ولا أخبرنا بشيء، فعلمت أن ذلك من كرامات الشيخ رضي الله عنه.”
শায়খ সালেহ আল-মুকরী এর ছেলে শায়খ তাকিউদ্দীন আব্দুল্লাহ আল-মুকরী আমাকে বলেছেন, শায়খ ইবনে তাইমিয়া রহ. যখন মিশরে ছিলেন তখন আমি মিশরে সফর করি। আমি রাতে মিশরে গিয়ে উপস্থিত হলাম। তখন আমার কাছে ভারী বোঝা ছিল আর আমি অসুস্থ ছিলাম। আমি এক জায়গায় গিয়ে বাহন থেকে নামলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে শুনতে পেলাম এক ব্যক্তি আমার নাম ও উপনাম ধরে ডাকছে। আমি দুর্বল শরীরে তার ডাকে সাড়া দিলাম। তখন শায়খ ইবনে তাইমিয়ার একদল ছাত্র আমার নিকট এলো। তাদের সাথে আমি পূর্বে দামেশকে সাক্ষাৎ করেছিলাম। আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা আমার আগমন সম্পর্কে কীভাবে জানলে; অথচ আমি মাত্র এলাম? তারা বলল, শায়খ ইবনে তাইমিয়া তাদেরকে বলেছে যে, আপনি এসেছেন এবং আপনার শরীর অসুস্থ। আমাদেরকে দ্রুত আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন। আমরা কাউকে আসতেও দেখিনি এবং আপনার সম্পর্কে কেউ পূর্বে সংবাদও দেয়নি। আমি তখন বুঝলাম এটি শায়খের কারামত।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৪, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
কারামত-৬:
“وحدثني أيضا قال مرضت بدمشق إذ كنت فيها مرضة شديدة منعتني حتى من الجلوس فلم اشعر إلا والشيخ عند رأسي وأنا مثقل مشتد بالحمى والمرض فدعا لي وقال جاءت العافية، فما هو إلا أن فارقني وجاءت العافية وشفيت من وقتي”
শায়খ সালেহ আল-মুকরী এর ছেলে শায়খ তাকিউদ্দীন আব্দুল্লাহ আল-মুকরী আরও বলেন, আমি দামেশকে কঠিন রোগে আক্রান্ত হলাম। এমনকি আমি বসতেও পারতাম না। হঠাৎ আমার মাথার নিকট শায়খকে দেখতে পেলাম।তখন আমি মারাত্মক জ্বর ও রোগে আক্রান্ত ছিলাম।তিনি আমার জন্য দুয়া করলেন এবং বললেন, সুস্থতা চলে এসেছে।তিনি আমার কাছ থেকে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি সুস্থ হয়ে গেলাম।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৫, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
কারামত-৭:
“وحدثني أيضا قال أخبرني الشيخ ابن عماد الدين المقرئ المطرز قال قدمت على الشيخ ومعي حينئذ نفقة فسلمت عليه فرد علي ورحب بي وأدناني ولم يسألني هل معك نفقة أم لا، فلما كان بعد أيام ونفدت نفقتي أردت أن اخرج من مجلسه بعد أن صليت مع الناس وراءه فمنعني وأجلسني دونهم فلما خلا المجلس دفع إلي جملة دراهم وقال أنت الآن بغير نفقة فارتفق بهذه فعجبت من ذلك وعلمت أن الله كشفه على حالي أولا لما كان معي نفقة وآخرا لما نفدت واحتجت إلى نفقة.”
আমার নিকট তিনি আরও বর্ণনা করেছেন, আমার নিকট শায়খ ইবনে ইমাদুদ্দিন আল-মুকরী আল-মুতাররায বর্ণনা করেন, তিনি বলেন আমি একবার শায়খের নিকট আগমন করলাম। তখন আমার কাছে খরচের টাকা-পয়সা ছিলো। আমি তাকে সালাম দিলাম, তিনি উত্তর দিলেন এবং আমাকে স্বাগত জানালেন। আমাকে তিনি তার নিকটে বসালেন। এবার তিনি আমার জীবিকা নির্বাহের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন না। কিছুদিন পর আমার খরচের উপকরণ শেষ হয়ে গেল। তখন আমি তার পিছে নামায আদায় করে তার মজলিশ থেকে বের হতে উদ্যত হলাম। তিনি আমাকে বাধা দিয়ে বসতে বললেন। এরপর যখন মজলিশ শেষ হলো, তখন তিনি আমাকে কিছু দিরহাম দিয়ে বললেন, এখন তোমার কোন খরচের টাকা-পয়সা নেই। এগুলো ব্যবহার করতে থাকে। এ ঘটনায় আমি বিস্মিত হলাম। বুঝলাম যে আল্লাহ তায়ালা আমার পূর্বের ও বর্তমান অবস্থা শায়খের নিকট প্রকাশ করে দিয়েছেন।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৬, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
কারামত-৮: মৃত সম্পর্কে সংবাদ:
“وحدثني من لا أتهمه أن الشيخ رضي الله عنه حين نزل المغل بالشام لأخذ دمشق وغيرها رجف أهلها وخافوا خوفا شديدا، وجاء إليه جماعة منهم وسألوه الدعاء للمسلمين فتوجه إلى الله ثم قال أبشروا فإن الله يأتيكم بالنصر في اليوم الفلاني بعد ثالثة حتى ترون الرؤوس معبأة بعضها فوق بعض.قال الذي حدثني فوالذي نفسي بيده أو كما حلف ما مضى إلا ثلاث مثل قوله حتى رأينا رؤوسهم كما قال الشيخ على ظاهر دمشق معبأة بعضها فوق بعض.”
আমার নিকট বিশ্বস্ত এক ব্যক্তি বর্ণনা করেছেন, যখন মোগলরা দামেশক ও অন্যান্য অন্চল দখলের জন্য শামে আক্রমণ করলো, দামেশকের অধিবাসীরা খুবই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। এসময় একদল মুসলমান শায়খ ইবনে তাইমিয়া রহ. এর নিকট আগমন করলেন এবং তাকে মুসলমানদের জন্য দুয়া করার অনুরোধ করলেন। তিনি আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করলেন। এরপর বললেন, তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ করো, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তিন দিন পর তোমাদেরকে সাহায্য করবেন, এমনকি তোমরা দেখবে যে একটার উপর আরেকটা মাথা স্তুপ হয়ে থাকবে। ঘটনার বর্ণনাকারী বলেন, আল্লাহর শপথ, তৃতীয় দিন দামেশকের প্রবেশ মুখে শত্রুদের মাথাগুলো একটার উপর আরেকটা স্তুপ হয়েছিলো যেমন শায়খ বলেছিলেন।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৬, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
কারামত-৯:
“وحدثني الشيخ الصالح الورع عثمان بن احمد بن عيسى النساج أن الشيخ رضي الله عنه كان يعود المرضى بالبيمارستان بدمشق في كل أسبوع فجاء على عادته فعادهم فوصل إلى شاب منهم فدعا له فشفي سريعا وجاء إلى الشيخ يقصد السلام عليه فلما رآه هش له وأدناه ثم دفع إليه نفقة وقال قد شفاك الله فعاهد الله أن تعجل الرجوع إلى بلدك أيجوز أن تترك زوجتك وبناتك أربعا ضيعة وتقيم هاهنا؟ فقبل يده وقال يا سيدي أنا تائب إلى الله على يدك وقال الفتى وعجبت مما كاشفني به وكنت قد تركتهم بلا نفقة ولم يكن قد عرف بحالي أحد من أهل دمشق.”
