ইতিহাস

আল হাকিম বি আমরিল্লাহ - এক খ্যাপাটে শাসকের ইতিবৃত্ত

ইমরান রাইহান শুক্র, 26 এপ্রি., 2024

৩৮৬ হিজরিতে উবাইদি শাসক আল আযিযের মৃত্যুর পর ক্ষমতায় বসানো হয় তার ১১ বছর বয়সী নাবালেগ পুত্র আল হাকিমকে। একটি বিস্তৃত সাম্রাজ্য চালানর মত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা কিছুই ছিল না তার, কিন্তু সমর্থকরা তাকে অভিহিত করে ‘ইমামে মাসুম’ বা নিষ্পাপ ইমাম নামে, ফলে তার ক্ষমতার বৈধতা পেয়ে যায় খুব সহজে।

বাল্যকাল থেকেই রগচটা স্বভাবের অধিকারী আল হাকিম ক্ষমতার স্বাদ পেতেই উম্মাদ হয়ে উঠলো। জারি করলো একের পর এক বিচিত্র ফরমান, সামান্য বিরোধিতাকেও দমন করা হল মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে। উবাইদিদের স্বভাবে ছিল খুন-লুন্ঠন ও দমননীতি। আল হাকিমের মধ্যেও এসব স্বভাব ছিল উত্তরাধিকার সূত্রেই, সাথে যোগ হল রগচটা স্বভাবের উন্মাদনা। খুনখারাপি ও পাগলামিতে সে নিজের পূর্বসুরীদেরকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। উবাইদি উজিররা বংশপ্রীতির কারণে শুরু থেকে তাকে সমর্থন দিলেও পরবর্তীতে তারা নিজেরাই হয় আল হাকিমের আক্রোশের শিকার।

ইতিহাসে আল হাকিম কুখ্যাত হয়ে আছে তার বিচিত্র সব ফরমানের কারণে। ফরমান জারি করার ক্ষেত্রে তার কোনো ক্লান্তি ছিল না। তবে খুব কমই সে নিজের সিদ্ধান্তে স্থির থাকতো, সাধারণত কোনো ফরমান জারি করার কিছুদিনের মধ্যেই তার মন ঘুরে যেত, জারি করা হত বিপরীতমুখি নতুন ফরমান। এসব ফরমানের কিছু ছিল হাস্যকর, কিছু ভালো, কিছু আবার অতিরিক্ত কঠোরতা। ফরমানের মান যাই হোক তার সামান্যতম বিরোধিতাও সহ্য করা হত না। বিরোধিতাকারিদের দমন করা হত অদ্ভুত নৃশংসতায়।

৩৯৫ হিজরিতে আল হাকিম আদেশ দেয় প্রকাশ্যে সাহাবায়ে কেরামকে গালি দিতে হবে। তার আদেশে মসজিদের দেয়ালে, দালানকোঠার সামনে এবং বাজারের উন্মুক্ত চত্বরে সাহাবায়ে কেরামের নামে গালি লিখে লটকে দেয়া হয়। মসজিদের মিম্বরে প্রকাশ্যে সাহাবায়ে কেরামকে গালি দেয়া হয়। বলা হয়, প্রথম তিন খলিফা অন্যায়ভাবে আলি (রা) এর ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিলেন। পরে একই কাজ করেছিলেন মুয়াবিয়া (রা)। আহলুস সুন্নাহর অনুসারীদের মনে জন্ম নেয় তীব্র ক্ষোভ, প্রকাশ্যে প্রতিবাদ জানান অনেকে। আল হাকিমের আদেশে গ্রেফতার করা হয় তাদেরকে, সবাইকে দেয়া হয় মৃত্যুদণ্ড। হত্যার সময় সরকারি জল্লাদ উল্লাস করে বলতো, আবু বকর ও উমরের অনুসারীদের শাস্তি এমনি হবে। তবে আহলুস সুন্নাহর অনুসারীরা এতে দমলেন না, তারা অব্যাহত রাখলেন প্রতিবাদ। দুবছর পর আল হাকিম নিজ থেকেই প্রত্যাহার করে নিলেন এই আদেশ। তবে পরের লোকদের জন্য তিনি পথ খুলে দিলেন। যেখানেই শিয়ারা সামান্য শক্তি অর্জন করতে পেরেছিল সেখানেই তারা সাহাবিদের গালি দেয়ার বর্বর প্রথা চালু করেছিল। সাফাবী সাম্রাজ্য ও আধুনিক ইরানের শিয়া বিপ্লব একথার জ্বলন্ত সাক্ষী। (আর রওযাতাইন, ২/২১৪)