শায়খ উসমান ইবনে আহমাদ ইবনে ইসা আন-নাসসাজ আমার নিকট বর্ণনা করেছেন, শায়খ ইবনে তাইমিয়া রহ. দামেশকের বিমারিস্তান নামক জায়গায় প্রত্যেক সপ্তাহে রোগীদের দেখতে আসতেন। অভ্যাস অনুযায়ী তিনি রোগী দেখতে এলেন। তাদের মধ্যে এক যুবককে তিনি দেখলেন এবং তার জন্য দুয়া করলেন। সে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠল। যুবকটি শায়খকে সালাম দেয়ার জন্য এলো। তাকে দেখে শায়খ হাসিমুখে নিকটে বসালেন। তার কাছে কিছু খরচের টাকা-পয়সা দিলেন এবং বলেন, আল্লাহ তায়ালা তোমাকে সুস্থ করেছেন। সুতরাং তুমি আল্লাহর কাছে ওয়াদা করো যে তুমি দ্রুত পরিবারের কাছে ফিরে যাবে। তোমার জন্য কখনও বৈধ হবে যে তোমার স্ত্রী ও চার কন্যাকে ধ্বংসের মুখে রেখে এখানে অবস্থান করবে? যুবকটি বলল, আমি তার হাতে চুমু দিলাম এবং বললাম, শায়খ, আমি আল্লাহর নিকট আপনার হাতে তওবা করছি।
আমি তার কাশফ দেখে বিস্মিত হলাম। বাস্তবেই আমি আমার পরিবারকে সহায়-সম্বলহীন রেখে এসেছিলাম।দামেশকের কেউ আামার পরিবার সম্পর্কে অবগত ছিলো না।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৬, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
এই কারামতগুলো লিখে আবু হাফস আল-বাযযার রহ. লিখেছেন,
و كرامات الشيخ رضي الله عنه كثيرة جدا لا يليق بهذا المختصر أكثر من ذكر هذا القدر منها . ومن أظهر كراماته أنه ما سمع بأحد عاداه أو غض عنه إلا و أبتلي بعدة بلايا غالبها في دينه وهذا ظاهر مشهور لا يحتاج فيه إلي شرح صفته
শায়খ রহ. অনেক কারামত রয়েছে। এই সংক্ষিপ্ত বইয়ে সেগুলো উল্লেখ করা সঙ্গত নয়। তার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ করামত হলো যে কেউ শায়খের বিরোধীতা করেছে বা তার সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক রয়েছে, সে বিভিন্ন ধরনের বালা-মুসীবতে নিপতিত হয়েছে। বেশিরভাগ মুসীবত দীন সম্পর্কীয়। বিষয়গুলো স্পষ্ট ও প্রকাশিত। এগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা অনাবশ্যক।
[আল-আ’লামুল আলিয়্যা ফি মানাকিবি ইবনে তাইমিয়া, পৃ.৫৮, তাহকীক, সালাহুদ্দীন আল-মুনজিদ, প্রকাশকাল, ১৯৭৬ ইং, দারুল কিতাবিল জাদীদ, বয়রুত, লেবানন]
কাশফ ও ইলহাম সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া রহ. এর অনেক কারামত রয়েছে। এ বিষয়ে তার অনেক বক্তব্যও আছে। এগুলোর কিছু কিছু ইবনে তাইমিয়া রহ. এর দৃষ্টিতে তাসাউফ বইয়ে উল্লেখ করেছি। দু:খজনক বিষয় হলো, আমাদের আজকের আলোচনার মূল বিষয় এখনও শুরু করা হয়নি। আজ এখানেই ইতি টানছি। পরবর্তী আলোচনায় গায়েব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করা হবে।
------ ------
[বর্তমানে ইবনে আবিল ইযের আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাগ্রন্থটি ব্যাপকভাবে প্রচারের চেষ্টা করা হচ্ছে। যেমন, সালাফী আলেম আব্দুল্লাহ শাহেদ মাদানী এর বাংলা অনুবাদ করে অনলাইনে প্রচার করছেন। সুতরাং এই কিতাবের বাস্তবতা ও এর লেখক সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাগুলো সুস্পষ্ট করা আবশ্যক। আকিদাতুত ত্বহাবীর উপর দরসের নিয়ত ব্যক্ত করেছিলাম কিছু দিন আগে। উক্ত দরসের প্রয়োজনে আজকের আলোচনাটি লেখা। যারা উক্ত দরস দেখবেন, আশা করি বিষয়টি তাদের উপকারে আসবে। ]
সৌদি আরবের কল্যাণে কাররামিয়াদের ভ্রান্ত দেহবাদী আকিদাগুলো সালাফী মতবাদের মোড়কে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। পেট্র-ডলারের সহায়তায় তারা এক্ষেত্রে অনেকটা অগ্রসর। সালাফীদের ভ্রান্ত আকিদা সম্পর্কে বেশ কিছু প্রবন্ধ লেখার সুযোগ হয়েছে আল-হামদুলিল্লাহ। আমাদের আইডিয়ার ওয়েবসাইটে লেখাগুলো পাবেন। সালাফী মতবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে থাকে। এর মধ্যে একটি বিশেষ কৌশল হল, বিভিন্ন ইমামের আকিদার কিতাব ব্যাখ্যার নামে নিজেদের ভ্রান্ত আকিদা ছড়িয়ে দেয়া। উদাহরণ হিসেবে ইমাম ত্বহাবীর আকিদাতুত ত্বহাবীর কথা বলা যায়। একটু খোজ নিলে দেখবেন, প্রায় প্রত্যেক সালাফী শায়খই আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখেছেন, কেউ অডিও বা ভিডিও লেকচার দিয়েছেন। অন্তত বিশ-পজিশজন বা এর চেয়ে বেশি সালাফী শায়খের ব্যাখ্যা পাবেন। একটি মৌলিক প্রশ্ন হল, এসব সালাফী আলেমরা কি ইমাম ত্বহাবীর আকিদা পোষণ করেন? ধ্রুব সত্য হল, ইমাম ত্বহাবীর আকিদার সাথে এদের আকিদার দূরতম কোন সম্পর্ক নেই। ইমাম ত্বহাবী রহ. এর আকিদার ও এদের আকিদার মাঝে আসমান-জমিনের ফারাক। আরেকটি প্রশ্ন মনে উকি দেয়, এরা যেহেতু ইমাম ত্বাহাবীর আকিদা পোষণ করে না, তাহলে এর ব্যাখ্যা করে কেন? সহজ উত্তর হল, ইমাম ত্বহাবীর আকিদা প্রচারের ছদ্মাবরণে নিজেদের ভ্রান্ত আকিদা প্রচার। এদের যে কোন একটা ব্যাখ্য পড়লেই এই বাস্তবতা উপলব্ধি করবেন।
সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে ইমাম ত্বহাবী রহ. এর আকিদাকে বিকৃত করার লক্ষ্যে লিখিত একটি বেনামী ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৩৪৯ হিজরীতে। বে-নামী ব্যাখ্যা এজন্য বললাম, উক্ত ব্যাখ্যার উপর লেখকের নাম ছিল না। আর প্রশাকগণ নিশ্চিত ছিলেন না যে, ব্যাখ্যাগ্রন্থটি মূলত: কার। পরবর্তীতে তারা তত্ব-তালাশ করে উদ্ধার করেন, এটি ইবনে আবিল ইয আল-হানাফীর লেখা। বর্তমানে এটি ইবনে আবিল ইযের ব্যাখ্যা হিসেবে প্রচার করা হয়। আমাদের আলোচ্য বিষয় শিরোনাম থেকে কিছুটা স্পষ্ট। তবে দু’টি বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করার চেষ্টা করব। ১. ইবনে আবিল ইযের নামে প্রচারিত আকিদা কি আসলেই ইবনে আবিল ইযের লেখা?২. ইবনে আবিল ইযকে হানাফী হিসেবে প্রচার করা হয়। তিনি কি হানাফী ছিলেন না কি দেহবাদী আকিদায় বিশ্বাসী হাশাবী ছিলেন?
প্রচলিত আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যা কি ইবনে আবিল ইযের?