৩৯৮ হিজরিতে উবাইদিদের বিখ্যাত সেনাপতি হুসাইন বিন জওহারকে অপসারণ করা হয়। কিছুদিন পর তাকে আবার দায়িত্ব ফিরিয়ে দেয়া হয়। তবে দ্রুতই আল হাকিম মত বদলে হুসাইনকে বন্দি করার নির্দেশ দেন। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে হুসাইন পালিয়ে যান। বছরখানেক তিনি পালিয়ে বেড়ান। তাকে ধরার জন্য আল হাকিম সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। হুসাইন ক্ষমার আশায় আল হাকিমের সাথে দেখা করতে এলে তাকে হত্যা করা হয়। তার সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয় তবে তার সন্তানদের ক্ষমা করা হয়। কিছুদিন পর আল হাকিম আদেশ দেয় হুসাইনের সন্তানদের হত্যা করতে হবে। হুসাইনের তিন সন্তান পালিয়ে এন্টিয়ক চলে যায়, সেখান থেকে তাদের ধরে এনে হত্যা করা হয়। (তারিখুল আন্তাকি, ১৯৯)

৩৯৫ হিজরিতে আল হাকিম এক ফরমানের মাধ্যমে কুকুর হত্যার আদেশ দেয়। এই ফরমানের কারণে রাজ্যের যেখানেই কুকুর দেখা যেত হত্যা করা হত। এ সময় বেশ কিছু প্রকারের মাছ নিষিদ্ধ করা হয়। প্রকাশ্যে মাছবাজার থেকে কয়েকজন জেলেকে ধরে এনে হত্যা করা হয়। শহরে ছড়িয়ে পড়ে তীব্র আতংক। একই সময় যবের তৈরী মদ ব্যতীত অন্য সকল মদ নিষিদ্ধ করা হয়। অদ্ভুতভাবে নিষিদ্ধ করা হয় মধু, এমনকি রাজ্যের বিভিন্ন স্থান থেকে খুঁজে খুঁজে প্রায় ৫ হাজার গ্যালন মধু নদিতে ফেলে দেয়া হয়। খেজুর ও আঙ্গুরের ব্যবসা নিষিদ্ধ করা হয়, বাগানে দেয়া হয় আগুন। নিমিষে পুড়ে যায় শত শত আঙ্গুর ও খেজুরের বাগান। চোখের সামনে স্বপ্ন ভস্ম হতে দেখেও জনসাধারণ নীরব থাকে, কারণ আল হাকিমের বিরোধিতা করার পরিণতি সবার সামনেই ছিল।

৩৯৯ হিজরিতে রাজপ্রাসাদের চাকর ও কর্মচারিদের বড় অংশকে কোনো কারণ ছাড়াই বন্দি করা হয়। কয়েকদিন পর আল হাকিম আদেশ দেন তাদের হাত পা বিপরিত দিক থেকে কেটে ফেলতে। দ্রুততার সাথে পালন করা হয় তার এ আদেশ। কেউ বলতে পারেনি এই নিহতদের কী দোষ ছিল, আল হাকিমকে জিজ্ঞেস করবে সেই সাহসও ছিল না কারো। ৪০০ হিজরিতে বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রচুর সুন্নি আলেমকে ধরে এনে হত্যা করা হয়। এই হত্যার মূল কারণ ছিল সুন্নিদের প্রতি উবাইদিদের মজ্জাগত বিদ্বেষ। (আস সুলুক, ৪/৮৮)

একই বছর আল হাকিম নিজেকে বিদ্যানুরাগী প্রমাণ করতে কায়রোতে আল জামিউল হাকিমি নামে একটি মসজিদ নির্মান করে। সেখানে দারুল ইলম নামে একটি শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেখানে ডেকে আনা হয় রাজ্যের বরেণ্য ফকিহ ও মুহাদ্দিসদের। শুরু হয় নিয়মতান্ত্রিক দরস। সবার মনে হচ্ছিল আল হাকিম হয়তো এতদিনে কিছুটা হেদায়াতের পথে ফিরে এসেছে। কিন্তু বছরখানের মধ্যে সে এই শিক্ষালয় বন্ধ করে দেয়। হত্যা করা হয় সেখানকার সকল শিক্ষক ছাত্রকে।

গিন নামে একজন সিসিলিয়ান ক্রীতদাসের সাথে আল হাকিম যা করেছিল তা রীতিমত অবিশ্বাস্য। গিন ছিল আল হাকিমের অত্যন্ত প্রিয় একজন ক্রীতদাস। আল হাকিমের সাথে গিনের সুসম্পর্কের কারণে অন্য ক্রীতদাসদের কাছে সে ছিল ঈর্ষার পাত্র। সুসম্পর্কের কারণেই আল হাকিম ৪০২ হিজরিতে তাকে পুলিশ প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়। এ সময় তাকে নানা ভারিক্কি উপাধিও দেয়া হয়। কিন্তু কয়েকদিন পর বিনাকারনে গিনের এক হাত কেটে ফেলার আদেশ দেয়া হয়। কিছুদিন পর তার অপর হাতও কেটে ফেলা হয়। হাত কাটার পর আল হাকিম তাকে অনেক মূল্যবান উপহার দেয়। তার চিকিৎসার জন্য নিয়োগ দেয়া হয় রাজ্যের সেরা চিকিৎসকদের। সবাই ভেবেছিল এবার বোধহয় সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। কিন্তু পাগলামি যার রক্তেমাংসে সে এত সহজে থামবে কী করে। কয়েকদিন পর আল হাকিম আদেশ দিল গিনের জিহ্বা কেটে ফেলতে। জিহ্বা কাটার পর গিন অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং কয়েকদিন পর মারা যায়। (আন নুজুমুয জাহিরা, ৪/২২৩)

৪০১ হিজরিতে আল হাকিম তারাবি নামাজ আদায় নিষিদ্ধ করে দেয়। তারাবি পরার অপরাধে বেশ কয়েকজন আলেমকে হত্যা করা হয়। পুরো মিসর ও সিরিয়ার বেশকিছু এলাকায় তারাবি আদায় বন্ধ হয়ে যায়। আবুল হাসান ইবনে দাক্কাক সাহস করে পুরো মাস তারাবি পড়েন। তাকে ধরে এনে হত্যা করা হয়। টানা দশ বছর এই নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকে। এ সময় আহলুস সুন্নাহর অনুসারীরা নিজেদের ঘরে তারাবি আদায় করতেন। তবে পুরো কাজটি করতে হত গোপনীয়তা বজায় রেখে। আল হাকিমের গোয়েন্দারা তারাবি আদায় করার সংবাদ পেলে তাদের ধরে এনে হত্যা করত। দশ বছর পর ৪১১ হিজরিতে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়া হয়। অবশ্য পরে উবাইদি শাসকদের অনেকে এই নিষেধাজ্ঞা চালু করেছিল বিভিন্ন সময়ে। (ইত্তিআজুল হুনাফা, ২/৭৮)

৪০৩ হিজরিতে আল হাকিম আদেশ দেয় ইহুদিরা বাধ্যতামূলকভাবে কালো পাগড়ি পরিধান করতে হবে, এবং খ্রিস্টানরা গলায় ক্রুশ ঝুলাতে হবে। এ সময় জ্যোতিষীদেরকেও রাজ্য থেকে বিতাড়ন করা হয় যদিও ইতিপূর্বে তাদের প্রতি আল হাকিমের বেশ অনুরাগ ছিল। আল হাকিমের আদেশে মিসরের গির্জাগুলো ভেঙ্গে ফেলা হয়, এমনকি খ্রিস্টানদের জোরপূর্বক মুসলমান বানানোর চেষ্টা করা হয়। প্রাণভয়ে অনেক খ্রিস্টান ইসলাম গ্রহণ করে। যদি তাদের ইসলাম ছিল উবাইদিদের শিয়া ইসলাম। এ সময় বাইতুল মুকাদ্দাসে অবস্থিত খ্রিস্টানদের বড় একটি গির্জাও ভেঙ্গে ফেলা হয়। কিন্তু বছর দুয়েকের মধ্যেই তার মত বদলে যায়, সে গির্জাগুলো আবার নির্মানের আদেশ দেয়, এমনকি জোরপূর্বক মুসলমান হওয়া খ্রিস্টানদের আদেশ দেয় তাদের পূর্বের ধর্মে ফিরে যেতে।