বিষয়টি বোঝার জন্য ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রকাশের ইতিহাসের দিকে ফিরে যেতে হবে। আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যাগ্রন্থটি ১৩৪৯ হিজরীতে মক্কায় সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়।
এই প্রকাশনায় কিতাবের উপর লেখকের কোন নাম ছিল না। বরং প্রকাশকরা লেখেন,
راجعنا ما في أيدينا من كتب التراجم والفنون، فلم نجد ما يمكننا معه الجزم بنسبته لشخص بعينه، وإنا نثبت هنا أسماء شارحي هذه العقيدة الذين عدهم صاحب كشف الظنون وهم سبعة ……. ومنهم صدر الدين علي بن محمد بن أبي العز الأذرعي الدمشقي الحنفي المتوفى سنة 746هـ وهو الذي يترجح الظن أنه الشارح” আমাদের কাছে বিদ্যমান বিভিন্ন জীবনীগ্রন্থ ও রিজালের কিতাবে আমরা অনুসন্ধান চালিয়েছি। আমরা এমন কোন তথ্য পাইনি, যার আলোকে সুনিশ্চিতভাবে ব্যাখ্যাগ্রন্থটিকে সুনির্দিষ্ট কোন লেখকের দিকে সম্পৃক্ত করা সম্ভব। কাশফুজ জুনুন এর লেখকের বক্তব্য অনুযায়ী আমরা এখানে আকিদাত্ব ত্বহাবীর সমস্ত ব্যাখ্যাকারের নাম উল্লেখ করছি। তারা হলেন সাতজন…….। এদের মাঝে একজন ব্যাখ্যাকার হলেন, সদরুদ্দিন আলী ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবিল ইয হানাফী (মৃত:৭৪৬ হি:)। আমাদের বিশেষ ধারণা হল, সাতজন ব্যাখ্যাকারের মাঝে তিনি হলেন আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাকার। “
এখানে প্রবল ধারণা হিসেবে সদরুদ্দিন আলী ইবনে মুহাম্মাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যার মৃত্যু তারিখ হল, ৭৪৬ হিজরী। আর বর্তমানে প্রচারিত ব্যাখ্যাকার হলেন, আলী ইবনে আলী ইবনে আবিল ইয। যার মৃত্যু তারিখ হল, ৭৯২ হিজরী। এখানে প্রবল ধারণা হিসেবে যার কথা বলা হয়েছে, তিনি হলেন বর্তমানে প্রচারিত লেখকের পিতা। ছেলে আর পিতা কখনও এক হতে পারে না। উভয়ের মৃত্যু তারিখ থেকেও বিষয়টি স্পষ্ট। মোটকথা, ব্যাখ্যাগ্রন্থটি কার সেটা সুনিশ্চিতভাবে বলার মত কোন তথ্য তখনকার উলামায়ে কেরাম পাননি। পরবর্তীতে সৌদি আরবের শায়খগণ বিখ্যাত আলেম আহমাদ শাকেরকে এটি তাহকীক করার অনুরোধ করেন। শায়খ আহমাদ শাকের পরবর্তীতে এটি তাহকীক করে প্রকাশ করেন।
তিনি এর ভূমিকায় লেখেন, ” এ কিতাবের যে মাখতুতা বা হস্তলিপি আমি পেয়েছি, সেখানে মূল লেখকের নেই। সুতরাং কিতাবের লেখক আসলে কে সেটা জানা সম্ভব হয়নি। ”
শায়খ আহমাদ শাকের তার ভূমিকায় কয়েকবার বলেছেন যে, তিনি এই কিতাবের নির্ভরযোগ্য কোন মাখতুতা বা হস্তলিপি পাননি।
তিনি তার সাধ্য অনুযায়ী এটি তাহকীক করার চেষ্টা করেছেন। শায়খ আহমাদ শাকের আশা ব্যক্ত করেছেন, তিনি যদি নির্ভরযোগ্য কোন হস্তলিপি পান, তাহলে পরবর্তীতে এটি সংশোধনের চেষ্টা করবেন।
শায়খ আহমাদ শাকের বলেন,
ولكني لا أزال أرى هذه الطبعة مؤقتة أيضا، حتى يوفقنا الله إلى أصل محفوظ للشرح صحيح، يكون عمدة في التصحيح فنعيد طبعه
“আমি এখনও মনে করি, এই সংস্করণ অস্থায়ী। আল্লাহ তায়ালা যদি নির্ভরযোগ্য বিশুদ্ধ কোন হস্তলিপি মিলিয়ে দেন, তাহলে এটি সংশোধন করে নতুনভাবে প্রকাশ করার করব। শায়খ আহমাদ শাকের আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. [মৃত: ১২০৫ হি:] এর একটি বক্তব্য পান ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিনে। সেখানে মোর্তজা যাবিদি রহ. ব্যাখ্যাকারের নাম লিখেছেন, আলী ইবনে আলী ইবনে মুহাম্মাদ আল-গাজ্জী আল-হানাফী। মোর্তজা যাবিদি রহ. এর উদ্ধৃতিতে লেখকের সঠিক পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি।
শায়খ আহমাদ শাকের বলেন, মোর্তজা যাবিদি রহ. লেখকের নামের নিসবতে ভুল করেছেন। তিনি লিখেছেন, আলী ইবনে আলী আল-গাজ্জী, বাস্তবে হওয়ার কথা ছিল, আলী ইবনে আলী ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী। মোটকথা, শায়খ আহমাদ শাকেরের সামনে মোর্তজা যাবিদি রহ. এর উদ্ধৃতি ছিল, বেশ কয়েকটি মাখতুতা ছিল এরপরেও ব্যাখ্যাকার সম্পর্কে সুনিশ্চিতভাবে বলেননিন যে, অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে, উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের লেখক ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী। শায়খ আহমাদ শাকের মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্যের আলোকে তার ধারণা অনুযায়ী কিতাবে লেখকের নাম লিখেছেন, আলী ইবনে আলী ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী। পরবর্তীতে মাকতাবাতুল ইসলামী থেকে শায়খ আলবানীর তাহকীকে ব্যাখ্যাগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। সেখানে কিছু মাখতুতা বা হস্তলিপি এর চিত্র দেয়া হয়েছে। এসকল হস্তলিপিতে স্পষ্টভাবে লেখকের নাম লেখা হয়েছে, আলী ইবনে মুহাম্মাদ। যার মৃত্যু তারিখ, ৭৪৬ হি:। সুতরাং মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্য অনুযায়ী, লেখকের নাম হওয়ার কথা ছিল, আলী ইবনে আলী আল-গাজ্জী। মাকতাবাতুল ইসলামী এর মাখতুতা অনুযায়ী, লেখকের নাম আলী ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবিল ইয। সুতরাং একথা সুনিশ্চিতভাবে বলার অবকাশ নেই যে, উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের প্রকৃত লেখক কে। এরপরেও শায়খ আলবানী ও যুহাইর আশ-শাবীশ দাবী করেন, সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হল, উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের লেখক ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী।
শায়খ যুহাইর আশ-শাবীস নবম সংস্করণের ভূমিকায় ( পৃ.৯) লিখেছেন,
وأما نسختنا فقد كان اسم مؤلفها مثبتا على الورقة الأولى منها، إلا أن بعض الأيدي قد لعبت فيه بالمحو والكتابة أكثر من مرة، وأخيرا أثبت عليه ما أثبته الشيخ أحمد شاكرঅর্থ: আমাদের মূল হস্তলিপিতে লেখকের নাম প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা ছিল। তবে অজ্ঞাত কেউ উক্ত নাম কয়েকবার ঘষা-মাজা করে নতুনভাবে লিখেছে। অবশেষে আমি শায়খ আহমাদ শাকেরের তথ্য অনুযায়ী লেখকের নাম উল্লেখ করেছি।মোটকথা, এই ব্যাখ্যাগ্রন্থের মূল হস্তলিপিতে লেখকের নাম উল্লেখ নেই। পরবর্তীতে বিভিন্ন ঘষা-মাজার মাধ্যমে অজ্ঞাত কেউ হস্তলিপিতে লেখকের নাম সংযুক্ত করেছে। ঘষা-মাজা করে নাম সংযুক্ত করার পরও বর্তমানে প্রচলিত লেখকের নাম উক্ত হস্তলিপিতে নেই। বরং প্রচলিত লেখকের পিতার নাম ও তার মৃত্যু তারিখ দেয়া রয়েছে।
চূড়ান্ত কথা:
ইবনে আবিল ইয এধরণের ব্যাখ্যাগ্রন্থ লেখাটা অসম্ভব নয়। প্রবল ধারণা মতে হয়ত তিনি এটি লিখেছেন। কিন্তু ইবনে ইয এর লেখক হওয়ার ব্যাপারে অকাট্য কোন প্রমাণ কারও কাছে নেই, যার আলোকে নি:সন্দেহে বলা যাবে, এটি ইবনে আবিল ইয আল-হানাফী লিখেছেন। ইবনে আবিল ইয আল-হানাফীর জীবনী থেকে একটা ধারণা সৃষ্টি হয়, হয়ত তিনি এটি লিখেছেন। আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. এর উদ্ধৃতি থেকে হয়ত ধারণাটি আরেকটু মজবুত হয়। কিন্তু এটা সুনিশ্চিত বা অকাট্য কোন প্রমাণ বলার সুযোগ নেই। উক্ত ব্যাখ্যাগ্রন্থের লেখক ইবনে আবিল ইয হলেও আমাদের কোন আপত্তি নেই। না হলেও এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই। কিতাবটি ছেলে লিখেছে না কি তার পিতা লিখেছে সেটাও মৌলিক কোন বিষয় নয়।
আমাদের নিকট মূল বিবেচ্য বিষয় হল, ইবনে আবিল ইযকে হানাফী হিসেবে প্রচার করা হয়। সেই সাথে এটাও বোঝানো হয় যে, তিনি হানাফীদের আকিদার প্রতিনিধত্ব করেন। অন্যান্য হানাফীগণ তার বিরোধীতা করে মূলত: হানাফীদের মৌলিক আকিদার বিরোধিতা করে থাকে।
আমাদের সামনে মৌলিক কয়েকটি প্রশ্ন দেখা দিয়েছে,
১. ইবনে আবিল ইয বাস্তবেই কি হানাফী ছিলেন?