একবার সে মালেকি মাজহাবের দুজন ফকিহকে ডেকে আনে। কিছুদিন নিজের মসজিদে তাদেরকে দরসদানে নিয়োগ দেয়। কিন্তু আচমকা মত বদলে তাদের দুজনকেই সে হত্যা করে। একবার মেয়েদের ঘর থেকে বের হওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আল হাকিম। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করায় বেশ কজন যুবতি ও বৃদ্ধা মহিলাকে সাগরে ডুবিয়ে মারা হয়। সাত বছর এই আদেশ বহাল থাকে। এ সময় মহিলারা স্বাধীনভাবে বাইরে বের হওয়ার সুযোগ পায়নি। সাত বছর পর এই আদেশ বাতিল করা হয়। আল হাকিমের সবগুলো আদেশই হত মনগড়া উদ্ভট। কখনওই সে কারো পরামর্শ বা মতামতের তোয়াক্কা করত না। কেন এমন আদেশ দিচ্ছে সে ব্যাখ্যা দেয়ারও প্রয়োজন মনে করতো না।  (আখবারু বনি উবাইদ, ১০২)

আল হাকিম টানা সাত বছর গোসল করেনি। টানা দুবছর দিন রাত সবসময় মোমবাতি জ্বালিয়ে রেখেছিল। এরপর বছর খানেক সবসময় অন্ধকারের মাঝে অবস্থান করত। রাত নামলে প্রদীপ জ্বালাতে নিষেধ করতো সেবকদের।

৪০৫ হিজরিতে আল হাকিমের আদেশে বিনা কারণে হত্যা করা হয় উবাইদি সাম্রাজ্যের অনেক গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তিবর্গকে। নিহতদের মধ্যে ছিলেন কাজিউল কুজাত মালিক বিন সাইদ ফারুকি, উজির হুসাইন বিন তাহির, কাতিব আব্দুর রহীম বিন আবু সাইদ। প্রফেসর আবদুল্লাহ ইনানের মতে আল হাকিম কোনো কারণ ছাড়া অন্তত ১৮ হাজার মানুষকে হত্যা করেছিলেন। (আল হাকিম বি আমরিল্লাহ ওয়া আসরারুদ দাওয়াতিল ফাতিমিয়্যা, ৫৮)

জীবনের শেষদিকে আল হাকিম জাদুবিদ্যার দিকে ঝুঁকে পড়ে। একটি নির্জন গুহায় বসে সে সাধনা চালিয়ে যেত। সে কখনো ঘোড়ায় চড়ত না। একটি গাধায় চড়ে রাজপ্রাসাদ থেকে নির্ধারিত সেই গুহার দিকে যেত। তার সাথে থাকতো মাসউদ নামে কৃষ্ণাঙ্গ এক ক্রীতদাস। পথে কোনো কারণে কারো উপর আল হাকিম বিরক্ত হলে মাসউদকে আদেশ দিত উন্মুক্ত বাজারে সেই ব্যক্তিকে ধর্ষন করতে। সেই ব্যক্তি পুরুষ হোক বা মহিলা আল হাকিমের আদেশের কোনো ব্যত্যয় ঘটতো না। যে ব্যক্তি এই ধর্ষনের শিকার হত পরে সমাজে মুখ দেখানো তার জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ত। অনেকে এই অপমানের কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

মাথায় নিত্য নতুন খেয়াল আসতো আল হাকিমের। একবার সে নিজেকে খোদা বলে দাবি করে। ঘটনাটি ঘটে ৪০৮ হিজরিতে যখন মুহাম্মদ বিন ইসমাইল নামে দ্রুজি মতবাদের একজন প্রচারক মিসর আসে। তার সাথে সাক্ষাত ও আলাপের পর আল হাকিমের মনে নিজেকে স্রষ্টা দাবি করার বাসনা জেগে উঠে। প্রাথমিকভাবে সে এই দাবি করে ফেলে, কিন্তু পরে তার সভাসদরা তাকে নিষেধ করে। সবার আশংকা ছিল এর ফলে জনসাধারণের মনে তীব্র ক্ষোভ জেগে উঠবে যা সামাল দেয়া যাবে না। সভাসদদের পরামর্শে আল হাকিম দাবি থেকে নিবৃত্ত হয় এবং মুহাম্মদ বিন ইসমাইলকে হত্যা করে।