২. তিনি আদৌ কি হানাফী মাজহাবের সুপ্রতিষ্ঠিত আকিদার অনুসারী ছিলেন?৩. তার লেখা ব্যাখ্যাগ্রন্থ ইমাম ত্বহাবী বা হানাফী মাজহাবের মৌলিক আকিদার প্রতিনিধিত্ব করে কি?৪. ইবনে আবিল ইযের আকিদা হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমদের নিকট নির্ভরযোগ্য কি?
৫. ইবনে আবিল ইযকে হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণ নির্ভরযোগ্য আলেম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন কি?
৬. হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণ ইবনে আবিল ইযের আকিদার সাথে সহমত পোষণ করেন না কি তার প্রবল বিরোধীতা করেন?
৭. হানাফী মাজহাবের উলামায়ে কেরামের জীবনীর উপর বিভিন্ন গ্রন্থ লেখা হয়েছে। এসকল কিতাবে হানাফী আলেম হিসেবে তার জীবনী বা নির্ভরযোগ্য আলেম হিসেবে কোথাও তস্বীকৃতি দেয়া হয়েছে কি?আমরা ইনশাআল্লাহ প্রত্যেকটি বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করব।
ইবনে আবিল ইযের মাজহাব:
শরহে আকিদাতু ত্বহাবীর তাহকীক করেছেন, শায়খ শুয়াইব আরনাউত ও শায়খ আব্দুল্লাহ তুরকী। তারা উক্ত তাহকীকে ইবনে আবিল ইযের জীবনী আলোচনা করেছেন। তার জীবনী আলোচনা করতে গিয়ে তারা লিখেছেন, ইবনে আবিল ইযকে হানাফী মাজহাবের দিকে সম্পৃক্ত করা হয়। তবে বাস্তবে তিনি নিজের গর্দানকে তাকলীদের (মাজহাব অনুসরণ) বন্ধন থেকে মুক্ত করেন। শায়খ শুয়াইব আরনাউত ও শায়খ আব্দুল্লাহ তুরকীর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ইবনে আবিল ইয একজন গাইরে মুকাল্লিদ, লা-মাজহাবী বা যাহেরী ছিল।
ইবনে আবিল ইয পারিবারিকভাবে হানাফী ছিল। যেমন শায়খ আলবানী পারিবারিকভাবে হানাফী ছিল। কিন্তু কেউ হানাফী পরিবারে জন্মগ্রহণ করলে, কিংবা হানাফী মাদ্রাসায় পড়লে বা পড়ালে সে হানাফী হয়ে যায় না। আমাদের দেশের অধিকাংশ লা-মাজহাবী হানাফী পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও তারা গাইরে মুকাল্লিদ। একইভাবে বর্তমানে আহলে হাদীসদের অধিকাংশ শায়খ হানাফী মাজহাবের মাদ্রাসায় পড়া-লেখা করেছে, কিন্তু তারা হানাফী নয়। সুতরাং কারও হানাফী হওয়াটা তার পরিবার, পিতা-মাতা বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করে না। ইবনে আবিল ইয জন্মগতভাবে হানাফী হলেও বাস্তবে সে হানাফী নয়। বরং ইবনে আবিল ইয একজন গাইরে মুকাল্লিদ বা লা-মাজহাবী।সুতরাং তাকে হানাফী হিসেবে প্রচার করে তাকে হানাফী মাজহাব বা আকিদার প্রতিনিধি হিসেবে প্রকাশ করা একটি মারাত্মক ভুল।
যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেই যে, ইবনে আবিল ইয হানাফী ফিকহের অনুসারী ছিল, কারণ সে হানাফী মাজহাবের মাদ্রাসায় শিক্ষতা করেছে, তাহলে এটি কখনও বলা সম্ভব নয় যে, সে আকিদার দিক থেকেও হানাফী ছিলা। মু’তাজিলা সম্প্রদায়ের অনেকেই হানাফী মাজহাবের অনুসারী ছিল, কিন্তু তাদের কাউকে হানাফী বলা হয় না। একইভাবে কাররামিয়াদের অনেকেই হানাফী মাজহাব অনুসরণ করত। কিন্তু তাদেরকেও হানাফী বলা হয় না। ফিকহের দিক থেকে কেউ হানাফী ফিকহ অনুসরণ করলেই তাকে হানাফী হিসেবে পরিচয় দেয়া হয় না। কারণ হানাফী হিসেবে কারও পরিচিতি এটা প্রমাণ করে যে, সে আকিদা ও ফিকহ উভয় ক্ষেত্রে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অন্তর্ভূক্ত। কেউ যদি ফিকহের ক্ষেত্রে হানাফী মাজহাব অনুসরণ করে, কিন্তু আকিদার ক্ষেত্রে আহলে সু্ন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত আকিদা পোষণ করে তাকে হানাফী বলা হয় না। বরং আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত আকিদার দিকে তাকে সম্পৃক্ত করা হয়। কাররামিয়া মতবাদের অনুসারী কারও নামের শেষে হানাফী লাগিয়ে দিয়ে আকিদা ও ফিকহে তাকে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের অন্তর্ভূক্ত করার অপচেষ্টা কেউ করলে সেটি অবশ্যই বাস্তবতা বিরোধী। সুতরাং ফিকহ ও আকিদা উভয় ক্ষেত্রে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত ইবনে আবিল ইযকে কীভাবে হানাফী হিসেবে পরিচয় দেয়া হয়? তার বাহ্যিক অবস্থা বিবেচনা করে হানাফী লিখলেও তাকে যদি কেউ হানাফী ফিকহ বা আকিদার প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন করে, তাহলে অবশ্যই আমরা বলব, প্রকৃতপক্ষে ইবনে আবিল ইয ফিকহ ও আকিদা কোন ক্ষেত্রেই হানাফী ছিল না। বরং সে কাররামিয়াদের অনুসারী হাশাবী বা দেহবাদী আকিদায় বিশ্বাসী ছিল। ইবনে আবিল ইযের যেসকল কিতাব তার দিকে সম্পৃক্ত করা হয়, তার প্রত্যেকটি সে হানাফী মাজহাবের বিরুদ্ধে লিখেছে। হানাফী মাজহাবের পক্ষে তার বিশেষ কোন খেদমত নেই।
ইবনে আবিল ইযের গাইরে মুকাল্লিদ হওয়ার আরেকটি প্রমাণ হল, তার একটি কিতাব বর্তমানের আহলে লা-মাজহাবীরা প্রচার করে থাকে। আহলে হাদীস আলেম আতাউল্লাহ হানীফ ইবনে আবিল ইযের “আল-ইত্তেবা” কিতাবটি তাহকীক করে প্রকাশ করেছে। পরবর্তীতে আবু সুহাইব আসিম ইবনে আব্দুল্লাহ আল-কারইউতী এটি তাহকীক করেছে। আবু সুহাইব এই কিতাবের ভূমিকায় হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেম আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. ও আল্লামা যফর আহমাদ উসমানী রহ. এর বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছে এবং এসমস্ত বিখ্যাত আলেমদের বিরুদ্ধে ইবনে আবিল ইযের বক্তব্য উপস্থাপন করেছে। যেখানে ইবনে আবিল ইয সুনিদিষ্ট একটি মাজহাবের অনুসারীকে শিয়াদের সাথে তুলনা করেছে। নাউযুবিল্লাহ। ইবনে আবিল ইযের অবস্থা থেকে বাংলা ভাষার প্রসিদ্ধ একটি প্রবাদবাক্য মনে পড়ে গেল। “মার চেয়ে মাসির দরদ বেশি” ।ইবনে আবিল ইযের প্রতি সালাফী ও আহলে হাদীসদের অতিশয় আগ্রহ এটিই প্রমাণ করে। বর্তমানের সালাফীরা হানাফী মাজহাবের উলামায়ে কেরামকে তাদের আকিদার বিরোধী হওয়ার কারণে কাফের, বিদযাতী, জাহমী, মুয়াত্তিলা ইত্যাদি আখ্যায়িত করে। এ বিষয়ে অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। হানাফী মাজহাবের অধিকাংশ আলেম যাদের কাছে কাফের ও বিদয়াতী, তারাই ইবনে আবিল ইযের আকিদা প্রচার করছে। আবার উপমহাদেশের লা-মাজহাবীরা মাজহাবের অনুসারীদেরকে মুশরিক বলে বিশ্বাস করে, অথচ তারাই আবার ইবনে আবিল ইযের কিতাব প্রকাশ ও প্রচার করছে। ইবনে আবিল ইয আসলেই যদি হানাফী হত, তাহলে হানাফীদেরকে যারা কাফের-মুশরিক আখ্যা দিচ্ছে, তারা কেন তার কিতাব নিয়ে এত মাতামাতি করে?
ইবনে আবিল ইয সম্পর্কে হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণের বক্তব্য:
মোল্লা আলী কারী রহ. এর বক্তব্য:
মোল্লা আলী কারী রহ. শরহে ফিকহুল আকবারে আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যাকার সম্পর্কে লিখেছেন,
والحاصل ان الشارح يقول بعلو المكان مع نفي التشبيه وتبع فيه طائفة من أهل البدعة
মোটকথা, আকিদাতুত ত্বাহাবীর ব্যাখ্যাকার তাশবীহমুক্ত অবস্থায় আল্লাহ তায়ালা স্থানগতভাবে উপরের দিকে রয়েছেন বলে বিশ্বাস করে। এক্ষেত্রে সে একদল বিদয়াতীর অনুসরণ করেছে। তিনি আরও বলেন,
و من الغريب أنه إستدل على مذهبه الباطل برفع الأيدي في الدعاء إلى السماء
অর্থ: আশ্চর্যের বিষয় হল, সে তার ভ্রান্ত মতবাদ প্রমাণ করতে গিয়ে দুয়ার সময় হাত উপরের দিকে উঠানোর দলিল দিয়েছে। (শরহুল ফিকহিল আকবার, পৃ.১৭২. আল-ইলিময়া)মোল্লা আলী কারী রহ. এর বক্তব্য থেকে দু’টি বিষয় স্পষ্ট। তিনি ইবনে আবিল ইযকে বিদয়াতীদের অনুসারী বলেছেন। এবং তার মতবাদকে বাতিল বা ভ্রান্ত মতবাদ আখ্যায়িত করেছেন।
আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্য:
আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিনে ইবনে আবিল ইয সম্পর্কে লিখেছেন,
“ولما تأملته حق التأمل؛ وجدته كلامًا مخالفًا لأصول مذهب إمامه!! وهو في الحقيقة كالرد على أئمة السنة، كأنه تكلم بلسان المخالفين، وجازف وتجاوز عن الحدود، حتى شبه قول أهل السنة بقول النصارى! فليتنبه لذلك”.
অর্থ: আমি তার (ইবনে আবিল ইযের) বক্তব্য সম্পর্কে পরিপূর্ণ চিন্তা-ভাবনা করে দেখেছি, তার বক্তব্য তার ইমামের মাজহাবের মৌলিক নীতিমালার সম্পূর্ণ বিরোধী। বরং প্রকৃতপক্ষে তার বক্তব্য যেন আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের ইমামগণের বক্তব্য খন্ডনে লিখিত। তার বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয়, সে যেন আহলে সুন্নতের ইমামগণের সাথে প্রতিপক্ষ হিসেবে কথা বলেছে। সে মারাত্মক বিকৃতির শিকার হয়েছে এবং সীমা অতিক্রম করেছে। এমনকি সে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের ইমামগণের বক্তব্যকে খ্রিষ্টানদের বক্তব্যের সাথে তুলনা করেছে। সুতরাং এ বিষয় সতর্ক থেক। [ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকিন, খ.২, পৃ.১৪৬]
আল্লামা মোর্তজা যাবিদি রহ. এর বক্তব্য থেকে যেসকল বিষয় স্পষ্ট:
১. ইবনে আবিল ইয হানাফী মাজহাবের মৌলিক নীতিমালা অনুসরণ করত না।
২. তার লেখনী মূলত: হানাফী মাজহাব ও আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের বক্তব্য খন্ডনের উদ্দেশ্যে লিখিত।৩. হানাফী মাজহাব ও আহলে সুন্নতের উলামায়ে কেরামের সাথে যেন সে প্রতিপক্ষ হিসেবে কথা বলেছে।
৪.সে মারাত্মক প্রগলভতার শিকার হয়ে সীমা অতিক্রম করেছে।
৫. আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের উলামায়ে কেরামের বক্তব্যকে খ্রিষ্টানদের বক্তব্যের সাথে তুলনা করেছে।
৬. আল্লামা যাবিদি রহ. তার এসব বক্তব্যের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেছেন।
আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. এর বক্তব্য:
হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত ইমাম আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাকার সম্পর্কে বলেন,
وطبع شرح لمجهول ينسب إلى المذهب الحنفي زورا ينادي صنع يده بأنه جاهل بهذا الفن وأنه حشوي مختل العيار
“আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যা হিসেবে একজন অজ্ঞাত ব্যক্তির একটি ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। যাকে বানোয়াটী করে হানাফী মাজহাবের দিকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এ লোকের লেখনী দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করে যে সে আকিদা সম্পর্কে অজ্ঞ। সে একজন হাশাবী বা দেহবাদী এবং মারাত্মক বিচ্যুতির শিকার। “[আল-হাবী ফি সিরাতিল ইমামিত ত্বহাবী, পৃ. ৩৮]আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. এর বক্তব্য থেকে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট। প্রথমত: ইবনে আবিল ইযকে হানাফী মাজহাবের দিকে সম্পৃক্ত করা একটি বানোয়াট বা মিথ্যা। বাস্তবে সে হানাফী ছিল না। দ্বিতীয়ত: ইবনে আবিল ইয আকিদা বিষয়ে জাহেল বা অজ্ঞ ছিল এবং সে একজন মুজাসসিমা বা দেহবাদী আকিদার অনুসারী হাশাবী ছিল। আল্লামা যাহেদ আল-কাউসারী রহ. এর বক্তব্য অনুযায়ী আমরা ইবনে আবিল ইযকে হানাফী না বলে দেহবাদী আকিদার অনুসারী হাশাবী বলতে পারি।
ইবনে আবিল ইযের সম-সাময়িক আলেমগণের বিরোধীতা:ইবনে আবিল ইযের ভ্রান্ত কিছু বক্তব্য প্রকাশিত হওয়ার তখনকার বিখ্যাত আলেমগণ তার প্রতিবাদ করেন। বিশেষভাবে অন্যান্য তিন মাজহাবের বিখ্যাত আলেমগণের সাথে হানাফী মাজহাবের আলেমগণও তার প্রতিবাদ করেন।
আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহ. তার ‘ইম্বাউল গুমর বি আবনায়িল উমর’ কিতাবে লিখেছেন,
وأن العلماء بالديار المصرية خصوصا أهل مذهبة من الحنفية أنكرواذلك عليه
অর্থ: মিশরের আলেমগণ বিশেষভাবে তার মাজহাব তথা হানাফী মাজহাবের উলামায়ে কেরাম তার বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন। [ইমবাউল গুমর, খ.২, পৃ.৯৬]
যেসব উলামায়ে কেরাম ইবনে আবিল ইযের বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন, এদের মাঝে বিখ্যাত কিছু আলেমের নাম উল্লেখ করেছেন ইবনে হাজার আসকালানী রহ.। যেমন, যাইনুদ্দীন ইবনে রজব রহ, তকীউদ্দীন ইবনে মুফলিহ রহ. শরফুদ্দীন ইবনে গাজ্জী রহ. ।
বর্তমানে সালাফীরা ইবনে আবিল ইযের আরেকটি কিতাব প্রকাশ করেছে। কিতাবের নাম হল, আত-তাম্বীহ আলা মুশকিলাতিল হিদায়াহ। সালাফী আলেমরা ইবনে আবিল ইযের রচনা হিসেবে এটি প্রকাশ করেছে। যদিও কিতাবটি ইবনে আবিল ইযের নাকি তার দাদার এটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সালাফীদের বক্তব্য অনুযায়ী কিতাবটি যদি ইবনে আবিল ইযের হয়, তাহলে তার সম্পর্কে হানাফী মাজহাবের আরও কিছু উলামায়ে কেরামের বক্তব্য শুনুন।
ইমাম সাখাবী রহ. তার আজ-জাওউল লামে কিতাবে লিখেছেন, হানাফী মাজহাবের বিখ্যাত ইমাম কাসেম ইবনে কুতলুবুগা ইবনে হেদায়া কিতাবের উপর ইবনুল ইযের অভিযোগ খন্ডন করে কিতাব লিখেছেন। “صنّف “أجوبةً عن اعتراضات ابن العزّ على الهداية”[আজ-জাওউল লামে, খ.৬, পৃ.১৮৭]