রগচটা স্বভাবের আল হাকিমের কাজকর্মের কোনো ব্যখ্যা ছিল না। সামান্য কারণে কারো উপর খুশি হয়ে দান করে রাজকোষ খালি করে ফেলত, পরক্ষনে আবার একই ব্যক্তিকে বিনা কারণে হত্যা করতেও দ্বিধা করত না। তার শাসনামলে শিয়া বা সুন্নি কেউই কখনো স্বস্তিতে ঘুমাতে পারেনি। যারা আল হাকিমের কাছের মানুষ ছিল তাদের আতংক ছিল আর বেশি, কখন কাকে হত্যা করা হবে তার কোন নিশ্চয়তা ছিল না। একবার আল হাকিম বিনা কারণে তার সেনাদের কায়রোর একটি মহল্লা লুট করার আদেশ দেয়। সেনারা সেই মহল্লা আক্রমণ করে সবার ঘরবাড়ি লুট করে পুরো মহল্লায় আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে আল হাকিম এক ব্যক্তিকে সেখানে পাঠায় পরিস্থিতি দেখে আসার জন্য। সে ব্যক্তি এসে বলে পুরো মহল্লা ধ্বংস হয়ে গেছে। যদি রোমানরা আক্রমণ করতো তাহলে তারা এত ক্ষতি করতে পারতো না, এখন যা হয়েছে। এই কথা শুনে আল হাকিম খেপে যায়। তক্ষুনি ওই ব্যক্তিকে হত্যার আদেশ দেয়। (আল ইবার ফি খবারি মান গবার, ২/১৯৬)

আল হাকিমের উপর মানুষ ক্ষিপ্ত ছিল। আবু রাকওয়া নামে একজন বিখ্যাত আলেম তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসেন। আল হাকিম কৌশলে এই বিদ্রোহ দমন করে এবং তাকে হত্যা করে। আবু রাকওয়ার মাথা কেটে কায়রোর অলিগলিতে প্রদর্শন করা হয়। এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হলে জনসাধারণ হতাশ হয়ে যায়। বাহ্যত মনে হচ্ছিল আল হাকিমের পতন ঘটানোর কেউ নেই। কিন্তু আল্লাহর ফায়সালা ছিল ভিন্ন। আল হাকিমের পতন হল সম্পূর্ন অপ্রত্যাশিত স্থান থেকে।

আল হাকিমের নৃশংসতা ও নির্যাতনে শুধু বাইরের মানুষই ক্ষিপ্ত ছিল না, তার বোন সিত্তুল মূলকও ছিল ভাইয়ের উপর ক্ষ্যাপা। আল হাকিমের একজন সেনাপতি ইবনে দাওয়াসের সাথে সিত্তুল মুলকের যোগাযোগ গড়ে উঠে। সিত্তুল মুলক এই সেনাপতিকে উচ্চপদের লোভ দেখিয়ে আল হাকিমকে হত্যা করার নির্দেশ দেয়। আল হাকিমের অভ্যাস ছিল মাঝে মাঝে সে গাধায় চড়ে একটি নির্জন স্থানে যেত। ৪১১ হিজরিতে একদিন সে ওই স্থানে যাওয়ার পথে পথে তাকে হত্যা করা হয়। হত্যার পর লাশ লুকিয়ে ফেলা হয়, ফলে কয়েকদিন তার মৃত্যুর সংবাদ জানা যায়নি। শুরুর দিকে সবার ধারনা ছিল আল হাকিম তার সেই নির্জন স্থানে অবস্থান করছে, কিন্তু কয়েকদিন পার হলে সবাই বুঝতে পারে আল হাকিম আর ফিরে আসার আশা নেই।

এভাবেই শেষ হল আল হাকিমের ২৫ বছরের দুঃশাসন। তার শাসনকালের পুরোটাই ছিল বর্বরতা ও নৃশংসতায় পূর্ন। তার মাঝে কোনো কল্যাণ ছিল না। ইমাম যাহাবী তার শাসনকালকে মূল্যায়ন করেছেন এভাবে, সে ছিল নিজের যুগের নিকৃষ্ট শয়তান ও ফেরাউন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, ১৫/১৭৪) 

------ ------