সালাফীরা ইবনে আবিল ইযের উক্ত কিতাবকে হেদায়ার ব্যাখ্যা হিসেবে প্রচারের চেষ্টা করলেও এটি মূলত: হেদায়া কিতাবের উপর তার অভিযোগ সংকলন। একারণে আল্লামা কাসেম ইবনে কুতলুবুগা তার অভিযোগ খন্ডন করেছেন। একইভাবে আল-বাহরুর রায়েকে রয়েছে ফাতহুল কাদীরে আল্লামা ইবনুল হুমাম ইবনুল ইযের বক্তব্য খন্ডন করেছেন।
وَقَدْ أَطَالَ فِي فَتْحِ الْقَدِيرِ فِي بَيَانِهِ إطَالَةً حَسَنَةً وَتَعَرَّضَ لِلرَّدِّ عَلَى ابْنِ الْعِزِّ، وَلَسْنَا بِصَدَدِ ذَلِكَ
[আল-বাহরুর রায়েক, বাবুল ইয়ামীন ফিল আকলি ওয়াশ শুরব]
সালাফীদের বক্তব্য অনুযায়ী আত-তাম্বীহ আলা শরহিল হেদায়া কিতাবটি যদি আকিদাতুত ত্বহাবীর ব্যাখ্যাকার ইবনে আবিল ইযের হয়, তাহলে তার বক্তব্য আল্লামা হাসকাফী ও আল্লামা ইবনে আবিদীন খন্ডন করেছেন। তার বক্তব্যকে গরীব (আশ্চর্যজনক) আখ্যা দিয়েছেন। বিস্তারিত,
“قال (ابن العز!): فحينئذ ينقض الوضوء، وهو فرع غريب وتخريج ظاهر.قال المصنف: ولظهوره عوّلنا عليه.قلت: قال شيخنا الرملي حفظه الله تعالى: كيف يعول عليه وهو مع غرابته لا يشهد له رواية ولا دراية، أما الاولى فظاهر إذا لم يرو عن أحد ممن يعتمد عليه، وأما الثانية فلعدم تسليم المقدمة الاولى ويشهد لبطلانها مسألة الجدي إذا غذي بلبن الخنزير فقد عللوا حل أكله بصيرورته مستهلكا لا يبقى له أثر، فكذلك نقول في عرق مدمن الخمر، ويكفينا في ضعفه غرابته”.[রদ্দুল মুহতার, খ.৬, পৃ.১৪৬-১৪৭]
আকিদার ক্ষেত্রে ইবনে আবিল ইযের বিচ্যুতি সুস্পষ্ট। অধিকাংশ বিষয়ে সে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত আকিদা পোষণ করে। এবং কাররামিয়া ও মুজাসসিমাদের ভ্রান্ত বক্তব্য প্রচার করেছে। আকিদাতুত ত্বহাবীর সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা ভিডিও আকারে প্রকাশের নিয়ত রয়েছে। আমাদের আলোচনায় ইবনে আবিল ইযের ভ্রান্ত মতবাদগুলি বিস্তারিত উল্লেখ করা হবে ইনশাআল্লাহ। এখানে সংক্ষেপে দু’একটি বিষয় উল্লেখ করা মুনাসিব মনে করছি। এসকল বিষয়ের কয়েকটি কুফুরী পর্যায়ের। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করেন।
১. কিছু সৃষ্টি কাদীম বা অবিনশ্বর। অনাদী থেকেই বিদ্যমান। এটি তাসালসুলুল হাওয়াদিস নামে পরিচিত। [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.১২৯, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]
২. আল্লাহ তায়ালার হদ বা সীমা রয়েছে। [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.২১৯, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]
৩. আল্লাহর সত্তার মাঝে নশ্বর বিষয় সৃষ্টি হয়। [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.১৭৭, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]
৪. আল্লাহর বক্তব্যের অক্ষর ও শব্দ রয়েছে। [শরহু আকিদাতিত ত্বহাবী, পৃ.১৬৯, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, অষ্টম সংস্করণ]
৫. আল্লাহ তায়ালা স্থানগতভাবে উপরের দিকে রয়েছেন। অর্থাৎ আল্লাহর দিক রয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে দেহবাদী আকিদার ভ্রান্তি থেকে হেফাজত করুন। আমীন।
------ ------
ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের মাঝে সর্বপ্রধান বিষয় হল, আল্লাহর তাওহীদ তথা একত্বের উপর ঈমান আনয়ন করা। এই বিশ্বাস করা যে, সৃষ্টা হিসেবে তিনি একক, গুণাবলীর বিবেচনায় তিনি একক এবং উপাসনার যোগ্য একমাত্র তিনিই। পবিত্র কুরআন ও রাসূল (সঃ) এর সমস্ত হাদীস তাওহীদ তথা আল্লাহর এককত্বের উপর ভিত্তি করেই আবর্তিত। কোন বিষয়ে আল্লাহর সমকক্ষ বা অংশীদার নেই, এটিই এ বিশ্বাসের মূলমন্ত্র। পবিত্র কুরআনের ১১২ নং সূরায় এ বিষয়টি সুষ্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষিত হয়েছে। সে প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর অস্তিত্ব অনুভব করে এবং আল্লাহর এককত্বের স্বাক্ষর প্রদান করে।
আমরা এখানে আল্লাহর এককত্বের উপর পাঁচটি যুক্তি উপস্থাপন করব।
কুরআন স্পষ্টভাষায় জিজ্ঞাসা করেছে, এই মহাবিশ্ব কি এমনিতেই সৃষ্টি হয়েছে? এর উত্তর খুবই সহজ ও স্পষ্ট। কেননা ভৌত পদার্থবিদ্যা এবং সকল দর্শন এবিষয়ে একমত যে, যে বস্তু অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এসেছে, তার অস্তিত্বের পিছে একটি কজ বা কারণ রয়েছে। আর মহাবিশ্ব যেহেতু অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এসেছে এজন্য এর পিছে একটি কারণ বা কজ রয়েছে। মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পিছে একটি সামগ্রিক কজ বা কারণ থাকাটাই যুক্তিযুক্ত। অসীম সংখ্যক কারণ থাকাটা অসম্ভব। কেননা বাস্তবে কখনও অসীম কোন কিছু থেকে আমরা কোন ফলাফল লাভ করি না।
উদাহরণ হিসেবে নীচের দু’টি বিষয় লক্ষ্য করুণ-
১. কোন কক্ষে যদি অসীম সংখ্যক মানুষ থাকে এবং সেখান থেকে যদি আমি দু’জনকে বাদ দেই, তাহলে কতজন থাকবে? আপনি উত্তর দিবেন, অসীম বিয়োগ দুই। অর্থাৎ অসীম থেকে দু’জনকে বাদ দিলে যা থাকে। এর দ্বারা বাস্তবে কোন অর্থ বোঝায় কি? অসীম থেকে যদি দুজনকে বাদ দেয়া হলেও কক্ষে অসীম সংখ্যক মানুষই থেকে যাবে। বাস্তবে এটি বিশেষ কোন অর্থ প্রদান করে না। আপনাকে যদি কক্ষের অসীম সংখ্যক লোক গণনা করতে বলা হয়, আপনার পক্ষে তা গণনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু লোকসংখ্যা যদি অসীম থেকে সামান্য কমিয়ে গণনা করতে বলা হয়, তবুও আপনার পক্ষে তা গণনা করা সম্ভব নয়। এর অর্থ হল, বাস্তব জীবনে অসীম সংখ্যা থেকে বিশেষ অর্থ বোঝা সম্ভব নয়।
২. মনে করুন, আমি একজন সৈনিক। আমি একটা শত্রুকে গুলি করতে চাই। আমার গুলি করার জন্য আমার পেছনের সৈনিকের অনুমতি নেয়া প্রয়োজন। আমার পিছের সৈনিকের জন্য আবার তার পেছনের সৈনিকের অনুমতি প্রয়োজন। এভাবে এ ধারা যদি চলতে থাকে এবং আমার গুলি করার জন্য অসীম সংখ্যক সৈনিকের অনুমতির প্রয়োজন হয়, তবে আমি কি আদৌ শত্রুকে গুলি করতে পারব? উত্তর খুবই সহজ ও স্বাভাবিক। একইভাবে আমি মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পিছে যদি অসীম সংখ্যক কারণ ধরে নেই, তবে আদৌ মহাবিশ্বের অস্তিত্ব সম্ভব হত না। এবং কখনও এটি অস্তিত্বে আসত না। সুতরাং মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পিছে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বাধীন ও একক কারণ থাকাটাই যুক্তিসঙ্গত।
আপনি এ যুক্তি দেখাতে পারেন যে, উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্য তথা স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বাধীন একাধিক কারণ একই সাথে ক্রিয়াশীল হলে সমস্যা কোথায়?
আমি বলব, আপনার এ যুক্তিটা খুবই দুর্বল প্রকৃতির। চতুর্দশ শতাব্দীর দার্শনিক অকহ্যাম রেজর এর তত্ত্বের মাধ্যমে আপনার এ যুক্তির অসারতা প্রমাণিত হয়। অকহ্যাম রেজরের নীতি হল, প্রয়োজন ছাড়া বহু সংখ্যার ব্যবহার অনুচিৎ। আরেকটু সহজ করে বললে এভাবে বলা যায়, সবচেয়ে সরল ও সর্বাধিক অর্থবহ ব্যাখ্যা হল, সর্বোত্তম ব্যাখ্যা।
অতএব, কোন প্রমাণ ছাড়া কিংবা প্রয়োজন ছাড়া আমরা এটা বলতে পারি না যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির পিছে অনেকগুলো কারণ ক্রিয়াশীল। সুতরাং এক্ষেত্রে আমাদেরকে সবচেয়ে অর্থবহ ও সরল কারণ তথা মহাবিশ্ব সৃষ্টির একক কারণকেই গ্রহণ করতে হবে। কেননা এক্ষেত্রে আমাদেরকে কাছে কোন প্রমাণ নেই যে আমরা বলতে পারি, মহাবিশ্বের সৃষ্টি মূলতঃ দুটি, তিনটি, কিংবা কয়েক হাজার কারণের কম্বিনেশন বা সমন্বয়। একাধিক কারণ গ্রহণের দ্বারা একটি স্বাধীন, স্বয়ংসম্পূর্ণ কারণে অতিরিক্ত কোন মাত্রা যোগ হয় না।
যেমন, যখন বলা হল, মহাবিশ্ব একটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কারণের দ্বারা সৃষ্ট, এ কথা দ্বারা যে অর্থ স্পষ্ট হয়েছে, যদি বলা হয়, মহাবিশ্ব দু’টি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কারণের দ্বারা সৃষ্ট, এ কথার দ্বারা অতিরিক্ত কোন অর্থ প্রকাশ পায় না। কেননা আমি যখন বলছি, কারণটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী তখন অন্য কোন সর্বময় ক্ষমতার প্রয়োজন নেই। কারণটি যদি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী না হত, তবে সাহায্যকারী হিসেবে অন্য কোন কারণের প্রয়োজন পড়ত। এক্ষেত্রে কোন কারণই তখন স্বাধীন বা স্বয়ংসম্পূর্ণ কারণ থাকবে না।
সুতরাং মহাবিশ্ব সৃষ্টির পিছে আমাদের মূলতঃ একটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কারণের প্রয়োজন ছিল এবং এটুকুই যথেষ্ট কেননা কারণটি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।
যুক্তির দাবি হল, মহাবিশ্ব সৃষ্টি যদি অনেক প্রভূ থাকত, তবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মাধ্যমে মহাবিশ্ব ধ্বংস হয়েছে। এবং আমরা মহাবিশ্বে যে সুষম শৃঙ্খলা ও নিয়মতান্ত্রিকতার সর্বোচ্চ সমাবেশ লক্ষ্য করে থাকি, অনেক প্রভূ থাকলে তা পরিলক্ষিত হত না।
আপনি যুক্তি দেখাতে পারেন, আপনার গাড়িটি তৈরি করে অনেক মানুষ। যেমন, কেউ গাড়ীর বডি তৈরি করে, কেউ ইঞ্জিন আবার কেউ চাকা। কিন্তু পূর্ণ গাড়িটি তৈরি হলে সেটি একটি সুন্দর ও সুষম গাড়ি হয়ে থাকে। অতএব, একটি সৃষ্ট বস্তুর অনেক স্রষ্টা থাকলেও সেটি ভারসাম্যপূর্ণ হতে পারে।
আপনার এ প্রশ্নের উত্তর হল, মহাবিশ্ব সৃষ্টির পিছে আমরা যে কারণটি উল্লেখ করেছি সেটি হল, এমন একজন প্রভূ যিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং ইচ্ছার ক্ষেত্রে এককভাবে স্বাধীন। কেননা প্রভূ তো তিনিই হবেন, যার অসীম প্রয়োগিক ইচ্ছা রয়েছে। যদি অনেক প্রভূ থাকত, তবে প্রত্যেকের ইচ্ছা প্রয়োগের প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হত, আর এটিই মহাবিশ্বে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণ হতো।
আপনি যুক্তি দেখাতে পারেন, এ সম্ভাবনা রয়েছে যে, অনেকগুলো প্রভূ একটি বিষয়ে একমত পোষণ করতে পারে। অথবা এক একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে তাদের পৃথক পৃথক ক্ষমতা থাকবে। এক্ষেত্রে আমরা বলব, এ ধরণের প্রভূর ইচ্ছা অসীম ও স্বাধীন নয়। ফলে এরা প্রভূ হওয়ার যোগ্য নয়। সার কথা হল, যদি দু’জন স্রষ্টা থাকে, এবং তারা কোন বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে, যেমন একজন ক নামক ব্যক্তিকে স্থির রাখতে চাচ্ছে, আরেকজন তাকে গতিশীল করতে চাচ্ছে। অথবা একজন প্রভূ খ কে জীবন্ত প্রাণি বানাতে চাচ্ছে, আরেকজন চাচ্ছে যে, এটি জড়পদার্থ হিসেবে অবস্থান করবে।
যুক্তির আলোকে যদি বিশ্লেষণ করা হয়, তবে এখানে তিনটি অবস্থার কোন একটি ঘটতে বাধ্য-
১. উভয় প্রভূর ইচ্ছা বহাল রাখা হবে এবং তা বাস্তবায়ন করা হবে।
২. শুধু তাদের একজনের ইচ্ছা বহাল রাখা হবে।
৩. তাদের কারও ইচ্ছায় বাস্তবায়ন করা হবে না।প্রথমটি সম্ভব নয়।
কেননা এক্ষেত্রে দু’টি বিপরীত বিষয় একই সাথে অস্তিত্ব লাভ করা আবশ্যক হবে। যা অসম্ভব। অর্থাৎ একই সাথে একটি বস্তু জীবিত ও মৃত হতে পারে না। তৃতীয় বক্তব্যও বাতিল হয়ে যাবে। কেননা এর দ্বারা এটা আবশ্যক হয় যে, একটি বস্তু গতিশীলও না, আবার স্থিরও না। একইভাবে একটি বস্তু জীবিতও না, আবার মৃত না। আর এটি অসম্ভব। সাথে সাথে তাদের কারও ইচ্ছায় যদি বাস্তবায়ন করা না হয়, তখন তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, তাদের কেউ-ই নিজ ইচ্ছা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম নয়। ফলে প্রত্যেকেই প্রভূ হওয়ার যোগ্যতা হারাবে।
দ্বিতীয় বক্তব্য অনুযায়ী, যদি দু’জনের মধ্য থেকে একজনের ইচ্ছা বাস্তবায়ন করা হয়, এবং অপরজনের ইচ্ছা পরিত্যাগ করা হয়, তবে তিনিই হবেন একক প্রভূ। যার ইচ্ছা পরিত্যাগ করা হয়েছে, সে প্রভূ হওয়ার যোগ্য থাকবে না। উপর্যুক্ত বক্তব্য দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, এই ভারসাম্যপূর্ণ মহাবিশ্বের একজন মাত্র প্রভূ থাকা সম্ভব, যিনি অসীম ইচ্ছার অধিকারী এবং একক ক্ষমতার অধিকারী।
আমরা কিভাবে দু’টি জিনিসকে পরস্পর থেকে পৃথক করে থাকি? দু’জন ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে আমরা তাদের মধ্যে পার্থক্য করি কীভাবে। এর উত্তর হল, আমরা এটা করে থাকি, কনসেপ্চুয়াল ডিফারেনসিয়েশন বা ধারণাগত বৈচিত্রের মাধ্যমে। এই ধারণাগুলো হল, স্থান, পারম্পরিক দূরত্ব, গঠন ও আকার-আকৃতিগত তারতম্য।
আমরা যে কোন দু’টি বস্তুর মাঝে পার্থক্য করতে পারি, তাদের পারস্পরিক দূরত্ব, বর্ণ ও আকার-আকৃতিগত বৈচিত্রের মাধ্যমে। দু’টি বিষয়ের মধ্যে যখন উপরোক্ত বিষয়গুলো না পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে কি আপনি উক্ত বস্তু দু’টির মাঝে কোন পার্থক্য করতে সক্ষম হবেন? আপনি পারবেন না। এবিষয়টি শুধু দু’য়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং অসংখ্য বস্তুর ক্ষেত্রে পার্থক্য নির্ণয় করতে হলে, উপরোক্ত বিষয়গুলো থাকা আবশ্যক।
প্রাসঙ্গিকভাবে বলে নেয়া আবশ্যক যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি মহাবিশ্ব থেকে বহির্গত হওয়া আবশ্যক। কেননা সৃষ্টির কারণ যদি মহাবিশ্বের ভিতরগত কিংবা মহাবিশ্বেরই কোন অংশ হয়, তখন এর অর্থ হয় যে, মহাবিশ্ব নিজেই নিজের স্রষ্টা। আর এটি অসম্ভব। মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ যেহেতু বহির্গত, আপনি সহজেই অনুমান করতে পারবেন যে, আপনি মহাবিশ্বের বহির্গত বিষয়ের মধ্যে অবস্থান, আকার-আকৃতি ও বর্ণগত পার্থক্য করতে পারবেন না। কেননা এ বিষয়গুলো কেবল মহাবিশ্বের অভ্যন্তরে বিশেষ অর্থ প্রদান করে, এর বাইরে নয়। কেননা উপর্যুক্ত বিষয় তথা দূরত্ব, আকার-আকৃতি বা বর্ণ প্রত্যেকটি সৃষ্ট। মহাবিশ্বের বাইরে সৃষ্ট কোন বস্তু নেই। মহাবিশ্বের বাইরে উপর্যুক্ত বিষয়ের অনুপস্থিতির কারণে সৃষ্টির পিছে ক্রিয়াশীল দু’টি কারণের মধ্যে পার্থক্য করাও সম্ভব নয়। এজন্য সৃষ্টির পিছে দু’টি বা অসংখ্য কারণের কথা বলাটাও ভিত্তিহীন, অযৌক্তি ও ধারণাপ্রসূত একটি বক্তব্য মাত্র।
মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি ইউনিক বা অনন্য হওয়া আবশ্যক। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “তাঁর কোন সমকক্ষ নেই”। মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি যদি অনন্য না হয়, তবে এর অর্থ হবে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ ও মহাবিশ্বের মাঝে একটি সিমিলারিটি বা সাদৃশ্য রয়েছে। কেননা এর দ্বারা এটি প্রমাণিত হয় যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি এর মাঝে রয়েছে। যার অর্থ এই দাঁড়াল যে, মহাবিশ্ব নিজেই নিজের স্রষ্টা। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি মহাবিশ্বের সাদৃশ্যপূর্ণ হতে পারবে না কেন? এর উত্তরটি খুবই সহজ। আমরা জানি মহাবিশ্ব অসংখ্য বস্তুর সমষ্টি। সুতরাং মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি অবশ্যই ইম্যাটেরিয়াল বা বস্তুজগতের ঊর্ধ্বে হতে হবে। নতুবা মহাবিশ্ব নিজেই নিজের স্রষ্টা হওয়া আবশ্যক হবে। সুতরাং বস্তু সৃষ্টির কারণটিও যদি বস্তুর মতো হয়, তবে বস্তু নিজেই নিজের স্রষ্টা হওয়া আবশ্যক, যা অসম্ভব। সুতরাং উপসংহারে আপনাকে অবশ্যই বলতে হবে যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণটি অবশ্যই ইম্যাটেরিয়াল ও ইউনিক হতে হবে। আমাদের এ বক্তব্যটি স্রষ্টার এককত্বের প্রমাণ হয় কিভাবে? আমরা বলব, মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ যদি একাধিক হয়, তবে তার কোনটিই ইউনিক বা অনন্য হবে না। ফলে স্রষ্টা একজন হওয়াটাই নির্দিষ্ট।
স্রষ্টার এককত্ব প্রমাণের সবচেয়ে সহজ উপায় হল, আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ঐশীবাণীর শরণাপন্ন হওয়া। এক্ষেত্রে যুক্তি হল, কোন বাণীর ব্যাপারে যদি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয় যে, এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত এবং এটি মানব রচিত নয়, তখন এ গ্রন্থের বক্তব্যের ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকে না। সুতরাং আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ঐশী গ্রন্থে আল্লাহ তায়ালা নিজের সম্পর্কে যে তথ্য প্রদান করবেন সেটি নিশ্চিতভাবে সত্য বলে বিবেচিত হবে।
কেউ যদি আল্লাহ সম্পর্কে অজ্ঞ হয় তবে সে কিভাবে আল্লাহ সম্পর্কে বা তার প্রেরিত কিতাব সম্পর্কে ধারণা অর্জন করবে?
এর দু’টি পদ্ধতি রয়েছে-
১. ইন্টারন্যাল
২. এক্সটারন্যাল
আভ্যন্তরীণভাবে আল্লাহ তায়ালার পরিচয় পাওয়ার অর্থ হল, আপনি আত্মপরীক্ষা বা আত্মদর্শনের মাধ্যমে আল্লাহ সম্পর্কে অবগত হওয়ার চেষ্টা করবেন। অর্থাৎ নিজের আভ্যন্তরীণ শক্তি ব্যবহার করে আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা। আজব ব্যাপার হল, আল্লাহ সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন মানুষের নিজস্ব শক্তির দ্বারা সম্ভব নয়।
এর কিছু মৌলিক কারণ হল,
১. মানুষ সৃষ্টিগতভাবে বৈচিত্রময়। ব্যক্তি বৈচিত্রের এধারাটি মূলতঃ মানুষের মানসিক ভিন্নতারই বহিপ্রকাশ। সাইকোলজিক্যাল ভিন্নতার প্রধান কারণ হল, ডি.এন.এ এর ভিন্নতা, বাস্তব অভিজ্ঞতা, সামাজিক পূর্বসূত্র, বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানার্জনের ক্ষমতা, লিঙ্গের বৈষম্য ইত্যাদি নিয়ামক দ্বারা প্রভাবিত। আত্মদর্শনের মাধ্যমে স্রষ্টা সম্পর্কে ধারণা পেতে এবিষয়গুলো আপনাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে। সুতরাং আপনার আত্মপরীক্ষার মাধ্যমে যে ফলাফল পাওয়া যাবে সেটি অন্যদের থেকে ভিন্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। আপনি নিজেও এই বাস্তবতা উপলব্ধি করবেন যে, উপর্যুক্ত বিষয়ের উপস্থিতিতে আপনি একাকী যদি স্রষ্টা সম্পর্কে ধারণা পেতে চান তবে তা সত্য থেকে অনেক বিচ্যুত হতে পারে। এটি একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ বছর আগে পৃথিবীতে প্রায় ৩৭০০ হাজার দেবতার ধারণা মানুষের মনে জেঁকে বসেছিল।
২. দ্বিতীয় কারণ হল, বাস্তবতার বিবেচনায় মানুষ খুবই সীমাবদ্ধ। এজন্য মানুষ যদি নিজের পক্ষ থেকে স্রষ্টা সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করতে চায়, তবে তা অধিকাংশ সময় ভ্রান্তির কারণ হয়। দার্শনিকগণ ¯্রষ্টার অস্তিত্বের ব্যাপারে কিছু যুক্তিসঙ্গত দার্শনিক তত্ত্ব উপস্থাপন করে থাকেন। তবে তারা স্বতঃসিদ্ধ ও বাস্তব কোন তথ্য দিতে অক্ষম। প্রকৃতপক্ষে যদি আপনি স্রষ্টা সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা অর্জন করতে চান, তবে তা হবে ইঁদুরের পক্ষে হাতির শক্তিমত্তা সম্পর্কে ধারণা অর্জনের মতো হাস্যকর। এজন্য শুধু যুক্তি বা ধারণার উপর ভিত্তি করে স্রষ্টা সম্পর্কে কিছু বলা তার সম্পর্কে মিথ্যাচারের নামান্তর। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, “তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে যা জান না, তা বলো কেন?” সুতরাং আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে আমরা যদি জ্ঞান অর্জন করতে চাই তবে তা অবশ্যই এক্সটারন্যাল বা বহির্গত কোন মাধ্যমে হতে হবে। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা ঐশীবাণীর মাধ্যমে আমাদেরকে যা জানিয়েছেন, সেটিই হবে বিশুদ্ধ জ্ঞান।
আর পবিত্র কুরআন থেকে আমরা একথা সুনিশ্চিতভাবে জানি যে, আল্লাহ তায়ালা হলেন এক ও অদ্বিতীয়। তার সমকক্ষ কেউ নেই। সুতরাং তার এককত্বের ব্যাপারে আর কোন সন্দেহ থাকে না।
------ ------
© COPYRIGHT 2021 - Hasbi Academy - We Love Our Students